এক ইতিহাসের কথা

0
1062

অণির্বাণ বিশ্বাস

( ১৭ )

মরিয়ম দুলিকে কোলে নিয়ে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়ালেন । ‘ আম্মু কি হইল,খোল ‘ বাহার জোরে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে । দুলি ভয়ে মরিয়মের কাঁধে মুখ গুঁজে আছে । সায়রা পিতলের জলের জগ নিয়ে ধানের মড়াইয়ের পাশে জড়সর হয়ে কাঁপতে থাকা মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে আছে ।

‘ তর সঙ্গে আর কে আছে্ ?’ মরিয়ম কড়া গলায় জানতে চান ।

‘ কেউ নাই । সবাই ঘরে লুঠের মাল নিয়া গেছে্ । আমার কাঁধে বড় ট্রাঙ্ক , খুব ভারী , শিগগিরই দরজা্ খোল ‘

মরিয়ম দরজা খুলে একটু ফাঁক করে দেখে পুরো দরজা খুলে দিলেন । বাহার মাথা নিচু করে ট্রাঙ্কটি কাঁধে নিয়ে উঠোনে ঢুকে ধপ করে মাটিতে নামাল । বাহার হাঁপাচ্ছে ।

‘ একটু পানি দে সায়রা ‘

সায়রা দৌড়ে এসে জগটি বাহারের হাতে দেয়। বাহার মাথা উঁচু করে ঢক ঢক করে জল খায় । ওর চোখে পরে মরিয়মের কোলে দুলি ।

‘ এইডা কেডা ?’

‘ এক হিন্দু মেয়ে । কয়েক ঘর হিন্দু দ্যাশ ছাইড়া পালাইতেছি্ল । এদের মধ্যে কয়েকজনকে মুসলমানরা মারছে্ । বাকিরা আমার ঘরে আইছে্ । ঐ যে ধানের মড়াইয়ের পাশে বইসা আছে্ ‘ মরিয়ম দাঁতে দাঁত চেপে আস্তে আস্তে বলেন ।

বাহার চমকে মড়াইয়ের পাশে আতঙ্কিত মানুষদের দেখে । ওর হাত কোমড়ে গোঁজা কুড়ুলের দিকে যায় ।

‘ এই কাফের গুলানরে ঘরে ঢুকাইছো্ ক্যান ? শালাদের কাইটা ফেলতে ..’ বলতে বলতে বাহার দুলির বাবাদের দিকে কুড়ুল উঁচিয়ে এগোয় ।

মরিয়ম দ্রুতো দুলিকে মাটিতে নামিয়ে চিৎকার করেন ,

‘ বাহার , তুই থাম ‘

বাহার হিংস্র মুখে এগিয়ে কুড়ুল তুলে ধরে । মরিয়ম দৌড়ে বাহারের হাত চেপে ধরেন ।

‘ বাহার , এই সব বন্ধ কর । তুই জানোয়ার হইছি্স ? আমার প্যাটে জানোয়ার আইছি্ল ?’

‘ আম্মু , তোমার কে লাগে এরা ? কিসের লগে অদের বাঁচাইতে চা্ও ?’

‘ আমার ভাই , আমার বোন , আমার মাইয়া । বাহার কুড়াল ফ্যাল ‘

মরিয়মের সাথে বাহারের ধস্তাধস্তিতে দুজনেই পড়ে যান । মরিয়ম বাহারের হাত চেপে ধরে বলেন ,

‘ আমার প্যাটে এমন জানোয়ার আসবে জা্নলে জন্মের সময় মুখে নুন দিয়া মারতাম ‘ মরিয়ম কুড়ুল হাতে নিয়ে নেন ।

বাহার মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে । চোখ বড় করে হাঁপায় ।

‘ এই কাফের গুলা পাশের গাঁয়ে আমাদের ঘর জ্বালাইছে ! আরও আকাম করছে ! তুমি জানো না আম্মু ?’

সপাটে বাহারের গালে মরিয়মের চড় পড়ে ।

‘ আমাদের কইতে কাদের কথা কস বাহার ? মুসলমান ? এই হিন্দুদের সঙ্গে এত বছর ছি্লি না ? এখন আমাদের ওদের বুঝাস ? তর এই কুড়ালের মুখে রক্তের দাগ । কয়জনকে মারছি্স আজ ? কোন বাড়ি থিকা এই ট্রাঙ্ক তুইলা আনছস ? কয়টা হিন্দু মাইয়ার ইজ্জত নিছিস ? তর ঘরে মা বাপ বৌ আছে্ সব ভুইলা গেলি বাহার ? আল্লার কথা ভাবলি না ? তুই আমার প্যাটে ক্যান আইছি্লি ?’ শেষের দিকে আর বলতে পারেন না মরিয়ম । কুড়ুল ছুঁড়ে ফেলে দু হাতে মুখ ঢেকে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকেন ।

বাহার আস্তে আস্তে উঠে বসে । একবার মায়ের দিকে , একবার সায়রার দিকে আর একবার ধানের মড়াইয়ের পাশে মৃতপ্রায় মানুষদের দিকে তাকায় । দুলির বাবাকে জিজ্ঞেস করে ,

‘ কি কইরা এইখানে আইলেন ? কি হইছি্ল ?’

দুলির বাবা হাত জোড় করে কাঁপা গলায় বললেন সব । বাহার মাথা নিচু করে সব শুনছে । বাহার উঠে দাঁড়ালো । আস্তে করে দুলির সামনে হাঁটু মুড়ে বসল । দু হাতে দুলির শুকনো ভীত মুখ ধরে বাহার দুলির চোখে কি যেন খুঁজছে !

বাহারের দুচোখে জল ! বাহার কাঁদছে ! বাহার দুলিকে বুকে চেপে ফিস ফিস করে বলছে ,

‘ আমারে মাপ কইরা দে মা ! এই পাপ থিকা মুক্তি দে ‘

সন্ধ্যে হয়ে এসেছে । দুলিরা উঠোনে বসে চা মুড়ি খাচ্ছে । বাহার ওর বাবার ঘরে , মরিয়ম ও সায়রার সঙ্গে মাগরিবের নামাজ পড়ছে । উঠোনে হাল্কা চাঁদের আলো । মাধবের বৌ , শম্ভুর মা বাবা নিঃশব্দে কাঁদছেন । এখন আর চোখ দিয়ে জল পড়ছে না ।

বাহার বাইরে এল । উঠোনে ফেলে রাখা ট্রাঙ্ক টেনে বাড়ির বাইরে ফেলে এল । পাশে এসে বসে বলল,

‘ আপনেরা একটু ভাত আর আলু সিদ্ধ খায়া নিবেন একটু পরে । আম্মু দিবে । চিন্তা কইরেন না । আমি আপনাদের শিতলকুচি পৌঁছায় দিব ‘

সবাই লাইন করে বসে আলু সেদ্ধ ভাত খেলেন । মরিয়ম ও সায়রা খাবার দিলেন । বিদ্ধস্ত মানুষদের এই সময় সান্তনা দেওয়ারও কিছু নেই ।

ইশার নামাজের পর সবাই রওনা দিলেন । মরিয়ম দুলিকে বুকে চেপে চুমু খেলেন ।

‘ আস্তে চলো , শব্দ কইরো না ‘ বাহার বলে । বাহার দরজা খুলে লন্ঠন নিয়ে বেরিয়ে একটু ঘুরে এল । তার পর দুলিকে কোলে নিয়ে বললে ,

‘ চ্লেন ‘ বাহার অন্ধকারে লন্ঠন নিয়ে সামনে দুলিকে কোলে নিয়ে এগোচ্ছে । পিছনে আর সবাই । পিছনে দেখা যাচ্ছে এক তরুনী ও এক মাঝবয়সী নারী বাড়ির দরজা ধরে দুলিদের তাকিয়ে আছে । ওরা হাত নাড়ছে । ওরা চোখ মুছছে ।

দেড় ঘন্টা পড় একটু দূরে আলো দেখা গেল । দুটো লোক দাঁড়িয়ে আছে ।

বাহার দুলিকে কোল থেকে নামাতে গিয়ে দেখে দুলি ওর ঘাড়ে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে । বড় মায়াময় মেয়েটি , বাহার লন্ঠনের আলোয় দেখে ।

‘ আপনেরা ঐ সামনে চইলে যান । ঐডা পুলিশ ফাঁড়ি । শিতলকুচি ‘

যাত্রীরা হাত জোড় করে বাহারকে নমস্কার জানিয়ে এগোতে থাকে । দুলি ওর মায়ের কোল থেকে নেমে পড়ে । দৌড়ে ফিরে এসে বাহারের গালে চুমু খায় ,তারপর ফিরে যায় ।

অন্ধকারে মিলিয়ে যায় রিফিউজিরা ।

পিছনে এক আকাশ তারার মাঝে মাঠে হাঁটু মুড়ে বসে এক পুরুষ দু হাত পেতে ‘ আল্লা তুমি রহম করো ‘ বলে কাঁদতে থাকে ।

( ১৮ )

এখনও সূর্যাস্ত হয় নি । সীতারহাট থানার জানলা দিয়ে শেষ বিকেলের আলো সুখেন দারোগার মুখে এসে পড়েছে । উনি বাইরে তাকিয়ে আছেন ।

‘ আপনে কন তাহইলে , কাইল কি করবো ? ‘ আবু হোসেন জানতে চান । আবু হোসেন ও নিশি ডাক্তার থানায় কথা বলতে এসেছেন ।

‘ আপনেই বলেন , যেই ভাবে আইজ মুসলিম লীগের প্রচার চইলল , যেই ভাবে অদের দলে গুন্ডারা ঢুকছে্ কাইল সব শান্ত থাইকব ? আপনিই কন দারোগাবাবু , চুপ কইরা থাইকেন না ‘ আবু হোসেন টেবিলে মাথা সামনে ঝুঁকিয়ে বললেন ।

‘ দ্যাহেন হোসেন বাবু , আপনেরাও বোঝে্ন সব ! আমার পরামর্শ যদি ন্যান কাইল বাইর হওনের দরকার নাই । কেউ বাইরাইলে মুসলিম লীগের দাঙ্গা বাঁধাইতে সুবিধা হইব ! ‘

‘ তা হইলে এইটাই আপনে ঘোষনা করতে পারেন , কেউ ঘরের বাইরে বাইরাইও না ‘ নিশিকান্ত বললেন ।

‘ এইডা কি কইলেন ডাক্তার বাবু ! সরকার এইভাবে কইতে পারে ? একটা কথা কই , আমাদের উপর থিকা আদেশ আছে্ কাইল কোন প্রো অ্যাক্টিভ ভূমিকা নেওন যাইবে না ! কেউ অভিযোগ কইরলে গিয়া দেখতে কইছে্ । না হইলে থানায় বইসে থাকতে কইছে্ ‘ সুখেন দারোগা মাথা নিচু করেন ।

‘ তার মানে হইল দাঙ্গা ফাসাদ আটকানোর কোন চেষ্টা পুলিশ কইরবে না , তাই তো ?’ আবু হোসেন বলেন ।

আবু হোসেন আর নিশিকান্ত থানা থেকে বেরিয়ে আসেন । অন্ধকার হয়ে আসছে । পিছনে ছায়ার মত রশিদ ও ইকবাল ।

‘ কাইল খুব খারপ কিছু হইব , তুই দেখস্ !’ নিশিকান্ত বললেন ।

‘ আসলে সরকার ইনডাইরেক্টলি এই হরতাল সাপোর্ট করতেছে । তাই পুলিশদের ইনঅ্যাক্টিভ করছে্ । এই সুরাবর্দী লোকটা ভাল না নিশি । মুসলিম লীগের গুন্ডারা তৈরী হইতেছে খবর পাইছি । বাগদি পাড়া , ঘোষপাড়ায়ও হিন্দুদের মধ্যে উত্তেজনা হইছে ‘ আবু হোসেন এই কথা বলতে বলতেই আবছা অন্ধকারে রাস্তার উল্টোদিক থেকে ছুটে আসা মানুষের ধাক্কা খেলেন ।

ইকবাল সামনে লাফিয়ে এসে লোকটির গলা ধরল ।

‘ কে তুই ? ছুটিস ক্যান ? কই যাস্ ?’

লোকটা হাঁপাতে থাকে । ‘ আমি ‘ ‘ আমি ‘বলতে থাকে । নিশিকান্ত চিনতে পারেন ।

‘ অ্যাই তুমি নিদাড়িয়া মসজিদের মুয়াজ্জিন না ? এই ভাবে ছুটতেছো্ ক্যান ? ‘

মুয়াজ্জিন একটু সামলায় , তারপর বলে ,

‘ খুব খারাপ খবর আছে্ ‘

‘ কি হইছে্ ‘

‘ খবর আইছে্ রংপুর হাসপাতালে ইমাম সাহেবের ইন্তেকাল হইছে্ ! কাইল অনার লাশ দাফন করার জন্য এইখানে আনা হইব !’

নিশিকান্তর মন ভারাক্রান্ত হয় । এমনটাই আশঙ্কা করছিলেন । ধরা গলায় আবু হোসেন বললেন ,

‘ ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন । বড় ভাল মানুষ ছিলেন ইমাম সাহেব । তা তুমি কোথায় যাইতেছো্ এইভাবে ? ‘

‘ এই খবর শুইনা অনেকে মসজিদের সামনে আইছে । শয়তান জালাল , যে ইমাম সাহেবকে মারছি্ল সে ঐখানে আইসা সবাইকে মিথ্যা বলতেছে্ , বলতেছে্ হেঁদুরা ইমাম সাহেবকে মারছে্ ! ও সবাইকে ভড়কাইতেছে্ । আমি থানায় জানাইতে যাই ‘

নিশিকান্ত, আবু হোসেন চুপ করে থাকেন । মুয়াজ্জিন ছুটে চলে গেল । দুই বন্ধু একটা কথা না বলে বাড়ির কাছে এলেন । নিশিকান্ত বাড়িতে ঢোকার আগে বললেন ,

‘ কাইল বড় অশান্তি হইবরে আবু । মন কু ডাকতেছে্ ‘

চারজনে নিঃশব্দে খাচ্ছেন । ইন্দ্রানী বলে উঠল,

‘ বাবু কিসু্ কও না ক্যান ? তুমি চুপ ক্যান ?’

চন্দ্রানী ইসারায় ইন্দ্রানীকে চুপ করতে বলল । ইন্দ্রানী একবার বাবা একবার মাএর মুখের দিকে তাকাতে লাগল ।

‘ আমরাও কি দুলিদের মতো চইলা যাব ?’ ইন্দ্রানী বলে উঠল ।

চমকে নিশিকান্ত ছোট মেয়ের দিকে তাকালেন ।

‘ তোমারে কে কইল এমন কথা ?’

‘ মা ‘

নিভাননা চুপ করে আছেন । খেতে পারছেন না , কেবল ভাত নাড়াচাড়া করছেন । বললেন ,

‘ তোমাগো খাওয়া হইলে উইঠা পড় । মুখ ধুইয়া শুইয় পড় যা্ও । রাত হইছে্ ‘

মেয়েরা শুয়ে পড়েছে । বারান্দায় নিশিকান্ত দাঁড়িয়ে আছেন । নিভাননা পিছনে এসে দাঁড়ালেন ।

‘ সুনু , আমাগো চইলা যাইতে হইব । এই সব ছাইড়া । নতুন জা্য়গায় । আমি বুসতে পারতেছি্লাম । দেশভাগ স্বাধীনতার আগে হইবই । এই সীতারহাট মুসলিম অধ্যুষিত । এইডা পাকিস্তানে যাইব । আমরা থাইকা যাইতে পারুম না । কিছু মুসলমান আমাগো , হিন্দুগো তাড়াইতে চায় । হিন্দুদের সম্পত্তি , বাড়ির মেয়েদের দিকা ওদের নজর ‘ নিশি আর বলতে পারেন না । গলা বুজে আসে ।

নিভাননা নিঃশব্দে কাঁদছেন । বললেন,

‘ আবু হোসেনের মত মানুষও তো আছে্ । অরা আমাগো থাকতে দিব না ?’

