খালিস্তান আন্দোলন (৯): সঞ্জয়ের মৃত্যুর পর পাঞ্জাবের ক্রমশ জটিল পরিস্থিতি, রাষ্ট্রপতি শাসন

ভিন্দ্রান‌ওয়ালের বাহিনী

– চিন্ময়ানন্দ অবধূত

(৮-ম পর্বের পর)

১৯৮২ -র দিল্লি এশিয়ান গেমস ভারতের ক্রীড়াজগতের ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, কারণ অনেকদিন পর ভারত এত বড় একটি আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দায়িত্ব লাভ করে। সঞ্জয় গান্ধীর মৃত্যুর পর ইন্দিরা গান্ধী তখন তাঁর উত্তরসূরী হিসেবে রাজীব গান্ধীকে তৈরী করার চেষ্টা করছেন। দিল্লি এশিয়াড আয়োজনের দায়িত্ব এসে পড়ে রাজীব গান্ধীর ওপর।

স্বরণ সিংয়ের মাধ্যমে আলোচনা কংগ্রেসের বেইমানির জন্য ভেস্তে যাওয়ার পর, ১৯৮২ -র ৬ ই নভেম্বর আকালি দলের নেতা আর ‘ধর্মযুদ্ধ মোর্চা’ -র আহ্বায়ক হরচান্দ সিং লোঙ্গোয়াল ঘোষণা করলেন, এবার তিনি দিল্লিতে নবম এশিয়াড চলাকালীন বিক্ষোভ প্রদর্শন করবেন। নভেম্বরের শেষেই দিল্লিতে নবম এশিয়াড শুরু হ‌ওয়ার কথা। এশিয়াড চলাকালীন কোনও গন্ডগোল হলে রাজীব গান্ধীর সন্মান নিয়ে টানাটানি হ‌ওয়ার কথা, আর সেটা হলে ম‍্যাডামের রোষানল থেকে কার‌ও মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনাই ছিল না।

পুরো দিল্লি কঠোর নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হল। এশিয়ান গেমসের সময় দিল্লির বর্ডার সিল করে দেওয়া হয়। পঞ্জাব থেকে দিল্লি যাওয়ার বেশিরভাগ রাস্তা এবং রেলপথ হরিয়ানার উপর দিয়ে গিয়েছে। হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী ভজনলাল অবশ্য এক্ষেত্রেও ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি আনুগত্যের প্রমাণ দিতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করলেন না।

নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশকর্মীদের ওপর আদেশ থাকে পার্শ্ববর্তী রাজ্য থেকে আগত শিখদের “বিশেষভাবে” তল্লাশী করার। পঞ্জাব থেকে আসা বাস এবং ট্রেনের প্রতিটি শিখ যাত্রীকে এমনভাবে তল্লাশী করা হতে থাকে যা তাদের পক্ষে যথেষ্ট অপমানজনক, যা কিনা কোন সাধারণ অপরাধীদের সঙ্গে করা হয়ে থাকে। এমনকি সরকারী কর্মচারী, আমলা, প্রাক্তন সেনা অফিসার যারা চীন এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন, তাঁদেরও এইভাবে তল্লাশী করা হয়। ভারতীয় বায়ুসেনার প্রাক্তণ প্রধান, এয়ার মার্শাল অর্জুন সিংকে প্রমাণ করতে বলা হয় যে তিনি কোনও রকম বিক্ষোভ প্রদর্শনে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছেন না। রেহাই পেলেন না লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, যাঁর কাছে বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল। কংগ্রেসের শিখ সদস্য শ্রীমতি অমরজিৎ কৌর পার্লামেন্টে হরিয়ানা পুলিশ কিভাবে তাঁকে তল্লাশি করেছে এবং তাঁর স্বামীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে, তা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

প্রায় দেড় হাজার শিখের গ্রেফতার আর তল্লাশির নামে উচ্চপদস্থ, সম্ভ্রান্তবংশের শিখেদের সঙ্গে অবমাননাকর ব‍্যবহার শিখ সম্প্রদায়ের মনে যে ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়েছিল, এর সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে ভিন্দ্রান‌ওয়ালে। খোলাখুলি বলতে থাকে, “এই অবমাননা প্রমাণ করে দেয় শিখ সম্প্রদায় আসলে হিন্দুদের ক্রীতদাস।” শিখ জনসাধারণের মধ্যে ভিন্দ্রান‌ওয়ালের প্রভাব ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।

