ইতিহাস ও কলা বিভাগের পাঠ্য পুস্তকে মাক্সবাদী ধ্যান-ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়ার কাহিনী

কলা এবং ইতিহাস বিভাগে মার্কসবাদী আদর্শ কীভাবে সৎ শিক্ষিত ব্যক্তিদের প্রভাবিত করে এবং এই সমস্ত পাঠ্যপুস্তকে কমিউনিস্টবাদ ঢুকিয়ে দেয়।

ভারতবর্ষে মার্কসবাদী ইতিহাস এর রচনা সোভিয়েত বা চিনের রচনার মত হাস্যকর হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এটি কেবল মাত্র হয়েছিল ভিন্ন পরিস্থিতির জন্য। ভারতেও মার্কসবাদী ইতিহাস রচনার (অন্যান্য সকল সমাজবিজ্ঞান সংক্রান্ত বিষয়েও) অনিবার্যভাবে একটি হাস্যকর স্তরে পৌঁছে যেত যদি স্বাধীন গণমাধ্যম, গণতন্ত্র, প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল এবং লেখকদের অস্তিত্ব এর উপর রাশ না টানত এবং বিদগ্ধজনেরা নানা দৃষ্টিকোণ ধারণ না করতেন। কমিউনিস্টদের একচ্ছত্র শাসনের জন্য ১৯১৮-১৯৮৮ সালের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের (এবং লোহিত চীন) সামাজিক বিজ্ঞানের বইগুলির পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করার মতো অবস্থা হয়েছিল। মার্ক্সবাদী লেখকদের আধিপত্য সত্ত্বেও যদি ভারতের এই পরিস্থিতি না আসে, তার জন্য গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামোর সুদূরপ্রসারী উপস্থিতিকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। যদি এভাবে নিয়ন্ত্রণ না করা হত, তবে ভারতীয় মার্ক্সবাদী রচনাগুলি একই প্রকারের হাস্যকর হয়ে উঠত। ভারতীয় মার্কসবাদীদের মধ্যে বিকৃত করা, মিথ্যা কথা বলা ও লুকিয়ে রাখার তীব্র প্রবণতা ছিল।

বৃহৎভাবে ঐতিহাসিক কোন রচনায় গুণমান পরীক্ষা করার দিক গুলি হল নিম্নরূপ:

  • তথ্যের সত্যতা যাচাই করা
  • ব্যাখ্যার জন্য যুক্তি ও তর্ক
  • নতুন পরীক্ষাযোগ্য তথ্য সরবরাহ
  • শিক্ষামূলক

কেবলমাত্র এইসকল ভিত্তিতে কোন ইতিহাস বই বা নিবদ্ধ মেধার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় এবং এভাবেই এর গুণমান নির্ধারিত হয়।

সরকারি স্বৈরাচারের দ্বারা সৎ ঐতিহাসিক ও পণ্ডিতদের বহিষ্কার

এই জাতীয় মানদণ্ড গুলিকে মাথায় রেখে যে কেউ খেয়াল করে দেখবেন যে আমাদের মার্কসবাদী রচনাগুলি সর্বদায় গুরুতরভাবে সমসাময়িক রাজনৈতিক নেতৃত্বের উদ্বেগ দ্বারা রঞ্জিত হয়েছে। অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে তাঁরা পাঠকদের উপর রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন। বস্তুত, আমাদের মার্ক্সবাদী লেখকরা এই তাঁদের চিন্তাটি নানা সময় জনসমাজে প্রকাশ করেছেন। শিক্ষাগত কারণে নয়, বরং তাঁদের অসুবিধাজনক মনে হচ্ছে এমন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য শিক্ষাক্ষেত্র থেকে অন্যান্য ঐতিহাসিকদের অপসারণ করার জন্য জোরাজুরি করেছেন, নিন্দা করেছেন এবং বরখাস্ত করেছেন।

উদাহরণস্বরূপ, তাঁরা যখন আর্নল্ড টয়েনবি, যদুনাথ সরকার বা রমেশ চন্দ্র মজুমদারদের মতো মহাপণ্ডিতদের দ্বারা রচিত ইতিহাস বইগুলি বরখাস্ত করেছিলেন, তখন তাঁরা তাঁদের বইতে কোনও ঘাটতি উল্লেখ করেননি (কারণ তাঁরা করতে পারেননি) বা ওয়ার্কশপ এবং সেমিনার আয়োজন করে বা পুস্তিকা প্রকাশ করে, ওই ইতিহাসবিদদের লেখা বইগুলির ত্রুটিগুলি দেখাতে পারেননি। এই লেখাগুলি প্রচুর, যাচাইযোগ্য তথ্য এবং যৌক্তিক সিদ্ধান্তের সাথে সমস্ত সততা এবং পাণ্ডিত্য দিয়ে উপস্থাপিত। তবে যেহেতু তাঁরা ইতিহাসের মার্ক্সবাদী ধারার উপস্থাপনার অন্তরায় ছিলেন, তাই সরকারী এবং আমলাতান্ত্রিক অত্যাচারের সম্পূর্ণ ক্ষমতা ব্যবহার করে এগুলি সংক্ষিপ্তভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল।

১৯৯৮ সালে প্রথম এনডিএ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরে প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর তাঁদের রাশ দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং মার্কসবাদী ঐতিহাসিকরা বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম থেকে তাঁদের বই অপসারণ নিয়ে বিভিন্ন প্রকার প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন।

রোমিলা থাপার: “কোন পণ্ডিতদের সাথে পরামর্শ করা হয়েছিল বা কাদের সাথে আলোচনা করা হয়েছিল?”

আর.এস. শর্মা: “ইতিমধ্যে ইতিহাস সম্পর্কিত কোনও ধারণা যখন আছে, তাই এটি পরিবর্তন করা উচিত নয়”।

এই অধ্যাপকরা কি প্রকাশ করতে পারবেন যে তাঁরা তাঁদের আগের ঐতিহাসিকদের প্রত্যাখ্যান করার সময় কাদের সাথে পরামর্শ করেছিলেন, তাঁরা কীভাবে ভারতীয় ঐতিহাসিক গবেষণা সংসদে সূক্ষ্ম গবেষণা এবং আজীবন কঠোর পরিশ্রম দিয়ে প্রস্তুত ইতিহাস ব‌ইগুলি বাতিল করে দিয়েছিলেন? মুসলিম, হিন্দু এবং খ্রিস্টান পণ্ডিতদের মধ্যে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অবধি ভারতের ইসলামিক শাসনের ইতিহাস সম্পর্কে সাধারণ ধারণা ছিল। এই বোঝাপড়াটি সংক্ষিপ্ত করে এই মার্কসবাদী মূল্যবোধগুলির আবির্ভাবের সাথে বাদ দেওয়া হয়েছিল কেন? যখন তাঁরা ইসলামী ইতিহাসের এই সমস্ত অন্ধকার সত্যকে সমাধিস্থ করে গোপন করেছিলেন এবং তাঁদের নিজের একত্রীকরণের একটি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ এবং প্রগতিশীল চিত্র তৈরি করেছিলেন, মার্কসবাদী ঐতিহাসিকরা তখন কাদের সাথে পরামর্শ করেছিলেন? যখন তাঁরা নির্বুদ্ধিতা সহ একটি “প্রগতিশীল” পরিবর্তনের দিকে চাপ দিয়েছিলেন এবং এই জাতীয় স্তরের মাধ্যমে ভারতকে একটি কমিউনিস্ট শাসনের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, তখন তাঁরা কার পরামর্শ নিয়েছিলেন? অবশ্যম্ভাবী সুস্পষ্ট উত্তর: কেউ না।

