শ্রীঅমর্ত্য সেন প্রতিবারের মত এবারেও ভারত সফরে এসেছেন এবং প্রতিবারের মত এবারও বলেছেন যে শ্রীনরেন্দ্র মোদীর সরকার কত খারাপ। প্রত্যেক মানুষের আত্মসমর্থনের ন্যায্য অধিকার আছে। তাই নীতি আয়োগের শ্রী রাজীব কুমার অমর্ত্য সেনের অভিযোগকে খণ্ডন করেছেন। তাতেই গোঁসা হয়েছে আনন্দবাজারের। প্রশ্ন করেছেন, নির্বোধ অসহিষ্ণুতাই মেনে নেব? অর্থাৎ মোদী সরকার নির্বোধ। তাদের আত্মসমর্থনের চেষ্টা অসহিষ্ণুতা মাত্র।
এর মানে কি এটাই দাঁড়ালো যে বুদ্ধিমানের অসহিষ্ণুতা মেনে নেবার যোগ্য। অমর্ত্যবাবু নোবেল পেয়েছেন, বুদ্ধিমান ব্যক্তি সন্দেহ নেই তায়, সে বুদ্ধি যে কাজেই খরচ হোক না কেন। এবং আমরা ভীষণভাবে দেখতে পাচ্ছি যে অমর্ত্যবাবু অসহিষ্ণু। শুনতে খারাপ লাগছে কি?
ঠিক আছে এক এক করে বলি। অমর্ত্যবাবু হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিরোধী, এ কোন নতুন কথা নয়। জন্ম হওয়া ইস্তক যতদিন ওনার কথা শুনেছি, তাই শুনে আসছি। তাতে কোন আপত্তি নেই। উনি তো ওনার নিজের আদর্শই বলবেন, এতো একান্তই কাম্য। উনি ২০১৪র নির্বাচনের আগে বলেছিলেন যে নরেন্দ্র মোদীর জাতীয়তাবাদ তাঁর কাছে পীড়াদায়ক। তিনি মনে করেন যে মোদীর নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের মনে-প্রাণে ব্যথা লাগবে এবং এ কারণে তিনি মোদীকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে চান না।
কিন্তু অমর্ত্যবাবু কি তাঁর এই নীতি সমানভাবে প্রয়োগ করেন? একেবারেই না। উনি বাংলাদেশের কথা বলতে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে পড়েন। বলেন যে বাংলাদেশ শিক্ষাক্ষেত্রে দারুণ কাজ করেছে, জনস্বাস্থ্যের ব্যপারে কি তাদের উন্নতি। কিন্তু আমি একবারও অমর্ত্যবাবুকে বলতে শুনিনি যে বাংলাদেশ একটি ইসলামীয় রাষ্ট্র, সেকুলার নয়। তাই বাংলাদেশের এইসব আর্থ-সামাজিক উন্নতির পরে একটা কিন্তু কোথাও আছে। একবারও আমি ওনাকে বলতে শুনিনি যে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের জনসংখ্যা ১৯৭১ এর পর থেকে উত্তরোত্তর কমে গেছে। এ কাজ তাঁর কাছে পীড়াদায়ক। তাহলে কি উনি কেবল ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে নিন্দা করেন, বাকীদের নয়। সাধারণ চোখে এ তো অসহিষ্ণুতাই হল, নয় কি?
