বাঙালীর খণ্ডিত জাতীয়তা: দেশভাগ ও প্রাদেশিক পেক্ষাপট

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

পঞ্চম সত্যাগ্রহ: বঙ্গ সত্যাগ্রহ
বাংলা-বিহার সংযুক্তি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ১৬ই মার্চ হরতাল পালিত হয়। মানভূমে রাসমেলায় অতুলচন্দ্র ঘোষের সভাপতিত্বে জনসভা বসে। এর মধ্যে লোকসভায় রাজ্যগুলির সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত বিল এলে দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের সীমানা নির্ধারক কোনও বিল আসেনি। পুরুলিয়ার বঙ্গভুক্তি ও বাংলা-বিহার সংযুক্তি দুটো বিষয়ই অমীমাংসিত।

২৪-২৫ মার্চ অনুষ্ঠিত লোকসেবক সঙ্ঘের সম্মেলনে দশ সহস্র মানুষের সামনে গৃহীত হয় ‘বঙ্গ সত্যাগ্রহ অভিযান’-এর সিদ্ধান্ত। এরও সভাপতি ছিলেন অতুলচন্দ্র ঘোষ। স্থির হয় ২০ এপ্রিল ১৯৫৬ মানভূমের পুঞ্চা থানার পাকবিড়া গ্রাম থেকে ভোরবেলা ১০ জন মহিলা সমেত ১০০৫ জন সত্যাগ্রহী কলকাতার মুখে পদযাত্রা করবে। নেতৃত্বের দায়িত্বে থাকা বৃদ্ধ অতুলচন্দ্র ঘোষ যাবেন গো-শকটে। বাঘমুণ্ডি ও হুড়া থানা এলাকায় কর্মীশিবিরও আয়োজিত হয় অংশগ্রহণকারীদের নাম নথিভুক্তির জন্য। পথে বিশ্রামেরস্থল স্থির করার জন্য ৪ঠা এপ্রিলই একটি দল সাইকেলে করে কলকাতা রওনা দেবে। ধামসা, মাদল, খোল, মৃদঙ্গ, কণ্ঠসঙ্গীত – সবকিছু নিয়ে রীতিমতো মহড়া চলল।

এই খবরে সারা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ উৎসাহে মেতে ওঠে। সত্যাগ্রহীদের থাকা খাওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় বাঁকুড়া, বর্ধমান, হুগলি ও কলকাতার নানা জায়গায়। কলকাতা পৌঁছে ৬ই মে জনসভা ও ৭ই মে সত্যাগ্রহ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। ২০শে এপ্রিল ৬.৩০-এ পতাকা উত্তোলনের সকাল ৭টায় পদযাত্রা শুরু করল ১০০০ সত্যাগ্রহীর ১০টি বাহিনী। বৈশাখের প্রখর রোদে ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ ও ‘বাংলা ভাষা রে’ গাইতে গাইতে অক্লান্ত হেঁটে ২১শে এপ্রিল শনিবার পৌঁছে গেল বাংলার সীমান্তে। সেখানে তাদের জন্য ছিল চন্দনের ফোঁটা, খৈ, উলুধ্বণি, শঙ্খধ্বণি সহ বিপুল অভ্যর্থনা। এরপর পদযাত্রীর দল বাঁকুড়া, বর্ধমান, হুগলি, কলকাতা – পশ্চিমবঙ্গের যেখানেই গেছে পেয়েছে বিপুল গণসম্বর্ধনা। চুঁচুড়ায় বিধায়ক হেমন্ত কুমার বসু বলেন এই সংগ্রাম শুধু মানভূমের নয়, সারা পশ্চিমবাংলার এবং সমস্ত বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল একত্রিত না হওয়া অব্দি সংগ্রাম চলবে। অতুলবাবু অভিভূত হয়ে যান পশ্চিমবঙ্গবাসীর অভ্যর্থনায়। প্রায় ২০০ মাইল পদযাত্রা শেষ করে ৬ই মে দলটি হাওড়া ব্রীজ পেরিয়ে মহানগরীতে প্রবেশ করে ।

ভাষা ভিত্তিক রাজ্য গঠনের ও ভারতের সমস্ত বাংলাভাষী বিচ্ছিন্ন অঞ্চলকে বাংলার অন্তর্ভুক্তিকরণের দাবিতে এক ঐতিহাসিক পদযাত্রার স্মৃতি কী করে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেল সেটাই বিস্ময়ের। ইতিপূর্বে দুই সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রশ্চেভ ও বুলগানিনের ভারত ভ্রমণ ছাড়া কলকাতা অনুরূপ উন্মাদনা দেখায়নি। সেদিন সত্যাগ্রহীদের ওপর সাধারণ মানুষ যেমন খই ছিটিয়ে উলুধ্বণি দিয়ে পুষ্পবৃষ্টি করেছিল, তেমনি মালা দিয়ে তাদের সম্বর্ধিত করেছিলেন প্রজা সোশালিস্ট পার্টির সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্যোতি বসু প্রমুখ নেতৃবৃন্দও। বিকেলে হল ময়দানে সমাবেশ।

পরের দিন ৭ই মে অতুল্য ঘোষের নেতৃত্বে ডালহৌসি চত্বরে ৯৬৫ জন সত্যাগ্রহী ১৪৪ ধারা অমান্য করে কারাবরণ করেন। অসুস্থতার জন্য যারা সেদিন অনুপস্থিত ছিল, সেই বাকি ৩৪ জনও পরে ৯ই মে কারাবরণ করে। ১৯শে মে তাদের মুক্তি দেওয়া হলে জেল ফটকে ফের সম্বর্ধনা। তারপর আবার ৯ মাইল পদযাত্রা করে হাওড়া স্টেশন। একটি বিশেষ ট্রেনে ভোর ৪টেয় রওনা হয়ে বঙ্গ-সত্যাগ্রহীরা ৩.১৫ নাগাদ পুরুলিয়া ফিরে যায়। ওদিকে ধলভূম থেকেও ১৭৫ জনের একটি সত্যাগ্রহীর দল ধলভূম মুক্তি পরিষদের নেতৃত্বে পদব্রজে কলকাতা পৌঁছিয়ে হাজরা পার্কে সম্বর্ধিত হয়।

বঙ্গসত্যাগ্রহীদের ঘিরে পশ্চিমবঙ্গবাসীর এই তুমুল উন্মাদনা প্রমাণ করে মানভূমের নাড়ীর যোগ বাংলার সঙ্গেই। এটাও বোঝা যায়, সাম্প্রদায়িক ব্যাপারে মার খেয়েও হিন্দু বাঙালী সহনশীলতা দেখাতে পারে, কিন্তু ভাষার প্রশ্নে যথেষ্ট ঋজু। বাংলাভাষী অঞ্চলগুলো এক করার যে ঘোষণা, তার মধ্যেও অখণ্ড বাংলার স্বপ্ন প্রচ্ছন্ন ছিল; তবে অবশ্যই ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন ইসলামিক বাংলাদেশ নির্মাণের অভিলাষ ছিল না।

বাংলা-বিহার সংযুক্তিকরণ প্রস্তাব প্রত্যাহার

বঙ্গ সত্যাগ্রহ চলাকালীনই কলকাতার উত্তর-পশ্চিম লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফল ঘোষিত হয়। প্রত্যাশিতভাবে কংগ্রেস প্রার্থী অশোককুমার সেন বামপন্থী সমর্থিত প্রার্থী মোহিত মৈত্রের কাছে হেরে যান। প্রতিশ্রুতি মতো বিধানচন্দ্র ৩মে দিল্লী থেকে ফিরে সংযুক্তি প্রস্তাব প্রত্যাহার করেন।

এতে আবার বিহারে তুমুল ক্ষোভের সঞ্চার হয়। রাজস্বমন্ত্রী কৃষ্ণবল্লভ সহায় পরিস্কার জানিয়ে দেন বিহার ঐ রিপোর্ট মানে না এবং বাংলাকে কুশাগ্র পরিমাণ জমিও ছেড়ে দেবে। সুতরাং কেন্দ্র সরকার সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে গেলে কণামাত্র সহযোগিতা করবে না বিহার সরকার।

যাইহোক, সংযুক্তিকরণ প্রস্তাব প্রত্যাহিত হওয়ায় সীমা কমিশনের সুপারিশ লোকসভায় পেশ করে বিলটি আইনে পরিণত করার আশু প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল; কারণ ১৯৫৭-র ফেব্রয়ারিতে ভারতের দ্বিতীয় সধারণ নির্বাচন।
লোকসভায় পশ্চিমবঙ্গ-বিহার ভূমি হস্তান্তর আইন পাস
২৫শে জুলাই ১৯৫৬ সরাষ্ট্রমন্ত্রী বি.এন.দাতার ‘পশ্চিমবঙ্গ বিহার ভূমি হস্তান্তর’ বিলটি পেশ করেন। দাতার ব্যাখ্যা দেন, পশ্চিমবঙ্গ বিহারের কাছে দাবি করেছিল ১৩,০০ বর্গ মাইলের ভূমি যেখানে সীমা কমিশন সুপারিশ করেছে মাত্র ২৫০০ বর্গমাইল। এর জনসংখ্যা মাত্র ১৩ লক্ষ যারা ভাষা-সংস্কৃতি ইতিহাসে বাংলার সাথেই সম্পর্কিত।
বিহারের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও সীমা কমিশনের অন্যতম সদস্য পণ্ডিত হৃদয়নাথ কুঞ্জরু ও ডাঃ রামস্বামী পশ্চিমবঙ্গের দাবিকে জোরালো সমর্থন জানান। যেখানে চাষ থানা ছাড়া সমস্ত মানভূম সদরই বঙ্গভূক্ত হওয়া উচিত, সেখানে চাণ্ডিল, ইচাগড় ও পটমদা থানা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বিহারে থেকে যাওয়া নিয়ে পণ্ডিত কুঞ্জরু দুঃখ প্রকাশও করেন। কিসানগঞ্জকে বাংলায় রাখার যুক্তি উত্তরবঙ্গের সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের সংযোগ রক্ষা। বিহারের দেওয়া লোকগণনার হিসাব ও মানচিত্র যে বিভ্রান্তিকর যা পশ্চিমবঙ্গ প্রদত্ত মানচিত্রে দূর হয় তাও উল্লেখ করেন। রামস্বামী মুদালিয়ার বাংলাভাষীদের স্বভাষীদের সঙ্ঘবদ্ধ করতে ৪০ বছর ব্যাপি সংগ্রামের কথা উল্লেখ করেন, স্মরণ করেন স্বাধীনতার জন্য তাদের যা মূল্য দিতে হয়েছে সে কথাও। দেশভাগের ফলে বিপর্যস্ত বাংলার ন্যায়সঙ্গত দাবির একটি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ দেওয়া নিয়ে এত অশান্তিকে দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করেন। উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের জন্যও বাংলাকে কিছু জমি দেওয়া দরকার।

ওদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গোবিন্দবল্লভ পন্থ বাংলা ও তার কমিউনিস্টদের তীব্র ভাষায় বিদ্রূপ ও আক্রমণ করে বলেন সীমা কমিশনের রিপোর্ট কাঁসাই নদীর ভৌগোলিক কারণে, ভাষার ভিত্তিতে আদৌ নয়। বলা বাহুল্য এতে বাদানুবাদ তুঙ্গে ওঠে।
বিলটি এরপর যুক্ত সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো হয় যার রিপোর্ট পেশের সময়সীমা ৭ই আগস্ট। কমিটির সদস্যপদ নিয়েও বাদানুবাদ হয়। কমিটি ১১ই আগস্ট রিপোর্ট জমা দেয় যার ভিত্তিতে লোকসভায় আলোচনা শুরু হয় ১৬ই আগস্ট থেকে।

ইতিমধ্যে বিহারের সমর্থকরা দিল্লীতে ‘ল্যাঙ্গোয়েজ হ্যান্ডবুক’ বিলি করে প্রমাণের চেষ্টা করে, ১৯৫১-র সেনসাসে নাকি প্রমাণিত হস্তান্তরিত হতে চলা বেশ কিছু অঞ্চল হিন্দিভাষী। তাই তাদের বিহারে রাখতে দরকারে ন্যাশনাল হাইওয়ে নির্মাণ করে বাংলা বিহারের সীমা নির্ধারণ করতে হবে। নাটক জমে ওঠে যখন ১৬ই আগস্ট পাঞ্জাবের ঠাকুরদাস ভার্গব নিরপেক্ষ হয়ে বাংলার দাবিকে সমর্থন জানানোর ভান করে বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে ভূয়ো তথ্য দ্বারা হস্তান্তরিত ভূমিকে হিন্দীভাষী প্রমাণের চেষ্টা করেন।

১৭ই আগস্ট হিন্দু মহাসভার সদস্য নির্মলকুমার চট্টোপাধ্যায়, কম্যুনিস্ট নেতা কমল কুমার বসু, তুষার চট্টোপাধ্যায়, লোকসেবক সঙ্ঘের চৈতন মাঝি এমনকি মহারষ্ট্রের গ্যাড়গিল – একে একে বাংলার পক্ষে হাল ধরেন। আজ তথাকথিত সেকুলার গোষ্ঠীর কাছে যেসব সংগঠন অস্পৃশ্য, রাজ্যের সামগ্রিক স্বার্থে সেই হিন্দু মহাসভার সদস্যকে পাশে নিতে সেদিন কমিউনিস্ট নেতৃত্বও দ্বিধা করেননি। নির্মলচন্দ্র চ্যাটার্জীই ‘ল্যাঙ্গোয়েজ হ্যান্ডবিল’টি যে ভুয়ো তা প্রমাণ করে বিহারের দাবিকে নস্যাৎ করে দেন। এইদিন দীর্ঘ বিতণ্ডার পর বাংলা বিহার সীমানা নির্ধারক বিলটি লোকসভায় পাস হয় যা কার্যকরী করার কথা ১লা নভেম্বর ১৯৫৬।

২৮শে আগস্ট বিলটি অপরিবর্তিতরূপে রাজ্যসভায় গেল। রাজ্যসভাতেও সেখানেও বিল নিয়ে উত্তপ্ত বাদানুবাদ। সাংসদ কে.পি. সিং-এর ভাষায় বাংলা-বিহারবাসীর নাকি আনুগত্য প্রথমত ভারতের প্রতি, দ্বিতীয়ত বিহারের প্রতি ও তার পরে বাংলার প্রতি। বাঙালীর তো সহিষ্ণু ও উদার বলে সুনাম আছে; অর্থাৎ আর একটু সহনশীলতা দেখিয়ে মানভূমের বাঙালীরা বাংলা ভুলে যান। যাইহোক, শেষ পর্যন্ত ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ রাষ্ট্রপতি ডাঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ ‘বাংলা বিহার ভূমি হস্তান্তর’ বিলে সাক্ষর করার পর সেটি আইন হিসেবে স্বীকৃত হয়।

সরকারি নথি পাচার:
১৭ই আগস্ট লোকসভায় বিল পাস হওয়ার পর আড়াই মাসের মধ্যে ১লা নভেম্বর তা কার্যকরী হবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর থেকেই বিহার সরকার পরুলিয়ার বিভিন্ন অফিস, জজকোর্ট থেকে ফাইলপত্র এমন কি আসবাবপত্র পর্যন্ত বিহারে পাচার শুরু করে দিল। যে ষোলটি থানা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা তাদের নথিও চলে গেল অন্যত্র। জজকোর্টের মূল্যবান গ্রন্থাগারের দুষ্প্রাপ্য বই, রেকর্ড রুমে সঞ্চিত গুরুত্বপূর্ণ ফৌজদারি ও শাসন সংক্রান্ত রেকর্ড, যার ঐতিহাসিক মূল্য অসীম সেগুলোও ট্রাক বোঝাই করে নির্বিচারে সব চালান হতে লাগল। সেইসব রেকর্ডে শুধু মানভূম নয়, বর্ধমান ও বাঁকুড়া জেলারও অনেক তথ্য নথিভুক্ত ছিল।

পুরুলিয়ার সরকারি কর্মচারীদের ৭ই অক্টোবরের মধ্যে কে কোন সরাকরের অধীনে বদলি চায় সেই ইচ্ছা বিহার সরকারকে জানাতে বলা হল। নতুবা ঐ সমস্ত কর্মচারীরা পশ্চিমবঙ্গের অধীনে কাজ করবেন ধরে নেওয়া হবে।

পুরুলিয়ার বঙ্গভুক্তি:
১৯৫৬-র ১লা নভেম্বর সকাল, পুরুলিয়াবসীর কাছে মাহেন্দ্রক্ষণ। ৩১শে অক্টোবর রাত থেকেই ফাটতে লাগল বাজি, আলোকিত শহর। যদিও বিহারে থেকে যাওয়া সমগ্র ধলভূমের এবং মানভূমের বহু বাংলাভাষী মানুষ বিহারে থেকে যাওয়ায় হতাশ, তবু ৪৪ বছর লড়াই করার পর যে অংশটুকুর দাবি মিটল তার উম্নাদনা উৎসাহ যে তুঙ্গে থাকবে তা বলা বাহুল্য। ১লা নভেম্বর থেকে ১২ই নভেম্বর পর্যন্ত টানা তেরোদিন ধরে নানা আলোচনা, বক্তৃতা ও নতুন পরিচয়ে কর্মসূচীর পরিকল্পনার সঙ্গে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মাতোয়ারা হয়ে রইল গোটা পুরুলিয়া যা বিহারের আধীনে একটি মহকুমা থেকে পশ্চিমবঙ্গের অধীনে পূর্ণাঙ্গ জেলায় পরিণত হল। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকেও আমন্ত্রিত ছিলেন বিশিষ্টরা। ১-২ নভেম্বর নিবারণ পার্কে একটানা জ্বলেছিল ২৫০০ প্রদীপ। মানভূমের শিল্প সংস্কৃতির ওপর একটি প্রদর্শনীও আয়োজিত হয়েছিল। শুধু উৎসব আনন্দে মাতা নয়, গৃহীত হয় কৃষিজীবি শ্রমিকদেরকে সহযোগিতা করার ও বন্যার্তদের অর্থ সাহায্যের অঙ্গীকারও। লোকসেবক সঙ্ঘের ভূমিকা কিন্তু এখানেই থেমে থাকেনি। এর পরেও প্রায় দেড় দশক ধরে পুরুলিয়ায় কংগ্রেসী কুশাসন বিরোধী প্রধান রাজনৈতিক দল এবং গ্রামভিত্তিক কৃষিউন্নয়নের রূপকার হিসেবে সক্রিয় ছিল।
এখন বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে যে পুরুলিয়া মহকুমার জেলায় উন্নিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভুক্তি ঘটল, বর্তমানে চূড়ান্ত অনটন ও অন্যান্য ফাঁকফোকর মারফৎ কী ভাবে ও কেন মাওবাদী জঙ্গিদের আস্তানা হয়ে উঠল, তার ইতিহাসটাও খতিয়ে দেখা দরকার। আজ যেসব আদিবাসী ও অন্তজরা সমাজের মূল স্রোত থেকে তিতিবিরক্ত হয়ে নিজেদের স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে, চার দশক ধরে চলা ভাষা আন্দোলনের সময় তাদের সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া কিন্তু পুরুলিয়ার বঙ্গভুক্তি সম্ভব হোত না। সেদিনের সত্যাগ্রহীরা কোন অভিমানে বা কীসের ইন্ধনে আজ সন্ত্রাসবাদী না জেনে সমাধানের চেষ্টা করলে বিদ্বেষের বীজ সুপ্ত থেকে যাবে, নির্মূল হবে না। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বাঙালীয়ানার সমণ্বয়সাধন তো হবেই না।

