এক ইতিহাসের কথা

0
563

অনির্বাণ বিশ্বাস

( ৪ )

‘ আমি আপনাদের একটি কথাই বলতে চাই , হিন্দুদের মধ্যে সংগঠন আরো জোরালো করতে হবে । হিন্দুদের এক হতে হবে । হাতে শক্ত লাঠি এবং দরকারে আরও অস্ত্র সঙ্গে রাখতে হবে আত্মরক্ষার জন্য । আক্রমনের জন্য নয় । আমাদের বরিষ্ঠ নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় আপনাদের এই বার্তা দিতে বলেছেন । ‘ পুরো বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি পাকিস্তান হবে ‘ এই ধারনার সর্বতো প্রতিরোধ করা হবে । এই তত্ত্বের নায়ক জিন্না এবং সুরাবর্দী । বেঙ্গল প্রভিন্সে মুসলমান সংখ্যা গরিষ্ঠ হলেও এর সমস্ত এলাকায় মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ নয় । প্রায় ৪৫ শতাংশের ওপর জনগন হিন্দু । তারা কোথায় যাবে ? কেন যাবে ? জোর করে তাদের পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করলে এর থেকে বড় প্রহসন আর কিছু হবে না । আমাদের অতীত আমাদের এই শিক্ষা দেয় , মুসলমান শাসনে হিন্দুদের দুর্গতির সীমা থাকে না । তাদের বলপ্রয়োগ করে ধর্মন্তকরন করা হয় , হিন্দু রমনীদের তুলে নিয়ে শ্লীলতাহানী, যৌনদাসী বানানো হয় । হিন্দুদের স্বাধীন ধর্মাচারনে বাধা দেওয়া হয় , ছলে বলে তাদের সম্পত্তি গ্রাস করা হয় । ‘ একবারে এত কথা বলে দেবেন্দ্র চুপ করলেন । উনি কোলকাতা থেকে এসেছেন । হিন্দু মহাসভার কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশে । চারিদিকে ঘুরে উনি এবং ওনার মত অনেকে হিন্দুদের এককাট্টা করার চেষ্টা করছেন । শ্যামাপ্রসাদের কথা সবাইকে বলছেন ।

দেবেন্দ্রর মুখ লাল হয়ে গিয়েছে । ঘরে উপস্থিত মানুষদের মুখের ওপর তাঁর চোখ ঘুরছে ।

‘ কেউ কিছু বলবেন ? ‘ দেবেন্দ্র জানতে চান । ‘ আপনারা নিজেদের সঙ্ঘবদ্ধ শক্তির ওপর আস্থা রাখুন । শিগগিরই শ্যামাপ্রসাদ বাবু আপনাদের এখনে এসে জনসভা করবেন ‘ দেবেন্দ্র জোর দিয়ে বলেন ।

জগদীশপ্রসাদের কাপড়ের গদি আজ সন্ধ্যবেলায় তাড়াতাড়ি বন্ধ করা হয়েছে । বাজারে গদির পেছনে জগদীশপ্রসাদের দুতলা বাড়ি । তার একতলায় একটি ঘরে শহরের কিছু হিন্দু মানুষকে নিয়ে এই জরুরী মিটিং । ঘরে টিমটিমে হলুদ আলো । একটু আস্তে চাপা গলায় কথা হচ্ছে । শহরে সিআইডির লোক সাদা পোষাকে ঘুরছে । এই শহরে এখন সন্ধ্যেবেলাতেই মনে হয় রাত নেমেছে ।

এটু গলা খাকারি দিয়ে জগদীশবাবু বললেন ,

‘ তাহলে হামরা লাঠি যোগার করি । আর …..’

‘ আরও কিছু লাগবে । তরোয়াল ছুড়ি চাকু রাখুন । ‘ দেবেন্দ্র জগদীশবাবুকে থামিয়ে বলেন ।

‘ জোয়ান ছেলে , শক্ত পুরুষ সবাইকে নামতে হবে । বাড়িতে মা বোনেদের হাতে বঁটি দিন ‘ দেবেন্দ্র আরো বলেন ।

ঘরের পেছনদিকে নিশিকান্ত বসে আছেন । বললেন.

‘ এগুলান সব আত্মরক্ষার জন্য ? এইখানকার হিন্দু মুসলমান অধিবাসীরা সবাই সবারে জা্নে চে্নে । অনেকেই আমার রুগী । আমাদের আসল শক্তিতো এই মানুষগুলানই।‘

দেবেন্দ্র উঠে দাঁড়ান । বললেন ,

‘ আপনার বিশ্বাস যেন বজায় থাকে । কিন্তু সেটা হবে না । যে আপনার খুব পরিচিত , সেই আপনার বুকে ছুড়ি বসাবে । না ডাক্তারবাবু ,অবাক হবেন না , ভয়ও পাবেন না । ইতিহাস বলে আপনার ধারনা ভুল !’

মিটিং শেষ হল । সবাই নিঃশব্দে বেরিয়ে যাচ্ছেন । আলাদা আলাদা ভাবে । দেবেন্দ্র বেরিয়ে গেলেন একসঙ্গীকে নিয়ে । আজ রাতেই রংপুর পৌঁছুতে হবে । কাল ওখানে মিটিং আছে ।

নিশিকান্ত বাজারের ভেতর দিয়ে ফিরছেন । দোকানপাট সব প্রায় বন্ধ । ডান দিকে কোনে একটা চায়ের দোকান খোলা । দু তিন জন দাঁড়িয়ে আছে । একটু দূরে রামুর মুদিখানা অর্ধেক খোলা । রামু দোকান বন্ধ করছে । আকাশে একাদশীর চাঁদ । নিশিকান্তে চোখ সয়ে এসেছে । আবছা অন্ধকারে চারদিক বোঝা যাচ্ছে।

পেছন থেকে নিশিকান্তের কাঁধে একটি শক্ত হাত পড়ল ।

‘ নড়বেন না ডাক্তারবাবু । না , মাথা ঘুরাবেন না । যা জানতে চাই জবাব দেন । মিটিং শেষ হইল ?’

নিশিকান্তের হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে । কোন রকমে ভাঙা গলায় বললেন ,

‘ হ্যাঁ , হইছে । আপনে কে ? ‘

‘ সিআইডি । এইসব মিটিংএ আপনি আসেন ক্যান ? খুন হওনের ভয় নাই ? এই সব কইরা কিসু্ হবেনা । সোজা্ বাড়ি যা্ন ‘

নিশিকান্ত হাঁটছেন । ঘামছেন । পায়ে জোর পাচ্ছেন না । মাথা তুলে বাঁ দিকে বন্ধ দোকানের সারির দিকে তাকান । এইতো ‘ সুধা ঔষধালয় ‘ ‘তামাকের দোকান ‘ ‘মিষ্টি ঘর ‘ … অন্ধকার হলেও হালকা চাঁদের আলোয় নাম গুলো পড়া যাচ্ছে । আর একটু গিয়ে বাঁয়ে ঘুরলেই নিশিকান্তের বাড়ির রাস্তা ।

