ভারতের মানচিত্রকারদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা

0
1754
উত্তর ভারতের মানচিত্র

গত সপ্তাহে ভারত সরকারের তরফ থেকে মানচিত্রকার ও অন্যান্য ভৌগোলিক বিশেষজ্ঞদের জন্য বিশেষ সুবিধার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। বেসরকারি কোম্পানিদের এই অংশে প্রবেশপত্র দেওয়ার ফলে এই গোষ্ঠীর মানুষদের চাকুরীগত ক্ষেত্রে বিশেষ উন্নতি হবে, এ আশা তো করাই যায়! তাছাড়া, এর ফলে নানা বিদেশি কোম্পানির অর্থ লগ্নি করার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। মানচিত্র নির্মাণ করাও এক বিশেষ শিল্পস্বরূপ। গত একশ’ বছরে যন্ত্রপাতির নানা উন্নতির ফলে নিখুঁত মানচিত্র নির্মান যেমন সহজ হয়েছে, তেমনই সেনাবাহিনীসহ আরও নানা ক্ষেত্রে এর গুরুত্বও বেড়েছে। কাজেই, সরকারের নতুন নীতি জানার আগে এই মানচিত্রকার এবং মানচিত্রের ইতিহাস জেনে নেওয়া খুব জরুরি।

ইউরোপীয় ইতিহাস

ষোড়শ শতকের প্রথম ভাগে মানচিত্র নির্মাণের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে ছিল স্পেন ও পর্তুগাল। যেহেতু তারা ভারত মহাসাগর ও আমেরিকায় বহুবার অভিযান চালিয়েছিল, সেজন্য সেসব দেশের বহু খুঁটিনাটি ছিল তাদের নখদর্পণে। তবে এই নিখুঁত মানচিত্র যে তারা গোপন রাখত, তা জেনে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এই মানচিত্র ছিল রাজসম্পত্তি। অভিযানফেরত ক্যাপ্টেনরা তাঁদের অভিজ্ঞতা কেবলমাত্র রাজসভা দ্বারা নিয়োজিত মানচিত্রকারদের সাথে ভাগ করে নিতেন। যদিও তার কিছুদিনের মধ্যেই অন্যান্য দেশের গুপ্তচররা ঘুষ দিয়ে ও আরও নানা উপায় অবলম্বন করে সেই তথ্য হাতিয়ে নিত।

১৫৩০ সাল নাগাদ থেকেই ডাচ ও ফ্লেমিশ ব্যবসায়ীরাও মাঠে নেমে পড়েন। তার আগে গুপ্তচরদের দিয়ে নিজেদের মানচিত্রকে উন্নত করে নিয়েছিলেন তাঁরা। মানচিত্র নির্মাণের জন্য ডাচরা একটা নিজস্ব গোষ্ঠী তৈরি করে নিয়েছিল। জেরার্ডাস মার্কেটারের মতো তুখোড় শিল্পীরা সেই গোষ্ঠির সদস্য ছিলেন। এঁদের রাখা হয়েছিল যাতে এঁরা চটজলদি কিছু জিনিস আবিষ্কার করে ফেলতে পারেন। সেই সময়ের এক বিখ্যাত আবিষ্কার ছিল মার্কাটার প্রজেকশন, যা কিনা এখনও মানচিত্র নির্মাণে ব্যবহৃত হয়।

ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে এই প্রযুক্তি ইংল্যান্ডে আসতে বেশি সময় লাগল না। জোডোকাস হোন্ডিয়াস নামে এক ফ্লেমিশ মানচিত্রকার ইংল্যান্ডে এসে ব্যবসা ফেঁদে বসলেন। যার ফলে ইংল্যান্ডে মানচিত্র নির্মাণের প্রযুক্তি হু হু করে ঊর্ধ্বমুখী হতে লাগল। মানচিত্র নির্মাণে ইংরেজ ও ডাচরা ছিল একই প্রকৃতির। তারা বিভিন্ন সফল অভিযাত্রীদের থেকে তো তথ্য নিতই, তার সঙ্গে তাদের খবরের সূত্র ছিল আরও নানা মাঝি-মাল্লা, মায় জলদস্যুরাও। এছাড়া অন্যান্য দেশে গুপ্তচরবৃত্তি করে তথ্য সংগ্রহ তো ছিল তখন একচেটিয়া। তবে এর ফলাফল ছিল খুব ভালো। খুব শিগগিরই তারা হয়ে উঠল শ্রেষ্ঠ মানচিত্রকারদের দেশ। এভাবে তথ্য সংগ্রহ করে মানচিত্র নির্মাণের ফলে পরবর্তীকালে তুড়ি মেরে স্পেন ও পর্তুগালকে হারিয়ে দেয় এরা। 

পরের কয়েক শতকে আমরা দেখব ডাচ ও ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মানচিত্র তৈরিতে রাশি রাশি টাকা লগ্নি করছে। এই দুই কোম্পানি এবং সরকার — দুজনেই বহু টাকা লগ্নি করে এই বিশেষ গোষ্ঠীর উন্নতিসাধন করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ একটা ঘটনার কথা বলা যাক। সালটা ১৭১৪। ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করে, কেউ যদি এমন কোনো ঘড়ি বানাতে পারে, যা মাঝসমুদ্রেও নিখুঁত কাজ করবে, তাঁকে সরকার থেকে ২০০০০ পাউন্ড পুরষ্কার দেওয়া হবে। তখনকার ২০০০০ পাউন্ড মানে কিন্তু যে সে কথা নয়! এখনকার হিসেবে দেখলে প্রায় ত্রিশ লক্ষ টাকার কাছাকাছি। এই ঘড়ির তখন খুবই প্রয়োজন ছিল। হাজার হোক, সমুদ্রের বুকে দুলতে থাকা জাহাজে তো আর পেন্ডুলাম ঘড়ি কোনো কাজে লাগে না! আর কোনো জায়গার অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ মাপার জন্য নিখুঁত সময়ের হিসেবেরও প্রয়োজন হয়। ব্যালেন্স-হুইল আবিষ্কার করে জন হ্যারিসন এই পুরষ্কার জিতে নিয়েছিলেন। এই আবিষ্কার অবশ্য মানচিত্র নির্মাতাদের জন্য এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি

ব্রিটেন যে ভারতসহ আরও নানা দেশকে অধিকার করে নিয়েছিল এবং সমুদ্রাভিযানে বহু দেশকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল, তার জন্য দায়ী তাদের মানচিত্র নির্মাণ শিল্পের ক্রমোন্নতি। ১৭৬০-এর দশকে জেমস রেনেলের মতো মানুষরা প্রথম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে ভারতের মানচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। এই প্রচেষ্টাকে একটা নির্দিষ্ট রূপ দেওয়ার জন্য ১৭৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সার্ভে অফ ইন্ডিয়া। মানচিত্র নির্মাণের পেছনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই বিপুল অর্থ লগ্নীকরণ বিফল হয়নি। মারাঠা ও ফরাসীদের হারাতে এই মানচিত্র খুব কাজে লেগেছিল। মারাঠারাই একমাত্র ভারতীয় গোষ্ঠী যারা মানচিত্র নির্মাণের চেষ্টা করেছিল। তবে ইংরেজদের প্রযুক্তির কাছে তাদের প্রযুক্তি ছিল নিতান্তই শিশু। কাজেই, কোনো লাভ হয়নি! দুই গোষ্ঠীর প্রযুক্তির মধ্যে এই বিশাল ফারাকের জন্য ইংরেজরা সহজেই ভারতীয়দের ওপর নিজেদের বাহুবল দেখাতে পেরেছিল।

উনিশ শতকে সার্ভে অফ ইন্ডিয়া ভারতের নিখুঁত মানচিত্র তৈরি করতে সফল হয়েছিল। এই কীর্তির জন্য সব কৃতিত্ব প্রাপ্য উইলিয়ম ল্যাম্বটন ও জর্জ এভারেস্টের। সেই সময়ের বৃহত্তম বৈজ্ঞানিক সাফল্য ছিল ‘দ্য গ্রেট ট্রিগনমেট্রিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’। এর মাধ্যমে প্রথমবার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আওতায় ভারতের ঠিক কতটা অংশ আছে, তা হিসেব করা সম্ভব হয়েছিল। শুধু তাই নয়, ভারতের প্রথম প্রাকৃতিক মানচিত্র নির্মাণও সম্ভব হয়েছিল এর মাধ্যমে।

এই পর্যায় থেকে ভারতের মানচিত্র নির্মাণটাকে ইংরেজরা সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার একচেটিয়া করে দেয়। ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক। কোনো করদ রাষ্ট্রের শাসকই চাইবেন না যে তাঁদের পরিশ্রমের ফসল স্থানীয় কেউ, বা অন্য কোনো শাসক গোষ্ঠী জেনে ফেলুক। পাঠক মনে রাখবেন, সে সময় সার্ভে অফ ইন্ডিয়া ভারতে অবস্থিত ছিল না, ছিল ব্রিটেনে।

স্বাধীনতা-উত্তর ভারত

নিয়তির কী অদ্ভূত পরিহাস, স্বাধীনতা পাওয়ার পরেও ভারতের মানচিত্র নির্মাণ সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার একচেটিয়া আধিপত্যই রয়ে গেল। এমনকি, কৃত্রিম উপগ্রহের মতো উচ্চ প্রযুক্তির জিনিস আবিষ্কার হওয়ার পরও এ ঘটনা ঘটেছে বহুদিন। দুঃখের বিষয়, প্রযুক্তিগত উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও সার্ভে অফ ইন্ডিয়া সেদিকে বিশেষ পা বাড়ায়নি।

কিন্তু মূল সমস্যা তা ছিল না। সমস্যা ছিল যে ব্যাপারটা ছিল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার একচেটিয়া। অর্থাৎ, সার্ভে অফ ইন্ডিয়া ছাড়া অন্য কোনো বেসরকারি সংস্থা মানচিত্র নির্মাণের জগতে আসতে পারত না। সে জন্য, ললিতেশ কাটরাগাড্ডা ও তাঁর কিছু সহকর্মী মিলে যখন গুগল ম্যাপ তৈরি করলেন, তা ছিল একদিক দিয়ে বেআইনী। কিন্তু এই গুগল ম্যাপের ব্যবহার হু হু করে ছড়িয়ে পড়ায় কিছুটা সরকারি অনুকম্পা পেলেও অবশেষে গত সপ্তাহে আইনী জটিলতা থেকে মুক্তি পেল সে।

অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক দিক থেকে দেখতে গেলে সারা বিশ্বে অত্যন্ত জরুরি এই মানচিত্র নির্মাণ। এই একচেটিয়া ব্যাপার থেকে মুক্তির জন্য যেমন বহু স্থানীয় সংস্থা আবেদন করেছিল, তেমনই আবেদন করেছিল বহু বিপণন সংস্থা, মায় প্রতিরক্ষা দপ্তর অবধি। বেসরকারি হস্তক্ষেপের অনুমতি মেলায় ভারত সরকার বর্তমানে আশা রাখেন যে আগামীতে ভারত বিশ্বের সেরা মানচিত্র নির্মাতাদের সঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকবে বহু উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে।

মূল লেখাটি স্বরাজ্য পত্রিকায় প্রকাশিত, লিখেছেন সঞ্জীব সান্যাল। অনুবাদ করেছেন দাশু।