বাংলার রাজনৈতিক বিকল্পের উৎস সন্ধানে

বিগত নয় বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সামনে “অনুপ্রেরণা” এর উৎস হিসেবে যে বিশাল ছবিগুলি কলকাতার রাজপথে এবং সংবাদমাধ্যমে ঘোরাফেরা করছিল, করোনা পরবর্তী সময়ে আশা করি তারা স্ট্যাম্প সাইজের থেকেও ছোট সাইজে পরিণত হবে। শুধুমাত্র সাদা নীল রং করলেই যে স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাল ফেরানো যাবে না তা বোঝার জন্য কোন পন্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। এই সমস্ত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও যেভাবে আমাদের চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী এবং তাদের সহযোগীরা সামনে দাঁড়িয়ে এই দুর্যোগের মোকাবিলা করেছেন তার জন্য কোনও ধন্যবাদই যথেষ্ট নয়।একই সাথে পুলিশ প্রশাসন, সাফাই কর্মী, নিত্য প্রয়োজনীয় যোগান দিতে থাকা সমস্ত ছোট বড় ব্যবসায়ী – এনারাও সামনে দাঁড়িয়েই লড়াই করেছেন। আর সবশেষে যাদের কথা না বললেই নয় সেই সাধারণ মানুষ, যারা ঘরবন্দী থেকে এই লড়াইয়ে সরকারের সমস্ত রকম সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়ে গেছেন।

করোনার মোকাবিলায় রাজ্য সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতা আর নতুন করে তুলে ধরার কোন প্রয়োজন নেই কিন্তু সেই ব্যর্থতার সাথেও, রাজ্যের সাধারণ স্বাস্থ্য পরিষেবা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে এবং সেই পরিষেবা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার দিকে রাজ্যের কাছে কোন “অনুপ্রেরণা” নেই, যা কার্যত এক নজিরবিহীন ঘটনা। ভারতীয় সংবিধানের Article 21 এ  স্বাস্থ্যপরিষেবা জনগণের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়লেও, পশ্চিমবঙ্গ সরকার করোনা পরিস্থিতিতে সেই পরিষেবা দিতে ব্যর্থ হওয়ায়  কার্যত নিজেদের গা ঝেড়ে ফেলে কখনো দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন রাজ্যের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য  বা কখনো অত্যন্ত অমানবিক ভাবে আঙুল তুলেছেন কাজের অভাবে পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের ঘর ছেড়ে অন্যত্র বসবাসকারী পরিযায়ী ভাই বোনদের উপর।

একসময় বাংলা সিনেমার অধিকাংশ নায়ক, নায়িকা ডাক্তার হতেন l উত্তমকুমার, পাহাড়ি সান্যাল, সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া দেবী সবাই চেষ্টা করতেন ডাক্তারের অভিনয় করতে l আনন্দ আশ্রম, সপ্তপদী, কাঁচের স্বর্গ আরোগ্য নিকেতন l কিন্তু গত কয়েক দশকে চিত্রটা আমূল পাল্টে গেলl  ডাক্তাররা ভিলেন হয়ে গেলেন কিভাবে? রঞ্জিত মল্লিক, মিঠুন চক্রবর্তী থেকে প্রসেনজিৎ ডাক্তারদের পেটালে করতালিতে ফেটে পড়ে সিনেমা হল l কেন?

পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার বেহাল দশা হয়েছিল বাম আমলেই। ব্যর্থতা ঢাকতে কলকাতা কেন্দ্রিক বেসরকারি হাসপাতালগুলো রচনা করেছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা পশ্চিমবঙ্গ ধ্বংসের কারিগর জ্যোতিবাবু। বাম শাসকদের দাক্ষিণ্যে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল কিন্তু বর্তমানে এই বেসরকারি হাসপাতালগুলো যে দুর্বিনীত মনোভাব তার জন্য অনেকাংশেই দায়ী বর্তমান সরকারের সীমাহীন নিষ্ক্রিয়তা l কি ব্যবস্থা নিয়েছেন AMRI এর গণহত্যার বিরুদ্ধে? Apollo তে রোগীর মৃত্যু নিয়ে হৈচৈ হলো l দুজন ডাক্তার বলির পাঁঠা হল কিন্তু ম্যানেজমেন্ট এর বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হল ? রোগী মরে গেলে মুখ্যমন্ত্রী রোগীর স্ত্রীকে চাকরি দিচ্ছেন, এতো ক্ষতিপূরণ কিন্তু বিচার কোথায়? বিচার না হলে তো এই বেসরকারি হাসপাতালগুলো অধিক শক্তিতে আক্রমণ করবে সমাজকে, ঠিক যেমন পুরো  এন্টিবায়োটিক কোর্স শেষ না করলে ব্যাকটেরিয়া আরও বেশী শক্তি নিয়ে রোগীকে আক্রমন করে l

