আলো ও আঁধার

0
7867

চারদিক ঘোর অন্ধকারে ডুবে আছে। তারই মাঝে চোখ মেলে তাকায় সঞ্জিৎ। এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে নেয় একবার। কোনো কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছেনা। অন্ধকারের এই সাগরের মাঝেই হাতরে হাতরে পার পেতে চাইছে। কিসের যেন একটা শব্দ হচ্ছে। ঝিঝি পোকা? তাই হবে। ক্রমাগত একটা ঝিনঝিনঝিন শব্দ হয়ে চলেছে। খুব শ্রুতিমধুর না হলেও এই নিস্তব্ধ আঁধারের মাঝে ঝিঝির ডাকটাই তাকে প্রাণের অস্তিত্বের বার্তা দিচ্ছে। সে জীবিত। কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত সঞ্জিৎ বিছানা থেকে উঠে আলোটা জ্বেলে নিলো। তারপর বাম দিকে ঘাড় ঘোরাতেই চোখ পরল টেবিলের দিকে। দুই জোড়া চোখ একে অপরের দিকে চেয়ে আছে। এক জোড়া চোখ বেশ বড় এবং নীল। সেই বেড়ালের দৃষ্টি আরেক জোড়া লাল চোখের উপর, যা থেমেথেমে জ্বলছে ও নিভছে। সেটা এক ইঁদুর। এই দুই জোড়া চোখের সম্পর্ক অতি গভীর এবং আদিমতম – খাদ্য ও খাদকের, ভয় ও ক্ষুধার।

ঝিঝির শব্দটির উৎস কোথায়? তাকে খুঁজে পেতে হবে, নাহলে একাকি সে এই অতল আঁধারে নিঃসঙ্গতার আঘাতে শেষ হয়ে যাবে। ভাবতে ভাবতে এদিক ওদিক তাকাতেই সঞ্জিৎ দেখল একটা বড় ঝিঝিপোকা তার খাটের উল্টোপাশের টুলের উপর আওয়াজ করে চলেছে। সে আশ্বস্ত হয়। নিঃশ্বাস ছেড়ে সেদিকে গিয়ে পোকাটাকে তুলে আবার যথাস্থানে রাখতেই শব্দ বন্ধ হয়ে যায়। সে বসে পরল। কোনো একটা বিষয়ে ভাবতে চাইল কিন্তু মনযোগ দিতে পারল না। ঘরের মাঝে বসে থাকতেও ভালো লাগছেনা। পুরো ঘরটা যেন কেমন অদ্ভুত এবং অস্বস্তিকর হয়ে উঠছে গরমে। সঞ্জিৎ দরজা খুলে দেয়। সাথে সাথে এক গুচ্ছ বাতাস এসে ঘরে ঢুকল। বড়ই শীতল ও মনোরম সে বাতাস। ঘরময় গুমোট ভাবটা তাতে কেটে গেলো। সাথে তার অস্বস্তি আরও কিছুটা দূর হলো। তবে উন্মুক্ত প্রকৃতির মাঝে যে স্বস্তি তা বদ্ধ ঘরে কোথায়? সঞ্জিৎ বাইরে পা বাড়ায়। কিন্তু এ কি? সে পরে যাচ্ছে কেন? নীচে তাকিয়ে দেখল সে প্রায় ১০০ ফুট উঁচু থেকে অসংখ্য শুষ্ক ভাসমান পাতার রাশি ভেদ করে এক হালকা কাঠের টুকরোর মতো ভেসে ভেসে পরছে। একটু পরেই ধুপ করে শব্দ হলো। সঞ্জিৎ এসে পরল মাটিতে। ব্যথা এতটুকুও পেলো না সে। কিন্তু হঠাৎ সমুদ্র আসল কোথা থেকে? তারপরেই মনে পরল যে সমুদ্রের পাশে বাড়ি বানিয়ে থাকার তার অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল। সেটাই হয়তো পূরণ হয়েছে কদিন আগে। কতদিন তা সে মনে করতে পারল না। সমুদ্রের ধার বেয়ে সে এগিয়ে চলল।

চলতে চলতে এক অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য তার চোখের সামনে ভেসে আসল।

সে দেখল এক গগনবিদীর্ণরত পাহাড়, তাতে জমাটবাঁধা তুষার। একে আরও সুন্দর করেছে উপর দিয়ে ছুটে চলা, ক্রোড়ে অসংখ্য নক্ষত্রমন্ডলীকে ধারণ করা অনন্ত আকাশ। তার মাঝে স্থিত আকাশগঙ্গা যেন মহাকাশেরও আগে ছুটে চলতে চাইছে। তার মাঝে উজ্জ্বল পীতবর্ণের এক আলোক-বিচ্ছুরণ দেখা যাচ্ছে। তারও একটু দূরে আরও উজ্জ্বল তারারা জ্বলজ্বল করছে, দূরদূরান্তের পথকে করছে আলোকিত। চারদিক শুধু আলো আর আলো – আলোকময় ব্রহ্মান্ড। আহ্! এমন দৃশ্য কোনোদিন দেখেনি সে। মহাশূণ্য থেকে লাফিয়ে এই দৃশ্যে মিশে যেতে মন চাইছে তার। সঞ্জিতের চোখেমুখে এক স্বর্গীয় আনন্দের ছাপ ফুটে উঠে। কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হলোনা! কোনো এক অজানা কারণবশত এক এক করে সমস্ত আকাশ,নক্ষত্র দূরে উল্টোদিকে চলে যাচ্ছে তার কাছ থেকে! এ কি??

সঞ্জিৎ ধেয়ে যায় সেদিকে- হারানোকে পুনর্প্রাপ্তির ব্যর্থ চেষ্টা করে। কিছু দূর এগোতেই সে নীচু হয়ে হাঁপাতে লাগল। উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই সমু্দ্রের ধার বেয়ে গড়ে ওঠা বাড়িঘরগুলির দিকে দৃষ্টি পরে। বড়ই অদ্ভুত ঘরবাড়িগুলো। চ্যাপ্টা হয়ে গুটিয়ে আছে সব। দেখতে যেন চারদিক থেকে হাতুড়ি দিয়ে মেরে দুমরে রাখা এক গাদা টিনের কৌটোর মতো। সেখানের গাছপালার অবস্থাও তথৈবচ। এখান দিয়ে যতদূর এগোচ্ছে ততই আধার ঘনাচ্ছে আর এই একই দৃশ্য বারবার চোখে পরছে। কি করে হলো এমন? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল সঞ্জিৎ।

সঞ্জিৎ আরও একটু দূর যখন এগোয় তখন কোথা থেকে তীব্র আলো তার চোখে এসে পরল। ক্ষণিকের জন্য চোখ বুজে গেলো। তাকিয়ে দেখল সমুদ্রের মাঝে একটি জ্বলন্ত বাড়ি। বাড়িটির আয়তন বিশাল। দেখে মনে হচ্ছে সারা শরীরে আগুন মাখা এক দৈত্য দূরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে, যার দুচোখ, মুখ ভয়ংকর ভাবে জ্বলছ এবং থেমে থেমে ড্রাগনের মতো আগুন উগড়ে দিচ্ছে। যেন সতর্ক করছে – আমার কাছে আসিস না, জ্বলে শেষ হয়ে যাবি।

বাড়িটির ছাদ নেই। সম্ভবত উড়ে গেছে। সেদিক দিয়ে বের হচ্ছে নিকষ কালো ধোঁয়া। ধোঁয়ার সাথে সাথে উড়ে যাচ্ছে অসংখ্য বই, পুঁথিপত্র ইত্যাদি। উড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে দিগন্তে। কারা করছে এসব?

