– – শ্রীমতী অনুরূপা দেবী
তোমার নিকটে পাওয়া অসীম ঋণের ভার
বড় সাধ ছিল মনে কিছু শোধ করিবার।
হে মোর শৈশব সখা, হে আমার শিক্ষা-গুরু,
হে মোর করুণানিধি, ওগো স্নেহ-কল্পতরু।
কি তুমি দাওনি মোরে? কি’ দিতে রেখেছো বাকি
সুদীর্ঘ জীবনে আজও মিলিলনা কোন ফাঁকি।
তোমার আশ্রম ছিল পৌরাণিক-তপোবন
হে মহর্ষি, হে ব্রহ্মর্ষি, ওগো মহা-তপোধন,
অন্তে-বাসী ছাত্রদের অধ্যয়ন মুখরিত,
দেব-দেবী স্তোত্র-গানে দেবভাষা ঝঙ্কারিত,
প্রত্যহ সন্ধ্যায় প্রাতে ললিত কাকলী তুলি,
গাহিত উদাত্ত স্বরে তব গৃহ-শিশুগুলি।
কুটীর ছিলোনা বটে; প্রাসাদের পাদমূলে
বহিতেন সুরধুনী কল কল কূলে কূলে।
সুরভিত গৃহদ্যানে অসংখ্য ফুলের মাঝে,
মুনিবালাদের মত সাজিয়াছি ফুলমাঝে,
পূজার কুসুম তুলি গাঁথিয়াছি ফুলমালা
দেব-গৃহ সাজায়েছি উজাড়িয়া ফুলডালা।
শিব-সম পতি-লাগি পূজা করিয়াছি হরে,
আশ্রিতে ও আত্মজনে খাদ্য দে’ছি আত্ম করে।
শিক্ষা-গুরু ছিলে তুমি বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যার,
বহিতে পারেনি অন্যে, পরে এত গুরুভার!
পরকার্যে বহুলোকে করে আত্ম-নিয়োজন;
হে মহা-শিক্ষক, তুমি ভুল নাই আত্ম-জন।
শুনি সাম্য-বাদ ধ্বনি, দেখেছি তোমার ঘরে
এক অন্নে এক বস্ত্রে এক শিক্ষা আত্ম-পরে,
পাইতে সমান স্নেহে আপন সন্ততিসহ
দরিদ্র অনাথ বন্ধু মিশেছিল অহরহ।
অভাগ্য-অস্পৃশ্য-শিশু দিয়ে গেছ গৃহে স্থান,
অনাথ সমাজ-ত্যাক্ত সমভাবে লভি মান
তোমার সংসারে; পরে পদস্থ, গৃহস্থ কত
ধনে-পুত্রে লক্ষী লভি হইয়াছে সম্মানিত;
দাতব্য চিকিৎসা লভি কত আর্ত পেলে ত্রাণ,
সংস্কৃত-শিক্ষার লাগি সুবিখ্যাত মহাদান।
তব পূত “পুষ্পাঞ্জলি” গ্রহণ করিয়া পায়,
হে মহা সাধকরাজ! তব পুণ্য কল্পনায়
“হরিৎ অম্বরধরা।” “শুভ্র-হিম-কিরিটিনী,”
“ভারত জননী” মূর্তি তোমারি সৃজিতা ইনি।
“হেমচন্দ্রে” “বঙ্কিমেতে” মাতৃমন্ত্র করি দান,
তুমি প্রচারিলে বঙ্গে “বন্দেমাতরম” গান।
আ-সমুদ্র হিমাচল তব মাতৃ-কল্পনায়,
বঙ্কিম সমগ্রে ছাড়ি বন্দে হেন্ বাংলা-মায়।
“ভারত বিলাপ” গাথা হেমের শিঙার-তানে