তবে এখানে যেটা বলার – এই রক্তক্ষয়ী দীর্ঘ সংগ্রামের পরেও কিন্তু বাঙালীদের বিহারী, হিন্দীভাষী বা হিন্দীভাষার প্রতি তেমন কোনও জাতক্রোধ অবশিষ্ট নেই, যে আক্রোশটা বাঙালীদের প্রতি অন্যান্য ভারতীয় অঙ্গরাজ্য বিনা প্ররোচনায় লালন করে। বাংলা সাহিত্যচর্চাকারীরা জাতীয় স্তরে বৈষম্য ও হিন্দীর আধিপত্য নিয়ে ক্ষুন্ন হলেও, দেশের ঐক্যের খাতিরেই হোক বা সর্বভারতীয় সংযোগরক্ষার স্বার্থেই হোক বা বিনোদনের তাগিদে, হিন্দী আপামর বাঙালীর জীবনে অঙ্গীভূত হয়ে গেছে। বল প্রয়োগে অবদমনের চেয়ে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ যে অনেক কার্যকরী, তা প্রমাণিত।
আসলে জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ভাষাগত প্রাদেশিক পরিচয়ের সংঘাতে বাঙালী বড় দিশাহীন ও অসহায়। আসাম থেকে সারা ভারতবর্ষ, এমন কি পশ্চিমবঙ্গেও – বাঙালী কিন্তু খুব সহজে পর-সংস্কৃতি সহিষ্ণুতা দেখাতে গিয়ে প্রায়ই নিজে ভাষা-সংস্কৃতিগতভাবে নতজানু হয়। তমসার মধ্যে আলোকরেখা একটাই সেদিন দলমত নির্বিশেষে পশ্চিমবাংলা ও মানভূমের প্রতিটি রাজনৈতিক দল কাদা ছোঁড়াছুড়ি সরিয়ে রেখে স্বাজাতির স্বার্থে বিরল একতার পরিচয় দিয়েছিল। সেই ইতিহাস আবার পুনরাবৃত্ত হবে কিনা তা সময়ই বলবে। আপাতত ভূমিকম্পপ্রবণ পাহাড় ও কোচবিহারের ভাঙন রুখতে পারলে হয়। প্রসঙ্গত দার্জিলিং-এর গোর্খারা যদি দাবি করে তারা বাঙালী নয় ও বাংলার সঙ্গে না থেকে পৃথক ভারতীয় অঙ্গরাজ্য হিসাবে থাকতে চায়, তাহলে ভুল কোথায় বুঝি না। বরং ভুলের মাসুল দিতে হবে যদি গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনেও পাকাপকি হিংসার অনুপ্রবেশ ঘটে।
এখানে অকপটে স্বীকার করি মুলত দিলীপ গোস্বামীর ‘মানভূমের ভাষা আন্দোলন ও পুরুলিয়ার বঙ্গভুক্তি’ বইটিকে মূলধন করেছি। বইটি বলতে গেলে মানভূমের প্রাচীন ইতিহাস থেকে দিনানুক্রমিক ইতিবৃত্ত। আমি ঘটনাগুলোর অনুপুঙ্খ দেওয়ার বদলে সুবিন্যস্ত করার চেষ্টা করেছি যাতে পুনরাবৃত্তি ছাড়া ঘটনা ও পরিস্থিতি পরম্পরা বজায় রেখে সংক্ষেপে ধলভূম মানভূমের বাংলা ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিক রূপটি তুলে ধরা যায়।

সপ্তম অধ্যায়
বাঙালীর রাজনৈতিক জাতীয়তা:
বাঙালী-চিনি ভাই ভাই

বাঙালীর দেশে প্রদেশিক শত্রু, নিজেদের মধ্যে জাতি ধর্মের রেশারেশি, ঘটি-বাটির ঠোকাঠুকি। তাহলে বিশ্ব-বন্ধুত্বের দিকে হাত বাড়ানো যাক। মার্কস্‌ ও এঞ্জেলের অর্থনীতি এবং দর্শন যে জারের অপশাসন ঘুচিয়ে আধুনিক রাশিয়ার বা ইউএসএসআর-এর রূপকার লেনিনের মার্গ-দর্শক সে বিষয়ে সন্দেহ নেই; লেনিন গ্রাদ সেন্ট পিটার্স বার্গে নামান্তরিত হওয়ার পরেও নয়। বার্লিনের দেওয়াল ভেঙে যাওয়ার দুই জার্মনির মিলনের উচ্ছ্বাস কিন্তু প্রমাণ করে, একটা রাজনৈতিক মতাদর্শের চেয়ে যে এক জাতি এক প্রাণের তাগিদ প্রবলতর। একটি অর্থনীতির বই একদল বুদ্ধিজীবীকে সমস্ত কিছু শ্রেণী চেতনার নীরিখে দেখতে, শোষনের বিরুদ্ধে লড়তে শিখিয়ে সত্যিই পৃথিবীর ইতিহাস বদলে দিয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কোথাও কমিনিউজ়ম বহু ভাষা-সংস্কৃতিকে একই রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে এনেছে, কোথাও একই জাতি ও ভাষাভাষীকে খণ্ডিত করেছে। যেমন প্রাক্তন ইউএসএসআর তৈরি হয়েছিল রাশিয়ার সঙ্গে কিছু ভিন্ন ভাষা সংস্কৃতির দেশকে জোর করে জুড়ে দিয়ে। অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির ডানা ছাঁটতে যে বার্লিন প্রাকার তোলা হয়েছিল তার পূর্ব দিকটা রাশিয়ার মতাদর্শী সাম্রাজ্যবাদে কমিউনিস্ট দেশ হয়ে যায়, ভিয়েতনাম দু-টুকরো হয় ভিয়েতনাম ও লাওস নামে; অখণ্ড কোরিয়া দক্ষিণপন্থী দক্ষিণ কোরিয়া আর কমিউনিস্ট উত্তর কোরিয়ায় দু-টুকরো হয়ে যায়। আর রুমানিয়া, চীন এবং কিউবা আদ্যন্ত কমিউনিস্ট দেশ হয়ে যায়।

সাম্যবাদ সকল রাজনৈতিক মতেরই আবশ্যিক ঘোষিত দাবি। কেউ সকলের একই রকম ব্যক্তি স্বাতন্ত্র, মত প্রকাশ, সুযোগ সুবিধা লাভের পক্ষে; আর এক দল কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ দ্বারা দেশের উৎপন্ন সম্পদ সবার মধ্যে সম বণ্টনের পক্ষে। বলা বাহুল্য কোনও পক্ষই প্রকৃত সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। আমরা রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ থেকে স্লাভ দেশগুলোর মুক্তির লড়াই দেখেছি, নিজের দেশে লেনিনের মরণোত্তর অপমানও দেখেছি, দেওয়াল ভেঙে জার্মানির জুড়ে যাওয়ার আনন্দ দেখেছি। তবু বিশ্বের কাছে, বিশেষত বাঙালীর কাছে কমিউনিস্ট দুনিয়ার দুই শক্ত দূর্গ ছিল জোড়-তাপ্পি দেওয়া রাশিয়া এবং চীন। প্রথমটি নিজের পূর্বতন অবস্থান থেকে ১৮০০ সরে এলেও বঙ্গবাসীর হৃদয়ে নস্টালজিয়া। দ্বিতীয়টি যথেচ্ছ নীতি বদল করেও সোস্যালিজমের তকমা সেঁটে আছে বলে বাঙালীর আরাধ্য। রাশিয়ার কম্যুনিস্টরা রাশিয়ান, চীনের কম্যুনিস্টরা চীনা, কোরিয়ার কম্যুনিস্টরা কোরিয়ান, কিউবাররা কিউবান, রুমানিয়াররা রুমানিয়ান, ভিয়েতনামেররা ভিয়েতনামি। কিন্তু ভারতীয় কম্যুনিস্টরা ভারতীয় নন, বিশ্ব নাগরিক। চেয়ারম্যানের চায়না বারবার ভারতের সীমা লঙ্ঘন করে যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করলেও ভারতীয় কমরেডদের চোখে বিদেশী হামলাকারীরা নয়, দোষী ভারত সরকার। তাই ১৯৬২ সালে চীনা আগ্রাসনের সময় যথার্থ কমিউনিস্টরা চীন-প্রীতি ও স্বদেশ-বিদ্বেষ দেখিয়ে ‘প্রতিক্রীয়াশীল’ ভারত সরকারের ষড়যন্ত্রে কারাবরণ করে। এমন দেশদ্রোহিতার শাস্তি মহাচীনেও সম্ভবত মৃত্যুদণ্ড, কিন্তু এদেশে কয়েক মাসের রাজকীয় মর্যাদায় কারাবাসের অতিরিক্ত কিছু না।
বস্তুত পাকিস্তান আমাদের চেনা শত্রু, গুপ্ত ঘাতক, কিন্তু পরিচয়টা গোপন নয়। বাংলাদেশও প্রায় জন্ম ইস্তক ভারত বিরোধীদের আশ্রয় ও মদত দিয়ে এসেছে। বর্তমান সরকার হয়তো সম্পর্কের উন্নতি চায় নিজেদের মঙ্গলামঙ্গল বুঝতে পেরে। তবে সেখানেও তা সম্ভব বাংলাদেশের অনুকূলে ‘তিস্তা চুক্তি’, ‘ছিট মহল বণ্টন’ সহ একাধিক রফাসূত্র মেনে নিয়েই। বর্ধমানের শিমুলিয়া খাগরাগড় বিস্ফোরণে বাংলাদেশী জঙ্গিগোষ্ঠীর পশ্চিমবাংলা বিহার ব্যাপি জাল আবিষ্কৃত হওয়ার পর বাংলাদেশ কোথায় কোণঠাসা হয়ে পড়বে, তার পরিবর্তে সন্ত্রাসবাদ দমনের প্রশ্নে আমাদের উল্টে চাপ দিয়েছে এবং ক্রমশ পরামর্শদাতা হয়ে উঠছে। অন্য দিকে তামিল বিদ্বেষের কারণে শ্রীলঙ্কাও আমাদের প্রতি তেমন বন্ধুভাবাপন্ন নয়। কিন্তু নাটের গুরু চীন বারবার আন্তর্জাতিক সীমা লঙ্ঘন করা ছাড়াও এই শত্রুভাবাপন্নদের কীভাবে উস্কানি, মদত ও সাহায্য দিয়ে যাচ্ছে তা সকলের জানা। আমাদের অঙ্গরাজ্য অরুণাচল প্রদেশ ও কাশ্মীরের লাদাখের প্রতি তো বটেই, এমনকি ভারতীয় সাহায্যে যে দেশটার অর্থনীতি ও সংযোগ ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে ও চলছে, সেই ভূটানের প্রতিও চিনের শ্যেনদৃষ্টি। চিনের ভয়েই বিপুল অর্থব্যয়ে ভূটান ও নেপালের বন্ধুত্ব কেনার চেষ্টা ভারত সরকারের বাধ্যবাধকতা দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ভারতীয়, বিশেষত বাঙালী কমিউনিস্টদের কাছে এইসব হাতেনাতে ধরা পড়া তথ্যপ্রমাণ নিতান্তই কেন্দ্রীয় সরকারের ও মিডিয়ার অপপ্রচার, Pan Nationalism। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তরাধিকার তাদের ভাষায় “ইয়ে আজ়াদী ঝুটা হেয়”। সমাজতন্ত্র যেখানে দেশের যাবতীয় সম্পদ, শিল্প, সংস্থা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়, পশ্চিম বাংলার সমাজতন্ত্রীরা সেখানে কেন্দ্র সরকারের হস্তক্ষেপের মধ্যে শুধুই “অগণতন্ত্র” দেখেছেন অথচ “কেন্দ্রীয় সাহায্য’ও চেয়েছেন। বর্তমান সরকারের কথা আর না তোলাই ভালো। কফিনের শেষ পেরেকটি পুঁতে দেওয়ার জন্য ঘাসফুল যে কাস্তে হাতুড়ির এত ভালো বিকল্প হতে পারে কে জানত? ক্ষমতায় টিঁকে থাকার জন্য মানুষ অনৈতিক কাজ করে, সে অনেক পুরোনো গল্প। কিন্তু নিজেদের পরিচয় পর্যন্ত জলাঙ্জলি দেয়, তাও দেখতে হল। অবশ্য ‘পুতুল’ শাসকের নজির ইতিহাসে বিস্তর এবং তারা বৈদেশিক বা বিশেষ গোষ্ঠীর হস্তক্ষেপে নিজের মানুষদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে ঘর গোছায় এর নিদর্শনও প্রচুর।

কিন্তু একটা ব্যাপার তারপরেও আশ্চর্য লাগে, ভারতীয় কমিউনিস্টরা স্বদেশের জাতীয়তাবোধে উগ্রতা বা ফ্যাসিজিম খুঁজে পান, কিন্তু ইসলামিক জাতীয়তাবোধে পান না। তাই জিন্নাহ সুরাবর্দি বা ভাসামির অখণ্ড বাংলার আবেগে এঁরা আজও আপ্লুত। চিন আজ আর যাই হোক সমাজতান্ত্রিক দেশ নয়, শুধু ব্যানারটা ধরে রেখেছে। সেইটুকু সম্বল করে সে পাকিস্তানকে সরাসরি ভারত বিরোধী নাশকতায় মদত দিয়ে যাচ্ছে। সেইজন্যই কি ভারতীয় কমরেডরা সন্ত্রাসবাদীদের স্বাধীনতাসংগ্রামী সাব্যস্ত করে এমনকি ভারত বিরোধী স্লোগান দিয়ে খোলাখুলি তালিবানদের সমর্থক হয়ে গেছে? আরও আশ্চর্য লাগে ভারতে নাশকতায় মদত দিলেও চিন কিন্তু নিজের দেশে ইসলামিক ধর্মান্ধতা বরদাস্ত করে না তার প্রমাণ উইগুর মুসলিম গোষ্ঠীকে কঠোরভাবে দমন দ্বারা বুঝিয়ে দিয়েছে। রাশিয়াও চেচেন জঙ্গী দমনে যে কঠোরতা দেখিয়েছে ও এখনও সন্ত্রাসবাদের প্রশ্নে যতটা কঠোর তাতে ইসলামি সন্ত্রাসবাদের অস্তিত্ব যে মোটেই অস্বীকার করে না তা স্পষ্ট। তাদেরই অনুসারী হয়ে ভারতীয় কমিউনিস্টদের তাহলে নিজেদের দেশে এই আত্মঘাতী অবস্থান কেন? বিষয়টা খতিয়ে দেখতে ঐতিহাসিক সমাজতাত্ত্বিক বা মনস্তাত্ত্বিক লাগবে নাকি গোয়েন্দা সেই বিতর্কে না যাওয়াই ভালো।

তলিয়ে দেখতে ‘মাকর্সবাদ’ ও ‘মৌলবাদ’এর মধ্যে বাস্তবে প্রায়োগিক দিকে থেকে দূরত্ব খুব কম। দুটোই অনমনীয়। Islamic Fraternity-র প্রশ্নে যেমন সারা বিশ্বের মুসলমানরা এক, তেমন মার্কসবাদের খাতিরেও বাঙালী কমিউনিস্টরা স্বদেশের চেয়ে বিদেশের প্রতি একাত্ম বোধ করেন। ইসলামিক মৌলবাদ যেমন সারা বিশ্বের মুসলমানদের এককাট্টা হয়ে ধর্মযুদ্ধে শামিল হওয়ার উস্কানি দেয়, কমিউনিস্ট মৌলবাদ তেমন কাল্পনিক বিপ্লবের জন্য ডাক দেয়। ধর্মের খাতিরে মৌলবাদী মুসলিমরা যেমন ক্ষেত্রবিশেষে দেশদ্রোহিতাকেও পরম ধর্ম মনে করে, ‘মার্কসীয় আদর্শ’এর খাতিরে তেমনি ভারতীয়, বিশেষ করে বাঙালী কমিউনিস্টারা ক্ষেত্রবিশেষে দেশ-বিরোধিতাকেই অবশ্য পালনীয় কর্তব্য মনে করে। ব্যক্তিহত্যা ও সন্ত্রাস ছাড়ানোর নীতিতেও যে আশ্চর্য মিল, তা নকশালরা প্রমাণ করে দিয়েছেন। কার্ল মার্কস বা অ্যাঞ্জেল বেঁচে থাকলেও নিজেদের তত্ত্বের এমন বিচিত্র সমর্থক দেখে উল্লসিত হতেন কিনা সন্দেহ; বরং তাঁদের মতবাদকে অনমনীয়, অপরিপবর্তনীয়, অযুগোপযোগী ঈশ্বর উবাচ ‘বাইবেল’ বা ‘কোরান’ বানানো হয়েছে দেখলে দুঃখই পেতেন। অনেককেই বলতে শুনি, “মার্কস্‌বাদ একটা বিজ্ঞান’। তাঁরা কি জানেন না, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও কোনও তত্ত্ব নতুন আবিষ্কারের নিরীখে খারিজ হয়ে যেতে পারে বা পুরোনো সূত্র সংশোধিত হতে পার? সমাজবাদ উন্নততর বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের একটা সামাজিক তত্ত্ব, কোনও স্বতোসিদ্ধ সূত্র বা নিয়ম (law) নয়। এর উদ্দেশ্য মহান, তবে তার প্রয়োগকে তো যুগোপযোগী হতেই হবে।

সিঙ্গাপুরের মতো গুটিকয়েকক গণতন্ত্রী এমনকি ধনতন্ত্রী দেশেও সমাজবাদের আদর্শ অনুচ্চারিত ভাবে রয়েছে, রয়েছে নাগরিকদের স্বার্থে রাষ্ট্রের দায়, দায়িত্ব ও নিয়ন্ত্রণ। তারা কমিউনিস্ট চিনের মতো শিশুকন্যা হত্যা, নারী নিগ্রহ কিংবা শিশু শ্রমিক শোষণের পরম্পরা জিইয়ে রাখেনি, বরং মেয়েদের ওপর নিগ্রহ কঠোরভাবে দমন করে রেখেছে। কিন্তু তারা ঘোষিতভাবে কমিউনিস্ট দেশ নয় বলে বাঙালী কমিউনিস্টরা তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা অনুভব করে না।

প্রসঙ্গত, অতীতে বেশ কয়েকবার কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টিকে হিন্দু মহাসভা বা পরবর্তীতে ভারতীয় জনসঙ্ঘের সঙ্গে এক সাথে আন্দোলন করতে দেখা গেছে। যেমন –
১. ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টির এক তাত্ত্বিক নেতা, পলিটব্যুরোর সদস্য তথা পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম-এর রাজ্য সম্পাদক কমরেড সরোজ মুখোপাধ্যায় তাঁর দুটি খণ্ডে লেখা “ভারতের কমউনিস্ট পার্টি ও আমরা” বইটির বেশ কিছু জায়গায় বিশেষত দ্বিয় খণ্ডে হিন্দুমহাসভা ও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কমিউনিস্টদের যৌথ আন্দোলন করার কথা উল্লেখ করেছেন। ১৯৪২ সালের ২৪শে জুন হাজার পার্কে যে ফ্যাসিজম বিরোধী সভা এবং তার সাথে চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন হয়, তার সভাপতিত্ব করেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, যিনি তখন বাংলার অর্থমন্ত্রী ও অখিল ভারতীয় হিন্দুমহাসভার নেতা। শ্যামাপ্রসাদ বলেন ফ্যাসিজমবিরোধী বন্দীদের মুক্তির জন্য তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করবেন। [২য় খণ্ড পৃ ১৯]
২. সরোজবাবুর বইতে উল্লেখ আছে ১৯৪২ সালের ২২শে ডিসেম্বর বাংলাতে কংগ্রেস, মুসলিমলীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, রেডিক্যাল পার্টি ও হিন্দুমহাসভা সমেত প্রায় সব দল ও সংগঠনের প্রতিনিধিরা এক বৈঠকে খাদ্য ও অন্যান্য দ্রব্যের অভাব ও আহাকার ও পরিস্থিতি নিয়ে এবং তার সমাধানের উপায় নিয়ে আলোচনা করেন ও একটি সর্বদলীয় একটি কমিটি গঠন করা হয়। [২য় খণ্ড পৃ ৬০]