বাঁ দিকে ঘুরতে গিয়ে নিশিকান্ত থমকে যান । আস্তে কথাবর্তার আওয়াজ আসছে । ডানদিকে ছায়ায় মিশে নিশিকান্ত উঁকি দেন । হালকা চাঁদের আলোয় বোঝা যাচ্ছে , তিনজন ছেলে মই নিয়ে বন্ধ দোকানের ওপর সাইন বোর্ডগুলোয় কিছু লিখছে । একটু পরেই পরিস্কার হয় । ওরা দোকান গুলোর নামের নীচে ‘সীতারহাট’ এই লেখার পাশে ‘ বাংলা প্রদেশ ‘ লেখাটি মুছে ‘ পাকিস্তান ‘ লিখছে , আলকাতরা দিয়ে।

‘ এই দিকটা হইসে্ । চল , ঐদিকে ‘সুধা ঔষধালয়’ ‘ মিষ্টি ঘর ‘ এই সব গুলানে লিখি । হালা ,’ পাকিস্তান ‘ বানাইয়াই ছা্ড়ব । আল্লাহু আকবর ‘

ছেলেগুলো এইদিকে মই নিয়ে ঘোরে । নিশিকান্ত অন্য গলিতে ঢোকেন । দৌড়তে থাকেন । নিশিকান্ত দৌড়তে থাকেন এক বুক আতঙ্ক নিয়ে ! নিশিকান্ত তাঁর নিজের ভূমি , নিজের দেশের মানুষদের আর চিনতে পারছেন না !

নিভননা খাবার নিয়ে বসে আছেন । বাইরে অন্ধকারে কেবল ঝিঁ ঝিঁর ডাক । এখনও নিশিকান্ত ফেরেন নি । ইন্দ্রানী খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে । চন্দ্রানীরও খাওয়া হয়ে গেছে , কিন্তু ঘুমায় নি, ও পড়ছে ।

হঠাৎ দুমদুম করে দরজায় ধাক্কা । চমকে নিভননা লাফিয়ে উঠলেন ।

‘ কে ?’

কোন উত্তর নেই । কেবল দুম দাম ধাক্কা । মনে হয় দরজা ভেঙে যাবে ।

নিভাননা রান্নাঘরে গয়ে বঁটিটা হাতে নিয়ে বেরোলেন । দরজার কাছে গিয়ে আবার বললেন,

‘ কে ? কে এসেছে ?’

‘ আমি , আমি .. শিগগিরই খোল ‘ নিশিকান্তের হাঁফানো গলা শোনা যায় ।

নিভাননা তাড়াতাড়ি দরজা খোলেন ।

‘ কি হইসে্ ? কি হইসে্ ?’

ঝড়ের বেগে নিশিকান্ত ভেতরে ঢুকে হাঁপাতে লাগলেন । এরপর দরজা একটু খুলে মুখ বাড়িয়ে গলির মধ্যে দুপাশে দেখলেন । তারপর দরজা লাগালেন । দুটো বড় চেয়ার দরজায় ঠেসে দিলেন ।

সোফায় ধপ করে বসলেন নিশিকান্ত । হাত বাড়িয়ে বললেন ,

‘ একটু জল দিবা সুনু ?’

নিভাননা জলের জগ ও গ্লাস তাড়াতাড়ি আনলেন ।

‘ কি হইসে্ তোমার ? কি হইসে্ কও ?’

নিশিকান্ত ঢকঢক করে আধজগ জল খেলেন । এরপর মাথানিচু করে দুহাতে মুখ ঢেকে বলতে লাগলেন ,

‘ আর এহানে থাকন যাইবো না সুনু ! আর পারতেসি্ না ! চলো আমরা পালায়ে যাই !’

‘ তোমার কি মাথাটা খারাপ হইসে্ ? কি সব আবল তাবোল বলতেসো্ ? বারবার কইছি্ এইসব মিটিংএ যাবা না ! শান্ত হও । চল ভাত খাইয়া একটু ঘুমাও !’

নিশিকান্ত স্ত্রীর হাত ধরে বলেন ,

‘ অরা আমাদের কাউকে ছা্ড়বে না ! কোন হিন্দুরে থাকতে দিবে না সুনু ‘ নিশিকান্তের চোখে জল । ঠোঁট কাপছে । হাত কাপছে । সত্ত্বা কাপছে ।

ভেতরের ঘরের পর্দার আড়াল থেকে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ আসে । চন্দ্রানী আড়ল থেকে সব শুনছিল ।

‘ এই ছ্যামড়ি ! তুই নিচে নামছস ক্যান ? ঘরে যা্ ! তুমি ওঠ । চল ভাত খাবা । আর একটাও কথা কইবা না ‘
নিভাননা কড়া গলায় বললেন ।

এখন তাকে শক্ত হতে হবে ।

( ৫ )

রবিবার নিশিকান্ত কেবল সকালে রুগী দেখেন । বিকেলে ফাঁকা । আজ দুপুরে খাওয়ার পর্ব মিটলে বাইরের বারান্দায় নিশিকান্ত আরাম কেদারায় শুয়ে পড়লেন । আরাম কেদারার বাঁ হাতলে ইন্দ্রানী বসে আছে । তাকে ‘ বাইশ জোয়ান-তেইশ জোয়ানে’র গল্প বলতে হবে । সে ‘নীলকমল-লালকমল’এর গল্পও শুনবে । একটু পরে নিভাননা এসে অর্ধেক বানানো সোয়েটার মোড়ায় বসে আবার বুনতে শুরু করবেন । ভেতরের ঘরে চন্দ্রানী গ্রামাফোনে যূথিকা রায়ের ‘ সাঁঝের তারকা আমি পথ হারায়ে ‘ শুনছে । পূজো এসে গেল ।

‘ বাবু ,বাইশ জোয়ান বলো ‘

‘ ও হ্যাঁ !’ নিশিকান্ত ছোট মেয়ের মাথার চুলে হাত বুলোতে বুলোতে গল্প বলতে থাকেন । ইন্দ্রানী চোখ বড় করে শুনছে । বড় মায়া এই দুই চোখে !

‘ ওঠ ওঠ বাবু ! ঘুমাইতেসো্ ক্যান ? কি সব বলতেসে্ মা দেখ ! বাইশজোয়ানের গল্পে নীলকমল আইল ক্যামনে !’ ইন্দ্রানীর কচি কন্ঠে কিচমিচ শুনে নিশিকান্তের তন্দ্রা ভাঙে । হেসে ফেলেন । মোড়ায় বসে নিভাননাও হাসেন ।

একদিন এমন এক পৃথিবী ছিল । পরাধীন ভারতে বাংলাপ্রদেশে এক মফস্বল শহরে এমন এক সুখী পরিবার ছিল । কেউ গল্প বলত , কেউ গান গাইত , কেউ কপট শাসন করতেন ! তখন আকাশ অনেক নীল ছিল , ফুল ছিল অনেক রঙীন , স্বপ্ন ছিল ছোট কিন্তু উজ্জল । চোখে জল ছিল , কিন্তু অকারণে পড়ত না ।

নিচের দরজা বন্ধ ছিল । খটখট আওয়াজ হচ্ছে ।

‘ আবু হোসেন আইল ‘ নিশিকান্ত বললেন । প্রতি রবিবার এই সময় আবু হোসেন বন্ধুর কাছে গল্প করতে আসেন । চন্দ্রানী ছুটে নিচে গিয়ে দরজা খুলে দিল ।

‘ ভাল আছিস্ মা ?’ আবু হোসেন হাসেন । চন্দ্রানী মাথা নাড়ে । সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আবু হোসেন চন্দ্রানীর হাতে একটি নতুন গ্রামাফোনের রেকর্ড দিলেন ।

‘এইটা কার কাকাবাবু ?’