প্রচারিত করে দেছ দেশিকের কানে-প্রাণে,
“রামদাস” সাক্ষী রেখে ঊনবিংশ পুরাণেতে,
দেশের দারুণ-দশা লিখে গেছ পাতে-পাতে।
“পরিবার” -কর্তব্যের নিত্য-কর্ম-পদ্ধতির,
তোমার “প্রবন্ধ”গুলি সনাতন চিরস্থির,
সমাজ-রাষ্ট্রের বার্তা “সামাজিকে” বিবিধের,
গভীর চিন্তার ফল, তুলনা নাহিক এর,
প্রগাঢ় দেশাত্মবোধ সাথে যোগ-দৃষ্টিবল
ভবিষ্য-আঁধার ভেদি দেখেছে ভবিষ্য ফল।
দেখেছি তোমার গৃহে বাংলার মনিষীগণে,
শিষ্যরূপে বন্ধুরূপে সৎ সাহিত্য আলাপনে,
“হেমচন্দ্রে” “বঙ্কিমেরে” “অক্ষয়ে” ও “চন্দ্রনাথে”
সর্ব ভারতীয় সুধী দেখিয়াছি একই সাথে,
দেখেছি ইংরেজ, বর্মী, শিখ, হিন্দু-মুসলমান,
মহারাষ্ট্রী, গুজরাতি, উড়িষ্যার অভিযান।
দেখিয়াছি জমিদার, রাজা, রাজ্-কর্মচারী,
দরিদ্র বান্ধব বন্ধু সমতুল্য সঙ্গে তারই;
সমান সম্ভ্রমে স্নেহে হইয়াছে সম্পূজিত,
বরঞ্চ পেয়েছে বেশী রুগ্ন তাপী, দুঃখ-হত।
কুটুম্বে আত্মীয়ে পরে এতখানি অধিকার,
সহায়তা প্রেম-প্রীতি দেখি নাই কোথা আর!
সবাই ভেবেছে মনে সর্বশ্রেষ্ঠ তারই মান,
হয়েছিল তব কাছে সর্ব-উচ্চে তারই স্থান!
এই তব জীবনের মহত্তম পরিচয়,
প্রাতঃস্মরণীয় তাই আজও তোমা লোকে কয়।
দেবতা দেখিনি দেব! তোমাকে দেখিয়া তাই
লোক-পিতামহ যিনি পরিচয় তাঁরই পাই।
দশবিদ্যা রূপে তুমি পূজিয়াছ গৃহিণীরে,
গৃহলক্ষী হারালেও হারাওনি মা-লক্ষীরে,
নারায়ণ নিত্যবন্ধু নারী যেথা সম্পূজিতা
নারীরে মর্যাদা দিয়া দেখালে সে সার্থকতা।
বলিবার কত আছে – প্রকাশের ভাষা নাই।
গগনের চন্দ্র-সূর্য ছবিতে আঁকিতে চাই!
তোমার জ্যোতিষ্ক রূপে ছিল যারা চারিধারে,
আজ তারা অস্ত গেছে জীবনের পরপারে।
ভারতের মুক্তি-যজ্ঞে নিয়েছিল যারা ভার,
ভুলিতেছে বঙ্গবাসী তুমি যে প্রধান তার;
প্রথম বিপ্লববাদী তোমারে মানিয়া গুরু
তোমারই ইঙ্গিত বুঝে করেছিল কার্য শুরু।
“ভারত মাতার” মূর্তি আজ বিশ্বে সম্পূজিত
বাঙ্গালীই দেখায়েছে; ছিল তব ধ্যানগত!
হে ঋষি! ভবিষ্য-দ্রষ্টা! দেশের নেতৃত্ব দায়,
“সুভাষেরই” মধ্য দিয়ে ফেরেনি কি বাংলায়?
