জয় রাধে, জয় রাধারমণ – ১

0
1244

বঙ্গদেশ অনলাইন পত্রিকায় গত ৩১শে অগস্ট তারিখে প্রকাশিত “ঝুলনযাত্রা ও রক্ষাবন্ধন উৎসবের তাৎপর্য” শীর্ষক একখানি নাতিদীর্ঘ রচনা পড়িয়া আমরা যারপরনাই বিরক্ত হইয়াছি। রচনাটির লেখক জনৈক শ্রী তপন আচার্য। বিরক্তির কারণ প্রথমতঃ রচনায় কোনোরূপ সূত্রের উল্লেখ ছাড়াই অজস্র ভুল তথ্যের সমাহার রহিয়াছে, তদুপরি ঐ ভুল তথ্যাবলীর মাধ্যমে লেখক বঙ্গদেশের বৈষ্ণব পরম্পরার একখানি অবিচ্ছেদ্য দিককে অত্যন্ত অবমাননাকর শব্দবন্ধের দ্বারা বর্ণনা করিয়া লেখনীর এক আঁচড়ে নস্যাৎ করিয়া দিয়াছেন। রচনাটিতে লেখক জানাইতেছেন :

রাধাকে যে কৃষ্ণের প্রেমিকারূপে বর্ণনা, এটির উৎস আধুনিক যুগে জয়দেব বিরচিত বৈষ্ণব কাব্য এবং চৈতন্য পরবর্তী যুগে চৈতন্য ভাগবত। এই বৈষ্ণবকাব্যগুলিতে রাধাকৃষ্ণকে প্রেমিক-প্রেমিকারূপে বর্ণনা করে রাধাকৃষ্ণের অশালীন ও আদিরসাত্মকপ্রেমলীলার কাহিনী সৃষ্টি হয়েছিল। এক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণের মূল প্রতীক ত্রিভঙ্গরুপের সাথে সংযোজন করা হল; ১৬, ৫০০ বৎসর পূর্বে উপাসিত ‘হরে’ দেবতার মুরলী হয়ে গেল একই সাথে বংশীধারী – ত্রিভঙ্গমুরারী রাধাপ্রেমিক শ্রীকৃষ্ণ। প্রণয় ও লাম্পট্য প্রকাশের রূপটি পূর্ণতা পেল। পুরাণকাররা তাঁদের কদর্যরুচির পরিচয় দিয়ে লিখলেন মাতুলানী রাধার সাথে ত্রিভঙ্গ শ্যামের অবৈধ সম্পর্কের কথা। বলাবাহুল্য, এই অশালীন সম্পর্কের কাহিনী হিন্দুজাতিকে অন্য ধর্মের মানুষের কাছে মাথা নত করে দিয়েছে। বাস্তবে কিন্তু কৃষ্ণ কোন জন্মগ্রহণকারী মানুষ নন।