‘ অরা ভাল মনের মানুষ । ন্যায় অন্যায় বোধ আছে্ । কিন্তু যখন এই পাপাচারের বাঁধ ভাঙ্গে , আবু হোসেনের মত মানুষরা চিরকাল পৃথিবীতে সংখ্যালঘু হয় । অদের যন্ত্রনা আরও বেশী ‘

ঘরে ঢুকে নিশিকান্ত খাটের ওপর একটি পুরোন বেড কভার পাতলেন । স্ত্রীর দিকে তাকালেন । নিভাননা চোখ মুছে কাঠের আলমারি খুললেন । তাঁর গয়নার বাক্সটা বের করে বেড কভারের ওপর রাখলেন । নিশিকান্ত তার কিছু টাকা , শেয়ারে কাগজ , খবরের কাগজে মুড়ে বেড কভারের ওপর দিলেন । তারপর দুটো বালিশ ও ছোট কাপড় দিয়ে সব ঢেকে বেডকভার দিয়ে ভাল করে বেঁধে দিলেন । একটি কাপড়ের পোটলা হল

‘ আমি যামু না , কিছু্তেই এইখান থিকা যামু না ‘ এই বলে নিভাননা পোটলার ওপর উপুর হয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলেন ।

নিশিকান্ত পাশে বসে স্ত্রীর পিঠে হাত রাখলেন ।

‘ কাঁইদো না সুনু । এখনই যাইতেসি্ না , সব তৈরী করতেসি্ ‘

নিশিকান্ত কান্না চাপতে বারান্দা দিয়ে দুরে বাইরে তাকান । তারপর নিভাননার পিঠ ঝাঁকান ,

‘ সুনু ,দেখ ‘

নিভাননা ও নিশিকান্ত দূরে দেখেন ছোট মসজিদ মশালের আলোয় পরিস্কার দেখা যাচ্ছে । বেশ কিছু মানুষ সামনে জমায়েত হয়েছে । কেউ একজন কিছু বলছে । তারপর দুজনে পরিস্কার শুনতে পেলেন , মানুষ গুলো এক সঙ্গে বলছে ,

‘ নারায়ে তাকবির , আল্লাহু আকবর ‘

( ১৯ )

রাত বাড়ছে । নিশিকান্ত নিভাননার কর্মতৎপরতা বাড়ছে । এবারে একটা মোটা বেড কভারে রূপোর থালা বাটি ,দামী কাঁসার বাসন শাড়িতে মুড়ে রাখা হচ্ছে । নিশিকান্ত তাড়াতাড়ি বেডকভার বাঁধছেন । মাঝে মাঝে জানলা দিয়ে দূরের আলোকোজ্জল মসজিদ দেখছেন । এই করতে গিয়ে দুটো কাঁসার বড় গ্লাস কাপড়ের ফাঁক দিয়ে নিচে কাঠের মেঝেতে পড়ল । দুম দুম করে আওয়াজ রাতের নিস্তব্ধতাকে বিদীর্ন করল ।

‘ আস্তে কর ‘ নিভাননা বললেন ।

‘ আমরা পলাইবো ! কেউ আস্তে পলায় ?’ নিশিকান্ত বলেন ।

গ্লাস দুটো ঢুকিয়ে ভারী কাপড়ের পোটলাটা দুজনে ধরে নিচে পেছনের দিকে একটি পাকা ঘরে রাখলেন । এইখানে নিশিকান্তের বই থাকে । দুদিকে দেওয়াল জুড়ে আলমারী । ইংরেজী বাংলা সাহিত্যের কত বই ! মাসিক ‘ ভারতবর্ষ ‘ , সাময়িকী ‘ সবুজ পত্র ‘ একদিকে সযত্নে রাখা আছে । বাসনের পোটলাটি রেখে নিশিকান্ত আলমারীর সামনে বইগুলো দেখেন । দরজা খুলে হাত বোলান । পুরোন ভারতবর্ষ উল্টে দেখেন । ছাপা অক্ষর গুলোয় হাত বোলান । নিভাননা পিছনে আসেন । ওনারও এইসবের অনেক কিছু পড়া । নিশিকান্ত বললেন ,

‘ সুনু , এত বই , পত্রিকা কি কইরা নিব ? এইসবের সাথে আমার তোমার কত স্মৃতি জড়ায় আছে !’ নিশিকান্ত মেঝেতে বসে পড়েন । চোখ ঢেকে কাঁদেন ।

‘ নতুন জা্য়গায় তুমি আবার সব নতুন কইরা করবা ‘

‘ আমাদের স্মৃতি গুলান ক্যামনে নতুন কইরা করব ?’ নিশিকান্ত কাঁদতে থাকেন । নিভাননা পাশে বসে নিশিকান্তের মাথা বুকে টেনে নেন । দুজনে কাঁদত থাকেন ।

‘ ভোলা যা্য় না , কিচ্ছু ভোলা যা্য় না সুনু ‘ নিশিকান্ত গোঙাতে থাকেন ।

নিভাননার শাড়ি আরেকটি বেডকভারের মধ্যে ঢোকানো হচ্ছে ।

‘ দামী শাড়ি গুলা নাও । সব নেওয়া যা্বে না ‘

নিভাননা কোন উত্তর দেন না । কাঠের আলমারী থেকে শাড়ি বের করে বেড কভারে রাখছেন । একটা বেনারসী নিয়ে ছেলে মানুষের মতো গায়ের ওপর রাখেন । আয়নার সামনে দাঁড়ান ।

‘ কেমন লাগতেছে আমারে ?’ নিভাননা আয়নার ভিতর দিয়ে নিশিকান্তের দিকে তাকিয়ে আছেন । এক ঝটকায় নিশিকান্ত কুড়ি বছর আগের এক সন্ধ্যায় ফিরে যান । লজ্জায় রাঙা হয়ে এই শাড়ি পরে সুনু তাকে আর চোখে দেখছিল ,নিশিকান্তের মনে পরে । মুখে হাসি আসে ।

‘ বিয়ার শাড়ি ?’ নিশিকান্ত বলেন ।

‘ হ , তোমার মনে নাই ?’

একটি ঢাকাই জামদানি শাড়ি নিভাননা পরম মমতায় রাখলেন ।

‘ এইডা তোমার মা আমারে বরণের দিন দিছিলেন ‘ পরম মমতায় নিভাননা শাড়ির ওপর হাত বোলান । চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল শাড়ির ওপর পড়ে ।

‘ আমি পারতেছি্ না । এত স্মৃতি ছিঁড়তে হইলে আমি মইরা যাব ‘ নিভাননা নিশিকান্তের কাঁধে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন ।

পাশের ঘরে চন্দ্রানী দাঁতে দাঁত চেপে কান্না সামলাতে চেষ্টা করে । ও সব শুনতে পাচ্ছে । পাশ ফিরে বালিশে মুখ চেপে চন্দ্রানী ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে ।

ভোর হয়ে এল । অনেক গুরুত্বপূর্ন জিনিস গুছিয়ে নিচের ঘরে রাখা হয়েছে । অনেক কিছুই থেকে যাবে । চলার পথে অনেক কিছু ফেলে যেতে হয় । কষ্ট হয় , ভীষন কষ্ট হয় । বুক ভেঙে যায় । চোখ ঝাপসা হয় । তবু মানুষকে এগিয়ে যেতে হয় । ‘ ক্ষমতাবান ’দের সভ্যতা এগিয়ে নেওয়ার জন্য ।

বারান্দায় নিশিকান্ত বসে আছেন । সূর্যের প্রথম আলো তাঁর মুখে পরেছে । সূর্য তার সন্ধানে উদভ্রান্ত সন্তানদের নিজেই কপালে তিলক পড়াচ্ছেন ।

সদর দরজায় ধাক্কা । কেউ আস্তে ধাক্কা দিচ্ছে আর বলছে,

‘ ডাক্তার বাবু , ডাক্তার বাবু খোলেন । আমি রতন ‘

নিশিকান্ত সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে নিভাননার মুখোমুখি হন । নিভাননার দুই হাতে দুই কাপ চা ।

‘ কে আইল ?’

‘ রতন , আমি কথা কইয়া আসতেসি্ । তুমি চা নিয়া বস ‘

নিশিকান্তা সদর দরজা খুললেন । রতন ঢুকল । একজনকে সঙ্গে নিয়ে ।

‘ এই হইল সুদামা ডাক্তার বাবু । অর নৌকা আছে্ । অ ধরলায় যাত্রী নিয়া ঐ পারে কুচবিহারে যায় ‘

সুদামা হাত জোড় করে ।

‘ আপনে ভাইবেন না ডাক্তার বাবু । আপনে যখন কইবেন , আপনাদের ঐ পারে পৌঁছায় দিব । রাধামাধব মন্দিরের পাশে আমার ঘর । কাছে্ই নৌকা বাঁধা থাকে ‘

নিশিকান্ত সুদামাকে দুই টাকা দেন । ও কিছুতেই নেবে না । জোর করে দেওয়া হল । সুদামা প্রণাম করে চলে যায় ।

নিশিকান্ত রতনের দিকে তাকান ।

‘ আমি আসতেছি্ ডাক্তার বাবু । দুই তিন দিন আপনের বাড়িতে থাকব ‘

‘ সেকি ! এইডা কি কও ! তোমার বাড়িতে বুড়া বাপ মা আছে ! এই দাঙ্গায় অনাদের কেউ বাড়িতে একা রাখে ? ‘

‘ ঐসব ভাইবেন না । আমি ঘোষ পাড়ায় থাকি । ঘোষের ছে্লেরা দিন রাত ঐ পাড়া পাহারা দিতাছে । অরা কইছে , সাহস দিছে । আপনের বাড়িতে আমি থাকুম । আসতেছি্ । আপনার এই সদর দরজাটায় আরও দুইটা শক্ত কাঠের ডাশা লাগাইব ‘

রতন বেড়িয়ে গেল । নিশিকান্ত দরজা লাগিয়ে ফিরতে গিয়ে দোতলার বারান্দায় তাকালেন ।

নিভাননা সামনে ঝুঁকে সব শুনছেন ।

( ২০ )

সকাল হয়ে গেছে । আজ ১৬ই আগস্ট । সীতারহাট আজ সকাল থেকে শান্ত । রাস্তায় কিছু কুকুর , গরু ঘুরে বেড়াচ্ছে । বাজার বন্ধ । চারদিকে মুসলিম লীগের পতাকা । বাজারের প্রায় সব দোকানের সাইনবোর্ডে ‘ বঙ্গ প্রদেশ ’ কেটে আলকাতরায় ‘ পাকিস্তান ‘ লেখা । কখনও এক আধজন পথচারীকে দ্রুত চলে যেতে দেখা যাচ্ছে । ‘ হরতাল সফল করুন ‘ ‘ লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান ‘ এমনসব হাতে লেখা পোষ্টার শহর জুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লাগানো । কিছু পোস্টারের এক পাশে তরোয়াল হাতে মহম্মদ আলি জিন্নার ছবি ।

একটি গলির মধ্যে হঠাৎ পাশের বাড়ি থেকে একটি বাচ্চাদের খেলার প্লাস্টিকের ফুটবল এসে পড়ল । ফুটবলটি পড়েই আছে । পাশের বাড়ির ভেতর থেকে আওয়াজ এল ,

‘ মা বলটা নিয়া আসি ?’

‘ চুপ খবর্দার না ! এখন বাইরাইলে কাইটা ফেলবে ‘ মায়ের শাসানি

‘ কে কাইটবে মা ? নিয়া আসি না ! আর জোরে লাথি দিব না !’ বাচ্চার কান্নায় অতিষ্ঠ হয়ে মা দরজা ফাঁক করে এক বার গলিতে দেখলেন , তারপর আস্তে বেরিয়ে বলটা নিয়েই দৌড়ে বাড়িতে ঢুকে পড়লেন ।

নিশিকান্ত তাঁর বাড়ির বাগানে ঘুরছেন । পরম মমতায় কাঁঠাল গাছ , আম গাছ , কামরাঙা গাছে হাত বুলোলেন । এসবই তাঁর মায়ের হাতে লাগানো । কলাগাছে মোচা বেশ বড় হয়ে গেছে । এত বড় হওয়ার আগেই কেটে খেয়ে নাওয়া হয় । এবারে হল না ।

‘ বাবু , তুমি গোলাপ গাছ কাঁচি দিয়া কাটবা না ?’ ইন্দ্রানী বাবার পেছনে ঘুরতে ঘুরতে বলল ।
‘ কাটবো আবু হোসেন ‘ নিশিকান্ত মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন ।

‘ বাবা আজ তোমার রুগী নাই ?’

‘ না আবু হোসেন । আইজ বন্ধ ‘

ইন্দ্রানী একটি প্রজাপতির পেছনে দৌড়তে থাকে ।

নিশিকান্তর ভিতরে অস্থির লাগছে । অজানা ভবিষ্যতের আশঙ্কায় দিশেহারা । স্ত্রী কন্যার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত । সমস্ত সীতারহাট এক ভয়ে আজ সন্ত্রস্ত ! রতন আরও দুটো ডাসা বানাচ্ছে । নিশিকান্ত কাছে গিয়ে বললেন ,

‘ শক্ত ডাসা দিয়া দরজা আটকাইয়া তুই দাঙ্গাকারীদের আটকাইতে পারবি রতন ?’

‘ পারুম । আপনে অত ভাইবেন না ডাক্তারবাবু ‘ রতন নিশিকান্তের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে । দুজনে দুজনার চোখে কিছু অজানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজে । রতন চোখ নামিয়ে নেয় ।

‘ তুমি এখন কোথায় যাও ? আইজ বাইরাইও না !’ সিতারা রান্নাঘর থেকে ছুটে আসেন ।

‘ নিশির বাড়ি যাই । এই সময় সবার পাশাপাশি থাকন দরকার ‘ আবু হোসেন পাঞ্জাবী পরতে পরতে বলেন ।

‘ আইজ বাইরে গন্ডগোল হইতে পারে । তুমি যা্ইও না । আগেরবার তোমারে ঐ ভাবে মারছি্ল ‘ সিতারা কেঁদে ফেলেন ।

নিঃসন্তান এই প্রৌঢ় দম্পতির সম্বল বলতে নিজেরাই । আবু হোসেন সিতারার কাঁধে হাত দিয়ে বলেন,

‘ চিন্তা কইরো না ! ইকবাল আছে্ বাইরে ‘

‘ ইকবালই কইছে , ও দেখছে্ ঘোষপাড়ার ছেলে গুলান দাও , সড়কি এক করতেছে্ ‘সিতারা আঁচলে মুখ ঢাকেন ।

‘ সিতারা , এই অমানবিক লড়াই পৃথিবীতে সৃষ্টি হইতে চলতেছে্ ! ঐ কথা যদি কও , মুসলমানেরাও ঐ একই কাজ্ করতেছে । আমি খবর পাইছি আইজ ইমাম সাহেবের দাফনের পর অরা আরও ভয়ঙ্করকিছু্ করবে !’

আবু হোসেন বেরিয়ে গেলেন ।

নিশিকান্ত ও আবু হোসেন বসে আছেন ডাক্তারখানায় । কথা খুব কম হচ্ছে । গুমোট অবস্থা । কেউ কারও কাছে পরিস্কার হতে পারছেন না । চন্দ্রানী দুকাপ চা নিয়ে এল । যেন এটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন , দুজনে হাত বাড়িয়ে চা নিলেন । চন্দ্রানী দাঁড়িয়ে আছে ।

‘ কিছু কইবি মা ?’ আবু হোসেন জানতে চান ।

‘ হ্যাঁ আবু কাকা ‘ চন্দ্রানী মাথা নিচু করে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল মাটিতে ঘষছে ।

‘ আমাদের এই খান থিকা চইলা যাইতে হইব ?’