৩. ১৯৪৩ সালে ২৭শে নভেম্বর মেদিনীপুরে সাইক্লোন রিলিফের দাবিতে ১৫ হাজার নরনারী এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ‘নিখিলবঙ্গ সাইক্লোন রিলিফ কমিটি’ গঠিত হয়। সেখানেও শ্যামাপ্রসাদের সভাপতিত্বে কমিউনিস্ট পার্টির অংশগ্রহণে যৌথভাবে বন্যাপীড়িতদের সাহায্যার্থে নয় দফা দাবির এক প্রস্তাব পাশ হয়। কোন বিশেষ রাজকর্মচারী পূর্বাহ্নে সংবাদ পাওয়া সত্ত্বেও কোন ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়নি বলে যে অভিযোগ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর করেছিলেন,
সরকারের কাছে তার জবাবদিহি চাওয়া হয়েছিল। এটাও উক্ত বইয়ে আছে। [২য় খণ্ড পৃ ২৯]
৪. ‘সোভিয়েত সুহৃদ’ আন্দোলনেও মকিউনিস্টদের বহু সভায় হিন্দুমহাসভার সভাপতি স্যামাপ্রসাদ মুখার্জী সভাপতিত্ব করেন। [২য় খণ্ড, পৃ ৬১]
৫. তাছাড়া নোয়াখালি হিন্দু মৃগয়ার বিভীষিকার সময়ও বাংলার কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি, হিন্দু মহাসভার নেতারা ও আরও কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীরা একত্রে ত্রাণ ও অপহৃত মেয়েদের উদ্ধারের কাজে নেমেছিল।
৬. মানভূমের ভাষা আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে পুরুলিয়ার বঙ্গভুক্তিতে কমরেড তুষার চ্যাটার্জি ও জনসঙ্ঘের শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে একযোগে সংসদে বাংলা ও বাঙালীর স্বার্থে সওয়াল করতে দেখা গিয়েছিল। তখন বিহার কংগ্রেসের বিরুদ্ধে একযোগে পশ্চিবঙ্গের প্রদেশ কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি, হিন্দু মহসভা, জনসঙ্ঘ – সবকটি প্রধান দল মানভূমের লোকসেবক সঙ্ঘের পাশে দাঁড়িয়েছিল।

অর্থাৎ তখনও পর্যন্ত বঙ্গীয় কমরেডদের কাছে শ্যামাপ্রসাদ বাবু সাম্প্রদায়িক বা ইংরেজদের দালাল ও ছিলেন না। কিন্তু স্বাধীন ভারতের ব্যালট গণতন্ত্রের আবেশে জাতীয়তাবোধ ও আন্তর্জাতিকতাবোধের ক্রমবিবর্তনে হিন্দুত্ব ও সাম্প্রদায়িকতা বামপন্থীদের কাছে সমার্থক হয়ে গেছে।

এই সমস্ত সর্বহারার প্রতিনিধিরা ঠাণ্ডা ঘরে বসে বোতলের পর বোতল বিলিতি ফাঁক করতে করতে বহুদিন পর্যন্ত অল্প শিক্ষিতদের মগজে শ্রেণী চেতনার বীজমন্ত্র ও অশিক্ষতদের মগজে জঙ্গীপনার উৎসাহ ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিল। শিল্পে অথর্নীতিতে পশ্চিমবঙ্গের পিছিয়ে পড়া ছাড়াও কয়েক প্রজন্মের ধরে শিক্ষাক্ষেত্রেও পাকাপাকিভাবে দলতন্ত্রের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিল। এবং বর্তমান শাসক দলও সাফল্যের সঙ্গে সেই উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে, ভবিষ্যতে যারা আসবে তারাও করবে। এই অপূরণীয় ক্ষতি কীভাবে ও কতদিনে পূরণ হবে তা বলা দুস্কর। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলার মানুষ দল বদলাচ্ছে, কিন্তু চরিত্র আরও নিম্নগামী। আমাদের জাতীয়তাবোধ কেন, কোনও মূল্যবোধই অবশিষ্ট নেই। না হলে চিন নিজের দেশে উইগুর মুসলিমদের কতটা প্রশ্রয় দিয়েছে কিংবা রাশিয়া চেচেন জঙ্গীদের কীভাবে দমন করেছে, সেখান থেকে কমিউনিস্ট বিশ্ব যে নিজেদের দেশে মৌলবাদকে এমনকি ধর্ম নিয়ে কোনও উদ্দীপনাকে কতটুকু আমল দেয়, সে বিষয়ে কিছুটা হলেও শিক্ষা নিতাম; স্বদেশ বিরোধিতার গায়ে ধর্মনিরপেক্ষতার তকমা চাপতাম না, আর চিন পাকিস্তানকে ভারত বিরোধী নাশকতায় মদত দিচ্ছে বলে সাম্যবাদের আবডালে সন্ত্রাসীদের পক্ষ নিয়ে খোলাখুলি তালিবানদের সমর্থক হয়ে যেতাম না। আর নিজেদের সর্বনেশে ভ্রান্তিকে প্রতিষ্ঠিত করতে ২০১৭-য় নির্বাচিত আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিরাপত্তার কারণে কয়েকটি মুসলিম দেশের নাগরিকদের ভিসা বাতিল নিয়ে আমরা এতটা শোরগোল করতাম না। ঐ দেশগুলি যে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, মেয়েদের যৌনদাসত্বে বাধ্য করা, নৃশংস নারী ও শিশু নিগ্রহের জন্য সারা বিশ্বের ত্রাস, সেটা আমাদের মাথাব্যথা নয়, ওরা যে ধর্মের নাম করে এসব করছে সেই ধর্মাবলম্বীরা আমাদের দেশে তথাকথিত সংখ্যালঘু বা আদতে দ্বিতীয় সংখ্যাগুরু যাদের ধর্মীয় গোঁড়ামি, মৌলবাদ বা লিঙ্গবৈষম্যে মদত দেওয়াকেই আমরা ধর্মনিরপেক্ষতার মডেল সাব্যস্ত করে রেখেছি। মার্কসবাদ ও মৌলবাদের মতো এই মডেলও অপরিবর্তনীয়।

অষ্টম অধ্যায়
ভারতীয় বাঙালীর সাংস্কৃতিক জাতীয়তা

বাঙালীর তথা সমগ্র ভারতবাসীর সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ধিক্কার তথা জাতীয়তাবাদ ধ্বণিত হয়েছে মূলত ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে। বস্তুত ভারতবর্ষ নামে একটি ভূমিখণ্ডকে নিজেদের দেশ বলে ভাবা, দেশাত্মবোধ জেগে ওঠা, পরাধীনতা অনুভূত হওয়া, স্বাধীনতার আকাঙ্খা – সবই সংগঠিত হয়েছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পরিপ্রেক্ষিতে। ইংরেজী শিক্ষা ও পাশ্চাত্য দর্শনের প্রভাবেই এই জাতীয় চেতনার বিকাশ। তার বহু আগে ৭১২ সালে সিন্ধু প্রদেশে আরব আক্রমণ ও তদ্‌পরবর্তী মুসলিম শাসনে ভারতীয় ভূমি সন্তানরা অপরিসীম অত্যাচার ভোগ করলেও ভারতবাসীর মনে পরাধীনতাবোধ বা স্বাধীনতার স্পৃহা কোনওটাই তৈরি হয়নি। ছোট থেকে মাঝারি রাজ্যের দেশীয় হিন্দু রাজারাও প্রজা নীপিড়ন করতেন, নারী নির্যাতন তো সমাজ জীবনের সমর্থিত অঙ্গই ছিল এবং তাঁরা নিজেদের মধ্যে কলহ বিশ্বাসঘাতকতায় যতটা পারঙ্গম ছিলেন, বহিঃশত্রু প্রতিরোধে ততটাই অপদার্থ। কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে স্বাধীনচেতা হলেও সামগ্রিক হিন্দু ঐক্যের অভাবে এবং নিজেদের রাজ্য বিস্তার ছাড়া সমগ্র জম্বুদ্বীপকে ঘিরে কোনও দেশাত্মবোধ না থাকায় একে একে আরব তুর্কি মোগল পাঠানদের দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। আর প্রজাদের কাছে তো মুসলিম শাসন ছিল রাজশক্তির রূপভেদ মাত্র – অত্যাচারীর প্রকারভেদ যারা গরীব প্রজা থেকে বিজিত রাজবংশের নারী কন্যাদের তুলে নিয়ে গিয়ে হারেমে বন্দী করে যথেচ্ছ ভোগ করে, ছলে-বলে ধর্মান্তরিত করে নিজেদের দল ভারি করত। এই নতুন রাজশক্তির বশ্যতা স্বীকার ও অত্যাচার মেনে নেওয়াকে নিজেদের নিয়তি ভেবে নিয়েছিল। নিজের দেশে বাস করে ‘জিজ়িয়া কর’ বা ‘তীর্থযাত্রা মাসুল’ কেন দিতে হবে উড়ে এসে জুড়ে বসা বহিরাগত শাসকদের হাতে – তাই নিয়ে প্রশ্ন তোলার উপায় বা শিক্ষা কোনওটাই ছিল না। মেবারের প্রজা ও বাংলার প্রজার মধ্যে এক জাতি এক দেশ – এই একাত্মবোধ বিকশিতই হয়নি। যারা আমাদের এটা শিখিয়েছিল, আমাদের যাবতীয় জাতীয় বোধ গড়ে উঠল তাদের বিরুদ্ধেই।

কিছু কিছু সাহিত্যিকের কলমে প্রচলিত ইতিহাসের বাইর মুসলিম শাসনের ভয়াবহ রূপ ফুটে উঠলেও কোনওদিন তাই নিয়ে নাটক বা চলচ্লিত্র নির্মিত হয়নি। আমাদের নব উন্মেষিত জাতীয়তাবোধে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটির ত্রুটিপূর্ণ অনুপ্রবেশের ফলে সত্যকে অস্বীকার করে বা ধামাচাপা দিয়েই পাঠ্যসূচীর ইতিহাস রচিত রচিত হয়েছে এবং বিস্ময়করভাবে সাহিত্য-সংস্কৃতিও সেইখানেই আবর্তিত হয়েছে। তাই দেশাত্মবোধক চলচ্চিত্র মানে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লবীদের অমর কীর্তি ছাড়া আর কিছু দেখানো হয় না। ইতিহাস থেকে উদাহরণ দেওয়ার উপায় না থাকলেও অত্যাচারী ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলমান সম্মিলিতভাবে লড়াই করার অসত্যকাহিনী উপ্ত থাকে, আর বোঝানোর চেষ্টা হয় ‘সম্প্রীতিপূর্ণ’ সহাবস্থানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির পেছনে শুধু ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দায়ী।

কিছু কিছু হিন্দী চলচ্চিত্রে ইন্দো-পাক যুদ্ধ ও ইন্দো-চিন যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বীরত্বের কাহিনী পরিবেশিত হলেও সাম্প্রদায়িক উপাদানটি মূলত বহিঃশত্রু হিসাবেই উপস্থিত থাকে। কিছু কিছু সাহসি সিনেমা বা নাটকে দাঙ্গার চিত্রও উঠে এসেছে। কিন্তু বাংলার সচেতন বিপ্লবী সংস্কৃতিতে যুদ্ধ নিয়ে বিস্ময়কর অনীহা। উদ্বাস্তু সমস্যা কয়েকটি ফিল্মের ফুটে উঠলেও সেটা মুসলিম আগ্রাসন নয়, এই দেশবাসীর বাঙালদের প্রতি তাচ্ছিল্য ও অসহযোগিতা দেখাতে আগ্রহী। আর যে ঘটনার অভিঘাত আন্তর্জাতিক স্তরে বাঙালী জাতি ও বাংলাদেশকে তুলে ধরল, তাই নিয়ে এপার বাংলার আবেগের সীমা পরিসীমা না থাকলেও মুক্তিযুদ্ধকালীন পরিস্থিতি বা যুদ্ধের পটভূমিতে চলচ্চিত্র নির্মাণের সাহস দেখাতে পারেনি কেউই। হয়তো সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের কমিউনিস্ট মতাদর্শ শ্রেণী সংগ্রাম ছাড়া আর কোনও সংঘাতের অস্তিত্ব স্বীকার করে না বলেই। কিন্তু বুর্জোয়া মূল ধারার বাণিজ্যিক ছায়াছবিতে মানুষের দুঃখ দারিদ্র মন্বন্তর যুদ্ধের বাজার ইত্যাদি প্রতিফলিত হলেও পাকিস্তানি আগ্রসন ও নিষ্ঠুরতার ছবি ঘুণাক্ষরেও ফুটে উঠতে দেখিনি। ১৯৭১ সালে মার্চের শেষ থেকে মধ্য ডিসেম্বর পর্যন্ত লাগাতার ন’ মাস ধরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যখন বাংলাদেশে রক্তপাত ধর্ষণ অপহরণের নারকীয় তাণ্ডব চলেছে, তখন আমাদের পশ্চিমবঙ্গ উত্তম-সূচিত্রা বা উত্তম-সুপ্রিয়ার রোমান্সে ভাসছে। যুদ্ধের পটভূমিকায় সমাজচিত্র বলতে উদ্বাস্তুদের দুঃসহ জীবনের টুকরো দেখানো হয়েছে, কিন্তু যাদের জন্য নিজেদের ভিটেমাটি মা-বোন-কন্যার সম্ভ্রম সর্বস্ব খুইয়ে ভারতে পালিয়ে আসা মানুষগুলো উদ্বাস্তু হয়েছিল, তাদের কীর্তিকলাপ দেখানোর সাহস কারও হয়নি, বরং চতুর নীরবতা পালিত হয়েছে এবং যাবতীয় দেশপ্রেম ‘ব্রিটিশ ভারত ছাড়ো’র মধ্যে সীমাবব্ধ রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশে ২১ ফেব্রুয়ারি ‘মাতৃভাষা দিবস’ বা ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে, এবং একই সাথে একটি রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। এছাড়া ফেব্রুয়ারি মাসটি মাসব্যাপী ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ বা ‘একুশে বইমেলা’ উদ্‌যাপন, ভাষা শহিদদের নামাঙ্কিত বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাষ্ট্রীয় বেসামরিক পদক ‘একুশে পদক’ দান ইত্যাদির মাধ্যমে মাতৃভাষার জন্য সংগ্রামটিকে স্মরণ করা হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই ও দেশের বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার প্রতিফলন; যেমন – শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর নাটক ‘কবর’; কবি শামসুর রাহমান রচিত ‘আমার দুঃখিনী বর্ণমালা, এবং ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯; জহির রায়হান রচিত উপন্যাস ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’; শওকত ওসমানের রচনা ‘আর্তনাদ’। তাছাড়া আছে ভাষা আন্দোলনকে উপজীব্য করে নির্মিত জহির রায়হান পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’। কিন্তু পাকিস্তানি প্রশাসনের অত্যাচারের কাহিনী নিয়ে দু-একজন গবেষক ছাড়া বাকি সাংস্কৃতিক জগত তেমন সরব নয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে প্রকৃত যুদ্ধ-নির্ভর চলচ্চিত্র নেই বললেই চলে।
বিগত কয়েক বছর কিঞ্চিৎ লেখালিখির সুবাদে বিভিন্ন সাহিত্যসভা বা সাহিত্যকেন্দ্রিক বিনোদনের আসরে উপস্থিত থাকার সুযোগ ঘটেছে। সভাগুলোয় বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আগে ভাগে দীর্ঘ বক্তব্য রেখে বা নিজেদের রচনা পাঠ করে প্রস্থান করেন। অবিশিষ্টদের কাছ থেকে তাঁদের কিছু শোনা বা জানার থাকে না। সন্ধ্যের অনুষ্ঠানে দূরাগত ও মহিলাদেরও একটু ‘আগে ছেড়ে দেওয়া’ হয়। ঘোষক/ঘোষিকা, আয়োজক পক্ষের গুটিকয় মানুষ, সভাপতি, মাইকম্যান এবং দিনের শেষে উদ্বৃত্ত জনাকয় কবি সাহিত্যিক ছাড়া অনুষ্ঠানের শেষ পর্ব বিশেষ কেউ দেখে না। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন থাকলে অবশ্য অন্য কথা। যাইহোক, অনুষ্ঠানের শুরুতে থাকে উদ্বোধনী সঙ্গীত, মধ্যে মধ্যে গান, শ্রুতি নাটক, আলোচনা ইত্যাদি। আর শেষের কথা তো শুরুতেই বললাম। ছোটবেলায় স্কুলে শিখেছিলাম, যেকোনও অনুষ্ঠানের শেষে জাতীয় সঙ্গীত (আসলে জাতীয় মন্ত্র) গাইতে হয় ‘সাবধান’এ দাঁড়িয়ে। সেই শিক্ষা বিদ্বজ্জন সভায় পরিত্যাজ্য। আমারও প্রথম দিকে মাথাতে আসেনি, সাহিত্য সভার সাথে দেশাত্মবোধের কোনও যোগ থাকতে পারে।

কিন্তু ভাবনাটা গুলিয়ে গেল ডায়মন্ড হারবারে এক গোষ্ঠীর আয়োজনে ইলিশ উৎসবে যোগ দিতে গিয়ে। অনুষ্ঠান শুরু হল “আমার সোনার বাঙলা/আমি তোমায় ভালোবাসি” উদ্বোধনী সঙ্গীত দিয়ে। গায়িকার সযত্ন পরিবেশনে বেশ আবিষ্ট হয়েই শুনছিলাম সবাই। হঠাৎ বাংলাদেশ থেকে আগত দুই মহিলা কবি উঠে এসে গান থামিয়ে সমবেতদের হুকুম করল, যেহেতু এটা বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত, সকলকে উঠে দাঁড়িয়ে শুনতে হবে। দু-একজন একটু গাঁইগুঁই করলেও আদেশ পালিত হল। একজন বেয়াড়া মানুষ কেবল ‘আমার কাছে এটা রবীন্দ্রসঙ্গীত, যা বসে শুনলেই বেশি উপভোগ করতে পারব’ বলে বসে থেকে গানটি শেষ হবার পর উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দেয়। স্বদেশের জাতীয় সঙ্গীতকে ওভাবে মাঝপথে থামিয়ে দেওয়া কতটা সঙ্গত জানিনা; তবে গানের তাল আবেদন ভঙ্গ করেও ঐ দুই মহিলা পররাষ্ট্রে আমন্ত্রিত হয়ে এসে যে সাহসিকতা, আত্মমর্যাদা ও দেশপ্রেমের পরিচয় রাখল, তার প্রশংসা না করে পারি না। সেই সাথে মনটা আত্মগ্লানিতে ভরে যায় আমাদের দেশের বঙ্গবাসীদের আপন দেশের মাটিতে দাঁড়িয়েও প্রতিবাদ প্রতিক্রিয়াহীন অমেরুদণ্ডী সমর্পণের জন্য।