আমরা ধরিয়া লইতেছি যে লেখক বঙ্গজ এবং হিন্দু, কারণ তাঁহার লেখক-পরিচিতি অংশে জানানো হইতেছে যে তিনি “২০১৫ সালে আমেরিকায় বিশ্বধর্মসম্মেলনে হিন্দুধর্মের বক্তা হিসাবে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন।” অতএব দেখা যাইতেছে যে হিন্দুধর্মের আজ বড়ই দুর্যোগের দিন উপস্থিত, কারণ যাঁহারা দেশেবিদেশে হিন্দুধর্মের মুখপাত্র হিসাবে আমন্ত্রিত হইয়া থাকেন, বিশ্বধর্মসম্মেলনের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ অবসরে হিন্দুজাতি ও ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করিয়া থাকেন, তাঁহারাই আবার বৈষ্ণব পদাবলী পড়িয়া লজ্জায় মাথা নত করেন। বৈষ্ণব পদাবলী – বিশেষত শ্রীজয়দেবের শ্রুতিমধুর কাব্যরচনা পড়িয়া, ভক্তিরসে টইটম্বুর শ্রীচৈতন্যভাগবত পড়িয়া – এবং এমনকি হিন্দু পুরাণগুলি পাঠ করিয়াও ইঁহাদের ন্যায় হিন্দুধর্মের নব্য মুখপাত্রদিগের মুখমণ্ডল লজ্জায় আরক্ত হইয়া উঠে (বিশ্বাস করুন, মান্যবর পাঠক, ইহা কল্পনা করিতে আমাদের বিন্দুমাত্র কষ্ট হইতেছে না, এই বিষয়ে স্বয়ং লেখকের বাক্যরাজি সাক্ষী!), এবং ঐসকল “অশালীন” গ্রন্থগুলি চেষ্টা করিলেই লুকাইয়া ফেলা তত সহজ নহে বলিয়াই উপায়ান্তর না দেখিয়া উক্ত মুখপাত্রগণ আপনাদিগের রক্তিম বদনমণ্ডল লুকাইবার নিমিত্ত অধোবদন হইয়া থাকেন। নিজেরা অধোবদন হন, এবং উপরন্তু সমগ্র হিন্দুজাতির হইয়া বড় মুখ করিয়া দাবী করিয়া বসেন যে “এই অশালীন সম্পর্কের কাহিনী হিন্দুজাতিকে অন্য ধর্মের মানুষের কাছে মাথা নত করে দিয়েছে।” অন্য কোন্‌ ধর্ম? ইহা আমরা লেখকের কাছে জানিতে ইচ্ছা করি। অন্য অন্য ধর্মের প্রবর্তকগণের কেচ্ছা লইয়া চর্চা করিতে বসিলে কাহার কাহার মাথা নত হইবে আর কর্ণ-নাসিকাসমেত সমস্ত মুণ্ডটিই কাটা যাইবে তাহার হিসাব দিবার জন্য এই রচনায় শব্দব্যয় করিব না। (মুণ্ডচ্ছেদ হইলে পরে সে কাটা মুণ্ড কি কখনো লজ্জায় নত হইতে পারে? বলিতে পারি না।) বরং আমরা বিচার করি, প্রকৃতি-শ্রী-আদ্যাশক্তিস্বরূপা শ্রীরাধিকার সঙ্গে বৈষ্ণবদিগের পরমপুরুষ পূর্ণাবতার শ্রীকৃষ্ণের প্রেমের সম্পর্ক আমাদিগকে লজ্জায় অধোবদন করিতে পারে কিনা।

