বাঙালীর খণ্ডিত জাতীয়তা: দেশভাগ ও প্রাদেশিক পেক্ষাপট

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

৫ম অধ্যায়

ত্রিপুরায় আদিবাসী বিদ্রোহ

দেশভাগের ইতিহাস পর্যালোচনায় ত্রিপুরার সমস্যাটাই সব চেয়ে কম আলোচিত থেকেছে, যেখানে অধিকাংশ বাঙালীই রাজনৈতিক ভাগ্য ও মানচিত্রের ফেরে বহিরাগত শরণার্থী। মূলত আদিবাসী প্রধান ছিল স্বাধীন ‘ত্রিপুরা’ রাজ্য, স্থানীয় আদিবাসীদের ভাষায় যার মানে ‘জলের ধারে ভূমি’। তবে রাজাসভায় বরাবরই বাঙালীর কদর। মহারাজ বিজয় মাণিক্য বাংলার সাতটি নদীতে পুণ্য-স্নান করেছেন। পূর্ববঙ্গের কুমিল্লা, অংশত চট্টগ্রাম, নোয়াখালি এমনকি ঢাকা মহকুমার কিছু অংশও ছিল ত্রিপুরারাজের শাসনাধীন; অর্থাৎ দশ হাজারের বেশি বাঙালী ত্রিপুরেশ্বরের প্রজা ছিল। ১২৮০-তে ত্রিপুরার রাজা প্রথম অনেক উচ্চ বর্ণের বাঙালীদের রাজসভায় আমন্ত্রণ করে আনেন। তারা বেশির ভাগই বাংলার ‘বারো ভুঁইয়া’ (H.L. Chatterji, ‘Glimpses of Tripura’s History’,Tripura Review, 15 August 1972)। তাছাড়া শুধু মাণিক্য রাজাদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি প্রীতি নয়, বাংলা ছিল বিভিন্ন জনজাতিগুলোর মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার সাধারণ ভাষা বা lingua franca. ইংরেজ প্রণীত আধুনিক শাসন ব্যবস্থার রূপকারও ছিল বাঙালীরা। তাছাড়া পূর্ববঙ্গীয়দের স্বাভাবিক কৃষি-দক্ষতা কৃষিশুল্ক দ্বারা রাজকোষকে রীতিমতো সমৃদ্ধ করে রাখত। এই আদানপ্রদানে কখনই আদিবাসীদের কোপে পড়তে হয়নি। সুতরাং ত্রিপুরার সঙ্গে বাংলা ও বাঙালীর যোগ স্বাধীনতা উত্তর ঘটনা নয়, রীতিমতো ঐতিহাসিক ও প্রাচীন। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই মুসলমান অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গ থেকে বিতাড়িত বা নিরাপত্তাহীন হিন্দু বাঙালীর ঢল ও তাদের বাড় বাড়ন্ত উপজাতিগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠতায় থাবা বসাল।
বস্তুত ত্রিপুরা ও সংলগ্ন পূর্ববাংলায় আদিবাসী ও বাঙালীর বসবাস ছিল মিলিয়ে মিশিয়ে। বাঁটোয়ারার ঠিক প্রাক্কালেও ত্রিপুরার বহু অংশেই ত্রিপুরী উপজাতিদের স্পষ্ট সংখ্যাধিক্য ছিল না; বরং চিটাগং পার্বত্য অঞ্চলে বা Chittagong Hill Tracts (CHT)-এ পার্বত্য উপজাতি জনগোষ্ঠীই প্রধান ছিল, বাঙালীর সংখ্যা ছিল মাত্র ২%। অন্যদিকে ত্রিপুরার সবচেয়ে আদিবাসীপ্রধান পাহাড়ি এলাকা তিপ্পারাতেও উপজাতি জনসংখ্যা ৪০%-র বেশি ছিল না। কিন্তু ১৯৪৭ যেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত অশ্রয়প্রার্থী বাঙালীর বাঁধ ভেঙে দিল। দুই দশকে উপজাতি জনগোষ্ঠী স্পষ্টত সংখ্যালঘু হয়ে পড়ল। ১৮৭৪-৮৫-এর আদমসুমারি অনুযায়ী আদিবাসীর সংখ্যা যেখানে ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যার ৬৩.৭৭% ছিল, ১৯৭১-এ তাদের জনসংখ্যায় প্রতিনিধিত্ব দাঁড়াল ২৮.৯৫%. (Source: Census Report)।

নীচের তালিকার দিকে চাইলে পরিস্থিতির একটা ধারণা পাওয়া যাবে –

Decadal Variation of Population and percentage of Tribals
(Source: Census Reports)

আর একটি সূত্র জানাচ্ছে “As per census records tribals constituted 52.89% of Tripura’s population in the first census of the last century held in 1901 while non-tribals formed 47.11%. The balance remained relatively stable in 1931 census when Tripura’s tribal population was 50.26% and non-tribal Bengali population was 49.74%. Even in 1941 tribal and non-tribal population was respectively 50.9% and 49.91%.” মানে ১৯০১ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত ত্রিপুরায় মোটের ওপর আদিবাসীর অনুপাত মোটামুটি স্থিতিস্থাপতক জায়গায় ৫২%-৫৬%-এর মধ্যে ঘোরা ফেরা করেছে যা দেশভাগের ফলে বিধ্বস্ত হয়ে গেল। ক্ষোভ জমতে জমতে শুরু হল আদিবাসী বিদ্রোহ (Tribal insurgency)। ক্ষোভটা সঙ্গত হলেও অতঃপর মাণ্ডাই গ্রামে উপজাতি জনগোষ্ঠী হিন্দু বাঙালীদের ওপর হিংস্রতা ও নৃশংসতার যা নিদর্শন রেখেছিল, তা এখনও শিড়দাঁড়া দিয়ে হিম স্রোত বইয়ে দেয়।
১৯৮০-তে আগরতলা থেকে ৩০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে ‘মাণ্ডাই’ (মাণ্ডাভি) গ্রামে বাস ছিল বাঙালী ও ত্রিপুরীদের। ৬ই জুন স্থানীয় TUJS ও TNV নেতারা বাঙালী নিধনের ব্লু প্রিন্ট তৈরি করে ফেলে। সেই রাত থকেই উপজাতির পুরুষেরা হিন্দু বসতিতে ঘাঁটি গাড়ে। ৭ই জুন ভোর থেকেই রক্তস্রোত বইতে থাকে; আর প্রাণ ভয়ে পলায়মান হাজার হাজার হিন্দু বাঙালী ঘর-বাড়ি ফেলে আশ্রয় নিতে থাকে ৪৪ নং জাতীয় সড়কের ধারে। জিরানা গ্রামের বিডিও পশ্চিম ত্রিপুরার জেলা শাসকের নির্দেশে ঘরছাড়াদের জন্য পরে খয়েরপুর স্কুলে ত্রাণ শিবিরও খুলে দেন। গুড় চিঁড়ে বণ্টনের নির্দেশ আসে। কিন্তু তার মধ্যে আদিবাসীদের আক্রমণে সরকারি হিসাবেই এ রাতে ২৫৫ জন হিন্দু বাঙালী ছটফট করতে করতে প্রাণ হারায়। বেসরকারি সূত্র বলে অন্তত ৩৫০ থেকে ৪০০ জন। সংখ্যাটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ মনে হচ্ছে না, তাই তো? তাহলে একটু বর্ণনা দেওয়া যাক। “Many of the victims had their heads crushed and their limbs severed. The children were spiked through. Pregnant women had their stomach slit open. According to UNI reports, the attackers inserted sharp weapons in the genitalia of the victim women. en.wikipedia.org/wiki/Mandai_massacre. মাথা গুঁড়িয়ে, হাত পা ছেদ করে, বাচ্চাদের এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে এবং অবশ্যই মহিলাদের আর একটু বাড়তি উৎসাহ নিয়ে, মানে জননাঙ্গে ধারালো অস্ত্র ঢুকিয়ে, গর্ভবতীদের পেট চিরে, – যত রকম বীভৎসতা হতে পারে! গুজরাটের গোধরা ও তার পরবর্তী দাঙ্গা বা দিল্লির ‘দামিনী’-কাণ্ডের লোহার রড পর্বের গর্ব চুরমার করে এই ভারতভূমিতে অনেক আগেই ত্রিপুরা রেকর্ড গড়ে রেখেছে। অমৃত বাজারের প্রতিবেদন জানায় অতীতের কলঙ্ক ‘মাইলাই হত্যাকাণ্ড’-কে ছাপিয়ে গিয়েছিল মান্ডাই গণহত্যা। ৯ জুন পৌঁছনো ভারতীয় সেনাদলের কমান্ডার মেজর আর. রাজামাণির মতে পূর্ববর্তী মাইলাই হত্যাকাণ্ড বীভৎসতায় ‘মাণ্ডাই ম্যাসাকার’-এর অর্ধেকও ছিল না।
৭ই জুন সন্ধ্যে বেলায় জিরানিয়া ব্লকেও শুরু হয় লুঠপাট। প্রশাসনের সবাই নিষ্ক্রিয় ছিল না। কিন্তু জেলা শাসক পি. এম. শর্মা ও অতিরিক্ত জেলা শাসক এম. এল. দাশগুপ্ত দুই কোম্পানি সেনার জন্য আবেদন করেন। কিন্তু আর্মির ওপর নির্দেশ ছিল শুধু ফ্ল্যাগ মার্চ করার। ততক্ষণে চম্পকনগর, বড়মুড়াতেও আগুন জ্বলছে। ৮ই জুন মাণ্ডাইয়ের LAMPS ম্যানেজার সত্যেন্দ্র চক্রবর্তী ও শচীন সাহা নামে জনৈক সিপিআই(এম) নেতা বিডিও অফিসে খবর দেন ৫০০-র বেশি হিন্দু বাঙালী বন্দি অবস্থায় মৃত্যুর প্রহর গুণছে। অনেকে আশ্রয় নিয়েছে শুনশান পুলিস চৌকিতে। শেষ পর্যন্ত পরের দিন সকাল ৬টা নাগাদ রাজস্থান সশস্ত্র বাহিনী (Constabulary) এবং ত্রিপুরা সশস্ত্র পুলিস বাহিনী জিরানিয়া থেকে মাণ্ডাইয়ের দিকে রওনা হল। রাস্তায় তখন দেখা যাচ্ছে পূর্বা নোয়াবাড়ি জ্বলছে। আর মাণ্ডাই পৌঁছে নেভানো মতো আগুনের শিখাও নয়, পাওয়া গেল রক্তপিচ্ছিল গ্রামময় ভস্ম-স্তূপ। কেবল LAMPS ভবনটি টিঁকে আছে। পুলিস চৌকিতে আশ্রণ নেওয়া দুজন বাঙালী হিন্দু রমনীকে সেখানেই কুপিয়ে খুঁচিয়ে ফেলে রাখে জীবন দেব্বামা নামক এক বীর পুংগব। আহতদের দু ঘণ্টা পরে ট্রাকে করে জিবি নিয়ে যাওয়া হল মৃত ঘোষণা শোনার জন্য। ৮ই জুলাই, ১৯৮০ সরাষ্ট্র মন্তক থেকে ‘দীনেশ সিংহ’ তদন্ত কমিটি গঠন করে দায় চোকানো হয়।

মান্ডাই হত্যাকান্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে ‘অমৃত বাজার পত্রিকা’য় ভারতীয় সেনার সংশ্লিষ্ট ভারপ্রাপ্ত মেজর রাজামণি তাকে ‘মাইলাই ম্যাসাকার’ (My Lai massacre)-এর সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন বীভৎসতায় মাইলাই হত্যাকাণ্ড মাণ্ডাইয়ের অর্ধেকও ছিল না। ১৯৬৮-র ১৬ই মার্চ ভিয়েতনামের মাইলাই গ্রামে চালানো মার্কিন সেনার নির্বিচার খুন ধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে কেন ত্রিপুরার মাণ্ডাই গ্রামে বাঙালীদের ওপর আদিবাসী বর্বরতার তুলনা করা হয়েছে পরিস্কার নয়। দুটি ভূখণ্ডই কমিউনিস্ট শাসিত ছিল বলে? একদিকে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের নির্লজ্জতম ও নৃশংসতম রূপ বিনা প্ররোচনায় একদিনে ৫০০-র ওপর নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে, আর একদিকে নিজেদের জমিতে প্রান্তিক হয়ে যাওয়া আদিবাসীদের আক্রোশে ৩০০-র বেশি বাঙালীর মৃত্যু – দুটো পরিস্থিতি মোটেই এক নয়। তবে চালচিত্র যাই হোক ত্রিপুরার বাঙালীদের ট্রাজেডির ছবিটা তাতে বদলাবে না।