এমনিতেই ওদেশ থেকে আসা সাহিত্যিক পদবাচ্যই নয় (হুকুম কর্ত্রীদের একজন) এমন ব্যক্তিকেও পদক, স্মারক, পুষ্পস্তবক, মানপত্র, উত্তরীয় ইত্যাদি প্রদানের মাধ্যমে পর্যাপ্ত সম্মান জানানোর পরও তার প্রতিক্রিয়া, বক্তৃতা, রচনাপাঠের জন্য যথেচ্ছ সময় ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, যা হয়েই থাকে। এদেশের নন-সেলিব্রিটি কবিদের করতালি দিয়ে বঙ্গালী উপভাষার মিশ্রণে কথিত বক্তৃতাকে স্বাগত জানানো ছাড়া বিশেষ কিছু করার ছিল না। ভিআইপি স্লটের ফাঁকেই সামান্য সময় প্রার্থনা করে নিজের সংক্ষিপ্ত কবিতা পরিবেশনের পর আমি বলেছিলাম, ‘আমন্ত্রিত কবি বন্ধুদের দেশাত্মবোধের আন্তরিক প্রশংসা করে আমি প্রস্তাব রাখছি অনুষ্ঠান শেষ যেন হয় “জনগণমন” দিয়ে এবং যথাযোগ্য সম্মান সহকারে। জয় হিন্দ।’ উত্তরে আয়োজক তথা ঘোষকের বিদ্রূপ ভেসে আসে, ‘অনুষ্ঠান রাত বারোটা পর্যন্ত চলবে। জনগণমন নিয়ে চিন্তা নেই।’ বলা বাহুল্য সকলেরই ট্রেন ধরে সেদিন ফেরার তাড়া ছিল, রাত বারোটার অনেক আগেই অনুষ্ঠানের সপাপ্তি ঘটে এবং যথারীতি ‘জনগণমন’ অগ্রাহ্য করে। তবে সমবেত এদেশীয় কবি সাহিত্যিক সতীর্থরা অনেকেই আমায় করতালি সহ অভিবাদন জানিয়ে বুঝিয়ে দেন, আমার বক্তব্য তাদেরও মনের কথা ছিল।

উক্ত আয়োজকের বক্তব্য ‘জনগণমন’তে সিন্ধুর কথা উল্লেখ আছে, যা এখন পাকিস্তানে। সুতরাং গানটির জাতীয় সঙ্গীত (অনেকেই জানে না, এটি ‘জাতীয় মন্ত্র, জাতীয় সঙ্গীত হল ‘বন্দে মাতরম’) হওয়ার যোগ্যতা নেই। প্রস্তর যুগের কিছু প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন ছাড়া ভারতের সভ্যতার ইতিহাস শুরুই হয়েছে যে সিন্ধু সভ্যতার আলোচনা দিয়ে, যে নদটির কিছু অংশ এখনও ভারতের(কাশ্মীর?) বুকেও বইছে, যে সিন্ধু থেকেই হিন্দু, হিন্দুস্তান, ইন্দাস, ইন্ডিয়া শব্দগুলির উৎপত্তি; তার নাম ভারতের মানচিত্র থেকে মুছে ফেলতে হবে? ১৯৪৭-এ অগণিত মানুষের রক্তপিচ্ছিল পথ বেয়ে ভারতের অঙ্গহানি ঘটিয়ে সেই প্রদেশটির বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াটাই ভারতের জাতীয় পরিচয়ের নিয়ামক হবে? আমাদের বেদমন্ত্রে যে সাতটি পবিত্র নদ-নদীর বা সপ্তসিন্ধুর উল্লেখ আছে তারা হল গঙ্গা, যমুনা, সিন্ধু, সরস্বতী, গোদাবরী, নর্মদা ও কাবেরী। অথচ সম্প্রদায় নির্বিশেষে এইরকম বিদেশী রাষ্ট্রতোষী প্রবণতা পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগুরু বাঙালী সাহিত্যিককূলের, যার প্রতিফলন বারবার বিভিন্ন সাহিত্য সভায় দেখা যায়, বিশেষত যেখানে বঙ্গভাষী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কেউ আমন্ত্রিত থাকেন।

১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের দেশের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিও গড়ে ওঠে, সরকারিভাবেই এদেশের অনেক সৈনিক পাকিস্তানী সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে। ১৯৫২-তে ভাষা আন্দোলনে শহিদের তালিকায় মূলত মুসলমান বাঙালীর নাম দেখা গেলেও পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু বাঙালীদের আত্মদান ছিল না ভাবাটা কষ্টকল্পিত। কলকাতা রেডিও থেকেই প্রথম ঘোষিত হয় ‘জয় বাঙলা’। বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্রও প্রথম স্থাপিত হয়েছিল এই পশ্চিম বাঙলার মাটিতে। সুতরাং স্বাধীন বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতীয়দের গর্ববোধ, বিশেষ করে ভারতীয় বাঙালীদের বাড়তি আবেগ থাকাটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু এই আবেগের আতিশয্যে আমরা প্রায়শ নিজেদের রাষ্ট্রীয় পরিচয়টি বিস্মৃত হই যেন। বাংলাদেশে কবিতা উৎসবে যোগ দিতে গিয়ে দেখেছি তারা নিজেদের জাতীয়তাবাদী কার্যক্রম অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে এবং সমস্ত বিদেশী আমন্ত্রিতদেরকেও সেই অনুষ্ঠানে শামিল করে। আবার পশ্চিবঙ্গের এক একটি অনুষ্ঠানেও বাংলাদেশের দেশাত্মবোধক সঙ্গীত, একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে আবেগমন্দ্রিত কবিতা, বঙ্গবন্ধুর নামে জয়ধ্বণি, তাঁকে নিয়ে লেখা গান কবিতার স্রোতে সত্যিই ভুলতে বসি, কলকাতার বাংলা অ্যাকাডেমি ভারতবর্ষে, আমরা ভারতীয়। মনে হয় বাংলাদেশটাই বুঝি আমাদের দেশ অথবা পশ্চিমবাংলা বাংলাদেশেরই অঙ্গ। জনৈক বাংলাদেশী কবির পংক্তি “যত দূর বাংলা ভাষা, ততদূর আমার বাংলাদেশ” শুনতে বড় উদাত্ত হৃদয়স্পর্শী লাগে, কিন্তু এর মধ্যে উপ্ত সাম্রাজ্যবাদটা আমাদের মষ্তিস্কে ধরা পড়ে না।

বস্তুত বাংলাদেশ তো আমাদেরই (ছিল)। এমন মনে হওয়াতেও হয়ত গলদ থাকে না যদি পররাষ্ট্রস্তুতির পাশাপাশি সেই রাষ্ট্র গঠনে আমাদের রাষ্ট্রের অবদানটাও স্মরণ করা হয়। ১৯৭১-এর রক্তক্ষয়ী দিনগুলোতে আমাদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে সরাসরি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বলেই ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি তথা রাষ্ট্রটির জন্ম। অথচ ভারতের মাটিতে বাঙালী বিদ্বজ্জন সভায় মুজিবরের নামে জয়ধ্বণি ওঠে, মুজিব তথা বাংলাদেশের ত্রাণকর্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নামটি উচ্চারিতও হয় না। ইন্দিরাকে সম্মান জানানো কি পশ্চিমবঙ্গীয় মনীষার পরিপন্থী? প্রায় চল্লিশ বছর পর দেরিতে হলেও বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কিন্তু ভারতের প্রাক্তন ও প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীকে মরণোত্তর ‘বঙ্গবন্ধু’ সম্মান জানিয়েছেন।

পাকিস্তানী মুসলমানদের অমানুষিক অত্যাচারে, উর্দু নিয়ে জবরদস্তিতে শুধু হিন্দু নয়, পূর্ব পাকিস্তান থেকে লক্ষ লক্ষ বাঙালী মুসলমানও ভারতমুখী হয়েছিল আশ্রয়প্রার্থী হিসাবে। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, উত্তর-পূর্বাংশ তথা সমগ্র ভারতবর্ষই বাড়তি জনসংখ্যার চাপে, জমি জবরদখলের জঙ্গীপনায় জেরবার। তবু আমরা আশ্রয় দিয়েছি; কিছুদিনের জন্য নয়, পাকাপাকি। এর খানিকটা যদি স্থানীয় ভোটব্যাংক তৈরীর অভিসন্ধিতে হয়েও থাকে, মূলত ছিল কিন্তু মানবতার খাতিরে। শ্রীমতী গান্ধী বারংবার রাষ্ট্রসংঘকে আবেদন জানান বিহিতের জন্য। বোঝান, ভারত যুদ্ধ চায় না, কিন্তু তার নাড়িছেঁড়া পেটের শত্রু (পাকিস্তান) ভারতের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিচ্ছে; কারণ কোটি কোটি শরণার্থীকে জায়গা দিতে গিয়ে ভারতীয় জমি ও অর্থনীতি দুটোই সংকটাপন্ন হয়ে উঠছে। নিপীড়িত পূর্ব পাকিস্তানী বাঙালী যারা এক সময় ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হতেই চেয়েছিল, তাদের বাঁচাতে গিয়ে ভারত তাদের মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয় নিজের সম্পদ ও জনসম্পদ ক্ষয় করে। সীমান্তে প্রহরা কড়া করে শরণার্থীর স্রোতে বাঁধ দেয়নি। হয়ত দিলেই ভারতের পক্ষে মঙ্গল ছিল। জনসংখ্যার এই বিস্ফোরণ (যার জন্য শরণার্থী প্রবেশ, অনুপ্রবেশ ছাড়াও আগত সম্প্রদায় বিশেষের জন্ম নিয়ন্ত্রণে অনীহাও দায়ী), অর্থনৈতিক সংকট এবং একটি শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্রের সাথে চির শত্রুতা এগুলোয় জর্জরিত হতে হোত না। এই শত্রুতার ফলে এখনও আসমুদ্র হিমাচলে নাশকতা, লোকক্ষয়, জনজীবনে ভীতি।

Statistics prove this contention. Bengali Hindus have never been safe and have always faced discrimination, killings, rapes, forcible conversions and forced displacements in Muslim-majority East Bengal that went on to become East Pakistan and then Bangladesh. In 1901, Hindus formed 33 per cent of the population of the eastern part of Bengal. They dwindled to 31.5 per cent in 1911, 30.6 per cent in 1921, 29.4 per cent in 1931 and 28 per cent in 1941.
After 1947, the decline in the Hindu population in East Pakistan was sharp. Hindus got reduced to 22.05 per cent of the population of East Pakistan in 1951, to 18.5 per cent in 1961, 13.5 per cent in 1974 (after the creation of Bangladesh), 12.13 per cent in 1981, 10.51 per cent in 1991, 9.2 per cent in 2001 and 8.96 per cent in 2011. By 2031, Hindus will form barely 5 per cent of the population of Bangladesh. Political connection[edit]
Gopal was an admirer and a staunch supporter of Subhas Chandra Bose. Coming from a family with a revolutionary background he didn’t believe in Gandhian non-violence. He believed that India could only become independent by ousting the British by force. Joya Chatterji, Professor of South Asian History at the University of Cambridge, explains that Gopal Mukherjee “was a major goonda at the time, who could command a force of around 500 men”. Patronised by Congress politicians (in an interview with Partition researcher Andrew Whitehead, Mukherjee claims close links with the second chief minister of West Bengal, BC Roy) and large businessmen, Gopal Pantha was the counterforce to Suhrawardy’s close links to the Muslim-dominated gangs of north Kolkata during the Great Calcutta Killings.

‘রাজাকার’দের মুণ্ডপাত আদতে একটি নারা, স্লোগান। তারাও বাংলাদেশী যারা দেশের সার্বভৌমত্বের বদলে পাকিস্তান ও উর্দুভাষীদের অধীনতা চেয়েছিল। কিন্তু তারা যে দেশটির হয়ে চরবৃত্তি করে, স্বদেশবাসীর ওপর অত্যাচার চালায়, সেই দেশটির প্রতি স্বাধীন বাংলাদেশের মনোভাব কী? ধর্মীয় কারণে ও ভারত-বিরোধিতার প্রশ্নে তারা কিন্তু আসলে মিত্র। Islamic fraternity-র এতটাই শক্তি যা বন্দুকের নল ঘুরিয়ে দিতে পারে। তাই শুধু ভারতের কাশ্মীর বা পশ্চিম প্রান্ত থেকে নয়, নাশকতাকামী জঙ্গী অনুপ্রবেশ ঘটে ভারতবর্ষের পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব সীমান্ত দিয়েও, বাংলাদেশের মাটিতেও গড়ে ওঠে পাকিস্তানী জঙ্গীদের শক্ত ঘাঁটি, ভারতীয় পাকিস্তানপন্থী উগ্রবাদী আবদুল করিম টুন্ডারা বাংলাদেশে পেয়ে যায় নিরাপদ আশ্রয়। এই দ্বিচারিতার মধ্যে ভারতীয় বাঙালীদের নির্লজ্জ বিদেশী তোষণ ও খোসামোদি আমায় শুধু লজ্জিত নয়, আতঙ্কিতও করে।

ওদেশের আতিথেয়তা নাকি অতুলনীয়। আমিও একবার ওখানে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তার প্রশংসাই করব মুক্তকণ্ঠে। তবে অতিথিপরায়ণার চাইতে আশ্রয়দাত্রী সাহায্যদাত্রীর ভূমিকা বড় বৈ ছোট মনে করব না। কতজনকে আর কত কারণে আশ্রয় দেবে এই পোড়া দেশ? ১৯৪৭-এ কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতো কোটি কোটি ক্ষত-বিক্ষত উদ্বাস্তুর পুনর্বাসন, ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় পুনরায় শরণার্থী পালন, চীন তীব্বত আক্রমণ করে অধিকার করে নিলে বৌদ্ধ শরণার্থীর স্রোত সামলানো, বাংলাদেশ থেকে খেদানো চাকমা শরণার্থীর ভিড়কে আশ্রয়দান, প্রতিদিন হিসাবহীন অনুপ্রবেশকারীদের পাকাপাকি রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড, সম্পত্তিক্রয়ের অধিকার প্রদান__!!

বাংলাদেশের বিরাঙ্গনা শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন নিজের দেশের স্বার্থে প্রয়োজনে অমানবিক হতে হয়। সে দেশে মুসলিম মৌলবাদীদের আক্রমণে পর্যুদস্ত ও বাস্তুহারা হয় চট্টোগ্রাম, কক্সবাজার অঞ্চলের অগণিত রাখাইন বৌদ্ধ; যার প্রতিক্রিয়ায় সামরিক শাসনাধীন ব্রহ্মদেশ শুরু হয়েছে রহিঙ্গা বা মুসলিম রাখাইন উৎখাত। বাংলাদেশ সরকারেরই নৈতিক দায়িত্ব ছিল রহিঙ্গাদের পুনর্বাসন দেওয়া বা অন্তত শরণার্থী শিবির খুলে দেওয়া। তা কিন্তু সে করেনি; সোজা তাড়িয়ে দিয়েছে ভারতীয় সীমান্তে। এমন কি রহিঙ্গারা যাতে বাংলাদেশের মূল স্রোতে কোনও ভাবেই মিশে যেতে না পারে, সেজন্য তাদের সঙ্গে বাংদেশী নাগরিকদের বিবাহও নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। মানবতায় দরাজ আমরা আবার খুলে দিয়েছি শরণার্থী শিবির, হোম এবং বাধ্য হয়ে হয়ত বা কারাগারও -আমাদেরই সম্পদের বিনিময়ে, নিজেদেরই অসুবিধায় ফেলে। আমরাও কি পারতাম না, যে দেশ নিয়ে এত আবেগাপ্লুত হই, তাদের অনুসরণে নারী, শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সহ ঐসব উদ্বাস্তুদের আশ্রয়দানের দায়িত্ব এড়াতে?

না, পারি না বলেই আমরা ভারতীয় যে দেশের মোট জাতীয় উৎপাদন উন্নত পশ্চিমী দেশগুলোকে টেক্কা দিলেও মুদ্রাস্ফীতি বিপদসীমার ঊর্ধ্বে, মুদ্রার মূল্য আন্তর্জতিক বাজারে ক্রমশ পতনশীল; পারি না বলেই আমরা ভারতীয় বাঙালী যারা বরাক উপত্যকার ১৯৬১র ১৯শে মের শহিদদের ভুলে ২১শে ফেব্রুয়ারি নিয়ে অধিক উন্মাদনা দেখাই। পারি না বলেই আমরা বাঙালী যারা আসাম জুড়েহীন প্রাদেশিকতায় রক্তাক্ত নিশ্চিহ্ন লক্ষাধিক বাঙালীর চূড়ান্ত সংকট ভুলে রোহিংগাদের জন্য কেঁদে ভাসাই, কারণ তাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভান করে কেন্দ্র সরকারকে নাজেহাল করা যায় বেশি, মাথা ঘামানোর দায় কম। হয়ত আসামের বিপন্ন বাঙালীর কে নাগরিক কে নয়, কে শরণার্থী কে অনুপ্রবিষ্ট, কে ভূমিসন্তান কে ভুঁইফোঁড় – ইত্যাদি নিয়ে রাজনৈতিক মতভেদের বিস্তর সম্ভাবনা আছে বলেই এই বিস্মরণ, যেখানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে সম্মান জানানোয় কোনও ঝুঁকি নেই। হয়ত আমাদের ভাষাগত পরিচয় ও রাষ্ট্রীয় পরিচয় এক নয় বলেই এই দিশাহীন অবস্থান; এফএম রেডিওগুলোতে উদ্ভট মিশ্রভাষার ভাষার আধিপত্য। হয়ত ভাষার কারণেই আমরা পর রাষ্ট্রের সঙ্গে এতটা একাত্মবোধ করি; এতটাই একাত্ম যার পরিবর্ধিত রূপ মায়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিংগাদের হিন্দু ও বৌদ্ধঘাতী সাম্প্রদায়িক চরিত্র ও অপরাধপ্রবণ স্বভাব জেনেও অস্বীকার করে আশ্রয় দিতে চাই যাতে অখণ্ড বাংলার সপ্নপূরণে কয়েক ধাপ এগিয়ে থাকা যায়। তবে এমন কিম্ভূত মানবতাবোধ ও জাতীয়তাবোধ যে দেশের নাগরিকদের, সে দেশ বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ নিশ্চই হতে পারে, কিন্তু ঐক্যে হতদরিদ্র থেকে যায়।

নবম অধ্যায়
তাহলে কি বৃহত্তর বাংলা?