শ্রীআচার্যের লেখা পড়িয়া বুঝা যাইতেছে যে বিশ্বসভায় হিন্দুধর্মের নব্য প্রতিনিধিগণ কথায় কথায় বেদের দোহাই পাড়িয়া থাকেন, এবং পুরাণ তথা বিবিধ বৈষ্ণব রচনা পাঠ করিয়া লজ্জায় মুখ লুকাইতে চাহেন। কিন্তু পুরাণসকল সম্বন্ধে ইঁহাদের মতামত জানিতে পারিলে বেদপ্রণেতা মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিগণ এবং বেদসংহিতাবণ্টক, পুরাণেতিহাস-রচয়িতা স্বয়ং ব্যাসদেব কোথায় মুখ লুকাইবেন তাহা ভাবিয়া আমরা তো কোনো কূলকিনারা দেখিতে পাই না। আজকের হিন্দু বড়ই দুর্ভাগা বোধ হইতেছে, কারণ বিশ্বসভায় তাহার প্রতিনিধি সাজিয়া যাঁহারা যান, যাঁহারা হিন্দুর ধর্মকে অন্যান্য জাতি ও সম্প্রদায়বিশেষের মান্যগণ্য ব্যক্তিবর্গের নিকট ব্যাখ্যা করেন, তুলিয়া ধরেন, তাঁহারা নিজেরাই হিন্দুজাতির রচিত সাহিত্যকীর্তির অন্যতম শ্রীজয়দেবের গীতগোবিন্দ পাঠ করিলে উক্ত কাব্যের ‘অশালীনতা’ দেখিয়া লজ্জায় মুখ লুকাইবার স্থান পান না। জিজ্ঞাসা করিতে চাহি, শালীনতার এই ‘হালাল’ পাঠ শ্রীআচার্য কোথা হইতে পাইলেন? Protestant Church কর্তৃক পরিচালিত কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, নাকি কোনো উলেমাচালিত মাদ্রাসায়? হিন্দুধর্মের এমন সব অর্বাচীন প্রতিনিধি-প্রবক্তাদের হাত থেকে শ্রীভগবান আমাদের রক্ষা করুন! এবং বিশেষ ক’রে প্রার্থনা করি যেন তিনি বাঙালি হিন্দুদিগকে এইরূপ ধ্যানধারণায় অভিষিক্ত ব্যক্তিগণ হইতে দূরে রাখেন, কেননা আপামর বাঙালি হিন্দুর নিকট শ্রীরাধা ব্যতিরেকে শ্রীকৃষ্ণের কোনোরূপ অস্তিত্ব নাই। শ্রীরাধাকে সরাইয়া লইলে বাঙালি হিন্দু রাধাগোবিন্দের গোবিন্দকেই হারাইবে। কারণ ইহা যে এক অঙ্গে দুই সত্তা। পুরাতন সাঙ্খ্যদর্শন অনুসারে – এমনকি বঙ্গদেশের একান্ত আপনার দর্শন শাক্তমতেও – যে পুরুষ ও প্রকৃতি দুই সত্তাই নিত্যসত্য, হিন্দু বাঙালি তাহাকেই বৈষ্ণব ভক্তিরসে সিক্ত করিয়া রাধামাধবের রূপে আপনার ভক্তিসিক্ত সংস্কৃতির অঙ্গীভূত করিয়া লইয়াছে। শ্রীরাধা যে শ্রীকৃষ্ণ নামক পূর্ণব্রহ্ম পরমপুরুষের হ্লাদিনী শক্তি, একথা অল্পকাল পূর্বেও বঙ্গদেশের প্রায় প্রত্যেক হিন্দুসন্তানের নিকট সাধারণ জ্ঞান হিসাবে পরিচিত ছিল। অধুনা আচার্যমহাশয়ের ন্যায় কিছু বিদেশী নীতিশাস্ত্রের পণ্ডিতদের পাল্লায় পড়িয়া বাঙালি হিন্দু অবশ্য সেসব ভুলিতে বসিয়াছে। আসলে শ্রীআচার্যের ন্যায় মাষ্টাররা এক্ষণে ইংরাজরাজোত্তর স্বাধীন ভারতবর্ষে লর্ড মেকলে সাহেবের ঋণ শুধিতেছেন। শুনিয়াছি ভিক্টোরীয় নৈতিকতায় দীক্ষিত এইরূপ নীতিবাগীশদের পাল্লায় পড়িয়া এক্ষণে কোণার্ক সূর্যমন্দির এবং খাজুরাহোর মন্দিরগুলির গাত্রে খোদিত তথাকথিত ‘অশালীন’ মূর্তিগুলি ঢাকিয়া ফেলিবার ‘সুচিন্তিত’ প্রস্তাব পর্যন্ত সরকারবাহাদুরের নিকট আসিয়াছিল। এখনো যে সে প্রস্তাবের ফাইল খুলিয়া দেখা হয় নাই ইহা শ্রীভগবানের অশেষ কৃপার নিদর্শন বলিতে হইবে।

উপনিবেশোত্তর কালে লাটসাহেব মেকলের মানসপুত্রদিগকে লইয়া বড় জ্বালা হইল দেখিতেছি! ইঁহারা দাবী করিয়া থাকেন যে মহাভারত রামায়ণ পুরাণসকল উত্তমরূপে পাঠ করিয়াছেন (অথবা বিবিধ লেখালেখির মাধ্যমে এমন ভান করেন যেন ঐসকল গ্রন্থ পাঠ করিয়াছেন), অথচ প্রায়শঃ এমন সমস্ত হাস্যকর উদ্ধৃতি-ব্যাখ্যান, এমন সমস্ত প্রমাদ উপস্থাপনা করিয়া থাকেন যে তাহার উল্টাটাই স্পষ্টরূপে প্রতিপাদিত হইয়া থাকে। একখানি উদাহরণ :

“বেদবিভাগ কর্তা ঋষি দ্বৈপায়ন বা বেদব্যাসের যুগে পূর্বকল্পের দেবতা উপাসনার ভ্রান্তি স্বীকৃত হতোনা। এমনকী তিনি মহাভারতে পূর্বতন দেবতা রামকেও বলরাম নাম দিয়ে গুরুত্বহীন হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন।”

ইহা আচাজ্যিমশাই কোথা হইতে পাইলেন তাহা শ্রীভগবানই জানেন। আমরা তো শ্রীব্যাসদেবের মহাভারতে পড়িয়াছি কথায় কথায় মর্যাদাপুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্রের উদাহরণ টানা হইতেছে তাঁহার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করিবার নিমিত্ত। এবং এই tradition সমানে চলিয়াছে, মহাভারতের আদিপর্বে জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞ হইতে শুরু করিয়া দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরসভা হইয়া একেবারে শেষ অবধি নানা বিষয়ের অবতারণায় দাশরথি শ্রীরামচন্দ্রের প্রসঙ্গ আসিয়াছে, এবং সবখানেই তাঁকে একজন শ্রেষ্ঠ পুরুষ হিসাবে বর্ণনা করিয়া তাঁহার কর্মজীবন হইতে উদাহরণ টানিয়া সেই কর্মের অনুগমন করিতে বলা হইয়াছে। বনপর্বে জয়দ্রথ কর্তৃক দ্রৌপদী নিগৃহীতা হইলে যুধিষ্ঠির আপন স্বভাববিরুদ্ধ শোকে অধীর হইয়া মার্কণ্ডেয়কে শুধাইয়াছিলেন যে তাঁহার চাইতে দুর্ভাগা কোনো রাজা কখনো ছিলেন কিনা। তখন মার্কণ্ডেয় তাঁহাকে বলিয়াছিলেন যে অযোধ্যার রঘুপতি রামকে যে দুঃসহ দুঃখ ভোগ করিতে হইয়াছিল, তাহার কোনো তুলনা নাই। এই বলিয়া তিনি অস্থির যুধিষ্ঠিরকে রামোপাখ্যান শুনাইয়াছিলেন, যাহা বাল্মীকির রামায়ণের সংক্ষিপ্ত রূপ মাত্র। মহাভারতের এই অধ্যায় রামোপাখ্যান পর্বাধ্যায় নামে খ্যাত এবং মহাভারতের কালে শ্রীরামের মহিমা কতখানি উচ্চ কোটিতে স্থাপিত ছিল তাহার একখানি জ্বলন্ত উদাহরণ।

এই হইতেছে আচাজ্যিমশায়ের স্বকপোলকল্পিত “মহাভারতে রামের গুরুত্বহীনতা” নামক অলীক থিয়োরির দশা।

উপরন্তু আচাজ্যিমশাই বলিতেছেন শ্রীরাধিকা ও শ্রীকৃষ্ণের প্রেম বর্ণনা ‘আধুনিক যুগে’ শ্রীজয়দেবের অবদান। বুঝিতে অসুবিধা হইবার কোথা নহে যে এই স্থলে লেখকের আক্রমণের লক্ষ্য গীতগোবিন্দ  গ্রন্থখানি। শ্রীজয়দেবের স্থান-কাল নির্ণয় করিবার সমস্যা লইয়া অনেকেই মাথা ঘামাইয়াছেন, ভারতবর্ষের যেকোনো প্রাচীন পুস্তক ও তাহার রচয়িতার মতো এই বিষয়েও পণ্ডিতগণের মতভেদেরও অন্ত নাই। কিন্তু তাঁহাদের কেহই গীতগোবিন্দ গ্রন্থকে খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর পূর্বেকার বলিয়া গণ্য করিতে রাজি হন নাই। দ্বাদশ শতাব্দী! এই হইতেছে আচাজ্যিমশাইয়ের ‘আধুনিক যুগ’! তা কোন্‌ হিসাবে দ্বাদশ শতাব্দীকে ‘আধুনিক’ বলা চলিতে পারে, কোন্‌ মাপকাঠি ধরিয়াই বা তিনি এই স্থলে প্রাচীন, মধ্য এবং আধুনিক যুগ নির্ণয় করিতে বসিয়াছেন সে ধোঁয়াশা কাটাইবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা শ্রীআচার্যের রচনার কোথাও দেখিতে পাই না। ভারতবর্ষের ইতিহাসকে আদৌ ইউরোপের মতো সুস্পষ্ট প্রাচীন মধ্য আধুনিক ইত্যাদি ভাগে বিভক্ত করা যায় কিনা সে বিষয়েও দেশবিদেশের পণ্ডিতরা একমত নন। অনেক বিদেশী পণ্ডিত ঐরূপ যুগবিভাগ করিয়া থাকিলেও স্বদেশী পণ্ডিতবর্গ, যাঁহারা এদেশের প্রাচীন শিক্ষাপরম্পরায় শ্রদ্ধাশীল তাঁহারা এই যুগবিভাগের যৌক্তিকতা খুঁজিয়া পান না। এই বিষয়ে লেখক সর্বশেষ গবেষণা সম্পর্কে যে অবহিত নন তাহা তাঁহার লেখা পড়িয়া বেশ বুঝা গেল। অধুনা শ্রী রাজীব মলহোত্র এবং শ্রী এস এন বালগঙ্গাধরের নিরলস গবেষণাকার্যের মাধ্যমে ভারতবর্ষীয় ও ইউরোপীয় সভ্যতার মূলগত পার্থক্য এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে ইতিহাস বলিতে এই দুই ভিন্ন সভ্যতার লোকে ঠিক কী কী বুঝিয়া থাকে এইসকল বিষয়ে নূতন যাহা কিছু আমরা উপলব্ধ হইয়াছি সেই দিকে শ্রীআচার্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে ইচ্ছা করি।

আরো দেখা যাইতেছে যে শ্রীকৃষ্ণে ব্যক্তিভাব আরোপ করিয়া তাঁহার পূজা করিবার মতো কুসংস্কারাদিতে আচার্যদেব অত্যন্ত রুষ্ট হইয়া থাকেন। ঐসকল নিম্নস্তরের উপাসনার বিরুদ্ধে প্রমাণ খাড়া করিবার জন্য আচাজ্যিমশাই মোক্ষম সূত্র বাছিয়াছেন – ব্যক্তি শ্রীকৃষ্ণের মুখ দিয়া ব্যাসদেব যে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা‘ আওড়াইয়াছিলেন’ সেই গ্রন্থেরই বিশেষ একখানি উদ্ধৃতিকে তিনি প্রমাণ হিসাবে হাতাইয়াছেন। এক্ষেত্রে অবশ্য তিনি প্রয়োজনীয় বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণও জুড়িয়া দিয়াছেন। সে সতর্কীকরণখানি তাঁহার উদ্দেশ্য সর্বতোভাবে সিদ্ধ করে। ইহা হইতেছে – “গীতা যে মহাভারত পরবর্তী যুগে সৃষ্ট উপনিষদের জ্ঞানের আধারে লিখিত এবং গীতার সপ্তম ও নবম অধ্যায়ে বেদসংহিতার পরম সত্য বিশিষ্ট অদ্বৈত তত্ব প্রকাশিত; তা প্রায় সমস্ত বেদ গবেষক স্বীকার করেছেন।” বেশ বেশ! খাসা যুক্তি। “উপনিষদের জ্ঞানের আধারে” যে গ্রন্থ রচিত তাহার প্রচারের জন্য উপনিষদের ঋষিদিগের কিংবা অদ্বৈতবেদান্তীদিগের কৃষ্ণ নামক এক প্রাচীন দেবতার কি প্রয়োজন পড়িল বুঝা দায়। (ইহা অবশ্য অন্য কথা যে অদ্বৈতবেদান্তীদিগের প্রধান নেতা আচার্য শঙ্কর স্বয়ং “ভজ গোবিন্দম্‌” নামক স্তব রচনা করিয়াছিলেন। তাঁহার অদ্বৈততত্ত্বের জ্ঞান তাঁহাকে নামরূপবিশিষ্ট ব্যক্তি-ঈশ্বর ভজনা করা হইতে নিরস্ত করিতে পারে নাই।) অজুহাত হিসাবে ইহা বড়ই উপাদেয়। লেখকের পক্ষে ভারী সুবিধাজনক। যেটুকু তাঁহার  থিসিসের সাথে খাপে খাপে ঠিক ঠিক মিলিয়া যায় তাহা লইয়া বাকিটা প্রক্ষেপ বলিয়া চালাইয়া দাও। কোথায় মহাভারত রচনার কাল, কখন উপনিষদ আসিল, উপনিষদসমূহ যদি মহাভারতের পরে আবির্ভূত হইয়া থাকে (যেমনটি আচাজ্যিমশাই দাবী করিয়া বসিয়াছেন) তাহলে তাহাদিগের শ্রুতিবাক্যরূপে অন্তর্ভুক্তি কবে কাহারা ঘটাইল ইত্যাদি প্রশ্নের জবাব আমরা দাবী করিতে পারি। আর ঐ “প্রায় সমস্ত বেদ গবেষক”-রাই বা কাহারা তাহাও আমরা জানিতে পারি না, কারণ লেখক তথ্যসূত্র/reference দেন নাই। একজন যে স্বয়ং আচার্যদেব, ইহা বুঝিতে সমস্যা থাকিবার কোথা নয়, বাকিরা কাহারা তাহাই জানিতে আমরা উদগ্রীব। বেদ গবেষকদের কথা বলিতে পারি না, অতদূর আমাদিগের ব্যুৎপত্তি নাই, পড়াশোনা ব্যতিরেকে অথবা তথ্যসূত্র উল্লেখ না করিয়া মন্তব্য করিবার ধৃষ্টতাও করি না। তবে মহাভারত গবেষকদের মধ্যে এদেশের অগ্রগণ্য, মহাভারতের প্রথম critical edition-এর সম্পাদক শ্রী ভি এস সুখতঙ্কর সুবিধেমত মহাভারতের নানান অংশকে যত্রতত্রপ্রক্ষেপ বলিয়া উড়াইয়া দিবার চেষ্টায় জল ঢালিয়া গিয়াছেন। তাঁহার প্রায় আসুরিক কর্মপ্রচেষ্টার পরবর্তীতে স্বদেশী ও বিদেশী উভয়দিক হইতেই দর্শন ও প্রাচীন সাহিত্যগ্রন্থশিক্ষার সর্বোচ্চ শিখরে আরূঢ় দুই একালীন পণ্ডিত (যাঁহাদের মধ্যে একজন – কী আনন্দের কথা – বাঙালি!) New York শহরে অবস্থিত Hunter College -এর Philosophy বিভাগের অধ্যাপক বিশ্ব আদলুরি এবং Free University of Berlin-এর ডঃ জয়দীপ বাগচী তাঁহাদিগের সর্বশেষ পুস্তকে নিজেদের স্বতন্ত্র অনুসন্ধানের মাধ্যমে সুখতঙ্করের গবেষণালব্ধ ফলকেই পোষণ করিয়াছেন। ইহা ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের কথা। এই পুস্তকখানির প্রতিও মহানুভব আচাজ্যিমশায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করি।

