ত্রিবেণী কুম্ভমেলা – বাঙ্গালার ধার্মিক ঐতিহ্য ও হিন্দু প্রতিরোধের গৌরবময় ইতিহাস

tribeni kumbhamela

বাঙ্গালার প্রাচীন জনপদ ও পবিত্র তীর্থক্ষেত্র হলো সুহ্মক্ষেত্রে অধিষ্ঠিত ত্রিবেণীধাম । যমুনা, গঙ্গা ও সরস্বতী নামে তিনটি নদীর মিলন থেকে ত্রিবেণী নামটি পাওয়া যায়। সম্ভাব্য পূর্বে নামগুলি ছিল “মুক্তবেণী”, প্রয়াগে অবস্থিত গঙ্গার উপনদীনির্মিত যুক্তবেণী ত্রিবেণীতে এসে বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে তৈরি করে মুক্তবেণী ।

“ত্রিস্রো বেন্য: বারিপ্রবাহা বিযুক্তা বা যত্র”

ত্রিবেণী স্নানের অর্থ নিদ্রিতা শক্তি কুন্ডলিনীর জাগরণ । ত্রিবেণীস্নান মূলাধার পক্ষে হয়, যেখানে ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না এই তিনটি নাড়ি একসাথে মিলিত হয়েছে । এক্ষেত্রে সরস্বতী নদী সুষুম্না হিসেবে কল্পিত, বামে যমুনা নদী ইড়া ও দক্ষিণে গঙ্গা নদী হলো পিঙ্গলা । এই গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতীর সঙ্গমস্থল ত্রিবেণীধাম হলো মুলাধার । তাই ত্রিবেণীতে স্নান করলে সাধকের সুপ্ত শক্তি জাগ্রত হয়, জ্ঞানলাভের পথ প্রশস্ত হয় এবং স্নানার্থী অপার্থিব শান্তিলাভ করে । তাই ত্রিবেণীধামে স্নান পরম পবিত্র বলে এই স্থান পুণ্যক্ষেত্র বলে কথিত । সাধকরঞ্জন উল্লিখিত ত্রিপদী ছন্দের একটি কাব্য থেকে পাওয়া যায় –

“ইড়া বাসস্থানে পিঙ্গলা দক্ষিণে
মধ্যে নাড়ি সুষুম্না ।।
বামে ভাগীরথী মধ্যে সরস্বতী
দক্ষিণে যমুনা বয় ।
মূলাধারে গিয়ে একত্র হইয়ে
ত্রিবেণী তাহারে কয় ।।”

বিখ্যাত হিন্দু দার্শনিক এলাকা “শ্মশান ঘাট”-এর পাশ দিয়ে সরু নদীখাতে প্রবাহিত হত সরস্বতী নদী যা ছিল সপ্তগ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিমে। পরে এই নদীপথ ছেড়ে গঙ্গা নদী বিশেষ করে হুগলি বা ভাগীরথী নামে পরিচিত হয়ে সমুদ্রে মিলিত হয়। ব্রহ্মপুরাণে ত্রিবেণীমাহাত্ম্যে বর্ণিত হয়েছে ত্রিবেণীসদৃশ পবিত্র পুণ্যক্ষেত্র জগতে দ্বিতীয় আর নেই –

“ন মাধব সমো দেব ন চ গঙ্গা সম দেবী ।
ন তীর্থরাজসদৃশং ক্ষেত্রমস্তি জগত্রয়ে ।।”

ত্রিবেণীসঙ্গমে স্নান তীর্থযাত্রার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ‘ঋগ্বেদ পরিশিষ্ট’ খণ্ডে । মহাভারতে অতীতের ভুল এবং অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত তপস্যার উপায় হিসাবে ত্রিবেণীসঙ্গমে স্নান তীর্থযাত্রার উল্লেখ রয়েছে। ৭ম শতাব্দীর বৌদ্ধ চীনা পরিব্রাজক জুয়ানজাং (হিউয়েন সাং) গৌড়াধিপতি মহারাজাধিরাজ শশাঙ্কদেবের শাসনকালে প্রয়াগ ক্ষেত্রের উল্লেখ করেছেন, যাকে তিনি শত শত “দেব মন্দির” এবং দুটি বৌদ্ধ মঠসহ একটি পবিত্র হিন্দু শহর বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি নদীর সংযোগস্থলে হিন্দু স্নানের আচারের কথাও উল্লেখ করেছেন।