‘ এক নতুন আর্টিষ্ট আসছে্ । শোন গিয়া । আমি কোলকাতা থিকা আনাইছি ।‘

চন্দ্রানী উজ্জল মুখে রেকর্ডের ওপর কভার পেজ দেখে । লেখা আছে ‘শচীনদেব বর্মন’ ।

‘ বাবা , আবু কাকা এই নতুন রেকর্ড আনছে্ । চালাই ‘ নিশিকান্ত হাসেন । নিভাননা একটি মোড়া এগিয়ে দেন ।

‘ বৌদি , আইজ কি রান্না হইল ?’

‘ মাগুড় মাছের ঝোল ‘

‘ ঐটা আপনে দারুন রাঁধেন ‘ আবু হোসেন হাসেন । নিভাননা রান্নাঘর থেকে একটি বাটিতে মাগুড় মাছের ঝোল নিয়ে এলেন । আবু হোসেন চোখ বুজে চেটে চেটে খেতে থাকেন । মাগুর মাছ খান । এমনটা প্রায়ই হয় এই বাড়িতে ।

‘ দারুন হইছে্ বৌদি ‘

‘ একটু ভাত দিই হোসেন দাদা ?’

‘ না না । একদম না । ‘ ভেতরের ঘর থেকে শচীন দেবের কন্ঠে শোনা যায় ‘ নিশিথে যাইয়ো ফুলোবনে’ । গল্পগাছা চলতে থাকে । কিছুক্ষন পরে আবু হোসেন বললেন,

‘ চল নিশি , নদীর ধারে যা্ই ‘

দুই বন্ধু দুটো সাইকেলে ধরলা নদীর ধারে এসে একটি অশ্বথ গাছের নীচে বসলেন । কথা হচ্ছে । উদ্বেগ বাড়ছে । সন্ধ্যা নামছে । গতকাল একটি ষোল সতের বছরের হিন্দু ছেলেকে পেটানো হয়েছে ।

‘ ছে্লেটা কেমন আসে্ ? ‘

‘ একটু ভাল । অরে মারল ক্যান ?’

‘ জা্নি না । ঐটুকু বাচ্চা্ ! শুনছি্ কিছু্ তবলিগের ছেলে অরে ফ্যালাইয়া বাশ দিয়া মারছে্। ঐ সময় অরা আল্লাহু আকবর কইতেসি্ল ! ভরা দুপুরে বাজারে হইছে্ । সবাই দেখছে্। পরিস্থিতি গরম হইয়া গেসে্ । পুলিশের টহলদারী বাড়ছে্ ! লিফলেট বিলাইয়া হিন্দু মুসলমান সবাইকে সাবধান করছে্ । কিন্তু ওইতে মানুষ আরও ভায় পাইছে্ ‘ আবু হোসেন বলে চুপ করেন ।

‘ নিশি ,মানুষ পাগল হইছে । ঈশ্বর যেরকমই হোন তিনি এমন হানাহানি চা্ন না । এই ভাবে দাঙ্গা বাধাইয়া লুঠপাট, সম্পত্তি গ্রাস ,নারীর ওপর অত্যাচার সব ঈশ্বরের নামে করা হয় ‘ আবু হোসেনের চোখে জল ।

‘ তর কি মনে হয়,সীতারহাটে দাঙ্গা হইব ?’ নিশিকান্ত জানতে চান ।

‘ হয়তো । দেশভাগ স্বাধীনতার আগেই ঘোষনা না করলে সুরাবর্দী , জিন্না রক্তগঙ্গা বয়াইবে ‘

‘ তা হইলে ?’ নিশিকান্ত জানতে চান ।

‘ ঘাবড়াইস না । আমরাও তো আছি্। এক খোদা বক্স , তবলীগ এরাই সবকথা কইবে না ‘ আবু হোসেন নিশিকান্তের হাত ধরেন ।

‘ কি গো দুই বন্ধু , সন্ধ্যা আরতির সময় হইছে্ ! আসবা না ?’ পেছন থেকে আওয়াজ আসে ।

ঠাকুরমশাই । সীতারহাটে সবাই ভাল বাসে । উনি সবাইকে নাম ধরে ডাকেন । নদীর পারে একটি পুরোন রাধামাধবের মন্দির আছে । দুবেলা তার নিত্য সেবা তিনি করেন । দুই বন্ধু উঠে মন্দিরের কাছে গেলেন । রামু মুদী মন্দিরের দেখভাল করে । ও ঘন্টা বাজাচ্ছে । সন্ধ্যা আরতি শুরু হল । আশেপাশের কিছু মানুষ এসে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন । ঘন্টার আওয়াজ ,ধুপ ধূনোর গন্ধে ধোঁয়ায় পরিবেশ অত্যন্ত মনোরম হয়ে উঠেছে ।

আরতি শেষ হল । ঠাকুরমশাই সবাইকে বাতাসা প্রসাদ দিচ্ছেন । নিশিকান্ত , আবুহোসেন তাঁরাও হাত পেতে নিলেন । আজ মানুষের সমাগম অন্য দিনের তুলনায় কম ।

‘ নিশি ,আবু , শহরের অবস্থা ভাল না । তোমরা কেউ কিছু্ করবা না ? এখন মন্দিরে ভক্ত সমাগম কম । ভাল লাগতেছে্ না ‘ ঠাকুরমশাই বললেন ।

‘ আমরা কয়েকজ্ন কমিশনারের কাছে গিছি্লাম । উনি কইলেন , উনি সব জানেন ,উনি দেখবেন ব্যাপারটা । কিন্তু ওনার কথায় আমাগো বিশ্বাস হয় নাই ঠাকুরমশাই ‘ নিশিকান্ত বললেন ।

নিশিকান্ত, আবুহোসেন বাতাসা চিবোচ্ছেন । ঠাকুরমশাইয়ের মুখ বড় বিষন্ন । নদী থেকে ঠান্ডা বাতাস আসছে ।

‘ আমগো বাতাসা দিবেন না ঠাকুরমশাই ?’

নিশিকান্তদের পাশে তিনজন লোক এসে দাঁড়িয়েছে হাত পেতে । ওরা মাথা ঘুরিয়ে আবু হোসেন ও নিশিকান্তকে দেখছে । ঠাকুরমশাই বাতাসা দিলেন ।

‘ তোমাগো তো চিনছি না বাবা ? নতুন আইলা ?’

‘ এইবার রোজ দেখবেন । ম্লেচ্ছরাও পূজার প্রসাদ নেয় ?’ একজন আবু হোসেনের দিকে তাকিয়ে বললে ।

‘ আহা । ভূল করতেসো্ । সবার আগে মানুষ ! ঐসব কথা কও ক্যান ?’ ঠাকুর মশাই বললেন ।

‘ নিশিডাক্তারের বন্ধুভাগ্য বড়ই ভাল ‘ ওরা তিনজনে নিশিকান্ত ও আবু হোসেনের দিকে ঘুরে দাঁড়ায় ।

নিশিকান্ত বিপদের আঁচ পান । আবু হোসেনের হাত ধরে বলেন,

‘ চল, বাড়ি ফিরি ‘

‘ ডাক্তারবাবু , আপনে বাড়ি যা্ন ! আপনের বন্ধুর সাথে আমাগো কাম আসে্ ।‘

একজন এক ঝটকায় নিশিকান্তকে সরিয়ে দেয় । বাকি দুজন আবু হোসেনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে । এল পাথাড়ি মারতে থাকে । আবু হোসেনের চশমা ছিটকে পড়ে । আবুহোসেন মাটিতে পড়ে যান । তাঁকে বলতে শোনা যায় ,

‘ আমারে মারতেছে্ন ক্যান ?’