এদিকে এশিয়ান গেমসের ঠিক আগে, ইন্দিরা গান্ধী আকালি দলকে ঠান্ডা রাখতে তাদের সঙ্গে বৈঠকের আয়োজন করেন। এবারে আলোচনার জন্য এগিয়ে দেওয়া হয় ক‍্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংকে। তিনি একদা রাজীব গান্ধীর স্কুলের সহপাঠী ছিলেন এবং তার থেকেও বড় কথা, তিনি জৈল সিংয়ের শিষ‍্য।

অমরিন্দর সিংয়ের বক্তব্য অনুসারে এশিয়ান গেমস শুরু হ‌ওয়ার ঠিক আগের দিন ১৮ই অক্টোবর, চন্ডীগড়ের পঞ্জাবে অন্তর্ভুক্তি ও জলবন্টন সমস্যা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এবং আকালি দলের মধ্যে একটি সমঝোতা হলেও কোনওক্রমে চুক্তির বয়ান হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী ভজনলালের কাছে পৌঁছে যায়, যিনি ঘটনাচক্রে ঐদিনই দিল্লিতে উপস্থিত ছিলেন‌ । ভজনলাল ইন্দিরা গান্ধীকে ভয় দেখান, হরিয়ানা সরকারের সঙ্গে কোনও রকম আলোচনা না করে আকালিদের সঙ্গে জলবন্টন আর চন্ডীগড়ের সংক্রান্ত কোনও চুক্তি বাস্তবায়িত হলে তার ফল ভালো হবে না। তাঁকে সমর্থন করেন রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী, ফলে শেষ মুহূর্তে সমঝোতা ভেস্তে যায়। কিন্তু দরবারা সিং বা সিদ্ধার্থশংকর রায়ের মত কংগ্রেসের প্রবীণ নেতারা পর্যন্ত যেখানে ইন্দিরা গান্ধীকে প্রভাবিত করতে পারতেন না, সেখানে মাত্র দুই বছর আগে জনতা দল থেকে কংগ্রেসে যোগ দেওয়া ভজনলাল কিভাবে ম‍্যাডামকে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন সেটাই আশ্চর্যের বিষয়।

এশিয়ান গেমস চলাকালীন শিখ সম্প্রদায়ের সঙ্গে অপমান এবং আলোচনার নামে প্রহসনের পুনরাবৃত্তি, ভিন্দ্রান‌ওয়ালের মুখের হাসি চ‌ওড়া করছিল; অন্যদিকে পায়ের তলার জমি সরে যাচ্ছিল আকালি দলের। তাই নিজেদের গুরুত্ব বজায় রাখতে ডিসেম্বর মাসে লোঙ্গোয়াল অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রাক্তণ শিখ সদস্যদের একটি সমাবেশ আয়োজন করেন। সাংবাদিকদের মতে, উচ্চপর্যায়ের অফিসার সমেত সেনাবাহিনীর প্রায় পাঁচ হাজার প্রাক্তন শিখ সদস্য ঐ সমাবেশে যোগ দেন। এসজিপিসির পাবলিক রিলেশন অফিসার নরিন্দরজিৎ সিং নন্দার মতে সংখ‍্যাটি তিরিশ হাজারের কম নয়। এমনকি স্বয়ং লোঙ্গোয়াল‌ও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন এত প্রাক্তণ সেনাকে সমাবেশে যোগ দিতে দেখে।