একটি স্বাধীন রাজতন্ত্রী দেশ থেকে ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসাবে তার অন্তর্ভূক্তিতে ততটা প্রতিক্রিয়া হয়নি। কিন্তু দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে হাজার হাজার তাড়া খাওয়া বাঙালীর আগমণ ঘটে রাজ্যটার জনসংখ্যার চরিত্রই(demography) বদলে দিতে আদিবাসীদের মধ্যে জন্ম নিল অবিশ্বাস ও সামগ্রিকভাবে বাঙালী বিদ্বেষ যা দূর করার উপায় বা উদ্যোগ যথেষ্ট ছিল না। প্রাকৃতিক গ্যাসে সমৃদ্ধ এই রাজ্যটির অর্থনৈতিক বিকাশের যে সম্ভাবনা ছিল তাতে কবর দিয়ে দিল ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে এর ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা। অর্থাৎ ভারতভুক্তির ফলে উদ্বাস্তু আগমণের ভার বইতে হলেও উন্নয়নের সুফল সেভাবে পাওয়া গেল না। স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পরেও মাত্র ৮০ কিলোমিটার রেল পথ আর একটি মাত্র অমসৃণ জাতীয় সড়ক (NH 44)। আগরতলার বিমান বন্দরের যাত্রী পরিবহন ক্ষমতা আর কতটুকুই বা সামাল দিতে পারে? মাত্র দু জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি পার্লামেন্ট সদস্য মারফৎ রাজ্যবাসীর অভাব অভিযোগ দিল্লির কানে পৌঁছনোর আগেই পথে হারিয়ে যায়। বিচ্ছিন্নতাবাদ ও অশান্তির আদর্শ প্রজনন ক্ষেত্রে শুধু বাঙালী বিরোধী নয়, ভারত বিরোধী জঙ্গিপনাও ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করছে।
রাজতন্ত্রের অবসান এবং ভারতীয় ব্যালট বাক্স গণতন্ত্রের সূচনা ত্রিপুরায় উপজাতিগুলোকে রাজনৈতিকভাবে সত্যিই গুরুত্বহীন অন্তেবাসী করে দিল। রাজতন্ত্র অবসানের ৪০ বছর পর ত্রিপুরা তার প্রথম উপজাতি মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে পেল দশরথ দেবকে, যিনি পাহাড়ি প্রদেশের রাজা দশরথ বলেও পরিচিত। ততদিনে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। দশরথ ১৯৯৩-এ কমিউনিস্ট দল ক্ষমতায় ফেরার পর চার বছর ক্ষমতায় থেকেছেন। এই দশরথ দেবকে মুখ্যমন্ত্রী করার প্রস্তাব ১৯৭৮ CPI(M)প্রথম ক্ষমতায় আসার পরেই উঠেছিল; তুলেছিলেন ত্রিপুরায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের হোতা বীরেন দত্ত, একজন বাঙালী। সেবারে অবশ্য পলিটব্যুরো নেতা প্রমোদ দাশগুপ্তর তৎপরতায় নৃপেন চক্রবর্তীকে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। বীরেন দত্ত জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই নিয়ে নিজের আক্ষেপ জানিয়ে গেছেন, ‘one big mistake by our party in Tripura’(২৩.০৪.১৯৮৭)। ১৯৭৮-এ দশরথ দেবকে মুখ্যমন্ত্রী করলে আদিবাসী আবেগ এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের ওপর বিশ্বাস দুটোই অটুট থাকত – ‘Tribal extremism would never have taken off had Deb been made the chief minister and we would have been able to spread the communist movement to other tribal-dominated states of Northeast. But we missed that great chance by foisting Nripen Chakrabarty who was always described by tribal extremists as the refugee chief minister’ (Dutta, ibid). তার আগে কংগ্রেস সরকারও উপজাতি জনগোষ্ঠীকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি এবং বাঙালী শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিল রাজা বীর বীক্রমের দ্বারা ১৯৪৩-এ চিহ্নিত ১৯৫০ বর্গ মাইল Tribal Reserve অঞ্চলেই […,but in 1948, the Regent Maharani’s Dewan A.B. Chatterji vide order no. 325 dated 10th Aswin, 1358 Tripura Era (1948 AD) threw open 300 sq. miles of this reserve for refugee settlement. Later, more of these areas would be opened to the refugees]। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ত্রিপুরায় মোট বাস্তহারা অনুপ্রবিষ্টের সংখ্যা ৬,০৯,৯৯৮। ফলে ক্ষোভ জমছিলই ১৯৪৭-এর পর থেকে। নীচের তালিকা অনুপ্রবিষ্ট পূর্ববঙ্গীয়দের একটা হিসাব দেয় –

মনে রাখতে হবে, ত্রিপুরায় এই স্রোত ছিল সর্বতোভাবে একমুখী। ত্রিপুরা থেকে কোনও আদিবাসী, কোনও অহিন্দু পূর্ব পাকিস্তানে বা বাংলাদেশে চলে যায়নি। ১৯৪১-এ জনজাতির অনুপাত ৫৩.১৬% থেকে ১৯৮১-তে ২৮.৪৪%-এ নেমে এল। ত্রিপুরার উপজাতি জনগোষ্ঠী নিজেদের ভূমিতে প্রান্তিক হয়ে যেতে থাকল। তাদের জমিও বেহাত হতে লাগল। এই একমুখী জনস্রোতের অভিঘাত যে স্থানীয় ও বহিরাগত উভয় সম্প্রদায়ের কাছে ভয়াবহ হবে তা বুঝেও কিছু করার ছিল না। সীমন্তের এপারে বা ওপারে হিন্দু বাঙালীকে তো মার খেতেই হোত।

আর একটা মারাত্মক আত্মঘাতী ভুল করেছিল কমিউনিস্ট দল। ত্রিপুরায় দল হিসাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও রাজ্য বিধানসভা গড়ার উপায় ছিল না কেন্দ্রশাসিত রাজ্যটির। ১৯৭৮-এ ক্ষমতায় এসেই উপজাতিদের রাতারাতি “আমরা বাঙালী” তকমায় দাগিয়ে দিতে চেয়েছিল। সবাই তো পশ্চিমবঙ্গের বাঙালী নয়, যে উড়ে এসে জুড়ে বসাটা মেনে নেবে। Tribal National Volanteers (TNV)-এর নেতৃত্বে কতটা হিংসা ও বিদ্বেষ জমা ছিল ও তার গতি প্রকৃতি কোন দিকে, তা নিয়ে কোনও চিন্তা ভাবনা কাজ করেনি এই আরোপিত অভিন্নতার প্রয়াসে। পুঞ্জিভূত বারুদে অগ্নিসংযোগ হল। ১৯৮৮-তে বাম সরকার পরাভূত হওয়া পর্যন্ত হিন্দু বাঙালীদের ওপর TNV-র তাণ্ডব চলতেই লাগল। সিপিআই(এম) নির্বাচনে হারার পর কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে TNV-র একটি চুক্তি হয় যাতে বিধান সভায় ত্রিপুরী উপজাতির প্রতিনিধির জন্য তিনটি আসন সংরক্ষিত হল। এর ফলে TNVকে প্ররোচিত করে বামপন্থীদের ওপর ওপার থেকে আগত বাঙালীদের আস্থা নষ্ট করার কংগ্রেসি ষড়যন্ত্রেরও সন্ধান পেতে লাগল ত্রিপুরার বাম দল। প্রমাণ স্বরূপ হাতে পাওয়া গেল ত্রিপুরা অ্যাসেম্বলি নির্বাচনের দুমাসের মধ্যে মিজোরামের সাপ্তাহিক কাগজ জোয়িং (Zoeng)-এ প্রকাশিত কংগ্রেসি মিজো মুখ্যমন্ত্রী লণ্ঠনহাওলা ও TNV নেতা বিজয় কুমার হ্রংখওয়ালের আঁতাত পত্র-বিনিময়। রাজনৈতিক চাপান-উতোর ষড়যন্ত্র-অবিশ্বাস বাঙালী-আদিবাসী সংঘাতকে ক্রমশ জটিলতর করে চলল। এর চরমরূপটা আবার দেখা গেল ২০০২-এ Tripura Tribal Areas Autonomous District Council (TTADC)-র নির্বাচনে বিচ্ছিন্নতাবাদী National Liberation Front of Tripura (NLFT) কয়েকজন বামপন্থী প্রার্থীকে অপহরণ ও খুন করে পুনরায় আতঙ্কের বাতাবহ সৃষ্টি করল Indigenous Peoples Front of Tripura (IPFT)-র প্রচারের স্বার্থে। IPFT প্রত্যাশিতভাবে TTADC নির্বাচন জিতল। TTADC গঠনের পর এই প্রথম বামফ্রন্ট ভোটে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। NLFT ইতিমধ্যেই বামপন্থী আদিবাসীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছে ২০০৩ বিধানসভা নির্বাচনের দিকে চোখ রেখে। বাম নেতাদের অবস্থা হল না ঘরকা, না ঘাটকা। আদিবাসী এলাকায় তারা NLFT-র আক্রমণের নিশানা, আর বাঙালী পাড়ায় তারা চিহ্নিত হল হয় অপদার্থ নয়তো বাঙালী-বিদ্বেষী হিসাবে। ৬.৬.২০০০ সালে দেওয়া এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে UBLF নেতা বিজন বসুর বক্তব্য, ‘It is because we Bengalis vote for them that the communists enjoy some clout in Indian politics. But these are the people who have, instead of protecting the Bengalis, dropped us before the tribal wolves and let them feast on our rotting flesh. We will punish them as much as the tribal extremists, though we will not touch tribals who are fighting the militants,’ তার মানে, আদিবাসী চরমপন্থীদের পাশাপাশি বাঙালী কমিউনিস্ট নেতৃত্বকেও ছেড়ে দেওয়া হবে না। অর্থাৎ বাঙালী উল্টে নিজেদের মধ্যেই অন্তর্দন্দ্বে জড়িয়ে পড়ল।

মাণ্ডবি রাত্রির পর দাঙ্গায় প্রাণ হরিয়েছে অন্তত ১০০০ জন, যাদের সিংহ ভাগ বাঙালী। US Committee for Refugees, Special Report on Northeast India, compiled by Hiram Ruiz, 2000-র খতিয়ান অনুযায়ী দু লক্ষের বেশি পুনর্বাসিত শরণার্থী আবার বাস্তুহারা হয়েছে। অন্যান্য সূত্র থেকে দেখা যায় গত কুড়ি বছরে ৬০০০ বাঙালী জাতি-দাঙ্গায় খুন হয়েছে, ৫০০-র বেশি অপহৃত হয়েছে যাদের কেউ কেউ মুক্তি পেয়েছে এমন অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে যাতে পরিবারটির আর্থিক ভিত উপড়ে যায়, আর নোখোঁজ যে কত শত তার হিসাব নিতেও আতঙ্ক। অস্তিত্ব সংকটে পড়ে প্রাণরক্ষায় তৈরি United Bengal Liberation Front (UBLF) যান বাহনে বোমা মেরে ২০ জন আদিবাসীকে উড়িয়ে দেয়। বাঙালীদের তরফ থেকে প্রতিশোধ বলতে এইটুকুই এবং সেটা অবশ্যই কোনও সুরাহা এক দিকে দিল্লির ‘উপজাতি গণমুক্তি পরিষদ’কে লাগাতার অবহেলা, অন্য দিকে বাঙালী বাম শক্তির ক্রমাগত উত্থান ত্রিপুরার জনজাতির মধ্যে যে অবিশ্বাস ও বিদ্বেষের বীজ বুনে জন সিঞ্চন করেছে, তার কোপ থেকে ত্রিপুরার বাঙালীদের মুক্তি নেই। লাগাতার রক্তক্ষরণের এই ইতিহাসে আরও আরও বীভৎসতা ও রাজনৈতিক জটিলতার তথ্য ও বিশ্লেষণ সংযোজন করা যায়, কিন্তু আজও শান্তি প্রতিষ্ঠায় সফল কোনও সমাধান সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি।

আদিবাসী উপজাতি বা জনজাতিদের ক্ষোভ হয়তো অহেতুক নয়; কিন্তু একটি সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক স্বার্থে বা ভাবাবেগে ভারত উপমহাদেশকে প্রথমে দুই পরে তিনখণ্ড করার মূল্য হিন্দু বাঙালীদের আর কত প্রজন্ম ধরে দিয়ে যেতে হবে তার উত্তর আমাদের এখনও জানা নেই। প্রসঙ্গত মূল ভারতীয় ভূখণ্ডে শতখানেক স্বাধীন রাজতন্ত্রী রাজ্যও থেকে গিয়েছিল, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল ছাড়া তাদের কী গতি হোত আর তাদের নিয়ে ভারতই বা কী করত কে জানে?

এই ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের দায় তো পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ওপরই বর্তায়। তবে এ নিয়ে আমাদের, মানে পশ্চিমবঙ্গীয় হিন্দু বাঙালীদেরই মাথা ব্যথা নেই, তো পররাষ্ট্রের দায়স্বীকার। এত কিছুর পরেও, এত মার খেয়েও আমরা একতাহীন, পরধর্ম, পরসংস্কৃতি, পররাষ্ট্র লেহনকারী আত্মবিস্মৃত এক জাতি। শুধু সাহিত্যচর্চার খাতিরে আগরতলা গিয়ে কি আমাদের জাতিগত চরিত্রের সামান্যতম উন্নতির প্রয়াস করছি? বাংলার ও হিন্দু বাঙালীদের সমস্যার মূল উৎস যে পাকিস্তানের দাবিতে দেশভাগ যা ক্রমাগত উৎখাৎ ও অনুপ্রবেশের দ্বারা বাংলাদেশ এখনও জিইয়ে রেখেছে, তা চিহ্নিত করার সাহস কি দেখাতে পারি? নাকি বাংলা সংস্কৃতি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তাদের কাছেই নিজেদের জাতীয়তা নিঃশর্তে সমর্পণ করে আসি?

তার ওপর আসামে ২০১৭-১৮-য় যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে উপজাতি অধ্যুষিত ত্রিপুরায় অনুরূপ জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি নির্মাণের প্রস্তাবে বাঙালীর আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে; বিশেষ করে যখন ক্ষমতাসীন দল উপজাতি জনজাতিদের মধ্যে শক্তি সঞ্চয় করেই ক্ষমতায় এসেছে। অনুরূপ নাগরিক স্বীকৃতি ও বিদেশী চিহ্নিতকরণ পদ্ধতি চালু হলে পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা বাঙালীরা যে রাতারাতি বিদেশী ও অবৈধ অনুপ্রবেশকারী সাব্যস্ত হবে না, তা জোর দিয়ে বলা যায় না। আর সেটা হলে আর একটা মাণ্ডাই গণ্ত্যাকাণ্ডের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ভারতীয় বাঙালীরা দেশের স্বাধীনতার খাতিরে চরম আত্মত্যাগের জন্য এখনও অনুতাপ করছে না, কিন্তু তারা চিরকাল সংকটেই থাকবে এটা যেন নিয়তি নির্ধারিত বলেই ভারতবর্ষ ধরে নিয়েছে।

“Indian tribe massacres 350 ‘outsiders'”. The Miami News. June 16, 1980. Retrieved July 15, 2012.
Paul, Manas (2010). The Eyewitness: Tales from Tripura’s Ethnic Conflict. Lancer Publishers. pp. 86-94. ISBN 1935501151. Retrieved July 16, 2012.
“Indian tribesmen reportedly massacre Bengali villagers”. St. Petersburg Times (St. Petersburg, Florida). June 17, 1980. Retrieved August 20, 2012.