সঞ্জিৎ কিছুই বুঝতে পারল না। সে শুধু নির্বোধের মতো হা করে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। তার একটু কাছেই সঞ্জিৎ দেখল তার বন্ধু বীরেশকে। একটি বেঞ্চে বসে আছে একাকি। সঞ্জিতের মনে পরল যে এই সম্বন্ধে বীরেশ তাকে আগে বলেছিল। সঞ্জিৎ তখন বিশ্বাস করেনি। বীরেশ সঞ্জিতের দিকে ঘুরে তাকায়। কিন্তু সে হাসছে কেন? জিজ্ঞেস করার আগেই সেও হঠাৎ উধাও হয়ে গেলো।

এদিক ওদিক তাকিয়েও আর তাকে পাওয়া গেলো না। তখনই কে যেন সঞ্জিতকে নাম ধরে ডাকে। এক নারীকন্ঠ! সেই ডাকে রয়েছে করুণামিশ্রিত গাম্ভীর্য। অনেকটা তার মার মতো। মনে হলো সমুদ্রের ভেতর থেকে শব্দটা আসল। সেই শব্দের ক্ষীণ প্রতিধ্বনি আরও কবার শোনা গেলো। সমুদ্রের ঢেউগুলির বিভিন্ন অংশ ছিটকে ছিটকে বের হচ্ছে! সমস্তটা একটা জায়গায় এসে জমা হয়ে খাচ্ছে ঘূর্ণিপাক। সঞ্জিতের চোখের সামনে সেই ঘূর্ণন বদলে গেলো এক বিরাট করালবদনী মূর্তিতে। সঞ্জিৎ কিছুটা ভয় পেয়ে যায়।

সে দেখল মূর্তিটি তার দিকে এগিয়ে আসছে হাসতে হাসতে। সঞ্জিৎ চেয়েও যেন পিছিয়ে যেতে পারছে না। মূর্তিটি তার সামনে এসে দাঁড়ায়। ভীষণ মূর্তিটির চুল এলোমেলো, বায়ুহীন এই পরিবেশেও উড়ছে চতুর্দিকে। তার ছায়া সঞ্জিৎ সহ আশেপাশের একটা বড় অংশকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ‘মাকে দেখে ভয় পেতে আছে রে বোকা ছেলে?’ মূর্তিটি বলে।

-তুমি? আমি যে তোমাকে মানিনি কখনও! কেন এসেছ তবে?

অবাক সঞ্জিৎ মূর্তির সম্মুখে চেয়ে ভাবগম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করে। তার মন থেকে প্রাথমিক ভয়টাও দূর হয়ে যায়।

মূর্তিটি ম্লান হেসে বলে

– তুই মানিস না তো কি? ওরা তো মানে। ওদিক দ্যাখ তো একবার।

সঞ্জিৎ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখল তার মা,বাবা,ভাই,বোন দাঁড়িয়ে আছে দূরে। সঞ্জিতের দিকে তাকিয়ে তারা মৃদু হাসছে।

মূর্তিটি আবার বলল, একটু অন্যমনস্ক মতো হয়ে ‘আর ওরাও মানত। যাদের ঘর ভেঙে গেছে, পুড়ে গেছে…যেখান থেকে হাজার হাজার পুঁথিপত্র,বই উড়ে গেলো। দেখতে পাসনি?’

সঞ্জিৎ অস্ফুটস্বরে শুধু ‘হ্যাঁ’ বলল।

‘তাহলে এগিয়ে গেলি না যে বাছা? আমার ঘর যখন ভাঙল তখন না হয় আমার প্রতি অবিশ্বাসের দরুণ এগোস নি… কিন্তু এদেরও কি মানিস না?’

সঞ্জিতের চোখের সামনে অল্প আগে দেখা সেই অগ্নিময় দৃশ্যগুলো আবার ভেসে আসল।

সে জিজ্ঞেস করল ‘ওরা তো আমাকে ডাকেনি। তুমি ওদের বাঁচাতে পারলে না? আর নিজের ঘরটুকু? সেও..