এই ডামাডোলে আশঙ্কা হয় ভারতীয় বাঙালীর জাতীয়তা কি ‘বৃহত্তর বাংলাদেশ’-এর ধারণা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে যে উদ্যোগ দেশভাগের সময়ই নেওয়া হয়েছিল? দেশভাগের দাবিতে জিন্নার সঙ্গে মিলে যে সুরাবর্দি কলকাতায় দাঙ্গা বাধিয়েছিলেন, সেই ব্যক্তিই খুনে সাম্প্রদায়িক সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগকে হটিয়ে বাঙালী জাতীয়তার মেরুদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তারই উত্তরাধিকার সুপ্তভাবে বহন করে কিন্তু আওয়ামি লীগ স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার হয়। তাই ‘মুক্তিযুদ্ধ’-এর প্রয়োজনীয়তাবোধ, আবেগ বা আত্মত্যাগে খাদ না থাকলেও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ জন্ম নিয়েই জন্মদাত্রীর আরও অঙ্গহানি দাবি করে বসে। সে দেশের প্রধানমন্ত্রী ‘বঙ্গবন্ধু’ মুজিবর রহমান ভারতের কাছে আসামকে দাবি করেন।
এই জাতীয়তাই এখনও বৃহত্তর ও অখণ্ড বাংলার স্বপ্নকে জিইয়ে রেখে ভারতের বিস্তির্ণ ভূখণ্ডের ওপরেও দখল চায়। আর সেই সঙ্গে রয়েছে রহিঙ্গাদের আবাসস্থল মায়ানমারের আরাকান প্রদেশেকেও বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত করে ‘বহৃত্তর বঙ্গদেশ’ গড়ার উচ্চাশা। বাঙালী জাত্যাভিমানের এই প্রতীক কিন্তু ভারতের অখণ্ডতা ও সংহতি নাশের ব্লুপ্রিন্ট। এই বৃহত্তর বাংলার মানচিত্রে আছে নবাব আলিবর্দি খাঁর শাসনাধীন ‘সুবে বাংলা’র বিস্তার মেনে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় এমনকি বিহার ও উড়িষ্যা। নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয় আর মুসলিমদের রাজত্ব হারানোর শোক কিছুতেই ভুলতে পারে না তারা। সেই সিরাজ যার সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের মতো মানুষের মন্তব্য, “এই বদমাইশের কারণে কোন স্ত্রীলোকই তার সতীত্ব রক্ষা করতে পারে নাই”। তবু সিরাজের পরাজয় নাকি বাংলার পরাজয়, যেখানে আলিবর্দি নিজেই বাঙালী ছিলেন না, ছিলেন বহিরাগত। প্রসঙ্গত সেনরাও দক্ষিণ ভারত থেকে এসেছিলেন। প্রথম বাঙালী রা যাদের পতনের পর বাংলার লোক-নির্বাচিত রাজা হয়েছিলেন গোপাল। পাল বংশই প্রকৃত অর্থে বাংলার নিজস্ব রাজবংশ। তার আগে রাজা শশাঙ্ক ছিলেন প্রথম বাঙালী যিনি সাত শতকের দিকে বঙ্গ বিহার উড়িষ্যার অধিপতি ছিলেন। অথচ ইংরেজের বিরুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বাহিনী যখন লড়াই করছে তখন বাঙালী কেন ধান ক্ষেতে নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিল, কেন হাল ফেলে তরোয়াল তোলেনি – এই আক্ষেপ বাংলাদেশের বাম কথাসাহিত্যিক তথা ব্লগার কিলিংয়ের সময়ের অন্যতম রাজাকার জনাব পাকা তালুকদার সাহেবের।

বস্তুত বাংলাদেশী সাহিত্যিকরা অনেকেই বঙ্গে মুসলিম আগমন এবং তাদের মহান ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ব দেখে দলে দলে স্থানীয়রা মুসলমান হয়েছিল – এইরকম প্রচলিত গল্পগুজবকে ভিত্তি করে ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেছেন। নেপথ্যের দমন অত্যাচারের ইতিহাস গোপনে রেখে সুফিদের মাহাত্ম প্রচার করে সেই প্রচলিত বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা দিতে চান তারা। আরবি নাম পরিচয় উৎসব প্রথা ক্যালেন্ডার ইত্যাদি যারা বয়ে নিয়ে বেড়ায়, স্থানে স্থানে কারবালা চক নির্মাণ করে, বাংলার নিজস্ব রীতি-নীতি পালা পার্বণকে ঘৃণা করে, তারা বাংলাভাষী মুসলিম ঠিকই, কিন্তু বাঙালী বলা যায় কি? বলা বাহুল্য এই বৃহত্তর বাংলার চালিকা শক্তি থাকবে ইসলামিক মৌলবাদী গোষ্ঠীর হাতে এবং স্বতন্ত্র সেই রাষ্ট্রকে মুখাপেক্ষী থাকতে হবে পাকিস্তান ও আরব দুনিয়ার।

অশোক মিত্রের মতো কিছু বাঙালী কমিউনিস্ট নেতার এবং হয়ত অনেকেরই বাংলা ভাগ নিয়ে তো আফসোসের সীমা নেই। অশোকবাবু তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আপিলা-চাপিলা’-তে শ্যামাপ্রসাদের সিদ্ধান্তে কংগ্রেসের রাজি হওয়া নিয়ে কটাক্ষ করেছেন – “পশ্চিমবাংলাবাসীর জন্য কত দরদ, পূর্বদিকের জেলাগুলোর মানুষের যা খুশি হোক”। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং ও নোয়াখালি গণহত্যার সাক্ষী হওয়ার পরেও কী করে এমন অদ্ভূদ আবদার জাগে তা বোঝা সাধারণ শুভ বুদ্ধি দিয়ে সত্যিই দুষ্কর। অবশ্য অশোকবাবুদের বাংলা দরদের মান রেখে সুরাবর্দি বাংলাভাগের প্রতিশোধটাও নিয়েছিলেন জমিয়ে। হিন্দু বাঙলিরা মুসলমানদের অধীনে ও দয়ায় বেঁচে থাকতে যখন রাজি নয়, তখন মরেই যাক।
তাই বাংলা ভাগ করেও হিন্দু নিধন আটকানো যায়নি। কারণ কাঁটাতারের ওই প্রান্তে জনসংখ্যার ৩০%, সূত্রান্তরে ২২% ছিল হিন্দু। ২০১৪-য় তা নেমে এসেছে ৮%-এ, এখন অর্থাৎ ২০১৭-র শেষের সঠিক পরিসংখ্যান হাতে থাকলেও অনুমান করা যায় সেটা আরও কম, কারণ ২০১৫-র পর থেকে হিন্দু নিধন ধর্ষণ উচ্ছেদ, তাদের ঘরবাড়িতে অগ্নি সংযোগ, বিয়ে করে বা অন্য উপায়ে জোর করে ধর্মান্তকরণ ইত্যাদির হার কল্পনাতীতভাবে বেড়ে গেছে। যে কোনও ছুতোয়, এমনকি ভুয়ো প্রোফাইল থেকে ফেসবুক পোস্ট করে কোনও হিন্দুর ওপর ইসলাম অবমাননার দোষ চাপিয়ে উন্মত্ত জনতা নিয়ে গিয়ে সারা হিন্দু বসতিতে তাণ্ডব খুন বলাৎকারও খুব মামুলি ঘটনা। ১৯৪৭-এর অখণ্ড বাংলার ৪৫% হিন্দু জনসংখ্যা যদি একই হারে ২০১৪-য় ১২-১৩%-এ নেমে যেত, তাহলে হয়ত অশোকবাবুদের অসুবিধা ছিল না। কারণ তাঁরা তো ১৯৪৭-এর পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে শ্যামাপ্রসাদের পশ্চিমবঙ্গে পালিয়েই এসেছিলেন, তখন না হয় পশ্চিমবাংলা থেকেও কোথাও পালানো যেত; কিংবা হয়তো ইসলাম আনুগত্যের কারণে পুরস্কৃত হওয়ার সম্ভাবনাও কল্পনায় ছিল। সম্প্রীতির একটা হিসাব হুসেন শাহ সোরাবর্দি স্বয়ং সেই ১৯৪৬ সালেই দিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক রাকেশ বটব্বাল জানাচ্ছেন, “H. S. Suhrawardy … while answering the question of Dhirendranath Datta on the floor of the Bengal Legislative Assembly, gave a figure of 9,895 cases of forcible conversion in Tipperah, while that for Noakhali was not known, ‘but (which) ran into thousands’.”

একই ভাষার সুযোগে ও ভারতীয় বাঙালী মুসলমানদের আশ্রয়ে ও মদতে পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশী জঙ্গিদের তৎপরতা বহুদিন ধরেই সকলের জানা কিন্তু না জানার ভান করেও চলে যাচ্ছিল। বর্ধমানের শিমুলিয়ায় বোমা বানাতে গিয়ে বিস্ফোরণে বাংলাদেশী মৌলবাদী জঙ্গী দুজনের মৃত্যু বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারকে তৎপর হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল মাত্র। না হলে ‘শারদা’, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও মাদ্রাসার আঁতাত গোটা দেশে নাশকতার মাস্টার প্ল্যানে খানিক গোপনীয়তা থাকত। পশ্চিমবঙ্গ যে ইসলামিক মৌলবাদীদের নিরাপদ আশ্রয় এবং তা নতুন নয়, অন্তত বিগত তিন দশক যাবৎ, তা জানার জন্য গোয়েন্দাসূত্র লাগে না। তবু কেন্দ্রীয় সরাকারকে তৎপর হতে হল ২০১৪-য় বর্ধমানের শিমুলিয়া খাগরাগড় বিস্ফোরণের পর, যখন বাংলাদেশ তার চিরন্তন রীতি বদলে ‘জামাত’ সহ মৌলবাদী ও জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে আর প্রশয় দিতে রাজি নয় বলে দাবি করে উল্টে বাংলাদেশের সন্ত্রাবাদীরা পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছে বলে অভিযোগ তুলল।

একটা অসাবধানী দুর্ঘটনার ফলে খাগড়াগড়ে যে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে তার তদন্তে নেমে আবিষ্কৃত হয় সেটি ছিল জেহাদি জঙ্গিদের একটি ডেরা। রাজ্যপুলিস বোমা নিষ্ক্রিয় করার বদলে সেগুলো নষ্ট করে তড়িঘড়ি আসল উদ্দেশ্যের প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করলেও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এর নেপথ্যে সারা পশ্চিমবঙ্গ এমন কি সংলগ্ন রাজ্যে ইসলামি মৌলবাদী জঙ্গিদের বিশাল জালের হদিশ পেয়েছে। খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কাণ্ডের তদন্তে নেমে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (N.I.A.) যেসব জঙ্গি জেহাদি মডিউল পেয়েছে তাতে বৃহত্তর ইসলামিক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যই স্পষ্ট। এগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের একাধিক জঙ্গি সংগঠন ও তাদের নিয়ন্ত্রক পাকিস্তান গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর যোগসাযোগও স্পষ্ট। লালগোলার জেহাদি ডেরাতেও মিলেছে বৃহত্তর বাংলার মানচিত্র। পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা Inter Services Intelligence (ISI),বাংলাদেশের গুপ্তচার সংস্থা Director General of Forces Intelligence (DGFI)-এর একাংশ এবং Pan South Asian Millitant Organisation-এর অধীনস্থ ৯টি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন মিলিতভাবে তৈরি করেছে এই চক্রান্তের জাল।

কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে ২০০২ সালে Pan South Asian Millitant Organisation-এর অন্তর্ভুক্ত আসামের মুসলিম ইউনাইটেড টাইগার্স (Muslim United Tigers), হিজবুল-মুজাহিদিন (Hizbul-Mujahidin), মুসলিম ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট (Muslim United Liberation Front), মুসলিম ভল্যান্টিয়র্স ফোর্স (Muslim Volunteer Force), বাংলাদেশ জামাত-উল-মুজাহিদিন (Bangladesh Jamat-ul-mujahidin) ও হরকত-উল-জেহাদি ইসলামি (Harkat-ul-Jihadi Islami) এবং মায়ানমারের রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশন (Rohinga Soliderity Organization), জামাত-উল-আরাকান (Jamat-ul-Arakan) ও ইত্তেহাদুল মুজাহিদিন অব আরাকান (Ittehadul Mujahidin of Arakan) এই পরিকল্পনার হোতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে ব্যাপক হারে মুসলিম অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে জন-মানচিত্র বদলে দিয়ে সর্বত্র মুসলমানদের সংখ্যা গরিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠিত করা এর অন্যতম কৌশল বা স্ট্রাটেজি। তার পাশাপাশি জঙ্গি-জেহাদি মডিউল তৈরি করে যুবক যুবতীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া ও তাদের মাধ্যমে সশস্ত্র লড়াই ও নাশকতা এই পরিকল্পনার প্রধান কর্মসূচি।

খাগড়াগড় কাণ্ডের তদন্তে নেমে আবিষ্কৃত হয়েছে মুসলিম মহিলাদের জেহাদি কার্যক্রমে প্রশিক্ষিত করার বিশেষ ব্যবস্থা। বর্ধমানের শিমুলিয়া ও মুর্শিদাবাদের লালগোলার এই দুটি মাদ্রাসায় জেহাদি বই, ল্যাপটপে সংশ্লিষ্ট মডিউল তো বটেই মহিলাদের বোমা তৈরি ও অস্ত্র-পাচারে তালিম দেওয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। রক্ষণশীলতার পর্দায় বোরখাবতীদের সন্দেহ করা বা করলেও খানা তল্লাশি করাটা তো স্পর্শকাতর বিষয় করেই রাখা আছে। “We are still in the process to ascertain as to how many women had got trained at the two madarsas and at what level. As of now 40 suspects have been rounded up, four of which have been formally arrested,” sources said. জিজ্ঞাসাবাদে উঠে এসেছ এই আপাদমস্তক ঢাকা মহিলাদের ব্যবহার করে প্রতিদিন অন্তত ৪টি আধারে ৩০টি IEDs (improvised explosive devices) বিস্ফোরক বাংলাদেশে পাচার হয়ে আসছে সেই ২০১১ থেকে। ২০১৪-য় সব ধরা পড়ার পর বাংলাদেশের হাসিনা সরকার Research and Analysis Wing (RAW)-র কাছ থেকে তথ্য প্রমাণ জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। দুই দেশ, গা লাগা দুই বঙ্গ – কার কতটা সদিচ্ছা কেউ জানে না। কিন্তু র-য়ের নিষ্ঠাবান কর্মীর নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে তা বিদেশী সরকারের হাতে তুলে দিয়েছে। তারপরেও বিস্ময়করভাবে ব্যাপারটা খুব তাড়াতাড়ি ধামাচাপা পড়ে গেল। বাংলাদেশ সরকার ধরা পড়ে কিছুদিন ‘বকি বকি’-র ভান করার পর নিজের গদি নিয়ে ব্যস্ত। সে দেশে ব্লগার খুন হলে তবু খবর হয় যেহেতু আন্তর্জালকের মাধ্যমের তাদের কিছুটা পরচিতি আছে, কিন্তু দিনের পর দিন হিন্দু উৎখাৎ নারী নির্যাতনের খবরগুলো ওদেশের প্রশাসনের কাছেও গুরুত্ব পায় না, আর এদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা শান্তিকাম তো খবর অস্বীকার করতে ও চাপা দিতেই তৎপর। খবরগুলো মূলত সোশাল মিডিয়ায় প্রচারিত যেগুলোকে প্রামাণ্য সূত্রের অভাবে গুজব বলে উড়িয়ে দেওয়ার সুবিধা ছিল। এই ছবিগুলোর কয়েকটিতে মধ্যে কিছু অতিশয়োক্তি আছে, না প্রকৃত চিত্রটা আরও আরও বেশি ভয়াবহ তা ধোঁয়াশায়। ২০১৬-র শেষ দিক থেকে খবরগুলো বড়ো বড়ো ধামাতেও আর চাপা থাকছে না। কিন্তু দৈনন্দিন খবরে আর বৈচিত্র্য থাকে না, তাই নিয়মিত ঘটনাগুলো নিয়মিত আরও বেপরোয়াভাবে পুনরাবৃত্ত হচ্ছে ধরে নেওয়ার মধ্যে কল্পনার বাতুলতা নেই।
সুতরাং বাংলাদেশের কাছ থেকে সন্ত্রাস দমনে খুব একটা সদর্থক সহযোগিতা পাওয়া যাবে এটা আশা করাই বাতুলতা। এক্ষেত্রেও দুই বাংলায় একটা সাদৃশ্য তথা বৈপরীত্য। আগে বেগম জিয়ার আমলে যা খোলাখুলি মদত পেত, তা হাসিনার আওয়ামি লীগের প্রচ্ছন্ন মদতে লালিত হচ্ছে, যেখানে এখানে যা বাম আমলে গোপনে হোত তা পরিবর্তনকামী সরকারের আমলে বুক বাজিয়ে হচ্ছে। ১৯৩৩ সালে অ্যাডল্ফ হিটলারের প্রচারমন্ত্রী জোশেফ গোয়েবেল যেমন নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ইহুদি ও আন্যান্য যুদ্ধবন্দীদের সাথে করা প্রতিটি নারকীয় আচরণের সাফাই গেয়েছিলেন, অনেকটা সেইভাবেই পশ্চিমবঙ্গের জামাত উলেমা-এ-হিন্দের রাজ্য জেনারেল সেক্রেটারি সিদ্দিকুল্লা চৌধুরি বাংলার মাদ্রাসাগুলির জেহাদি কর্মকাণ্ডকে আড়াল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। [Upananda Brahmachari | HENB | Burdwan | 21 Oct 2014]। তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় এসেই পশ্চিমবঙ্গের ১০ হাজার মাদ্রাসার স্বীকৃতি ঘোষণা করার পরেও বেশ কয়েক হাজার কিছু অনোনুমোদিত মাদ্রাসা রয়ে গেছে যেগুলো মূলত এই উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হয়। কিন্তু সব তথ্য-প্রমাণ বিপদ সঙ্কেত দিলেও এই সন্ত্রাস প্রজনন কেন্দ্রগুলোকে বন্ধের কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বরং অনুমোদন দিয়ে সেই সব কর্মকাণ্ডকে আইনি সুরক্ষা দেওয়া হলেও আশ্চর্যের কিছু নেই। বরং স্বীকার করতে হয় ঢাকার গুলশন হত্যাকাণ্ডের পর হাসিনা সরকারের তৎপরতা সত্যিই কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু সরকারি সদিচ্ছা এক চুল বাড়লে জঙ্গি তৎপরতা কয়েক বিঘত বেড়ে যায়। তাই এতদিন পশ্চিমবঙ্গ ইসলামি জঙ্গিদের নিরাপদ আশ্রয় হিসাবে জঙ্গি হানা থেকে কিছুটা নিরাপত্তা ভোগ করে থাকলেও ক্রমশ কলকাতাও তাদের আক্রমণের নিশানায় চলে আসছে।

NIA-র তদন্তে শিমুলিয়া মঙ্গলকোটের ‘ইল্লুন্নেসা মাদ্রাসা’, লালগোলার মাকিমনগরের ‘মাদ্রাসাতু তালিমুল বানাত ফতিমাতুজ জোহ্‌রা’ ছাড়াও বোলপুরের আল ইনশাল্লাহ্ আল তৌহিদ জামাইতুল মাদ্রাসা সহ মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা, মালদা, বীরভূম, বর্ধমান প্রভৃতি জেলার অন্তত ৬৫টি মাদ্রাসায় ‘জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশ’-এর মদতে বোমা তৈরি, অস্ত্র মজুত করা, গোপন ডেরা নির্মাণ ও জঙ্গি প্রশিক্ষণ হয় বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
শাসকদলের বিধায়ক সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী অবশ্য পরিষ্কার নির্দেশ দিয়েছেন পুলিস সরেজমিন তদন্তে এলে মাদ্রাসায় যাতে ঢুকতে না দেওয়া হয়। মোটামুটি পুলিসের বিরুদ্ধে মুসলিম বিদ্রোহের হুমকি বলা যায়। এমনকি ২০১৪-র ২০ অক্টোবর খাগড়াগড় বিস্ফোরণের যাতে তদন্ত না হয় সে জন্য NIA-এর বিরুদ্ধে বর্ধমানের কার্জন গেট থেকে ‘জামাত-উল-উলমায়ে-হিন্দ’-এর ‘শান্তি মিছিল’ বার করে নিজেই জিহাদ করে দেখিয়ে দিলেন। সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের কোনও মাদ্রাসাতেই আশঙ্কার বশবর্তী হয়ে অনুসন্ধান চালানো যাবে না, যদি হয় তার প্রতিক্রিয়া হবে গুরুতর। বিনা অনুমতির খারিজি মাদ্রাসাগুলির অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার্থে চৌধুরী মশাই আসামের AIDUF নেতা বদরুদ্দিন আজমলের সঙ্গে যোগসাযোগে রাজ্য জুড়ে কত না মিটিং মিছিল সমাবেশ আয়োজন করেছেন। এই লোকটাই তাৎক্ষণিক তিন তালাকের বিরোধিতা করে মামলা করা ইসরত জাহানকেও শিক্ষা দিতে কোনও কসুর করেননি। তাঁর দলনেত্রীর পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া এটা সম্ভব হোত না। ইসলাম মহম্মদ ও কোরানের গূনকীর্তনের পাশাপাশি জেহাদকে সরাসরি সমর্থন করেই তিনি সসম্মানে রাজ্যের বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। পশ্চিমবঙ্গে বসে হিন্দু বাঙালীর দুর্গা পুজো, সরস্বতী পুজো বানচাল থেকে মন্দির ভাঙচুর আর অবাধ নারী ধর্ষণের স্পর্ধা কি এমনি এমনি বেড়েছে?