ষষ্ঠ অধ্যায়

মানভূমের বাংলা ভাষা আন্দোলন ও প্রাপ্তি:
বাঙালী ঐক্যের এক ব্যতিক্রমী ছবি

বাংলাভাষার জন্য সংগ্রামের ইতিহাসে সব চেয়ে উপেক্ষিত মানভূমের লড়াই আর তার আঞ্চলিক ইতিহাস। এখানকার বাঙালীদের সমস্যা ঠিক দেশভাগ নয়, প্রাদেশিতার কারণে যার পেছনে ঔপনিবেশিক প্রভাব যথেষ্ট। সম্ভবত ভারত উপমহাদেশে এখানেই হয়েছে প্রাচীনতম বাংলাভাষা আন্দোলন। অথচ ২০১১ সালে এর শতবর্ষ পূর্তিতেও এই নিয়ে তেমন আলোচনা কোথায়? সাঁওতাল বিদ্রোহের কথাও আমাদের ইতিহাস পাঠ্যক্রমে উল্লেখ আছে, কিন্তু এই অঞ্চলের বাঙালীদের ভাষা আন্দোলনের কথা না পাঠ্য পুস্তকে বিবৃত না বাংলা ভাষা আন্দোলনের আলোচনায় শামিল। ১৯১২ থেকে দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে লাগাতার আন্দোলনের আংশিক সাফল্য আসে ১৯৫৬ সালের ১লা নভেম্বর পুরুলিয়ার বঙ্গভুক্তির মাধ্যমে। সুদীর্ঘ লড়াইয়ে প্রাক্‌-স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা-উত্তর একাধিক তারিখ তাৎপর্যপূর্ণ, কোনও নির্দিষ্ট দিনকে ‘শহীদ দিবস’ বলে চালানোর উপায় নেই বলেই কি এই উপেক্ষা?

মানভূমের বিদ্রোহী পটভূমি:

মানভূম ধলভূম অঞ্চলের ইতিহাস তলিয়ে দেখলে লক্ষ্য করা যায় বহুকাল আগে থাকতেই এই অঞ্চলটি এতটাই স্বাতন্ত্যপ্রিয়, যে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদকেও বারবার নাজেহাল হতে হয়েছে। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাহ আলমের কাছে বাৎসরিক ২৬ লক্ষ টাকা রাজস্ব প্রদানের বিনিময়ে দেওয়ানি লাভ করে এখানকার (ঝাড়খণ্ড) জঙ্গলমহলে চড়া হারে খাজনা আদায় শুরু করে। ১৭৯৮ সালে খাজনা অনাদায়ের অজুহাতে পঞ্চকোট রাজার জমিদারি নিলামে উঠলে রাজভক্ত প্রজাদের তীব্র বিক্ষোভে কোম্পানিকে পিছু হটে শেরগড় পরগণার ১৮টি মৌজা ছাড়া বাকি অংশ পঞ্চকোটরাজকে ফেরত দিতে বাধ্য হয়। জঙ্গুলে দক্ষিণ পুরুলিয়াতেও খাজনার চড়া হার ও অন্যান্য কারণে সাধারণ মানুষ ১৭৬৭ সাল থেকে ১৮৩২ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ৬৬ বছর ধরে কোম্পানির সঙ্গে খেপে খেপে লাগাতার লড়াই করে যায়, ইতিহাসে যা ‘চুয়াড় বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহ তীব্রতম রূপ নেয় ১৮৩২ সালে রাজা গঙ্গানারায়ণের নেতৃত্বে যাকে ইংরেজরা নাম দিয়েছিল ‘গঙ্গানারায়ণ হাঙ্গামা’। এলাকাটি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টায় একের পর এক প্রশাসনিক বিভাজনে তৈরি হতে থাকল নতুন নতুন জেলা। ১৯৭৩-এ পাঞ্চেত (সদর রঘুনাথপুর), ১৮০৫-এ জঙ্গলমহল (সদর বাঁকুড়া) এবং শেষে ১৮৩৩-এ মানভূম (সদর প্রথমে মানবাজার পরে ১৮৩৮ থেকে পুরুলিয়া গ্রাম বা অধুনা শহর)।

জন্মলগ্নে মানভূম ছিল ৭৮৯৬ বর্গমাইল জোড়া ভূমিখণ্ড যা একই সঙ্গে খণিজ ও বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ, আবার রাঢ় বাংলার লোক সংস্কৃতিতেও সম্পৃক্ত। কিন্তু ১৮৫৫-র সাঁওতাল বিদ্রোহই হোক বা ১৮৫৭-র সিপাহি বিদ্রোহ – মানভূমের জনতা কখনই নিস্পৃহ ছিল না। ফলস্বরূপ বিদ্রোহ প্রবণ একালাটিকে নিয়ে চলতে লাগল কাঁটা ছেঁড়া। ১৮৩৩-৭৯ এই ৪৬ বছরের মধ্যে আয়তন প্রায় অর্ধেক হয়ে গেল (৪১১২ বর্গমাইল)। তবে মানভূমের অনেকটা অংশ বাঁকুড়ায় জুড়ে দেওয়ায় তা পরবর্তীতে পশ্চিমবাংলায় চলে আসে বিনা ঝঞ্ঝাটে। পশ্চিমবাংলায় চলে আসার কথাটা বলতে হল, কারণ প্রাচীন ও মধ্যযুগ থেকে বাংলার অংশ বলে পরিচিত বঙভাষী এই ভূখণ্ডকে ২০১১-য় বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল যার সামান্যই ফিরে আসতে পেরেছিল।

লক্ষণীয় গাঙ্গেয় সমতল বাংলা সেই সময় ইংরেজ সরকারের এইসব সাম্রাজ্যবাদী পদক্ষেপের বিরোধিতা করার বদলে সমাজ সংস্কার ও শিক্ষাপ্রসারের স্বার্থে শাসক শ্রেণীর ইতিবাচক ভূমিকার প্রতি বেশি আগ্রহী ছিল। অস্বীকার করার উপায় নেই দেশে ১৮২৯-এ সতীদাহ বেআইনি ঘোষণা থেকে ১৮৫৬-য় বিধবা বিবাহ আইন লাগু, স্ত্রী শিক্ষা প্রসার, বহু বিবাহের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠা ইত্যাদি সামাজিক প্রগতি বাঙালীর নেতৃত্বেই হয়েছে। অন্যদিকে মানভূমে স্থানীয় সামন্ততন্ত্রের সাথে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের দ্বৈরথ কখনই থামেনি।

ভাষা আন্দোলনের সূচনা:

বাঙালী তখন এত আত্মকেন্দ্রিক ছিল না। মধ্যবিত্ত নামে এক শ্রেণী আবার বড্ড সমাজ ও রাজনীতি সচেতন। সেই বাঙালীকে কমজোর করতেই ১৯০৫-এ লর্ড কার্জন বাংলার বিভাজন করেন প্রশাসনিক সুবিধার দোহাই দিয়ে। ১৯০৫ সালের ১৯শে জুলাই সরকারীভাবে ঘোষিত বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব অনুযায়ী ঢাকা, রাজশাহী, চট্টোগ্রাম, মালদহ, পার্বত্য ত্রিপুরা ও আসামকে নিয়ে গঠিত হবে পূর্ববঙ্গ প্রদেশ যার রাজধানী ঢাকা। অবশিষ্ট বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে হবে বাংলা প্রদেশ বা বেঙ্গল প্রভিন্স যার রাজধানী কলকাতা। পরিকল্পনা কার্যকরী হওয়ার কথা ছিল ১৬ই অক্টোবর।

বাংলা জুড়ে মূলত হিন্দু বাঙালীরা প্রবল প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। কারণ পূর্বে মুসলিম ও পশ্চিমে অবাঙালীদের কাছে সংখ্যালঘু হয়ে পড়ার আশঙ্কায় মোটেই অমূলক ছিল না, যদিও বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে কোথাও সেই আশঙ্কার কথা ব্যক্ত হয়নি, বরং জোর পেয়েছে স্বদেশীয়ানা ও হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের বাণী। প্রবল প্রতিবাদের মুখে পড়ে ৬ বছর পরে বৃটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। কিন্তু ১৯১১ সালের ১২ই ডিসেম্বর দিল্লির দরবার উৎসবে সরকারের পক্ষ থেকে পঞ্চম জর্জের ঘোষণা অনুযায়ী বঙ্গভঙ্গ প্রত্যাহৃত হলেও বাংলার বিরুদ্ধে দুটি নিপূণ চক্রান্ত বাস্তবায়িত করা হয়। প্রথমত, কলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লীতে স্থানান্তরিত হল, আর দ্বিতীয়ত, ভাষার ভিত্তিতে বাংলা প্রদেশকে (Bengal Province) দু ভাগ করে গঠিত হল ‘বাংলা’ (পূর্ববঙ্গ সহ) রাজ্য যার রাজধানী কলকাতা এবং ‘বিহার ও উড়িষ্যা’ যার রাজধানী পাটনা। ১৯১২ সালের ১লা এপ্রিল কার্জনের বঙ্গভঙ্গ রদ করে পূর্ব-পশ্চিম বাংলাকে এক করার অছিলায় মানভূম, ধলভূম, রাঁচি, জামশেদপুর, সাঁওতাল পরগণা সহ বিস্তির্ণ বাংলাভাষী বঙ্গসংস্কৃতির অঞ্চল যাদের পরিচিতি ছিল Greater Bengal হিসাবে, তাদের বাংলা থেকে কেটে বিহার-উড়িষ্যা রাজ্যে জুড়ে দেওয়া হয়। এরপর শুরু হল সংগ্রামের আর এক অধ্যায় যা চলেছিল ১৯৫৬ পর্যন্ত।

১৯১২ থেকে শুরু হল মানভূমের (৪১১২ বর্গ মাইল) বাংলাভাষীদের গণ বিক্ষোভ। সরকারকে চিঠি লিখে জানতে চাওয়া হল কারণ। পুরুলিয়ে কোর্টের আইনজীবি রজনীকান্ত সরকার, শরৎচন্দ্র সেন, গুণেন্দ্রনাথ রায় ছিলেন আন্দোলনের পুরোধা। সঙ্গে পেয়েছিলেন কিছু জমিদার, কোলিয়ারির মালিক ও ব্যবসায়ীকেও। এমনকি কিছু বিহারী নেতাও এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন। যৌথ বিবৃতিতে বলা হল –“The whole district oh Manbhum & pargana Dhalbhum of Singbhum district are Bengali speaking and they should go to Bengal”। মানভূম বার অ্যাসোসিয়েশন মানভূমের বঙ্গভূক্তির দাবিতে প্রস্তাব নেয়। বৃটিশ শাসিত ভারত সরকারের প্রধান সেক্রেটারি বিহার ও উড়িষ্যা রাজ্যের গভর্নরের কাছে রিপোর্ট চেয়ে পাঠান। এদিকে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় “The Bengali” পত্রিকায় এর তীব্র প্ররিবাদ জানিয়ে বাংলার সীমানা পুনর্নিধারণের দাবি জানালেও বাংলার অন্যান্য নেতারা সেদিন বুঝতে পারেননি বাংলার অঙ্গহানি হচ্ছে। সেই সময় স্থানীয় বুদ্ধিজীবি ছাড়া আপামর ও বাংলার বাকি অংশের এ বিষয়ে সচেতনতাই ছিল না। এই নিয়ে তথ্যনিষ্ঠ গবেষণার অভাবে সেখানকার অনেক বাঙালী মনে করে তারা তো প্রথম থেকেই বিহারেই ছিল।
বিহারীদের কাছ থেকে যথাযোগ্য মর্যাদা পাবে না ও বিধানসভায় ঠিকমতো প্রতিনিধি পাঠাতে পারবে না – আন্দোলনকারীদের এই আশঙ্কা নব গঠিত বিহার-উড়িষ্যা সরকারের প্রধান সেক্রটারি অমূলক বলে উড়িয়ে দেন। কেন্দ্র সরকারও সিদ্ধান্তে অনড়। মানভূমে বাংলাভাষীদের প্রান্তিক হয়ে পড়ার আশঙ্কা বিহার বা কেন্দ্রীয় প্রশাসন কেউই আমল দেয়নি, বলা যায় ইচ্ছাকৃতভাবেই। প্রধান সেক্রেটারি কড়া ভাষায় লেখেন, “It seems very desirable from all points of view that further discussion on the subject should be discouraged.” ১৮৩৩ সালের Non-regulatory Act XIII অনুযায়ী গঠিত যে মানভূম জেলাকে উনবিংশ শতাব্দীতেই চার বার ভেঙে তিনটি জেলায় ভাগ করা হয়, আর বিংশ শতকে পা দিয়ে তাকে বাংলার অঙ্গ থেকেই ছিন্ন করা হল। ১৯৩৬ সালে পৃথক উড়িষ্যা রাজ্যও তৈরি হল, কিন্তু মানভূমের বাংলায় ফেরা হল না।

জাতীয়তাবাদী ও বাংলাভাষা আন্দোলনের সমান্তরাল গতি:

পরাধীন ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে মানভূমের অংশগ্রহণ বাঙালীর হাত ধরেই। ১৯১২ থেকে ১৯২০ পর্যন্ত মানভূমে জাতীয়তাবাদের লড়াইটা ছিল মূলত পুরুলিয়া বার অ্যাসোসিয়েশন কেন্দ্রিক। ১৯২০ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে মানভূমের কংগ্রেস প্রতিনিধি তথা মানভূম বারের সদস্য রাজনীকান্ত সরকার যোগ দেওয়ার পর থেকে মানভূমে কংগ্রেসের একটা ভিত্তি তৈরি হয়।

১৯২১-এ রাজেন্দ্রপ্রসাদ মানভূম এসে অসহযোগ আন্দোলনের আহ্বান দিতে পেশা জলাঞ্জলি দিয়ে বাঙালী আইনজীবিদের অনেকেই ও অন্যান্য পেশার বাঙালীরা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অতুলচন্দ্র ঘোষ পাঁচ নাবালক সন্তানসহ সপরিবারে গৃহত্যাগ করে গড়ে তোলেন ‘শিল্পাশ্রম’ নামে আশ্রম, যেখানে জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নিবারণ চন্দ্র দাশগুপ্তও সপরিবারে গিয়ে উঠেছিলেন। ১৯৪৭ পর্যন্ত এই শিল্পাশ্রমই মানভূম কংগ্রেসের কর্মশালা তথা কার্যালয় হয়ে ওঠে। ১৯২৫-এর ১২-১৩ সেপ্টম্বর পুরুলিয়া শহরে বিহার কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগ দেন মহাত্মা গান্ধী, রাজেন্দ্রপ্রসাদ সহ একাধিক সর্বভারতীয় নেতা। ঐ বছরই ২১শে ডিসেম্বর কংগ্রেস মুখপত্র ‘মুক্তি’ পত্রিকাও শুরু হয়েছে বাঙালী নিবারণচন্দ্র চক্রবর্তীর সম্পাদনায়। জনতার দানে প্রতিষ্ঠিত হল ‘দেশবন্ধু’ প্রেস। ১৯২৯-এ ‘মুক্তি’ ও তরুণশক্তি’ পত্রিকার বিরুদ্ধে সরকারের মামলায় নিবারণচন্দ্র ও অন্নদাপ্রসাদের জেল হয়। মূলত বাঙালীদের আত্মত্যাগ ও নেতৃত্বেই সংগঠিত ছিল মানভূমে কংগ্রেসের কর্মসূচি ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন।

১৯২৯-এ ঝালদায় গুপ্তঘাতকের কুঠারে মৃত কংগ্রেস কর্মী সত্যকিংকর দত্তকে বলা হয় মানভূমের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম শহীদ। পরের বছর ঝালদাতেই ১৪৪ ধারা জারি হওয়া ‘সত্যমেলা’য় উপস্থিত হ‌ওয়ার অপরাধে পুলিসের গুলিতে মারা যায় পাঁচ জন কুর্মী মাহাত। এই উত্তপ্ত পরিবেশে ১৯৩০-এ গান্ধীজীর ডাণ্ডি অভিযানের প্রভাবে মানভূমেও শুরু হয়ে যায় সত্যাগ্রহ। একে একে ‘মু্ক্তি’ পত্রিকা, ‘দেশবন্ধু প্রেস’, ‘শিল্পাশ্রম’ বাজেয়াপ্ত হল। ১৯৩৫-এ নিবারণচন্দ্রের মৃত্যুর পর অতুলচন্দ্র ঘোষ হলেন জেলা কংগ্রেস সভাপতি এবং নিবারণচন্দ্রের জ্যেষ্ঠপুত্র বিভূতিভূষণ চক্রবর্ত্তী হলেন সম্পাদক।
১৯৩৫-এ চালু প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসনের সুবাদে বিহারে জাতীয় কংগ্রেস প্রদেশ সরকার গঠন করে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে ১৯৩৬ সালে উড়িষ্যা আলাদা হওয়ার পর বাংলাভাষী মানভূম হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিল। খণিজসম্পদে সম্পৃক্ত এই ভূমি। মানভূমে বিহারের আধিপত্য কায়েম রাখতে তড়িঘড়ি তৈরি হল ডাঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদের সভাপতিত্বে “মানভূম বিহারী সমিতি”। পাল্টা প্রস্তুতি নিতে অন্নদাপ্রসাদ চক্রবর্ত্তীর পরামর্শে তৈরি হল “মানভূম বাঙালী সমিতি”। বিহারী সমিতি হিন্দী স্কুল খুলে হিন্দী প্রচারের আয়োজন করলে বাঙালী সমিতিও বাংলা স্কুল খুলে পাল্টা প্রতিযোগিতায় শামিল হল। রাজ্যস্তরেও “বিহার বাঙালী সমিতি” প্রতিষ্ঠিত হল। অর্থাৎ ইংরেজের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পাশাপাশি বাঙালী-বিহারী ভাষা-জাতিগত রেষারেষিও শুরু হয়ে গেল। ১৯৩৮-এ মানভূম কংগ্রেসের রঘুনাথপুর অধিবেশনে মানভূমকে বাংলায় ফেরত আনার বেসরকারি প্রস্তাবও উঠল।

১৯৩৯-এ বিহারে কংগ্রেস সরকার গঠন করলে জনহিতে কিছু উন্নয়নমূলক কাজ হলেও বিহার সরকার বাঙালীদের দমিয়ে রাখতে জারি করল বৈষম্যে ভরা “Domicile Rule” যদিও ‘বিহার বাঙালী সমিতি’র চেষ্টায় অবশ্য সেই কুখ্যাত আইন ক্রমে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এরপর ১৯৪২-এ ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হলে সমগ্র মানভূমেও তার ঢেউ আছড়ে পড়ল। পুলিসের গুলিতে নিহত হন চুনারাম মাহাত ও গোবিন্দ মাহাত। ১৯৪৭ পর্যন্ত বড়সড় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বদলে জেলা কংগ্রেসের উদ্যোগে প্রত্যন্ত গ্রামে সমবায় আন্দোলন, সমাজ সংস্কার ও আদিবাসীদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার ইত্যাদি কর্মসূচি এগোতে লাগল যার মূল উদ্যোক্তা ছিল বাঙালী নেতৃ ও কর্মীবৃন্দ।

কিন্তু ১৯৪৭-এ স্বাধীনতার পর মানভূমের ২২,৭৯,২৫৯ জন মানুষ শাসক হিসাবে কাদের পেল? একের পর এক বিজ্ঞপ্তি জারিতে শুরু হল বাংলাভাষী স্কুল ইনস্পেক্টরকে বদলি, হিন্দীতে সাইনবোর্ড টাঙানো বাধ্যতামূলক করা, বাংলায় বোর্ড লাগানোতে নিষেধাজ্ঞা জারি, বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়গুলির অনুমোদন বাতিল, আদিবাসীদের নিজস্ব চয়ন বাংলার বদলে হিন্দীতে শিক্ষালাভে প্ররোচিত বা কার্যত বাধ্য করা – ইত্যাদি দ্বারা বাংলায় পঠন-পাঠন ও বাংলাভাষী শিক্ষকদের কোণঠাসা করার আয়োজন। সেই সঙ্গে ১৯৪৬-এ প্রণীত ‘জননিরাপত্তা আইন’-এর অজুহাতে সভাসমিতি বন্ধ করে আদতে বাঙালী কংগ্রেসিদের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছিল। অর্থাৎ বিহার কংগ্রেস নিজেরই শাখা সংগঠন মানভূম কংগ্রেস-কে দমানোর প্রচেষ্টায় লেগে পড়ল।

লোকসেবক সঙ্ঘের জন্ম:

বাংলাভাষাভাষীদের ওপর লাগাতার আক্রমণের পরিস্থিতিতে স্থির হয় ১৯৪৮-এর ৩০ এপ্রিলে বান্দোয়ান থানার জিতান গ্রামে অনুষ্ঠিতব্য মানভূম জেলা কংগ্রেসের অধিবেশনে ভাষার প্রসঙ্গটি আলোচিত হবে। ১৯৪৮ সালের ১২ই এপ্রিল ও ১৯শে এপ্রিল সংখ্যার ‘মুক্তি’ পত্রিকায় দেওয়া বিজ্ঞপ্তি থেকে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল অধিবেশনের প্রধান আলোচ্য বিষয় হতে চলেছে ভাষাগত বিবাদের মীমাংসা। প্রসঙ্গত ‘মুক্তি’র সম্পাদক বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত মানভূম জেলা কংগ্রেসেরও সম্পাদক ছিলেন।
আট দফা প্রস্তাবের অন্যতম তৃতীয় প্রস্তাবের মূল বক্তব্য ছিল: বাংলাই মানভূমবাসীর ভাষা এবং এতেই শিক্ষালাভ ও অফিস আদালতের কাজ অব্যাহত থাকুক। কিন্তু জেলায় নানান অপপ্রচার ও অপচেষ্টার দ্বারা ভাষা ও জাতিগত বিদ্বেষের সৃষ্টি, কংগ্রেস কর্মীদের উপর অযথা পীড়ন ও ভীতিপ্রদর্শন এবং কংগ্রেস অনুমোদিত “আদিম জাতি সেবামণ্ডল”কে উপেক্ষা করে নতুন কমিটি গড়ে আদিবাসীদের মধ্যে জাতীয়তাবিরোধী প্রচার চালানোর প্রশাসনিক চেষ্টা চলছে। আবার ১৯৪৬-এ হঠাৎ উদ্ভূদ “জননিরাপত্তা আইন”-এর সুযোগ নিয়ে মানভূমে সমস্ত সভাসমিতি ও অনুষ্ঠানে বাধা দিয়ে প্রতিবাদের রাস্তাও বন্ধ রাখা হচ্ছে।

ধানবাদ থেকে আসা হিন্দীপন্থীদের তীব্র প্রতিক্রিয়ায় ও প্রস্তাবটি দীর্ঘ হওয়ার অজুহাতে তার বিবেচনা স্থগিত করা হয়। এই নিয়ে ভোটাভুটি হলে সেদিন বাংলার সংখ্যাধিক্য প্রমাণ হয়ে যেত। কিন্তু বিষয়টি ২৫শে মে পুরুলিয়ার তেলকলপাড়ার ‘শিল্পাশ্রম’-এ কংগ্রেসের পরবর্তী অধিবেশনে অলোচিত হবে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। জিতান অধিবেশনে অন্যান্য কর্মসূচীগুলি নির্ধারিত দিনে পালিত হলেও ভাষা বিষয়ক মূল প্রস্তাবের আলোচনাই পিছিয়ে যায় ২০ দিন।

কিন্তু চারদিনের মধ্যে ৯ই মে ধানবাদ সাবডিভিশনাল কংগ্রেস কমিটির সভা ডেকে প্রচার করা হয় জিতানে অনুচিৎভাবে মানভূমের ভাষাকে বাংলা ভাষা বলে দাবি করে রাষ্ট্রভাষার বিরোধিতা করা হয়েছে। ফলে মানভূম জেলা কংগ্রেসের সাথে ধানবাদ মহকুমা কমিটির বিরোধ প্রকাশ্যে এসে পড়ল। প্রসঙ্গত মানভূমের দুটি মহকুমার মধ্যে সদর পুরুলিয়ায় বাঙালীরা সংখ্যায় অনেক বেশি (৮৩%) ও ধানবাদে বিহারী কিছু বেশি (৫৯%)।
কিন্তু পরবর্তী ২৫শে মে শিল্পাশ্রমে অনুষ্ঠিত জেলা কার্যকরী কমিটির মিটিং-এ এবং ৩০শে মে জেলা কমিটির সাধারণ অধিবেশনে সভাপতি অতুলচন্দ্রের প্রস্তাব নাটকীয়ভাবে পরাজিত হল। এই অভাবিত পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে সভাপতি অতুলচন্দ্র ঘোষ, সম্পাদক বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত সহ পুরুলিয়া মহকুমার ৩৪ জন এবং ধানবাদের ১ জন সদস্য একযোগে নিজ নিজ পদ ও কংগ্রেস পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন। অনেক অনুরোধ উপরোধেও তাঁরা পদত্যাগ পত্র প্রত্যাহার করলেন না। ঠিক হল পদত্যাগ পত্রগুলো নিয়ে সিদ্ধান্ত ২০শে জুনের শিল্পাশ্রম অধিবেশনে নেওয়া হবে।

পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়তে জনগণ স্বতস্ফূর্তভাবে পুরুলিয়ায় হরতাল পালন করে। শহরের মাড়োয়াড়ি ব্যবসায়ীরা ও সরকারি আধিকারিকরা দোকান অফিস খোলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। তার মধ্যে জেলা কমিটি থেকে আরও তিনজন পদত্যাগ করেন। কংগ্রেসকে জরুরি ভিত্তিতে নতুন সভাপতি ও সম্পাদক নির্বাচন করতে হয়।
এরপর ১৩ই জুন থেকে পুঞ্চা থানার পাকবিড়ায় মানভূম জেলা কংগ্রেস কর্মীদের অধিবেশনে স্থির ছিল। তার দ্বিতীয় দিন ১৪ই জুন প্রায় ৫০০ কংগ্রেসকর্মী ও ১০০০ দর্শককে সাক্ষী রেখে জন্ম নিল একটি নতুন রাজনৈতিক দল – “লোক সেবক সঙ্ঘ”, যার পরিচালক – সভাপতি অতুলচন্দ্র ঘোষ এবং সাতজন সচিব।
বাংলাভাষীদের সঙ্গে বিহার কংগ্রেসের পাকাপাকি দূরত্ব সূচিত হল। অবশ্য যে রাজনৈতিক দলটির গর্ভে এর জন্ম, সেই কংগ্রেসের সঙ্গে নাড়ির যোগ ছিন্ন হয়েছিল ৩০শে মে মানভূম জেলা কংগ্রেসের তেলকলপাড়ার অধিবেশনেই, যেখানে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার তথা পুনর্বিবেচনার অনুরোধ উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত ৪০ জন সদস্য দল ছাড়েন। লোকসেবক সঙ্ঘের জন্ম যেন সেই বিচ্ছেদেই শীলমোহর হয়ে।

নতুন কংগ্রেস কমিটির কাজ হল হিন্দীর প্রচার ও লোকসেবকের কাজে ব্যাগড়া দেওয়া। বাঁধকু্য়ো লাইসেন্স, নগদ বেতন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামীর সার্টিফিকেট নানা টোপ দিয়ে হিন্দীভাষীদের বাংলাভাষীদের চেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রমাণ করা। অন্যদিকে ‘শিল্পাশ্রম’ ও ‘মুক্তি’ পত্রিকা কংগ্রেসের বদলে ‘লোকসেবক সঙ্ঘ’-এর কার্যালয় ও মুখপত্র হয়ে দাঁড়ায়।

পরাধীন ভারতে যেখানে মানভূমের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অভিষেক হয়েছিল বাংলাভাষীদের হাতে, স্বাধীনতার মাত্র আট মাসের মধ্যে তাদেরই ‘লোকসেবক সঙ্ঘ’ নামে আলাদা সংগঠন তৈরি করে কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হয় বাঙালী হিসেবে অস্তিত্ব বজায় রাখার তাগিদে।