এবার আসি কলকাতার বাইরের চিত্র l আপনারা হয়তো জানেননা, কলকাতা বা শহরতলীর বাইরে বেশীরভাগ জায়গাতেই রোজ নেফ্রোলজিস্ট বা উরোলোজিস্ট পাওয়া যায় না। তাই একটা এইমস বানাচ্ছেন হরিণঘাটা আর চাকদার মধ্যে – এইমস কল্যাণী l কিভাবে যাবে তারকেশ্বর, বর্ধমানের রোগীরা ? কেন্দ্র বলেছিলো, মেট্রো দিয়ে এইমস এর সঙ্গে কলকাতা ও শহরতলি জুড়তে l কেন মেট্রো হতে দিচ্ছেন না ? রায়গঞ্জের এইমস হতে দেননি কেন? CMC ভেলোরকে কলকাতায় জমি দিচ্ছেন না কেন? শহরতলির বেসরকারি নার্সিংহোমে গেছেন কোনোদিন? একবার দেখে আসুন মানুষ কত অসহায় ভাবে এদের কাছে সর্বস্ব খোয়াচ্ছে l প্রতিটি নার্সিংহোমের সঙ্গে স্থানীয় নেতাদের যোগ আছে l দিদি আয়ুষ্মান ভারত এরাজ্যে আসতে দিলেন না কেন? কারণ ওই বীমা হাতে থাকলে বেসরকারি হাসপাতালের প্রতিটি পরিষেবার দর নির্দিষ্ট হয়ে যাবে l এপোলো, রুবিদের লুট বন্ধ হয়ে যাবে l

এবার বলি, এই বেসরকারি হাসপাতাল স্বার্থ রক্ষার জন্য কিভাবে আপনাদের সরকারি ব্যাবস্থা সাহায্য করেছে। কতজন ডাক্তারকে আপনারা স্থায়ীভাবে নিয়োগ করেছেন? চুক্তিতে ভালো ডাক্তার পাওয়া যায় নাকি? ডাক্তারদের স্নাতকোত্তর করতে আপনার অনুমতি দেননা বলে অভিযোগ বহু ডাক্তারের l পে-কমিশন, ডি-এ দেননা l পিছনের দরজা দিয়ে চাকরি পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীরা গোলেমালে হরিবলে পার করে দিলেও দিতে পারে কিন্তু পিছনের দরজা দিয়ে কন্টাক্ট এ চাকরি পাওয়া ডাক্তারের পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। আর কোন রোগীর মৃত্যু ঘটলো সর্বপ্রথম আঘাত নেমে আসে ডাক্তারদের উপর কারণ সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় যে  মূল সমস্যা ডাক্তারদের জন্য নয়, মূল সমস্যা হলো অর্থলোভী ম্যানেজমেন্ট এবং সেই ম্যানেজমেন্ট এর প্রতি সহানুভূতি দেখাতে থাকা আমাদের সরকার।  বাইপাসের পাশের  কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে কিছু বিশেষজ্ঞ এসে মানুষকে জ্ঞান দিচ্ছে, যাতে করোনা পরবর্তী কালে এদের ব্যবসার আরও উন্নতি হয় l যে বিশেষজ্ঞ রোজ টিভিতে এসে জ্ঞান দেন, তিনি আজ পর্যন্ত কোন সরকারি বীমাওয়ালা রোগী দেখেছেন ? এরা অনেকেই আজ বুক ফুলিয়ে “স্বাস্থ্যসাথী” বা “আয়ুষ্মান ভারত” এর  রোগীদের প্রত্যাখ্যান করে l করোনার মতো মহামারীর সময়ে ভার্চুয়াল কনসালটেশন ফী দশ হাজার টাকা ! চ্যাংড়ামো হচ্ছে ? কে সাহস দিয়েছে?

কিন্তু আজও মানুষ ডাক্তারদের ভালোবাসে । তাই প্রেসিডেন্সীর পড়ুয়ারা হোস্টেল নিয়ে  বারবার মাননীয়া মমতা ব্যানার্জীর সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে হেরে গেলেও, ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেল আন্দোলনের কাছে মাননীয়ার সরকারকে মাথানত করতে হয়েছে। যাদবপুরের পড়ুয়াদের আন্দোলনের উপর যে সমাজ শুধু ঘৃণাবর্ষণ করে, সেই সমাজ নীলরতন সরকারের আহত ডাক্তারের পিছনে দাঁড়িয়ে প্রমান করে দিয়েছে, তারা এখনো বিশ্বাস করে ডাক্তাররা ভিলেন নয়, ভিলেন আমাদের স্বঘোষিত রাজনৈতিক অভিভাবক-অভিভাবিকারা।

রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়ার পরেও তৃণমূলের দলদাসেরা  বলছেন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দিদির কোন বিকল্প নেই l ঠিকই বলেছেন ! পশ্চিমবঙ্গের বেকারদের যেমন ১০০ দিনের কাজ করা ছাড়া বিকল্প পথ নেই, পশ্চিমবঙ্গের ছাত্রদের যেমন স্কুল কমিটির নেতাদের অত্যাচার সহ্য করা ছাড়া বিকল্প নেই, পশ্চিমবঙ্গের রুগীদের যেমন ভেলোর ছাড়া গতি নেই, কলকাতায় চাকরি করতে আসা সুদূর শহরতলির মানুষের যেমন ভিড়ে ঠাসা ট্রেনে ব্যাতিত ভালো রাস্তা বা মেট্রো রেলের মত বিকল্প নেই, সেচের জলহীন চাষীদের যেমন ভূগর্ভস্ত জল তুলে রাজ্যেকে আরও আর্সেনিক সংকটে নিয়ে যাওয়া ছাড়া কোন বিকল্প নেই, জনগনের যেমন দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ বিদ্যুতের   বিল ভরা ছাড়া বিকল্প নেই, চাষীদের যেমন অসৎ ফড়ের কাছে আত্মসর্পন ছাড়া বিকল্প নেই, বাড়ি বানাতে গেলে আপনার কর্মীদের ঘুষ দেয়া ছাড়া বিকল্প নেই, ডাক্তার পুলিশদের যেমন দুধেল গাইয়ের লাথি খাওয়া ছাড়া বিকল্প নেই, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার  প্রশিক্ষণের জন্য পর্যন্ত  মাড়োয়ারি ( আকাশ, FIITJEE, KOTA),  বা তেলেগু ( নারায়ণ, চৈতন্য ) সংস্থার বিকল্প নেই এবং চাকরি পেতে গেলে ঘুষ দেওয়ার বিকল্প নেই, তেমনই দিদিরও কোন বিকল্প নেই l রাজ্যের দারিদ্রতম মানুষেকে বিপদের চালিত করতে কেন্দ্রে জনধন, জীবনবীমা, দুর্ঘটনা বীমা, চিকিৎসা বীমা, কৃষি বীমা, আবাস যোজনা, উজালা যোজনা প্রত্যাখান করাতে কোন বিকল্প নেই, কেন্দ্রের দেয়া বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প তথা স্মার্ট সিটি, স্মার্ট ভিলেজ, সাগর বন্দর, মেট্রো রেল, ডেডিকেটেড ফ্রেট করিডোর, ইন্ডাস্ট্রিয়াল করিডোর প্রত্যাখ্যান করে রাজ্যেকে অন্ধকারে ঠেলে দয়ার মত সিদ্ধান্তের বিকল্প নেই l

একটা কথা মেনে নিচ্ছি, যথেচ্ছ ধার করে ও ৯৯ শতাংশ সরকারি সংস্থার শেয়ার বেঁচে ( হলদিয়া পেট্রো, হরিণঘাটা সহ বিভিন্ন ডেয়ারি, বিভিন্ন জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি ) সেই টাকা খেলা-মেলায় বিলিয়ে ভোট কেনা যদি মুখ্যমন্ত্রীর একমাত্র কাজ হয়, আমি বিজেপিতে দিদির কোন বিকল্প দেখতে পাচ্ছি না l কমরেড জ্যোতিবাবুর মত কেউ যদি আবার এই প্রজন্মে “কং-রেড”  (কংগ্রেস + কমরেড) রুপে জন্মগ্রহণ করেন, তিঁনিই আপনার বিকল্প হতে পারেন l