‘ কে কইছে ?’ আবু উত্তেজিত হয়ে পড়েন ।

‘ বাবা মা কাইল রাতে অনেক কিছু কাপড়ে বাঁধছে্ ! বলেন আবু কাকা ! গেলে দিনের বেলায় যাওন ভাল ! রাতে আমার ভয় করে ! রাতে দুর থিকা ‘ আল্লা হু আকবর ‘ আওয়াজ আসে ! যদি মুসলমানেরা আমাদের বাড়িত আসে ! আমার খুব ভয় করতেছে আবু কাকা ‘ চন্দ্রানী আর বলতে পারে না । দরজায় মাথা ঠেকিয়ে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে ।

আবু হোসেন উঠে কাছে আসেন । চন্দ্রানীর দুই কাঁধ ধরে বলেন ,

‘ দ্যাখ , আমারে দ্যাখ ! আমি মুসলমান ! আমি তরে মারতে চাই ? আমার দিকে দ্যাখ ! আমার চখে খুনের নেশা দেখতেছিস্ ? ক্যান যাবি ? এইডা তর আমার সবার দ্যাশ ! যারা ক্ষমতার লোভে দ্যাশ ভাগ করতেছে্ , তারা আমাগো সাথে কথা কইছিল ? তবে ক্যান মানুষ ভিটা মাটি ছাইড়া যাবে ? কোথাও যাবি না ‘ চন্দ্রানী আবু কাকার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে ।

আবু হোসেনের বুক মোচরাতে থাকে । নিশির দুই মেয়েকে নিজের মেয়ে মনে হয় । এই চন্দ্রানী তার কোলে পিঠে বড় হয়েছে ।

আবু হোসেন চন্দ্রানীর পিঠে হাত বুলিয়ে বলেন ,

‘ কান্দিস না ! আমি আছি্ । কিছু হবে না । ঘরে যা ‘

দুপুর হয়ে গেছে । আবু হোসেন নিশিকান্তর বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন ।

‘ রাতে সাবধানে থাকিস । আলো বাতি সব বন্ধ রাখিস । আমার ছেলেরা ইকবাল , রশিদ , হারু , পরেশ, আলম এমন অনেকেই আশেপাশে পাহারা দিবে, শহরের এই অংশে আমি কিছু আমার ছাত্রদের দিয়া পাহারা ব্যবস্থা করছি্ ‘

‘ তুইও সাবধানে থাকিস আবু ‘

‘ হ ‘ বলেই আবু হোসেন বেরোতে গিয়ে আটকে গেলেন । একটা বড় মিছিল নিঃশব্দে যাচ্ছে ।

‘ ইমামসাহেব রে মসজিদের কাছে্ আনছে । দাফনে আপনে যাবেন না আবু মিঁঞা ?’ মিছিল থেকে একজন আস্তে বলে । আবু হোসেন মাথা নাড়েন , বলেন ‘ হ ‘

মিছিল শেষ হয়ে এল । একজন মিছিল থেকে বেরিয়ে নিশিকান্তের দিকে একবার তাকিয়ে আবু হোসেনের হাতে কাগজ ধরিয়ে দিল ।

আবু হোসেন কাগজটা খুললেন । দুই বন্ধু দেখলেন একটি লিফলেট , লেখা আছে ‘ লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান ‘ পাশে তলোয়ার হাতে জিন্নার ছবি ।

( ২১ )

সীতারহাটে সন্ধ্যা নামছে । আজ সারাদিনের হরতালে শহরটি শান্ত । লোকজন বাইরে নেই । আবুহোসেন মাগরিবের নমাজ পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন । উনি ইমাম সাহেবের দাফনে যেতে পারেন নি । না কি ইচ্ছে করে যাননি ?

দরজা জানলা বন্ধ । ঘরে একটি হারিকেন জ্বলছে । চন্দ্রানী ঘর গোছাচ্ছে । ইন্দ্রানী বিছানায় পুতুল সাজিয়ে বসেছে । আজ ওর পুতুলের বিয়ে । ওর বড় ( পুতুল ) মেয়ের বিয়ে দুলির ( পুতুল ) ছেলের সঙ্গে হয়েছে । সেই যে দুলিরা চলে গেল , তারপর থেকে ইন্দ্রানীর মেয়ে বাপের বাড়ি আসে নি । ওর মন খারাপ । আজকে ওর ছেলের সঙ্গে দিদির ( পুতুল ) মেয়ের বিয়ে হবে । এতে ভালই হবে । ছেলে মেয়েরা বাড়িতেই থাকবে । এই সব নিয়ে ইন্দ্রানী ওর কচি গলায় বকর বকর করে যাচ্ছে ।

‘ উফ তুই থামবি ?’ চন্দ্রানী এক সময়ে হেসে বলে ফেলে ।

চন্দ্রানী পাশের ঘরে এল । বারান্দার দরজা আটকানো । জানলাও সব বন্ধ । হারিকেনের আলোয় নিশিকান্ত ও নিভাননা চা খাচ্ছেন । চন্দ্রানী তার চায়ের কাপ হাতে নিল । ও অল্প বয়স থেকেই চা খায় ।

‘ নিচে্ রতন রে চা্ দিছো্ ?’ নিশিকান্ত নিস্তব্ধতা ভাঙেন । এটা বলতে হয় বলে বলা । নয়তো নিভাননার এসবে তীক্ষ্ন নজর ।

‘ হ ‘

‘ বাবা , চাইরদিক কেমন চু্পচা্প ! কুকুরের ডাকও নাই ‘

‘ নাহ্ । সব ঘরের দরজা জানলা লাগাইছস ?’

‘ হ ‘

‘ আমাগো সবাইরে এখন মানুষের শুভবুদ্ধির উপর নির্ভর কইরতে হইবে । সব মানুষতো আর দাঙ্গা চা্য় না ‘ নিশি কান্ত নিজেকে প্রবোধ দেন । কথাগুলো তার নিজেরই অবিশ্বাস্য ঠেকে ।

‘ তোমার কোমড় উঁচু ক্যান বাবা ? কি আছে্ ? ’

‘ অ কিছু্ না ‘ নিশিকান্ত আস্তে আস্তে হারিকেন নিয়ে নিচে নামেন । বাইরে অন্ধকার নেমে গেছে ।

‘ রতন , চা খাইছস ?’

‘ হ ডাক্তারবাবু ‘ অন্ধকারে বাগান থেকে এক ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসে । নিশিকান্ত অন্ধকারে ছিটিয়ে পড়া হারিকেনের আলোয় দেখতে পান , রতনের হাতে একটা বড় রাম দা ।

‘ ঘোষেরা এইডা আমারে দিচ্ছে । দরজা আটকানো আছে্ । আপনে ভাইবেন না ‘ রতন বলে । নিশিকান্ত আবার উপরে যান । বারান্দার দরজা খুলে বাইরে দেখেন । সব অন্ধকার । কেবল দূরের ছোট মসজিদ হলুদ আলোয় উজ্জল । মনে হয় কয়েকটা হ্যাজাক জ্বালানো আছে। নিশিকান্ত স্ত্রীকে ডাকেন ।

‘ সুনু , মসজিদের সামনে হ্যাজাকের আলো ক্যান ? রোজ এই সময় কোন আলো দেহি নাই ‘ নিশিকান্ত ফিশফিশ করে বলেন ।

‘ আজ ইমামের দাফন হইছে । লোকজ্ন বেশী । তাই হয়ত ‘ নিভাননা স্বামীকে ফিশফিশিয়ে প্রবোধ দেন ।

এরকম এক সময় নিদাড়িয়া মসজিদের সামনে অনেক মানুষের ভীড় । ইমাম সাহেবের কবরে মাটি দেওয়া হয়ে গেছে । ভীড়ের মানুষেরা কিছু শুনতে চায় । মুয়াজ্জিন একটু দূরে এক ছাতিম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কাঁদছে । ওর খুব কষ্ট হচ্ছে ইমাম সাহেবের জন্য ।

হঠাৎ একটি মুখ ঢাকা লোক ছুটে এল । উঁচু একটি পাথড়ের ওপর দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করল ,

‘ আপনেরা , আমার মুসলমান ভাইরা এইবার শোনেন , আমাদের ইমাম সাহেবরে মারছে হেঁদুরা ! আমরা বদলা চাই ‘

উপস্থিত জনগনের মধ্যে চাষ্ণল্য উত্তেজনা বাড়ল । পেছন থেকে কেউ একজন চেঁচালো,

‘ নারায়ে তাকবির ‘

কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতার পড় শোনা গেল অনেক কন্ঠে ,

‘ আল্লাহু আকবর ‘

মুয়াজ্জিন দৌড়ে সামনে আসে । পাথড়ের উপর দাঁড়ানো লোকটাকে ধাক্কা মেরে সরায় । ধাক্কাতে লোকটির মুখের ঢাকনা সরে যায় । ঐ দিকে একবার তাকিয়ে মুয়াজ্জিন বলে,

‘ মিথ্যা কথা আল্লাহর নামে কইও না । ইমামসাহেব কে মারছে এই জামাল । আমি নিজে দেখছি্ । ইমামসাহেব অর কুকাজে বাধা দিছিলেন । আল্লা সব দ্যাখছেন । আপনেরা এই পাপীর কথা শুইনেন না । ও আপনেদের হেঁদুদের বিরুদ্ধ ভড়কাইতেছে । ও শয়তান । খারাপ কাম করতে চায় ‘ মুয়াজ্জিন এই সব বলতে বলতেই কেউ একজন ওর মাথায় লাঠির বাড়ি মারে । কট করে খুলি ফাটার আওয়াজ হয় । মুয়াজ্জিন ‘আল্লাহ ‘ বলে ছিটকে পড়ে ।

জামাল এক লাফে পাথড়ে উঠে দাঁড়ায় । চিৎকার করে ,

‘ এই মুয়াজ্জিন কাফির হইছে । মিথ্যা কয় । আমি মুসলমান হইয়া ইমামসাহেবকে মারুম ক্যান ? আপনেরা ভুলবেন না , এইডা আমাগো দ্যাশ ! এইডা পাকিস্তান হইব । হিন্দুদের বাড়ি ,সম্পত্তি , মাইয়া সব আমাগো সম্পত্তি । সব দখল কইরতে হবে ! নারায়ে তাকবীর !’

‘ আল্লাহু আকবর ‘ জনগন সায় দেয় । অনেকেই কোমড়ে গোঁজা তরোয়াল , ছুড়ি কুড়ুল হাতে নেয় । মুহূর্তের মধ্যে জামালের লোকেরা অনেকের হাতে মশাল ধরিয়ে দেয় ।

‘ কিয়ামতের দন আসছে্ ! চল ভাইরা । আল্লাহু আকবর ‘

এক উন্মত্ত জনতা মশাল হাতে ,তরোয়াল ছুড়ি কুড়ুল হাতে নিয়ে তীব্র চিৎকার করতে করতে মসজিদের সামনে থেকে বেরিয়ে বাজারের দিকে ছুটতে থাকে ।

সমস্ত বাজার বন্ধ । অন্ধকারে ডুবে আছে । জগদীশপ্রসাদ তাঁর বন্ধ দোকানের ছাদে দাড়িয়ে অস্থির হয়ে পায়চারি করছেন । তার পরিবারকে দুদিন আগে কাটিহার পাঠিয়ে দিয়েছেন । তাঁর হাতে আজ বন্দুক । মোহিত দৌড়ে আসে ।

‘ কর্তা কিছু্র আওয়াজ শুনছেন ? কিছু্ দেখতেছেন ?’

জগদীশপ্রসাদ দূরে অন্ধকারে তাকান । ডানদিক , বাঁ দিক । মোহিত জগদীশ বাবুর হাত ধরেন,

‘ কর্তা , ঐ দেহেন ‘

মোহিতের দৃষ্টি অনুসরন করে জগদীশ প্রসাদ বেশ কিছু দূরে দেখেন অনেক মশাল , মানুষ এইদিকে আসছে । ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি শোনা যাচ্ছে ।

চন্দ্রানী দৌড়ে আসে ,

‘ মা , বাবু আসো ‘

নিশিকান্ত ও নিভাননা পশ্চিমের ঘরের জানলা দিয়ে দেখেন , দূরের আকাশ লাল । গোলমালের আওয়াজ । শোনা যাচ্ছে ‘ নারায়ে তাকবির , আল্লাহু আকবর ‘ ।

‘ বাবা , অরা কি এই দিকে আসতেছে্ ? ‘ চন্দ্রানীর কান্না মিশ্রিত আতঙ্কের গলা । নিশিকান্ত কোমড়ে গোঁজা রিভলবারে হাত দিলেন ।

আবু হোসেন ইসার নমাজ পড়ছেন । পাশে সিতারা । কোথাও গোলমালের আওয়াজ আসছে । নমাজ পড়তে অসুবিধা হচ্ছে । নমাজ শেষ হল । দুইজনে ঘরের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে দেখেন ,উত্তরপূর্ব কোনে আকাশ লাল । চিৎকার শোনা যাচ্ছে ,

‘ হর হর মহাদেও ‘

‘ কি হইব গো ? ‘ সিতারা কেঁদে ফেলেন ।

আবু হোসেন দৌড়ে বাড়ির সব আলো নেভাতে থাকেন । বুক ধরফর করছে ।

আজ ১৬ই আগস্টএর রাতে সীতারহাটের আকাশ আগুনে লাল !

( ২২ )

“কতটুকু অশ্রু গড়ালে হৃদয় জলে সিক্ত,
কত প্রদীপ শিখা জ্বালালেই
জীবন আলোয় উদ্দীপ্ত
কত ব্যথা বুকে চাপালেই
তাকে বলি আমি ধৈর্য,
নির্মমতা কতদূর হলে জাতি হবে নির্লজ্জ”
………………………..

হিংসায় উন্মত্ত মুসলমান দাঙ্গাকারীরা বাজারে ঢুকে পড়ে । জামাল ও তার সঙ্গীরা নেতৃত্বে । ‘ নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর ‘ ধ্বনিতে পুরো বাজারে তান্ডব চলতে থাকে ।

‘ আমাগো মুসলমান ভাইদের দোকানে আগুন দিও না ‘ জামালের হুঁশিয়ারি । এই বাজারে অধিকাংশ দোকান কাঠের । কিছু পাকা বা কিছুটা পাকা । সব গায়ে গায়ে ।

‘এইডা রামুর দোকান ! আগুন দে ‘

‘ রামু মইরা গেছে ‘

‘ তাতে কি হইল ? কাফেরের বাচ্চা !’একজন বলে । রামু দুদিন আগে পুড়েছে । আজ রামুর মুদির দোকান পুড়ছে দাউ দাউ করে । আগুনের ফাঁক দিয়ে রামুর রেখে যাওয়া আটা ,চালের বস্তা , মশলার কৌট , সর্ষের তেলের টিন লুঠ হয় । দোকানের এক কোনে রাখা রামুর নিত্য পূজার গনেশও পুড়তে থাকে ।

বাজারে এর মধ্যে অনেক গুলো দোকানে আগুন লেগে গেছে । উন্মত্ত লোকের ছোটাছুটি চলছে , লুঠের মাল নিয়ে , চোখে হননের হিংসা নিয়ে । রামুর দোকানের লাগোয়া একরাম আলির তামাকের দোকান । ওর দোকানে আগুন লাগানো হয়নি । কিন্তু রামুর দোকানের আগুনের আঁচ একরামের বন্ধ দোকানে পড়েছে । দোকানের পিছনে আগুন লেগেছে । দোকানের বন্ধ দরজার পেছন থেকে ধাক্কার আওয়াজ আসছে । কে যেন চিৎকার করছে ,

‘ বাঁচা্ও বাঁচা্ও ‘

কিছু দাঙ্গাকারী দাঁড়িয়ে পড়ে । মশালের আলোয় দেখা যায় কে যেন জোরে জোরে ধাক্কা দিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করছে । দড়াম করে দরজা খুলে যায় । একটি পায়জামা পরিহিত তরুন ছেলে খালি গায়ে বেরিয়ে আসে । ওর চোখে মুখে আতঙ্ক !