মরক্কোর পরিব্রাজক ইবনবতুতা তাঁর ‘কিতাব-অল-রোহিলা’ ভ্রমনবৃত্তান্তে স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন, গঙ্গা ও যমুনার সংযোগস্থলে বাঙ্গালার সপ্তগ্রাম বন্দর সংলগ্ন ত্রিবেণী তে মুশরিকদের একটি তীর্থযাত্রার সমাবেশ হয় । দশম শতাব্দীতে কবি বিপ্রদাস পিপলাই এর মনসামঙ্গল গ্রন্থে চন্দ্রপতি বণিকের মধুকর ডিঙ্গা ত্রিবেণী প্রবেশের বর্ণনা নিম্নরূপ –

“দেখিয়া ত্রিবেণী গঙ্গা চাঁদরাজা মনে রঙ্গা
কুলেতে চাপায় মধুকর ।”

আইন-ই-আকবরির লেখক আবুল ফজল ত্রিবেণীতে গঙ্গা যমুনা ও সরস্বতীর উল্লেখ করেছেন । ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম হেজেস ও ১৭৬৯-৭০ খ্রিস্টাব্দে স্ট্যাভরিনাস ত্রিবেণী পর্যবেক্ষণ করেছিলেন । দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত ‘গঙ্গাভক্তি তরঙ্গিনী’ গ্রন্থে ত্রিবেণীধামের উল্লেখ রয়েছে । ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে জেমস রেনেলের বাংলার মানচিত্রে “টেরবোনি” নামে অভিহিত করা হয়েছিল।

বাংলায় সংস্কৃতচর্চার জন্য চারটি স্থান অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ছিল – নবদ্বীপ, ভাটপাড়া, গুপ্তিপাড়া ও ত্রিবেণী । ত্রিবেণী সংস্কৃত শিক্ষাকেন্দ্রে মোট ৩০ টির অধিক গুরুকুল ছিল । এই স্থানে মকরসংক্রান্তি, বিষ্ণু সংক্রান্তি, দুর্গাপুজো, দশহরা, বারুনী, সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণ প্রভৃতি হিন্দুপর্ব উপলক্ষে লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম হতো এবং সেই উপলক্ষ্যে মেলা বসতো । ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে ত্রিবেণীধামে মোট ৫৩০০০ ভক্তের সমাগম হয়েছিল, যার মধ্যে একমাত্র মেদিনীপুর থেকেই ৩০০০০ ভক্ত সমাগত হয়েছিল ।

সরস্বতী নদীর তীরে ত্রিবেণী সংলগ্ন বাংলার প্রাচীন ও এককালীন সমৃদ্ধশালী বাণিজ্যবন্দর হলো সপ্তগ্রাম । দক্ষিণ রাঢ়বাংলার সুহ্মদেশ এর রাজা প্রিয়বন্ত’র মোট সাতজন পুত্র ত্রিবেণীধাম সংলগ্ন এই স্থানে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাই এর নাম সপ্তগ্রাম । আচার্য রঘুনন্দনের ‘প্রায়শ্চিত্ততত্ত্বে’ উল্লেখ রয়েছে,

“দক্ষিণ প্রয়াগ উন্মুক্তবেণী সপ্তগ্রামোখ্যা
দক্ষিণা দেশে ত্রিবেণী খ্যাত:।”

খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে রোমান লেখক প্লিনি দ্য ইউলার এর বর্ণনাতে উল্লেখ করেছেন, সপ্তগ্রাম ভারতের এক বৃহৎ বন্দর ও সমুদ্রগামী জাহাজসকল সপ্তগ্রাম যাতায়াতকালে ত্রিবেণীতে নোঙর করতো । ১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে ভেনেশিয় পর্যটক সিজার ফ্রেডরিক তাঁর ভারত ভ্রমণ বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন বিশাল সপ্তগ্রাম বন্দরে মোট ৩০-৩৫ টি জাহাজে মাল তোলা হতো । ইংরেজ পর্যটক বণিক রালফ ফিচ বলেছেন, “উত্তর আফ্রিকার শহরগুলির তুলনায় সপ্তগ্রাম রূপকথার নগরী ।” ষোড়শ শতকে মহারাজ রুদ্রনারায়ণ এর নেতৃত্বে সপ্তগ্রাম অঞ্চল ভূরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় । ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের পৃষ্ঠপোষনায় সপ্তগ্রাম অঞ্চলে সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের ব্যবসায় প্রভূত উন্নতি হয়েছিল এবং তারা তীর্থক্ষেত্রে প্রচুর দানধ্যান করতেন। ভূরিশ্রেষ্ঠ শাসনে সুবর্ণবণিকদের সমৃদ্ধি প্রসঙ্গে কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী লিখেছেন –