বিহার সরকারের দমন নীতি: কংগ্রেস বনাম লোকসেবক সঙ্ঘ

বৃটিশ কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে “প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন” (Provincial Autonomy) লাভ করেই বিহার সরকার বাংলাভাষীর ওপর যেভাবে হিন্দীভাষীদের আধিপত্য চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিল, স্বাধীনতা লাভের পর তা আরো রুদ্ররূপ ধারণ করল। একের পর এক সার্কুলার বা বিজ্ঞপ্তি জারি হতে থাকল, যার মাধ্যমে বাংলাভাষী স্কুল ইনস্পেক্টরকে বদলি, হিন্দীতে সাইনবোর্ড টাঙানো বাধ্যতামূলক করা, বাংলায় বোর্ড লাগানোতে নিষেধাজ্ঞা জারি, বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়গুলির অনুমোদন বাতিল ইত্যাদি দ্বারা বাংলায় পঠন-পাঠন ও বাংলাভাষী শিক্ষকদের কোণঠাসা করার আয়োজন। Bihar Text-Book Committee এযাবৎ পাঠ্যক্রমের সমস্ত বই বাংলা ও হিন্দী দুটো ভাষাতেই ছাপাত। ১৯৪৮-৪৯ সালে প্রথম মাধ্যমিক স্তরে কোনও পাঠ্যপুস্তক বাংলায় ছাপা হল না। জেলার আদিবাসী স্কুল (aboriginal) স্কুলগুলিতে প্রচলিত বাংলা মাধ্যমের বদলে হিন্দীতে পড়ানো, হিন্দীতে সাইনবোর্ড টাঙানো তথা খাতাপত্র লেখা বাধ্যতামূলক করে ১৮.৩.১৯৪৮ তারিখে দুটি সার্কুলার জারি করা হল। অথচ আদিবাসী বিশেষত সাঁওতালরা মুখে সাঁওতালিতে কথা বললেও বাংলাই তাদের শিক্ষালাভের ও লেখার ভাষা।

শিক্ষকদের যোগ্যতা, ছাত্র সংখ্যা কোনটাই খতিয়ে না দেখে ১৯৪৮ সালে প্রায় একশো হিন্দী স্কুলকে অনুমোদন দিয়ে সরকারি সাহায্যের জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল। বিহার জুড়ে তখন এমনটাই রীতি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল যে স্কুলকে সরকারি বোর্ডের অনুমোদন পেতে হলে হিন্দী মাধ্যম হতে হবে এবং দেবনাগরী হরফ চেনা ছাড়া শিক্ষকতার জন্য আর বিশেষ কোনও যোগ্যতা দরকার নেই। অন্যদিকে চলল বাংলাভাষী শিক্ষকদের হ্যানস্থা, বাংলা মাধ্যম সেকশন বন্ধ, বাংলায় সাইনবোর্ড নিয়ে অশান্তি ইত্যাদি দ্বারা প্রবলভাবে বাংলাভাষা দমন। সেই সঙ্গে মানভূম যে বাংলাভাষী নয়, বাঙালীরা যে বহিরাগত, বাঙালী পরিচালিত জেলা ও পৌর প্রশাসন যে আদিবাসীদের অত্যাচার করে বাংলা ভাষা চাপিয়ে দিয়েছে সেটা প্রতিপন্ন করতে উঠে পড়ে লাগল বিহার সরকার।
এভাবে বাংলাকে অকস্মাৎ হিন্দীর মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত করা ডাঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের বাঙালী বিহারী বিতর্ক সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত (Bengali Bihari question, page 3), Bihar Education Code-এর বিধান (Notification no. 1194 E.R., Dt 4th August, 1993), ১৯৪৫-৪৬-এর নির্বাচনী ইস্তেহার তথা অনুযায়ী সংখ্যালঘু শ্রেণী ও বিভিন্ন ভাষাভাষী অঞ্চলের ক্রীষ্টি, ভাষা ও বর্ণমালা রক্ষার প্রতিশ্রুতি, অথবা ১৯৪৮ সালের ১লা মে ভারত ইউনিয়নের ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, স্যার এম. এস. ভাটনগর, ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে গঠিত কমিটির ঘোষণা – এগুলোর কোনওটা দ্বারাই সমর্থিত ছিল না। তাছাড়াও উপেক্ষিত হয়েছিল ১৯৩১-এর করাচি কংগ্রেসের ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের প্রস্তাবও।
বাংলায় শিক্ষাদানের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করার পর সরকারি দপ্তরগুলির চিঠিপত্র ও যাবতীয় নির্দেশবলীও হিন্দীতে লেখা বাধ্যতামূলক করা হল। ১৮ই আগস্ট ১৯৪৮ ধানবাদের সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে এক বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী বাংলায় লেখা দলিল রেজিস্ট্রি হওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়াতে উকিল, দলিল লেখক, সরকারি কর্মচারী থেকে জনসাধারণ সব একযোগে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ১৯৩৭ সালের বিহার রেজিস্ট্রেশন বিধির ১৯ নং ধারা উল্লেখ করে বাংলাভাষী অঞ্চলে রেজিস্ট্রির কাজে বাংলাভাষার বৈধতা প্রমাণ করেন আইনজীবিরা। ২০শে আগস্ট থেকেই বাংলায় লেখা দলিল যথারীতি রেজিস্ট্রি হতে শুরু করে যদিও নতুন নোটিসটি তখনও প্রত্যাহৃত হয়নি।
বাংলা শিক্ষার ওপর কোপের প্রতিবাদের শেষে ১৯৪৯-এর ৯ ফেব্রুয়ারী পুরুলিয়া শহরের একাধিক স্কুলের চার হাজার শিক্ষাকর্মী ও পড়ুয়া বয়কটের ডাক দেয়। ১১ই ফেব্রুয়ারি তো সমগ্র পুরুলিয়া শহর জুড়েই ২৪ ঘণ্টা হরতাল পালিত হয়। পুলিস প্রশাসন দ্বারা আন্দোলন দমনের পাশাপাশি চলতে লাগল Educational Council গঠন করা হয় যার আওতায় একের পর এক হিন্দী স্কুল স্থাপন করে মূলত সাঁওতাল, ভূমিজ, কুর্মী (মাহাত) ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর এলাকায় বাংলাকে হটিয়ে হিন্দী প্রসারের এবং বাংলাভাষী আদিবাসীদের জোর করে হিন্দীভাষী হিসেবে দাগিয়ে দেওয়ার সরকারি উদ্যোগ। ১৯৫১-য় “বিহার সরকারী ভাষা আইন (১৯৫০)” দ্বারা দেবনাগরী অক্ষরে হিন্দীভাষার ব্যবহারকে রাজ্যজুড়ে বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ তীব্রতর হল। অথচ ১৯৫৩ সালের ১লা এপ্রিল স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী বদ্রীনারায়ণ বর্মার লিখিত পরিসংখ্যান জানায় মানভূমের সদর পুরুলিয়ায় বাংলা মাধ্যমে ছাত্রসংখ্যা ৮৩% শতাংশ ও হিন্দী মাধ্যমে ১৭%; আর ধানবাদ মহকুমায় এই অনুপাত যথাক্রমে ৪১% ও ৫৯%। অর্থাৎ ১৯৪৮ থেকে হিন্দী বাধ্যতামূলকভাবে চাপিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও বাংলায় পঠনপাঠনকারী ছেলেমেয়ের সংখ্যা ছিল হিন্দীর চেয়ে অনেক গুণ বেশি।

২১শে মে ১৯৫২ সালে বিহার বিধানসভার এক অধিবেশনে বাদানুবাদ তীব্র হয়। মানভূমের জননেতা অন্নদাপ্রসাদ চক্রবর্ত্তী রাষ্ট্রভাষার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বিগত পাঁচ বছরে কীভাবে জোর করে হিন্দী চাপিয়ে বাংলাভাষীদের দমন করা হচ্ছে, সেই নিয়ে বক্তব্য রাখলে শিক্ষামন্ত্রী বদ্রীনারায়ণ অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করে পাল্টা অভিযোগ করেন বহিরাগত বাঙালীরাই মানভূম সহ সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলিতে এসে স্থানীয় জনতা বিশেষত হরিজনদের ভাষাকে দমন করে বাংলা চাপিয়ে দিয়েছে। ১৯২১-২২ থেকে কংগ্রেসকে নেতৃত্ব দেওয়া অতুলচন্দ্র ঘোষের মতো ব্যক্তিও বহিরাগত ঘোষিত হয়ে গেলেন।
বাংলাভাষীর ওপর হিন্দীর অবদমন চাপিয়ে না দিলে গান্ধীবাদী কংগ্রেস ভেঙে নতুন সংগঠন তৈরি করতে হোত না, আর বঙ্গভুক্তির জন্য ব্যকুলতাও জাগত না। বাংলার সঙ্গে সংযুক্ত থেকে ভাষা ক্রিষ্টিগত ঐতিহ্য রক্ষা ছাড়া তাঁদের আর কোনও রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক উচ্চাভিলাষ ছিল না।

মানভূমের প্রথম সত্যাগ্রহ

বাঙালী নেতারা পদত্যাগের পর যে নতুন কংগ্রেস কমিটি তৈরি হয়েছিল, তার কাজ ছিল গ্রামে গ্রামে ঘুরে হিন্দীর পক্ষে প্রচার চালানো ও নবনির্মিত লোকসেবক সঙ্ঘের সাংগাঠনিক ও বাংলাভাষার অনুকূল প্রচারে ব্যাগড়া দেওয়া। বাঙালী নেতৃবর্গের বিরুদ্ধে মিথ্যে টাকা তছরূপের অভিযোগ দিয়ে অপপ্রচার চলতে লাগল। সেই সঙ্গে হিন্দীতে শিক্ষা নিলে ১০০-১৫০ টাকা মাইনের টোপ এবং হিন্দীর হয়ে প্রচার করলে বাঁধকুয়ো, জলাশয় নির্মাণের প্রতিশ্রুতি, এমনকি স্বাধীনতাসংগ্রামী সংশাপত্র দান – সব চলতে লাগল। লক্ষ্য ছিল সামনে ১৯৫১ সালের জনগণনায় যাতে যেনতেন প্রকারেণ মানভূমে হিন্দীর চেয়ে বাংলাভাষীদের সংখ্যালঘু দেখানো। বিবাহ, শবযাত্রা বা নিছক সাহিত্যসভা ছাড়া জমায়েত নিষেধকারী ‘জননিরাপত্তা আইন, ১৯৪৬’-এর মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল লোকসেবক সঙ্ঘের সম্মেলনগুলো ভেস্তে দেওয়া।
১৯৪৯-র ২৩শে মার্চ লোকসেবক সঙ্ঘের সচিব বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত দিল্লীতে নিখিল ভারতীয় কংগ্রেস কমিটির পার্লামেন্টারি বোর্ডের কাছে ১২ দফা দাবি সমন্বিত একটি অভিযোপত্র জমা দিয়ে উৎপীড়ন বন্ধ করার আবেদন জানান। কিন্তু দু সপ্তাহ পর্যন্ত সদুত্তর না পেয়ে ৬ই এপ্রিল থেকে লোকসংবক সংঘের নেতৃত্বে শুরু হয় “বিহার জন নিরাপত্তা আইন” নামের কালা কানুনের বিরুদ্ধে “মানভূম জনমুক্তি আন্দোলন”। হুড়া, মানবাজার, বরাবাজার বিভিন্ন জায়গায় লোকসেবকের সত্যাগ্রহীদের সভা ভুণ্ডুল, লাঠিপেটা, গাড়ি ভাঙচুর, চোখে লঙ্কাগুঁড়ো দেওয়া, এমন কি সাংবাদিকদের আলকুশিপাতা ঘষা, কলম ক্যামেরা চশমা কেড়ে নেওয়া, উস্কানিমূলক উক্তি – সব রকম অবদমন চলেছিল। মহিলাদেরও ছেড়ে দেওয়া হয়নি। লোকসেবক সঙ্ঘের নাকি ভারতের জাতীয় পতাকা ব্যবহারের অধিকার নেই।
৬ই এপ্রিল থেকে ১৬ই এপ্রিল পর্যন্ত পুরুলিয়া মহকুমার ২১টি থানার মোট ৬৪টি গ্রামে সত্যাগ্রহ পালিত হলে দমন পীড়নের ছবিটা করালতর হয়ে ওঠে। ভাঙাট, মাঝিহিড়া ইত্যাদি গ্রামে সাদা পোশাকের পুলিসের সাথে ভাড়া করা সশস্ত্র গুণ্ডাবাহিনীও নিযুক্ত হয়েছিল। আন্দোলনে সাঁওতালি বা কুর্মী মাহাতদের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও আহত হওয়া প্রমাণ করল তাদের হিন্দীভাষী হিসাবে চালানোর চেষ্টা কতটা মিথ্যাচার।

উত্তপ্ত পরিবেশে এরপর ২৫শে এপ্রিল ১৯৪৯-র বেলা ন’টায় পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিহার প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রজাপতি মিশ্র শিল্পাশ্রমে প্রথমে অতুলচন্দ্র ঘোষ ও পরে অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে দেখা করে মানভূমের পরিসজথিতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন। আলোচনায় স্পষ্ট হয়, মানভূম মূলত বাংলাভাষীই; আর যারা একদা ব্রিটিশ সরকারের চর ছিল তারাই বিহার কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় মানভূমবাসীর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসেছে। এই সূত্রে ১২ দফা দাবিসনদ প্রস্তুত হয়। কিন্তু প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রজাপতি মিশ্র জানালেন, উক্ত ১২ দফা দাবি বিহার প্রদেশ কংগ্রেসকে জানানো হয়নি। প্রত্যাশিতভাবে, তিনি লোকসেবক সঙ্গের ভাষা নিয়ে বাড়াবাড়িকে কটাক্ষ করেন।
দুই সভাপতির দু’দিন ধরে আলোচনাতেও কোনও সমাধানসূত্র বেরিয়ে এল না।

