এক ইতিহাসের কথা

0
868

অনির্বাণ বিশ্বাস

( ৯ )

নিশিকান্ত স্নান করে একটু খেয়ে বিছানায় টান টান হয়ে শুয়ে আছেন । ছাদের দিকে তাকিয়ে আছেন । ওপরে টিনের ছাদ । তার নিচে বাঁশের মাচা , পুরো ঘর জুড়ে । এইদিকের বাঁশের মাচা কিছু জায়গায় আলগা হয়ে গেছে । এবছর পূজোর আগে সাড়াই করবেন ঠিক করেছিলেন । কিন্তু ..

পাশে হাতের চুড়ির আওয়াজ । নিভাননা পানের ডিবা নিয়ে পাশে এসে বসলেন । যাতি দিয়ে কুচ কুচ করে সুপাড়ি কেটে একটা পানের পাতায় অল্প দিয়ে নিশিকান্তকে দিলেন , নিজেও নিলেন ।

‘ আসমা খাইসে্ ? ‘

‘ হ । নিচে্র ঘরে আসে্ । খুব কান্দেতেছিল । ভয় পাইছে্ খুব । ঐটুকুন মাইয়া ! বার বার আম্মু আব্বুর খোঁজ্ করতেছে । চন্দ্রানী অনেক ভুলাইয়া একটু খাওয়াইলো । আমি অর মাথায় হাত বুলায় দিলাম । ঘুমায় পড়ছে্ ‘

নিশিকান্ত ছাদের দিকে তাকিয়ে আছেন । চোখের পলক পড়ছে না ।

‘ সুনু , ঠান্ডা মাথায় শোন । আমি বেশ বুজছি্ এই হানে আর থাকন যাইবো না । আমি কুচবিহারে আমার বন্ধু নীরেনের কাছে্ গিসিলাম । ও কইল কুচবিহারে চইলা যাইতে । দেশ ভাগ হইবই । মুসলমান যেই দিকা বেশী সেই ভাগ নিয়া পাকিস্তান হইব । এই সীতারহাটে মুসলমান সংখ্যায় বেশী । দেশ ভাগের পর এই খানে থাকলে অত্যাচা্রের সীমা থাকবে না । মুসলমানরা হিন্দুদের জমি জমা সম্পত্তি এবং হিন্দু মেয়েদের দিকে লক্ষ্য রাখছে্ । এইডাই আসল । ধর্মের নামে এই অমানবিক কাজ্ সারা বাংলা প্রদেশে শুরু হইয়া গেছে । দাঙ্গা হইতেছে সুনু । আরও ভয়ঙ্কর দাঙ্গা হইব । ‘

নিভাননা নিঃস্তব্ধে সব শুনছেন । ওনার কান্না পাছে । ভীষন । নিঃশব্দে কাঁদতে থাকেন নিভাননা ।

‘ এই বাড়ি ঘর ছাইড়া আমি কোথাও যামু না ! কিছু্তেই না ।‘ নিভননা আর বলতে পারেন না । নিশিকান্ত নিভাননার মাথায় হাত বুলান ।

‘ তুমি নতুন যা্য়গায় গিয়া কি কাম করবা ? এই ডাক্তারী ? আবার এত নাম ডাক হইব ? কত বছর লাগছে তোমার এইখানে আসতে ! নতুন জায়গায় ভিক্ষা করব ? তোমার মাইয়া দুইটার কি করবা ! ‘ নিভাননা অবরুদ্ধ গলায় বলেন ।

‘ আমি পারুম । তুমি দেইখ । পারতে হবেই । আমি কুচবিহারে না , ওর থিকা একটু দূরে আলিপুরদুয়ার বইলা এক জা্য়গা আছে্ । ঐখানে লোকজন কম । একটা দুই বিঘা জমি দেইখা আসছি নীরেনের সাথে । অরে বেশ কিছু্ টাকা দিয়া আসছি । ঐ জমিটা কিনা ঐ খানে আমরা ঘর বানাইয়া থাকুম । আমার রুগী ঐ খানেও হবে । আমি জানি ‘ নিশিকান্তর গলায় দৃঢ় বিশ্বাস শোনা যায় ।

‘ এই বাড়ি জমি বেইচাও কিছু টাকা পাব । তুমি দেইখ । ‘ নিশিকান্ত বলেন । ওনার চোখে জল । মাথা ঘুরিয়ে নেন ।

বাইরে অন্ধকার নেমে আসছে । কিছু কাক এবং ঘরে ফেরা বকের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে । মাঝে মাঝে কারফিউর হুঁশিয়ারী । পড়ন্ত সূর্যের আলো জানলা দিয়ে নিভাননার মুখে এসে পড়েছে । কপালে বড় সিঁদুরের টিপ । কুড়িবছর আগের এমন এক তরুনীর মুখ মনে ভেসে আসে নিশিকান্তর । সেই তরুনী বড্ড লাজুক হাসত । চোখ তুলে কথা কইতে পারতো না । আজ সেই মুখে আতঙ্কের ছাপ । চোখের নিচে কালি ।

রতন দুপুরে ভাত খেয়ে বাড়ি চলে গেছে । বাড়িতে মা বাবা আছে । ও এ গলি সে গলি করে দুহাত মাথার ওপর তুলে বাড়ি যাবে বলেছে । নিভাননা আস্তে আস্তে নিচে নামেন । সন্ধ্যে দিতে হবে । উঠোনের এক পাশে তুলসীমঞ্চ । নিভাননা ঠাকুরঘর থেকে প্রদীপ জ্বালিয়ে তুলসীমঞ্চে আসেন । প্রদীপ দেখিয়ে তুলসীতলায় রেখে নিভাননা গলবস্ত্র হয়ে প্রণাম করতে গিয়ে আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না । হাউহাউ করে কাঁদতে থাকেন ।

‘ কোথায় যাব ঈশ্বর ? কি করব আমরা ঠাকুর ? ওদের মঙ্গল কর ‘

নিশিকান্ত বারান্দা থেকে দেখেন এই সন্ধ্যারতি । নাঃ , নিচে নামতে হবে । আসমা কি ঘুমোচ্ছে ? নিশিকান্ত পেছনে ঘরে ঢোকেন পাঞ্জাবী পরতে । নিচ থেকে নিভাননার চিৎকার ,

‘ ও মাগো ! এই সব কি ? হায় ভগবান !’

নিশিকান্ত দৌড়ে নিচে নামেন । নিভাননা দাঁড়িয়ে কাঁপছেন । তাঁর পরোনের শাড়ীতে রক্তের ছোপ ! তুলসীমঞ্চে একটি বেশ বড় কাটা মাংসের টুকরো !

নিশিকান্ত একলাফে সদর দরজা খুলে বাইরের গলিতে দেখেন কেউ নেই ।

বাইরের দরজা লাগিয়ে নিশিকান্ত স্ত্রীর কাছে ফেরেন । নিভাননাকে ধরে আস্তে আস্তে ঘরে আনেন ।

‘ গায়ের সব পাল্টাও । এই গুলান আমি বাইরে ফেইলা দিব । আমি আস্তেসি্ । ‘

‘ ঐটা গায়ের উপর কি আইসে পড়ল গো ?’

নিশিকান্ত মাথা ঘুরিয়ে বললেন ,

‘ গোরুর মাংস , কেউ বাইরের থেকে ছুঁড়ছে্ ‘

নিশিকান্ত দ্রুত গামছা পরে গোরুর মাংসের টুকরো বাইরে রাস্তার ধারে আবর্জনায় ফেললেন । জল ঢেলে তুলসীমঞ্চ পরিস্কার করলেন । তারপর নিভাননার ছাড়া জামাকাপড় কাগজে মুড়ে বাইরে আবর্জনায় ফেলে পিছন ফিরতেই ভারী গলায় একজন বলে উঠল,

‘ এসব কি ফেলছেন , ডাক্তার বাবু ?’

নিশিকান্ত চমকে দাঁড়ান । একটু দূরে সাইকেলে চেপে একটি গোঁপওয়ালা স্বাস্থ্যবান লোক বসে আছে । সোজা নিশিকান্তের দিকে তাকিয়ে আছে ।

‘ এই মানে একটা ইয়ে ..’ নিশিকান্ত আটকে যান ।

‘ আমি সব দেখছি্ । একটি ছেলেকে দৌড়াইয়া আপনার এই গলি থেইকা বাইরাইতে দেইখা আমি আইসা দেখি আপনি এইসব করতেছে্ন । এইটা গোরুর মাংসের টুকরা , জা্নেন আপনি । একদিন আপনারাও এই ভাবে টুকরা টুকরা হবেন । হয় পালান সীতারহাট ছাইড়া , নয় হাতে অস্ত্র তোলেন । পাল্টা দ্যান । বাঁচতে গেলে তাই করতে হবে ‘ সাইকেল আরোহী দ্রুত বেরিয়ে গেল ।

নিভাননা স্নান করে পরিস্কার শাড়ী পরে বসে কাঁদছেন । নিশিকান্ত স্নান করে এসে লুঙ্গী পাঞ্জাবী পরে নিভাননার পাশে এসে বসলেন ।

‘ সুনু শাঁখ বাজাবা না ? গত কুড়ি বছরে এই বাড়িতে সব সন্ধ্যায় শাঁখ বাজানো হইছে্ কিন্তু ‘

নিভাননা ঠাকুরঘরে গিয়ে শাঁখ বাজাতে থাকেন । শাঁখ ঠিকমত বাজছে না । কেটে কেটে যাচ্ছে ।

একটি ঘরের পর্দার পিছন থেকে বড়বড় চোখ করে চন্দ্রানী , ইন্দ্রানী আসমা মহাকালের রঙ্গমঞ্চে এই ঘটনা দেখতে থাকে । কাঁদতে থাকে ।

সেই রাতে সীতারহাটের আকাশে কালো মেঘ এসে অসময়ের বৃষ্টি শুরু করল । সীতারহাটের মানুষের চোখে ঘুম নেই । নিদাড়িয়া মসজিদে আজ নমাজ হয় নি । মুয়াজ্জিন আজান দেবে কি না বুঝতে পারে নি । সন্ধ্যেবেলায় দুটি ছেলে এসে মুয়াজ্জিনকে শাসিয়েছে ,

‘ হিঁদুরা ইমাম সাহেব কে মারছে্ । তুই বেশী জানিস ? জামাল ভাইয়ের নাম নিছিস কেন ? এরপর তোর মাথা নামাবো ‘

মুয়াজ্জিন দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে ছিল ।

সেই রাতে ধরলার তীরে রাধামাধবের মন্দিরে পাতা ধুলো উড়েছে । সারাদিনে নিত্যসেবা হয় নি ।

পুরোহিত মশাই ধরলার ধারে দাঁড়িয়ে আছেন । অনেক রাত হল । রাধামাধব জল পায় নি , পুরোহিত মশাইও কিছু খান নি । অন্ধকারে পুরোহিত মশাই কাঁদছেন । বৃষ্টির জল আর ঝোড়ো হাওয়ায় এক মানব ঈশ্বরের কাছে অনেক আকুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ।