সুতরাং খারিজি মাদ্রাসা কোঅর্ডিনেশন কমিটির সঙ্গে আসাম জিহাদি মডিউল, আসামের মৌলবাদী নেতা বদরুদ্দিন আজমল, পশ্চিমবঙ্গের মাননীয় বিধায়ক সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী, হাসান আহমেদ, শারদা অর্থ পাচার চক্র দ্বারা বাংলাদেশী জিহাদি দলগুলির পরিপোষণ এবং দৈনিক কলম পত্রিকার স্পষ্ট যোগসাযোগ খুঁজে পেলেও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে নখদন্তহীন বাঘের ভূমিকাতেই থাকতে হচ্ছে।

মাঝেমাঝে কেন্দ্রের জাতীয়তাবাদী হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মৌলবি মৌলনা পোষক তৃণমূল সরকারের কোনও গোপন সমঝোতা হয়েছে কিনা সেই নিয়ে এক সময় জল্পনা হয়ে থাকলেও ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে ততই তাদের যুযুধানের ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে। তবে উভয় শিবিরের বিরোধী পক্ষরাও কিন্তু মুসলিম তোষণ বা ইসলামিক বাংলা তৈরির বিরোধিতা করছে না, বরং নিজেদের আরও বেশি সংখ্যালঘু দরদী প্রতিপন্ন করে তাদের ভোট পেতে চাইছে। একটা আস্ত সম্প্রদায়, যাদের সংখ্যালঘু তকমা দিয়ে নানা সুবিধা পাওয়ানোর অপচেষ্টা চললেও তারা আদতে দেশের দ্বিতীয় সংখ্যাগুরু, তারা বছরের পর বছর রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ‘ভোটব্যাঙ্ক’ হয়ে থাকার সুবিধা বুঝে গেছে। তাই সে পক্ষ থেকে প্রতিবাদ নেই।

মহিলা সংগঠনগুলি যদিও ‘তিন তালাক’ জাতীয় অব্যবস্থা থেকে মুক্তি চাইছে, কিন্তু তাদের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষমতা আমাদের সুশিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সমাজের হয় না। বাঙালীর প্রতিবাদী সত্তা শুধু কবর খূঁড়ে মুসলমান নারীর মৃতদেহ ধর্ষণের গুজবে বা ধরে নিচ্ছি সত্য কিন্তু হতাশা ও বিকারগ্রস্তের স্বগোতক্তিতে কান দিয়ে প্রতিবাদ মুখর হয়, এই বাংলার গ্রাম থেকে দিনের পর দিন নিকাহর নামে মধ্যপ্রাচ্যে যৌন দসত্বের জন্য পাচার হওয়া মুসলিম মেয়েদের জন্য হয় না, তিন তালাকের পর ‘হালালা’র নামে অনিচ্ছুক পরস্ত্রী ভোগের নোংরা ষড়যন্ত্রের প্রতি হয় না, বোরখা সহ দৈন্দিন অবদমনের প্রতি তো নয়ই। গৈরিক শিবির ‘আভিন্ন দেওয়ানি আইন’-এর কথা তুললে তা কেন উদারপন্থী ধর্মনিরপেক্ষ দেশে গতি পায় না, এটা কি ভাবার বিষয় নয়?
কতটা ভণ্ডামি ও অধঃপতন এই বাঙালী বুদ্ধিজীবিকায় বাসা বেঁধেছে, যে সে শুধু মুসলিম জঙ্গিপনায় উস্কানি লাগবে এমন খবরগুলোই বেছে নেওয়া হয়, বিপন্ন হিন্দু অস্তিত্ব বা নারী নির্যাতনের খবরগুলোকে চাপা দিয়ে? কামদুনির হাড় হিম করা নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে নির্যাতিতা দুষ্কৃতিদের প্রায় সবাই মুসলমান হওয়ায় তড়িঘড়ি নিহতকে ও পরে প্রতিবাদী গ্রামবাসীদের ‘মাওবাদী’ ছাপ দিয়ে শুরুতেই কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা হয়েছিল। টুম্পা ও মৌসুমী কয়ালের অসম সাহসিকতায় ভর করে অভিযুক্তদের ফাঁসির সাজা ‘ঘোষণা’ (এখনও কার্যকর নয়, উচ্চতর আদালতে যাবে কিনা বা গেলে রায় উদারতর হবে কিনা জানা নেই) বলতে গেলে ব্যতিক্রমী ঘটনা। অবশ্য ফাঁসি হবে কিনা জানা নেই, কারণ ভারতবর্ষ নাকি এতটাই সভ্য হয়ে গিয়েছে যে সেখানে আর মৃত্যুদণ্ডের প্রয়োজনীয়তা নেই, বরং ধর্ষক হত্যাকারীদের মানবাধিকার রক্ষার মঞ্চ আছে। মধ্যমগ্রামে দু বার গণধর্ষণের পর পুড়িয়ে মারা মেয়েটির পরিবার তো এ রাজ্যে বিচারের আশা ছেড়ে বিহারে আশ্রয় নিয়েছে। যে রাজ্যের নেতৃত্বের শিখরে একজন নারী থাকা সত্ত্বেও নারকীয় হত্যাকাণ্ডের শিকার মেয়েরা বিচার বা সহানুভূতির বদলে অপরাধীর তকমা পায়, আর অপরাধীরা পায় দলানুগত্যের কারণে সুরক্ষা, সেই রাজ্যের নৈতিকতার অধঃপতনের তল খুঁজে পাওয়াই তো যাবে না। বুদ্ধিজীবীরা যেখানে রাজনৈতিক বেচাকেনার সামগ্রী সেই জাতির বিরুদ্ধে যে কোনও ষড়যন্ত্র সফল হওয়া কী এমন কঠিন?

বাম সরকারের সময় ব্যাপারটা ছিল চোরাগোপ্তা। কিন্তু পরবর্তী ক্ষমতাসীন রাজ্য সরকারের প্রশ্রয়ে এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে স্পষ্ট মদতে এই অনৈতিক স্বপ্নের স্পর্ধা এতটা বেড়েছে যে মালদহের কালিয়াচকে পোস্তর ছদ্মবেশে আফিম চাষে পুলিস বাধা দিতে গেলে তা প্রতিহত করতে গিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে দেওয়া হয়, দেগঙ্গা ক্যানিং ধূলাগড়ে রীতিমতো পাকিস্তানের নামে জয়ধ্বণি দিতে দিতে বিনা প্ররোচনায় হিন্দুদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়, মালদা মুর্শিদাবাদ এমন কি কলকাতার অনতি দূরে বারাসাতেও দুর্গা পুজো বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়, তেহট্টে সরস্বতী পুজো বন্ধ করে দেওয়া হয়, বেলডাঙা সহ বহু গ্রামে সরস্বতীর ভাসান দিতে মুসলিম মাতব্বরদের অনুমতি লাগে। বারাসাতের একটি বইমেলায় দেখেছি নামাজের সময় বলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে কবি লেখক শিল্পী সঞ্চালকদের নেমে যেতে হল। জনৈক মোল্লা অনুমতি দেওয়ার পরই অনুষ্ঠান পুনরায় শুরু করা হয়। সন্ধ্যারতির সময় বলে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বন্ধ রাখার বিধান আজ পর্যন্ত কোনও ভাটপাড়ার পণ্ডিতকেও দিতে দেখিনি, যদি না অনুষ্ঠান ঠাকুরবাড়ির নাটমঞ্চে হ্য় যেখানে নির্দিষ্ট সময় আরতি করাটাও একটা অনুষ্ঠান। অর্থাৎ নিজেদের দৈনিক ধর্মাচারণই হোক বা হিন্দুদের পুজো পার্বণ – নিয়ন্ত্রণ তথা অনুমোদন মুসলিমদের হাতেই থাকবে।

২০১২ সালে বাংলাদেশ থেকে আগত দুই মহিলা ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি সকল ভারতবাসীকেও দাঁড়িয়ে শোনার হুকুম দানের সাহস কোথা থেকে পায় তার নেপথ্য ক্রমশ উদ্‌ঘাটিত হচ্ছে। অবশ্য হলেই বা কী? জল বিপদসীমা ছাড়িয়ে গেছে, যদিও প্রতিকারের রাস্তাটি এখনও বন্ধ হয়ে যায়নি। কিন্তু পাকিস্তান বাংলাদেশে যেমন সংখ্যালঘু বিশেষত হিন্দু ও ভারত বিরোধিতা নেতা নেত্রীদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের প্রাথমিক শর্ত, ভারতবর্ষে তেমনি কোনও দুর্বোধ্য কারণে সংখ্যালঘু এবং শত্রু প্রতিবেশী রাষ্ট্র তোষণ এমন কি সরাসরি সন্ত্রাসবাদীদের স্বীকৃতিদান রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে বুদ্ধিজীবিকার ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফ্যাশনের স্থায়িত্ব সাধারণত খুব বেশিদিন হয় না, পাল্টা প্রবণতায় নতুন ফ্যাশনের আমদানি হয়। কিন্তু এ দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিই দাঁড়িয়ে আছে মুসলিম মৌলবাদের মৌলিক অস্বিত্বকে মেনে নিয়ে। না হলে ‘অভিন্ন দেওয়ানি আইন’ একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের অপ্রধান অ্যাজেন্ডা হয়ে থেকে যেত না।
দুঃখের এবং সেইসঙ্গে বিস্ময়ের বিষয় পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালীদের একটা বিশাল অংশ সব দেখেও না দেখার, সব বুঝেও না বোঝার ভান করে একতরফা হিন্দুত্ববাদকে আক্রমণ করে নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষতা ও উদারতা জাহির করতে ব্যস্ত। সন্দেহ হয় এদেরও টিকি জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর কাছে বাঁধা কিনা। সন্দেহ কেন প্রত্যয়ই জাগে। কারণ পশ্চিমবঙ্গের সবুজ দলটি যেখানে ইমাম ভাতা, মাদ্রাসা বৃদ্ধি ও আরও নানা ভাবে ঢালাও ইসলামি মৌলবাদকে সরকারি স্বীকৃতি দিয়ে চলেছে, বামপন্থীরা তখন নিজেদের আরও বেশি মুসলিম দরদী সেকুলার প্রতিপন্ন করতে একের পর এক নাশকতাকে স্বাধীনতা সংগ্রাম, কট্টর মৌলবাদী জঙ্গি যারা সারা দুনিয়াকে পারাধীন করতে চায়, তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং সম্মুখ সমরে বা আদালতের নির্দেশে প্রাণ-দণ্ডিত সন্ত্রাসীদের মৃত্যুকে রাষ্ট্র পরিচালিত হত্যা সাব্যস্ত করতে উঠে পড়ে লেগেছে।

অনেক সময় এক জায়গায় জনগণকে বিভ্রান্ত করে অশান্তি উস্কে দিয়েই এরা অন্য জায়গায় গিয়ে একই কাজ করছে। আর এর জন্য রাজ্য ও দেশের কিছু উৎকৃষ্ট মেধার ছেলেমেয়েদেরই ব্যবহার করা হচ্ছে। যে জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে শাসক দলের আঁতাত, তারাই যে বিরোধীপক্ষকে হাত করে যে শাসক দলের নেওয়া কোনও রকম উন্নয়নমূলক কাজে ব্যাগড়া বাধানোর চেষ্টা করছে, ২০১৭-র গোড়ায় ভাঙড়ে পাওয়ার গ্রীড সংস্থার গ্রীড স্টেশন নির্মাণ পণ্ড হওয়ার মধ্যে আভাসিত। তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও প্রোমোটারদের স্বার্থ যদি প্রত্যক্ষ কারণ হয়ে থাকে, জনগণকে বিজ্ঞানের নামে ভুল বুঝিয়ে উন্নয়ন বিরোধী করে তোলার যে ষড়যন্ত্র বামপন্থী ছাত্রনেতা নেত্রীরা করে দেখাল, তাতে এই জঙ্গি যোগসাযোগের সম্ভাবনা মোটেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অবশ্য জানি না, তেমন কিছু আবিষ্কৃত হলে মা-মাটি-মানুষের সরকার হয়ত ধামা চাপা দেওয়ারই চেষ্টা করবে যাতে কেঁচো খুঁড়তে সাপ না বেরিয়ে পড়ে। সুতরাং কোনও দৈব প্রভাব বা জরুরি অবস্থা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীদের সঙ্গে মৌলবাদী ইসলামি সন্ত্রাসীদের জোট বিচ্ছিন্ন করা যাবে না।

আমাদের রাজ্যের এবং হয়তো বা দেশের সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলি ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতায় এতটাই মরিয়া এতটাই নীতিহীন, যে গৈরিক শিবিরকে প্রান্তিক করতে দেশের শত্রু সন্ত্রাসবাদীদের মদত নিয়ে এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে এখন চাইলেও বেরোতে পারছে না। বাঘের পিঠে চড়লে যা হয়। মুসলিম বাঙালীরা ইসলামিক বাংলার স্বপ্ন দেখতে পারে। রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের না হয় স্বার্থ আছে, কিন্তু তাদের সমর্থক সাধারণ মানুষের একটা বৃহদংশও কেন জোর করে সত্য গোপন রেখে বা বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে নিজেদের বিলোপ সুনিশ্চিত করছে বোঝা ভার। এরা কি নিজেদের ঘরে আগুন লাগাতে এলে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়ে আত্মরক্ষার কৌশল স্থির করে ফেলেছে?
যারা এখনও প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ সন্ত্রাসমুক্ত ভারত ও তার অঙ্গরাজ্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গকে দেখতে চায়, তারা ক্রমশ এতটা সংখ্যালঘু হয়ে চলেছে, যে কিছু বলতে বা করতে সাহস পাচ্ছে না। কারণ তাদের বিপদে পাশে রাজ্য প্রশাসনকে পাবে না, যেমন তথাকথিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাত দুষ্কৃতি (যাদের একজন হিন্দু নামধারী) দ্বারা কামদুনির ধর্ষিতা ও জরাসন্ধের মতো খুন হ‌ওয়া মেয়েটির পরিবার পায়নি; বরং বিচারপ্রার্থীদের মাওবাদী বলে গালাগাল শুনতে হয়েছে। তখন বামপন্থী শিবিরের কোনও কোনও বিদ্ধিজীবিকে তবু অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে দেখা গিয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে বিগত পাঁচ-ছ বছের ধরে একের পর এক ঘটে যাওয়া অনুরূপ নৃশংস ও ন্যাক্কারজনক ঘটনার প্রতিবাদ করার বদলে তারা খবর চাপা দিতে তৎপর হবে। আর গৈরিক অধিকৃত কেন্দ্র সরকারও যে এসব ছোটখাটো ব্যাপারে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসবে তেমন ভরসা নেই, কারণ পশ্চিমবঙ্গের মতো পুঁচকি রাজ্যের চেয়ে উত্তরপ্রদেশ, মহরাষ্ট্র, রাজস্থানের মতো বড়ো বড়ো রাজ্যের লোকসভা ও বিধানসভার আসন সংখ্যা অনেক বেশি, যেগুলো দখলে রাখতে অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের প্রতীকি জয়ই যথেষ্ট।

অবশ্য বৃহত্তর বাংলার স্বপ্ন যা এই অসাবধানি খাগড়াগড় বিস্ফোরণের নেপথ্য প্রেরণা হিসেবে আবিস্কৃত হয়েছে, তা বঙ্গবন্ধুর কন্যার স্বপ্ন নয় ভাবাটা কষ্টকল্পিত। সাময়িক তৎপরতার পেছনে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরাকরের কতটা দেশের জন্য সদর্থক চিন্তা কাজ করছিল আর কতটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা তা নিয়েও সন্দেহ ঘণীভূত হয়েছিল। কারণ তার অব্যবহিত পরে ‘যোগ দিবস’ পালন করে দেশবাসীর শরীরের মেদ ও মাথা ব্যাথা দুটোই লঘু রাখার আয়োজন দেখা গিয়েছিল।
জঙ্গি ডেরার জন্য ভারতকে মুখে আক্রমণ করলেও বা পরবর্তীকালে জঙ্গি দমনে সদর্থক পদক্ষেপ দেখালেও বৃহত্তর বাংলার স্বপ্ন বঙ্গবন্ধুর কন্যার স্বপ্ন নয় জোর দিয়ে বলা যায় না। সাময়িক তৎপরতার পেছনে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরাকরের কতটা দেশের জন্য সদর্থক চিন্তা কাজ করছিল আর কতটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা তা নিয়েও সন্দেহ ঘণীভূত হয়েছিল। কারণ তার অব্যবহিত পরে ‘যোগ দিবস’ পালন করে দেশবাসীর শরীরের মেদ ও মাথা ব্যাথা দুটোই লঘু রাখার আয়োজন দেখা গিয়েছিল। তারপর গঙ্গা পদ্মা সিন্ধু দিয়ে অনেক রক্ত বয়েছে, অনেক লাশ ভেসেছে।

আজ থেকে পাঁচ বছর আগে যা অনুমান করে সাবধানে ইঙ্গিত দিতাম, ২০১৮-য় এসে তা কল্পনার চেয়ে বেশি মিলে গেছে দেখে শিহরিত হচ্ছি। মুসলিম পুরুষ দ্বারা হিন্দু কিশোরীর পৈশাচিক ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় সাম্প্রদায়িক রং লাগে না, লাগে তাৎক্ষণিক তিন তালাকের মতো সংবিধান ও মানবতাবিরোধী ব্যবস্থা অবসানের চেষ্টা করলে। মুসলিম মেয়ের সঙ্গে হিন্দু ছেলের প্রণয়ের জেরে আকছার প্রেমিকের নৃশংস খুন সাম্প্রদায়িক মনে হয় না, হয় ‘লাভ জিহাদ’ সম্পর্কে সতর্কীকরণ বা তার বিচ্ছিন্ন প্রতিক্রিয়া।

খাগড়াগড় শিমুলিয়া খবরের শিরোনাম থেকে সরে গেলেও সেই তদন্তের সূত্র ধরে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা উদ্ঘাটন করছে একের পর এক ষড়যন্ত্র, দিয়ে চলেছে বিপদ সংকেত। কিন্তু যাদের সাবধান করা, তারা অধিকাংশ তো লেলিহান শিখাকে সিঁদুরে মেঘ বলে পূর্বরাগে বুঁদ। পশ্চিমবাংলার বাঙালী বিদ্বজ্জদের কেউ কেউ খোলাখুলি ‘সাম্রাজ্যবাদী’ ভারত থেকে হাঁড়ি আলাদা করে ‘বাংলাদেশী ভাই’-এর সঙ্গে এক হেঁসেলের স্বপ্ন দেখছে।
হিন্দু বাঙালীর নিজস্ব এই অতি ক্ষুদ্র আবাসভূমিকে পুনরায় বাংলাদেশ ওরফে পুর্ব পাকিস্তানের মতো বধ্যভূমি বানানোয় কেন এত উৎসাহ জানা নেই। তবে যে বাঙালীর হাত ধরে ধর্মীয় কুসংস্কার ছুঁড়ে ফেলে ভারতে নবজাগরণ শুরু, সেই বাঙালীর জাতীয়তাবোধের উত্তরাধিকার যদি মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদের হাতে চলে যায়, আর ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ এঁটে অবশিষ্ট বাঙালীরা যদি ক্রমশ সেইদিকেই আত্মঘাতী সমর্পণ করে, তাহলে বাঙালীর জাতিগত ঐতিহ্যের মৃত্যুই হয়েছে ধরে নিতে হবে।