এই সমাবেশ আরও একটি কারণে উল্লেখযোগ্য যে, ভিন্দ্রান‌ওয়ালের সঙ্গে এই সমাবেশে যোগ দেন শাহবাগ সিং। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিংয়ের দায়িত্বে ছিলেন এই শাহবাগ সিং। কিন্তু দেরাদুনে নিজের বাড়ি বানানোর সময় বেআইনি ভাবে তিনি আর্মির ট্রাক ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানতে পারলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং তাঁর চাকরি যায় অবসর গ্রহণের ঠিক আগের দিন। ফলে শাহবাগ সিং পেনশন সহ অন্যান্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। শাহবাগ সিংয়ের বদ্ধমূল ধারণা হয়, তিনি শিখ বলে তাঁর সঙ্গে এইরকম অন্যায় করা হয়েছে। এশিয়ান গেমসের সময় দিল্লিতে ঢুকতে গিয়ে অন্যান্য শিখের মত তাঁকেও তল্লাশীর নামে চূড়ান্ত অপমানের শিকার হতে হয়। শাহবাগ সিং হয়ে ওঠেন কট্টর হিন্দু বিদ্বেষী এক খলিস্তান সমর্থক। ভিন্দ্রানওয়ালের জহুরী চোখ ঠিকই শাহবাগ সিং কে চিনে নিয়েছিল। ভবিষ্যতে ভিন্দ্রানওয়ালে শাহবাগ সিংকে নিযুক্ত করেছিল খলিস্তানি জঙ্গিদের ট্রেনিং দেওয়ার কাজে। শাহবাগ সিং স্বর্ণমন্দিরকে একটি দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করেন।

শাহবাগ সিং

ভিন্দ্রান‌ওয়ালে আর শাহবাগ সিং সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে ছিল, কিন্তু সেনাবাহিনীর প্রাক্তণ অফিসারদের অধিকাংশ সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে ছিলেন না। তাদের মতে পঞ্জাবের সমতলভূমি সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য উপযুক্ত নয়। তাঁরা বরং একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করে জনমত গঠনের পক্ষে ছিলেন।

ভিন্দ্রান‌ওয়ালে অবশ্যই সেনাবাহিনীর প্রাক্তনীদের সঙ্গে একমত হতে পারেনি। এই সময়ে ভিন্দ্রান‌ওয়ালের প্রধান পরামর্শদাতা ছিল দলবীর সিং। বহুদিন ধরে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য দলবীর সিং ক্রমে কট্টর শিখ এবং ভিন্দ্রান‌ওয়ালের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে। দলবীর সিংয়ের পরামর্শে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য ভিন্দ্রান‌ওয়ালে পঞ্জাব পুলিশের কিছু প্রাক্তণ সদস্য, কিছু প্রাক্তণ নকশাল এবং কিছু জেলপালানো দাগী আসামিদের নিয়ে একটি ‘কিলার স্কোয়াড’ তৈরী করে। পঞ্জাবে শুরু হয় ত্রাসের রাজত্ব। এই ‘কিলার স্কোয়াড’ প্রথমে বেছে বেছে নিরঙ্করীদের মারতে থাকে, এরপর এদের বলি হতে থাকে হিন্দুরা। শুধু তাই নয়, ভিন্দ্রান‌ওয়ালে স্বর্ণমন্দিরের লঙ্গরের ছাদে নিজস্ব “দরবার” বসাতে থাকে। কারো বিরুদ্ধে ভিন্দ্রান‌ওয়ালের কাছে কেউ অভিযোগ জানালে তার আয়ু আর বেশিদিন থাকত না।

ভিন্দ্রান‌ওয়ালের দরবার

সাংবাদিক তাভলীন সিং এশিয়ান গেমসের ঠিক পরে ভিন্দ্রানওয়ালের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময়ের এক ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। সাক্ষাৎকার চলাকালীন ভিন্দ্রানওয়ালের এক শিষ্য এসে অনুযোগ করে একজন পুলিশ কনস্টেবল তাকে লাঠি দিয়ে মেরেছে। ভিন্দ্রানওয়ালে তাকে জামা খুলে লাঠির দাগ দেখাতে বলে। এরপর ভিন্দ্রানওয়ালে আহত ব্যক্তিকে বলে যে পুলিশ তাকে মেরেছে তার নাম বলতে।
লোকটি উত্তর দেয়, “গোবিন্দ রাম”। ভিন্দ্রানওয়ালে সবাইকে শুনিয়ে চেঁচিয়ে বলে ওঠে, ” গোবিন্দ রাম”। কয়েক সপ্তাহ পরে তাভলীন সিং জানতে পারেন গোবিন্দ রাম নামক একজন পুলিশকর্মী কয়েকজন অজ্ঞাতপরিচয় শিখ আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছে। তাভলীন সিং বুঝতে পারেন তাঁর সামনে ভিন্দ্রানওয়ালে গোবিন্দ রাম নামক ঐ পুলিশকর্মীর হত্যার আদেশ দিয়েছিল। বস্তুত ভিন্দ্রানওয়ালে পঞ্জাবে এক সমান্তরাল প্রশাসন গড়ে তুলেছিল, যার ভরকেন্দ্র ছিল অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির।

পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী দরবারা সিংয়ের অবস্থা শোচনীয় হয়ে ওঠে। অসহায় দরবারা সিং খালিস্তানি জঙ্গিদের এনকাউন্টারের আদেশ দেন। কিন্তু ইতিমধ্যে পুলিশের শিখ সদস্যদের অনেকেই ভিন্দ্রান‌ওয়ালের প্রতি আনুগত্য দেখাতে শুরু করেছে। তাছাড়া ভিন্দ্রান‌ওয়ালের বাহিনীর কাউকে এনকাউন্টার করলে ভিন্দ্রান‌ওয়ালের হাতে এনকাউন্টারে অংশ নেওয়া পুলিশেকর্মীদেরও ডেথ সার্টিফিকেট লেখা হয়ে যেত। এর ফলে পঞ্জাব পুলিশের মনোবলে চিড় ধরে।

ভিন্দ্রান‌ওয়ালের বাহিনী

সবচেয়ে বড় কথা, সব সমস‍্যার উৎপত্তিস্থল যেখানে, সেই গুরু নানক নিবাসে পুলিশের ঢোকার অনুমতি ছিল না। কেননা দরবারা সিং নামে মুখ্যমন্ত্রী হলেও আসল ক্ষমতা ছিল একটি ‘থিংক ট‍্যাঙ্ক’ এর কাছে। অবশ্যই ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন এই ‘থিংক ট‍্যাঙ্ক’ এর ভরকেন্দ্র।এছাড়া অন‍্যান‍্য সদস্য হিসেবে ছিলেন ইন্দিরার প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পি সি আলেকজান্ডার, ক‍্যাবিনেট সেক্রেটারি কৃষ্ণস্বামী রাও, গৃহমন্ত্রকের সেক্রেটারি টি এন চতুর্বেদী এবং রাজীব গান্ধী। এঁদের কেউই শিখ না হ‌ওয়ার পঞ্জাবের সমস্যা বোঝার ক্ষমতা কারো মধ্যেই ছিল না। এই ‘থিংক ট‍্যাঙ্ক’ কখনোই দরবারা সিংকে গুরু নানক নিবাসে পুলিশ পাঠানোর অনুমতি দেয়নি।

ধীরে ধীরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। কংগ্রেসের সদস্য, মন্ত্রী এবং আধিকারিকদের ওপর হামলা শুরু হয়। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী দরবারা সিং একটুর জন্য বেঁচে যান। পাঞ্জাব সরকারের শিক্ষামন্ত্রীর বাড়িতে গ্রেনেড ছোঁড়া হয়। ১৯৮৩ -র ২৬ শে জানুয়ারি অমৃতসরে প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠান ভন্ডুল করে দেওয়ার চেষ্টা করে ভিন্দ্রান‌ওয়ালের অনুগামীরা। তার পরের দিন অমৃতসরে সিন্ডিকেট ব‍্যাঙ্কের একটি শাখা লুঠ করে খালিস্তানি জঙ্গিরা।

ইন্দিরা গান্ধী ওপর ওপর একটার পর একটা আলোচনা নামের প্রহসন চালিয়ে গেলেও ভিন্দ্রান‌ওয়ালের দলে একজন ডাবল এজেন্ট ঢুকিয়ে রেখেছিলেন, তার নাম হরমিন্দর সিং সান্ধু। সান্ধু ‘অল ইন্ডিয়া শিখ স্টুডেন্ট ফেডারেশন’ এর জেনারেল সেক্রেটারি ছিল, আর ভালো ইংলিশ জানার ফলে ভিন্দ্রান‌ওয়ালের দোভাষী হিসেবে কাজ করত। বস্তুত অপারেশ ‘ব্লু স্টার’ এর পর, ভিন্দ্রান‌ওয়ালের ঘনিষ্ঠদের মধ্যে এই সান্ধুই একমাত্র ব্যক্তি যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল।