সঞ্জিৎ শেষ করার আগেই মূর্তিটি হো হো করে হেসে উঠল

‘ওরে পাগল ছেলে। আমার আবার ঘর কি রে? ওটা তোদেরই বানানো। আর তোদেরই শত্রুর হাতে ভাঙা পরেছে। আমাকে কেউ মারতে,বাঁচাতে পারেনা। তোদের বানানো আমার প্রতিরূপ তোরাই রক্ষা করতে পারিসনি। আমার কি দায়? আজ তোরা এগোবিনা, সাত সমুদ্র পারের অন্য কেউ এ কাজ করবে। আমি না হয় সেখানেই বিরাজ করব। কিন্তু তোরা? কি করবি ভেবেছিস?’

সঞ্জিৎ চিন্তায় পরল। প্রশ্নগুলো কঠিন।

‘তুই কি দুনিয়ায় একা থাকিস? আমার কথা ছাড়, বাকিদের প্রতি দায়বোধও নেই?’

কথা বলতে বলতে মূর্তিটি অন্যদিকে দৃষ্টি দেয়। তার সাথে সাথে সঞ্জিৎ ও তাকালো সেদিকে। দেখল তার পরিবার সরে সরে শূণ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। সঞ্জিৎ চিৎকার করে উঠে ‘নাআআ…’। সেদিকে দৌড়ে যেতে চাইল সে। কিন্তু দেখল সবাই যে যার জায়গাতেই দাঁড়িয়ে। কেউ কোথাও হারায়নি।

মূর্তির দিকে চেয়ে কাঁপা গলায় করুণ স্বরে সঞ্জিৎ বলে ‘আমি এসব কিছুই বুঝছি না যে!’

‘ওরা তো ডাকেনি তোকে? তবে ছুটছিলি যে?’ বলে মূর্তিটি আরও কাছে এগিয়ে আসল। সঞ্জিতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো অল্প। সাথে সাথে সঞ্জিতের সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো। মন থেকে সমস্ত ভয়, আশঙ্কা, উদ্বেগ নিমেশে উধাও।

‘হাতে দে’ মূর্তিটি বলল।

সঞ্জিৎ দুহাত পেতে এগিয়ে দেয়। করালবদনী তার হাতের অস্ত্রটি সঞ্জিতের হাতে তুলে দেয়। সেটা উঁচু করে ধরে সঞ্জিৎ। ক্ষীণালোকেও অস্ত্রটি বেশ ঝলমল করছে। তখনই তার সামনে সমুদ্রের প্রকান্ড ঢেউ উঠে এসে থেমে যায়। তাতে সঞ্জিৎ নিজেরই প্রতিবিম্ব দেখতে পেলো। সে দেখল আরেক সঞ্জিৎ দাঁড়িয়ে, তার হাতে অস্ত্র,মাথায় মুকুট, দৃষ্টি দৃঢ়।

করালমূর্তিটি এবার পিছিয়ে যাচ্ছে। সাথে নিয়ে যাচ্ছে তার প্রকান্ড ছায়া। সঞ্জিৎকে জোরে জোরে বলছে ‘ বলো বীর.. বলো উন্নত মম শির’। একই কথা বার বার বলে চলল মূর্তিটি। প্রথমে জোরে, পরে ধীরে ধীরে ক্ষীণ হতে থাকল সেই আহ্বান। একসময় জমাট বাঁধা প্রজাপতির ঝাঁকে ঢিল পরলে ঝাঁকটি যেমন হারিয়ে যায় তেমনি মূর্তিটি মিলিয়ে গেলো শূণ্যে।

সঞ্জিৎ ঘেমে উঠে পড়ে বিছানা থেকে।

 

ফীচার: লেখক।