‘ কেডা তুই ? একরামের দোকানে কি করিস ?’

‘ আমি … আমি … রাতে দোকানে থাকি । আমি আলি বাবুর কর্মচারী !’ তরুন হাঁপাতে হাঁপাতে বলে ।

‘ আলি বাবু ? কি বলিস ? তর নাম কি ?’ দুইজন তরুনকে টেনে বাইরে রাস্তায় আনে ।

‘ আমার নাম …. আমার নাম ..’ তরুনটি তার চারিদিকে ঘিরে ধরা হিংস্র মানুষদের মুখ দেখে ‘ আমার নাম রাজেন… রাজেন সেখ ‘ তরুনটির গলা কাঁপে ।

‘ এইডা কি নাম ? তুই হেঁদু না মুসলমান ?’ চারিদিকে হুঙ্কার শোনা যায় ।

‘ আমি … আমি …হি…হি…মুসলমান ! আমারে মাইরো না ‘ তরুনটি হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে । দুই হাত মুঠি করে । কাঁদতে থাকে ।

‘ মুসলমান ? তা হইলে তো খৎনা হইছে ? পাজামা খোল , দেহি ‘

একটুদূরে ছাদ থেকে জগদীশপ্রসাদ এবং মোহিত দেখতে থাকেন বাজারে একরাম আলির দোকানের সামনে একটি ছেলে হাঁটু মুড়ে হাত জোড় করে কি যেন বলছে ! দুইজন মশালধারী ওর পায়জামা টেনে খুলছে ! ওই তো , ওরা চিৎকার করছে ,

‘ আল্লাহু আকবর ‘

কে যেন ছেলেটির গায়ে জলের মতো কিছু ছিটিয়ে দিল ! ঐ তো , ছেলেটির গায়ে কেউ আগুন ধরিয়ে দিল ! জ্বলন্ত এক মানব সন্তান ছুটতে ছুটতে চিৎকার করছে ,’ বাঁচা্ও , বাঁচা্ও ‘ ! জগদীশপ্রসাদ ছাদ থেকে সব দেখতে পাচ্ছেন ! জ্বলতে জ্বলতে মানুষটা দৌড়ে এসে জগদীশপ্রসাদের বন্ধ কাপড়ের দোকানের সামনে রাস্তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে । আস্তে আস্তে মানুষটার নড়াচড়া বন্ধ হল । উন্মত্ত জনতা তরোয়াল , ছুড়ি , কেরোসিনের ডিব্বা , জ্বলন্ত মশাল নিয়ে ছেলেটির পেছনে ছুটতে ছুটতে জগদীশ প্রসাদের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল ।

জগদীশপ্রসাদ মোহিতের হাত টেনে পিছনে আসেন ।

‘ কি করবি ? ওরা এই দোকানে আগুন দিবে ‘

মোহিত ছুটে নিচে যায় । এই কাপড়ের দোকানের সামনে শক্ত লোহার দরজা । উড়ন্ত মশাল , কেরসিনে ভেজা কাপড়ের দলা দোকানের ওপর এসে পড়ছে । ‘ আল্লাহু আকবর ‘ চিৎকারে জনতা বন্ধ দরজায় লাথি মারছে । ভীড়ের মধ্য থেকে একজন সামনে এগিয়ে আসে । মশালের আলোয় শ্বাপদ জামালের হিংস্র মুখ দেখা যায় । ও চিৎকার করে,

‘ এই খানে শালা হারামী হেঁদু জগদীশের বাড়ি । আগুন লাগা । বৌটাকে নিয়ে আয় । আইজ কাউকে ছাড়ুম না ‘

বলতে বলতেই মোহিত ও তার দুই সঙ্গী দোকানের আড়াল থেকে বন্দুক চালায় । জামাল এবং আরও একজন ছিটকে পড়ে । উন্মত্ত জনতা পিছু হটে ফুঁসতে থাকে । তারপর দ্বিগুন আক্রোশে বন্ধ দরজায় ঝাঁপিয়ে পড়ে , চিৎকার শোনা যায় ,

‘ নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর ‘

মুহুর্মুহূ দরজায় ধাক্কা পড়ে । মোহিত হাঁপাতে হাঁপাতে সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করে ,

‘ আমাগো হিন্দু ছেলেরা কই ? অরা খবর পায় নাই ?’

‘ পাইছে্ তো নিশ্চয়..’ বলতে বলতেই দরজার এক পাল্লা খুলে যায় । মশালধারীরা ঢুকতে শুরু করে । মশাল কাপড়ের গাঁটে ছুঁড়ে দেওয়া হয় । মোহিত পিছু হটে । বন্দুকের কার্তুজ ফুরিয়ে গেছে । ও কোমড় থেকে কুড়ুল বের করেই সামনে চালায় । প্রথম লোকটির মুখ থেঁতলে যায় , ‘ আল্লাহ ‘ বলে ছিটকে পড়ে । পরের জনের গলা লক্ষ করে মোহিত কুড়ুল ঘোরায় । কিছু বোঝার আগেই মোহিত পেটে তীব্র যন্ত্রনা অনুভব করে । একটা বড় ছোরা পেটে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে । অনেক লোক দোকানে ঢুকে পড়েছে । কাপড় লুঠ হচ্ছে । আগুন লাগা কাপড় গুলো দাউ দাউ করে জ্বলছে ।

কিছু লোক জগদীশপ্রসাদকে খুঁজছে । ওর বৌকে খুঁজছে । জগদীশপ্রসাদ ওপরে সিঁড়ির কোন থেকে সব দেখতে পাচ্ছেন । নিচে একদিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে । তিনজন মশাল হাতে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে ।

জগদীশপ্রসাদ কোনে আড়াল হয়ে বন্দুক তাক করলেন ।

নিচে কোনে একটি ঘরে দরজা বন্ধ করে জগদীশপ্রসাদের রাঁধুনি প্রসাদ এবং ওর বৌ মিনতি কাঁপছে । দরজার ফাঁক দিয়ে আগুনের আভা আসছে ।

‘ এই দরজা বন্ধ ক্যান ? কি আছে্ ? ‘ দরজায় ধাক্কা পড়ে । তিন চারবার ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে যায় ।

প্রসাদ , মিনতি ঘরের কোনে সিঁটিয়ে আছে । কাঁপছে ।

‘ আমাগো ছাড়ো ! আমাগো মাইরো না !’

‘ আল্লাহু আকবর ‘ এর হুঙ্কারে সব ঢাকা পড়ে যায় । একজন মুহূর্তের মধ্যে প্রসাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে , বা হাত দিয়ে মুখ চেপে গলায় ছুড়ি আড়াআড়ি এক টান মারে । ফিনকি রক্ত ছিটিয়ে প্রসাদ মাটিতে মুখ থুবড়ে পরে । ওর শরীর থেকে থেকে কাঁপতে থাকে । দুইজন আতঙ্কে দিশেহারা মিনতিকে মাটিতে ফেলে নিজেদেরে লুঙ্গি খোলে । মিনতির কাপড় ছিঁড়ে ফেলে । উপুর্যপরি ধর্ষন চলতে থাকে । এক সময় মিনতির শরীর থেকে উঠে একজন মিনতির গলায় ছুড়ি চালিয়ে দেয় ।

ওপরে গুলির আওয়াজ শোনা যায় । একটু পর জগদীশপ্রসাদের জামা খামচে টানতে টানতে রাস্তায় আনা হয় । পিছনে জগদীশপ্রসাদের দোকান বাড়ি সব দাউ দাউ করে জ্বলছে । জগদীশপ্রসাদের নাক মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে । একজন জগদীশপ্রসাদের চুল খামচে মাথাটি পেছনে টেনে বলে ,

‘ দেখ কুত্তা ! দেখ তোর দোকান বাড়ি ! সব হেঁদুর এই হাল করব ! আল্লাহু আকবর ‘ বলেই জগদীশের গলায় ছুড়ি চালিয়ে দেয় । মুখ থুবড়ে জগদীশপ্রসাদ রাস্তায় পড়ে যান । শরীরটা দুবার কেঁপে স্থির হয় ।

কিছু দূরে একটি অন্ধকার বাড়ির আধ খোলা জানলা দিয়ে তিন জোড়া চোখ বাইরে দেখছে ।

‘ বাবা , ঐ দিকে আকাশ এত লাল ! এত চিৎকার হইতেছে্ , আমার ভয় করতেছে্ বাবা ‘

‘ দাঙ্গা হইতেছে্ চন্দ্রানী ‘

নিভাননা নিশিকান্তের পিঠ খামচে ধরেন । নিশিকান্ত ঘামছেন । পাঞ্জাবি ভিজে গেছে । কাঁপা হাতে নিশিকান্ত স্ত্রীর হাত ধরেন ।

বাইরে কিসের আওয়াজ ? নিশিকান্ত , নিভাননা বারান্দার দরজা ফাঁক করে দেখেন , চারিদিক অন্ধকার । তার মধ্যে সামনের গলির মধ্য দিয়ে কারা যেন ধুপধাপ করে দৌড়ে যাচ্ছে , মশালের আলোর আভায় শোনা যাচ্ছে ,

‘ হর হর মহাদেও ‘

( ২৩ )

“ আমি চিৎকার করে কাঁদিতে
চাহিয়া করিতে পারিনি চিৎকার
বুকের ব্যথা বুকে চাপায়ে
নিজেকে দিয়েছি ধিক্কার “
………………………………….

কিছু মশাল দৌড়ে গেল গলির মধ্যে দিয়ে । সব চুপ চাপ এখন । নিশিকান্ত ঘরের হারিকেন প্রায় নিভিয়ে দেন । বারান্দার দরজা খুলে আস্তে বাইরে পা রাখেন ।

‘ তুমি এহন বাইরে যা্ইও না ! যদি কিছু্ ছো্ড়ে ? ‘ নিভাননা কান্না ভেজা গলায় আস্তে বললেন ।

‘ চুপ্ ‘ নিশিকান্ত ঠোঁটে আঙ্গুল রাখেন । অন্ধকারে বাইরে কাঠের বারান্দায় দাঁড়ান , রেলিং ধরে । চারিদিকে অতল অন্ধকার , কেবল ,

কেবল বাঁদিকে সীতারহাটের বাজারের দিকে আকাশ লাল । দাউ দাউ আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যাচ্ছে । সঙ্গে মানুষের আর্তনাদ , কান্না ।

নিভাননা স্বামীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন । স্বামীর হাত খামচে ধরে আছেন । কম্পিতে কন্ঠে সামনে তাকিয়ে বললেন ,

‘ ঐ খানে কি হইতেছে্ !’

নিশিকান্ত স্ত্রীর দৃষ্টি অনুসরন করে দেখেন , দূরে ছোট মসজিদের পাশে অনেকগুলো বাড়িতে আগুন জ্বলছে । মানুষ ছোটাছুটি করছে , চিৎকার আর্তনাদ নিশিকান্তের বাড়ি অবধি শোনা যাচ্ছে । দেখা যাচ্ছে একজন লোককে চেপে ধরে কয়েকজন এক আগুনের গোলায় ছুঁড়ে দিল । লোকটির আর্তনাদের সঙ্গে এক মহিলা চিৎকার করে ‘ আল্লা এই কি করলা ‘ বলে ছুটে এলেন । পাশ থেকে একজন রাম দা উঁচিয়ে মহিলাকে কোপাতে লাগল । শোনা যাচ্ছে ‘ হর হর মহাদেও ‘ ।

‘ সুনু , আইজ আর সীতারহাটে কোন মানুষ নাই । কতগুলান পশু দাপাইতেছে্ । আমর আর ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস নাই । ‘ নারায়ন ‘ নাই , ‘ আল্লা ‘ নাই । সব মিথ্যা । আমরা সব জানোয়ার ‘ নিশিকান্ত কাঁদতে লাগলেন ।

‘ বাবা , ভয় করতেছে্ । চল পালাই , আইজই এইখান থিকা ‘ চন্দ্রানী পিছন থেকে বলে । আতঙ্কে ওর গলা কাঁপছে ।

‘ চুপ্ ঘরের ভিতর যা্ও তোমরা ‘ নিশিকান্ত ফিশফিশিয়ে বললেন । সামনের গলির মধ্যে হঠাৎ অনেক মশালের আলো । সঙ্গে চিৎকার ‘ নারায়ে তাকবির , আল্লাহু আকবর ‘

কাঠের বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিনটি প্রানী কাঁপতে থাকেন । দরজার বাইরে রাস্তায় মশালধারীরা দাঁড়ালো ।

‘ এইডা নিশি ডাক্তারের বাড়ি , ভাঙ দরজা ‘ খোদা বক্সের গলা , নিশিকান্ত টের পান ।

‘ তোমরা ভিতরে ঢোক ‘ নিশিকান্ত স্ত্রী মেয়েকে ঠেলে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা লাগালেন । বাইরের দরজায় ধাক্কা পড়ছে । নিশিকান্ত হাঁপাচ্ছেন । একবার চারিদিক দেখলেন । স্ত্রী দুই কন্যাকে দেখলেন । ইন্দ্রানী ঘুম থেকে উঠেই এই অবস্থায় কাঁদছে । নিভাননা দুই মেয়েকে দুদিক থেকে বুকে চেপে বিছানায় বসে আছেন । হারিকেনের আলোয় অন্ধকারের আলো ছায়ায় দাঁতে দাঁত চেপে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন !

‘ তুমি পারবা না ? তোমারে পারতেই হইব ‘ নিশিকান্ত স্ত্রীর মুখের কাছে মুখ এনে চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন ।

‘ কি করতে কও ?’ নিভাননা স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলেন । নিশিকান্ত দৌড়ে কাঠের আলমারির ভিতর থেকে ধুতরো ফুলের বিচি ভর্তী শিশিটা নিয়ে আসেন । নিভাননার হাতে দেন ।

‘ আমি নিচে যাই সুনু । এই শিশি তোমারে আমি আমার হাতে দিলাম । যদি সময় আসে , বোঝ আর ধর্ম রক্ষা কইরতে পারবা না , বিচি গুলান মেয়েদের মুখে দিয়া নিজেও মুখে নিও । আমি তোমাগো মুখে ভাত দিছি্ , আইজ এইটা দিলাম ‘ নিশিকান্ত দুহাতে স্ত্রীর মাথা চেপে কপালে কপাল ঠেকিয়ে কাঁদতে থাকেন । নিভাননা দুই মেয়েকে বুকে আরো শক্ত করে চেপে ধরেন ।

দুম করে বাইরের বারান্দায় আওয়াজ । চমকে নশিকান্ত ঘুরে দেখেন বন্ধ দরজার নিচে আলো , আগুনের আভা । তাড়াতাড়ি দরজা খোলেন । একটা বড় জ্বলন্ত কেরসিন ভেজানো কাপড় কেউ বাইরে থেকে ছুঁড়ে দিয়েছে । কাঠের মেঝেতে আগুন ধরে গেছে । বাইরে চিৎকার ,
‘ আল্লাহু আকবর ! কাফিরটাকে বাইর কইরা মার । বৌ বাচ্চা গুলান আমারে দিবি , লুঠের মাল তোদের ‘ খোদা বক্সের বিকৃত উল্লাসের গলা শোনা যায় ।

উদভ্রান্ত নিশিকান্ত কেরসিন ভেজা জ্বলন্ত কাপড়টা বাইরে ছুঁড়ে ফেলেন । দৌড়ে খাবার জলের জগ নিয়ে কাঠের মেঝেতে জল ঢালেন । তারপর পা দিয়ে বাড়ি মেরে আগুন নেভান । দৌড়ে ভিতরে এসে দরজা লাগিয়েই নিচে ছুটে যান ।

বিছানায় বসে তিনটি প্রানী নিঃস্তব্ধ হয়ে মানুষটির ছোটাছুটি দেখেন । নিভাননা শক্ত হাতে ধুতরো ফুলের বিচির শিশি চেপে ধরেন ।

নিশিকান্ত নিচে নেমে আস্তে ডাকলেন ,

‘ রতন ,রতন ‘ নিশিকান্তের হাতে রিভলবার ।

রতনের সারা নেই । নিশিকান্ত আবার ডাকলেন । অন্ধকারে সামনের গোলাপের বাগানে কিছু বোঝা যচ্ছে না । হঠাৎ বাইরে থেকে একটি জ্বলন্ত মশাল ভেতরে কেউ ছুঁড়ে দিল । গোলাপ গাছে দাউ দাউ করে আগুন লেগে গেল

ঐ আগুনে নিশিকান্ত দেখলেন রতন রামদা উঁচু করে বন্ধ দরজার এ পাশে দাঁড়িয়ে আছে । দরজায় দাক্কা পড়ছে । মনে হয় ভেঙ্গে যাবে ।

দরজার এই পাশের দেয়াল বেয়ে কেউ ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছে । মাটির গাঁথনিতে ইটের দেওয়াল ।

নিশিকান্ত দু হাতে রিভলভার ধরে আকাশে ফায়ার করলেন । অপটু হতে জোর ঝটকা লাগল । কয়েক মুহূর্তের জন্য বাইরের চিৎকার থামল । তারপর দ্বিগুন জোরে শোনা গেল

‘ নারায়ে তাকবির , আল্লাহু আকবর ‘

আরও জোরে বন্ধ দরজায় ধাক্কা শুরু হল ।

নিশিকান্ত রিভলবার দরজার দিকে তাক করে দাঁড়িয়ে আছেন । রতন দু হাতে রামদা তুলে দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ।

( ২৪)

“ আজও কানে ভাসে সেই কথাগুলো
কে জানে হবে যে শেষ কথা
নিয়তির ডাকে দিলি যে সাড়া
ফেলে গেলি শুধু নিরবতা
যার চলেযায় সেই বোঝে হায়
বিচ্ছেদে কি যন্ত্রণা
অবুঝ শিশুর অবুঝ প্রশ্ন
কি দিয়ে দেব সান্তনা “

বাইরে রাস্তায় গোলমাল হচ্ছে । নিশিকান্ত রিভলবার হাতে উৎকন্ঠিত হয়ে রাতের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছেন । নিভাননা দুই মেয়েকে বুকে চেপে একহাতে ধুতরো ফুলের বিচির শিশি শক্ত করে ধরে খাটে বসে আছেন । বুকের মধ্যে ধড়াম ধড়াম করছে । ভয়ে উত্তেজনায় মনে হচ্ছে হৃৎপিন্ড গলায় উঠে আসছে ।

রাস্তার বাইরে কে যেন চিৎকার করল ,

‘ জানোয়ারের দল ! আল্লার নামে নোংরামি করিস ! নে আমিও বলি ‘ আল্লাহু আকবর ’ ‘

বাইরে তুমুল মারামারি হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে ।

‘ খোদা বক্স , আইজ তুই থাকবি না হয় আমি , কুত্তা শালা ‘

কিছুক্ষন পর সব চুপ কিছু মশালধারী পালিয়ে গেল দৌড়ে ।

‘ ডাক্তারবাবু ভয় পাবেন না , আমি , আমরা আছি্ । একটু দরজা্টা খোলেন ‘

কিছু মশালের আলো বন্ধ দরজার ও পারে আছে । নিশিকান্ত আস্তে আস্তে দরজার কাছে আসেন । রতন নিশিকান্তের হাত চেপে ধরে , খুব আস্তে আস্তে বলে ,

‘ খুইলেন না ! মিথ্যা হইতে পারে ! অদের বিশ্বাস করন যা্য় না !’

‘ ডাক্তারবাবু , একটু খোলেন । ভয় নাই । আমি কসাই বদরুদ্দোজা । বাওমি গ্রামের । আমার মেয়ে আপনের রুগী । সেদিন আসমারে আপনের ঘর থিকা নিয়া গিছিলাম ‘

নিশিকান্ত ও রতন কাঁপা হাতে দরজার তিনটে ডাশা নামান । বাইরের থেকে কেউ দরজা ঠেলে ঢুকলো না । নিশিকান্ত দরজা খুললেন ।

অন্ধকারে মশালের আলোর নিচে সাত আটজন দাঁড়িয়ে আছে । হাতে দা , তরোয়াল লাঠি । মশালের আলোয় ঘাম রক্ত মাখা প্রত্যেকের মুখ চকচক করছে । লম্বাদেহী বদরুদ্দোজা সামনে এগিয়ে এল । ওর গায়ে ভেজা ছেঁড়া পাঞ্জাবি ।

‘ আমি থাইকতে আপনাগো কোন চিন্তা নাই । আমার সঙ্গে এরা সবাই পাহারা দিতেছে । আবু হোসেন আমাদের সব কইছেন । আর মনে হয় না কেউ আসবে । হারামী খোদাবক্সের পায়ে লাঠির বাড়ি মারতে পারছি । পালাইছে শালা । না হইলে ঐটারে আইজ এইখানেই শেষ করতাম ‘

নিশিকান্ত রিভলবারটা কোমড়ে গুঁজে হাত জোড় করলেন । তার চোখে জল এসে গেছে । বাঁ হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন ।

‘ আপনে এই ভাবে ভাঙ্গবেন না ডাক্তারবাবু । শক্ত হন । যে মাইনষেরা আপনাগো মাইরতে আসে তারা মানুষ না । ঐ গুলানের হিসাব আল্লা আমাদের হাত দিয়া নেওয়াইবে ‘ বদরুদ্দোজা এগিয়ে নিশিকান্তের হাত জড়িয়ে ধরে ।

কিছু মানুষ বাঁচার আকাঙ্খায় , কিছু মানুষ বাচানোর চেষ্টায় গভীর রাতে সীতারহাটে এক আকাশের নিচে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে ।

‘ বদুরোদ্দোজা , তোমরা একটু ভিতরে আইস ‘ । সবাই ওপরে তাকিয়ে দেখে , অন্ধকারে নিভাননা বারান্দায় দাঁড়ে আছেন । তার দু পাশে দুই মেয়ের অবয়ব ।

সবাই ভিতরে বাগানে এসে দাঁড়াল । রতন দরজা ভিতর থেকে লাগিয়ে দিল ।

মশাল গুলো জ্বলছে । মানুষগুলো তৃষ্ণার্ত । নিভাননা প্রত্যেকের হাতে বাতাসা দিলেন । জলের জগ থেকে প্রত্যেকের হাতে জল ঢেলে দিলেন । সবাই ঢকঢক করে জল খেল ।

‘ আমার বাড়ি থিকা কেউ না খাইয়া ফেরে না । আইজ্ এই সময়ে আমার কাছে এই ছাড়া কিছু্ নাই । অতিথি নারায়ন । নারায়নরে আইজ বাতাসা জল দিলাম ‘

বদরুদ্দোজা ফ্যাল ফ্যাল করে নিভাননার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে । বলে ,

‘ মা তার সন্তানরে পানি দেয় । আপনি আইজ পানি দিলেন আপনের সন্তানদের । আমরা আছি্ মা । এই সীতারহাটে কেউ কিছু করবো না ‘

এইসব বলতে বলতে বদরুদ্দোজার চোখ নিভাননার আঁচলে আটকানো শিশির দিকে চলে যায় ।

‘ এইডা কি মা ? শিশিতে ধুতরা বিচি আছে্ মনে হইতেছে্ ? এই সব ক্যান ?’

‘ ও কিছু্ না । আর একটু জল খাও ‘ নিভাননা আঁচল আড়াল করতে যান ।

বদরুদ্দোজা একটু চুপ থেকে উপরে তাকায় । বারান্দায় এক কিশোরী , এক শিশু দাঁড়িয়ে আছে । আবার নিভাননার দিকে তাকায় । তারপর দু হাতে মুখ ঢেকে অস্ফূটে ‘ আল্লাহ ‘বলে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে । নিশিকান্ত বদরুদ্দোজার পাশে এসে পিঠে হাত রাখেন ।

বদরুদ্দোজা উঠে দাঁড়ায় । নিভাননাকে বলে ,

‘ আমি সব বুজছি্ মা । আমি থাইকতে ঐটা হইতে দিব না ‘

বদরুদ্দোজা নমস্কার করে ওর দল নিয়ে বেরিয়ে যায় । যাওয়ার আগে বলে ,

‘ দরজা বন্ধ কইরা ভিতরে যান । ভয় নাই । আমি আছি । আল্লা আমার সাথে আছে্ ‘

রতন দরজা লাগায় । নিশিকান্ত নিভাননা ধীরে ধীরে ওপরে উঠছেন ।

‘ কি হইবে এইবার ? আমার বুক কাঁপতেছে্ । ভীষন ভয় লাগতেছে্ । এই ভাবে কয়দিন বাঁচুম ? রোজ এইভাবে কারা বাঁচাইবে ? ’ নিভাননা জিজ্ঞেস করেন ।

‘ জানি না সুনু ! ভাবতেছি্ …’ বলতে বলতে নিশিকান্তরা দোতলায় ওঠেন । অন্ধকারে দুই বোন সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আছে ।

‘ বাবু , আমাগো মারতে আইছিল ওরা ?’ কান্না ভেজা কাঁপা গলায় ইন্দ্রানী জানতে চায় ।

‘ না আবু হোসেন ! কিছু্ দুষ্টু লোক আইছিল । কিন্তু ভাললোকেরা অদের তাড়ায় দিছে্ ‘ নিশিকান্ত ইন্দ্রানীকে কোলে তুলে বলেন ।

‘ তোমরা কান্দতেছি্লা ক্যান ? অত আগুন ক্যান বাবু ? আমাদের এইখানে থাকতে দিবে না ? আমার খুব ভয় করতেছে্ বাবু ’ ইন্দ্রানী নিশিকান্তের গলয় মুখ গুঁজে ফোঁপাতে থাকে ।

‘ অনেক রাত হইছে্ । শোও তোমরা ‘

‘ না , শুব না । তোমার কাছে্ শুব , আমার ভয় করে ‘ ইন্দ্রানী জোরে কেঁদে ফেলে ।

নিশিকান্ত ছোট মেয়েকে কোলে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়ান । বারান্দার পুড়ে যাওয়া কাঠ এখনও গরম । নিভাননা চন্দ্রানী নিশিকান্ত অন্ধকারে বাইরে তাকান ।

চারদিক জুড়ে দূরে ইতঃস্তত আগুন জ্বলছে । সঙ্গে মানুষের আর্তনাদ , চিৎকার ।

সীতারহাটের আকাশ আজ লাল ।

( ২৫ )

ভোর থেকে আকাশ ঘোলাটে । এখনও সূর্য ওঠেনি । সুখেন দারোগা অফিস ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন । গতকাল রাত থেকে দাঁড়িয়ে আছেন । তাঁর চোখের সামনে সীতারহাটে তান্ডব চলছে । মাঝে মাঝে সাবির পাশে এসে বলছিল ,

‘ স্যার , এই ভাবে আমরা থানায় বইসা থাকব ? আমাগো পুলিশ হিসাবে কর্তব্য নাই ? এই দাঙ্গায় মানুষ কি কইরা থানায় অভিযোগ জা্নাইতে আসবে ? স্যার আমরা এমনিই যাইতে পারি !’

সুখেন চুপ করে থাকেন ।

‘ স্যার আপনে কন , উপর থিকা থানায় বইসা থাকার হুকুম আসছে্ , এইডা কি আইন হইল ! তাও আপনেরে মুখে বলছে্ , লিখিত কিছু্ দেয় নাই ‘ সাবিরের ক্ষুব্ধ গলা ।

‘ সাবির , এই দাঙ্গা অনেক আগেই আটকানো যাইত । আমাদের কাছে্ খবর ছি্ল ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে তে গোলমাল হইব ! তখনই ব্যবস্থা নিলে আইজ এই দিন দেইখতে হইত না । একডা বড় নোংরা রাজনীতির খেলা হইতেছে । না হইলে কেউ পুলিশকে চুপ থাইকতে কয় । কাইল দুইবার কমিশনারকে ফোন করছি্ । তরেও একবার চিঠি দিয়া পাঠাইছি । কি হইছে্ ? কমিশনার সাহেব কয় নাই ,’ Don’t take any step tonight, we will see tomorrow ‘ । এর মানে কি ?’ সুখেন দারোগা তীব্র ক্ষোভে বলেন ।

সকাল হয়েছে । এখনও অনেক জায়গায় ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে । আর্তনাদ আর হাহাকার ! থানার ভিতর থেকে এক কনেস্টবল বেরিয়ে এল ।

‘ স্যার , কমিশনারের অফিস থিকা ফোন আসছে !’

সুখেন মুখ বিকৃত করে ফোন ধরলেন ,

‘ See SI,Mr Sukhen , I want to have a report of last night’s incidence in Sitarhat as soon as possible’

‘Yes Sir’

সুখেন দারোগা সাবির ও আর একজন কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে শহর সরেজমিনে দেখতে বেরোলেন ।
প্রথমে বাজারে ঢুকলেন । চারদিকে পোড়া অধিকাংশ দোকান । কিছু দোকানে এখনও আগুন জ্বলছে । কিছু মানুষ তাদের পুড়ে যাওয়া দোকানে থেকে যাওয়া মাল পত্রের হদিস খুঁজছে । বালতি করে জল এনে ঢালছে । চারিদিকে হাহাকার, কান্না । বাজারের চত্বরে নয়টি মানুষের মৃতদেহ পড়ে আছে ।

সুখেন দারোগা ঘোড়া থেকে নামেন । চারদিকের মৃতদেহ গুলো দেখতে থাকেন । একটি আধপোড়া মৃতদেহের পাশে এক বুড়ো মানুষ কাঁদছেন । সুখেন রুমালে মুখ ঢেকে কাছে গেলেন । সুখেনকে দেখে বৃদ্ধ হাত জোড় করে বললেন ,

‘ এইডা আমার পোলা । বিশ্বাস করেন দারোগাবাবু । ঐ একরামের দোকানে কাইজ্ করত । ওর মা ছো্টবেলায় মরছে । আমি অরে বড় করছি্ । অর মুখ গা পুইড়া গেলেও পা দেইখ্যা চিনছি্ । অরে ক্যান মারল দারোগা বাবু ? অ কার কি ক্ষতি করছে্ ! হায় ভগবান ‘

সুখেন দারোগা সামনে এগোন । জামাল মুখ পাশ করে পড়ে আছে । বুকে গুলির দাগ । একটা শরীর , উপুর হয়ে চাপ রক্তের মাঝে জগদীশপ্রসাদের দোকানের সামনে পড়ে আছে । সুখেন লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে শরীরটাকে চিৎ করলেন । খুব বড় বড় চোখে জিভ বের করে জগদীশপ্রসাদ ! গলার পশে চাপ চাপ রক্ত । সুখেন তার পুলিশ জীবনে এত ভয়াবহ মৃতদেহ দেখেন নি ।

‘ সাবির ‘ সুখেন আকাশের দিকে তাকিয়ে ডাকেন ।

‘ স্যার ‘

‘ সামনে জগদীশপ্রসাদের বাড়ির ভিতরে দেখে এস ‘।

সাবির ভিতরে গেল । বাজারে সর্বস্ব হারানো বেশ কিছু মানুষ সুখেন দারোগার একটু দূরে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে কাঁদছে , কেউ শব্দ করে , কেউ নিঃশব্দে , কেউ বা গোঁঙাচ্ছে । সবাই যেন দারোগাবাবুকে কিছু বলতে চাইছে , কিছু জানতে চাইছে । কিন্তু কান্না ছাড়া কিছুই আসছে না !