কিন্তু স্বর্ণমন্দিরে এক বিপুল সংখ‍্যক সেনাবাহিনীর প্রাক্তণ শিখ সদস্যদের উপস্থিতি ইন্দিরা গান্ধীর চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছিল।তাছাড়া মুখ্যমন্ত্রীর ওপর আক্রমণ হলে কেন্দ্রীয় সরকারের একটা দায়িত্ব থেকেই যায়। সুতরাং ১৯৮৩ -র ২৪ শে জানুয়ারি আকালি দলের সঙ্গে আর একদফা আলোচনা শুরু হয়। ইন্দিরা গান্ধীর ‘থিংক ট‍্যাঙ্ক’ ছাড়াও আলোচনায় সামিল করা হল বিরোধী পক্ষের নেতা, সিপিএমের হরকিষেণ সিং সুরজিৎকে। কিন্তু এইবারও একটি তুচ্ছ কারণে আলোচনা ভেস্তে যায়। পাঞ্জাব তখনও পর্যন্ত যে পরিমাণ জলসম্পদের অংশ পেয়ে আসছিল, ইন্দিরা গান্ধী তা দিতে রাজি ছিলেন না। পাঞ্জাব কতটুকু জলসম্পদ পাবে তার দায়িত্ব বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল একটি ট্রাইব্যুনালের ওপর এবং তিনি আকালি দলকে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার ব‍্যাপারে বাধ্য করতে থাকেন। ফলত আলোচনা ভেস্তে যায়।

(১৯৮৩ -র জুলাই মাসে সরকার এই দাবি মেনে নিয়েছিল, কিন্তু ততদিনে খুব দেরী হয়ে গিয়েছিল।)

আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার ফলে লাভ হয় ভিন্দ্রান‌ওয়ালের।আকালি দলের ত্রিমূর্তির মধ‍্যেও ভাঙন ধরে। লোঙ্গোয়াল জনসমর্থন হারিয়ে কোনঠাসা হয়ে পড়েন। সুযোগ বুঝে গুরচরণ সিং তোহরা ভিন্দ্রান‌ওয়ালের আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। তোহরার উদ্দেশ্য ছিল আকালি, মোর্চা আর ভিন্দ্রান‌ওয়ালের ওপর স‌ওয়ার হয়ে নিজের ওজন বৃদ্ধি করা, যাতে তিনি প্রকাশ সিং বাদলকে সরিয়ে নিজেই আকালি দলের মুখ‍্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হয়ে উঠতে পারেন।

ইন্দিরা গান্ধী

ওদিকে ইন্দিরা গান্ধী শিখ জনমানসের ক্ষতে মলম লাগানোর উদ্দেশ্যে পার্লামেন্টের কাছেই বাংলা সাহেব গুরদোয়ারায় উপস্থিত হয়ে ঘোষণা করেন, তিনি আকালি দলের ধর্মীয় দাবি মেনে নিয়েছেন। তিনি জনান পাঞ্জাব সরকারের হাতে আরও সায়ত্ত্বশাসনের অধিকার দেওয়া যায় কি না, তা খতিয়ে দেখতে খুব তাড়াতাড়িই তিনি এক সদস্যের একটি কমিশন তৈরী করতে চলেছেন।

কিন্তু ইতিমধ্যে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে এমন একটি নৃশংস হত‍্যাকান্ড সংঘটিত হল যে স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধী পাঞ্জাবে রাষ্ট্রপতি শাসন করতে বাধ্য হলেন। ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন কোনো রাজনৈতিক দল কোনো রাজ‍্যে নিজের দলের সরকারকেই বরখাস্ত করেছিল।

(ক্রমশ)

তথ‍্যসূত্র :
1. Amritsar. Mrs. Gandhi’s Last Battle. Mark Tully and Satish Jacob
2. The Khalistan Conspiracy. GBD Sidhu
3. India, the Siege Within. M.J . Akbar
4. Durbar. Tavleen Singh