অন্ন-বস্ত্র সংকট ও লোক গণনায় দুর্নীতি: দ্বিতীয় সত্যাগ্রহ
১৯৪৯-এ বর্ষাভাবে খরার ফলে মানভূমের প্রধান ফসল ধান উৎপাদন কমে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দেয়। গণবণ্টনের অব্যবস্থায় সংকট গুরুতর হয়। সরকার চাষীদের সাহায্য করার বদলে ৩০ মণের বেশি ধান সঞ্চয়ে রাখা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তাদের কাছ থেকে জোর করে লেভি আদায় করতে থাকে। এমনকি খাজনা আদায়ের জন্য পুজো-পার্বণের দিনেও ম্যাজিস্ট্রেট ও সশস্ত্র পুলিস দিয়ে কার্যত লুঠতরাজ চালানো হয়। ঘটে চলে অনাহার মৃত্যু। লোকসেবক সংঘের পক্ষ থেকে বিহার ও কেন্দ্রের খাদ্যমন্ত্রী যথাক্রমে অনুগ্রহ নারায়ণ ও কানাইলাল মুন্সীর কাছে আলোচনার জন্য যান অরুণচন্দ্র ঘোষ ও বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত।

খাদ্যের পাশাপাশি দেখা দেয় চূড়ান্ত বস্ত্র সংকট। বাজারে আমদানি কম। চড়া দামে কমজোরি কাপড় পরেই চলছে লজ্জা ও শীত নিবারণ থেকে পৌষ-পার্বণে নতুন জামা গায়ে দেওয়ার নিয়মরক্ষা। ‘ফেয়ার প্রাইস’-এর দোকান থাকলেও প্রচণ্ড ভিড় ও সঙ্গে কালোবাজারির দাপটে চাহিদার চেয়ে যোগান কম। বিহার সরকার নির্বিকার।
তাদের সামনে ১৯৫১-র লোকগণনা যার প্রস্তুতি ১৯৪৮-৪৯ থেকেই। এতদিন সাঁওতাল (সাঁওতাল), ভূমিজ (মুণ্ডারি), বাউরি, বাগদি, মুদি (ওঁরাও) ও মাহাত (কুর্মী)দের ‘আদিম জাতি বিদ্যালয়’ স্থাপন করে বাংলা হটিয়ে হিন্দী শেখানোর চেষ্টা সফল হয়নি। এখন জনগণনার সুযোগে সমম্ত আদিবাসী ও হরিজনদের ‘দ্বিতীয় ভাষা’ হিন্দী হিসেবে নথিকৃত হতে লাগল। পুলিস, ফরেস্টার, বনকর্মী, আদিবাসী ও ওয়েলফেয়ার অফিসার থেকে চৌকিদার, হিন্দী শিক্ষক সকলে মানভূমের জেলা কংগ্রেসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানভূমে যেনতেন প্রকারে হিন্দীভাষীর সংখ্যা গরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লাগল। অতুলচন্দ্র ঘোষ লোকসেবক সঙ্ঘের পক্ষ থেকে এই কারচুপির অভিযোগ জানিয়ে ও প্রতিকার চেয়ে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুকে টেলিগ্রাম করেন। কিন্তু ততদিনে চক্রান্ত অনেকটাই সফল।

১৯৪৯-এর সত্যাগ্রহের পর থেকে বাঙালী বাড়িতে ঢুকে হুজ্জোতি করা আর সেই সঙ্গে হোলিতে বাঙালী বা বাঙালী অধিকৃত দোকান দেখলেই গায়ে নোংরা জল নর্দমার পাঁক ছিটিয়ে অত্যাচার শুরু হল। মেয়েদেরও রেয়াত করা হোত না। আনন্দোৎসব হয়ে গেল বিভীষিকা।
ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাস দ্বারা বাঙালীদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখা, জননিরাপত্তা আইন দ্বারা গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ, সর্বনাশা খাদ্য আইন দ্বারা খাদ্য সংকট সৃষ্টি, লোকগণনায় কারচুপি – এই বহুবিধ অনাচারের প্রতিবাদে লোকসেবক সঙ্ঘ গ্রহণ করল দ্বিতীয় সত্যাগ্রহের কর্মসূচী। ৯ই মার্চ থেকে ৬ই এপ্রিল পুরুলিয়া জুবিলি ময়দানে প্রায় দশ হাজার মানুষের জমায়েত হল এবং সেটা হল ‘বিহার জন নিরাপত্তা আইন’ সজ্ঞানে অমান্য করেই। ক্রমশ অন্যত্রও জনসভা হতে লাগল।

প্রথমে ৯ই মার্চ থেকে ১৮ই মার্চ ও দ্বিতীয় দফায় ১৯শে এপ্রিল থেকে ১১ই মে অব্দি সত্যাগ্রহের যে কর্মসূচি নির্ধারিত হয়, তাতে নেতৃত্বস্থানে ছিলেন বহু অন্ত্যজ ও আদিবাসী। সুতরাং লোকসেবক সঙ্ঘের সঙ্গে মানভূমের জনসাধারণের যোগ নেই এটা প্রমাণের চেষ্টা যেমন ব্যর্থ হতে লাগল, তেমনি বিহার সরকারের অবদমননের পারাও চড়তে লাগল।

২৫শে এপ্রিল বিকেলে জুবিলি ময়দানে কংগ্রেসের ডাকা সভায় বিহার সরকারের খাদ্যমন্ত্রী অনুগ্রহ নারায়ণ সিংহ ও রাজস্বমন্ত্রী কৃষ্ণবল্লভ সহায় বক্তৃতার মিথ্যাভাষণে উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে থেকে প্রতিবাদ ধ্বণিত হতে থাকে। নির্দয় প্রহার দ্বারা তাদের দমন করা হয়। কিন্তু পুরুলিয়া বার অ্যাসোসিয়েশন ২৬ তারিখে ঘটনার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব এনে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, কংগ্রেস সভাপতি ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠালে এবং প্রতিবাদে ২৭ শে এপ্রিল পুরুলিয়ায় হরতাল পালিত হলে, ৩০শে এপ্রিল প্রতিবাদী নেতাদেরকেই অর্থ ছিনতাইয়ের দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়।

পুলিসি নির্যাতনের এই পরিস্থিতির মধ্যে বলরামপুর থানার ২০-২২টি গ্রাম কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বেশ কিছুদিন ধরেই মুক্তাঞ্চল হয়ে গিয়েছিল। সেখানে পুলিস সেখানে গেলে কাউকে ধরার বদলে নিজেরাই বেদম প্রহার খেয়ে আসত। এমনকি রাঁচি থেকে নিয়ে আসা সেনাও ব্যর্থ। ১৯৫০-এ কিছু নেতা অবশ্য ধরা পড়ে। কিন্তু জন নিরাপত্তা আইন, খাদ্য ও বস্ত্র আইনের প্রতিবাদে ৪-৫ বছর ব্যাপী কৃষক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বলরামপুর থানার কানা, আমারু, ডমনতোড়, জোরাডি, হাসপুর ইত্যাদি গ্রামগুলোতে কমিউনিস্ট নেতৃত্ব সেই যে দুর্ভেদ্য ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল, সেটাই আজকের মাওবাদী ভাবধারার সূত্রপাত করেছিল কিনা ভেবে দেখার। আসলে ‘তেভাগা’ আন্দোলনের এই শাখাকে বিহার সরকারের প্রচারে ভাষা আন্দোলন হিসাবে দেখানো হয়। প্রকৃত গবেষণার অভাবে এর ইতিহাসও সামনে আসেনি।

মানভূমের প্রথম সাধারণ নির্বাচন ও লোকসেবক সঙ্ঘ
লাগাতার আন্দোলন এবং দু-দু’বার সত্যাগ্রহের পর ১৯৫২-র সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে ১৯৫১ সালের ১৩ই ডিসেম্বর বিহার সরকার ‘বিহার জননিরাপত্তা আইন’ প্রত্যাহার করে নেয়। স্বাধীন দেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন হল ১৯৫২ সালের ৩রা জানুয়ারি থেকে ২৪শে জানুয়ারি। লোকসেবক সঙ্ঘ ‘ইঞ্জিন’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করল। মানভূম জেলা থেকে মোট ১৮ জন (পুরুলিয়া-১২, ধানবাদ-৬) বিধানসভা প্রার্থী ও ৪ জন (পুরুলিয়া-২, ধানবাদ-২) লোকসভা প্রার্থী নির্বাচিত হতে পারে।

লোকসভায় কংগ্রেস ২টি (ধানবাদ থেকে) ও লোকসেবক সঙ্ঘ ২টি করে আসন পেল। বিধানসভার ১৮টি আসনের মধ্যে লোকসেবক সঙ্ঘ ৭টি, কংগ্রেস ৭টি, জনতা পার্টি ২টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ২টি আসনে বিজয়ী হল। ৬টি সংরক্ষিত আসনের ৩টি সঙ্ঘ, ৩টো কংগ্রেস। অর্ধাৎ প্রধান দুই যুযুধান শিবিরের অবস্থান তুল্যিমুল্যি। ভোটে দক্ষিণ মানভূমে পুরুলিয়া থেকে বান্দোয়ান পর্যন্ত লোকসেবক সঙ্ঘের ব্যাপক সাফল্য বাংলাভাষীদের জনসমর্থন নেই এই অপপ্রচারের যোগ্য জবাব। পরবর্তী ৫ বছর পাটনা বিধানসভায় এই সাত বিধায়ক ও লোকসভায় দুই সাংসদের সৌজন্যেই মানভূমের দাবি দাওয়াগুলো উচ্চারিত হোত।

এই নির্বাচন জয়ের পরেই অন্নদাপ্রসাদ চক্রবর্ত্তীর কুশলী বক্তৃতার পাশাপাশি ভজহরি মাহাতর ভাঙা হিন্দীতে দেওয়া আন্তরিক ভাষণ মানভূমের দাবিকে জনগণের দরবার থেকে কেন্দ্রীয় আইনসভা এমনকি ইওরোপীয় সংবাদপত্র পর্যন্ত পৌঁছে দিল।

১৯৫২ সালের নির্বাচনের পর সংসদে এইসব প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলে দেখা গেল, ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের দাবি মানভূমের একা নয়, দেশের বহু জায়গাতেই অনুরূপ সমস্যা আবিষ্কৃত ও ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠন দ্বারা সমাধানের দাবি ধ্বণিত হতে লাগল। তারপরেও মূলত দেশের অখণ্ডতার দোহাই দিয়ে বিহার ও কেন্দ্রীয় সরকারের অনেক টালবাহানায় অনেক সময় গড়িয়ে যায়। কিন্তু ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য গঠনের দাবি ক্রমশ জোরদার হওয়ায় শেষ পর্যন্ত গঠিত হল ‘সীমা কমিশন’।

ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠনের দাবি
লোকসেবক সঙ্ঘের আন্দোলনের পাশে বাংলার যে নেতারা নিয়মিত দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অতুল্য ঘোষ ছিলেন অন্যতম। ক্রমশ মানভূমবাসীর দাবি দাওয়ার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের একাত্মতা বাড়ল।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যবিধানসভায় প্রস্তাব গ্রহণ:
এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় যাতে বিহারের কাছ থেকে পশ্চিমবঙ্গের দাবি –
“(১) গঙ্গা উপত্যকার মহানন্দা নদীর এপারে পুর্ণিয়া জেলার কিসানগঞ্জ ও সদর মহকুমার অংশবিশেষ। (২) ভাগীরথী উপত্যকায় সাঁওতাল পরগণার রাজমহল, পাকুড়, দুমকা, জামতাড়া, দেওঘর। (৩) দামোদর উপত্যকায় সাঁওতাল পরগণার সদর ও গিরিডি মহকুমা এবং মানভূমের সদর মহকুমার একাংশ। তন্মধ্যে ধানবাদের সাথে বিহারের যোগ রাখিবার জন্য একাংশ বাদ যাইবে। (৪) সুবর্ণরেখা উপত্যকার সিংভূম জেলার ধলভূম মহকুমা এবং মানভূমের সদর মহকুমার অংশ, তন্মধ্যে টাটানগর বাদ যাইবে।”

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় ব্যাখ্যা দেন, “ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ গঠনের নীতিতে ইহা দাবি করা হইতেছে না, উদ্বাস্তু পুনর্বসতি এবং অর্থনৈতিক ও শাসনকার্যের সুবিধার জন্য ঐ সমস্ত এলাকাগুলি দাবি করা হইতেছে।”

ব্যস! এই প্রস্তাবে বিহারে হুলুস্থূল বেধে গেল। দিল্লীতেও কম হল্লা হল না। প্রজাপতি মিশ্র বিধান রায়কে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করে বলেন বিহার সূচ্যগ্র ভূমিও ছাড়িবে না, প্রয়োজনে লড়াই করবে। বিহারের প্রচারমন্ত্রী মহেশ্বর প্রসাদ আবার আবার হুমকি দিলেন, “পশ্চিমবঙ্গ এরূপ দাবি করিলে বিহারে বাংলাভাষীদের জীবন অতিষ্ঠ করিয়া তোলা হইবে”। ২০শে আগস্ট রাঁচিতে বিহার প্রাদেশিক কমিটির অধিবেশনে বলা হল পশ্চিমবঙ্গের দাবির পেছনে “ডাঃ রায়ের রাজনৈতিক মতলব ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য নাই।…..”।