দুটি শক্তহাত পুরোহিত মশায়ের কাঁধ ধরল ।

‘ কে ?’ বলেই মাথা ঘোরাতেই অন্ধকারে দুটি মানুষকে দেখতে পেলেন । একজন পুরোহিত মশায়ের মুখ চেপে ধরল । পুরোহিত মশাই পেটে হঠাৎ তীব্র যন্ত্রনা অনুভব করলেন । পুরোহিত মশাই মুখ হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছেন । দম আটকে আসছে । দুই পা ছুঁড়ছেন । পুরোহিত মশাই পড়ে গেলেন । তাঁর হাতটা পেটে ব্যাথার জায়গায় চলে গেল । শক্ত কিছু ঢুকে আছে ।

( ১০ )

দুদিন কার্ফিউ চলার পর আজ সকাল দশটা থেকে দুটো ছাড় দেওয়া হয়েছে । এদিক ওদিক মানুষের ওপর আক্রমনের খবর পাওয়া গেছে এর মধ্যে । পুরোহিত মশাইয়ের হত্যা হিন্দু সম্প্রদায়কে ভীষন সন্ত্রস্ত করেছে । রংপুর হাসপাতালে ইমাম সাহেব ভাল নেই ।

কোন মানুষ ভাল নেই । কেবল ধর্মের নামে উস্কানি দিয়ে দাঙ্গা বাধানোর পশুরা ভাল আছে । ওরা জিভ চাটছে । সন্ত্রস্ত মানুষ তড়িঘড়ি বাজার হাট করছেন । নিশিকান্ত তেল আটা চিনি নুন দেশলাই মোমবাতি কিনে ফিরছিলেন । পিছন থেকে ডাক,

‘ ডা্ক্তারবাবু একবার আইসে্ন !’ জগদীশ প্রসাদ তার কাপড়ের দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন । নিশিকান্ত ইতঃস্তত করে কাছে গেলেন ।

‘ ভিতরে আইসেন ‘ জগদীশবাবুর পিছন পিছন নিশিকান্ত ভিতরের ঘরে গেলেন ।

‘ অবস্থা খুব খারাপ ডাক্তার বাবু । আমি হুমকি পাচ্ছি দুকান বেচবার । একটা ছেলে আইসে হামাকে শাসায়ছে , ১৬ই অগস্ট হরতালের দিন , ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে । ঐ দিন আমার কাপড়ের দুকানে আগুন দিবে । ‘ জগদীশবাবু চুপ করেন ।

‘ কেন দিব ? কেন সব বেইচে চইলে যাব ? হামার বাপ দাদার , হামার হাড্ডি পসিনার মেহনত আছে এই বেওসায় ! হামি যাব না । পরিবারকে কাটিহার ভেজে দিব । লেকিন হামি লড়ব । দাঁড়ান । এ মোহিত !’ জগদীশবাবু হাঁক দিলেন ।

নিশিকান্তকে চমকে দেখলেন সেই গোঁপআলা স্বাস্থ্যবান লোকটি এল। একে সেদিন রাতে গোরুরমাংস বাইরে ফেলতে গিয়ে দেখেছেন, লোকটি কিছু কথা বলেও ছিল ।

‘ ও হামার আদমি । হামি এমন সাত আটটা আদমি যোগার করেছি । হামার সিকিউরিটির জন্য । আপনাদেরও সিকিউরিটি হোবে । ও আপনার সাথে দেখা হওয়ার ঘটনা হামায় বলেছে । ও হিন্দু মহাসভার লোক । ওদের কছে আর্মস আছে , ফায়ার আর্মস ভি ‘

মোহিত একটু গলা খাঁকাড়ি দিয়ে বলে ,

‘ ডাক্তার বাবুরে আমি সেইদিন কইছি । আমরা আছি । আপনেরাও হাতে অস্ত্র তোলেন । সব হিন্দুরে এককাট্টা না হইলে এই লড়াই জিতা যাবে না ‘

নিশিকান্ত আসু বিপদের কথা ভেবে ঘামতে থাকেন । আর চারদিন পর ১৬ই আগস্ট । পাকিস্তানের দাবিতে জিন্না ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডের ডাক দিয়েছেন । সেদিন কি মারাত্মক কিছু হবে ?

‘ আপনার কি মনে হয় ১৬ই আগস্ট বাজে্ কিছু্ হইবে ?’

‘ মনে হোয় না , হামি বিশ্বাস করি । পুলিশ এত লোককে প্রোটেকশন দিতে পারবে নাই । হামাদের প্রোটেকশন হামাদেরই করতে হোবে । হামি হিন্দু পাড়ায় পাড়ায় জোয়ান অল্প উমরের ছেলেদের এককাট্টা করছি । আর্মস দিচ্ছি । আপনার বাড়িতে ম্যাডাম , দুই মেয়ে আছে । আপনি ইটা রাখুন ‘ জগদীশবাবু ঘরের সিন্দুক খুলে একটি রিভলবার নিশিকান্তের হাতে দেন । নিশিকান্ত কাঁপা হাতে রিভলবারটি উল্টে পাল্টে দেখেন । এক দিকে লেখা আছে Enfield No.2 MK 1 . 38/200 Calibre ।

‘ এইটা কোথায় পাইলেন ? আমিতো চালাইতে জানি না ‘

‘ চোরা বাজারে বৃটিশ সৈন্য এগুলা বেচে । এইটা আপনের চালানো শিখার কি দরকার ? এইভাবে ধইরা সোজা সামনে তাক কইরা ট্রিগার টিপবেন । ছয়টা গুলি আমি ভইড়া দিতেছি্ । ‘ মোহিত বলে ।

‘ কত দাম ?’ নিশিকান্ত জানতে চান ।

‘ আপনের কাছে কুছু নিব না ডাক্তার বাবু । ইটা ধর্মযুদ্ধ । আত্মরক্ষার জন্য । যখন দরকার হবে হামি আপনার কাছ থেকে টাকা নিব । ঝোলার মধ্যে ঢুকায় নিয়ে যান্ । আলাদা জায়গায় রাখবেন । কারোকে দিখাবেন না । ম্যাডামকেও না !’

নিশিকান্ত বাড়ি ফিরছেন । বুক ধরফর করছে । কেউ কি জানতে পারল , এই রিভলবারের কথা ? । রাস্তার কোন থেকে একটি পুলিশ নিশিকান্তের দিকে এগিয়ে আসে ।

‘ ডাক্তারবাবু , বেশি কিছু্ বাজার করেন নাই ? থলিটা হালকা ! কি কিনলেন !’

‘ ঐ তেল নুন চিনি দেশলাই । বাড়ির বাগানে কিছু্ সব্জি হয় । চা্উলতো আসে্ই । তাই ‘

‘ ঠিক আছে্ , যা্ন ‘

নিশিকান্ত তাড়াতাড়ি বাড়ির পথে হাঁটা দেন ।

বাড়ির দরজার সামনে দুটি মালপত্রে ঠাসা গরুর গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে । বাড়ির ভিতর থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে । নিশিকান্ত বাড়িতে ঢুকে থমকে গেলেন । দুলির মা নিভাননাকে জড়িয়ে কাঁদছেন । দুলিরবাবা একপাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন । একদিকে ইন্দ্রানী কাঁদছে এবং দুলিকে বলছে ,

‘ কেন তুই যাবি ? আমি কার সাথে খেলব ? বাবু দেখ দুলিরা চইলা যাইতেসে্ ! তুমি অদের যাইতে না কর না ‘ ইন্দ্রানী কাঁদতে থাকে ।

নিশিকান্ত তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে ঝোলা রেখে বাইরে এলেন । দুলির বাবা হাত জোড় করে বলেন ,

‘ চইলা যাইতেছি্ ডাক্তারবাবু । এই শহরে আর আমাদের থাকন যাইবে না ! খুব কষ্ট হইতেছে ।‘ নিশিকান্ত দুলির বাবার কাছে গিয়ে পিঠে হাত রাখেন । দুলিরবাবা আর নিজেকে সামলাতে পারেন না । নিশিকান্তকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকেন ।

‘ দাদা ঈশ্বর জানেন কেন আমরা যাইতেছি । অনেকদিনের ভয় দেখানো ,বাড়ি ছাড়ার হুমকি , অন্ধকারে বাড়িতে ঢুইকা দুলির মায়ের ধর্মনাশের চেষ্টা , কি হয় নাই ! কাউরে কইতে পারি নাই ! পুলিশ কইছে ‘আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি , কিন্তু পরে আপনারা সামলাইতে পারবেন তো ?’ কোথায় গিয়া বিচা্র পাব আপনে কন দাদা । আপনে শহরের গন্যমান্য লোক ! আপনের জন্য দুটা লোক খাড়াইবে । আমার পাশে কেউ ভয়ে দাঁড়ায় নাই ‘

‘ কোথায় যাইতেসে্ন ‘ নিশিকান্ত ধরা গলায় বললেন ।

‘ কুচবিহার ‘

‘ গরুরগাড়ী কইরা অনেক ঘুইরতে হইব ! ধরলা পার হইয়া ঢোকেন । তাড়াতাড়ি হইব । নইলে অনেক সময় লাগবো । সন্ধ্যা হইলে বিপদ হইতে পারে ‘

‘ এই সংসারের জিনিস ফেলায়ে যাব , দাদা ? আপনে কন ? ধরলার খেয়া পারে ভীড় । নৌকা কম । অনেকেই চইলা যাইতেছে ! নৌকায় মাল তুলতে দিতেসে্ না । পাড়ে লোক খাড়ায় আসে্ । অরা দশ টাহা কুড়ি টাহা দিয়া এই সব মাল এক সাথে কিনতেছে্ । আপনে কন , আমার খাট , দেবিল আলমারি জামাকাপর , বাসনকোসন সব মিলা দশ টাকা ? এ কোথাকার বিচার ?’ দুলির বাবা কাঁদতে থাকেন ।

‘ আমার এই বাড়ি একশ টাহা দিতে চাইি্ল । দুই কাটা জমির উপর একতলা কাঠের বাড়ি , আপনি কন , একশ টাকা হয় ? আমি কারোরে বেচি নাই । আপনেরে চাবি দিয়া যাইতেছি্ । বাড়িটার তুলসী তলায় আমার সাত বছরের ছেলেটা মরলে ঐ খানে শুয়ায় রাখছিলাম । যতদিন না বাড়ি দখল হয় , আপনি মাঝে মাঝে তূলসীতলায় প্রদীপ দিয়েন দাদা । আমার মরা ছেলেটা আমাদের খোঁজে যে !’

জীবন ফেটে অবরুদ্ধ কান্না বেরিয়ে আসছে । নিশিকান্ত , তাঁর দুই মেয়ে ,আসমা স্ত্রী গলিতে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকেন দুলিরা চলে যাচ্ছে । আস্তে আস্তে গরুর গাড়ীর আওয়াজ মিলিয়ে যায় । ইন্দ্রানী বাবার বুকে গুঁজে কেবলই কাঁদতে থাকে ।

নিভাননার চিৎকার শোনা যায়,

‘ এইডা কি ? কি আনছো্ তুমি ?’