এবার তাঁর মোদী বিরোধিতা কতটা সত্যনিষ্ঠ ও নিজের আদর্শের অনুসারী তা নিয়ে একটু আলোচনা হোক। অমর্ত্যবাবুর অর্থনীতির তত্ত্বের মূল সিদ্ধান্ত হল যে শুধু জিডিপির আলপনা গুলে কিছু হয় না, প্রয়োজন সর্বস্তরের মানুষের জন্য জীবন-জীবিকার স্বাচ্ছন্দ্য বিধান। এখন নরেন্দ্র মোদীর কাজগুলোয় চোখ ফেরানো যাক।
- প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমলে দেশের শেষ গ্রামটিতেও বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। প্রায় ১৮ হাজার দুর্গম প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ। গ্রাম বলতেই আমরা কোলকাতার শহুরে মানুষজন ভাবতাম নিষ্প্রদীপ কিছু স্থান। সে চিত্র আজ বদলে গেছে। উপরন্তু ভারতের সমস্ত দরিদ্র পরিবারগুলিকে নিখরচায় বিদ্যুৎ পরিষেবা দেবার জন্য সৌভাগ্য প্রকল্প চালু হয়েছে।
- দেশের সাড়ে তিন কোটির উপর অধিক দরিদ্র পরিবার পেয়েছে উজ্জ্বলা প্রকল্পে এলপিজি গ্যাসে রান্নার সুযোগ এবং তা পেয়েছে দেশের স্বচ্ছল পরিবারগুলি পূর্বে যে ভর্তুকি পেত, সেই অর্থেই।
- জনধন যোজনায় দেশের দরিদ্রতম পরিবারগুলি পেয়েছে ব্যাঙ্কিংয়ের সুযোগ। এই যোজনায় ৩১ কোটি ব্যাঙ্কের অ্যাকাউণ্ট খোলা হয়েছে এবং দরিদ্র পরিবারগুলি অ্যাকাউণ্ট খুলে পাঁচ হাজার টাকা পেয়েছে। বিখ্যাত সংস্থা ক্রিসিলের সমীক্ষা বলছে যে এই ব্যাঙ্কিং পরিষেবার উন্নতি অভূতপূর্ব। অমর্ত্যবাবুর দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রস্তাবেই আছে দরিদ্রের জন্য সমান সুযোগ, এই ব্যাঙ্কিংয়ের সুবিধা প্রদান তার পথে এক বিশাল অগ্রগতি।
- সরকার সকলের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে ৬ কোটি শৌচালয় সারা ভারতে বানিয়েছে। এর ৯০ শতাংশের বেশি সম্যকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
- দেশের ৫০ কোটি মানুষের জন্য ৫ লক্ষ টাকা অবধি স্বাস্থ্যবীমা আনতে এবারের বাজেটে প্রস্তাব এনেছে কেন্দ্রীয় সরকার।
আমি সেই উদাহরণগুলিই দিলাম যেগুলি বস্তুগতভাবে অমর্ত্যবাবু পরখ করতে পারেন এবং যেগুলি অমর্ত্যবাবুর নিজস্ব তত্ত্বের সাথে মিলে যায়। এর বাইরেও প্রধানমন্ত্রী শ্রীনরেন্দ্র মোদীর অনেক সাফল্য আছে। যেমন এই সরকার দিনে ৪০ কিলোমিটার করে রাস্তা বানাচ্ছে যেখানে আগের ইউ পি এ সরকার বানাত মাত্র ১৭ কিলোমিটার। কিন্তু অমর্ত্যবাবু হয়ত ভারতের রাস্তা নিয়ে তেমন ব্যাকুল নন। এই সরকারের পাঁচ বছরের দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ভারতে অভূতপূর্ব এবং এই সরকার হবার আগে ছিল অভাবনীয়। কিন্তু অমর্ত্যবাবু হয়তো বলে বসবেন যে তাঁর বিচারে নরেন্দ্র মোদীর জাতীয়তাবাদই সবচেয়ে বড় দুর্নীতি, তাই আমি আর সেসব প্রসঙ্গে গেলাম না।
আমি অ্যাকাডেমিক জগতের নই, তবে আমার বন্ধুদের কাছ থেকে দেখি যে এই জগতের মানুষরা সাদা-কালো মিলিয়ে মিশিয়ে কথা বলেন। পুরোটা ভালো বা পুরোটা খারাপ এরকম বলতে চান না। রাজনীতির মানুষ হিসেবে আমি একটা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কথা বলি। কিন্তু অমর্ত্যবাবু তা নন। শিক্ষাজগতের একজন দিকপাল মানুষ হিসেবে তাঁর কি উচিৎ ছিল না বলা যে, “হ্যাঁ নরেন্দ্র মোদী দরিদ্রদের জন্য অনেক কাজ করেছেন, কিন্তু যেহেতু তিনি আমার বিচারে যথেষ্ট ধর্মনিরপেক্ষ নন, তাই আমি তাঁর বিরোধী।” কিন্তু আমি কোনদিন দেখলাম না, অমর্ত্যবাবুকে বলতে যে শ্রী নরেন্দ্র মোদী কোনদিন কোন ভালো কাজ করেছেন বলে। এই পক্ষপাতদর্শী বিচার কি তাঁর মত এতো বড়ো অ্যাকাডেমিক জগতের মানুষকে সাজে? এ কি তাঁর অসহিষ্ণুতা নয়?