লোকসভায় প্রস্তাব উত্থাপন:
১৯৫২ সালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির তুষার চ্যাটার্জী লোকসভায় ভাষাভিত্তি রাজ্য পুনর্গঠনের প্রস্তাব রাখলে তার পক্ষে বিপক্ষে তুমুল তর্ক হয়। তাঁর সমর্থনে দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন ‘জনসঙ্ঘ’-এর প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। হ্যাঁ, বাঙালীর স্বার্থে সেদিন জাতীয়তা বিরোধী কমিউনিস্ট পার্টির পাশে হিন্দুত্ববাদী জনসঙ্ঘ। বাংলার পক্ষে মত দেন কমরেড এ. কে. গোলাপন, মাদ্রাজের কংগ্রেস নেতা অনন্ত শয়নম্‌ আয়েঙ্গার এঁরাও। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ কৈলাস নাথ ও প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু শ্যামাপ্রসাদের যুক্তি সমর্থন করলেও জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন। ১৯৫২-র ১২ই জুলাই প্রস্তাবটি ১৬১-৭৭ ভোটে অগ্রাহ্য হয়ে যায়।
বাংলা-বিহার চাপান-উতোর
বলা বাহুল্য বিহার মন্ত্রীসভায় বাংলার দাবি নস্যাৎ হয়ে যায়। মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিংহের মতে দার্জিলিং এবং জলপাইগুড়ির সাথে বাংলার অবশিষ্ট অংশের সংযোগের জন্য ভূমিখণ্ডের দাবি নাকি হিটলারের পোলিশ করিডোর দাবির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বরং ভাষাঐক্য ও প্রশাসনিক সুবিধার্থে পশ্চিমবঙ্গ থেকে দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও মালদহের কিছু অংশ এবং দিনাজপুর ও বীরভূমকে কেটে বিহারে জুড়ে দেওয়া হোক। তাছাড়া মানভূমে বাঙালীর অস্তিত্ব থাকলেও বাকি জায়গাগুলোতে বাংলাভাষীর সংখ্যা যৎসামান্য বলে খতিয়ান দেখান ।
২২শে আগস্ট ১৯৫১ ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন পারস্পরিক সৌহার্দ্য রক্ষার তাগিদে ভূমি পুনর্বণ্টন হওয়া উচিত। ১৯৫২-র ২৪ শে আগস্ট বঙ্গীয় প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভার আয়োজিত নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে এক জনসভায় বক্তারা বহিরাগত উস্বাস্তু পুনর্বসন দ্বারা দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যয় থেকে বাঁচানোর খাতিরে পশ্চিমবঙ্গের লাগোয়া কয়েকটি বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল অবিলম্বে পশ্চিমবঙ্গে আনার পক্ষে জোরালো সওয়াল করে বক্তৃতা দেন। তাঁদের সাফাই – মানভূম জেলা, ধলভূম মহকুমা এবং পুর্ণিয়া ও সাঁওতাল পরগণার যে বাংলাভাষী অঞ্চলগুলি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তে বিহারে চলে গিয়েছিল সেইটুকুরই বঙ্গভুক্তি চাওয়া হচ্ছে।

পশ্চিমবাংলার রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি অতুল্য ঘোষও ৩০শে আগস্ট ১৯৫২-তে কলকাতায় বিবৃতি দিয়ে বিহার মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যকে বেদনাদায়ক বলেন। স্মরণ করান, “১৯১২ সালের পর বহু কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির অধিবেশনে বিহারের বহু নেতাই এই অঞ্চলগুলিকে বাংলায় ফিরাইয়া দিবার প্ররিশ্রুতি দিয়াছিলেন।” তাছাড়া স্বাধীনতার চড়া মূল্য দিয়ে বাংলা দু’ভাগ হওয়ায় উদ্বাস্তু সমস্যায় তো পশ্চিমবঙ্গকেই জর্জরিত হতে হচ্ছে; বাস্তুহারা বাঙালীর ধনপ্রাণের মূল্যেই অবশিষ্ট ভারত স্বাধীনতা ভোগ করছে। অন্যদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী যেখানে কোনও রকম তিক্ততা এড়াতে বলেছেন, সেখানে অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে পশ্চিমবঙ্গকে লক্ষ্য করে বিহারের গালাগালি তিন-তিন বার সম্প্রচারিত হয়েছিল।
সেই উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে তেলেগু ভাষাভাষীদের জন্য মাদ্রাজ থেকে পৃথক অন্ধ্র রাজ্য গঠনের দাবিতে অনশনরত কংগ্রেস কর্মী শ্রীরামুলুর মৃত্যু হল। বেঘোরে পড়ে গঠিত হল অন্ধ্র প্রদেশ ১৯৫৩-র ১লা অক্টোবর। বলা যায় ভাষাভিত্তি রাজ্য গঠন দাবির এই প্রথম শহীদের জন্যই মানভূমের দাবি খানিকটা গতি পেল এবং কেন্দ্র সরকার এই নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের কমিশন গঠনের অঙ্গীকার করল। কলকাতাতেও বৈদ্যনাথ ভৌমিক ও সুখেন্দুবিকাশ দাস এবং জীবনকৃষ্ণ খাঁড়া (৪৫ দিন) অনশন শুরু করলে পরিস্থিতির মোকাবিলায় গঠিত হল ‘রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন’।

এখানে লক্ষ্যনীয়, সেই সময় সব রাজনৈতিক দলেই কিছু তদ্‌গত নেতা কর্মী ছিলেন যাঁরা বৃহত্তর জনস্বার্থে সংকীর্ণ রাজনৈতিক অবস্থান ভুলে বিষয়ভিত্তিক জাতিগত একতা দেখিয়েছিলেন, যা পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে একেবারে উধাও। আজ হিন্দুত্ববাদী ও হিন্দীভাষী গোবলয়কে এক করে দেখা হলেও বাঙালী বিদজ্জন বৃত্তে হিন্দুত্ববাদী বলে ব্রাত্য শ্যামাপ্রসাদ কিন্তু আজীবন দেশের সার্বভৌমতার পাশাপাশি বাংলার স্বার্থে নিবেদিত ছিলেন।

রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন:
১৯৫৩-র ২৩শে ডিসেম্বর লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী এই কমিশন গঠনের কথা ঘোষনা করলেন। উড়িষ্যার রাজ্যপাল ফজল আলি, রাজ্যসভার সদস্য পণ্ডিত হৃদয়নাথ কুঞ্জরু ও মিশরের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত সর্দার কে.এস. ভগতকে নিয়ে গঠিত হল কমিশন যার চেয়ারম্যান হলেন সৈয়দ ফজল আলি। ঐতিহাসিক পটভূমি, বর্তমান পরিস্থিতি ও আনুসঙ্গিক বিষয় খতিয়ে দেখে কমিশনকে ১৯৫৫-র জুন মাসের মধ্যে রিপোর্ট পেশ করতে বলা হয়। এরপরেই শুরু লাগাতার ‘টুসু সত্যাগ্রহ’ আর সীমা কমিশনের আতঙ্কে বিহার সরকারের মিথ্যাচার।
তৃতীয় সত্যাগ্রহ: টুসু সত্যাগ্রহ
টুসু পরব আসলে শষ্যোৎসব যাতে পৌষ মাস জুড়ে সন্ধ্যেবেলা গাওয়া হয় টুসুগান। লোকসেবক সঙ্ঘ এই লোকগীতিকেই করে তোলে সত্যাগ্রহী আন্দোলনের হাতিয়ার যা সভা সমিতি ভাষণের চেয়ে দ্রুততর চারিয়ে গেল জনমানসে। শুরু হয়েছিল ১৯৫৪-র ৯ই জানুয়ারি আর শেষ হয় ৮ই ফেব্রুয়ারি। ‘টুসুগানে মানভূম’ বই ছেপে কয়েক লক্ষ কপি বিক্রি হয়ে গেল। “ও বিহারী ভাই, তোরা রাখতে লারবি ডাঙ দ্যাখাঁই” প্রায় মানভূমের জাতীয় সঙ্গীত হয়ে উঠল। সাধারণত অন্তজ শ্রেণির এই পার্বণে বিদগ্ধজনেরাও গান বাঁধতে লাগলেন। সামান্য টুসুগানের ওপরেও বিহার সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করল। কাররুদ্ধ হলেন একাধিক নেতানেত্রী কর্মী নানা রকম সাজানো মিথ্যে অভিযোগে।

নির্বিচারে ৩৩ জন সত্যাগ্রহীর ৬-১২ মাস কারাদণ্ড ও জরিমানায় তীব্র অসন্তোষ জমেছিল। অগ্নিতে ঘৃতাহূতি হল ৭৩ বছর বয়সী ক্রনিক প্লুরিসিতে ভোগা লোকসেবকের বর্ষীয়ান নেতা অতুলচন্দ্র ঘোষের সশ্রম কারাদণ্ডে, সেইসাথে জরিমানায়। একদা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী যাঁর ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা পাওয়ার কথা, তাঁর প্রতি এই নিষ্ঠুরতায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি অতুল্য ঘোষ প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। প্রতিবাদের ঝড় ওঠে সারা দেশেই। বিহার সরকার কোনঠাসা হয়ে যায়। তার মধ্যে ভজহরি মাহাতর কোমরে দড়ি পরিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধেও ওঠে প্রবল প্রতিক্রিয়া। বিহার বিধানসভার ৫ জন সদস্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রতিবাদপত্র পাঠান।

রাজ্য সীমা কমিশন গঠনের প্রতিক্রিয়া:
১৯৫৩-র ডিসেম্বরে সীমা কমিশন গঠিত হওয়ার পর পুরুলিয়ার প্রাক্তন জজ পি. সি. চৌধুরী তার সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। ১৯৫৪-র ২৪শে এপ্রিলের মধ্যে যার যা দাবি দাওয়া আছে পেশ করতে বলা হল। লোকসেবক সঙ্ঘ আন্দোলনের পথ ছেড়ে দাবিপত্র তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং অতিরিক্ত সময় চেয়ে নেয়। সময়সীমা ৩১শে মে পর্যন্ত বাড়ানো হলে লোকসেবক সঙ্ঘ ১২০০ পৃষ্ঠার স্মারকলিপি পেশ করে। সেই সঙ্গে সদর লোকাল বোর্ড, পুরুলিয়া বার অ্যাসোসিয়েশন সহ মানভূম ধলভূমের একাধিক সংগঠন মানভূম ও ধমভূমকে বাংলার অন্তর্ভুক্ত করার দাবি সনদ পেশ করে। এমন কি ধানবাদ জনসাধারণও একই দাবিতে স্মারকলিপি জমা দেয়। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গ সরকার, বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রস কমিটি, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, ভারতীয় হিন্দু মহাসভা, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি, ভারতীয় জনসঙ্ঘ, ভাতীয় প্লান্টার্স অ্যাসোসিয়েশন ইত্যাদি সংগঠনও নিজস্ব রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা সরিয়ে রেখে মানভূম ও ধলভূমের বঙ্গভূক্তির সপক্ষে স্মারকলিপি দেয়।

ওদিকে লোকাল বোর্ড বঙ্গভুক্তির দাবিতে স্মারক পেশ করলেও সরকার জেলা বোর্ডকে তা নাকচ করার জন্য চাপ দিতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের দাবি নাকি অধর্মমূলক (unholi)। রাজস্বমন্ত্রী কৃষ্ণবল্লভ সহায় মানভূম জুড়ে বাংলাবিরোধী জনসভায় ছিল রীতিমতো মারধোর গুণ্ডামির প্ররোচনা দিয়ে বক্তৃতা! প্রতিবাদীরা কখনও প্রহৃত হোত, কখনও সমবেতভাবে সভা ত্যাগ করে চলে যেত।
বিহার সরকার কিছু বিহারীপন্থী বাংলাভাষীকে সঙ্গে নিয়ে বাঙালীদের বিরুদ্ধে কুৎসা ও অপপ্রচারে কোনও ত্রুটি রাখল না। ৭-৯ জুন ১৯৫৪ পুরুলিয়া শহরে বিহার প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সম্মেলনে বাংলার ‘সীমাহীন’ দাবিকে কটাক্ষ করা থেকে জাত তুলে, প্রথা তুলে ইতর গালাগালি কিছুই বাকি রইল না। মানভূমের উন্নয়নে বাঙালীদের অবদান স্বীকার তো দূর, দেশভাগের নির্মম বলি বাংলার প্রতি বিদ্বেষ ছাড়া সহানুভূতির ছিটেটুকু ছিল না। অন্তত সাতজন বাংলাভাষী বক্তাও ছিল এই চক্রান্তে শামিল।

কিন্তু “মানবাজারি বোল রহে হেয় হম বিহার মে রহেঙ্গে”, “মানভূমবাসী বোল রহে হেয় হম বিহার মে রহেঙ্গে” ইত্যাদি প্রচার করেও বিনোদানন্দ ঝা, অজিত সিং দেও, কৃষ্ণবল্লভ সহায়রা জনগণকে ভুল বোঝাতে পারলেন না, উল্টে সম্মুখীন হলেন প্রতিবাদী সভার – হিন্দীভাষীরা জঙ্গল লুঠ করেও ছাড়া পায় ,আর গরীব পাতা কুড়ুনিকে শুকনো ডালপালা-পাতা কুড়োনোর জন্য ফরেস্টারকে ঘুষ দিতে হয়। অভিযোগ তো একটা নয়। কিন্তু সবকটিরই জবাব বাংলাভাষীদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া।

বাংলা বিহার মুখ্যমন্ত্রী বৈঠক:
কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির নির্দেশে বাংলা বিহার সংঘাত মিটিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে ১৯৫৪ সালে দুই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে বৈঠকের পর বিধানচন্দ্র রায় বিস্ময়কর বিবৃতি দেন। বিধানবাবু যিনি ধলভূম মানভূমের বঙ্গভূক্তির জন্য উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের যুক্তিটাও তুলে ধরেছিলেন, তিনি সাধারণ মানুষের খবর না নিয়ে শুধু বিহার মুখ্যমন্ত্রী কৃষ্ণ সিংহের সাথে কথা বলে কীভাবে বিহারে বাংলাভাষা ও বাংলাভাষীর স্বার্থ সুরক্ষিত আছে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন ও সেই বিবৃতও দিয়ে ফেললেন তা অনেককেই হতবাক করে দিয়েছিল। এই বিবৃতি থেকে বিহার স্বাভাবিকভাবেই সুবিধা উসুল করতে চাইছিল। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অতুল্য ঘোষ কিন্তু আগের অবস্থানে থেকেই এর তীব্র বিরোধিতা করেন।

সীমা কমিশন রিপোর্ট ও সাব কমিটি:
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের দুজন সদস্য ডাঃ কুঞ্জরু ও সর্দার পানিকর ১৯৫৫ সালের ২৮শে জানুয়ারি পাটনায় এসে ৩১শে জানুয়ারি পর্যন্ত অবস্থান করেন। সফরসূচীতে ছিল যথাক্রমে পুর্ণিয়া, কিসানগঞ্জ, দুমকা, মানভূমের মাইথন, ধানবাদ, পুরুলিয়া, তারপর রাঁচী, ধলভূমের চাইবাসা, খরসোঁয়া ও শেষে জামশেদপুর। লোকসেবক সঙ্ঘ ছাড়াও পাটনা, মাইথন, পুরুলিয়া ও অন্যত্র বিভিন্ন সংগঠন, নেতা, মন্ত্রীদের সাক্ষ্য খতিয়ে দেখা হয়। পুরুলিয়ায় লোকসেবক সঙ্ঘ প্রতিনিধিরা আলোচনার পর পেশ করেন ১৪০০ পৃষ্ঠার (প্রথমে ১২০০-র সঙ্গে পরে ২০০ পৃষ্ঠা সংযুক্ত হয়ে) বিশদ রিপোর্ট।

সরকারের পক্ষ থেকে সীমা কমিশনের কাছে ভুল তথ্য দিয়ে বাঙালীরা কত ভালো আছে এবং মানভূমের কত উন্নয়ন হচ্ছে, সেই উদ্দেশ্যে বাঙালী ছাড়া মানভূমের বাকি শিক্ষা সাব-ইন্সপেক্টরদের তালিম দেওয়াই ছিল। উৎকল সমাজ ও মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু মানুষকে শিখিয়ে পড়িয়ে বাংলা বিরোধী সাক্ষ্যও দেওয়ানো হল। সঙ্গে বিধান রায়ের দেওয়া ক্লীন চিট তো ছিলই। সরকারি মদতপুষ্ট এক পক্ষ ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠনের প্রস্তাবও দেয়। কয়েক দশক পরে সেই উস্কানি বুমেরাং হয়ে ফিরবে কে ভেবেছিল?