নিশিকান্ত রান্নাঘরে দৌড়ে যান । নিভাননা থলে থেকে বের করা জিনিস মাটিতে রেখে বড়বড় চোখে তাকিয়ে আছেন । নিশিকান্ত তাড়াতাড়ি রিভলবারটি পকেটে ঢোকান ।

‘ ঐটা কি আনছো্ ?’

‘ সুনু , চেঁচায়োনা । পর কমু ‘ নিশিকান্ত তাড়াতাড়ি দোতলায় উঠে কাঠের আলমারির মাঝের তাকে জামাকাপড়ের পেছনে রিভলবারটি রাখেন । রাখতে অসুবিধে হচ্ছে । কোন প্যাকেট । নিশিকান্ত প্যাকেটটি বের করেন । একটি শিশি । ভিতরে ভর্তী ধুতুরা ফুলের বিচি ।

‘ প্যাকেট টা তোমার বন্দুকের পাশে থোও । তোমার বন্দুক আমাদের বাঁচাইতে না পারলে ঐ বিচি গুলান আমাকে এবং তোমার মেয়েদের সম্মানহানী থেইকা বাঁচাবে ‘

নিভাননা দাঁতে দাঁত চেপে বললেন ।

( ১১ )

আবু হোসেন একটা লাঠি নিয়ে আস্তে আস্তে নিশিকান্তের বাড়ি এসেছেন । হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে । সঙ্গে দুইটি ছেলে । তারা নিশিকান্তের বাড়ির বাইরে গলিতে আছে । কারফিউ তুলে এখন ১৪৪ ধারা চলছে ।

‘ তুই আইলি ক্যান ? তর শরীর ভাল নাই । আমিই যাইতাম !’ নিশিকান্ত বলেন ।

‘ বৌদি , আপনে ভিতরে যা্ন । একটু নিশির সাথে কথা কই ‘ আবু হোসেন বলেন ।

‘ চা দিই ভাইজান ?’

‘ হ , দ্যান ‘

কয়েকজন রুগী আজ এসেছেন । রতন নিচে চেম্বার ঠিক করছে । আবু হোসেন নিশিকান্তের দিকে ঝুঁকে বললেন ,

‘ আসমাকে ঘরে রাখছস্ ক্যান ? তর মাথা খারাপ হইছে নিশি ? ‘

‘ কস কি ? ঐটুকু মেয়ে বাড়ি আসছে্ । মা বাপ কোথায় জা্নে না ! অরে তাড়ায় দিব ? ভগবান নাই ?’

‘ না ! ভগবান ঈশ্বর আল্লা কেউ নাই ! থাকলে এই পাপাচা্র হয় না ! ধর্মের নামে দ্যাশভাগে ছুতায় কিছু মুসলমান হিন্দুদের তাড়াইয়া তাদের সম্পত্তি টাকা পয়সা নিতে চায় , হিন্দু মেয়েদের দিকে কুনজর ! তুই বোঝস না ?’ আবু হোসেনের গলা উত্তেজনায় চড়ে যায় ।

‘ তো কি করুম ? অসহায় আসমাকে ঘর হইতে তাড়ায় দিব ? অরে মাইরা ফেলব ? ধম্মে সইবে না আবু !’

‘ আমি জানি না । আমি কিছু্ জানি না । তুই অহনই আসমাকে বাইর কর । আমি অরে আমার বাড়ি রাখুম । নইলে খুব ঝামেলা হইব । আমি খবর পাইছি্ । এই ছু্তায় খোদা বক্স লোকজন জুটায়া তর বাড়ি হামলা করবে ! ‘ আবু হোসেন অস্থির হয়ে ওঠেন ।

নিভাননা দুই কাপ চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন । নিশিকান্তর মাথা কাজ করছে না । মানুষ কত নিচে নামতে পারে ! আবু হোসেন ডিসে ঢেলে তাড়াতাড়ি চা খেতে থাকেন । নিশিকান্তের চা টেবিলে জুরোতে থাকে । নিশিকান্ত মেঝের দিকে চেয়ে আছেন । চোখে জল ।

নিভাননা আস্তে বলেন ,

‘ ভাইজান্ , আসমা আমার প্যাটের মেয়ের মতো ! কোন পাষন্ডরা অর মা বাবাকে মারছে জা্নি না ! অদের পাপের বিচা্র উপরআলা করবে । আমি আসমারে ছাড়ুম না ! আমার দুই মেয়ে যদি এই অবস্থায় আপনার বাড়িতে যাইত , আপনে তাড়ায় দিতেন ? বাইরের পশুদের হাতে ছাইড়ে দিতেন ?’

আবু হোসেন হতভম্ব হয়ে একবার নিশিকান্ত একবার নিভাননার দিকে তাকান । উনি বুঝতে পারেন না তাঁর বন্ধু ও স্ত্রীকে । এরা কি ধাতুতে তৈরী ! তাঁর নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয় । নিচে গোলমাল হচ্ছে । সদর দরজার বাইরে কিছু লোকের জটলা । ওখান থেকে চিৎকার আসে ,

‘ এই শালা নিশি ডাক্তার , বাইরে আয় ! আসমাকে ঘরে ঢুকাইয়া মারছিস্ ! তরে ছাড়ব না । নাড়ায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর !’

আবু হোসেন লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়ান । তাঁর চোখমুখ লাল হয়ে গেছে ।

‘ নিশি , তুই থাম । আমি দেখতাছি্ ‘ আবুহোসেন সিড়ি দিয়ে নামতে থাকেন । নিশিকান্ত পেছনে নামনে । রিভলবারটা কি সঙ্গে নেবেন ?

আবু দরজার সামনে কথা বলছেন । ওনার সঙ্গে আসা দুইজন ছেলে মোটা লাঠি , তরোয়াল হাতে নিশিকান্তের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে পাহারা দিচ্ছে । ওদের একজন সামনের জনতার উদ্দেশ্যে বললে ,

‘ ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করলেই কাইটা ফেলব ! আল্লাহু আকবর ‘

ভীড় থেকে আওয়াজ আসে ,

‘ তরাও মুসলমান । এই হিন্দুদের হইয়া দালালি মারিস ক্যান ? সর সামনে থিকা !’

‘ এই মজিদ , আমি তদের সবকটাকে চিনি । তরা এই ডাক্তারের ওষুধ খাইছিস । এই ডাক্তার এক বাপ মা হারা মুসলমান মেয়েকে আশ্রয় দিছে্ ! তদের লজ্জা হয় না ? কেন আসছিস আমি বুঝি না ?’

‘ আবু মাস্টার অহন নিশিডাক্তারের সাথে থইক্যা হিন্দু হইছে্ । ঐ আবু হোসেন ইসলামের কলঙ্ক ‘ মজিদের চিৎকার ।

ধস্তাধস্তি শুরু হয় । আবু হোসেনের সঙ্গে আসা দুই ছেলে দরজার সামনে শক্ত ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে । ওদের গায়ে মার পড়ে। ওরাও পাল্টা দেয় । ওরা চিৎকার করে ,

‘ আমরাও মুসলমান । কিন্তু তদের মত জানোয়ার নই । সইরা যা , নইলে মড়বি ‘

পিছন থেকে নিভাননার গলা শোনা যায় ,

‘ দ্যাহেন সব , আমি মা , আমার কোলে এই আসমা । ও আমার সন্তান । ক্ষমতা হয় , কাছে্ আসেন ‘ নিভাননা আসমাকে কোলে নিয়ে বুকে চেপে দাঁড়িয়ে আছেন । নিভাননার হাতে বঁটি । আসমা নিভাননাকে ধরে আকুল হয় কাঁদছে ,বলছে ’ আমি যামুনা ,আমি যামুনা ‘ ।

‘ অরে , আসমার সাথে ঐ মা-টারেও তুইলা আন ‘ মজিদ বলে । উত্তেজনায় ওর নাকের পাটা ফুলে গেছে । চোখ দুটো দানবীয় সন্ত্রাসে লাল ।

‘ খবর্দার ‘ আবু হোসেন চিৎকার করেন । বারান্দায় দাঁড়িয়ে চন্দ্রানী ইন্দ্রানী ‘মা ,মা ‘ বলে কাঁদতে থাকে ।

নিশিকান্তকে দেখানোর জন্য কিছু রুগী এসেছে , তারা ভয়ে চেম্বারের ভেতর ঢুকতে চইছে । কেবল এক দশাশই চেহারা মানুষ তাঁর মেয়েকে নিয়ে এসেছেন , নিশি ডাক্তারকে দেখানোর জন্য । উনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলেন । গালে দাড়ি । মাথায় টুপি । তার মুখের পাশ দিয়ে একটি পাথড় সোজা ডিস্পেন্সারিতে ঢুকে ওষুধ রাখার কাচের আলমারিতে পড়ে কাচ চুরমার করে দিল ।

মানুষটা এক লাফে বাইরে বেরিয়ে এলেন । ‘ ডাক্তারবাবু , মাজননী , আবু সাহেব আপনারা ভিতরে যান , আমি দেখতেছি্ ‘

উনি ভাড় ঠেলে বাইরে বেরিয়েই মজিদের মুখে এক ঘুঁষি মারলেন । মজিদ ছিটকে পড়ল । মজিদের জামা খামচে টেনে তুলে আবার সপাটে গালে চড় মারলেন । মজিদ সামনের ড্রেনে গিয়ে পড়ে । ওর নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে । এইবার মানুষটা মজিদের সঙ্গীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন । এলোপাথারি চড় ঘুষি চালাতে লাগলেন । মুহূর্তে আক্রমনকারী জনতা ছত্রখান। মানুষটা হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন ,

‘ মজিদ , আমারে চিনা রাখ । বাওমি গ্রামে থাকি । কসাই আমি । আমার নাম বদরুদ্দোজা । ফজরের নমাজ পইড়া আইছি । তর মতো জানোয়ারের জন্য যোহরের নমাজ পড়া হইল না। আল্লা সব দেখতাসে । আমি আসমাকে আজ নিয়া যাব । ক্ষমতা থাকলে আটকা । আর এই ডাক্তারবাবুর উপর চোখ দিলে চোখ গাইলা দিব ‘

মজিদের দলবল পালায় । মজিদ রক্তাক্ত মুখ ঘুরিয়ে বলে ,

‘ সব হিসাব নিব ‘ , তারপর দৌড়ে পালায় ।

পরিস্থিতি শান্ত হলে নিশিকান্ত আগে রুগীদের দেখেন । বদরুদ্দোজা বলেন ,

‘ ডাক্তারবাবু , কি আর বলি ! লজ্জায় মাথা কাটা যাইতেছে্ আমার । এই জানোয়ার গুলা আমার স্বজাতি ! ভাবতেও ঘিন্না হয় । আমি আসমারে নিয়া যাইতেছি্ । চিন্তা করবেন না । ও আমার মেয়ের মতো থাইকবে । আর এটা কথা , আপনে ভয় পাবেন না । আবু সাহেব ,আমি এমন অনেকেই আপনার সঙ্গে আছি্ । এই সীতারহাট ছাইড়া যাইয়েন না । আমরা অনাথ হইব ‘

বদরুদ্দোজা তার অসুস্থ মেয়ে আর আসমাকে কোলে নিয়ে চলে গলেন । নিভাননা রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে কাঁদতে থাকেন ।

আবু হোসেন , তার সঙ্গী দুইটি ছেলে রতন ও নিশিকান্ত চেম্বারের বাইরে বসার যায়গায় বসে আছেন । সুখেন দারোগা গোলমালের খবর পেয়ে একটু আগে এসেছেন । বললেন ,

‘ এই প্রতিরোধ না থাইকলে এই তান্ডব বন্ধ করন যাইবো না । হিন্দু মুসলমানকে এক হইতে হবে । দেশভাগ হইলে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা সংখ্যাগুরুদের দিতে হইব ।‘

‘ মানুষ পশু হইলে কি কইরা লড়বেন দারোগা বাবু ?’ আবু হোসেন বলেন ।

সুখেন দারোগা আবু হোসেনের দিকে তাকিয়ে আছেন । বললেন ,

‘ দুইদিন পর ১৬ই আগস্ট ‘

‘ হ । আপনেরা কার্ফু লাগায়ে রাখেন । আমরা পাড়ায় ছেলেদের প্রতিরোধ , হিন্দুদের রক্ষার জন্য তৈরী করতেছি । দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে সরকার খুব কড়া , এই বার্তা দেওয়া খুব দরকার এহন ! ‘

সুখেন দারোগা চুপ থাকেন । অনেক দুর থেকে তাঁর গলা ভেসে আসে,

‘ আমাদের ঐ দিনে কার্ফিউ জারি করতে নিষেধ করা হইছে , উপরতলা থিকা । রুটিন কাজ করতে কইছে । কোন প্রোঅ্যাক্টিভ রোল নিতে বারন করছে ‘

আবু হোসেন হতভম্ব হয়ে সুখেন দারোগার দিকে তাকিয়ে থাকেন । নিশিকান্তর পিঠ দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে যায় ।

( ১২ )

আজ সকাল সকাল সন্ধ্যে দিয়ে নিভাননা তার দুই কন্যা ও স্বামীকে নিয়ে তাড়াতাড়ি যাচ্ছেন দুলিদের বাড়িতে । তাঁর হাতে ঝাঁটা । চন্দ্রানীর হাতে বালতি ভরা জল । ইন্দ্রানী দুহাতে ধরে প্রদীপ নিয়ে যাচ্ছে , প্রদীপে তেল ও পলতে । বাড়িতে রতন আছে । নিশিকান্তরা ফিরলে রতন বাড়ি যাবে ।

নিশিকান্তের বাড়ির কয়েকটি বাড়ি পড়েই দুলিদের বাড়ি । দুলিদের বাড়ির উত্তরে জংলা জমি । দুলির বাবা চলে যাওয়ার আগে অনুরোধ করে গেছেন, সম্ভব হলে বাড়িতে একটু সন্ধ্যাবাতি দেখাতে । আজ নিভাননা পাড়ার কয়েক ঘরকে আসতে অনুরোধ করেছেন । দুলিদের বাড়িতে নামসংকীর্তন হবে ।

নিশিকান্ত সদর দরজা খুলে ভেতরে পা রাখলেন । প্রায় অন্ধকারে তিন ঘরের কাঠের বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে । দুদিনেই বাড়িতে , বাড়ির বারান্দায় , ছোট উঠোনে ধুলোবালি শুকনো পাতা জমেছে । বাঁদিকে তুলসী মঞ্চ । তার পাশে একটি জবাফুলের গাছ । অনেক ফুল ফুটে আছে । এখনও তুলসী মঞ্চে চাল গুড়োর আল্পনা ,পরিপাটি করে আঁকা । রেখে যাওয়া প্রদীপে দুটো তুলসী পাতা । দুদিন আগেও এই বাড়িতে মানুষ থাকত । এক শিশুর কলধ্বনিতে উঠোনে চাঁদ জোছনা ঢেলে দিত । শাঁখ বাজতো । তাঁদের ছেড়ে যাওয়া স্মৃতিগুলো এখন ভীষনভাবে জীবন্ত । নিশিকান্তের দুচোখ জলে ভরে গেল ।

নিভাননা ঝাঁটা দিয়ে উঠোন ঝাড়লেন । তুলসী মঞ্চ পরিস্কার করলেন । রেখে যাওয়া প্রদীপটি পরম মমতায় তুলে ঘরের বন্ধ দরজার সামনে রাখলেন । নতুন প্রদীপটি রাখতে গিয়ে দেখেন ইন্দ্রানী তুলসী মঞ্চের পছনে কি যেন দেখছে ।

‘ কি দেখিস মা ?’

‘ মা, দ্যাহ এইখানে দুলি লিখা আছে্ । আর লিখা আছে দাদা । এইটা মা দুলি লিখছে ?’

নিশিকান্ত ছোটমেয়ের পাশে দাঁড়ান । মানুষের স্মৃতি ঈশ্বরও মুছতে পারেন না । দুলির দাদা তিন বছর আগে ওলাওঠায় মারা গেছিল । এই তুলসী তলায় তাকে রাখা হয়েছিল , এমনই এক সন্ধ্যায় । সে সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বলেনি । মা বাবার বুক ফাটা হাহাকার , বিদ্ধস্ত চিকিৎসক নিশিডাক্তার , পড়শীদের কান্না এবং নিভাননার কোলে ছোট্ট দুলির আধো স্বরে ‘দা..দা’ ডাক এই সব কিছুর সাক্ষী হয়ে তুলসী গাছটি আজও দাঁড়িয়ে আছে ।

পাড়ার অনেকেই এসেছেন । নিধু গোয়ালা ও তার বৌ , সস্ত্রীক হরি মাষ্টার ,বুড়ি আলো বামনী ,ব্যবসায়ী নরেন ও তার দুই ছেলে মেয়ে , বিধবা মাধবী এমন অনেকে । প্রদীপ জ্বালিয়ে নিভাননা গড় হয়ে প্রণাম করলেন । সবাই উঠোনে বসেছে । তুলসী তলার পাশে বসে কানাই বোষ্টম ও তাঁর বোস্টমী খোল করতালে গাইতে লাগলেন ,

‘ হরে মুরারে মধুকৈটভারে
গোপল ও গোবিন্দ মুকুন্দ শৌরে
যজ্ঞেশ নারায়ণ কৃষ্ণ বিষ্ণো
নিরাশ্রয় মাং জগদীশ রক্ষো ‘

সবাই আস্তে গলা মেলাতে লাগলেন । সবাই যেন ঈশ্বরের কাছে মুক্তি যাইছেন । নিশিকান্ত কাঁধে স্পর্শ অনুভব করলেন । ঘুরে দেখলেন আবু হোসেন বসে আছেন । উনিও গলা মেলাচ্ছেন । নিশিকান্ত আর পরলেন না , বন্ধুর কাঁধে মাথা রেখে নিঃশব্দে কেঁদে ফেললেন । আবু হোসেন বন্ধুকে জড়িয়ে ধরলেন । রুদ্ধ কন্ঠে তিনিও গলা মেলাচ্ছেন ‘গোপল ও গোবিন্দ মুকুন্দ শৌরে ‘ ।
সেদিন সাক্ষী ছিল তুলসী , সাক্ষী সন্ধ্যে রাত্রি , সাক্ষী মানুষের কদাচার , সাক্ষী মানুষের ভালবাসা , ঈশ্বর দেখেছিলেন সব কিছু ।

‘ হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে
হরিবোল হরিবোল গৌর হরিবোল ‘

সবাই উঠে দাঁড়িয়ে গলা মেলাচ্ছেন । এক সময় সংকীর্তন শেষ হল । নিভাননা সবাইকে বাতাসা দিলেন । সবাই প্রায় নিঃশ্চুপে বিদায় নিলেন । যাওয়ার আগে হরি মাষ্টার নিশিকান্ত ও আবু হোসেনের কাছে এসে বললেন ,

‘ আমাদেরও এমন কইরা সব ফ্যালাইয়া চইলা যাইতে হইবে , তাই না ?’ হরি মাষ্টারের পিছনে নিধু , নরেনও দাঁড়িয়ে আছে । নিশিকান্ত চুপ করে থাকেন । আবু হোসেন বলেন ,

‘ মনে জো্র রাখেন । আমরা আছি্ । ক্যান যাবেন ? সব্বাই থাকবেন ‘ ।

নিশিকান্ত বললেন,

‘ সব্বাই বাড়ি ফেরেন । রাত হইছে্ ।‘

নিশিকান্তরা বাড়ি ফিরছেন । আবু হোসেন এগিয়ে দিচ্ছেন । একটু পিছনে আবু হোসেনের সঙ্গী দুইটি ছেলে। ওরা পেছন পেছন আসছে । হাতে শক্ত লাঠি । অন্ধকারে মিশে হাঁটছে ।

‘ রাস্তায় কোন লোক নাই আবু ! সীতারহাটে মনে হইতেছে এক ঝড় আসতেছে্ । তুই বাড়ি যা । ‘

‘ আমার চিন্তা নাই । পিছনে দেখ ‘

নিশিকান্ত ছেলে দুটিকে দেখতে পান । ওরা সেদিন সকালে তাঁর বাড়ি আক্রমনের সময় প্রতিরোধ করেছিল ।

‘ তর কে হয় ?’

‘ আমার দু ছাত্র , ইকবাল আর রশিদ । ইমানদার । ওরাই আগায় আইছে । তরে আমারে পাহারা দেয় । অমন আর কিছু ছে্লে যোগাড় হইছে্ । অত ভাবিস না । আমি আছি্ । একটা কথা কইতে ভুইলা গেছি্ । রামু রংপুর হাসপাতালে মইরা গেছে । ইমাম সাহেবের অবস্থা খারাপ ।‘

দুলিদের বাড়ির উত্তরের ফাঁকা জমির পায়চলা পথে কানাই বোষ্টম ও বোষ্টুমী ঘরে ফিরছে । নিশি ডাক্তার পাঁচ টাকা দিয়েছেন । সঙ্গে চাল আলু তেল । আবু হোসেনও দুইটাকা দিয়েছেন ।

‘ বড় ভাল মানুষ ডাক্তারবাবু ! অনেক বড় মনের । আবু সাহেবও খুব ভাল ‘ কানাই বলে ।

‘ হ ‘ বোষ্টুমী জবাব দেয় ।

পেছনে খসখস আওয়াজ । কানাই ঘুরে দেখে চারজন মুখ ঢাকা লোক ।

‘ কে তোমরা ? কি চা্ও ? ‘

‘ শালা হরিনাম করিস ..’ বলতে বলতে একজন ঝাঁপিয়ে কানায়ের বুকে ছুড়ি ঢুকিয়ে দিল । চাল তেল আলু খোল সব ছিটকে পড়ে । ‘কৃষ্ণ’ বলতে বলতে কানাই স্থির হয়ে গেল ।

বোষ্টুমী ‘ বাঁচাও বাঁচাও ‘ বলতে বলতেই একজন ওর মুখ চেপে ধরে মাটিতে ফেলে দিল । চারটে পশু বোষ্টুমীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল । শরীরের কাপড় সব ছিঁড়ে দিল ।

আধ ঘন্টা পর একজন বোষ্টুমীর নলী কেটে দিল । চারজন হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল ।

( ১৩ )

দাবানলের মত পুরো শহরে কানাই বোষ্টম ও বোষ্টমীর হত্যার খবর পৌঁছে গেছে । সুখেন দারোগা চাইছিলেন সকাল সকাল সুরতহাল করে বডি দুটো রংপুরে ময়না দতন্তে পাঠাবেন । দুই কনস্টেবল নিয়ে অকুস্থলে পৌঁছে ধাক্কা খেলেন । ইতিমধ্যে চল্লিশ পঞ্চাশজন লোক জড়ো হয়েছে । মৃদু গুঞ্জন । সুখেন দারোগা বেশ কয়েকজনকে কাঁদতে দেখলেন । তাঁর অস্বস্তি বাড়ালো কুড়ি পঁচিশ জন জোয়ান ছেলে ,যাদের অনেকের হাতে মোটা লাঠি । পুলিশি চোখে নজরে এল অনেকেরই কোমড়ে সামনে বা পিছনে কিছু শক্ত গোঁজা আছে । এরা বাগদি – ঘোষ পাড়ার ছেলে ।

‘ সরেন সবাই , আমারে কাজ্ করতে দ্যান ‘ সুখেন দারোগার গলা শোনা গেল । জনতা সরে রাস্তা করল ।
এক লাফে ঘোড়া থেকে নেমে কানাই বোষ্টম ও দূরে পড়ে থাকা বোষ্টুমীর দেহের দিকে নজর গেল । এতটা ভয়াবহতা আশা করেন নি সুখেন । কানাই বোষ্টোমের খোলা বিস্ফোরিত দুই চোখ সভ্যতাকে ব্যঙ্গ করছে । বোষ্টুমীর মুখ , কাটা গলার ওপর মাছি ভনভন করছে । তাড়াতাড়ি আইনের কাজ করে সুখেন ডেড বডি দুটো সঙ্গে আনা ঘোড়ায় টানা গাড়ির ওপর চাপালেন । গাড়ি চালক ত্রিপল দিয়ে বডি দুটো ঢেকে দিল । গাড়ির দুইপাশে দুই কনস্টেবল এবং সামনে সুখেন দারোগা ঘোড়ায় চেপে রওনা দিলেন ।

‘ এইবার কি হইবে দারোগা বাবু ?’ পিছন থেকে কর্কশ কন্ঠে আওয়াজ এল ।

‘ পোষ্ট মর্টেম হইব ।‘ সুখেন দারোগা ইসারায় ঘোড়ার গাড়িচালক ও কনস্টেবলদের এগোতে বললেন ।

‘ ঐ আইনি কাজ্ জা্নতে চা্ইনা ! সোজা কথায় বলেন , এর বিচার দিতে পারবেন ?’

‘ সরকারী আইনে বিচার হইব !’

‘ আরে থোন আপনের সরকারী ! মুসলমানরা মারতেছে্ । রামু কে মারছে্ । জোর কইরা হিন্দুদের ঘর ছাড়ন করা হইতেছে্ ! ঘরে আগুন দিতাছে্ । মাইয়াদের তুইলা নিয়া যাইতেছে্ ! আপনেরা কিছু্ জানেন না ? আপনেরা কি করতেছে্ন ?’

‘ এই ভাবে বইল না ! দুপক্ষেই মারামারি চলতেছে্ । আমরা খবর রাখি না ভাইব না । আমরা আমাদের কাজ্ ভাল বুঝি্ ! ‘

‘ খবর রাইখা কি করেন ? কেন আটকইতে পারেন না ? পুলিশ পারে না এমন কাজ আছে্ ? ‘

সুখেন দারোগা থমকে যান । এরপরের উত্তর তাঁর জানা নাই । গলা উঁচিয়ে বললেন ,

‘ কেউ ঝামেলা করবা না । সব্বাই ঘরে যাও ‘

‘ কানাই বোষ্টম ও তার পরিবারের এই খুনের বদলা নিব । কাজ ঠিক করতেছেন না আপনেরা ‘

কতগুলো উদ্ধত ক্ষিপ্ত মানুষের মুখোমুখি সুখেন দারোগা । উনি ঘোড়ার মুখ ঘুড়িয়ে লাশ দুটোর পিছন পিছন যেতে থাকেন । ত্রিপলে পুরো শরীর ঢাকা যায় নি । বোষ্টম-বোষ্টমীর পা দুটো বেরিয়ে আছে । ঝুলছে । রাস্তার ঝাঁকুনির তালে নাচ্ছে ।

রাস্তার দুপাশে লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । কেউ কাঁদছে । বুড়ি আলো বামনী কোত্থেকে ছুটে এসে ঝুলন্ত পা গুলো জড়িয়ে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে ,’ কৃষ্ণ ,তুমি বিচার কইরো ‘

‘ এই সর সর ! লাশের গায়ে হাত দেওয়া বেআইনি ‘ একজন কনস্টেবল বামনীকে সরিয়ে দেয় ।

‘ এদের লাশ বানানো বোধ হয় আইনি তাই না দারোগাবাবু ? ‘ চাবুকের মতো কথাটা বাদিক থেকে সুখেন দারোগার কানে এল । মাথা ঘুড়িয়ে দেখেন আবু হোসেন দাঁড়িয়ে আছেন , চোখদুটো লাল ।

‘ সরকার চাইলে এইসব বন্ধ কইরতে পারে ! ক্যান করে না ? ক্যান ? এই দুই মানুষ ঈশ্বরের নামগান করত ! আপনেদের লজ্জা নাই ? আপনেরা সরকারের প্রতিনিধি , উত্তর দ্যান ‘ আবু হোসেন আর বোলতে পারেন না । দু হাতে মুখ ঢেকে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকেন । বিড় বিড় করেন

‘ আল্লা , এর বিচা্র কইরো ‘

লাশ দুটো এগোতে থাকে । সুখেন দারোগা মুখ শক্ত করে পিছনে যাচ্ছেন । কিছুটা গিয়ে বাঁদিকে চোখ গেল ।

নিশিডাক্তার , তাঁর স্ত্রী , দুই কন্যা বাড়ির সামনে পাথড়ের মতো দাঁড়িয়ে আছেন ।

রাত নেমেছে । থানায় দারোগাবাবুর ঘরে কিছু মানুষ বসে আছেন । জগদীশপ্রসাদ , তামাকের আড়তদার একরাম আলি , ফল ব্যবসায়ী ইদ্রিস , মিষ্টির দোকানের গোপেন । প্রায় সবাই ব্যবসায়ী । গলা খাকারি দিয়ে সুখেন শুরু করলেন ,

‘ পরশুদিন ১৬ই আগস্ট , মুসলিম লীগ দেশজুড়ে হরতাল ডাকছে । আবার কইছে ঐ দিন ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে । আপনেরা কি করবেন ঠিক করছে্ন ?’

‘ আমরা খুলা রাখব সব ‘ প্রায় সবাই একবাক্যে বললেন ।

‘ আমার কাছে্ খবর আছে্ ঐদিন ঝামেলা হইবে ! আপনেরা বন্ধ রাখেন সব । চারদিকে গন্ডগোল । দোকানপাট খোলা রাইখলে ঝামেলা বাইরবে !’

‘ এ আপনি কি বোলছেন দারোগাবাবু ! আপনি আমাদের বেওসা যাতে ঠিক চলে সেইটাতে হেল্প না করে বন্ধ করতে বলছেন ? এ কি রকম কথা ?’

‘ ঠিক কইতেছি্ । ঝামেলা হইলে সামলানোর পুলিশ নাই ‘

‘ পুলিশ নাই ক্যান ? আমরা ট্যাক্স দেই না ? আপনে মুসলিম লিগের হইয়া কথা কইতেছে্ন দারোগা বাবু ! ‘ ইদ্রিস উত্তেজিত হয় ।

‘ মুখ সামলাও ইদ্রিস ! কার সাথে কথা কইতেসো্ জান না ?’ কনস্টেবল সাবির চেঁচায় ।

সুখেন দু হাত তুলে দাঁড়ান ।

‘ দ্যাহেন , সবার ভালোর জন্য কইতেছি্ । বাকিটা নিজেদের বিচার ‘

থানা থেকে সবাই বেরিয়ে গেলেন । সাবির সুখেনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ।

‘ স্যার , ঐ হরতালের দিন আমরা কি করব ?’

‘ তর কি মনে হয় ?’

সাবির চুপ করে থাকে । সুখেন দারোগা আস্তে আস্তে বলেন ,

‘ আমাদের রুটিন কাজ করতে কইছে উপর থিকা । কেউ অভিযোগ জানাইলে যাব , অবস্থার গুরুত্ব বুইঝ্যা !মানে বোঝস ? ঐ দাঙ্গায় কে কিভাবে অভিযোগ করতে আসবে ?’

‘ স্যার এইডা খুব খারাপ স্যার ‘ সাবিরের আর্তনাদ !

‘ চিরকাল এইভাবে দাঙ্গায় সন্ত্রাসে হয় শাশ্বত ক্ষমতার আস্ফালন । যারা ক্ষমতাবান তারা শক্তিশালী । তাদের ছুড়ি বুকে বসে , চলে হুমকি , লুঠ । তারপর সাধারন মানুষ বাঁচার জন্য ছোটে অন্ধ রাস্তায় । তবু বাঁচে না । ঘর থিকা টাইনা চলে শ্লীলতাহানী । আমরা আর রাস্তায় বাইরাইবো না । তরোয়াল কাটুক কারো গলা । আমরা খালি লাশ গুনব , লাশ তুলব ‘ সুখেন দারোগা দুহাতে মুখ ঢেকে টেবিলে মাথা নামান ।

ওসমান তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরছে । রাত হয়েছে । ও গোপেনের মিষ্টির দোকানে কাজ করে । এতক্ষন দোকানে ছিল । গোপেন গজগজ করে থানা থেকে ফিরল । থানা নাকি পরশু হরতালের দিন দোকান বন্ধ রাখতে বলেছে ।

ওসমান ওর ছোট্ট বাড়িতে একা থাকে । ওর মা বাবা কেউ নেই । এখন গিয়ে ভাত বসাবে । ওর মধ্যে দুটো আলু ছেড়ে দেবে । তালা খুলে ঘরে ঢোকার সময় দেখে অন্ধকারে বুড়ি আলো বামনী দাঁড়িয়ে আছে ।

‘ এত দেরী করলি ক্যান বাপ ?’

‘ দেরী হইল মা । আর ভাইব না ‘ । আলো বামনী ওসমানের পাশের বাড়িতেই থাকে । ওসমানকে পুত্র স্নেহে দেখে । ওসমান বোঝে । ও মাঝে মাঝে মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি এনে আলো বামনীকে খাওয়ায় ।

‘ তর আইজ রাধন লাগবো না । আমার কাছে ভাত খাবি ,আয় ‘

‘ চল , খুব খিদা লাগছে ‘ ওসমান খুশি হয়ে বলে ।

ওসমান ঘরে বসে খাচ্ছে । আলো বামনী লন্ঠনের আলো বাড়িয়ে দেয় । ওসমানের মুখ দেখে । কি সুন্দর !

‘ কি দ্যাথতেসো্ মা ?’

‘ তরে ‘ আলো বামনীর কথা শেষ হয় না , বাইরে অনেক লোকের আওয়াজ । মশালের আলো । শোনা যায়,

‘ ওসমান ম্লেচ্ছ কুথায় ? শালা , এই তো বাড়ি । বন্ধ । আগুন লাগা । এই পাশে বুড়ির বাড়ি দ্যাখ । হর হর মহাদেও !’

ওসমান আতঙ্কে লফিয়ে ওঠে । কাঁপতে থাকে । আলো বামনীর পিছনে দাঁড়ায় । বলে,

‘ মা অরা আমারে মারতে আসছে ‘

দরজায় ধাক্কা । খুব জোরে ।

‘ এই বুড়ি দরজা খোল । ওসমান তোর ইখানে আছে ‘

ধাক্কায় দরজা ভেঙে যায় । চার পাঁচজন উন্মত্ত লোক মশাল ,তরোয়াল হাতে ঘরে ঢোকে !

আলো বামনী বঁটি হাতে দাঁড়িয়ে আছে । পিছনে ওসমান ।

‘ কেউ আসলে আমি মাইরা দিব !’ আলো বামনীর রুদ্রমূর্তি

‘ এই মুসলমান তর কে লাগে ? তুই বামুন না ? অরে আমাদের হাতে তুইলা দে !’

‘ অ আমার ছেলে । কেউ আসবা না কাছে্ ‘

এক মুহূর্ত থমকায় উন্মত্ত মানুষেরা । তার পরেই আলো বামনীর মুখে লাঠির বাড়ি এসে পড়ে । রক্তাক্ত মুখে ‘ কৃষ্ণ ‘ বলে বুড়ি পড়ে যায় । ওসমানের কলার ধরে বাইরে টেনে আনা হয় ।

‘ আমারে ছাইড়া দাও , আল্লা ‘ ওসমান বলতে চায় ।

উল্টো দিকের একটি হিন্দু বাড়ি থেকে বন্ধ জানালার ফাঁক দিয়ে কেউ দেখে আলোবামনীর বাড়ির সামনে একজনকে কোপানো হচ্ছে , তাঁর আর্তনাদ আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে ।

দুটো পাশাপাশি বাড়িতে আগুন লেগেছে । একটি হিন্দুর , আরেকটি মুসলমানের ।

( ১৪ )

‘ হাতিবান্ধা ‘ একটি ছোট গ্রাম । এখান থেকে আর কিছুটা গিয়ে ডানদিকের আমবাগানের মধ্যে দিয়ে গেলে কুচবিহারের শীতলকুচি । হাতিবান্ধার একটু আগে একটি পুলিশ ফাঁড়িতে তিনটে হিন্দু পরিবার তাঁদের গোরুর গাড়িতে মাল পত্র নিয়ে প্রায় দুদিন আটকে আছে । এরা সীতারহাট থেকে একসঙ্গে এসেছে । জন্মভূমি ,পৈতৃকভিটে , অনেক সুখ দুঃখ হাসি পিছনে ফেলে এই সব মানুষেরা পালাচ্ছে বেঁচে থাকার তাগিদে ।

পুলিশ ফাঁড়িতে আটকে আছে তাঁরা , কারন সামনে হাতিবান্ধায় দাঙ্গা হচ্ছে । পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ হাসান গতকাল সকালেই তাঁদের আটকে ফাঁড়িতে রেখেছেন ।

‘ আপনেরা সামনে যাইয়েন না । দাঙ্গা হইতেছে্ । এখন কুচ্বিহার যাওন যাইবে না । হাতিবান্ধায় আপনাগো কাইটা ফেলবে । অপেক্ষা করেন । আমি কইয়া দিব কখন যাওনের সময় । ‘ হাসান বলেন ।

দুলির বাবা , মাধব ,শম্ভু , গাড়ির চালকরা হাঁ করে হাসানের দিকে তাকিয়ে থাকে । ওদের বুক ধরফর করছে ।

‘ এতদূর আইলাম , কোন অসুবিধা হয় নাই ছা্র । তবে রাস্তার পাশের জনবসতি গুলান ফাঁকা ‘ দুলির বাবা বলেন ।

‘ এখন এইখানে থাহেন । কোথাও যাইবেন না । সঙ্গে মহিলারা আছে্ ‘

সেই থেকে এখানে আটকে আছে এই কটি প্রানী । মহিলা বলতে দুলির মা , মাধবের বৌ । মাধবের পনের বছরের ছেলে । শম্ভুর বুড়ো মা বাবা । এবং দুলি । সন্ধ্যে হয়ে গেল । গতকাল সন্ধ্যায় হাসান একজন কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে হাতিবান্ধা গ্রামে ছুটেছেন । একজন কনস্টেবল ফাঁড়িতে ছিল । গতরাতে সবাই গরুর গাড়ীর ফাঁকে বসে জেগেছিলেন । দূরে আগুনের শিখা , মানুষের চিৎকার এবং ‘ নারায়ে তাকবির , আল্লাহু আকবর ‘ এইসবে সবাই কাঁপছিলেন , মহিলারা কাঁদছিলেন । দুলি ঘুমিয়ে পড়েছিল ।

আজ আবার রাত নেমে এল । সঙ্গের খাবার প্রায় ফুরিয়ে এসেছে । কেউ চিঁড়ে , কেউ মুড়ি চিবোচ্ছেন । মাঝে মাঝে দূরে অন্ধকারে অজানা আতঙ্কে তাকাচ্ছেন ।

‘ ছা্র সেইযে কাইল গেলেন , এখনও আইলেন না তো সেপাই দাদা ‘ মাধব বলে ।

‘ কি জানি । ঝামেলা চলতেসে , তাই বোধ হয় ‘ কনস্টেবলের উত্তর ।

হঠাৎ কনস্টেবল লাফিয়ে ওঠে । হাত দুচোখের ওপর রেখে দূরে কি যেন দেখে । তারপর ভীষন উত্তেজনায় বলে ,

‘ আপনেরা তাড়াতাড়ি গরুর গাড়ি গুলা গোল কইরা রাখেন । সবাই পিছ্নের ঘরটায় ঢুইকা পড়েন আমি বাইরে থিকা তালা দিতাছি্ । কেউ ভিতরে আওয়াজ্ কইরেন না । শিগগিরই !’

দূর থেকে দেখা যাচ্ছে অনেক লোক আসছে । হাতে মশাল , তরোয়াল বল্লম । সঙ্গে গর্জন ,

‘ নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর ‘

দ্রুত সবাই পেছনের ঘরে ঢোকেন । মহিলারা কাঁদছেন । দুলি কাঁদছে । পুরুষেরা ভীষন ভয়ে চোখ বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছেন ।

‘ কাঁইদো না , শব্দ কইরো না ‘ একজন বললেন । কনস্টেবল বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিল ।

অন্ধকারে মশালগুলো দাউ দাউ করে জ্বলছে । ধর্মোন্মাদরা চেঁচায়,

‘ হেঁদুরা কই সেপাই , তাড়াতাড়ি ক ‘

কনস্টেবল তাঁর শক্ত লাঠি নিয়ে সামনে আসে ।

‘ কেউ নাই ‘

‘ এই গরুর গাড়ি গুলা কুথা থাইকা আইল ?’

‘ হাসান স্যার আইনা রাখছেন ‘

‘ অ , তাই কও । হাসান পুলিশও হেঁদুদের লুঠতেছে্ ? ‘

‘ মুখ সামলায় কথা কও । জানোয়ারের দল ! ভাগো ইখান থিকা ‘

‘ যামু না । পিছো্নের ঘর দেখুম ‘

পিছনের ঘরের মধ্যের মানুষদের হৃৎস্পন্দন দ্রুত হতে থাকে । বাইরে আওয়াজ শোনা যায় ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর , । দুইজন লোক মশাল নিয়ে দরজার সামনে আসে । দরজার ফাঁক দিয়ে আলো দেখা যায় । মানুষ গুলো কাঁপছে । আতঙ্কে সাদা হয়ে গেছে । দুলি কেঁদে ফেলল ।

‘ কাঁইদো না মা ‘ কাঁপা হাতে দুলির মুখ চাপেন দুলির বাবা ।

কনস্টেবল এক লাফে দরজার সামনে আসে ।

‘ খবরদার , এই ঘরে সরকারী মাল আছে্ । হাসান ছা্র চাবি লাগাইয়া গেছেন । হাত দিলা বড় বিপদে পড়বা ! যাও ইখান থিকা ‘

‘ তাই নাকি ? ভিতর থিকা কান্নার আওয়াজ আইল যেন ! দেখি এইবার তালা ভাইঙা ‘ ।

দরজার সামনে কনস্টেবলের সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু হল । এই ফাঁকে অন্যরা তিনটে গোরুর গাড়ি লুট পাট শুরু করল । কিছুক্ষনের মধ্যেই সব লুট হয়ে গেল । গরুর গাড়িগুলোয় আগুন দেয়া হলে গরুগুলো ভয়ে আতঙ্কে হাম্বা হাম্বা চিৎকার করতে করতে অন্ধকার মাঠে দৌড় লাগালো । দুটো গরু দড়ি ছিঁড়তে পারেনি । আগুনের গ্রাসে তাদের আর্তনাদ চাপা পড়ে গেল । বাতাসে মাংস , চামড়াপোড়া গন্ধ !

একজন কনস্টেবলের বুকে চেপে বসেছে । আর একজন উন্মত্তের মত তালা ভাঙার চেষ্টা করছে ।

‘দুম’ ‘দুম’ করে দুটি গুলির আওয়াজ । দুজনেই ছিটকে পড়ল ।

হাসান দূরে ঘোড়ার ওপর বসে আছেন । হাতে বন্দুক ।

উন্মত্ত ধর্মোন্মাদরা পিছু হটছে । মশালের আলোয় সারি সারি জিঘাংসার মুখ ।

‘ মুসলমান হইয়া মুসলমানকে মারলি হাসান ?’

‘ আমি জানোয়াররে মারছি । এইহানে থাইকলে সবকটাকে মারব ‘

‘ আচ্ছা , কতক্ষন বাঁচাইস দেখি ‘ উন্মত্ত জনতা দূরে চলে গেল ।

একটু পর, কেবল আগুন জ্বলার ফট ফট আওয়াজ । হাসান ঘোড়া থেকে নামলেন । বন্ধ দরজার সামনে গেলেন । কনস্টেবলের কাছ থেকে চাবি নিয়ে দরজা খুললেন ।

‘ মাইরো না । আমাগো মাইরো না ‘ বলতে বলতে সবাই হাসানের পায়ে পড়ল ।

হাসানের দুই পা জড়িয়ে দুলি ঠক ঠক করে কাঁপছে ।

‘ ভয় পাইও না তোমরা । আমি আছি্ ‘ হাসান পরম মমতায় দুলিকে কোলে তুলে নিলেন ।

সেই সময় সীতারহাটে একটি বাড়িতে দোতলায় একটি ছোট মেয়ে ঘুমের ঘোরে কেঁদে উঠল ।

‘ কাঁইদো না মা , কি হইছে ?’

‘ মা , দুলিকে দেখছি । ও কান্দতেছে্ ‘

‘ ঐটা স্বপ্ন মা , ঘুমাও ‘ নিভাননা ইন্দ্রানীকে বুকে চেপে ধরলেন । শূন্য চোখে জানলা দিয়ে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি । তাঁর হৃৎস্পন্দন দ্রুত হচ্ছে ।

( ১৫ )

ফজরের নমাজ পড়ে আবু হোসেন বেরিয়েছেন । ডান কাঁধে এখনও ব্যাথা । কোমড়েও ব্যাথা । সিতারার আপত্তি না শুনেই সকালে রাস্তায় হাঁটছেন । বাঁ হাতে লাঠি । মনটা বড় অস্থির হয়ে পড়েছে । আগামী কালের মুসলিম লীগের ডাকা হরতাল নিয়ে এক অজানা আশঙ্কায় আবু হোসেন । রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় সাদা কাগজে কাঁচা হাতে লেখা , কিছু ছাপানো পোস্টার ‘ পাকিস্তানের দাবীতে আগামীকালের হরতাল সফল করুন ‘ ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে ১৬ই আগস্ট ‘ ‘ লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান ‘ এমন সব পোস্টারে ছেয়ে গেছে । এ যেন যুদ্ধের আগের প্রস্তুতি !

এই ছোট শহরে যদি এমন হয় , তাহলে রংপুরে কি হচ্ছে ! রাজধানী কোলকাতার অবস্থা কি ! সমস্ত বাংলা প্রদেশের প্রধান মন্ত্রী হোসেন সুরাবর্দী কি ব্যবস্থা নিচ্ছেন ? আবু হোসেনের ভাবনা জট পাকিয়ে যাচ্ছে ।

‘ মিঁঞা , একা একা ঘুরতেছেন ক্যান ? কি ভাবেন ? ‘ রাস্তার এক কোনে খোদা বক্স দাঁড়িয়ে আছে । মাথায় টুপি । চোখে সুর্মা । মুখে ধূর্ত হাসি ।

‘ হ , একাই ঘুরতেছি্ ‘ আবু হোসেন মুখ ঘোরান ।

‘ আমারে দ্যাখলেই আপনে চটেন ক্যান আবু মিঁঞা ? ধরম জ্খন একই !’ খোদা বক্স কাছে আসে ।

‘ কি কইতে চাও ?’ আবু ঘুরে মুখোমুখি দাঁড়ান ।

‘ আপনে পাকিস্তান চা্ন না ? ‘

‘ না ! আমি স্বাধীন ভারত চা্ই । হিন্দু মুসলমানের আলাদা কইরা রাষ্ট্রের দরকার নাই ! ‘

‘ অ , আপনে আবার কংগ্রেসের লোক ! কংগ্রেস তো হিন্দুদের দল , মানেন তো ?’

‘ না মানি না । ফজলুল হক , জিন্না এই সব ছড়াইতেছে্ । এতে দেশের ভাল হইব না ‘ আবু হোসেনের ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে । ওনার আর খোদা বক্সের সঙ্গে কথা বলার রুচি নেই । উনি হাঁটতে থাকেন ।

‘ ক্যান মুসলমানদের হেঁদুরা ঘিন্না করে , ক্যান মুসলমানদের ঘরে বসতে কয় না , মুসলমানদের ছোঁয়া কিছু খায় না , ক্যান হেঁদুরা সমাজে্ সব বড় জা্য়গায় , ক্যান হেঁদুরা বড়লোক এই সব ভাবেন না মিঁঞা ?’ আবু হোসেনের পিছন পিছন হাঁটতে থাকে খোদা বক্স ।

‘ এগুলান বোঝা্র বিদ্যা তোমার প্যাটে নাই , খোদাবক্স ! তোমার চ্খে ঘৃণা । তোমার চ্খে লোভ ! হিন্দুদের নিজেদের মধ্যে জাতপাত ,ছোয়াছুয়ি দেখ নাই ? এই সীতারহাটে কয় ঘর হিন্দু বড়লোক ? হিন্দু মুসলমান সবাই গরীব ! আমি তোমার সাথে আর কথা কইতে চাই না ‘ আবু হোসেন উত্তেজনায় কাঁপতে থাকেন ।

‘ আবু মিঁঞা ! কাফেরদের সঙ্গে থাইকা আপনেও কাফের হইতেছেন ! ছা্ড়েন , আপনের বন্ধু নিশি ডাক্তাররে কন ,এখনও সময় আছে্ । বাড়ি জমি বেইচা দিক । আমি আগে পাঁচ হাজার দাম দিছিলাম । এখন আড়াই হাজারের বেশি দিব না । পড়ে একশ টাহা দামও পাইবে না ! নিশি ডাক্তারের দুখান মাইয়া আছে , এইডাও মনে রাইখতে হবে ’

আবু হোসেন ঘুরে দাঁড়িয়েই খোদা বক্সের গালে তাঁর দূর্বল ডান হাত দিয়ে শরীরের সকল শক্তি দিয়ে চড় বসালেন । চড়টা জোরেই পড়েছে । খোদা বক্স রাস্তায় পড়ে যায় ।

‘ শূয়ার ! এই নিশি ডাক্তারের ওষুধ খাইয়া বড় হইছি্স্ । নিশি ডাক্তার সীতারহাট ছাইড়া যা্বে ক্যান ? তর মত জানোয়ার গুলান যা্বে । তুই ইসলামের কলঙ্ক !’ আবু হোসেন হাঁপাতে থাকেন ।

বাজারের মধ্যে এই ঘটনাটা ঘটে । আশে পাশে কিছু লোক দাঁড়িয়ে গেছে । সবাই দেখছে , শুনছে কিন্তু কেমন যেন আতঙ্কে সিঁটিয়ে আছে ।

খোদাবক্স গালে হাত বোলাতে বোলাতে উঠে দাঁড়ায় । চোখ দুটো জ্বলছে !

‘ আবু হোসেন ! মনে রাখিস্ ! ঐ নিশি ডাক্তারের বাড়ির আগুনে তরে ফেলব !’

ভোর হতেই হাসান বললেন ,

‘ আমি সামনে ঘোড়ায় যাইতেছি্ । আপনেরা আমার পিছ্নে আসেন । সামনে আর পিছ্নে ছেলেরা থাকেন । মাঝে্ মায়েরা । হাতিবান্ধা পার হইয়া আর তিন মাইল গেলেই ডানদিকের রাস্তা দিয়া সোজা শীতলকুচি । ঐ দিকে ঝামেলা নাই । কেউ কাঁইদো না । মনে জোর রাখ । উপরে ঈশ্বর আছেন । সঙ্গে আমি । এই ছয় মাইল কষ্ট কইরা আসো আমার সঙ্গে ‘

একটি ছোট মিছিল যাচ্ছে বাঁচার জন্য , সামনে ঘোড়ায় চেপে বন্দুক হাতে হাসান পুলিশ । একটি মিছিল যাচ্ছে কাঁপতে কাঁপতে , অজানা ভবিষ্যতে । একটি অর্ধভূক্ত মানব মিছিল যাচ্ছে , মাঝে এক ক্লান্ত শিশু , বৃদ্ধ বৃদ্ধা ও নারী ।

মিছিল নিঃশব্দে এগোচ্ছে । নিঃশব্দে ? দুলি কাঁদে ,

‘ মা ,জল খাব । পায়ে লাগে,হাঁটতে পারি না । কোলে নাও ‘

‘ ও শম্ভু , তর বাপ আর হাঁটতে পারে না , হাঁপায় ‘ শম্ভুর মা বলেন ।

‘ চু্প চু্প, কথা কইও না । আর এট্টু চ্লো । এই তো সামনে ‘

‘ জল ফুরায় আইল যে্ !’

রোদ চড়া হচ্ছে । হাতিবাঁন্ধা গ্রামের মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছে মিছিল । চারদিকে পোড়া বাড়ী । মানুষের চিহ্ন নেই । উল্টানো হাঁড়ি , আধপোড়া বিছানা , পোড়া গরুর গন্ধ , পুড়ে ছাই হওয়া খড় এই সবের মধ্যে দিয়ে আতঙ্কে হাঁটতে থাকে মানুষ ।

সবার জলতেষ্টা পাচ্ছে । শম্ভু জলের খোঁজে ভস্মিভূত গ্রামে কুয়ো খুঁজতে চায় । হাসান ইসারায় না করেন । পেছনে আসতে ইঙ্গিত করেন ।

বাঁদিকের পোড়া বাড়ির মধ্যে খসখস আওয়াজ । কিছু টানাটানি হচ্ছে । হাসান বন্দুক তাক করেন । মিছিল থমকে গেছে । তারপরেই পোড়া খড়ের মধ্য থেকে একটি কুকুর একটি আট দশ বছরের শিশুর পোড়া দেহ টেনে আনে । শিশুটির হাতে কিছু চেপে ধরা আছে । একটি আধপোড়া কাঠের পুতুল ।

দুলির মা এবং অনেকেরই বমি উঠে আসে । আতঙ্কে সবার চোখ বড় হয়ে গেছে । হাসান সবাইকে পেছনে তাড়াতাড়ি আসতে বলেন ।

একটি কাঁঠাল গাছের নিচে সবাই দাড়িয়ে আছেন । হাতিবাঁন্ধা গ্রাম পেরিয়ে এসেছেন । আর চলার শক্তি নেই । তীব্র জল পিপাসা । হাসান বাঁদিকে একটু দূরে কুয়ো দেখেন । বলেন ,

‘ ঐ খানে কুয়া আছে্ । কয়েকটা লোক মালপত্র নিয়া বইসা আছে্ । ওরা জল খাইতেছে্ । ছেলেদের একজন যান । জলের পাত্র কিছু নিয়েন । ঐ মাটির ঢিপির পাশে কুয়া । আগে একজন যা্ন, সব দেইখে আসেন । আমি এই খানে পাহারা দেই । তারপর সবাই যা্ন !’

শম্ভু গেল । একটা অ্যালুমিনিয়ামের ক্যান নিয়ে । পাঁচ মিনিট , দশ মিনিট , পনের মিনিট হয়ে গেল , শম্ভু ফিরছে না । হাসান দূর থেকে দেখতে পান কুয়োর পাশে কিছু লোক বসে আছে । কথা বলছে , জল খাচ্ছে । হাসান উদ্বিগ্ন হন ।

‘ কি হইল , আসে না ক্যান ? এই আপনারা দুজনে যান তো ‘

মাধব ও তার ছেলে গেল ।

‘ বাপ , তাড়াতাড়ি চলো , খুব তেষ্টা পাইছে্ ‘

‘ চল বাপ ‘

মাধবরা কুয়োর কাছে পৌঁছায় । কয়েকটা লোক আশেপাশে বসে আছে ।

‘ জল নিবেন ? ন্যান । আমরাও আপনাগো মত ভাগতেছি্ । এইখানে খাওয়ার জল পাইছি্ ‘

মাধব লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে হেসে কথা বলছে আর কুয়োর দড়ি বাঁধা বালতি ছেড়ে তাড়াতাড়ি জল তুলছে । মাধবের ছেলে একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে । শম্ভু কাকা কই ?

মাধব মাথা ঘুরিয়ে উঠে আসা জলের বালতির দিকে তাকায় । আতঙ্কে দিশেহারা হয় । পুরো লাল জল ।

‘ একি !’ বলতে বলতে মাধব কুয়োয় উঁকি মারে । শম্ভূর গলাকাটা দেহ ভাসছে । মাধব ‘ ভাগ বাপ ‘ বলতে বলতেই কেউ একজন পিছন থেকে মাধবের গলায় ছুড়ির টান দিয়েই ধাক্কা দিয়ে কুয়োয় ফেলে দিল ।

‘ বাপ গো ‘ বলে চিৎকার করে মাধবের কিশোর ছেলে পেছন দিকে দৌড় লাগায় । পেছনে কিছু লোক দা কুড়াল নিয়ে তাড়া করেছে । মুখে বলছে ,

‘ নারায়ে তাকবির , আল্লাহু আকবর ‘

কাঁঠাল গাছের নিচে অপেক্ষারত মানুষেরা হতচকিত হয়ে দেখে , মাধবের ছেলে দৌড়ে আসছে । পিছনে কিছু হিংস্র মানুষ তাড়া করেছে ।

এক মুহূর্তে হাসান বন্দুক তাক করে গুলি ছুঁড়লেন ।

তার আগেই একটি উড়ন্ত কুড়াল এসে মাধবের কিশোর ছেলের পিঠে ঢুকে গেল ।

ছেলে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ল ।

( ১৬ )
.

আমাদের পূর্বপুরুষ মৃত মানুষের হাতের রেখা দেখে ভেবেছিলেন , একটি মানচিত্র দরকার । সেই থেকে আমাদের চলার পথ হাতের রেখার মতো । তোমার আমার রক্তের মধ্যে এইসব ইতিহাস লেখা আছে ।

মাধবের বৌ কাঁদতে কাঁদতে উর্ধশ্বাসে ছেলের মৃত শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়ে । সঙ্গীরা কেউ আটকাতে পারলো না । হাসানের গুলিতে একজন মাটিতে পড়ে যেতেই বাকি উন্মত্ত হিংস্র লোকেরা থমকে যায় । অনেকেই পেছনে দৌড় লাগায় ।

‘ আপনেরা শিগগিরই এইখান হইতে চইলে যান । আর এক মাইল গেলেই ডাইনে আমবাগানের মধ্যে দিয়া মাইল দুয়েক গেলেই কুচ্বিহার । আমি খাড়ায় আছি । কাঁইদেন না মা ! আল্লা এই পাপের বিচার করবে !’ হাসান বললেন ।

বিহ্বল মাধবের বৌ কুড়ালবিদ্ধ ছেলের মাথায় হাত বুলায় । টানাটানি করে কুড়াল বের করতে চায় ।

‘ বাপ আমার ! কথা ক ! তর বাপের কি হইল ! হায় ভগবান !’

‘ শম্ভু কই গেলি বাপ ? অর কি হইল গো ‘ শম্ভুর বৃদ্ধ বাবা মায়ের আর্তনাদ শোনা যায় ।

হাসান একলাফে ঘোড়া থেকে নেমে মাধবের বৌকে জোর করে টেনে তুলে কাঁঠাল গাছের তলায় নিয়ে আসেন ।

‘ আর ভাবনের সময় নাই । আপনেরা শিগগিরই যা্ন । আমি পাহারা দিতেছি্ ‘ হাসান বলে ।

বিহ্বল হতচকিত মৃতপ্রায় দুলির মা , বাবা , দুলি ,শম্ভুর মা বাবা ,মাধবের বৌ, তিন গাড়োয়ান ছুটতে থাকে ।

ক্ষুধা তৃষ্ণা আতঙ্কের গ্রাসে মানুষ গুলো ছুটতে পারে না । হাঁপায় ।

‘ আমার ছেলে শম্ভু কই ? অর কি হইছে ?’ শম্ভুর মা কাঁদে ।

‘ চুপ করো, ও আসবে ক্ষন ! চল চল ‘ দুলির বাবা বলেন । ছুটছে কিছু মানুষ প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে । কাঁদছে কিছু মানুষ ঈশ্বরের খোঁজে ।

পিছনে গুলির আওয়াজ । এখান থেকে দেখা যাচ্ছে , শোনাও যাচ্ছে, হাসানের গলা,

‘ আয় হারামের বাচ্চারা ! তোদের দোজখে পাঠাই ‘ হাসান বন্দুকে কার্তুজ ভরছেন । ঐ দেখা যাচ্ছে দুইজন হাসানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল । বন্দুক নিয়ে টানাটানি হচ্ছে ।

‘ শূয়ারের বাচ্চা , আল্লার নামে মানুষ মারিস , তদের ..’ হাসান কথা শেষ করতে পারেন না । ঐ দেখা গেল হাঁসুয়ার কোপ হাসানের গলায় পড়ল । ফিনকি দিয়ে রক্ত আকাশে ছিটকালো ।

প্রাণের ভয়ে মানুষগুলো ছুটছে । আর পেছনে তাকানোর ক্ষমতা নেই । পিছনে কোন আওয়াজ নেই । ঐ তো ডান দিকে আমের বাগান । মানুষ গুলো ঢুকে পড়ে । আসেপাশে কিছু সংসারের গৃহস্থলীর জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে । কেউ এখান দিয়ে পালিয়েছে হয়ত । ধপ করে মাধবের বৌ মাটিতে পড়ে গেল ।

‘ ওঠো গো ! আর অ্যাকটু ! শিগগিরই চল ! পিছ্নে মুসলমানেরা আসতেছে্’ দুলির মা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন । একটুও খাওয়ার জল নেই যে মাধবের বৌএর মুখে দেবেন ! দুলির বাবা ও একজন গাড়োয়ান কোথাথেকে এক চাকাওয়ালা ঠেলা গাড়ি নিয়ে এল ।

ঠেলা গাড়ির ওপর কিছু ভাঙা চুড়ি , শাখা । রক্তও লেগে আছে ।

‘ অ মাগো !’ দুলির মা দেখেই চোখ বোঁজেন ।

‘ তাড়াতাড়ি কর ! মাধবের বৌরে তোল ‘

মাধবের বৌ কে তোলা হল , পাশে দুলিকে বসিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে কিছু মানুষ ঠেলা গাড়ি নিয়ে ছুটতে থাকেন।

আর পারা যাচ্ছে না । সবাই চোখে অন্ধকার দেখছেন । ঐ টা কি ? একটা বাড়ি না ?

দুলির বাবা ঐ দিকে ছুটলেন । পিছনে সবাই হাঁপাতে হাঁপাতে আসছেন । একজন গাড়োয়ান আটকালো ।

‘ ঠায়রান কর্তা ! ঐটা মনে হয় মুসলমানের বাড়ি ‘ গাড়োয়ান জিভ বের করে হাপাচ্ছে ।

মনে হয় রাস্তা ভুল হয়েছে । দুলির বাবা চারিদিক তাকিয়ে ভাবেন ।

দড়াম করে বাড়ির দরজা খুলে গেল । একজন মাঝবয়সী মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন । উনি দরজা খুলেই সামনে এতগুলো মানুষ দেখে দরজা বন্ধ করে দিলেন ।

‘ কে আপনেরা ? কোথা থিকা আইতেছে্ন ? কোথায় যাইবেন ?’ ভিতর থেকে মহিলার গলা শোনা গেল ।

‘ আমরা .. মা … মা .. আমরা সীতারহাট থিকা আইছি । কুচবিহার যা্মু । পিছ্নে মুসলমানেরা তাড়া করছে । তিনজনরে মাইরা দিছে । একটু জল দিবেন ,মা জননী ?’ কোন রকমে দুলির বাবা বললেন ।

কিছুক্ষন চুপ । তারপর ,

‘ এইডাও মুসলমানের বাড়ি ! আপনেরা চইলা যা্ন ‘

মানুষ গুলো দাড়িয়ে আছেন । বোধ শক্তি নেই । শরীর কাঁপছে । আত্মা কাঁপছে ।

আর চলবার শক্তি নেই । মানুষগুলো অবসন্ন শরীর ঘুরিয়ে হাঁটতে থাকেন । ঠেলা গাড়িটার চাকা থেকে ক্যাঁচ কাঁচ আওয়াজ হয় ।

‘ একটু ঠায়রান !’ পেছনের বাড়ির দরজা খুলে মহিলা এগিয়ে আসেন । সবাইকে দেখেন । তারপর দুলিকে কোলে নিয়ে বলেন ,

‘ আপনেরা ভিতরে আসেন ‘

আধঘন্টা হয়ে গেছে । বাড়ির ভিতরে ধানের মড়াইয়ের পাশে সবাই বসে আছেন, কাঁপছেন । জল , কিছু খাবার সবাইকে দেওয়া হয়েছে । মঝবয়সী মহিলা ও তার সঙ্গে একটি অল্প বয়সী বৌ খাবার , জল দিলেন ।

‘ ন্যান , এই সামান্য কিছু্ খান ‘

ফ্যালফ্যাল করে মানুষ গুলো আশ্রয়দাত্রীদের দেখেন , আর জল , খাবার দেখেন ।

‘ কি হইল খান ? মুসলমানের ছোঁয়া বইলা খাবেন না ?’

কেউ আর কোন কথা না বলে খেতে লাগলেন । মাঝবয়সী মহিলা মাধবের বৌকে ধরে বসিয়ে চোখে মুখে জল দিলেন । আস্তে আস্তে জল খাওয়ালেন । বললেন ,

‘ আমার নাম মরিয়ম । ঐটা আমার ছে্লের বৌ , সায়রা । এই খানে সবই মুসলমানের বাড়ি । আপনেরা হিন্দু হওনে , আপনাদের জায়গা দেওয়ায় আমরা বিপদে পড়তে পারি । আবার আপনারা এখন বাইরে গেলেও বিপদ । আমার ছে্লে বাহার বাইরে দাঙ্গার দলে মিশা দাঙ্গা করতে গেছে্ । অর বাপ অসুস্থ ,বিছানা থিকা উঠতে পারে না । ভিতরের ঘরে শুইয়া আছে্ । আমি ,অর বাপ কত মানা করছি্ , এই পাপ কাজে যা্ইও না । অ শোনে নাই । অ ফিরলে কি বলমু ভাবতেছি্ ‘

আশ্রিত মানুষ গুলো হাঁ করে শোনে , কোন অনুভূতি নেই ।

‘ আপনেরা এই খানে একটু বসেন । দেহি ‘

বলতে বলতেই বাইরে অনেক মানুষের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল । একটু পড়েই দরজায় ধাক্কা ,

‘ দরজা খোল আম্মু ‘

আশ্রিতরা আতঙ্কে কাঁপতে থাকে ।

মরিয়ম ঠোঁটে আঙুল রেখে দুলির বাবাদের চুপ থাকতে বলে দুলিকে কোলে নিয়ে আস্তে আস্তে উঠলেন ।

চলবে