রথধ্বনি ওই শোনা যায়

0
691

রথযাত্রা নিয়ে দেশের শীর্ষ আদালতের রায়কে উৎকলবাসীর সমবেত প্রয়াস অবশেষে বদল করে দিতে পারল।

করোনা আবহে প্রভু জগন্নাথের রথযাত্রা সম্ভব নয়, শীর্ষ আদালতের এমন পর্যবেক্ষণ কে সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বলে কটাক্ষ করেছিলেন ধর্মগুরু পুরীর শংকরাচার্য্য স্বামী নিশ্চলানন্দ সরস্বতী। প্রভু জগন্নাথের রথযাত্রা নিয়ে কয়েক হাজার বছরের ঐতিহ্যের অবমাননা উড়িষার সাধারণ জনগণ ভালোভাবে নেন নি। ক্ষোভে ফেটে পড়ার নানা খবর আমরা পাচ্ছিলাম।

উৎকল নরেশ গজপতি দিব্য সিংহ দেব, মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কের কাছে অনুরোধ করেন আদালতের শরণাপন্ন হয়ে রায়ের পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করতে। বিজেপি নেতা সম্বিত পাত্র যখন সমগ্র উৎকলবাসীর হয়ে প্রভু জগন্নাথের প্রতি তাদের আবেগ ও ভালোবাসার কথা আদালতে উগড়ে দিচ্ছিলেন- এমন সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পরেই নিশ্চিত হয়েছিলাম আদালত রায়ের পরিবর্তন ঘটাবেন। সমবেতভাবে শক্তির জয় চিরদিন; উৎকলবাসী আরো একবার তার প্রমাণ দিল।

১৯৪৭ সালের এক রথযাত্রার দিনই পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটির জন্ম হয়েছিল, এক তীব্র মরণপণ সংগ্রাম ও রক্তস্নানের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানের করাল গ্রাস থেকে বাঙ্গালিকে উদ্ধার করার জন্য সেদিনও বাংলার রাজন্যবর্গ, ভিন্নমতধারী রাজনৈতিক নেতৃত্ব, ঐতিহাসিক, বিজ্ঞানী, চিন্তাবিদ- সকলে একমত হয়ে বাঙ্গালীকে আত্মসম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার একটি উপায় খুঁজে বের করেছিলেন। আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল বাংলার পশ্চিম অংশে বাঙ্গালীর জন্য এক স্বতন্ত্র ভূমির। সমগ্র চিন্তার উৎস ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ৪৬ এ কলকাতার দাঙ্গা, নোয়াখালীর বীভৎস গণহত্যা বাঙ্গালীকে বুঝিয়ে দিতে পেরেছিল “মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম” এর অসাড়তা। সেই সময় থেকে আজও ভিটে মাটি উচ্ছেদ হয়ে লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালী যে চরম নির্যাতন ও অত্যাচারিত হয়ে ওপার বাঙলা থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসছেন- এই অনুমান শ্যামাপ্রসাদের আগেই হয়েছিল। তাঁর সফল দৌত্যে সেদিনের বাংলার প্রবুদ্ধজন যদি বাঙ্গালীর জন্য একটি আলাদা প্রদেশের দাবি না রাখত, তবে শুধুমাত্র কয়েক কোটি বাঙ্গালীই হারিয়ে যেত না, বরং ভারতবর্ষ থেকে চিরতরে মুছে যেত কয়েক হাজার বছরের একটি প্রাচীন সংস্কৃতি।

সে সময় শ্যামাপ্রসাদের জনপ্রিয়তা এতটাই ছিল যে তিনি চাইলেই সেদিন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হতে পারতেন। কিন্তু, তিনি তো শ্রীকৃষ্ণের মতো। রাজা তৈরি করতে এসেছেন, রাজা হতে নয়। ২০শে জুন বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভায় ধর্মের ভিত্তিতেই অর্থাৎ হিন্দুদের জন্য ৫৮-২১ ভোটে বাংলার পশ্চিমভাগ বাঙ্গালীর নিজস্ব বাসভূমির স্বপক্ষে আইন অনুমোদিত হয়। ৩রা জুলাই প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে একাদশ মন্ত্রীসভা শপথ নেন। স্বাধীনতার পর পাঁচ মাস তিনিই পদ সামলেছেন(সেই সময়ও পশ্চিমবঙ্গের প্রধানমন্ত্রী নামেই অভিহিত হতেন, ১৯৫০ সালে এর পরিবর্তন হয়ে মুখ্যমন্ত্রী শব্দটি চালু হয়)। এরপর বিধান রায় দায়িত্ব নেওয়ার পর বাঙ্গলার জন্য যত বৃহৎ প্রকল্প এসেছে, সবকিছুতেই শ্যমাপ্রসাদের ভূমিকা ছিল অপরিহার্য্য।