অমর্ত্যবাবুর সব তত্ত্বের শুরু আর শেষ হয় গণতন্ত্র কত ভালো এই বয়ানে। অথচ তিনি ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মোদী সরকারকে স্বীকার করতেই প্রস্তুত নন। গণতন্ত্রকে স্বীকার করার বদলে তিনি শ্রীমোদীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে তাঁর আপত্তির কথাই বলেন। যে সিদ্ধান্তই তাঁর বিরুদ্ধে যায়, তাতেই তাঁর ক্ষোভ। তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়া মাত্র, যখন সরকার তাঁকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়, তিনি তাঁর ক্ষোভ প্রকাশেও কুণ্ঠিত হন নি। সাধারণ চোখে তো এটাই মনে হবে, তিনি তাঁর পদের প্রতি আসক্ত আর তার জন্য গণতান্ত্রিক সরকারের বিরোধিতাও তাঁর কাছে অসুবিধাজনক ঠেকে না। গণতন্ত্রের সিদ্ধান্তের প্রতি এ কি কোন অসহিষ্ণুতা নয়?
আরও বলি, ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের মেয়ের বান্ধবী, যিনি একজন দিল্লীর এক কলেজের এক রীডার ছিলেন (পূর্ণ অধ্যাপকও নন), তাঁকে শ্রীসেনের আমলে নিয়োগ করা হয় মাসিক ৫ লক্ষ টাকা মাইনেতে নালন্দার উপাধ্যক্ষ হিসেবে। এই উপাধ্যক্ষ মহোদয়া নালন্দা যেতেনও না, দিল্লীতেই থাকতেন ও তাঁর বেতন ভোগ করতেন। অবশ্য তিনি তাঁর বান্ধবী মনমোহন সিংয়ের মেয়েকে প্রথমেই নালন্দার অতিথি-অধ্যাপক নিয়োগ করেছিলেন। শ্রীসেনের কি কোন দায়ই নেই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তা হিসেবে এই সব দুর্নীতির ব্যাপারে? আমরা বাংলায় বলি, আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও। জানি না, শ্রী সেনের অভিধানে এই শব্দ কয়টি আছে কিনা? নাকি নিজের দায়িত্ব নিয়ে তিনি সমালোচকদের প্রতি দায়বদ্ধও নন? এ কি তাঁর সহিষ্ণুতার পরাকাষ্ঠা?
আনন্দবাজার লিখেছেন,
গভীর উদ্বেগের কথা হল, ক্ষমতাবানের এই উৎকট অসহিষ্ণুতার প্রকাশেও দেশে, আলোড়ন দূরে থাকুক, প্রায় কোনও প্রতিবাদ নেই।
আমি বলি, নোবেল প্রাপক আমেরিকাপ্রবাসীর অসহিষ্ণুতার কি সামান্য প্রতিবাদও অন্যায়?
ফীচার: DW