‘ ওয়াক ‘ ‘ ওয়াক ‘ করে বমি করতে করতে সাবির জগদীশপ্রসাদের বাড়ির ভিতর থেকে বেরলো । সাবির একটি পোড়া দেওয়াল ধরে নিজেকে সামলাচ্ছে । সুখেন দারোগা একটু অপেক্ষা করলেন । সাবির নিজেকে সামলে কাছে এসে বললে ,

‘ স্যার ‘

‘ কিছু্ কওনের নাই সাবির । থানায় গিয়া কইবা । আমি বুঝছি ‘

সুখেনরা এগোতে থাকেন । এদিকে স্কুল । গেট ভাঙা । এধারে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিস । দরজা ভাঙা । এর উল্টো দিকে চায়ের দোকান , মিস্টির দোকান । সব আগুনে পোড়া । অফিসের ভেতরে কিছু কাগজ এখনও পুড়ছে । অফিসের সামনে তিনজন পড়ে আছে । কারও পেটে ছুড়ি । কাওকে কোপানো হয়েছে ।

‘ সাবির ‘ আর্দ্র গলায় সুখেন দারোগা ডাকেন ।

‘ স্যার ‘

‘ মরা দেইখ্যা বুঝতে পারিস কোনটা হিন্দু কোনটা মুসলমান ?’

বিহ্বল সাবির মাথা নাড়ে ।

সুখেন এগোতে থাকেন । একটা কালী মন্দির । পুড়ে কালো হয়ে গেছে । সামনে মনে হয় পূজারী , কপালে লাল তিলক , ডান হাতে জবা ফুল নিয়ে , গলাকাটা অবস্থায় পড়ে আছেন । আশেপাশের বেশ কিছু বাড়িতে এখনও ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে । কোনও লোক নেই । সামনে ছোট মসজিদ । সুখেন দারোগা এগোন ।

মসজিদ আগুনে পোড়া । দেওয়াল গুলো কালো । সামনে পোড়া তিনটি দেহ । কোপানো উলঙ্গ এক নারী দেহ । দুটো বাচ্চা নারী দেহের পাশে বসে দেহ ঝাঁকাচ্ছে আর ‘ মা মা ‘ বলে কাঁদছে । পেছন থেকে কান্নার আওয়াজ ।

‘ কি হইল সাবির ?’

‘ স্যার আমি সহ্য কইরতে পারতেছি্ না । স্যার আমারে ছাইড়া দ্যান ‘

‘ তুই না পুলিশ ? ভয় পাস ক্যান ? পিছে্ আয় । আরও অনেক কিসু্ দেখনের আছে্ ’

সুখেন দারোগা ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নেন । গলির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন । এই দিকে অত কিছু হয় নি । দুটো বাড়ি পোড়া । ঘোড়া থেকে নেমে একটি বাড়িতে ঢুকলেন । কান্নার আওয়াজ । একটি ঘর থেকে আসছে । পোড়া গন্ধ । সুখেন ভিতরে ঢুকলেন ।

‘ আমাগো মাইরো না । মাইয়াকে ছইড়া দাও । এই দ্যাহ গোরুর মাংস , তোমরা আনছিলা । আমরা খাইছি্ । আবার খাইতেছি্ ‘ স্বামী স্ত্রী হাত জোড় করে ঘরের এক কোনে বসে কাঁপছে , কাঁদছে আর পোড়া মাংস মুখে দিচ্ছে । পাশের বিছানায় এক কিশোরীর গলা কাটা উলঙ্গ লাশ । সার শরীরে অত্যাচারের চিহ্ন ।

‘ দ্যাহ , দ্যাহ আমাগো মাইয়াকে ছাইড়া দাও । তোমরা যা্ কইছ করছি , গোরুর মাংস খাইছি । আমরা আর হেঁদু না । আমরা কলমা পড়ব । শিখায় দাও , মাইয়ারে ছাড়ো ‘

সুখেন দারোগা ছিটকে বেরিয়ে আসেন । হাঁপাচ্ছেন ।

‘ স্যার , কি হইল ?’

‘ কিসু্ না ,চল ‘ বিদ্ধস্ত সুখেন দারোগা মাথা নিচু করে ঘোড়ায় বসে আছেন ।

‘ দারোগা বাবু , শহরের অবস্থা খুব খারাপ তাই না ?’ আবু হোসেন বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন , বললেন ।

‘ হ , আপনেরা ঠিক আছে্ন ?’

‘ বাঁইচা আছি্ ! শুনছি্ কাইল নিশি ডাক্তারের বাড়ি হামলা হইছি্ল । আমি যামু এহন ‘

‘ এহন বাইরাইয়েন না ‘ সুখেন দারোগা নিশি ডাক্তারের বাড়ির দিকে চললেন ।

রোদ উঠেছে চড়া । আকাশ থেকে বিকট আওয়াজ আসছে । সুখেন দারোগা , সাবির আকাশে তাকায় ।

‘ সাবির , সীতারহাটের আকাশে শকুন এহন ! দেইখতে পাস ? এত লাশ শহরে । কি কইরা কি করব ? শিগগিরই চল , কমিশনারকে জানাই ‘

সুখেন দারোগা ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে তাড়াতাড়ি ছুটলেন ।

( ২৬ )

নিশিকান্ত ও নিভাননা বাকি রাত আর ঘুমোন নি । দুই মেয়ে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছে । মেয়েদের বিছানায় দুইজনে বসে আছেন । নিভাননার স্থির দৃষ্টি অন্ধকারে বাইরে । আতঙ্কের রাত কেটে সূর্য উঠলো না । কেবল ঘোলাটে আকাশ ।

‘ সুনু , আমাগো চইলা যাইতে হইব , বুঝসোনি ? কাইল যা হইল , আইজ হইতে পারে ,কাইল হইতে পারে , যে কোন দিন হইতে পারে !’

‘ পুলিশ কিছু্ করবে না কও ?’

‘ হ ,তোমার সন্দেহ আছে্ ? পুলিশ চা্ইলে এই দাঙ্গা হয় না । মুসলিম লীগের প্রধানমন্ত্রী সুরাবর্দী চা্য় বঙ্গ প্রদেশ পাকিস্তানে যাক । সরকার চাইছে্ এই দাঙ্গা হোক । হেঁদুরা ভয় পায়া চইলা যাক । আসল কি জান , এই মুসলমানেরা ধর্মের নামে আকাম করতেছে্ । ভাইবা দেখ , দাঙ্গা হইলে অদের লাভ । হেঁদুদের জমি , সম্পত্তি দখল কইরব , হেঁদু মাইয়াদের লুঠ কইরব । শ্যামাপ্রসাদবাবু কি ভাবে এই বংলা ভাগ আটকাইবেন জানি না । কংগ্রেসের নেতা , মুসলীম লীগের নেতারা দেশ ভাগ কইরা ক্ষমতা ভোগের স্বপ্নে মত্ত । উয়াদের কাছে্ কোন বিচার পাইবা না । উয়াদের সাধারন হিন্দুমুসলমানের কথা ভাইবতে বইয়া গেছে । আমাগো কেউ নাই সুনু । কয়েকজন বদরুদ্দোজা , আবু হোসেন কতদিন কি ভাবে আমাগো বাঁচাইবো ?’ নিশিকান্ত আস্তে আস্তে বলেন । উনি মেঝের দিকে তাকিয়ে আছেন ।

নিশিকান্ত উঠে দাঁড়ান । দুই মেয়ের কপালে চুলে গালে হাত বুলান ।

‘ এই মাইয়া দুইটার কাইল কি হইতে পারতো বুঝতে পার ? যদি সীতারহাট বা এই রকম মুসলমান অধ্যূষিত জায়গা পাকিস্তানে পরে , আমাগো হিন্দুদের সঙ্গে ঐ মুসলমানেরা কেমন ব্যাভার করবে বুঝতে পারনা ! দ্যাশভাগের আগেই আমায় বাড়ি আইসা শাসায় ,চইলা যাইতে কয় , প্রায় বিনা পয়সায় এই বাড়ি ঘর জমি বেচতে কয় , জানায় আমার মাইয়াদের উপর নজর আছে , এতসব নিয়া কি কইরা থাকব কও সুনু ?’ নিশিকান্তের গলা ধরে আসে ।

নিভাননা কাছে আসেন । নিশিকান্তের বুকে মাথা রেখে কাঁদতে থাকেন । চোখ দিয়ে জল বেরোয় না । গত রাতের ত্রাস , উদ্বেগ আতঙ্ক একবারে অশ্রু হয়ে বেরোতে চায় । কিন্তু চোখে জল কই ?

‘ আমরা কবে যা্ব , কি ভাবে যা্ব ঠিক করছ ? দিনের বেলায় যাওয়া ঠিক । রাতের কথা ভাইবলে আতঙ্ক হয় ? ‘

‘ দিনে গেলে দেইখা ফেলবে সব । লুটপাটের শঙ্কা বেশি । রাতে পালাইব । আমি একটু আবু হোসেনের সাথে কথা কই ‘

‘ তোমার কষ্ট হইবো না , এতদিনের চেষ্টায় , কত স্মৃতি জড়ানো এই বাড়িঘর সীতার হাট ছাইড়া চইলা যাইতে ?’

‘ আমি নিজে আমার বাপ মায়ের মুখাগ্নি করছি । তহন খুব কষ্ট হইছিল । আরেকবার না হয় ‘ দেশ ‘ নামের মায়ের মুখাগ্নি কইরা যাইব । কষ্ট হইলেও সহ্য করব ‘ নিশিকান্ত দৃঢ় কন্ঠে বলেন ।

আবু হোসেন হনহন করে হাঁটছেন । মাথার ওপর রোদ । মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশ দেখছেন । নিশিকান্তের বন্ধ দরজার সামনে এসে আস্তে ডাকলেন ,

‘ নিশি , দরজা খোল । আমি আবু ‘

নিশিকান্ত বাগানেই ছিলেন । গত রাতে পুড়ে যাওয়া গোলাপ ফুলের গাছে পরম মমতায় হাত বুলাচ্ছিলেন । রতন ভেতরে ঘুমুচ্ছে । নিশিকান্ত গিয়ে দরজা খুললেন ।

আবু হোসেন ভিতরে ঢুকেই দরজা লাগালেন । বিধ্বস্ত নিশিকান্তকে দেখেন । পোড়া বাগান দেখেন । তারপর নিশিকান্তকে জড়িয়ে ধরলেন ,

‘ ঠিক আছিস নিশি ! বৌদি চন্দ্রানী ইন্দ্রানী ঠিক আছে্ ?’

‘ হ , উপরে চল ‘

আধঘন্টা পর নিশিকান্ত , নিভাননা , আবু হোসেন ঘরে মোড়ায় বসে আছেন । সবার মাথা নিচু ।

‘ তুই ঠিক খবর শুনছস ?’ নিশিকান্ত জানতে চান ।

‘ হ , কাইল কলকাতায় ভয়ঙ্কর দাঙ্গা হইছে । একতরফা মুসলমানরা করছে । সুরাবর্দী অর পুলিশরে বসায় রাখছে । আমার মনে হয় ,ঐ রকম কামই এইহানে পুলিশরে করতে কইছে । কলকাতায় দাঙ্গা চলতেছে্ । কতদিন চলবে কেউ জানে না । তা হইলে এইখানে কি হইব ?’

‘ যা কাইল হইছে , আজও তাই হইব ‘ নিশিকান্ত বলেন ।

‘ আমরা চইলা যাই আবু , কুচবিহারে । তুই ,বদরুদ্দোজা আমাগো সাহায্য কর ‘ নিশিকান্ত হাতজোড় করেন ।
‘ না হইলে এই দাঙ্গায় বাইরাইতে পারুম না । থাইকা গেলে আইজ না হোউক কাইল আমাগো কাইটা ফেলাইয়া যাবে ‘

আবু হোসেন এতক্ষন চোখ বড় করে নিশিকান্তকে দেখছিলেন । এবারে এক লাফে উঠে নিশিকান্তর কাঁধ ধরেন । চিৎকার করেন,

‘ ভাবিস কি তুই নিজেরে ? তর কেউ নাই এইহানে । আমরা কেউ লাগিনা তর ? এই সীতারহাট তর জায়গা না ? আমার আব্বু চইলা গেলে তুই কাঁধ দিস নাই ? মাটি দিস নাই ? মাসিমা চইলা গেলে আমি তর সাথে শ্মশান যাই নাই ? আমি হবিষ্যি খাই নাই ? আইজ তুই আমার সামনে হাত জোড় করতেছিস্ ! ক্যান করতেছিস্ ?’ আবু হোসেন কেঁদে ফেললেন ।

নিভাননা উঠে দুজনকে সামলালেন । বললেন ,

‘ সবারই মাথা গরম । কি করন লাগব জানা নাই । ভাত বসাইছি্ । ভাত খাইয়া যাইবেন আবু ভাইজান ‘

‘ খাবই তো । আপনে অন্নপূর্ণা । দেন খাই । খিদা লাগছে , সকালে নাস্তা হয় নাই ‘ আবু বলেন ।

মাইকে একটি ঘোষনা শোনা যাচ্ছে ।

‘ এখন থিকা অনির্দিষ্ট কালের জন্য সীতারহাট থানায় কার্ফ্যু । দেখলেই গুলি চালানোর আদেশ আছে্ ‘

‘ কিছুটা ভাল ‘ আবু হোসেন বলেন ।

‘ হ ‘ নিশিকান্ত বলেন

নিশিকান্ত ও আবু হোসেন নিচে নেমে দরজার বাইরে উঁকি মারেন । একটা পুলিশের জিপ চোঙা লাগিয়ে ঘোষনা করতে করতে যাচ্ছে । পিছনে কুড়ি জনের বন্দুকধারী পুলিশ চলছে । একদম পিছনে ঘোড়ায় চেপে সুখেন দারোগা ।

সুখেন নিশিকান্তদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মাথা নিচু করে বললেন ,

‘ একশ আর্মড ফোর্স রংপুর থিকা পাঠাইছে । দেখা যাক ‘

পুলিশ চলে গেল । দুইবন্ধু বাগানে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন । একটা বিশ্রী কটু গন্ধ আসতে লাগল এবং ক্রমেই সেটা তীব্র হচ্ছে । সঙ্গে বাইরের গলিতে খসখস আওয়াজ ।

আবার দরজা খুলে উঁকি দিয়ে দুইজনে দেখলেন , তিনটে মৃতদেহ , ফুলে গেছে , পচছে। সেগুলোকে নাড়কেল গাছের বড় পাতায় ফেলে টানতে টানতে মেথররা নিয়ে যাচ্ছে । একজন বললে ,

‘ হোসেন চাচা এমন অনেক বডি পইড়া আছে শহরে । হুকুম হইছে সব গুলান কে তুইলা ধরলার ধারে পুড়ায় দিতে ‘

আবু হোসেন মুখ ঘুরিয়ে হড়হড় করে বমি করে ফেললেন ।

( ২৭ )

ধরলার দক্ষিন পাড়ে সীতারহাট শহরের শেষ প্রান্তে দাউ দাউ করে মৃতদেহগুলো জ্বলছে । একটু দূরে একটি উঁচু মাটির ঢিপির ওপর সুখেন দারোগা দাড়িয়ে আছেন । মুখ রুমাল দিয়ে ঢাকা । সাবির ও অন্য দুজন কনস্টেবলও মুখে রুমাল বেঁধে তদারকি করছে । চারটে , পাঁচটে মৃতদেহ ডাঁই করে তার ওপর কেরসিন ভেজা কাপড় , কাঠ ফেলে আগুন জ্বালিয়ে পোড়ানো হচ্ছে । পচা দেহের গন্ধ , পোড়া দেহের গন্ধ নিয়ে কালো ধোঁয়া কুন্ডলীপাকিয়ে উপরে উঠে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে ।

বেলা তিনটে বাজে । এই মুহূর্তে তিনটে এমন চিতা জ্বলছে । সাবির একটি কাগজ নিয়ে সুখেন দারোগার কাছে এল ।

‘ স্যার এখন অবধি পনেরটা বডি পুড়তেছে । আরও চাইরটা বাকি আছে্ । মেথড়রা কইতেছে , আর তিনটা লাশ আনতেছে্ । সবসুদ্ধা বাইশটা লাশ । কাইল দাঙ্গায় সীতারহাটে বাইশজন মরছে্ ‘

‘ নারী পুরুষ ভাগ করছিস্ তো ? কারও বাড়ির লোক আইছিল ?’