‘ শালা মোল্লা ! ঐ বাচ্চাটারে তরা মারছিলি ক্যান ? ভাবছিস্ দ্যাশটা তদের বাপের ?’ একজন বাঁশের টুকরো বের করে আবু হোসেনের গোটা শরীরে মারতে থাকে । আবু হোসেনের মুখ রক্তে ভেসে যাচ্ছে ।

নিশিকান্ত লাফিয়ে তিনজনকে সরাতে যান । অসম্ভব ! কিছু না ভাবতে পেরে সোজা বন্ধুর শরীরের ওপর নিজেকে ফেলে দেন । কিছু মার নিশিকান্তের পিঠেও পড়ে ।

‘ শোনেন নিশিডাক্তার ! এইসব মুসলমানের সঙ্গে থাকলে আপনারও এই হাল হবে । হর হর মহাদেও ‘

তিনজন অন্ধকারে দ্রুত মিলিয়ে যায় । চারিদিক নিস্তব্ধ । অল্প আলোয় রক্তাক্ত আবু হোসেন গোঙাতে থাকেন । নিশিকান্ত বন্ধুকে তোলার চেষ্টা করেন । পারছেন না ।

‘ আপনেরা কেউ আসবেন ? একটু সাহায্য করেন !’

কেউ আসে না । মানুষ দুর থেকে ভয়ে দেখছে । ঠাকুরমশাই একটি ঘটিতে জল নিয়ে আসেন । বারবার বলতে থাকেন ,

‘ হে রাধামাধব , এ কি করলা ! হে রাধামাধব !’
আবুহোসেন গোঙাচ্ছেন । নিশিকান্ত উদভ্রান্তের মত এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন ।

‘ কেউ আসেন ! অরে হাসপাতাল নিয়া যাইতে হইব ‘

রামুমুদী একটা ঠেলা গাড়ি নিয়ে আসে । নিশিকান্ত , রামুমুদী , ঠাকুরমশাই ধরাধরি করে ঠেলা গাড়িতে আবু হোসেনকে চাপান।

রামু জোরে গাড়ি চালাচ্ছে । পাশে নিশিকান্ত সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন । ওনার কান্না পাচ্ছে । আবু সাড়া দিচ্ছেন না । নিশিকান্তর সাইকেলের ডায়নামো ঠিক কাজ করছে না । মাঝে মাঝে আলো জ্বলছে না ।

রামু গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে । সামনে দুটি লোক । রাস্তা আটকে ।

‘ কে মারছে্ আবু চাচাকে ? কোন হিন্দুর বাচ্চা ? এই তো নিশিডাক্তার ! দরদ দেখাইতেছে্ ! ভাগ শালা ! আল্লাহু আকবর !’

নিশিকান্তের মুখে একট ঘুঁষি এসে পড়ে । নিশিকান্ত ছিটকে রাস্তার ধারে গড়িয়ে যান । আবছা ভাবে দেখেন ঐ ছেলেগুলো ঠেলাগাড়ি নিয়ে চলে গেল । রামু রাস্তার ওপর পড়ে আছে ।

( ৬ )

তিনদিন হল নিশিকান্ত ঘরে শুয়ে আছেন । বাঁদিকের চোখের নিচে ফুলে কালসিটে হয়েছে । মুখের ভেতর বাঁদিকের ওপরের মারীর একটি দাঁত নড়ছে । শরীরের যন্ত্রণা কমেছে , কিন্তু মনে তুমুল ঝড় বইছে । তিন রাত ঘুম হয়নি । শহরে সবাই জেনে গেছে নিশিডাক্তার , আবু হোসেনের নিগ্রহের খবর । দারোগাবাবু এসে একদিন কথা বলে গেছেন । রামুর পেটে ছুড়ি ঢোকানো হয়েছিল । ওকে রংপুর হাসপাতালে ভর্তী করা হয়েছে ।

‘ এইভাবে না খাওনের কি হইল ? কিসু্ তো খাও ! শরীলে জো্র না থাকলে মনে জো্র থাকে না । শক্ত হও ‘
নিভাননা সুজির বাটি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন । নিশিকান্ত ফ্যালফ্যাল করে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন । এতদিনের জীবন সঙ্গী , তাঁদের দুই কন্যা এই সবার জীবন তাঁর ওপর নির্ভর করছে । তাঁকে শক্ত হতে হবে । নিশিকান্ত দাঁতে দাঁত চাপলেন ! উহুহু ! বাদিকের নড়া দাতে চাপ পড়েছে । ব্যাথা করছে ।

‘ হইল ! কি করতেসো্ ‘ নিভাননা ,স্বামীর মাথায় হাত বুলান । এই কয়দিনে মানুষটার ওপর ভয়ানক ঝড় চলছে , উনি বোঝেন ! ওনার নিজেরই কত রাত ঘুম হয় না । মেয়ে দুটোকে বুকে চেপে শুয়ে থাকেন । তারও চোখে ঘুম নেই !

নিশিকান্ত আস্তে আস্তে সুজি খাচ্ছেন । চন্দ্রানী পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছে ।

‘ কিসু্ হয় নাইরে মা আমার ! একবার কমলা ঝরিয়ার রেকর্ডটা বাজা্ ‘ । চন্দ্রানী ভিতরে গেল ।

‘ বাবু তোমার খুব লাগসে্ ?’ ইন্দ্রানী কাছে এসে বলে । মেয়েটার মুখ শুকিয়ে গেছে এই কয়দিনে ।

‘ না আবুহোসেন ! তুমি ভাইব না ।‘বাইশ জোয়ান- তেইশ জোয়ান’ এর গল্প বলবনি তোমায় আজ ‘ নিশিকান্ত মেয়ের গাল টিপে দেন । ভেতর থেকে কমলা ঝরিয়ার গলায় গজল শোনা যাচ্ছে ‘প্রিয় যেন প্রেম ভুলো না এ মিনতি করি’।

কয়েকদিন রুগী দেখা বন্ধ আছে । রতন সামলাচ্ছে । নিশিকান্ত সাদা টুইডের সার্ট পরে রাস্তায় বেরিয়েছেন । চারদিন পর বেরলেন । রাস্তায় লোকজন অল্প । অনেকেই ঘুরে ঘুরে নিশিডাক্তারকে দেখছে । স্কুলের শিক্ষক হরিবাবুর সঙ্গে দেখা । বললেন ,’ আপনার লাগে নাইতো ডাক্তারবাবু ? সব শুনছি্ ‘ । নিশিকান্ত মাথা নাড়েন । কথা বলতে বলতে হাঁটতে থাকেন । লোকজন সন্ত্রস্ত । সামনে বাড়ির দেওয়ালে পোষ্টার । কয়েকজন দাঁড়িয়ে পড়ছে । নিশিকান্ত মাথা উঁচু করে পড়েন
‘ আগামী ১৬ই আগস্ট দেশজুড়ে পাকিস্তান গঠনের দাবীতে হরতাল । পাকিস্তান আমাদের চাই । ঐ দিন প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস হিসাবে পালন করুন । আল্লাহু আকবর । অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ ‘

হরিবাবু আস্তে বললেন ,’ কি হইবে ডাক্তারবাবু ? ঐদিন কি গোলমাল হইবে ?’

‘এখনই বা কি কম গোলমাল হইতেসে্ । সেদিন আরও বেশী কইরা হবে হয়ত ‘ নিশিকান্ত বলেন ।

একটি বাড়ির সামনে এসে নিশিকান্ত দরজায় ধাক্কান ।

‘ কে ? আসতেসি্ ‘ ভিতর থেকে নারীকন্ঠ আসে ।

দরজা খুললে , নিশিকান্ত ভিতরে ঢুকে দরজা ঠেলে দেন । সামনে এক মহিলা । উনি নিশিকান্তকে দেখেই ‘ভাইজান’ বলে কেঁদে ফেললেন ।

‘ আবু কই ? কাঁইদেন না বোন ‘ । সিতারা চোখ মোছেন ।

নিশিকান্ত আবু হোসেনের পাশে বসে আছেন । চোখ বুজে আবু শুয়ে আছেন । কপালে গালে গলায় স্টিচ । মুখে না কামানো দাড়ি । টিংচার আয়োডিনের দাগ । দান হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে গলায় ঝুলানো । মাথার কাছে অ্যাসপিরিনের বড়ির শিশি । বন্ধুর জন্য নিশিকান্তের বুক হু হু করে । আবু হোসেনের মাথায় হাত বুলান ।

‘ আবু , আমি নিশি ! একটু ভাল আছি্স্ ?’

আবু হোসেন চোখ খোলেন । নিশিকান্তের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন । আস্তে আস্তে বন্ধুর মুখে হাত বুলান ।

‘ তর মুখ ফুইলা আসে্ । খুব লাগসে্ ?’ আবুর চোখে জল ।

দুই বন্ধু পরস্পরের হাত শক্ত করে ধরে থাকেন । সিতারা জানালেন , সেদিন রাতে তবলিগের ছেলেরা আবুকে পল্টনের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় । উনিই সব চিকিৎসা করেন । কোথাও সে রকম ভাঙে নি । তবে অনেক জায়গায় রক্ত জমেছে ।

সিতারা চা নিয়ে আসেন । আবু ঘাড়ের নিচে বালিশ দিয়ে আস্তে আস্তে মাথা উঁচু করে বসেন । দুই বন্ধুর চা খেতে খেতে কথা হয় ।

‘ পোষ্টার দিছে্ শুনলাম , দেখছস্ ?’

‘ হ । ১৬ই আগস্ট হরতাল ..’
‘ জা্নি । সঙ্গে ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে ‘ আবু বলেন । ‘ এই জিন্না হইল শয়তান । ক্ষমতার স্বপ্ন দেখতাসে্ । আমাগো গান্ধী ক্যানে চুপ , আমি বুজি্ না । সুভাষ বোস থাইকলে এইসব হইতো না ‘ আবু এক নিঃশ্বাসে বলেন ।

‘ আবু , আমি কাইল পরশু কইরা কুচ্বিহার যা্ব । সেইদিন না পারলেও পরদিন ফিরব । তরে কয়া গেলাম ‘

‘ ক্যান যা্বি ? ক্যান ? সত্যি কইরা ক ‘ আবু ভ্রু কুঁচকে বলেন । নিশিকান্ত চুপ করে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকেন ।

‘ আমি বুজি না কিছু্ ভাবিস্ ? আমরা জানোয়ার ? আমরাও তকে ,তদেরকে মারব ? ঘর ছাড়া করব ? ‘ আবু হোসেন উত্তেজিত হয়ে পড়েন ।

নিশিকান্ত মাথা নিচু করে থাকেন । এতদিনের বন্ধুকেও বলতে পারছেন না ।

‘ তুই কোথাও যা্বি না নিশি । এই কয়া দিলাম ‘ আবু বলেন ।

নিশিকান্ত আবুহোসেনের বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন । পেছন থেকে সিতারা বললেন ,

‘ আপনের জন্য আমার স্বামী বাঁচছে্ ভাইজান । আমি ভুলব না কখনও । এই সময় আমি আল্লার কাছে্ ওর সঙ্গে আপনের জন্যও দোয়া করছি । কোথাও যাইয়েন না ভাইজান । আমরা সবাই মিলে মিশে থাকব , যেমন আছি্ । এইবার পূজায় দিদির হাতের নাড়ু , তক্তি মুড়কি খাইব না ? সত্যি বলেন ‘ সিতারা আর বলতে পারেন না । হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেন ।

নিশিকান্ত ঘুরে সিতারার মাথায় একটু হাত রেখে বেরিয়ে পড়লেন ।

নিশিকান্ত বাড়ি ফিরছেন । পেছনে অনেক মানুষের আওয়াজ । ১৬ই আগস্ট হরতালের সমর্থনে মিছিল আসছে । ‘ লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান ‘ ‘ ১৬ই আগস্ট হরতাল সমর্থন করুন ‘ ‘আল্লা হু আকবর ‘ শ্লোগানে চারিদিক মুখর । নিশিকান্ত একটু রাস্তার কোন ঘেষে দাঁড়ান । মিছিলটা পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ।
মিছিলের শেষ থেকে খোদা বক্স নিশিকান্তের পাশে এসে দাড়ালো ।

‘ ভাবলেন কিছু্ ডাক্তারবাবু ? পাঁচ হাজার দাম দিসিলাম । এখন আড়াই হাজার বলতেসি্ ‘

নিশিকান্ত চুপকরে থাকেন ।

‘ এর পরে এই দামও কেউ দিবে না ‘ খোদা বক্স খিক খিক করে হাসতে হাসতে চলে গেল ।

রাত অনেক । নিশিকান্ত ও নিভাননা বাইরের বারান্দায় আলো নিভিয়ে বসে আছেন ।

‘ কিসের লগে কুচ্বিহার যাবা ? কবে ফিরবা ?’

‘ আইসা কবো । কাইল রাতে না পারলে পরশু দুপুরে । রতনকে থাকতে কইছি্ কাল ।‘ নিশিকান্তের কথা শেষ হয় না ।

দূরে মাঠের ওপারে মসজিদের একটু দূরে দুই তিনটে বাড়িতে আগুন জ্বলছে । অন্ধকার রাতে লক লক করছে আগুনের শিখা । মানুষের চিৎকার । এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে অনেক মানুষ ছোটা ছুটি করছে । নিশিকান্ত নিভাননা শক্ত করে পরস্পরের হাত ধরে দাঁড়িয়ে পড়েন। পরিস্কার শোনা যাচ্ছে ,

‘ নারায়ে তাকবীর , আল্লাহু আকবর ‘

( ৭ )

নিশিকান্ত ঘরের বাইরে এলেন । পেছনে নিভাননা । ভোরের আলো গোলাপ গাছগুলোর ওপর পড়েছে । নিশিকান্ত গোলাপ ফুলগুলোর ওপর তাকান । অযত্নের ছাপ স্পষ্ট । কতদিন গাছগুলোর যত্ন নেওয়া হয় না !

গতরাতে দুজনে চোখের পাতা এক করতে পারেনি । মসজিদের পাশের সব বাড়িগুলোর ছাই হওয়া ওনারা দেখেছেন । মানুষের আর্তনাদ , ধর্মীয় হুঙ্কার মাঝ রাতের পর থেমে গেছে ।

‘ আমার ভয় করতেসে্ । আইজ্ না গেলেই হইত !’ নিভাননা বলেন ।

‘ তুমি অত ভাইব না সুনু ! পুলিশ ব্যবস্থা নিসে্ । নইলে মাঝ্ রাইতে সব থামে না ! আইজ যাওনের খুব দরকার ! না হইলে পরে আর যাইতে পারুম না । এখনি রতন আইসবে । আমি আইজ সন্ধ্যায় না হইলে কাইল দুপুরের মধ্যে ফিরব ‘

নিশিকান্ত সদর দরজা খুলে রাস্তায় পা দিলেন । দরজা টেনে বন্ধ করতে গিয়ে চোখে পড়ল ,দরজায় হরতালের পোষ্টার লাগানো আছে ! ‘ ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে ‘ নিশিকান্ত বিড়বিড় করেন । একটু হেঁটে গলির মুখে পৌঁছে দেখেন , থানার দারোগা সুখেন বাবু ঘোড়ায় বসে টহল দিচ্ছেন । পেছনে চার জন পুলিশ ।

‘ সাত সকালে কই যা্ন ডাক্তারবাবু ?’ সুখেন দারোগা জিজ্ঞেস করেন ।

‘ কুচ্বিহার । একটু কাইজ্ আছে্ ‘

‘ কাল রাইতে শহরে বেশ গোলমাল হইছে্ । টের পাইছে্ন কি না জানি না । কমিশনার সাহেব ১৪৪ ধারা জা্রি করতে কইছে্ন । এখন শহরে ১৪৪ ধারা চলতেসে্ । এখুনি মাইকিং হবে । এই অবস্থায় পরিবার ছাইড়া যাওনের খুব দরকার ? কি ভাবে যা্ইবেন ?’ সুখেন দারোগা জানতে চান ।

‘ হ । কাল রাতে মসজিদের পাশের বাড়িগুলানে আগুন জ্বলতে দেখছি্ । কিন্তু আমার যাওনের খুব দরকার দারোগাবাবু ! আমি ধরলা পার হইয়া কুচ্বিহারে যা্ব ‘

সুখেন দারোগা ঘোড়াটিকে নিশিকান্তের সামনে আনলেন । তারপর একটু মাথা ঝুঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ,

‘ সাবধানে যা্ন । আইজই ফেরার চেষ্টা করেন । অবস্থা ভাল না । ভায়োলেন্ট মবএর সামনে পুলিশ কিছু্ করতে পারে না । দরকার হইলে কার্ফু জা্রি হবে । আপনারা কি চইলা যাবেন সীতারহাট ছাইড়া ? কোথায় , কুচ্বিহারে ?’

নিশিকান্ত সুখেন দারোগার চোখের দিকে তাকান । ভদ্রলোকের কঠিন মুখের মধ্যে ভীষন নরম চোখের দৃষ্টি ! নিশিকান্ত কিছু বলতে পারেন না । মাথা নামিয়ে ঢোঁক গেলেন । তাড়াতাড়ি ধরলা নদীর খেয়াঘাটের দিকে হাঁটতে থাকেন নিশিকান্ত । মনে একরাশ উদ্বেগ । পেছনে শোনা যাচ্ছে ১৪৪ ধারা ঘোষনার মাইকিং । এইদিকের রাস্তা ফাঁকা । ডানদিকে একটু দূরে মাঠের ওপর কালকের পোড়া বাড়ি গুলো দেখা যাচ্ছে । পোড়া বাড়িগুলো থেকে এখনও ধোঁয়া উঠছে । দুজন বন্দুকধারী পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে । নিশিকান্ত দাঁড়িয়ে পড়েন । একটি বাচ্চা একটি আধপোড়া উলঙ্গ শরীরের ওপর মাথা রেখে ‘মা মা’ বলে কাঁদছে । একটু দূরে একটি রক্তাক্ত পুরুষের দেহ পড়ে আছে ।

নিশিকান্ত আর থাকতে পারলেন না । মুখ ঘুরিয়ে ধরলার খেয়াঘাটের দিকে দৌড়তে লাগলেন !

নিদারিয়া মসজিদে জোহরের নামাজ পড়া হয়ে গিয়েছে । আজ লোক কম । ইমাম সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলেন । মুয়াজ্জিন কাছে আসে । মাথা নিচু করে জানায় কয়েকজন দেখা করবে ।

ইমাম সাহেব মসজিদের বাইরে আসেন। কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে । হাতে লাঠি । কোমড়ে পিছনে তরোয়াল ছুড়ি আছে , ইমাম সাহেব বুঝতে পারেন । সামনের মাটিতে ছড়ানো টিনের সুটকেস , কাপড়ের পুঁটলি , জামা কাপড় ,হাড়ি বাসন ।

‘ এগুলান কি লুটের মাল ? এখানে এই সব ক্যান ?’ ইমাম সাহেব জানতে চান ।

‘ অমন কইবেন না ইমাম সাহেব । কেয়ামতের দিন আসছে । এগুলা মসজিদের ভেতরে রাখব । আমার নাম জামাল , তবলিগের লোক ‘

‘ মরা মানুষ কই ? গনিমতের মাল নারী কই ? এই সবও তো রাখতে হইবে ‘

‘ ঝামেলা করবেন না ইমাম সাহেব । যা হইতেছে , ইসলামের মতে । এই সব রাখব এইখানে । কাল আবার এমন মাল আসবে ‘ জামাল গর্জায় ।

সপাটে জামালের গালে ইমাম সাহেবের থাপ্পড় এসে পরে । জামাল ছিটকে পড়ে । এক লাফে উঠে পেছন থেকে ছুড়ি বের করে ।

‘ শয়তান সব । ধর্মের নামে পাপ কর , আবার ঢাল কর আল্লাকে । তোদের দোজখেও জায়গা হবে না । ভাগ ইখান থিকা ‘ ইমাম সাহেব উত্তেজনায় কাঁপতে থাকেন ।

‘ জামাল, এই হারামি প্রথম থিকাই আমাদের ব্যাগরা দিতেসে্ ‘ জামালের সঙ্গীদের একজন উস্কায় ।

জামাল ছুড়ি নাচায় । একলাফে ইমামের সামনে আসে । মুয়াজ্জিন দৌড়ে ইমাম সাহেবের সামনে আসে । শুরু হয় ধস্তাধস্তি । জামালের সঙ্গীরা মুয়াজ্জিনকে টেনে হিঁচরে সরায় । জামালের চোখে হত্যার জিঘাংসা ।
জামাল ইমাম সাহেবের পেটে ছুড়ি ঢোকায় ।

‘ আল্লাহ ‘ বলে ইমাম সাহেব মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ।

সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত নেমে এলো । নিভাননা ঘর বার করছেন । নিশিকান্ত ফেরেন নি । রতন উঠে এসে বলে ,

‘ আপনারা মা ঠাকরুন , খাইয়ে শুয়ে পড়েন । উপরে লাইট জ্বালাইবেন না । আমি নিচে দরজা বন্ধ কইরা আছি্ । অত ভাবনার কিছু্ নাই । ১৪৪ ধারা চলতেসে্ । পুলিশ টহল দিতেসে্ । ভয় নাই ‘