দশম অধ্যায়
সংকটে বাংলা ভাষাও

কলকাতার একটি এফএম রেডিও স্টেশনে দুরন্ত গতিতে কথার তুবড়ি ফোটাচ্ছে রেডিও জকি। বাক্যগুলো যেমন মজাদার উচ্চারণভঙ্গীটিও তেমনি ‘মজাকিয়া’। প্রতি দশটি শব্দে চারটি হিন্দী চারটি ইংরিজির পর পড়ে থাকা দু আনার মতো দুটি বাংলা শব্দের ‘বিন্দাস’ সহাবস্থান। কোন ভাষায় কথা বলছে সেটা বোঝা দুষ্কর হলেও মানে বুঝতে একটুও বেগ পেতে হচ্ছে না। এতদিন ভাবতাম রবি ঠাকুরের কী বুদ্ধি! এমন কায়দা করে ‘জনগণমন’ লিখেছেন যে কোনও ভারতীয়ের কাছেই অর্থটা অধরা থাকছে না। বাঙালী কবি বাংলায় গান বাঁধলেও তা সর্বতোভাবে সর্বভারতীয় হয়ে গেছে। এখন দেখছি এই যুগের রেডিওর অনুষ্ঠান বা টিভি রিয়্যালিটি শোয়ের সঞ্চালকরাও কম যায় না। এমন চমৎকার ককটেল রচনার সামর্থ্য রাখে যাতে হিন্দী ও বাংলা যা খুশি ভেবে নেওয়া যায়। আর ইংরিজির তো যেখানে খুশি ঢুকে পড়ার লাইসেন্স আছেই। এ যুগের মানুষ শুদ্ধতা নিয়ে অত পিটপিট করে না, পাঁচ মিশেলি যা পরিবেশন করা হবে তা যদি ‘চটপটা’ চাটের মতো উপাদেয় লাগে, তাহলে চেটেপুটে খেয়ে নেয়; উপাদান নিয়ে প্রশ্ন তুলে রসভঙ্গ করে না।

ভাষাকে বহতা নদীর সঙ্গে তুলনা করা নতুন নয়। নদী যখন তখন তাতে বহিরাগত স্রোত এসে যেমন মেশে, মূল স্রোত থেকে শাখা প্রশাখাও বেরোয়। ইন্দোইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠীগুলোর উৎস অভিন্ন মনে করা হয়। ইওরোপে প্রবাহিত ধারাটি গ্রীক, গথিক, ল্যাটিন, ইত্যাদি ও পরবর্তী পর্যায়ে জার্মান, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, ইংরিজি ইত্যাদি হিসাবে বিকশিত হয়েছে। আর ভারতের দিকে যে শাখাটি বয়ে আসে তা প্রাথমিকভাবে বেদভাষা ও পরে সংস্কৃত নামে পরিচিতি পেয়েছে। এ ব্যাপারে গবেষকরা মোটামুটি ঐক্যমত। প্রসঙ্গত ভারতে আগত আর্যদের বেদ ভাষা ও সংস্কৃত মূলত এক হলেও একেবারে অভিন্ন নয়। অনার্য ভাষার সংমিশ্রণে বেদভাষার বিকৃতি রুখতে পাণিনি তাকে ব্যাকরণের শক্ত নিগড়ে বেঁধে সংস্কার সাধন করেন বলেই নতুন নামকরণ ‘সংস্কৃত’। তবু সংস্কৃতের সঙ্গে অনার্য ভাষার মিশ্রণে তৈরি হয়েছে একাধিক প্রাকৃত, পৈঙ্গল যার উত্তরাধিকারী আজকের হিন্দী, বাংলা, মারাঠী সহ বিভিন্ন ভারতীয় ভাষা। পাকৃত চার রকম ছিল। যেমন হিন্দীর পূর্বসূরী ‘সৌরসেনী প্রাকৃত’; মারাঠী, গুজরাটীর জননী ‘মহারাষ্ট্রী প্রাকৃত’; বাংলা, অসমীয়া উড়িয়ার জন্মদাত্রী ‘মাগধী প্রাকৃত’ আর কিছু অন্তজ শ্রেণীর মধ্যে প্রচলিত ‘পৈশাচী প্রাকৃত’। সুতরাং এক ভাষার সাথে আর এক ভাষার সংমিশ্রণে নতুনতর ভাষা সৃষ্টি হবে – এটাই কৃষ্টিশীলতা, গতিময়তা।

এখন মিশেলের ফলে উদ্ভূদ ভাষাটি যদি কিছুটা শৃংখলাবদ্ধ হয়, গড়ে ওঠে তার নিজস্ব ব্যাকারণ, বাকধারা, হয়ে পড়ে উন্নত চিন্তা প্রকাশের মাধ্যম – তাহলে মিশ্রণটি সার্থক বলা যায়। এই রকম একটি সার্থক নবনির্মাণ হল ‘উর্দু’। হিন্দী বা খড়িবোলীর ধাঁচায় তৎসম শব্দগুলো সচেতনভাবে বাদ দিয়ে আরবি ফারসি শব্দ এমনকি বাকধারার অফুরান ব্যবহারে তৈরি এই ভাষা। প্রাথমিকভাবে এর জন্ম সেনা ছাউনি। কিন্তু উর্দু (যার অর্থ তাঁবু) নিছক সেনাদের কেজো কাঠখোট্টা ভাব আদানপ্রদানের মাধ্যম হয়ে থাকেনি, রাজকীয় বিশেষত মুঘল বাদশাদের পৃষ্ঠপোষকতায় হয়ে উঠেছিল সাহিত্য, সঙ্গীতের অনুপম আশ্রয়। উর্দু সেনা শিবিরের মিশ্রভাষা হলেও এর নিজস্ব ব্যাকরণ আছে। নতুবা মিশ্রণের ফলে অধিকাংশত মিশ্রভাষা বা অপভাষার জন্ম হয়। যেমন জিপসি, বীচ-লামার কিংবা আমাদের ‘ডেঞ্চিবাবু’দের ভাষা। কতগুলো মজার উদাহরণ মনে পড়ছে – “মাই বেলি নো কাই কাই” যার অর্থ আমার পেটে খাদ্য নেই, আমি কিছু খাইনি, খাওয়া হয়নি বা খাব না – কিছু একটা হতে পারে। কলকাতার বাঙালীরা বিহারে বেড়াতে গিয়ে যা দেখত তাই তাদের কাছে কলকাতার তুলনায় ‘ড্যাম চীপ’ মনে হোত আর তাতে করে স্থানীয় মানুষের কাছে তারা ‘ডেঞ্চি’ অর্থাৎ ড্যাম চীপ বাবু হয়ে যায়। আরও আছে, “মাই হাউস মর্নিং অ্যান্ড ইভিনিং টোয়েন্টি লীভস্ ফল, লিটিল লিটিল পে হাউ ম্যানেজ?” যার অর্থ “সাহেব, সকাল সন্ধ্যা বাড়িতে বিশটা পাত পড়ে, অল্প অল্প মাইনেয় চলে কী করে?” বাংলায় ‘পাত পড়া’ তার নিজস্ব বাগ্‌ধারা বা figurative expression. ইংরিজিতে তার অনুবাদ ‘লীভস্ ফল’ বললে মানেটা শুধু হাস্যকর নয় রীতিমতো বিভ্রান্তিকর দাঁড়ায়।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমারও আশংকা হয়, বাংলার মতো উৎকৃষ্ট ও সমৃদ্ধ ভাষাও না সেই রকম সংকটে পড়ে যায় ইংরেজি, হিন্দী এমনকি নিজেরই কোনও উপভাষার দাপটে। উপভাষার প্রসঙ্গ তুললাম কারণ, আমাদের লিখিত ও চলিত কথ্য ভাষার একটা মান্য রূপ আছে যাকে Standard Colloquial Bengali বা মান্য চলিত বলে। এটি মান্য সাধুভাষার উত্তরসূরী। এর ভিত্তি রাঢ়ী উপভাষা যা গাঙ্গেয় পশ্চিমবাংলার ভাষা। এর সবচেয়ে পরিশীলিত রূপ নদীয়ার শান্তিপুর অঞ্চলে ব্যবহৃত। রাঢ়ীর নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলোই একটু মেজেঘষে মান্য চলিত বাংলা হিসাবে স্বীকৃত। এর মধ্যে যদি বঙ্গালি বা বাঙাল উপভাষার শব্দ বা বাকরীতি ঢুকে পড়ে চলিতের নিজস্ব শব্দ বা শৈলীকে প্রতিস্থাপিত করে তাহলেও কিন্তু তা মান্য ভাষার দুষণ বলেই ধরতে হবে।
চলিতের পীঠস্থান কলকাতায় এসে আমি ক্রমাগত শুনে যাচ্ছি চিবোনোকে চাবানো, মাড়ানোকে পাড়ানো। ‘যাবা’ ‘খাবা’ ‘বলবা’ করে কথা বললে মানুষটির উপভাষাগত ভৌগোলিক উৎস বোঝা যায়। কিন্তু মান্য চলিতের সাথে যদি চাবানো পাড়ানো যাবা খাবা মিশিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তা নিঃশব্দ ঘাতক, silent killer-এর কাজ করে। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা অশুদ্ধটাকেই শুদ্ধ হিসাবে জানছে। আমার কন্যা থেকে থেকেই গুলিয়ে ফেলে, “মা কথাটা মাড়ানো না পাড়ানো?” সব ছেলেমেয়ের এই প্রশ্ন নেই, তাদের সদুত্তর দেওয়ার মতো মা বাবাও কমে যাচ্ছে। কেউ বলতেই পারেন বাঙাল ভাষাও তো বাংলারই একটা রূপ, তার মিশেলে মান্য বাংলা সংকটে পড়বে কেন? তাহলে বলতে হয় বঙ্গালির রূপই স্থানভেদে পরিবর্তনশীল – যশোর-খুলনা আর ঢাকার ভাষা এক নয়, সিলেটি ভাষার সাথে বাংলার চেয়ে অসমীয়ার মিল বেশি, চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের ভাষা বোঝার জন্য আমাদের দোভাষী লাগবে। উপভাষার অনুপ্রবেশ মান্য ভাষায় কেন অনভিপ্রেত বোঝাতে আর একটা উদাহরণ দিই। আমার শেকড় বর্ধমান জেলার পশ্চিমাংশের একটি গ্রামে যার সাথে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূমের জলবায়ু, ভূপ্রকৃতি এমনকি ভাষাগত সাদৃশ্য খুব নিবিড়। ঐ সব অঞ্চলে কাউকে ‘পড়ে যাবি’ বলতে বলে ‘পড়ে হবি’। আমি আমার পিতৃভাষায় কথা এখানেও বলতেই পারি, সে স্বাধীনতা কলকাতাবাসীরা হরণ করতে পারবে না। কিন্তু মান্য চলিত বলতে গিয়ে যদি ঝাড়খণ্ডী বাগ্‌ধারার আদলে বলি ‘আমি সিঁড়ি থেকে পড়ে হলাম’ বা ‘আমি অমুক বটি, তুমি কে বট?’ সেটা কি অনুমোদনযোগ্য? তা হলে কেন ‘ফোন করা’ ক্রমশ বাংলাদেশের অনুকরণে ‘ফোন দেওয়া’ হয়ে যাবে? আরও কতগুলো ভুলভাল বিভক্তির প্রয়োগ রীতিমতো জাঁকিয়ে বসেছে। এখানকার লোকে বাজার ‘থেকে’ সব্জি আনে না, আনে বাজার ‘দিয়ে’। যা অবস্থা ‘থেকে’ বিভক্তিটির আর আগের অবস্থানে থেকে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। তারও প্রয়োগ হচ্ছে নতুনভাবে। এর উদাহরণ পরে দিচ্ছি। দু’চারটে শব্দ, অলংকার তথা প্রবচন অথবা expression রস সৃষ্টির জন্য প্রয়োগ করাই যায়, কিন্তু অন্য ভাষার বা উপভাষার প্রভাবে মূল মান্য ভাষার বাকরীতি বা figurative expression বদলে ফেললে কিন্তু ভাষার শরীরে ক্ষতই সৃষ্টি হয়, সময় যার শুশ্রুষা করতে পারে না; বরং ভাষার কাঠামোয় স্থায়ী রূপান্তর এনে দেয় যা কালের সাপেক্ষে উত্তোরণ নাও হতে পারে।
এই যে বাগ্‌ধারার কথা বললাম, তা কিন্তু প্রবাদ প্রবচন নয়। বাগ্‌ধারা হল একটি ভাষায় কথা বলার রীতি। আমরা গাছ থেকে বা উঁচু জায়গা থেকে ফল বা জিনিষপত্র পাড়ি। ‘পাড়া’টা নামিয়ে আনা অর্থে ব্যবহৃত একটা এক্সপেশন। বাংলায় গাল পাড়া যায়, দেওয়াও যায় কিন্তু গাল বকা যায় না। ‘গালিয়া বকনা’ একান্ত হিন্দীর নিজস্ব বাকধারা। কবি গায়ক সুমন চট্টোপাধ্যায় এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, “আমি কেন-কি-ওয়ালা বাংলা বলতে পারব না”। বাংলায় ‘কারণ’ শব্দটির পরিবর্তে ‘কেন না’ বলাটাই রীতি, ‘কেন কি’ হল হিন্দীর ‘কিঁউ কি’র অনুকরণ। এটা আমি প্রথম যে বাঙালীকে বলতে শুনি তিনি হলেন সুস্মিতা সেন, যার জন্ম ও বড় হওয়া দিল্লীতে অবাঙালী পরিমণ্ডলে। প্রবাসী টানে বিশ্বসুন্দরীর মুখে বাংলা শুনতে বেশ মিষ্টি লেগেছিল। কিন্তু সেই ভুলটা এতটা জনপ্রিয় হয়ে গেল যে আমাদের মায়ের প্রজন্মের মানুষেরও ‘কেন না’ ভুলে ‘কেন কি’ বলা অভ্যেস হয়ে গেল? অনেকের মুখেই ‘ছবি তোলা’ হয়ে গেছে ‘ছবি ওঠানো’, যা বলা বাহুল্য ‘তসবীর উঠানা’র অনুসরণ। ‘তসবীর খিঁচনা’র অনুবাদ করে এবার বাঙালীকে কল্যামেরায় ‘ছবি টানতে’ দেখলেও আশ্চর্য হব না। বাঙালীর ছেলেমেয়েরা যে আজকাল জন্মদিন ‘পালন’ করে না, জন্মদিন ‘মানায়’ যেহেতু হিন্দীতে ‘জনমদিন মানানা’টাই স্বাভাবিক। আমার ভাষায় অভাব থাকলে বা সৌন্দর্য বৃদ্ধির প্রয়োজনে অন্য ভাষা থেকে নানা শব্দ বা শব্দবন্ধ ভাষাঋণ হিসাবে গ্রহণ করা যেতেই পারে, এমনকি প্রবাদ বা proverbs গুলোর ভাষান্তর করলেও অসুবিধা নেই যদি দরকার হয়। এতে ভাষার শ্রীবৃদ্ধিই ঘটে। কিন্তু ভাষাঋণ নিতে গিয়ে যদি নিজের ভাষার নিজস্বতা নষ্ট করে ফেলি সেটা কোনও ইতিবাচক সংশ্লেষ নয় বরং ক্ষয়।

এইরকম চ্যুতির উদাহরণ আরও দেওয়া অনেক যায় আজকের বাঙালীর মুখের ভাষায়, বিজ্ঞাপনের ভাষায়, এমনকি টিভি চ্যানেলে সংবাদ পাঠের ভাষাতেও। এখন বাঙালীরা কেউ কারও ‘কাছ থেকে’ কিছু নেয় না, সবার ‘থেকে’ জিনিস বা পরামর্শ নেয়। ‘কাছ থেকে’-র বদলে শুধু ‘কাছে’ও বলা যেত বা যায় বলে জানতাম। যেমন – তোমার কাছে পরামর্শ নেব না। আর এখন কাছ থেকে কেউই বলে না। হয়ত আমরা আসলে কেউ কারও কাছাকাছি নই বলেই কিনা জানি না, ‘কাছে’ বা ‘কাছ থেকে’ হয়ে গেছে কেবল ‘থেকে’ – “তোমার থেকে টাকা চাইনি”। এই বদলটাও বলা বাহুল্য ‘হিন্দী’র ‘সে’ বিভক্তির অনুবাদের ফল – তুম সে নসীহত নহী লেনা হেয় মুঝে।

আজকের বাচ্চাদের কথায় আসি। আমার মেয়ে স্কুল থেকে ফিরে (যাকে এখন অনেকেই স্কুল দিয়ে ফেরা বলে) বলল, “মা আমি ফিজিক্সে হাইয়েস্ট নাম্বার এনেছি”। সেই অবধারিত ভাবে হিন্দীর ‘নাম্বার লায়া’ হয়ে গেছে বাংলায় ‘নাম্বার আনা’, ‘নম্বর পাওয়া’ বেমালুম গুম! আরও শুনি, “সোমালি ক্লাসে ফার্স্ট এসেছে”, ‘ফার্স্ট হয়’নি। এরা তো বাচ্চা, যা শোনে তাই শেখে। এদের মুখের ভাষায় ভেজাল মেশানোর জন্য দায়ী কারা? দায়ী অর্ধ শিক্ষিত শিক্ষক শিক্ষিকারা আর চলচ্চিত্র মিডিয়া বিজ্ঞাপণ জগতের ওপর চালাক অগভীর মানুষগুলো যারা উচ্চ পদে আসীন থেকে প্রচুর উপার্জনের বিনিময়ে দায়িত্ব নিয়ে বাংলার বারোটা বাজাচ্ছে। সবচেয়ে করুণ অবস্থা বাংলা বিজ্ঞাপণগুলোর যেগুলো হিন্দী বা ইংরেজী থেকে অনুদিত হয়েছে। একটা পরিচিত ডিটারজেন্টের বিজ্ঞাপণে একটা বাচ্চা ছেলে তার বন্ধুর সঙ্গে জল কাদায় মারামারি পর ভাব করার সময় বলছে, “তাহলে আমরা গলা মেলাই”। হায় ঈশ্বর! হিন্দীতে ‘গলে মিলনা’ হল আলিঙ্গন করা; ওদিকে বাংলায় ‘গলা মেলানো’ বলতে কিন্তু সঙ্গে কণ্ঠ্যদানকে বোঝায়, অর্থাৎ সমস্বরে গান, আবৃত্তি বা স্লোগান দেওয়া। মোটা মাইনে পাওয়া অ্যাড এজেন্সির কপি রাইটারদের আদৌ কোনও শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে না গাঁজায় দম দিয়ে মাতৃভাষার পিণ্ডি চটকায় জানতে ইচ্ছা করে। এরা হিসাব মতো সাংস্কৃতিক অপরাধ করছে; কারণ নতুন প্রজন্ম ভাষা শিক্ষার জন্য বাংলার রেফারেন্স হিসাবে এই দুষিত ভাষাটাই পাচ্ছে। তুমি বহু ভাষায় পারদর্শী হতেই পারো, কিন্তু প্রতিটা ভাষাকেই তার মর্যাদা দিয়ে নিজস্ব রীতি অনুযায়ী বল; নতুবা ‘টোয়েন্টি লিভস্ ফল’ হয়ে যাবে।

