সিনেমা যখন অপপ্রচার

0
578

ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন হযরত বিল্লালকে নিয়ে ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে দুবাইতে একটি অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রে ‘বিল্লাল: অ্যা নিউ ব্রিড অফ হিরো (Bilal: A New Breed of Hero)’ নির্মিত হয়েছে। এই সিনেমাতে হযরত আবু বকর সিদ্দিকীকেও অ্যানিমেশন করে চিত্রিত করা হয়েছে। ইসলামের প্রথম সারির ব্যক্তিদের ছবি আঁকা ভাস্কর্য নির্মাণ ইসলামী বিশ্বে প্রায় নিষিদ্ধ হলেও সম্প্রতি তাদের নিয়ে সিনেমা কার্টুন নির্মাণ শুরু হয়েছে। এই শুরু হওয়াটা কি ইসলামের রক্ষণশীলতা থেকে বেরিয়ে আসার ইঙ্গিত? হয়ত নয়। এমনকি একদিন হযরত মুহাম্মদ (সাল্লালুহা অলায়হি ওয়া সাল্লাম) চরিত্রে কেউ অভিনয় করবে। সেটাকেও ইসলামী বিশ্বের বিশেষ উদারতা হিসেবে ভাববার সুযোগ অল্পই। এরকম চলচ্চিত্র নির্মাতাদের বিরুদ্ধে কোন মুফতি আল্লামার বিরোধ লাগা ছাড়া বড় কোন প্রগতিশীল মুভমেন্ট এখানে নেই। কারণ এরকম চলচ্চিত্র নির্মাতারা সপ্তম শতাব্দীর কিছু বর্বরতাকে আজকের যুগের সভ্য মানুষের কাছে গ্রহণীয় করে উপস্থাপন করার প্রচেষ্টা করছে।

বিলাল বিন রাবাহ আল-হাবশি পূর্ব আফ্রিকার আবিসিনিয়ার একজন কালো মানুষ। ছোটবেলায় ডাকাত দল তাঁকে ও তাঁর বোনকে লুট করে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়। তাঁদের কিনে নেন আরবের ধনী ব্যবসায়ী উমাইয়া বিন খালাফ। দাসদের জীবন মোটেই সুখকর নয়। কাজেই বিল্লালের জীবন সুখকর ছিলো না। তাঁর বয়স যখন ৩০ তখন তিনি হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) ধর্ম গ্রহণ করে। এটা করায় তাঁর মালিক চটে গিয়ে তাঁকে কঠিন সাজা দেয়। বিল্লালকে সাজা দেয়ার কথা শুনে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আবু বকরকে বিল্লালকে কিনে নিতে বলেন। আবু বকর কথা মত বিল্লালকে কিনে নিয়ে মুক্ত করে দেন। সিনেমা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বারাজুন এন্টারটেইনমেন্ট ও প্রযোজক আইমান জামালের আসল উদ্দেশ্য এইখানেই দেখানো যে ইসলাম দাস থেকে মুক্ত করে মানুষকে মুক্তি দিয়েছিল। আমাদেরকে বোঝানো হচ্ছে সপ্তম শতাব্দীতে ইসলাম আসার আগে পৃথিবী বর্বর অন্ধকাচ্ছন্ন ছিল। ইসলামই দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মানুষকে মুক্তি দিয়েছিল। আজকে যখন আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিপরীতে ইসলামবাদী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জঙ্গি আন্দোলন চলছে তখন এরকম অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রে ইসলামকে সপ্তম শতাব্দীতে মানুষের মুক্তির আন্দোলন বলে পরিচয় করানোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যোগসাজিস রয়েছে। আজকের যুগে যখন অন্যান্য ধর্ম একটা প্রগতিশীল আন্দোলনের মাধ্যমে পরাজিত হয়ে রাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত হয়ে ধর্মালয়ের চার দেয়ালে বন্দি হয়েছে তখন ইসলাম ধর্মকে মানবতার সমাধান, মুক্তির সনদ বলে দাবী করাটা সপ্তম শতাব্দীতে প্রত্যাবর্তন। কিছু সাম্রাজ্যবাদী ফ্যাসিস্ট ভাবধারাকে আজকের যুগে অপপ্রচারের এটা একটা ধান্দা। ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক প্রগতিশীল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এটি একটি চক্রান্ত।