এদিকে শ্রীরাধাকৃষ্ণ এবং ব্রজের গোপীবৃন্দের প্রেমলীলায় এদেশের ‘আধুনিক’ (নাকি অত্যাধুনিক বলিব? কাল নির্ণয়ের কোন্‌ মাপকাঠি ব্যবহৃত হইতেছে তাহারই উপর এইসকল বিশেষণের প্রয়োগ নির্ভর করিবে) Film Censor Board -এর ন্যায় কাঁচি চালাইলে ভক্তের রাধাভাব অস্বীকার করা হয়। রাধাভাব অস্বীকার করিলে শ্রীচৈতন্যদেবকে হিসাবের বাহিরে রাখিতে হয়। আর শ্রীচৈতন্যদেবকে হিসাব-বহির্ভূত করিয়া রাখিলে বঙ্গসংস্কৃতির ঠিক কতখানি অবশিষ্ট থাকে তাহা বিচার করিবার মত উপযুক্ত অণুবীক্ষণ যন্ত্র এখনো আমরা উদ্ভব করিতে অথবা বিদেশ হইতে আমদানি করিতে পারি নাই। কালে কালে সেসকল ‘অত্যাধুনিক’ বিদেশী কৌশল নব্য মুখপাত্রগণের মাধ্যমে আমাদিগের মত ভাবালু এদেশীয় ভক্তগণের হস্তগত হইবে এই আশা করা যাইতেছে। ঐসকল যন্ত্রচালনে আমরা নিশ্চয়ই এক্কেবারে শুদ্ধ বৈদিক অগ্নিহোত্র হইয়া যাইব! তখন কেবল আদিরস কেন, কোনোরূপ রসের আলোচনাই আর হইবে না। কাজেই বেলা থাকিতে থাকিতে রসালোচনা সারিয়া ফেলা ভালো। শ্রীজয়দেবের গীতগোবিন্দ হইতে শুরু করিয়া, বৈষ্ণবদিগের রাধাভাবপ্রাধান্য ছুঁইয়া – অথবা বলা ভালো রাধাভাবকে অবলম্বন করিয়াই – শ্রীচৈতন্যদেব কীভাবে বাংলা তথা ভারতবর্ষের সংস্কৃতি ও মননকে এই অধুনা বর্তমানকাল অবধি ব্যাপ্ত করিয়া আছেন সেই বিষয়ে বিশদরূপে দ্বিতীয় পর্বে আলোচনা করা যাইবে। আজিকে শ্রীকৃষ্ণজন্মাষ্টমী। আমার গৃহের রাধামাধবের যুগলমূর্তির পূজা করিব মূর্তির সম্মুখে বসিয়া – তাঁহার মুখনিঃসৃত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার পাঠ তাঁহাকেই ফের শুনাইয়া – এইরূপ নানান তুচ্ছ কাজের অছিলায় আজিকার মতো এইখানেই আচার্যমহাশয়ের প্রতি আমাদিগের এই ক্ষুদ্র তর্পণখানি মুলতুবি রাখিতে হইতেছে। কিন্তু আমরা রসিক লোক। রসের সন্ধান পাইয়াছি, নিংড়াইতে ছাড়িব না।

(ক্রমশঃ)

রচনাকাল : জন্মাষ্টমী, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