“সপ্তগ্রামের বেনে সব কোথা নাহি যায় ।
ঘরে বসে সুখ মোক্ষ নানা ধন পায় ।।
তীর্থ মধ্যে পুণ্যতীর্থ অতি অনুপম ।
সপ্তঋষি শাসনে বলয়ে সপ্তগ্রাম ।।”

● ত্রিবেণী ধামের হিন্দু প্রতিরোধ :

১) মহানাদের যুদ্ধ (১৩০৫ খ্রি:) :

১২৯২ খ্রিস্টাব্দে দিল্লি সালতানাত এর সিপাহসালার বাহরাম আইতিগিন জাফর খান গাজী ত্রিবেণী আক্রমন করে । জাফর খানের নির্দেশে তুর্কি সেনা ত্রিবেণীতে প্রচুর গণহত্যা চালায়, হিন্দুদের ধর্মীয় শোভাযাত্রা বন্ধ করে দেয় ও ত্রিবেণীর পালযুগে নির্মিত একটি বিষ্ণু মন্দির ভেঙে দেয় । পবিত্র তীর্থক্ষেত্র ত্রিবেণীধামে জাফর খান হিন্দুদের জমায়েত নিষিদ্ধ করে এবং কুম্ভমেলা বন্ধ করে দেয় ।

এমন সময় বর্ধমানভুক্তির মহারাজা ভূদেব রায় ত্রিবেণী পুনরুদ্ধার ও হিন্দু শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধযাত্রা শুরু করেন । ১৩০৫ খ্রিস্টাব্দের মাঘী পূর্ণিমার দিন রাজা ভূদেব রায়ের নেতৃত্ব ১৫০০০ বর্ধমান সেনা ত্রিবেণী আক্রমণ করে । ইটাচুনার কাছে মহানাদের প্রান্তরে রাজা ভূদেব রায় আর জাফর খান গাজীর সাক্ষাৎ হয় । মহানাদের প্রান্তরে বর্ধমান সেনার সাথে দিল্লি সালতানাত এর সেনার প্রবল যুদ্ধ শুরু হয় । এই যুদ্ধে মহারাজা ভূদেব রায় দিল্লির সেনাকে পরাস্ত করেন ও জাফর খান গাজীর মুণ্ডচ্ছেদ করে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেন । বর্ধমানের হিন্দু সেনা ত্রিবেণী ও সপ্তগ্রাম বিজয় করে, ত্রিবেণীধামে পুনরায় হিন্দু শাসন প্রতিষ্ঠা হয় এবং পুনরায় কুম্ভমেলা শুরু হয় ।

২) সপ্তগ্রামের যুদ্ধ (১৩৭৩ খ্রি:) :

চতুর্দশ শতকে বিহার-লক্ষ্নৌতির ইলিয়াস শাহী গভর্নররা পুনরায় সপ্তগ্রাম দখল করে হিন্দুদের কুম্ভমেলা বন্ধ করে দেয়। এর বিরুদ্ধে রাঢ়ভূম ও বঙ্গভূম দুই অঞ্চলেই প্রবল প্রতিরোধ শুরু হয় । দেববংশীয় কুলতিলক বঙ্গাধিপতি মহারাজ দনুজমর্দনদেব, যশোরের রাজা মুকুট রায়, গোপভূমের রাজা মহেন্দ্র সিংহ গোপ,কাটোয়ার রাজা আকিঞ্চন যশ ও হিজলিপতি রাজা হরিদাস ভৌমিকের সহিত ঐক্যবদ্ধ জোট নির্মাণ করে ইলিয়াস শাহী কেন্দ্র ‘ওলায়েৎ এ সাতগাহ’ (اولایت آ ساتگا) আক্রমন ও বিজয় করেন । তাঁদের সম্মিলিত বঙ্গজ ও রাঢ়ীয় সৈন্যবর্গের যৌথ আক্রমণে সপ্তগ্রাম পুনরুদ্ধার হয় ও ত্রিবেণীধামে কুম্ভমেলা পুনঃসূচনা হয় । ইবন বতুতার বিবরণী থেকে জানা যায় এসময় বাংলার কাফের রাজারা সম্মিলিতভাবে লক্ষ্নৌতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করে এবং হিন্দুরা ত্রিবেণীতে মহাসমাগম শুরু করে ।