পুরুলিয়ায় সন্ধ্যেবেলা কমিশনের বিনোদনের আসরে যে নাচনি নাচের আয়োজন ছিল, তাতে শিল্পীরা যে হিন্দী জানেই না তা গোপন থাকে না। সাধ্যমতো সাক্ষ্য প্রমাণ, আশপাশের জনজীবন সব খতিয়ে দেখে কমিশন ৬ই ফেব্রুয়ারি মানভূম ত্যাগ করেন। এরপর বিহার মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তি সত্ত্বেও ৭-৮ই ফেব্রুয়ারি বিহারের সীমান্তবর্তী এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন এবং লোকসেবক নেতা অতুলচন্দ্র, বার অ্যাসোসিয়েশন ও সাংবাদিকদের সঙ্গে সাক্ষাত করে যান পশ্চিমবঙ্গের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অতুল্য ঘোষ। এই পরিভ্রমণের অভিজ্ঞতার বিবৃতি ১২ই ফেব্রুয়ারির আনন্দবাজারে প্রকাশিত হলে বাংলাভাষীর ওপর বিহার সরকারের সন্ত্রাসের দৃশ্যটি আর একবার প্রকাশ্যে আসে। অতুল্যবাবুও বাংলা ও বাঙালীর স্বার্থ দেখেছিলেন, রাজনৈতিক শিবির নয়।

কমিশনের আহ্বানে দার্জিলিং-এ লোকসেবকের দুই নেতা বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত ও অরুণচন্দ্র ঘোষের সঙ্গে আলোচনার পর জুলাই মাসে সঙ্ঘের রিপোর্টে সংযুক্ত হয় ৪০০ পাতার সংযোজনী স্মারকলিপিও (supplementary memorandum)। দিল্লীতেও লোকসেবক সঙ্ঘের তৎপরতা বাড়ে।

চতুর্দিকে নানা গুজব। কেউ বলে পশ্চিমবঙ্গ বিহার থেকে অনেকগুলি জেলা পাচ্ছে, অন্যপক্ষ বলে একটিও না। ২১ মাস ধরে নানা দিক খতিয়ে দেখে ১৯৫৫-র ৩০শে সেপ্টেম্বর ১১টা ৩০মিনিটে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন ভারত সরকারের কাছে ৩০০ পৃষ্ঠার রিপোর্ট পেশ করে। রাষ্ট্রপতি ডাঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ, প্রধানমন্ত্রী জোহরলাল নেহেরু ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্থের হাতে তুলে দেওয়া হয় এই রিপোর্ট।

জনসাধারণের কাছে প্রকাশিত হয় ১০ই অক্টোবর। এতে ভারতে কটা রাজ্য হবে ও কিসের ভিত্তিতে তার সুপারিশ ছিল। তখন রাজ্যের সংখ্যা ছিল ২৭টি। ভারতীয় সংবিধানে বাংলা, হিন্দী, মারাঠি, গজরাটি,তামিল, তেলেগু, উর্দু, সংস্কৃত সহ যে ১৪টি ভাষাকে আঞ্চলিক ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া আছে, তার মধ্যে উর্দু ও সংস্কৃতভাষী আলাদা এলাকা নেই বলে বাকি ১২টি ভাষা নিয়ে ১৬টি রাজ্যের সুপারিশ করা হল যার মধ্যে হিন্দীভাষী রাজ্য ৩টি – উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মহাকোশল; তেলেগুভাষী ২টি – অন্ধ্র ও হায়দরাবাদ। ৮টি মারাঠিভাষী জেলা নিয়ে তৈরি হল বিদর্ভ রাজ্য এবং অধিকাংশ মারাঠিভাষী জেলা থাকল বোম্বাই রাজ্যে যার আয়তন কিছুটা বৃদ্ধি পেল। এদিকে মানভূমকে খণ্ডিত করে পুরুলিয়া সদর ও ধানবাদ মহকুমা আলাদা করা হল। পুরুলিয়ায় ছিল ২১টি থানা – বরাভূম, পটমদা, বান্দোয়ান, চাণ্ডিল, ইচাগড়, মানবাজার, কাশীপুর, পুরুলিয়া, বলরামপুর, হুড়া, আড়ষা, পুঞ্চা, ঝালদা, জয়পুর, বাঘমুণ্ডি, চাষ, চন্দকিয়ারি, পাড়া, রঘুনাথপুর, সাঁতুড়ি ও নিতুড়িয়া। আর ধানবাদে ১০টি – নির্সা, চিরকুণ্ডা, টুণ্ডি, গোবিন্দপুর, ঝরিয়া, কেন্দুয়াড়ি, থানবাদ, তোপচাঁচি, বাগমারা ও কাতরাস। কমিশন ধানবাদ মহকুমা এবং লোকগণনায় হিন্দীভাষী বেশি হওয়ায় পুরুলিয়ার চাষ থানা বিহারে রেখে বাকি পুরুলিয়া পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দিল। নতুন বিন্যাসে বিবেচিত হয়েছিল ভূপ্রাকৃতিক কারণও।

পুর্ণিয়া জেলার মহানন্দা নদীর পূর্বভাগে কিসানগঞ্জ মহকুমার প্রায় ৮০০ বর্গমাইল অঞ্চলও বাংলায় থাকবে। ধানবাদ, ধলভূম (বাংলাপ্রধান মেনেও), সাঁওতাল পরগণা, কাছাড়, গোয়ালপাড়া প্রভৃতি মিলিয়ে প্রায় ১৫০০০ বর্গমাইল ভূখণ্ডের ২০ লক্ষ বঙ্গভাষী বাংলার বাইরে বিহারেই থেকে গেল। উড়িয়াপ্রধান হওয়া সত্ত্বেও সেরাইকেলা ও খরসোঁয়াকেও উড়িষ্যার না দিয়ে বিহারেই রাখা হল।

রাজ্য পুনর্গঠন সাব কমিটি:

এই রিপোর্টে মানভূম, বাংলা ও বিহার কেউই খুশি নয়। তার ওপর আবার প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গোবিন্দবল্লভ পন্থ, শিক্ষামন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ ও কংগ্রেস সভাপতি ইউ এন গেধর-কে নিয়ে রাজ্য পুনর্গঠন সাব কমিটি গঠন করে পুরুলিয়ার আরও প্রায় ১৫০০ বর্গমাইল এলাকাকেও বিহারে রাখার সুপারিশ করল। কিন্তু এতে বাংলা ও মানভূমবাসীর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখে সিদ্ধান্ত কার্যকর করা পিছিয়ে গেল।
বাংলা বিহার দুই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাব কমিটির বৈঠকে বিধানচন্দ্রকে অনুরোধ করা হয় টাটা কোম্পানির জলাধার নির্মাণের জন্য বিহারকে কিছু অংশ ছেড়ে দিতে যা কমিশনের সুপারিশে পশ্চিমবঙ্গে যাওয়ার কথা। ডাঃ রায় রাজি হয়ে যাওয়ায় পুরুলিয়া মহকুমারও চাষ, চন্দকিয়ারি, চাণ্ডিল, ইচাগড় ও পটমদা সমেত মোট ১১, ০৮,৭০০ জনসংখ্যার ১৯০৫ বর্গমাইল অঞ্চলের বাঙালীকে হতাশ করে বিহারেই রেখে দেওয়া হল আরও কিছু অংশ। শেষ পর্যন্ত পুরুলিয়া মহকুমারও চাষ, চন্দকিয়ারি, চাণ্ডিল, ইচাগড় ও পটমদা সমেত মোট ১১, ০৮,৭০০ জনসংখ্যার ১৯০৫ বর্গমাইল অঞ্চলের বাঙালীকে হতাশ করে বিহারেই রেখে দেওয়া হল। সদর মানভূমের মাত্র ২৪২৪ বর্গমাইল এলাকা বাংলায় এল যার তৎকালীন জনসংখ্যা ১১,৬৯,৩৫৯। বাকি অর্ধেক ১১,০৯,৯০০ মানুষ যার সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষী বাংলার বাইরে থেকে গেল।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তে বঙ্গচ্যুত মানভূম ৪৪ বছর ধরে দীর্ঘ সংগ্রামে ক্ষতবিক্ষত হয়েও সুবিচার পেল না। যেটুকু জুটেছিল দিল্লী-বিহার আঁতাত তাতেও কোপ বসাতে ছাড়ল না।

রাজ্য সীমা কমিশন ও সাব কমিটির রিপোর্টের প্রতিক্রিয়া: চতুর্থ সত্যাগ্রহ
২০শে ডিসেম্বর ১৯৫৫ মানভূম কেন্দ্রে দুই নির্বাচিত লোকসভা সদস্য ভজহরি মাহাত ও চৈতন মাঝি সীমা কমিশনের রিপোর্ট ও সাব কমিটির খবরদারিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে লোকসভায় বক্তব্য রাখেন। সীমা কমিশনের সুপারিশে জোটা এই অপূর্ণ প্রাপ্তিতেও কোপ পড়ায় মানভূম ১৯৫৬-র ১৫ই জানুয়ারি পৌষ সংক্রান্তিতে আবার টুসু সত্যাগ্রহের রাস্তা নেয়।

মানভূম ও কিসানগঞ্জের ‘বঙ্গালি’ অধিকৃত সামান্য অংশ হারিয়ে ১৭ই জানুয়ারি বিহার সরকারও পাল্টা হরতাল পালন করে। পুলিস ও প্রশাসনের যোগসাজশে যান চলাচল রুখে হরতাল সফল করাতে বন্‌ধ্ সমর্থকদেরকে টাকাও বিলি করা হয়েছিল। প্রশাসনের প্রশ্রয়ে ১৮-৩১ জানুয়ারি গুণ্ডামি, নাশকতা, রেলের তার কাটা ইত্যাদি দ্বারা হিন্দিপন্থীরা জনজীবন বিপর্যস্ত করে রেখেছিল। জয়পুর গ্রামের মানুষ অগত্যা মরিয়া হয়ে ৩১শে জানুয়ারি প্রতিকার চেয়ে প্রধানমন্ত্রী ও পশ্চিবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তারবার্তাও পাঠায়।

ওদিকে পশ্চিমবঙ্গ ও মানভূম ২১ তারিখে একযোগে হরতাল ও অরন্ধন পালন করে। পুরুলিয়ায় ১৪৪ ধারা অমান্য করে একদল লোকসেবক কর্মী ও বলরামপুরে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সত্যাগ্রহ করে একাধিক কর্মীও গ্রেপ্তার হন। রাজনৈতিক ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে ওঠার সত্যিই এক আশ্চর্য উদাহরণ এই ভাষা আন্দোলন। প্রবল দমন সন্ত্রাসেও সত্যাগ্রহীদের দমানো যায়নি। বরং ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করতে হয়।

বাংলা বিহার সংযুক্তিকরণ প্রস্তাব ও প্রতিক্রিয়া
সীমা কমিশনের রিপোর্টে দুই রাজ্যের কেউই সন্তুষ্ট নয় দেখে বাংলা ও বিহারের দুই মুখ্যমন্ত্রী আলোচনা করে যুগ্ম বিবৃতি দিয়ে একটি উদ্বট প্রস্তাব রাখেন। দুই রাজ্যকে সংযুক্ত করে তৈরি হোক নতুন ‘পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার সংযুক্ত প্রদেশ’ যেখানে বাংলা ও হিন্দী দুটি ভাষাই হবে সরকারি ভাষা। এর প্রধান রাজধানী হবে কলকাতা ও দ্বিতীয় রাজধানী পাটনা। রাজ্যটিতে একজন রাজ্যপাল, একটি বিধানসভা, একটি মন্ত্রীসভা ও একটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন থাকবে। হাইকোর্ট ও পঞ্চবার্ষিকি পরিকল্পনা পরিদর্শনের জন্য আঞ্চলিক কাউন্সিল হবে দুটি করে। প্রধান রাজধানী হবে কলকাতা ও দ্বিতীয় রাজধানী পাটনা। আইন-শৃঙ্খলা বিভাগ ও নীতি হবে অভিন্ন।
কিন্তু সারা বাংলাজুড়ে এই একীকরণের বিরুদ্ধে প্রবল বিরোধিতা দেখে বিধান রায় ঘোষণা করেন ১৯৫৬-র এপ্রিল-মে নাগাদ কলকাতা উত্তর-পশ্চিম লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী পরাজিত হলে তিনি সংযুক্তিকরণ প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেবেন। বিহারেও অনেক সংগঠন এই সংযুক্তি প্রস্তাবে অখুশি ছিল।

চলবে