প্রকৃতপক্ষে, কীভাবে বিশুদ্ধরূপে পুঁথিগত মার্কসবাদ থাকতে পারে না এবং প্রতিটি মার্কসবাদী কীভাবে একজন আন্দোলনকারী, যে কেবল কাজ করে না কিন্তু সামাজিক বিপ্লবের জন্যও লেখেন,  সে সম্পর্কে বিপান চন্দ্র বিস্তারিত লিখেছিলেন। তিনি বিস্তারিতভাবে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে তাঁদের কৌশলী পরিকল্পনা ও কাজের কৌশল উন্নত করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। জেএনইউ-র ঐতিহাসিক গবেষণা কেন্দ্রের সভাপতি হিসাবে তিনি নিজের যোগ্যতায় এই সমস্ত লিখেছিলেন। ১৯৭৪ সালের জুনে ‘সেমিনার’-এ প্রকাশিত ‘টোটাল রেক্টিফিকেশন’ শিরোনামে তাঁর প্রবন্ধটি দেখুন। সুতরাং, তাঁর নিজের স্বীকারোক্তির মাধ্যমে জানা যায়, মার্কসবাদী ঐতিহাসিকরা মূলত রাজনৈতিক কর্মী হয়ে আছেন। তাঁদের মৌলিক জেদ ছিল – ‘বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাঠামো পরিবর্তন করা’,  যেমনটি বিপান চন্দ্র ষোল বছর পরে অন্য একটি বইয়ের মুখবন্ধে লিখেছিলেন, যা তিনি মৃদুলা মুখোপাধ্যায় এবং অন্যান্যদের সাথে সহ-লেখক হিসেবে লিখেছিলেন: ভারত কা স্বতন্ত্রতা সংঘর্ষ।

আরামদায়ক ক্লাবের মাধ্যমে কেতাবি আধিপত্য

মার্কসবাদী রাজনীতি এবং সমগ্র বিশ্ব জুড়ে লেখার পুরো ইতিহাস এই তথ্যের সাক্ষ্য দেয় যে তাঁদের নিজেদের এবং অন্যদের জন্য আলাদা আলাদা মান রয়েছে। যখন তাঁরা অন্যকে প্রত্যাখ্যান করেন তখন তাঁরা স্ব-শৈলী বিশারদ হন; তবে যদি সেগুলি প্রত্যাখ্যান করার হয় তা অবশ্যই ব্যাপক সেমিনার, প্রক্রিয়াগুলির মাধ্যমে হওয়া উচিত এবং বিভিন্ন পদাধিকারী, তাঁদের নিজস্ব প্রচারকারীদের একটি চক্রের মধ্যে একটি গণভোট অবশ্যই করা উচিত। এটি সেই আদর্শ সাম্যবাদী মনোভাব যা ভারতের “বুর্জোয়া” দেশে সর্বপ্রকার বিরোধিতা, বিক্ষোভ, সত্যাগ্রহ, বয়কট, আন্দোলন, রাষ্ট্রদ্রোহের স্তর পর্যন্ত (‘মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার’) ইত্যাদি সর্বাধিক স্বাধীনতার উপর জোর দেয়। তারা গণহত্যাকারী, সন্ত্রাসবাদী, চরমপন্থী এবং বিশ্বাসঘাতকদের এমনকি মানবাধিকারের প্রতি জোর দিয়ে থাকে। কিন্তু যখন বিষয়টি চীন, কিউবা, উত্তর কোরিয়া বা তাঁদের দ্বারা অনুগ্রহপ্রাপ্ত নৃশংস ইসলামী স্বৈরশাসনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে, তখন নাগরিক স্বাধীনতার অনুপস্থিতি একটি অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে পরিণত হয়।

আমরা সহজেই পুঁথিগত কষ্টিপাথরে আমাদের মার্কসবাদী ঐতিহাসিকদের লেখার সত্যিকারের মূল্য পরীক্ষা করতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায়, কোড দেওয়া রোল নম্বর সহ উত্তরপত্রগুলির স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মূল্যায়ন নিশ্চিত করার জন্য পরীক্ষকদের পাঠানো হয়। একইভাবে, আমরা যদি লেখকদের পরিচয় প্রকাশ না করে বিশিষ্ট মার্কসবাদী ঐতিহাসিকদের লেখা বই এবং নিবন্ধগুলি পুঁথিগত মূল্যায়নের জন্য প্রেরণ করি তবে আমরা খুব আকর্ষণীয় ফলাফল পেতে পারি। কারণ, তখন পরীক্ষক কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের সভার সভাপতিত্ব বা অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত লেখকদের দ্বারা প্রদত্ত ক্ষমতা দ্বারা প্রভাবিত হবেন না। পরীক্ষক কেবল নিম্নলিখিত বিষয়গুলি মূল্যায়ন করবেন:

  • বিষয়
  • প্রস্তাবগুলি
  • প্রস্তাবগুলির সমর্থনে তথ্য এবং প্রমাণ
  • প্রত্যাখ্যাত সূত্রগুলির উৎস, যদি থাকে
  • প্রদত্ত উপসংহারের অনুমোদন এবং প্রত্যাখ্যানের জন্য মানদণ্ড বা নিয়ম
  • প্রক্রিয়াতে এভাবেই সত্য নিরপেক্ষতা (অর্থাৎ রাজনৈতিক কুসংস্কার থেকে মুক্ত), যুক্তি এবং কঠোরতা অর্জন করা যায়।

এমনকি একজন সাধারণ পাঠকও এই পরীক্ষাটি করতে পারেন। উপরোক্ত ছয়টি মানদণ্ডের ভিত্তিতে মূল্যায়নের মাধ্যমে আমাদের মার্কসবাদী অধ্যাপকদের লেখা এবং ঘোষণাপত্র পুরোপুরি প্রকাশ করা হবে। কেতাবি মানদণ্ডের কঠোরভাবে পরীক্ষা করা, তাঁদের বক্তৃতা, বই এবং পুস্তিকা পাণ্ডিত্য হিসাবে প্রদর্শিত হবে না তবে অনুগত রাজনৈতিক কর্মীদের জন্য রচিত সাধারণ লেনিনবাদী প্রচারমূলক উপাদান রয়েছে। এর উদ্দেশ্য একটি পাঠক বা ছাত্রকে আলোকিত করা নয়, বন্দিস্বরূপ অনুসারীদের অন্তরে বিশ্বাস জাগানো।

এই ধরনের লেখাগুলি নিরবচ্ছিন্ন ভাবে তথ্য সমৃদ্ধ হয় না, তবে পরিবর্তে তাঁরা যা উল্লেখ করে তা হ’ল নতুন আবিষ্কৃত সমস্যা, একটি কল্পিত‌ শত্রু বা খলনায়ক এবং খলনায়কত্বটিই একটি প্রতিষ্ঠিত তথ্য হিসাবে বিবেচিত হবে! সুতরাং, কথিত শত্রুটিকে ধ্বংস করার লক্ষ্য একেবারে গোড়াতেই পরিষ্কার হয়ে গেছে। যদি এটি কোনও শত্রুর শনাক্তকরণের সাথে সম্পর্কযুক্ত না হয়, তবে শুরুতে কোনও এক ধরণের ঘোষণা ঘটে। তবে তারপরে, একটি ঘোষণা একটি প্রস্তাবের থেকে পৃথক হয়ে যায়। যখন কোনও প্রস্তাবের সাথে তথ্য এবং প্রমাণ অনুসরণ করা হয়, তখন ঘোষণার কোনও দরকার হয় না। পুরো নিবন্ধ বা বক্তৃতাটি ঘোষিত শত্রু বা লেখক এবং বিদ্বানদের বিভিন্ন মতামতের নিন্দা, ঘোষণাপত্র দ্বারা পরিপূর্ণ। এই কৌশলটি মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অবিচ্ছিন্ন পুনরাবৃত্তি সহকারে আসতে থাকবে।

এই জাতীয় লেখার উদ্দেশ্য কোনও বিচক্ষণ পাঠক বা শিক্ষার্থী নয়, যাঁরা ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক মতামত পোষণ করতে পারেন। এটি একটি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ দলীয় কর্মীর লক্ষ্য যাঁদের মনে এই আদর্শ “উপবৃত্তি” বারবার রাজনৈতিক অধ্যবসায় অর্জনের জন্য জোরদার করা উচিত। এটি সাধারণভাবে মার্ক্সবাদী ইতিহাস লেখার শৈলী ছিল।

মূল লেখাটি ধর্ম ডেস্প্যাচ পত্রিকায় প্রকাশিত, অনুবাদ করেছেন অঙ্কুশা।