নিভাননা দুই মেয়েকে নিয়ে বিছানায় বসে আছেন । রাত্রি আটটা এখন । খাওয়া হয়ে গেছে ।

‘ মা , বাবা ফিরবে না আইজ, তা হইলে ?’ চন্দ্রানী জানতে চায় ।

‘ না , মনে হয় । কাইল দুপুরে আসবে তা হইলে ‘ নিভাননা বলেন ।

‘ মা , ঘুম পায় না ‘ ইন্দ্রানী বলে ।

‘ চোখ বন্ধ কইরা শুইয়া থাক ‘ নিভাননা ধমক দেন ।

হঠাৎ বাড়ির সামনে গলির মধ্যে দৌড়াদৌড়ির আওয়াজ । চিৎকার । ‘ বাঁচাও বাঁচাও ‘ । নিভাননারা দৌড়ে বারান্দায় আসেন । বাইরের দরজায় দড়াম দড়াম ধাক্কা । ‘ বাঁচাও বাঁচাও ‘

নিচ থেকে রতন বলে ,

‘ আপনারা ভিতরে যান মা জননী । কে তুমি ? কি হইছে ?’

‘ আমি ডাক্তারবাবুর রুগী । মুর্শেদ মাষ্টার । নামাজ পইড়া ফিরতেসি্লাম । আমারে কিছু্ লোক তাড়া করছে । মারবে । দরজা খোলেন, বাঁচান ‘ বাইরে থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে একজন বলেন ।

‘ দরজা খুইল্যা দাও ‘ নিভাননা বলেন ।

‘ মা জননী, আপনে ভেতরে যা্ন ‘

দরজা খোলা হয়না । ধুপ ধাপ আওয়াজ গলিতে বাড়ে । দরজার সামনে পৌঁছায় । নিভাননা শুনতে পান ,

‘ আমারে ছাইড়া দাও । আমি কিসু্ করি নাই ‘

‘ হর হর মহাদেও ‘ এই আওয়াজের সঙ্গে এক আর্তনাদ নিভাননা শুনতে পান ।

‘ আল্লাহ ‘

নিভাননা মেয়েদের নিয়ে ঘরে ঢোকেন । উনি কাঁপছেন । ঘরে ঢোকার সময় নিভাননা দেখতে পেয়েছেন বাঁদিকের আসমাদের একচালা কাঠের বাড়িতে আগুন জ্বলছে । অনেক মানুষ চিৎকার করছে।

( ৮ )

‘ মা জননী , ঘুমায়ে আছে্ন ? উঠবেন ?’ রতন ঘরের বাইরে থেকে বলে ।

নিভাননা ধরমর করে লাফিয়ে ওঠেন । ভোরের দিকে তন্দ্রা এসে গিয়েছিল । সারারাত নিভাননা দুই মেয়েকে বুকে চেঁপে অন্ধকারে বিছানায় বসেছিলেন আর থরথর করে কাঁপছিলেন । চন্দ্রানী কাঁদছিল । ইন্দ্রানী মাকে আঁকড়ে ধরে থেকে থেকে প্রশ্ন করছিল ,

‘ মা , বাবু কেন আসতেসে্ না ? কখন আসবে ?’

নিভাননার কোন উত্তর ছিল না। কেবল তুমুল আতঙ্কে মেয়েদের জড়িয়ে বসে থেকে শুনছিলেন মানুষের আর্তনাদ , জানালা দিয়ে দেখছিলেন দূরে আকাশে আগুনের শিখা । শুনতে পাচ্ছিলেন ‘ নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর ‘ ‘হর হর মহাদেও ‘

ভোর হয়েছে । নিভাননা বললেন ,

‘ হ্যাঁ রতন, ক ‘

‘ নিচে দারোগাবাবু আইছে । আপনেরে একবার যাইতে কইছে্ । ‘ রতন জানায় ।

নিভাননা শক্ত মহিলা । চোখে মুখে জল দিয়ে নিচে নামলেন । বাইরের দরজা খোলা । দুজন পুলিশ মাথা নিচু করে কি যেন করছে । দরজার কাছে গিয়ে মাথায় আঁচল টেনে বললেন ,

‘ বলেন দারোগা বাবু ‘

একটি ঘোড়া আস্তে আস্তে গলির মধ্য থেকে দরজার কাছে এল। সুখেন দারোগা । বললেন ,

‘ কি আর কই দিদি ! কাইল সারারাত শহরে তান্ডব হইছে্ । ইমাম সাহেবকে তবলিগের ছেলেরা পেটে ছুড়ি ঢুকাইছে্ । মুয়াজ্জিন দেখসে্ । বেশ কিছু গরীব হিন্দু মুসলমানের বাড়িতে আগুন দেওয়া হইছে । বেশকিছু মহিলা বাচ্চার খবর নাই । এর মইধ্যে আপনের বাড়ির সামনে খুন হইছে্ । ঐজন্য আপনেরে ডাকছি । চে্নেন এঁরে ?’

নিভাননা আঁচলের ফাঁক দিয়ে দেখেন একটি মানুষ চোখ বড় করে চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন । মুখে দাড়ি । বুকের মধ্যে একটি ছোরা ঢোকানো । বুক রক্তে ভিজে গেছে । মানুষটির মুখ একটু হাঁ করা । মুখের চারপাশে মাছি উড়ছে ।

‘ না চিনি না । তবে রতন কাইল রাতে শুনছিল ..’

‘ আমি রতনের কাছ থিকা সব শুনছি । ও ডাক্তারবাবুর রুগী মুর্শেদ । কাইল রাতে তাড়া খাইয়া আপনাদের ঘরে ঢুকতে চা্ই ছিল ‘

‘ অনারে ঢুকায় নিলে হয়তো বাঁইচা যাইতেন ‘ নিভাননা কেঁদে ফেলেন ।

‘ বাড়িতে ডাক্তারবাবু নাই । ভুল কিছু করেন নাই । ঐ ভয়ঙ্কর জনতা আপনেদেরও শেষ কইরা দিত হয়তো । রতন, জল ঢাইলে জায়গাটা পরিস্কার কর। আমরা লাশ নিয়া যাইতেছি্ । আরেকটা কথা , শহরে এখন আটচল্লিশ ঘন্টার কার্ফিউ । সুট অ্যাট সাইট অর্ডার আসে্ । কেউ বাইরাইয়েন না । ডাক্তারবাবুতো ফেরে নাই ! সাবধান ‘ সুখেন দারোগা চলে যায় ।

মাথা ঘুড়ছে নিভাননার । টলতে টলতে একতলায় সিঁড়ির পাশে ধপ করে বসে পড়েন ।

এগারোটা বাজে , বারোটা বাজে । চড়া দুপুর এখন । সীতারহাট শহরের আকাশে কিছু কাক আর শকুন উড়ছে । মাঝে মাঝে পুলিশের গাড়ি হুঁশিয়ারী দিয়ে গলিতে রাজপথে ঘুরছে । নিশিকান্ত এখনও ফেরেন নি । আচ্ছা , আচ্ছা কাল রাতে ফিরতে গিয়ে যদি মুসলমানদের হাতে পড়েন ? নিভননা আর ভাবতে পারছেন না । মেয়েদুটো রুটি তরকারী খাচ্ছে , খেতে পারছে না , তবুও খাচ্ছে । রতন নিচে ভাবলেশহীন মুখে বসে আছে । নিভাননা একবার ঘর একবার বাড় একবার ঠাকুড়ঘর করছেন ।

সুখেন দারোগা উপদ্রুত এলাকায় টহল দিচ্ছেন । সঙ্গে কনেষ্টবল সাবির । এই পাড়ায় অনেকগুলো বাড়ি পুড়েছে । এটা হিন্দু অধ্যূষিত পাড়া । ধোঁয়া উড়ছে অনেক বাড়ি থেকে । লুটপাটের চিহ্ন চারিদিকে । দুটো আধপোড়া লাশের সন্ধান পেলন । সুখেন দারোগা বিহ্বল । সাবির বলে ,

‘ আর দেহন যাইতেছে্ না স্যার ‘ সাবিরের গলা ভেঙ্গে আসে ।

‘ এই জন্যই তরে কইছিলাম তুই সাহিত্যের ছেলে , পুলিশে আসিস না । শুনিস নাই । আরও অনেক কিছু সামনের দিনগুলায় দেখতে হবে সাবির । রেডি হ ‘ সুখেন দারোগা বলেন ।

সামনের আধপোড়া বাড়ির ভেতর থেকে একটা ঝটাপটির আওয়াজ পাওয়া যায় । সুখেন দারোগা রিভলবার বের করে ঘোড়া থেকে নামেন । পেছনে কনেষ্টবল সাবিরের হাতে পুলিশি লাঠি । দুজনে আস্তে আস্তে এগোন । বাঁদিকে একটি ধানের মড়াই । ওখান থেকে গোঁগোঁ আওয়াজ আসছে । সুখেন সাবির ঝাঁপিয়ে মড়াইয়ে খুঁজতে থাকেন ।

‘ মাইরো না ! আমাগো মাইরো না ‘ বলে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে এক মাঝ বয়সী মহিলা বাচ্চা কোলে নিয়ে বেরিয়ে আসেন উনি বাচ্চার মুখ চেপে রেখেছেন । বাচ্চাটি গোঁ গোঁ করছে ।

‘ আমরা পুলিশের লোক মা ‘ সুখেন দারোগা বলেন । প্রবীনা হাউহাউ করে কাঁদতে থাকেন । বলেন ,

‘ কাইল রাতে ‘নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবর’ বইলা অনেক লোক এই পাড়ায় ঢুকছি্ল । সব বাড়িতে আগুন লাগাইল , পাকিস্তানে হিন্দুদের থাকন যা্ইবেনা বইলা চিৎকার করল । তারপর ঘরে ঘরে ঢুইকা লুঠপাঠ মারধর খুন করতে লাগল । অনেকে অন্ধকারে পলাইয়া গেল । তিনজন মেয়ে বৌরে তুইলা পাশের মাঠে নিয়া গেছে .. ওদের মাকেও নিয়া গেসে্ ‘ প্রবীনা আর বলতে পারেন না ।

‘ ওদের মানে ? আর কারা আছে্ আপনার বাড়িতে ?’

প্রবীনা একটু থমকান ।

‘ আমার ছেলেরে কাইটা ঐ কুয়ায় ফেলছে দেহেন ! আমার তিন নাতি নাতনি । এইডা ছোট । বাকীরা ..’ প্রবীনা হাত নেড়ে সুখেনদের ডাকেন । সুখেন সাবির পিছন পিছন যায় । এই পাশে একটি ধান সেদ্ধ করার বড় হাড়ি । উনুনে বসানো । উনুনের নিচে পোড়া কাঠ । প্রবীনা আঙ্গুল দিয়ে হাড়িটি দেখান ।

সুখেন দাড়োগা কাঁপা হাতে হাড়ির ঢাকনা সরান । ভিতরে দুটি ছোট বাচ্চা চোখ বন্ধ করে কুন্ডলি পাকিয়ে আছে । বাচ্চা দুটিকে তাড়াতাড়ি বের করা হল । শ্বাস নিচ্ছে । গায়ে পিঠে ফোস্কা ।

‘ অরা বাঁইচা আছে দারোগা বাবু ?’

‘ হ, সাবির তুমি বাচ্চা দুটা নিয়া এইখানে দাঁড়াও । আমি আসতেসি্ ‘

সুখেন দারোগা দৌড়ে কূয়োয় উঁকি মারলেন । দুপুরের রোদের আলোয় একটি মানুষকে ভাসতে দেখা যাচ্ছে। কুয়োর জল লাল । সুখেন দারোগা দৌড়ে পাশের মাঠে যান । ঝোপের মাঝে ছড়ানো তিন উলঙ্গ নারী দেহ । ধর্ষনের চিহ্ন প্রবল । তার ওপর সবার নলি কাটা ।

সুখেন ফিরে আসেন । বলেন ,

‘ সাবির তুমি এই দুইজনকে নিয়া থানার কাছের রিলিফ ক্যাম্পে নিয়া যাও । তার পর থানা হইতে আরও দুইজনকে নিয়া আস । কমিশনারকে সব জানাইতে কও ‘

বেলা দেড়টায় নিশিকান্ত ঘরে ঢোকেন । দু হাত তুলে । নিভাননা দৌড়ে স্বামীর কাছে আসেন । রতন আসে । দুই মেয়েও আসে ।

‘ বাবু তুমি দুই হাত তুইলা আসছো্ ক্যান ?’ ইন্দ্রানী জানতে চায় ।

‘ কার্ফিউ, সুট অ্যাট সাইট চলতেছে্ । এই সময়ে দুই হাত তুইলা বাইরে যাইতে হয় ‘ নিশিকান্ত নিভাননাকে দেখেন । এক রাতেই তাঁর স্ত্রী যেন একা হয়ে গেছেন ।

‘ চান কইরা খায়া বিশ্রাম নাও । পড়ে কথা হবেনে ‘

পেছনে বন্ধ দরজায় ধাক্কা । বেশ জোরে জোরে । নিভাননার বুক ধরফর করতে থাকে। দুই মেয়েকে তাড়াতাড়ি ঘরের ভিতরে পাঠান ।

‘ কে ?’ রতনের চিৎ কার । কোন উত্তর নেই । আবার ধাক্কা ।

নিশিকান্ত এগিয়ে গিয়ে দরজা খোলেন । পিছনে বঁটি হাতে নিভাননা , লাঠি হাতে রতন ।

‘ আপা , আমি আসমা । আপনাদের পাশে আমাদের বাড়ি । কাইল রাইতে কিছু্ লোক আমাদের বাড়িতে আগুন ধরায় । আব্বুকে খুব মারে । আম্মুকে ধইরা নিয়া যায় । আম্মু আমারে পিছো্নে গোয়ালে লুকায় রাকছিল । আমি সব দেখছি্ । আম্মু খুব কান্দতেছি্ল ‘ বিধ্বস্ত এক দশবছরের মেয়ে কাঁদতে থাকে ।

‘ আব্বু আম্মু কোথায় গেছে্ ? আমি কোথায় যা্মু ? আমার খিদা লাগছে্ ‘ আসমা মাথা ঘুরে নিশিকান্তের পায়ের কাছে পড়ে যায় । নিভাননা আসমাকে কোলে তুলে ভেতরে ঢুকে যান ।