৩) হুসেন শাহের উড়িষ্যা আক্রমন ও কুম্ভমেলা নিষিদ্ধকরণ (১৫০৫ খ্রি:) :

১৫০৫ সালে ঘুর-বিহারের সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ উড়িষ্যা আক্রমনের জন্য এই অঞ্চল দখল করে । তিনি সপ্তগ্রাম থেকে ত্রিবেনি যাওয়ার জন্য সেতু নির্মাণের আদেশ দেন এবং এই অঞ্চলে কাফের হিন্দুদের জমায়েত নিষিদ্ধ করেন । তিনিই ত্রিবেণীর কুম্ভমেলা পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ করে দেন । উড়িষ্যা আক্রমণ করে তিনি বহু মন্দির ধ্বংস করেন ।

৪) ত্রিবেণীর যুদ্ধ (১৫৭৫ খ্রি:)

১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে ভূরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের মহারাজা রুদ্রনারায়ণ টাণ্ডার কাররানী আফগান সুলতান সুলেমান খান কাররানীকে ত্রিবেণীর যুদ্ধে পরাজিত করে সপ্তগ্রাম বিজয় করেন । ভূরিশ্রেষ্ঠ সীমান্তে ত্রিবেণী নামক স্থানে পাঠান সৈন্যের সাথে ভূরিশ্রেষ্ঠ সৈন্যের যুদ্ধ শুরু হয় । ভূরিশ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনীর সেনানায়ক ছিলেন রুদ্রনারায়ণ এর ভাই রাজীবলোচন রায়ভাদুড়ি । “কুমারসদৃশ বীর্যশালী মহাবীর রাজীবলোচন বেগবান তুরঙ্গমোপরি আরোহণ করিয়া নিষ্কষিত অসি-হস্তে শত্রুব্যূহ ভেদ করতঃ অগণিত সুলতানি সৈন্য ধ্বংস করিতে আরম্ভ করিলেন ।” সম্পুর্ন দিবস ভীষণ যুদ্ধের পর অবশেষে পরাজিত হয়ে সুলতানি সেনা পালিয়ে যায় ও ত্রিবেণীধামে ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যর শাসন প্রতিষ্ঠা হয় । যুদ্ধজয়ের প্রতীক স্বরূপ মহারাজা রুদ্রনারায়ণ ত্রিবেণীধামে গৌড়ীয় রীতিতে বিষ্ণুমন্দির ওএকটি বিজয়স্তম্ভ নির্মাণ করেন । এছাড়াও তিনি গঙ্গাতীরে গজগিরি-সংলগ্ন একটি ঘাট নির্মাণ করেন । মহারাজা রুদ্রনারায়ণ এর রাজসভায় কবি মাধবাচার্য চণ্ডীমঙ্গল কাব্য রচনা করেন, সেখানে তিনি ভূরিশ্রেষ্ঠের ব্রাহ্মণবংশীয় রাজাকে শ্রীরামচন্দ্রের সাথে তুলনা করে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন-

“অপার প্রতাপী রাজা বুদ্ধি বৃহস্পতি ।
কলিযুগে রামতুল্য প্রজাপালে ক্ষিতি ।।
সেই পঞ্চগৌড় মধ্যে সপ্তগ্রাম স্থল ।
ত্রিবেণীতে গঙ্গাদেবী ত্রিধারে বহে জল ।।
সেই মহানদী তটবাসী পরাশর।
যাগ-যজ্ঞে জপে তপে শ্রেষ্ঠ দ্বিজম্বর ।।”