হযরত বিল্লাল দাস থেকে মুক্ত হয়ে ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন হয়েছিলেন। ছিলেন দাস অথচ ইসলাম গ্রহণ করে সমান কাতারে এসে গিয়েছিলেন আবু বকর ওসমানদের সঙ্গে। এটাই বলার চেষ্টা করা হয়েছে চলচ্চিত্রটিতে। অথচ ইসলাম দাস প্রথা বিলোপ করেনি। ইসলামের পয়গম্বরের সাথী মহান সব সাহাবীদেরই দাসদাসী ছিলো। শরিয়তী আইন, সেই সপ্তম শতক থেকে শুরু করে বহুদিনই, বাড়ির দাসীর সঙ্গে গৃহকর্তার অবাধ সেক্সকে অনুমোদন করেছে। এর জন্য মালিককে দাসীকে বিয়ে করার কোন প্রয়োজনই নেই। আজকেও আইসিস-জাতীয় ইসলামবাদীরা সেই আইনকেই লাগু করতে চায়। ইসলামী ইতিহাস যদি আমরা দেখি তাহলে দেখব, মদিনার আশেপাশে ইহুদী বসতিগুলোতে হামলা করে ইহুদী সক্ষম পুরুষদের হত্যা করে তাদের নারীদের মুসলমানেরা গণিমতের মাল হিসেবে যৌনদাসী করে রেখে দিচ্ছে। এইসব যৌনদাসী ও তাদের শিশুদের পরে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। হযরত বিল্লাল ইসলাম গ্রহণ না করলে তাঁকে কেউ কিনে এনে মুক্ত করে দিত না। তিনি মুসলমান হয়েছিলেন এবং তার জন্যই তিনি স্বাধীন মানুষও হয়েছিলেন।

পক্ষান্তরে সেই সপ্তম শতাব্দীর মদিনাতে বনু কুরাইজা, বনু নাযির ইত্যাদি গোষ্ঠীর যারা ইহুদী ছিলো তাদের ভাগ্যে নেমে এসেছিলো মৃত্যু। নারী ও শিশুদের কপালে লেখা হয়ে গিয়েছিল দাস জীবন। অর্থাৎ ইসলামের আগমনের সাথে সাথে একটা নতুন শক্তির আবির্ভাবও ঘটেছিল যা কিনা শত শত ছোট বিল্লালদের দাস বানিয়ে রেখেছিলো। তারা সকলেই ইহুদী নয়ত আরব পৌত্তলিক বাবা-মার সন্তান। অর্থাৎ এই ছোট বিল্লালরা আমাদের হযরত বিল্লালের দলের হাতে পরে দাস হিসেবে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। ইসলাম তাদের জন্য কি মুক্তির বার্তা এনেছিল?

নিজে দাস জীবন কাটিয়েও হযরত বিল্লাল কিন্তু নিষ্ঠুরতা করতে কম যাননি। এটা হয়ত তাঁর উপর চলা অতীতে অন্যায়গুলোর একটা পৈশাচিক প্রতিশোধ বলা চলে। খায়বার আক্রমণ চলাকালে বিল্লাল চরম নিষ্ঠুরতার পরিচয় দেন। খায়বারের ইহুদী গ্রামে হামলা শেষে ইহুদী নারীদের যখন মুসলমান যোদ্ধাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়, তখন এক ইহুদী সর্দারের স্ত্রীকে হযরত মুহম্মদের (সাঃ) সামনে আনতে আদেশ দেওয়া হয়। হযরত বিল্লাল সেই হতভাগী ইহুদী সর্দারের স্ত্রী সাফিয়া ও তার বোনকে টেনে হিছড়ে আনতে থাকেন তাদেরই মৃত বাবা ভাই ও স্বামীদের নিথর দেহের সামনে দিয়ে। এই নির্মমতা দেখে সাফিয়ার সেই বোন চিৎকার করে বিলাপ করতে থাকেন। (দেখুন সীরাতুন নবী, ইবনে হিশাম, খায়বার অধ্যায়)

এরকম নিষ্ঠুরতা করতে বিল্লালের বাধেনি যিনি নিজে এক সময় দাস ছিলেন। এমন একটি চরিত্র কেমন করে হিরো হয়? ইসলামের পূর্বে আমরা দেখি নারীরা স্বাধীন ছিলো। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হযরত খাদিজার জীবন। তিনি ছিলেন স্বাধীন ব্যবসায়ী এবং হযরত মুহম্মদের (সাঃ) কর্ত্রী। কিন্তু ইসলামবাদ এসে কি বাস্তবে নারীকে পুরুষের অধীন করে দিল না? অথচ নানা রকমভাবে একটা প্রচার চালু আছে সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামের বার্তা একান্তই সাম্যের। এই অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রটি কি সেই অপপ্রচারের একটি অংশ মাত্র নয়?

ফীচার: লেখক স্বয়ং। ফেসবুক থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত।