প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর কীভাবে বাঙালি দলিত সম্প্রদায়কে পাকিস্তানের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করেছিলেন

0
4880

অভীক সরকার

(প্রথম পর্ব)

পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী মহলে জাতের প্রসঙ্গটি উপেক্ষিত থাকে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে এই জাতের প্রসঙ্গটি ১৯৪৭ এর বঙ্গ-বিভাজনের পক্ষে বা বিপক্ষে থাকা রাজনৈতিক মতাদর্শগুলির সংহতিকরণে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেনি। দেশ-বিভাজন বিষয়টির নিরিখে বাংলার দলিত সম্প্রদায় দুটি পরস্পর বিরোধী দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে – একটি যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল এবং অপরটি প্রমথ রঞ্জন রায়ের অধীনে গঠিত হল। শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় ও অনসূয়া বসু রায় চৌধুরী তাঁদের ‘অস্তিত্বের অন্বেষণে : বিভাজন পরবর্তী সময়ে পশ্চিমবঙ্গে তফসিলি জাতির আন্দোলন (২০১৪)’ প্রতিবেদনে এই দুটি পরস্পর বিরোধী দলিত নেতার বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির উপর আলোকপাত করেছেন।

প্রাক-স্বাধীনতার সময়কালে বিশিষ্ট নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল তাঁর পাকিস্তান-সৃষ্টির পরিকল্পনার প্রচারক হিসেবে সমাদৃত হয়েছিলেন। তিনি ভারতে ৭০ লাখ উপজাতি মানুষের স্থানান্তরণের বিরোধিতা করেন এবং পাকিস্তানের প্রথম মুসলিম লিগ মন্ত্রকের সাথে যুক্ত হন। যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল এই মন্ত্রকের আইন সচিব নিযুক্ত হন ও পাকিস্তানি সংবিধানের খসড়াপত্র প্রণয়ন করেন। পূর্ববঙ্গে ঘটে চলা হিন্দু-বিরোধী হত্যা, উপজাতি মানুষের উপর নির্যাতন হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানি সরকারের উদাসীনতা যোগেন্দ্রনাথের মোহভঙ্গ করে। তিনি তাঁর মন্ত্রীত্ব পদত্যাগ করেন এবং ১৯৫০ সালে ভারতে ফিরে আসেন।

এই প্রতিবেদনে আমরা বিশিষ্ট নেতা প্রমথ রঞ্জন ঠাকুরের বিস্মৃত কাহিনী সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করব। বাঙালি ভদ্রলোকদের পাশাপাশি, প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর বঙ্গ-বিভাজনের পক্ষে লড়েছিলেন। তিনি ভারতে বাঙালী হিন্দুদের নিজস্ব বাসভূমিতে থাকার মতামতের অনুকূলে বাংলার দলিতদের সুসংহত করেছিলেন। অতঃপর তিনি বাঙালী হিন্দু দলিতদের আগামী প্রজন্মকে পাকিস্তানি বিভাজনী শক্তির করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করেন। একই সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়েও তাঁর এই সকল কর্মকাণ্ড তাঁকে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের বিরুদ্ধে পরিচালিত করেছিল। প্রমথ রঞ্জন ঠাকুরের মতাদর্শ ও কর্মকাণ্ড ভারতে যোগেন্দ্রনাথের মত বিস্তারিতভাবে চর্চিত হয়নি। আমরা বলতেই পারি যে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের তুলনায় প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর একজন অধিক হিন্দুপন্থী ও ভারতপন্থী মানুষ।

প্রমথ রঞ্জন ঠাকুরের : জন্ম ও শিক্ষা

প্রমথ রঞ্জন ঠাকুরের জন্ম হয় ১৯০৪ সালে বাংলা প্রেসিডেন্সীর ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত ওরাকান্দি গ্রামে। তাঁর পিতা শশীভূষণ ঠাকুর ও পিতামহ মতুয়া সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা গুরুচাঁদ ঠাকুর। প্রমথ রঞ্জন নমঃশূদ্র জাতির অন্তর্গত এবং মতুয়া ধর্মাবলম্বী যা তাঁর প্রপিতামহ হরিচাঁদ ঠাকুর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বৈষ্ণব ধর্মের একটি পরিবর্তিত রূপ। প্রমথ রঞ্জন ব্রিটিশ কলকাতা থেকে উচ্চ-শিক্ষা সম্পূর্ণ করে লণ্ডনের আদালতে প্রশিক্ষণের জন্য চলে যান। তিনিই নমঃশূদ্র সমাজের প্রথম উকিল।

প্রাক-বিভাজন সময়কালে ঠাকুরের অবদান:

১৯৩০ সালে পিতামহ গুরুচাঁদ ঠাকুরের মৃত্যুর পর প্রমথ রঞ্জন মতুয়া সম্প্রদায়ের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেন। এই সময় যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল বঙ্গীয় আঞ্চলিক তফসিলি জাতি সংগঠন (বি.পি.এস.সি.এফ) স্থাপন করেন। উল্টো দিকে প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর এর বিরোধী সংগঠন বঙ্গীয় আঞ্চলিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বা বি.পি.ডি.সি.এল গঠন করেন। দুটি সংগঠনই দেশ-বিভাজনের বিষয়ের ক্ষেত্রে তীব্র রূপে একে অপরের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। নিজ নিজ সংগ্রামে এই দুটি দলই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলগুলির সাথে সারিবদ্ধভাবে কাজ করে গেছে।

ঠাকুরের নেতৃত্বে সংখ্যালঘু শ্রেণি সংগঠন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল এবং ১৯৪৬-৪৭ সাল নাগাদ দেশভাগের দাবিতে ক্ষোভ প্রকাশ করার জন্য হিন্দু মহাসভার সঙ্গে এটি যুক্ত হয়। কোলকাতা ও নোয়াখালির ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড পূর্ববঙ্গের তফসিলি জাতিভুক্ত মানুষের মনে আশঙ্কার মাত্রা আরো বাড়িয়ে তুলেছিল – এঁরা ইসলামপন্থী পাকিস্তানে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ক্রমশ সচেতন হয়ে উঠছিল। তাঁদের পাকিস্তান-বিরোধী তীব্র বিদ্বেষ অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত ছিল কারণ ১৯৪৬ এর দুটি ভয়াবহ ঘটনায় সর্বাপেক্ষা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তফসিলি জাতিভুক্ত মানুষেরাই। তাঁদের পরিবার-জীবন ও জীবিকা এবং সম্পত্তির উপর ইসলামপন্থীরা আক্রমণ করেছিল।

যখন মণ্ডল মহাশয় তফসিলি জাতি ও মুসলিমদের অভিন্ন পেশাগত স্বার্থ ও অর্থনৈতিক অবস্থানের কথা উল্লেখ করে একটি জোট গঠনের জন্য জোর করেছিলেন, তখন শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা অনুসারে বলা যায় যে, বাংলায় মুসলিম ও নমঃশূদ্রদের মধ্যে কোনো নিরবচ্ছিন্ন সম্প্রীতি বা সহযোগিতার সম্পর্ক ছিল না – ইতিহাস এই সাক্ষ্যই বহন করে; ইহা প্রায়ই ভয়ানক আগ্রাসী দাঙ্গার কারণে ব্যাহত হত। হিন্দু নমঃশূদ্র ও মুসলিমদের মধ্যে কৃষিজমি নিয়ে প্রতিযোগিতা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৯৪৭ সালের এপ্রিলে তারকেশ্বর অধিবেশনে মহাসভা কর্তৃক বঙ্গভঙ্গ ও হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গকে ভারতীয় ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি পেশ করা হয় এবং তা বঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি (বিপিসিসি) কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছিল।

এই ঘটনার পরে হিন্দু বঙ্গরাজ্যের জন্য নমঃশূদ্রদের নিয়ে আর কোনো ভয়ের ব্যাপার থাকল না। তাঁরা বিভাজনের পক্ষে বিপুল সংখ্যায় যোগদান করেছিলেন। ঠাকুর বঙ্গভঙ্গের জন্য ভদ্রলোকদের পাশাপাশি তফসিলি জাতির সদস্যদের সমর্থনও আদায় করে একে সুসংহত রূপ দিয়েছিলেন। গণপরিষদের দুজন পূর্ববঙ্গের তফসিলি জাতিভুক্ত সদস্য ৩রা জুলাইয়ে ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং জানান যে, তফসিলি জাতির সদস্যরা মুসলিমদের নৃশংস আধিপত্য ও দমন-পীড়নের মধ্যে কিছুতেই থাকবে না।

তাঁরা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে দেশভাগের দাবি জানান এবং প্রস্তাব দেন যে, পূর্ববঙ্গের প্রায় সত্তর লাখ তফসিলি জাতির মানুষদের বাঙালী হিন্দুদের প্রস্তাবিত বাসভূমি – পশ্চিমবঙ্গে স্থানান্তরিত করা যেতে পারে। ঠাকুরের প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ বঙ্গ প্রাদেশিক সংখ্যালঘু শ্রেণি সংগঠন তাঁর সম্পাদক আর. দাসের মাধ্যমে এই মর্মে সংক্ষিপ্তাকারে ঘোষণা করেন যে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের সংযুক্ত সার্বভৌম বঙ্গের পক্ষে ধারণাটি তফসিলি জাতির সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে প্রকাশ করে না।

ভারতে তফসিলি জাতির শরণার্থীদের গণ-অভিবাসন

বঙ্গভঙ্গ পূর্ববঙ্গের তফসিলি গোষ্ঠভুক্ত মানুষ বিশেষত নমঃশূদ্র ও রাজবংশীদের ক্ষেত্রে একেবারে বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল। খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, বাখরগঞ্জ প্রভৃতি যে সকল জেলাগুলি নমঃশূদ্রদের স্বাভাবিক বাসস্থান হিসেবে চিহ্নিত ছিল, সেগুলিকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বঙ্গভঙ্গের প্রভাব স্বরূপ, পূর্ববঙ্গের আতঙ্কপ্রবণ জাতি – হিন্দুরা বিপুল সংখ্যায় পশ্চিমবঙ্গে অভিবাসিত হতে থাকে।

ঠিক এমত সময়েই প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর তাঁর পরিবার এবং শত সহস্র মতুয়া গোষ্ঠীর মানুষদের সঙ্গে নিয়ে পূর্ববঙ্গ (পূর্ব পাকিস্তান) এর জেলাগুলি থেকে পশ্চিমবঙ্গে অভিবাসিত হয়েছিলেন। কিন্তু তবুও নমঃশূদ্রদের সংঘবদ্ধ অভিবাসন তখনো হয়ে ওঠেনি। যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের পরিকল্পনা মাফিক বঙ্গে মুসলিম ও তফসিলি জাতির জোটের পথ ইতিমধ্যেই বিভাজন পূর্ব সময়ে দুটি আতঙ্কের কারণে রুদ্ধ হয়ে গেছে। ১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গে সেই ভয়ানক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ঘটনাগুলি সেই ন্যক্কারজনক জোটের কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতে দেয় – যদিও এটি থেকে হিন্দু তফসিলি জাতির মানুষদের পাওয়ার কিছুই ছিল না। কোনো একটি ইসলামপন্থী রাষ্ট্রে হিন্দু তফসিলি জাতির মানুষদের প্রাপ্য সম্মান পাওয়া নিয়ে প্রমথ রঞ্জন ঠাকুরের উদ্বেগকে সঠিক প্রমাণিত করে এই ঘটনা।

১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাসে খুলনা জেলায় বাগেরহাট মহকুমায় কালশিরা গ্রামে সাম্প্রদায়িক অশান্তি দেখা দিলে পুলিশ কিছু কমিউনিস্টদের সন্ধান করতে আসেন, যারা একটি নমঃশূদ্রদের গ্রামে লুকিয়েছিল।নমঃশূদ্র কৃষক ও পুলিশদের মধ্যে মতবিরোধ অত্যন্ত আগ্রাসী রূপ নেয় – যার ফলে দুজন পুলিশ মারাও যান। পরদিন পুলিশ ও মুসলিম আনসাররা কালশিরা ও তৎসংলগ্ন প্রায় কুড়িটি নমঃশূদ্রদের গ্রামে অভিযান চালান এবং স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের দৃঢ় লক্ষ্য ছিল হত্যাকারীর উপর প্রতিশোধ নেওয়া। এর ফলস্বরূপ একটি ব্যাপক অংশে হিন্দু নমঃশূদ্রদের পশ্চিমবঙ্গে আগমন ঘটে – এরাই কোলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলিতে হিন্দুদের বিরুদ্ধে আগ্রাসন প্রদর্শন করেছিল। কিন্তু যখন হিন্দুরা পালটা আঘাত হানতে থাকেন, তখন মুসলিম ব্যাপক সংখ্যায় পূর্ববঙ্গ থেকে পাকিস্তানে চলে যেতে থাকে।

পূর্ববঙ্গে এইরূপে মুসলিমদের একত্রিত হওয়া সেখানকার মুসলিমদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল এবং আগে থেকেই টগবগিয়ে ফুটতে থাকা হিন্দু-বিরোধী স্বার্থে এটি আরো বেশি করে ইন্ধন জোগায়। খুলনা থেকে যে হিন্দু-বিরোধীদের হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ ইত্যাদির শুরু হয়েছিল সেগুলি কালক্রমে রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও বরিশাল জেলায় ছড়িয়ে পড়েছিল। অবশেষে ১৯৫০ সালের জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারি মাসে নমঃশূদ্র উদবাস্তুরা ভারতে ব্যাপক সংখ্যায় অভিবাসনের সিদ্ধান্ত নেয়। ‘বাঙালী ভদ্রলোক’ ও ‘বাঙালী অস্পৃশ্য’দের মধ্যকার ভয়ানক বৈষম্য অতঃপর ঘুচে যায়। শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন পাকিস্তান জাতি-বর্ণ-শ্রেণী নির্বিশেষে সমস্ত হিন্দু জাতের উপরই ‘হিন্দু’ পরিচয় চাপিয়ে দেয়।

(ক্রমশ)