‘ হ , দশটা নারী বারোটা পুরুষ । চাইরজনের বাড়ির লোক আইতে চাইছিল । আসতে দেই নাই । কইছি সরকার শেষ কাইজ করবে ‘

‘ যারা আইসতে চাইছিল নাম লিখা রাখিস । রিপোর্ট লিখিস , ছয়জন মরছে ‘

‘ স্যার ! ‘ সাবির হতভম্ব ।

‘ এত মরছে্ , দ্যাখানো যাইব না । সরকারের বদনাম হইব । রিপোর্ট দিব বাকিরা মিসিং । চাকরীর এইডাই নিয়ম ‘

সাবির ফ্যালফ্যাল করে সুখেন দারোগার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে । সুখেন দারোগা দূরে জ্বলন্ত আধপোড়া দেহগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকেন ।

‘ এই ডেড বডিগুলার মধ্যে কোনটা হিন্দু কোনটা মুসলমান কেউ জানে না । সব্বাইকে তাড়াতাড়ি পুড়ইয়া ফেলবার হুকুম আসছে । শহরে কোন লাশ রাখন যাইবে না ‘

নদীর হাওয়ার দিক শহরের দিকে ঘুরে গেছে । সীতারহাটে এই বিকেলে মড়া পোড়ার গন্ধ । সবার খাওয়া হয়েছে । আলু সেদ্ধ ভাত সঙ্গে ঘি ও কাঁচা লঙ্কা । দুই মেয়ে খেয়ে ঘরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে । নিশিকান্ত ও আবু হোসেন বারান্দায় বসে নিম্নস্বরে কথা বলছেন । নিভাননা দু হাতা ভাত আলু সেদ্ধ মেখে খেতে গিয়েই মড়া পোড়ার গন্ধ পেলেন । এক গ্রাস খেলেন । বাকিটা আর খেতে পারলেন না। গন্ধ তীব্র হচ্ছে । উঠে বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুলেন । অনেক চেষ্টা করলেন আটকানোর । শেষে আর পারলেন না । হড় হড় করে বমি করে দিলেন ।

‘ স্যার রংপুর থিকা আসা পুলিশদের রাস্তার মোড়ে , গলির মুখে ডিউটি দিলেন ক্যান ?’ সাবির জানতে চায় ।

একটু চুপ থাকেন সুখেন । তারপর বললেন ,

‘ ওপর থিকা আদেশ আসছে , মুসলিম মহল্লা গুলানে এই পুলিশ গুলারে ডিপ্লয় করবার , এর মানে বুঝস ?’

‘ সেকি ! তা হইলে হিন্দু মহল্লায় , হিন্দুদের কোন প্রটেকশন নাই ? আইজ রাইতে যদি আরও বড় হাঙ্গামা হয় ?’

‘ আরও শোন , বলা হইছে ভীষন ঝামেলা না হইলে এই পুলিশরা যেন স্পটে না যায় ! অরা কি ভাবে আমাগো ? আমরা জানোয়ার ? এই জন্য আমি আর্মড ফোর্সকে গলিতে ,মোড়ে বসাইছি্ । কইয়া দিছি , ঝামেলা দেখলেই গুলি চালাইতে ! কাওরে ছাড়তে না কইছি্ ! জানি এর জন্য আমার পানিশমেন্ট হইব , হউক !’ সুখেন দারোগা মুখ থেকে রুমাল খুলে ফেলেন । ওনার চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে ।

সাবির হা করে সুখেনের দিকে তাকিয়ে থাকে । একবার প্রণাম করবার ইচ্ছে হয় সুখেনকে ।

একজন কনস্টেবল ছুটে এল ।

‘ দুইটা ছোট বাচ্চার বডি আইছে । দুই তিন বছর হইবে । দুইজনেই পুইড়া গেছে । কি করুম ? ঐ চিতা গুলানে দিব ?’

‘ বাচ্চাদের দুইবার দাহ করবি হারামজাদা ?’ সুখেন দারোগা চেঁচায় ।

‘ অদের কলাপাতায় মুরায় ধরলায় ভাসায় দে । চল , আমি যাইতেছি্ ‘

বাচ্চা দুটোকে কলা পাতায় মুরে জলে ভাসানোর আগে সুখেন বলেন ,

‘ একবার মুখ দুইটা দেখি ‘

‘ স্যার ‘ সাবির ইতস্তত করে ।

‘ খোল , কইতেছি্ , শুইনতে পাস না ?’ সুখেন চিৎকার করেন ।

মুখের ওপর থেকে কলাপাতা সরানো হয় । দুইটি আধপোড়া শিশুর মুখ । সুখেন তাকিয়ে থাকেন,তাকিয়েই থাকেন । তারপর হাত নেড়ে জলে ভাসিয়ে দিতে বলেন ।

সুখেন দারোগা আর পারলেন না । দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললেন । মৃত শিশু দুটি ধরলার জল বেয়ে ঈশ্বরের কাছে ফিরে যায় ।

( ২৮ )

শ্মশানে সন্ধ্যা নামার মত সীতারহাটে সন্ধ্যা নামল । একটু আগে আবু হোসেন চলে গেছেন । লালচে আকাশে শ্মশানের ছাই এখনও উড়ছে । থানার কাছে দুটো ত্রিপল খাটিয়ে গতকাল রাতের দাঙ্গায় সব হারিয়ে যাঁরা এখনও প্রাণে বেঁচে আছেন তাঁদের ওখানে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে । প্রায় দুশ লোক । অধিকাংশ হিন্দু । কিছু মুসলমানও আছে । তাঁদের চিঁড়ে গুড়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে , সরকারের পক্ষ থেকে । বিদ্ধস্ত অভুক্ত সুখেন দারোগা রিপোর্ট লিখছেন , মাঝে মাঝে জানলা দিয়ে বাইরের মানুষদের দেখছেন । কতদিন মানুষকে এভাবে পুলিশ দিয়ে রক্ষা করা সম্ভব ?

‘ স্যার এই চা আর টোস্ট খান । সারাদিন প্যাটে কিছু্ পড়ে নাই ‘ সাবির প্লেটটা টেবিলের ওপর রাখে।

‘ তরা খাইছস ? ‘ সুখেন মুখ তুলে জানতে চান । বড় মায়ময় সাবিরের মুখ । আবার তাঁর মনে হয় ভুল করে ও পুলিশে ঢুকেছে । ওর শিক্ষক ওর উচিৎ ছিল ।

‘ খাইতেছি্ স্যার । আপনে শুরু করেন ‘ সাবির স্যালুট করে ।

সুখেন উঠে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন ।

‘ সাবির ‘

‘ স্যার ‘

‘ দ্যাখ , একই মাটিতে পাশাপাশি বইসা মানুষ গুলান চিঁড়া খাইতেছে্ । কে মুসলমান কে হিন্দু বোঝ্নের উপায় নাই । তবে ক্যান এত দাঙ্গা ?’

‘ দাঙ্গা স্যার শয়তানেরা করে । লোভ , লুঠের জইন্য ,ধর্মের নামে । আর করায় কিছু্ সমাজে্র উপরের লোক ‘ সাবিরের গলা ধরে আসে ।

নিভাননা তুলসীতলায় সন্ধ্যা প্রদীপ দেখিয়ে ঠাকুর ঘরে শাঁখ বাজাচ্ছেন । আজ শাঁখের আওয়াজে কান্নার সুর । নিশিকান্ত তুলসীতলায় হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন । হাঁটু মুড়ে বসে দুহাতে তুলসীমঞ্চ জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। বিড়বিড় করে বলতে থাকেন ,

‘ আমাগো মাপ কইরো । মাগো , আমার বাবা , তোরা আমাগো মাপ কইরো । অনেক চেষ্টা করছি্ । আর পারতেছি্না । তোমাগো বৌমা ,নাতনিগো সম্মানের লগে এইসব ছাইড়া যাইতেছি্ । আমার আবার নাড়ি ছিঁড়ার যন্ত্রনা হইতেছে্ । এত কষ্ট সহন যায়না । তোমাগো ভিটা ছাইড়া যাইবার কথা আমি ভাবি নাই ‘

দোতলার বারান্দা থেকে চন্দ্রানী ও ইন্দ্রানী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বাবার কান্না দেখে । নিভাননা স্বামীর পাশে আসেন । কাঁধে হাত দিয়ে বলেন ,

‘ ভিতরে চ্লো ‘

নিশিকান্ত উঠে স্ত্রীকে ধরে দাওয়ায় বসে পড়লেন । কান্না থামাতে পারছেন না ।

‘ আমাগো আইজই যাইতে হইব ?’ নিভাননা জানতে চান ।

‘ হ সুনু ! আমি আর সহন করতে পারতেছি্ না । এই বাড়ি ঘর এই স্মৃতি মায়া গাছ ফুল সব ছাইড়া ক্যামনে যামু ? ‘

নিভাননা দাঁতে দাঁত চেপে আছেন ।

‘ আইজ হয়ত গোলমাল হইব না । পুলিশ আছে্ । মাঝ রাইতের পর আমরা চইলা যামু । অন্যদিন কি হইব জা্নিনা । এই ভাবে কতদিন চলব জানা নাই । তবে এইটুকু বুঝছি্ , যত সময় যাইবে বিপদ বাইরবে ‘

‘ তুমি আবু দাদারে কইছ ?’

একটু চুপ থাকেন নিশিকান্ত ।

‘ না অরে কই নাই । যাওয়ার সময় কইব । জানলে ও যা্ইতে দিবে না । তুমি ভাত কইরা ফ্যালো । আইজ তাড়াতাড়ি খাইব । আরও কিছু্ গুছানোর আছে্ ‘

নিভাননা আস্তে আস্তে উঠে ভিতরে গেলেন ।

নিশিকান্ত রতনকে ডাকলেন । রতন দরজা লাগাচ্ছিল । নিশিকান্ত রতনকে সব বললেন ।

‘ এখনই যা । আমি দরজা লাগইতেছি্ । সব ব্যবস্থা কইরা আয় ‘ রতন বেরিয়ে গেল ।
নিশিকান্ত দোতলায় উঠলেন । বাইরে তাকালেন । সব অন্ধকার । ডাকলেন ,

‘ চন্দ্রানীমা , শোন’

চন্দ্রানী কাছে এল । ওর দুচোখ ফোলা । নিশিকান্ত বুঝতে পারলেন । বললেন ,

‘ আলো গুলা জ্বালাতো মা । কমলা ঝড়িয়া , যুথিকা রায়ের গানগুলা একবার বাজা । শুনি ‘ নিশিকান্ত তাঁর আরাম কেদারায় বসলেন । ডাকলেন ,

‘ আবু হোসেন আইস । তোমারে বাইশ জোয়ান-তেইশ জোয়ানের গল্প বলি আবার ‘ অন্ধকারে ইন্দ্রানী বাবার কাছে এল । নিশিকান্ত মেয়েকে তুলে আরামকেদারার ডান বাহুতে বসালেন । নিশিকান্ত ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছেন ।

রাত আটটা বাজে । নিশিকান্তরা চারজন মিলে ডালভাত আলুভাজা খেয়েছেন । খাওয়ার সময় ইন্দ্রানী একবার বলেছিল ,

‘ আজ মাছ নাই ক্যান মা ? দুপুরেও ছি্ল না ‘

‘ খাব , শিগগিরই মাছ্ খাব ‘ নিভাননা বলেন ।

নিশিকান্ত সব ঘরের আলো নিভিয়ে দিলেন । কেবল দুটো আলো জ্বলছে । রতন ফিরে এসেছে । গতকালের মত তিনটে ডাশা দিয়ে দরজা ভিতর থেকে লাগিয়ে রামদা হাতে বসে আছে । দুই মেয়ে বিছানায় শুয়ে আছে । আস্তে আস্তে ওরা কথা বলছে শোনা যাচ্ছে ।

নিভাননা তাঁর একটি সায়ার ভিতরে তিন চারটে বড় বড় কাপড়ের পকেট বানিয়েছেন । তাতে তার কিছু সোনা গয়না , টাকা ঢুকিয়ে পকেট গুলোর মুখ সেলাই করে দিলেন । নিভাননার মুখ পাথড়ের মত ভাবলেশহীন । নিশিকান্তও তাঁর প্যান্টের পকেটে কিছু টাকা রাখলেন । আলমারীর ভিতর থেকে বাড়ি-জমির দলিল বের করলেন ।

রাত এগারোটা । নিশিকান্ত নিভাননা বারান্দায় বসে আছেন । চারিদিক অন্ধকার । কোথাও হালকা আলো । নিস্তব্ধ চারিদিকে । কেবল ঝিঁঝিঁর ডাক ।

‘ আমি এই শ্বশুরের ভিটা ছাইড়া কোথাও যামুনা । কিছু্তেই না ‘ নিভননা কেঁদে ফেলেন ।

‘ সুনু , আমাগো যাওন লাগবো মাইয়া দুইটার জন্য ! অদের কথা ভাববা না ?’