শ্যামাপ্রসাদের এই উদ্যাগ সেদিন মোটেই ভালোভাবে নেয় নি জিন্নাসহ সমগ্র বিভেদপন্থীরা। কোলকাতা সহ সমগ্র বাঙ্গলা তারা পাবে না, লীগপন্থী নেতাদের তা ছিল স্বপ্নের অতীত। চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখে নি। শরৎ বসু, কিরণশংকর রায়েদের সামনে এনে সুরাবর্দি যুক্ত বাংলার গল্প ফেদেঁছিল। কিন্তু, বাংলার বিদ্বজ্জন, প্রবুদ্ধসমাজ তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে।

স্বাধীন ভারতে শ্যামাপ্রসাদের ব্যক্তিত্বের ধারে কাছেও আসতে পারতেন না নেহেরু ও তার বশংবদরা। বলতে দ্বিধা নেই এই আক্রোশ থেকেই শ্যামাপ্রসাদকে কার্যতঃ হত্যা করা হয়।

ওপার বাঙলা থেকে শুধুমাত্র ভিটে মাটি উচ্ছেদ হয়েই নয়, বরং নিদারূণ অত্যাচার ও যন্ত্রণার সম্মুখীন হয়ে কয়েক দশক ধরে যে লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালী পশ্চিমবঙ্গে চলে এল, সেই অবর্ণনীয় হত্যা, নারী ও শিশুদের প্রতি অত্যাচার ধর্ষণের করূণ কাহিনী কোনো এক অদ্ভূত রহস্যে পরর্রতী সময়ে সৃষ্টিশীল বাঙ্গালীর কলমে ফুটে উঠল না। বাঙ্গালীর প্রিয় নাটকের উপাদান হল ভিয়েতনাম থেকে কিউবার গণ অভ্যুত্থান। বলিভিয়ার জংগলে চে গুয়েভরার বিপ্লবের গল্প মুখে মুখে ঘুরে বেড়াতে লাগল তরূণ প্রজন্মের কাছে। ঘরের দেওয়ালে বাঘা যতীন, সূর্য সেনের বদলে ছবি ঝুলতে লাগল লেনিন, স্টালিন, ফিদেল কাস্ত্রোর।

আস্তে আস্তে বদলে যেতে থাকে বাংলার চালচিত্র। পাঠ্যবই থেকে মুছে ফেলা হয় বাঙ্গালীর অতীত গৌরব, বাঙ্গালীর ইতিহাস। পাল সাম্রাজ্য়, হর্ষবর্ধন, মহারাজা শশাঙ্ক বা মগ ও মোগলদের বিরুদ্ধে বীর প্রতাপাদিত্যের বিজয়গাথার বদলে ইতিহাসের পাতায় স্থান পেল তিতুমীর। পাতায় পাতায় স্বাধীনতার ইতিহাস ভুলিয়ে মোগল রাজাদের জয় জয়কার। অষ্টাদশ শতকে যে বাংলার শত শত কবি সাহিত্যিকের কলম গোটা দেশকে জাতীয়তাবাদের স্বপ্নে বিভোর করতে পেরেছিল, সেই বাংলাই সমস্ত অতীত ঐতিহ্য ভুলে অন্ততঃ পঞ্চাশ বছর মিথ্যে মায়ায় ভুলে রইল। শুধুমাত্র সাহিত্য সংস্কৃতিই নয়- শিল্প বাণিজ্য সবকিছুতেই পশ্চিমবঙ্গের নিদারুণ অধঃপতন।

অবস্থার পরিবর্তন আর অপ্রকাশ্যে নয়, বরং বেশি মাত্রায় প্রকাশ্য। আমরা দেখতে পাচ্ছি পাঠ্য বই এ অপ্রয়োজনে উর্দু ও আরবী শব্দের রমরমা। সংবিধানের ত্রি ভাষা সূত্র অগ্রাহ্য করে কলকাতার রাস্তায় অসংখ্য হোর্ডিং, পুলিশের বিভিন্ন নির্দেশিকা, চাকরির আবেদন, রাস্তার নেমপ্লেট সব উর্দুতে। উত্তর দিনাজপুরের দাড়িভিটে এক অখ্যাত স্কুলে একজন ছাত্রও উর্দুভাষী না হলেও উর্দু শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে ছাত্র পুলিশের ধুন্ধুমার। দুই ছাত্রের মৃত্যু। সব চেয়ে ভয়ঙ্কর পুলিশের গুলিতে আহত ছাত্রদের ইসলামপুর হাসপাতালে নিয়ে যাবার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল পার্শ্ববর্তী গ্রামের কয়েকশ মুসলিম জনতা । পুলিশ প্রশাসন নির্বিকার। বিগত কয়েক বছরে বসিরহাট, কালিয়াচক, ধূলাগড়, দেগঙ্গা, টিকিয়াপাড়া এমন কি খোদ কলকাতার রাস্তায় যেভাবে প্রকাশ্যে জেহাদিদের আক্রমণ ও হুমকির শিকারা হয়েছে বাঙ্গালী তা কিসের ইঙ্গিত?

দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ করে আসা লক্ষ লক্ষ মুসলিম জবরদখল করে বসতি স্থাপন করেছে। তাদের নাগরিক অধিকার, জীবন ও সুরক্ষার অধিকার দেওয়ার জন্য সচেষ্ট একশ্রেণীর রাজনীতিবিদরা। এর প্রমাণ মিলল বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা সংখ্যালঘু মানুষদের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের আনা নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন।  সংসদের দুটি কক্ষে পূর্ণ সহমতে আইন পাশ হলেও দিনের পর দিন আইন বাতিলের দাবিতে কোলকাতায় এবং রাজ্যের বিভিন্ন অংশে যে ভয়াবহ ধ্বংসলীলা বাঙ্গালী প্রত্যক্ষ করল, এর বিরুদ্ধে আজ সজাগ হওয়ার সময় এসেছে।

কোলকাতা সহ সমগ্র বাংলাকে না পাওয়ার ব্যথা মুসলিম শাসকেরা ভুলতে পারে নি। দীর্ঘ সত্তর বছর ধরে আরব সাম্রায্যবাদ এক এক করে ঘুঁটি সাজিয়েছে। বাংলাকে যদি কোনোভাবে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায়, তবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে সমগ্র উত্তরপূর্বাঞ্চল। ভারতের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করাই হয়ে উঠবে দুরূহ। দীর্ঘ সত্তর বছর ধরে ধর্মনিরপেক্ষতার অসাড় তত্ত্বে ক্লীব বাঙ্গালী আজ ক্লান্ত। তাদের দীর্ঘদিনের শীতঘুম ভাঙ্গছে। ঋতু পরিবর্তনের আহ্বান। শোনা যাচ্ছে বসন্তের কোকিলের ডাক। নতুন প্রভাতের অপেক্ষায় আপামর বাঙ্গালী। যে বিজয় রথ তিয়াত্তর বছর আগে সজ্জিত হয়ছিল, সময় এসেছে তার বিজয় যাত্রার।

শাস্ত্রে বলেছে, “কালহ পচতি ভূতানি কালহ সংহারতে প্রজা। কালহ সুপ্তেষু জাগর্তি কালও হি দুরতিক্রম ।।” অর্থাত মহাকাল ই জীবের নিয়ন্ত্রক, মহাকাল ই জীবের সংহার কর্তা। যখন সবাই ঘুমিয়ে থাকে, তখনও কাল জেগে থেকে। কাল অলঙ্ঘণীয়। সেই মহাকালের নিদান, সময় অপেক্ষমাণ । গত কয়েকবছরের চেষ্টায়, আবার শুরু হয়েছে প্রতাপাদিত্য উৎসব। আরব ও বামপন্থীদের সাজানো ইতিহাস  ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বঙ্গাব্দের স্রষ্টা আকবর নয়, মহারাজা শশাঙ্ক- নববর্ষ উদযাপনের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালী আবার তার উত্তরাধিকার ফিরে পেয়েছে। গত রবিবার ২০শে জুন পশ্চিমবঙ্গের আত্মপ্রকাশের দিন যে ভাবে বিভিন্ন গণমাধ্যম, সাংস্কৃতিক সংগঠন সাড়ম্বরে তা পালন করা শুরু করল, তা মহাকালের আগমন বার্তাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।

সমাজের সর্বস্তরের মানুষের আপ্রাণ চেষ্টায় ওড়িশা যেভাবে শীর্ষ আদালতের রায় বদল করিয়ে দিতে পারল, সর্বস্তরের বাঙ্গালীর সেই জাগরণের সময়ের অপেক্ষামাত্র। বিজয় রথ প্রস্তুত। রথচক্রে গঙ্গোদকে তাকে ধৌত করার প্রক্রিয়া চলছে। রথারূঢ় বঙ্গমাতার বিজয়ধ্বনি শোনা যাচ্ছে।

….অতীতে যাহার হয়েছে সূচনা, সে ঘটনা হবে হবে/ বিধাতার বরে ভরিবে ভুবন বাঙ্গালীর গৌরবে।

লেখক প্রবীর ভট্টাচার্য আকাশবাণীর পরিবেশক। মতামত ব্যক্তিগত।