হিন্দী কিন্তু নিজের জায়গায় বাগ্‌ধারার দিক দিয়ে অতটা বিচ্যূত নয়, যদিও ইংরেজির মিশেল দিয়ে সংলাপ ও গানের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। আর অন্যান্য ভাষা থেকে তার ঋণ গ্রহণের ক্ষমতাও বেশি, তার উচ্চারণ শৈলীও ইংরেজী সহ অনেক পশ্চিমা বিদেশী ভাষার সঙ্গে বেশ খাপ খেয়ে যায়। বাংলা সহ প্রায় সব উত্তর ভারতীয় ভাষাতেই প্রচুর আরবি, ফার্সি শব্দের পাকাপোক্ত জায়গা। কিন্তু সেগুলোর তাদের মূলানুগ উচ্চারণ নিয়েই হিন্দীতে আত্তিকরণ ঘটেছে, যেখানে বাংলায় মূল উচ্চারণের শ্বাসাঘাত এমনকি ধ্বণিও অনেক ক্ষেত্রেই পরিবর্তিত। যেগুলো শুধু উচ্চারণের ফারাক সেগুলোর কথা বলছি না। কিন্তু অনেক শব্দের গঠনও বদলে গেছে বাংলায় অঙ্গীভূত হতে গিয়ে। যেমন ‘নেস্তনাবুদ’ বাংলায় ‘নাস্তানাবুদ’। ‘গুলাব’ হয়ে গেছে ‘গোলাপ’, তরাজ়ু (tarazu)-র উচ্চারণে ‘z’ বদলে পরিস্কার ‘জ’(j) হয়ে তরাজু হয়ে যায়, কম্মর > কোমর। সম্ভবত বাংলায় দুটি বহুল ব্যবহৃত শব্দের উৎসও এই রকম : ওয়াকিব-এ-হাল > ওয়াকিবহাল, সর জ়মিন (zamin) > সরেজমিন। ‘ফাজ়িল’ (fazil) শব্দটি হয়েছে ‘ফাজিল’ যার উচ্চারণের সঙ্গে অর্থতেও বিপ্লব ঘটে গেছে। বহুক্ষেত্রে মূল শব্দ ও অর্থ খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। আবার আমার অনুমান থেকে বলছি – সম্ভবত ‘মুয়ায়না’ অর্থ পরীক্ষা বিশেষত রসায়নাগারে পরীক্ষা বোঝায়। আর বাংলায় তা হয়ে গেছে ‘ময়না তদন্ত’ অর্থাৎ কিনা পোস্ট মর্টেম, যে পরীক্ষা মৃতদেহে করা হয়। কোথায় মুয়ায়না আর কোথায় ময়না পাখি? উক্ত শব্দগুলো হিন্দীতে কিন্তু তাদের মূল উচ্চারণ ও অর্থসহ গৃহীত হয়েছে।

উদাহরণের তালিকা বাড়ালে একটা বই লিখে ফেলা যাবে। একটা ভাষায় অন্য ভাষার শব্দ বা বাক্যাংশের প্রয়োজন অনু্ভূত হয় যদি সেই ভাষায় উপযুক্ত প্রতিশব্দ বা সমতুল্য অভিব্যক্তি (expression) না থাকে। আমি নিজে যেমন ‘মস্তি’, ‘বিন্দাস’, ‘অদা’ – এই শব্দগুলোর উপযুক্ত বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে পাইনি যারা ঠিক ঐ একই ব্যঞ্জনা ও সৌরভ বহন করে। আবার issue, correspondence এই শব্দগুলোর অর্থের যা ব্যাপ্তি তাদের বাংলা অনুদিত রূপগুলির তা নয়। issue শব্দটার ইংরিজিতে বিষয় বা ব্যাপার অর্থে প্রযুক্ত হতে পারে, সমস্যা হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে, আবার সন্তানও হতে পারে। বাংলায় প্রতিটি ক্ষেত্রে আলাদা শব্দ বা শব্দগুচ্ছ প্রযোজ্য, নয়ত ‘ইশ্যু’ বলেই ল্যাটা চোকাও। অন্যদিকে correspondence-এর বাংলা দূর থেকে পরিচালিত বা সংবাদ দাতা এই জাতীয় কিছু। আবার corresponding-এর বাংলা করলে আবার সংশ্লিষ্ট, তুলনীয়, অনুরূপ একাধিক মানে দাঁড়ায়। তাই এই ইংরিজি শব্দগুলো এড়িয়ে অনুরূপ অর্থ ও অভিব্যক্তির বাংলা বলা দায়। যার ফলে উক্ত শব্দগুলোর বাংলায় আত্তিকরণ সম্ভব না হলেও অন্তর্ভূক্তি ঠেকানো মুশকিল।

আর একটি দিক উল্লেখ করব। প্রতিটি ভাষায় শব্দের অর্থের পরিবর্তন সময়ের সাথে ঘটেই থাকে। কখনও অর্থের ব্যাপ্তি বেড়ে যায়, কখনও সংকুচিত হয়, কখনও বা একেবারে বদলে যায়। বাংলাতেই এমন বহু উদাহরণ আছে। ‘মৃগয়া’র অর্থ আদিতে মৃগ শিকার হলেও কালক্রমে সামগ্রিকভাবে শিকারকেই বোঝাতে শুরু করে। ‘নাগর’ কথাটা গোড়াতে নাগরিক বা নগরবাসী অর্থেই প্রচলিত ছিল যার মানে পরবর্তীকালে বাংলায় দাঁড়াল প্রেমিক,বিশেষত অবৈধ প্রেমিক। ইদানিং কয়েকটি শব্দের অর্থের পরিবর্তন ও বঙ্গসমাজে তার সর্বজন স্বীকৃতি দেখে আমার নিজেকে বড় সেকেলে মনে হচ্ছে। যেমন ‘ব্যাপক’ শব্দটি। ছোটবেলা থেকে শ্রেণীকক্ষে শুনে অভিধান পড়ে জেনেছি ব্যাপক মানে পরিব্যপ্ত, বিস্তীর্ণ, বেশ খানিকটা অঞ্চল জুড়ে, wide।ব্যাপক হারে বৃষ্টি মানে বিস্তির্ণ অঞ্চল জুড়ে বর্ষণ। মহামারীতে যে মৃত্যু ছড়িয়ে পড়ে তাকেও বলা যায় ব্যাপক মৃত্যূ। কিন্তু ইদানিং, শুধু ইদানিং বলব না, আমি যখন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলাম তখন সেই ১৯৯৩ সালেই প্রথম শুনি আমার এক আসানসোলের বান্ধবীর মুখে, “কাল ব্যাপক গরম ছিল” যার দ্বারা সে বোঝাতে চেয়েছিল প্রচণ্ড গরম, ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে গরম নয়। এর পর শুনলাম, “মাংসটা খেতে ব্যাপক হয়েছে”, ‘ছেলেটাকে ব্যাপক দেখতে’ এবং সব চেয়ে বড় ধাক্কা খাই আমার মা মাসির প্রজন্মের এক প্রতিষ্ঠিত মহিলা কবির সংলাপে, “সম্পাদক আমার ওপর ব্যাপক খচে গেছে”। এই পরিবর্তিত অর্থ গণমাধ্যমগুলিতে এমনকি সাহিত্য রচনাতেও রমরমিয়ে চলছে। এইভাবে ‘অত্যন্ত’ বা ‘দুর্দান্ত’র প্রতিশব্দরূপে ‘ব্যাপক’ বিশেষণটির ব্যবহৃত হ‌ওয়ায় তার প্রয়োগের ব্যাপকতা ক্রমশ ব্যাপকতর হয়ে চলেছে, কিন্তু ‘ব্যাপক’ আর ‘ব্যাপক’ অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছেই না বলতে গেলে।

পশ্চিমবঙ্গে ‘আধুনিক বাংলা বানান বিধি’র নামে তদ্ভব তো বটেই এমনকি তৎসম শব্দের বানানেরও যা পরিবর্তন করা হয়েছে এবং বিভিন্ন পত্র পত্রিকা গোষ্ঠী আপামরকে তা মেনে নিতে বাধ্য করছে সেটা কতটা যুক্তিগ্রাহ্য ভাবার অবকাশ রয়েছে। একদিকে ‘গান্ধী’ শব্দটিকে হিন্দীর অক্ষম অনুকরণে ‘গাঁধী’ লেখার বিচিত্র প্রয়াস, অন্যদিকে সংস্কৃত বানানবিধিকে কাঁচকলা দেখিয়ে সমস্ত দীর্ঘ-ই-কারান্ত শব্দকে হ্রস্ব-ই-কার করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ‘দেশী’, ‘পাখী’, ‘বাঙালী’, ‘হিন্দী’ ইত্যাদি শব্দের ঈ-কার বদলে ই-কার করা তো তো বটেই ‘শ্রেণী’, ‘গোষ্ঠী’ ইত্যাদি তৎসম শব্দগুলোকেও অসংস্কৃতভাবে ‘শ্রেণি’, ‘’গোষ্ঠি’ লেখা হচ্ছে। এমনকি মানা হচ্ছে না স্ত্রী লিঙ্গে ‘ঈ’ প্রত্যয় ব্যবহারের নিয়মও। ‘মুরগী’র বদলে ‘মুরগি’ (অজুহাত তৎসম নয়), ‘নাচনী’র বদলে ‘নাচনি’ (অজুহাত তদ্ভব) এমন কি ‘রানী’-ও গুরুত্ব ও দৈর্ঘ্য হারিয়ে ‘রানি’ হয়ে গেছে, ণত্ব বিধানকে তো কবেই কাঁচকলা প্রদর্শন করা হয়েছে। একটা যুক্তি রানি হল ‘রাজ্ঞী’ শব্দের তদ্ভব রূপ। ব্যস্! আর কী বিশুদ্ধ সংস্কৃত ছাড়া বাংলা শব্দে দীর্ঘস্বর উচ্চারিত হলেও বানানে দেওয়া চলবে না। হয়ত বা ‘নদী’-ও হতে চলেছে ‘নদি’। যেখানে হিন্দী বানানের সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে ‘পাঞ্জাব’, ‘মারাঠী’, ‘পাটনা’ ইত্যাদিকে বেখাপ্পাভাবে ‘পঞ্জাব’, ‘মরাঠি’, ‘পটনা’ লেখা হচ্ছে ‘অ’ স্বরবর্ণটি বাঙালীর জিহ্বায় কীরূপ ধারণ করবে তার পরোয়া না করে, সেখানে হিন্দী বা অন্যান্য সংস্কৃতজাত ভাষাগুলির বিপরীত মেরুতে গিয়ে শুধু দীর্ঘ ‘ঈ’-কারের ও ক্ষেত্রবিশেষে দীর্ঘ ‘ঊ’-কারের প্রতি পশ্চিমবঙ্গীয় আধুনিক বাঙালীদের কীসের আক্রোশ বোঝা সত্যিই দুষ্কর। বাংলায় স্বরের আদিতে শ্বাসাঘাতের কারণে শব্দের শুরুতে স্বর দীর্ঘ হয়ে যায়। সেই কারণেই আমাদের উচ্চারণে আগামী বা গত ‘কল’ হয়ে গেছে ‘কাল’। হিন্দীতে ‘কল’ হল বিগত বা আগামী কাল আর ‘কাল’ হল সময়, মহাকাল। দুটোর মধ্যে সম্পর্ক থাকলেও এক নয়। বাংলায় যদি ‘পটনা’ লিখতে পারি তাহলে সেই যুক্তিতে আগামী‘কাল’-কেও খুড়োর ‘কল’ বানিয়ে দিতে আপত্তি কোথায়? বাংলা ব্যাকরণ ও বানানের আধুনিক ঠিকাদারেরা না বিজ্ঞান, না ধ্বণিতত্ত্ব (phonetics) না পাণিনির যুক্তিসম্মত বিজ্ঞানসম্মত ব্যাকরণ – কোনওটাই মানতে রাজি নন। নাম করা বাণিজ্যিক পত্রিকায় উচ্চ পদাদিধার বলে কিছু সাহিত্যিক নিজের স্বেচ্ছাচার দ্বারা বাংলা বানানের যা চ্যুতি ঘটিয়ে দিয়ে গেলেন তার থেকে উদ্ধারের আশা নেই। এটা ‘ডিমনিটাইজেশন’-এর মতো অমোঘ যা সমর্থন না করলেও সকলে মেনে নিতে বাধ্য, কারণ মূলানুগ বানান বাতিল নোটের মতো অচল ঘোষিত হয়েছে।
অথচ হিন্দীর দাপটে পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারত ভূখণ্ডে বাংলা তার স্বকীয়তা হারাচ্ছে। আর অন্যদিকে ইসলামিক অনুশাসনে এবং উপভাষার সংমিশ্রণে বাংলার একটা বিকৃত রূপই সারা বিশ্বে বাংলা ভাষার কার্যত প্রতিনিধি হিসাবে মান্যতা পেয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের কবিতা থেকেও ‘শ্মশান’. ‘মন্দির’, ‘ভগবান’ ইত্যাদি শব্দগুলো বহুদিন আগেই বাদ দিয়ে ‘করবস্তান’ ‘মসজিদ’ বা ‘রহমান’ দ্বারা প্রতিস্থাপিত করার উদ্যোগ দেখা গিয়েছিল। বর্তমানে ধর্মীয় সংকীর্ণতার বাড় বাড়ন্তে রবীন্দ্রনাথকেই পাঠ্যসূচি থেকে পরিত্যাজ্য করা হয়েছে। ‘বাংলাদেশ’ নামের দেশটিতে যে ভাষার চাষাবাদ হচ্ছে ও তার গতিপ্রকৃতি যেদিকে অদূর ভবিষ্যতে তা যে নাম ছাড়া কার্যত বাংলা থাকবে না সেটা মনে হয় ভবিষ্যৎবাণী করাই যায়। ‘সিধু কানহো বিরসা’ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ আয়োজিত এক সেমিনারে জনৈক বিদগ্ধ ব্যক্তি ভবিষ্যৎবাণী করলেন, “একদিন মান্য চলিত বাংলাদেশে সাধুভাষা হিসেবে গণ্য হবে আর সেখানকার উপভাষা মর্যাদা পাবে চলিত হিসেবে”। তিনি অবশ্য এর মধ্যে বাংলাভাষার সুদিনের সন্ধান পাচ্ছেন, কিন্তু আমি উদ্বিগ্ন। আমার তেরো বছর বয়সী ইংরিজি মাধ্যমে শিক্ষিত কিশোরী কন্যাও কোনও সূক্ষ্ম অনুভবে একই পরিণতি অনুমান বা আশঙ্কা করেছে। ভাবি এইজন্যই কি পূর্ব পাকিস্তান, আসাম বা বিহারে মাতৃভাষা নিয়ে এত রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করেছে বাংলাভাষীরা?

পশ্চিমবঙ্গেও উদারতার ছলে বিরাজমান সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের জেরে মা, বাবা, পিসি, মাসি, দাদু-ঠাকুমা, দাদু-দিদা ইত্যাদি স্বাভাবিক ও মূল বাংলা শব্দগুলির পাশাপাশি প্রবল পরাক্রমে স্থান পাচ্ছে আম্মা, আব্বা, ফুফু, খালা, দাদা-দাদি, নানা-নানি। জলের বদলে পানি শব্দটি এই বাংলায় মোটেই প্রচলিত ছিল না, কিন্তু ক্রমশ তার প্রয়োগ বাড়ছে। শুধু সহাবস্থান নয়, চলেছে সাম্প্রদায়িক কারণে প্রতিস্থাপনও। তার মধ্যে ‘রামধনু’-র ‘রংধনু’ হওয়া নিয়ে কিঞ্চিত আলোচনা হলেও ক্রমশ সেটিই ধর্মনিরপেক্ষ(!) আধুনিক রূপ হিসাবে মান্যতা পাচ্ছে।

একজন ভাষাকর্মী হিসাবে একটু রক্ষণশীল হলে বোধহয় অনুদারতা নয়, মাতৃভাষার কাঠামোটির প্রতি আনুগত্যই প্রকাশ পায়। পৃথিবী থেকে প্রতিদিন বহু ভাষা অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। যে ভাষা জনসংখ্যার বিচারে বিশ্বে পঞ্চম স্থান দখল করে আছে, তার অবলুপ্তি নিয়ে আশঙ্কা হয়তো নেই, কিন্তু আরও কয়েক দশক পরের বাংলাকে আজকের বাঙালীরা বাংলা বলে চিনতে পারবে তো? এক ইতিবাচক অভিযোজনের ফলশ্রুতি ছিল অশিষ্ট ‘মাগধী প্রাকৃত’ থেকে আধুনিক পরিমার্জিত বাংলার রূপান্তর। কিন্তু যে পরিবর্তন, বিবর্তন ও প্রবণতার মধ্যে দিয়ে আজকের বাংলাভাষা চলেছে, তাকে তো ইতিবাচক নয় অবক্ষয়ী বলেই আশঙ্কা হচ্ছে।

অবক্ষয়ের কারণটা খুব অকারণ নয়। ‘বন্দেমাতরম্’ নিয়ে সম্প্রদায় বিশেষের প্রতিক্রিয়ার জেরেই জাতীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি গৃহীত হয়েছে জাতীয়মন্ত্র (National Anthem)। দুটোরই রচয়িতাই বাঙালী। প্রথমটি সংস্কৃতে রচিত হলেও দ্বিতীয়টির ভাষা আদ্যন্ত বাংলাই, শব্দচয়নের গুণে যাকে সর্বভারতীয় মেনে নিতে একটুও অসুবিধা হয় না। ভারতবর্ষই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে জাতীয় গীতির ভাষা রাষ্ট্রভাষার মার্যাদা পায়নি। আমাদের অভিযোগ নেই। কিন্তু এই সহিষ্ণুতাই যেন আত্মবিস্মরণের কারণ। কিংবা হয়তো গোপন অসন্তোষ থেকেই রাষ্ট্রীয় পরিচয় অতিক্রম করার বাসনা।

আসলে এত সমৃদ্ধ ভাষার অধিকারী হয়েও আমরা বড় অসহায়। প্রাদেশিক বিশিষ্টতা, মাতৃভাষার জন্য দাবি – এগুলো জাতীয় ঐক্যের পরিপন্থী বলেই কি এই আপুশে অবস্থান, নাকি হিন্দী ‘হারাম’ হলেও উর্দু ‘হালাল’ বলে ঘুরপথে সন্ধি? কারণ যাই হোক, হিন্দীর আধিপত্যে হেরে ও জনপ্রিয়তায় মজে একদিকে বাংলাভাষার পিণ্ডদান করি, অন্যদিকে দীর্ঘশ্বাস গোপন করি, অন্যদিকে আবার বাংলাদেশের সঙ্গে ভাষা ঐক্যের খাতিরে ও সাম্প্রদায়িক ঐক্য বজায় রাখার আকুলতায় মান্য বাংলায় যুগপৎ উপভাষা ও আরবি-ফার্সি শব্দের অনুপ্রবেশ অবাধ করে দিই। ভাষা তো বিবর্তিত হবেই। কিন্তু এই দুটো রাস্তার কোনওটাই কিন্তু বাংলাভাষার বিবর্তনের সহায়ক নয়। বাঙালীর বিভ্রান্ত ও খণ্ডিত জাতীয়তাবোধ দ্বারা কি তার সবচেয়ে বড় সম্পদ ভাষাও চরম সংকটে?