নিভাননা চুপ করেন । চারিদিকের নিস্তব্ধতা বড় বেশি বাঙ্ময় ।

হঠাৎ ঈষান কোনে আলোর আভাস । সঙ্গে চিৎকার ,

‘ নারায়ে তাকবির , আল্লাহু আকবর ‘

নিশিকান্তরা বিস্ফোরিত চোখে ধড়মর করে উঠে দাঁড়ান ।

( ২৯ )

ডানদিকে কোনে আধ কিলোমিটার দুরে আবার অনেক মশালের আলো এবং হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে । ঠিক কালকের মতো । নিশিকান্ত নিভাননার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে ।

‘ বাবা ,আবার কাইলকের মতন আসতেছে ! বাবা ..’ চন্দ্রানী ইন্দ্রানী দুজনেই পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে । চন্দ্রানী আর কথা শেষ করতে পারে না । কাঁদত শুরু করে । ইন্দ্রানীও কাঁদছে ।

‘ কাঁইদো না । চল শিগগিরই । মনে জোর রাখ । আমরা পারুম । চ্লো আমরা পালাই ‘ নিশিকান্ত উদভ্রান্তের মত ঘরে ঢুকে রিভলবার কোমড়ে গোঁজেন । ধুতরোর বিচি ভরা শিশি নিভাননার হাতে দেন । তারপর ইন্দ্রানীকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকেন । নিভাননা শিশিটি ভালো করে শাড়ির আঁচলে বাঁধেন । চন্দ্রানীর হাত ধরে নিশিকান্তের পিছনে সিঁড়ি দিয়ে উর্ধশ্বাসে নামতে থাকেন ।

‘ রতন ‘ নিশিকান্ত চিৎকার করলেন ।

রতন দৌড়ে এল ।
‘ কন ডাক্তারবাবু ‘

‘এখনই ধরলার ধারে যা । সুদামাকে রেডি হইতে ক । আমরা আসতেছি্ । পিছো্নের চ্যাকার ( বেড়া ) ফাঁক কইরা রাখছস ?’ নিশিকান্তের উৎকন্ঠিত গলা । বাইরের দরজায় ধাক্কা পড়ছে ।

‘ খোলা আছে্ । আপনার অন্ধকারে যাইতে পারবেন ? আমি আগে যাইতেছি্ । পিছনের ঘরে রাখা কাপড়ের পোটলা গুলান নিয়া যা্ই । এই রাস্তায় অনেকটা আলপথ আছে্ । দুইখান বাশ ঝাড় । শ্যাষ বাশ ঝাড়ের পর কিছুটা ফাঁকা জমি । তারপরই নদী । মনে রাইখেন ডাক্তারবাবু । একখান লন্ঠন সাথে নিয়েন ‘ রতন বাড়ির পিছনে অন্ধকারে মিলিয়ে যায় ।

বাইরের দরজায় ঘনঘন ধাক্কা পড়ছে । কেউ বললে ,

‘ নিশি , একবার দরজা খোল , আমি আবু । তাড়াতাড়ি ‘ নিশিকান্ত ইন্দ্রানীকে কোল থেকে নামালেন । দৌড়ে বাইরের দরজা খুলতে গেলেন ।

নিভননা চন্দ্রানী ও ইন্দ্রানীর হাত ধরে ঝড়ের বেগে একতলায় ঠাকুর ঘরে ঢুকে নারায়নের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন ।

‘ ঠাকুর , আমরা কোন পাপ করি নাই , কোন অন্যায় করি নাই । আমরা তোমায় ছাইড়া চইলা যাইতেছি ‘ নিভননা কাঁদছেন । তাঁর অন্তর আত্মার হাহাকার শোনা যাচ্ছে । দুই মেয়ে মায়ের পাশে দাড়িয়ে হাত জোড় করে কাঁদছে ।

‘ অদের রক্ষা কইরো ঈশ্বর ‘ নিভাননা বারবার মাটিতে মাথা ঠুকতে থাকেন ।

আবু হোসেন দুজন ছেলেকে নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন । আবু হোসেন হাঁপাচ্ছেন । ছেলে দুটো দরজা লাগিয়ে দিল ।

‘ নিশি , শোন অবস্থা খুব খারাপ । মুসলমানেরা আইজ এইদিকে আসতেছে্ । ঘর বাইছা বাইছা হিন্দুদের ঘরে আগুন লাগাইতেছে্ । পুরুষদের খুন কইরা ফেলতেছে্ । মাইয়াদের তুইলা নিয়া যাইতেছে্ ‘

‘ পুলিশ ..পুলিশ নাই ?’ বিহ্বল নিশিকান্ত এইটুকুই বলতে পারেন ।

‘ না । যা্রা ছিল , এত লোক দেইখা ভাগছে্ । কিন্তু আমরা আছি্ । তর বন্দুক অদের হাতে দে ‘ আবু হোসেন নিশিকান্তের কোমড় থেকে বন্দুক নিয়ে সঙ্গের ছেলেদের একজনের হাতে দিলেন । নিশিকান্ত বন্ধুর হাত ধরলেন ।

‘ আবু , এই বাড়ি জমির দলিল তর কাছে থুইয়া গেলাম । যদি আর কখনও আসতে না পারি এই সব তোর । আমি অদের নিয়া পিছন দিক দিয়া পালাই । ধরলায় নৌকা ধরব ‘

‘ আল্লাহু আকবর ‘ চিৎকার বাড়ির কাছে এসে গেছে । দরজায় উপুর্যপুরি ধাক্কা পড়ছে । তিন চারটে মশাল দোতলায় পড়ল । কিছু বাগানে । দরজা ভেঙে গেল । চিৎকার করতে করতে লোক ঢুকছে । যে ছেলেটি রিভলবার হাতে নিয়েছিল , সে গুলি ছুঁড়েও আটকাতে পারল না । মুহূর্তের মধ্যে একটি ছুরি তার বুকে ঢুকল । ‘ আল্লাহ ‘ বলে আর্তনাদ করে মাটিতে পড়ে গেল । নিশিকান্ত পিছু হটছেন । সামনে আবু হোসেন । তাঁর মেয়ে কন্যারা কোথায় ?

‘ কি নিশি ডাক্তার ? কথা মিলল ? তর মেয়ে বৌ কোথায় ?’ খোদাবক্স অন্ধকারে মশালের আলোয় বেরিয়ে এল । ওর হাতে রাম দা ।

দুইজন নিভাননা ও দুই মেয়ের হাত ধরে ঠাকুর ঘর থেকে টেনে আনল । নিভাননার চিৎকার শোনা যাচ্ছে ,

‘ ছাইড়া দাও , ছাইড়া দাও আমাগো ! এত বড় অধর্মের কাজ কইরো না !’

নিভাননার শাড়ি খুলে ফেলা হয়েছে । চন্দ্রানীর শাড়ি ছেঁড়া । ইন্দ্রানীর গায়ের জামা ছিড়ে ফেলা হয়েছে । ইন্দ্রানী চিৎকার করে কাঁদছে । নিভাননা শায়া ও ব্লাউজ পরে মাটিতে হাঁটু মুড়ে বসে মুখ ঢেকে কাঁদছেন । চন্দ্রানী মায়ের পাশে বসে আতঙ্কে কাঁপছে ।

দুইজন নিশিকান্তকে চেপে ধরে আছে । আবু হোসেন পাশে নিস্ফল আক্রোশে ফুঁসছেন ।

‘ কি নিশি ডাক্তার ! দ্যাখ তর বৌ মাইয়ারা এখন গনিমতের মাল ! তর সামনেই অদের ….’ খোদাবক্সের শয়তানের হাসি ।

‘ খবর্দার ‘ বলে আবু হোসেন এক লাফে নিভাননাদের সামনে দাঁড়ালেন । মুহূর্তের মধ্যে মশালের আলোয় খোদাবক্সের রামদা চকচক করে উঠে আবুহোসেনের গলায় এসে পড়ল । আবু হোসেনের মাথা একদিকে ছিটকে গেল । ধড় চারিদিকে রক্ত ছিটিয়ে কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে পড়ল ।

‘ আবুরে ! ‘ বলে নিশিকান্ত চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন ।

( ৩০ )
“ আমার সৌরভ্রমন সম্পন্ন হলে তুমি এই ভাবে মানবজনম দিও ঈশ্বরী । আরেকবার উত্তীর্ণ হতে চাই জীবনের এই পাঠ , এই পরীক্ষা “
………………………………………………………………….

আবু হোসেনের মাথা একদিকে পড়ে আছে । ধড় একদিকে । ছিটকে আসা রক্ত নিভাননা , তাঁর মেয়েদের গায়ের ওপর পড়েছে । দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের গায়ে পড়েছে। কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়া নিশিকান্তের মুখে পড়েছে । এমন বীভৎস ঘটনায় খোদাবক্সের রামদা হাতে ‘ আল্লাহু আকবর ‘ চিৎকার । দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের গলায়ও একই হুঙ্কার ধ্বনি ।

বেশিক্ষন এই তান্ডব স্থায়ী হল না । কয়েকজন লোক তরোয়াল রামদা কুড়ুল নিয়ে নিশিকান্তের বাড়িতে ঢুকে পড়ল । একজন দীর্ঘদেহী ‘ শূয়ারের বাচ্চা ‘ বলে চিৎকার করেই হাতের কুড়ুলটা ছুঁড়ে মারল । এক মুহূর্তে খোদাবক্স মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ল । তার পিঠে কুড়ুলটা ঢুকে গেছে ।

দীর্ঘদেহী এক মুহূর্ত আবু হোসেনের ধড় ও মাথা দেখে হাতের তরোয়াল দুহাতে ধরে সমানে চারিদিকে ঘোরাতে লাগল । তাঁর সঙ্গীরাও একই কাজ করছিল । অল্পক্ষনেই আক্রমনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল । দীর্ঘ মানুষটি চিৎকার করলেন ,

‘ আইজ সব শালার হিসাব নিব ‘ তারপর দৌড়ে নিশিকান্তকে ঝাঁকিয়ে তুললেন । নিশিকান্তের চেতনা লুপ্তি হয়েছিল । মানুষটি নিশিকান্তকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেন ,

‘ ডাক্তারবাবু খাড়া হন । আমি বদরুদ্দোজা । ডাক্তারবাবু চখ খুইলা দ্যাহেন ! আপনে মা জননী আর মাইয়াদের নিয়া পিছনের রাস্তা দিয়া বাইরান । শিগগিরই । আমি এই কুত্তাগুলানরে দেখতাছি্ । আইজ শালা দুনিয়ার পাপ পূইণ্যের হিসাব মিটায় দিব । শিগগিরই যা্ন ডাক্তার বাবু ‘

নিশিকান্তের চেতনা ফিরেছে । নিশিকান্ত তাঁর দুই কন্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে পেছনের আলপথে ছুটছেন । নিভাননার গায়ে ব্লাউজ আর সায়া । প্রানপনে ছুঠছেন । একবার দাঁড়ালেন । হাঁপাচ্ছেন সবাই । মাথা ঘুরিয়ে দেখলেন , বাড়িটা জ্বলছে । এখান থেকে দেখা যাচ্ছে বদরুদ্দোজা ও তার সঙ্গীদের সঙ্গে দাঙ্গাকারীদের তুমুল মারামারি হচ্ছে । নিশিকান্তরা দৌড়তে থাকলেন । প্রাণ বাঁচাতে নিজের দেশ মাটি ঘর ছেড়ে কিছু মানুষ পালাচ্ছে । পেছনে কয়েকজন ছুটে আসছে । মুখে আওয়াজ

‘ নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর ‘

‘ বাবা আর পারতেছি্ না ‘ চন্দ্রানী হাঁপায়

‘ দম ফাইটা যাইতেছে্ ‘ নিভাননা বলেন

‘ বাবু পায়ে কাঁটা ফুটছে্ ‘ ইন্দ্রানী কাঁদছে

নিশিকান্ত অন্ধকার আলপথে দাঁড়ান । কোথায় যাবেন ! এই তো বাঁশঝাড় একটা ! নিশিকান্ত সপরিবারে বাঁশঝাড়ের জঙ্গলে ঢুকে পড়েন । দূরের কয়েকটা লোক মশাল নিয়ে কাছে চলে আসছে । বাঁশঝাড়ের ঝোপ খুব উঁচু নয় । নিশিকান্ত বললেন ,

‘ শিগগিরই তোমরা মাথা নিচু কইরা বস । তাড়াতাড়ি ‘ নিভাননা ,চন্দ্রানী ইন্দ্রানী নিশিকান্ত হামাগুড়ি দিয়ে ঝোপের ভিতর লুকিয়ে আছেন ।

বাইরের লোকরা মশাল হাতে চারিদিক খুঁজছে । একজন বললে ,

‘ কোথায় গেল কাফির গুলা ?’

‘ এতদূর হয়ত আসে নাই । দাঁড়া এইখানে ‘ লোকগুলো মশাল হাতে চারপাশে খুঁজতে থাকে ।

‘ বাবু ,পায়ে লাগতাসে্ ‘ ইন্দ্রানী কাঁদে ।

‘ চুপ চুপ , কথা কইও না ‘ নিশিকান্ত ফিসফিস করে বলে ইন্দ্রানীর মুখ চেপে ধরেন ।

ঝিঁঝিঁ ডাকছে । জোনাকি উড়ছে । চারটে প্রানী প্রাণ ভয়ে কাঁপছে । কিছু মানুষরূপী শ্বাপদ রাতের অন্ধকারে শিকার খুঁজছে ।

কতক্ষন হল ! ঠাওর হচ্ছে না । মশার কামড়ে অতীষ্ঠ সবাই । কোন আত্তয়াজ করা যাচ্ছে না । নিশিকান্ত ঘড়ি পরে আসতে পারেন নি ।

দুজন লোক বাঁশঝাড়ের কাছে এসে পড়েছে ।

‘ এই ঝো্পের ভিতর লুকায় নাই তো ? দেখিতো ‘

মশাল হাতে একজন এগিয়ে আসছে । চারজনের হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক দ্রুত চলছে । চারজন পরস্পরকে শ্বাস বন্ধ করে আঁকড়ে ধরে আছেন । পিছন থেকে একজন বললে ,

‘ ঐ খানে নাই ! ঐ টুকু ঝো্পে চাইরজন থাইকতে পারে ? আলপথ থিকা নাইমা ঐ মাঠের মধ্যে দিয়া গ্যাছে কিনা দেহি , চল ‘

মশালধারীরা মাঠের দিকে নেমে গেল ।

আর কিছুক্ষন অপেক্ষা করে নিশিকান্তরা বাঁশঝাড় থেকে বেরিয়ে আলপথ দিয়ে ছুটতে লাগলেন ।

‘ বাবু , জল খাব ‘

‘ আর এট্টু চলো , তারপর ‘ সামনে আরএকটা বাঁশঝাড় । এটার কথাই বোধহয় রতন বলে ছিল । নিশিকান্তরা দ্বিতীয় বাঁশঝাড়ে ঢুকে পড়লেন । সামনে অন্ধকারে কিছু বোঝা যায় না । চারটি প্রানী কুন্ডলিত হয়ে বসে আছেন । এখন ভীষন শারীরিক অবসাদ আসছে ! চন্দ্রানী ইন্দ্রানী ঘুমিয়ে পড়ল । এক নর ও এক নারী কেবল তারা ভরা আকাশের নিচে বসে শূন্য মনে পরস্পরের হাত ধরে থাকল ।

পুব আকাশে একটু আলো দেখা যাচ্ছে । নিশিকান্ত মাথা উঁচু করে দেখলেন , সামনে ঢাল জমি আর ঐ দূরে ধরলা । নিশিকান্ত মাথা ঘুরিয়ে দেখলেন নিভাননা চোখ বুজে আছেন । নিজের গায়ের জামাটি খুলে নিভাননার গায়ে দিলেন । তারপর একটু ধাক্কা দিয়ে বললেন ,
‘ সুনু , চল যাই ‘

নিভাননা নিশিকান্তের জামা দিয়ে শরীরের উর্ধ্বাংশের আব্রু ঢেকে দুই মেয়েকে নিয়ে নিশিকান্তের পিছনে ঢাল জমিতে নামতে লাগলেন ।

নিশিকান্ত ডাকলেন ,

‘ রতন , রতন ‘

‘ ডাক্তারবাবু আসছেন ! আমার খুব ভয় করতেছি্ল ‘ রতন ছুটে আসে । ও কাঁদছে ।
সুদামা নৌকা নিয়ে তৈরী ছিল । নিশিকান্তরা নৌকায় উঠলেন । সুদামা নৌকার কাছি খুলে নিল । ও নৌকা বাইছে । নৌকা সীতারহাটের মাটি ছেড়ে কুচবিহারের দিনহাটার দিকে চলতে লাগল । রতন নদীর তীরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে আর হাত নাড়ছে । চারটে প্রানী নৌকায় বসে সীতারহাটের দিকে তাকিয়ে আছে । সীতারহাটের আকাশ কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে ।

‘ মাগো ! ‘ বলে নিশিকান্ত দুহাতে মুখ ঢেকে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলেন ।

( সমাপ্ত )