“গুপ্ত মন্ত্র সাধনেতে” “মনোভব-গুহামাঝে”;
“মহাশব-সাধনায়” -আজও সে ধ্যানস্থ আছে;
যুগ-সন্ধিক্ষণে এলে সাথে কত শত কর্মবীর,
তোমাদেরই অনুসরি উচ্চশির বাঙ্গালীর।
পেয়েছি যা’ তব কাছে কণামাত্র শুধিবার,
সাধ্য মোর হইল না; অসীম এ ঋণভার।
তোমার এ ঋণ মোর তখনই সমাধা হ’বে,
এ জীবন পুষ্পাঞ্জলি ও চরণে দিব যবে।
কিছু কথা – শ্রীমতী অনুরূপা দেবী দ্বারা লিখিত এই কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল আশ্বিন, ১৩৬৪ সাল (ইংরেজি – ১৯৫৭ সাল) দেব সাহিত্য কুটীরের “নব পত্রিকা” নামক পূজাবার্ষিকীতে, স্বীয় পিতামহ শ্রী ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের প্রতি এক শ্রদ্ধার্ঘ হিসেবে।
শ্রী ভূদেব মুখোপাধ্যায় (১৮২৭ – ১৮৯৪) পেশাগতভাবে ছিলেন এক শিক্ষক এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গের নবজাগরণের এক অন্যতম পুরোধা। তাঁর দ্বারা লিখিত প্রবন্ধ সকল, আধুনিক চিন্তাসমুহ তৎকালীন নবীন সাহিত্যগোষ্ঠীর মধ্যে এক গভীর প্রভাব সৃষ্টি করে যাঁদের অন্যতম হলেন শ্রী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও শ্রী হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। বাংলা ভাষা ব্যতিরেকে তিনি হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষা নিয়ে প্রভূত উৎসাহ ও তদজনিত কর্মতৎপরতার পরিচয় রেখেছেন। স্কুল পরিদর্শক থাকাকালীন বিহারে প্রদেশে তিনি বহু হিন্দি স্কুল স্থাপন, বাংলা বইয়ের হিন্দি অনুবাদ প্রকাশ ও মূল হিন্দি বই লেখায় সচেষ্ট ছিলেন। সংস্কৃতর প্রতি তাঁর আত্মিক অনুরাগের পরিচয় হিসেবে (মূলত ভাষার উন্নতির জন্য) তিনি তাঁর পিতার নামে বিশ্বনাথ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছিলেন এবং চতুষ্পাঠীর শিক্ষকদের বৃত্তিদান করতেন। এছাড়াও বিশ্বনাথ চতুষ্পাঠী এবং মায়ের নামে ব্রহ্মময়ী ভেষজালয় স্থাপন করেছিলেন। শ্রী মুখোপাধ্যায় কে ভারতচিন্তার পথপ্রদর্শক হিসেবে অভিহিত করা হয়।
শ্রীমতী অনুরূপা দেবী (১৮৮২ – ১৯৫৮) ছিলেন তাঁর যুগের অন্যতম প্রখ্যাতা নারী সাহিত্যিক। এক সাহিত্য অনুরাগী পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, শ্রী মুকুন্দদেব মুখোপাধ্যায়ের কন্যা ও শ্রী ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের পৌত্রী হিসেবে। শৈশব থেকেই তিনি পিতামহ ও জ্যেষ্ঠা ভগিনী শ্রীমতি ইন্দিরা দেবীর উৎসাহে সাহিত্য রচনায় ব্রতী হন। রাণী দেবী ছদ্মনামে তাঁর রচিত প্রথম গল্প কুন্তলীন পুরস্কার প্রতিযোগিতায় প্রকাশিত হয়। ১৩১১ বঙ্গাব্দে তাঁর রচিত প্রথম উপন্যাস “টিলকুঠি” নবনূর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৩১৯ বঙ্গাব্দে তাঁর উপন্যাস “পোষ্যপুত্র” ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তিনি বিখ্যাত হন। সাহিত্যচর্চা ব্যাতিত অনুরূপ দেবী সমাজসংস্কারে প্রভূত উৎসাহী ছিলেন। তৎকালীন বঙ্গের নারী আন্দোলনের এক অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। নিজস্ব কর্মোদ্যোগে তিনি একাধিক নারীকল্যাণ আশ্রমের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কাশী ও কলকাতায় কয়েকটি বালিকা বিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি মহিলা সমবায় প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।