শ্রীরামকৃষ্ণ ও পরিবেশ

0
737
sri ramkrishna

শ্রীরামকৃষ্ণ কি পরিবেশ নিয়ে ভাবতেন? কিছু বলে গেছেন?
এসব কথায় ঢোকার আগে বলে নেওয়া উচিত যে পরিবেশ বলতে আমরা যা ভাবি তা একেবারের একটি সাম্প্রতিক ভাবনা। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত বঙ্গীয় শব্দকোষে (প্রথম প্রকাশ ১৯৩৪) পরিবেশ শব্দের অর্থ ‘বেষ্টন, পরিবৃতি’। সংসদ বাঙ্গালা অভিধানের চতুর্থ সংস্করণে (১৯৮৪) পরিবেশ কথার শব্দের অর্থে অতিরিক্ত যুক্ত হচ্ছে ‘পারিপার্শ্বিক আবহাওয়া (পরিবেশ-দূষণ)’। আজ থেকে অর্ধ শতক আগেও পরিবেশ বলতে প্রকৃতিকেই বোঝাত। এখন আমরা পরিবেশ বলতে বুঝি আমাদের চারপাশের পৃথিবীকে – জীব ও জড় সবাইকে নিয়েই। আর চিন্তাটা থাকে এই পরিবেশকে কেউ দূষিত করছে কিনা। প্রকৃতিকে নিজের মত ব্যবহারে মানুষ তৈরী করে নিজস্ব পরিবেশ। প্রকৃতি স্বয়ম্ভু, পরিবেশ তৈরী করা হয়। এই পরিবেশ একটি মানবিক ধারণা।
মানুষের প্রাথমিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে প্রকৃতির সঙ্গেই। ছয় বছরের বালক গদাধর চলেছে কামারপুকুর গ্রামের মেঠো পথে। আকাশ ঢেকে এলো কালমেঘে। সেই কালোমেঘের আকাশে উড়ে এলো শ্বেতশুভ্র বকের সারি। গদাধর তা দেখতে দেখতে বাহ্যজ্ঞান হারালেন। গদাধর পরে শ্রীরামকৃষ্ণ হবেন এবং তাঁর ভক্তদের মতে এটাই তার প্রথম ভাবসমাধি। ঘটনাটি আমাদের আলোচনার জন্য একটু গুরুত্বপূর্ণ। বালক গদাধর কামারপুকুর ও আশপাশের গ্রামের মন্দিরে ঘুরে বেড়াতেন, সাধু দেখলেই সেখানে বসে যেতেন। কিন্তু বালকের ভাবসমাধি হচ্ছে কোন কালী মূর্তি বা শিব মূর্তি দেখে নয়, হচ্ছে প্রকৃতির রূপ দেখে। বিভুতিভূষণের ‘আরণ্যক’ মনে করাচ্ছে – ‘দিন যতই যাইতে লাগিল, জঙ্গলের মোহ ততই আমাকে ক্রমে পাইয়া বসিল। এর নির্জনতা ও অপরাহ্নের সিঁদূর – ছড়ানো জঙ্গলে কি আকর্ষণ আছে বলিতে পারি না – আজকাল ক্রমশ মনে হয় এই দিগন্তব্যাপী বিশাল বনপ্রান্ত্র ছাড়িয়া, ইহার বোদপোড়া মাটির তজা সুগন্ধ, এই স্বাধীনতা, এই মুক্তি ছাড়িয়া কলিকাতার গোলমালের মধ্যে আর ফিরিতে পারিব না।‘ গদাধরও যেন সেই বালকবেলা থেকেই প্রকৃতির মধ্যেই নিজেকে খুঁজে পেতে থাকলেন।
এবার ঢোকা যাক ধর্মের কথায়। ধর্ম ছাড়া শ্রীরামকৃষ্ণ নিয়ে কথা বলা যাবে না। আবার ধর্মের সঙ্গে প্রকৃতি ভাবনার সম্পর্কও রয়েছে। আজকাল এটাই নিদান যে বলতে হবে সব ধর্ম সমান, সব ধর্মেই একই ঈশ্বরের কথা রয়েছে ইত্যাদি। সংঘ পরিবার থেকে ইসকন- সবাই এ ব্যাপারে এক। এ প্রসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের ‘যত মত তত পথ’ বহু উচ্চারিত। এর প্রমাণ শ্রীম বা মহেন্দ্রলাল গুপ্ত লিখিত ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’-এ কিছু আলোচনা এবং পরে সেই প্রসঙ্গে ভক্তদের পুনরাবৃত্তি। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে ফেব্রুয়ারি নিউ ইয়র্কে স্বামী বিবেকানন্দ এক ভাষণে এই ব্যাপারে বিশদে বলেন ‘এইভাবে নিজে প্রত্যক্ষ করিয়া তিনি জানিতে পারিলেন, যে প্রত্যেক ধর্মেরই উদ্দেশ্য এক, সকলেই সেই একই বস্তু শিক্ষা দিতেছে – প্রভেদ প্রধানতঃ সাধন প্রণালীতে, আরও অধিক প্রভেদ ভাষায়। মূলতঃ সকল সম্প্রদায় ও সকক ধর্মের উদ্দেশ্য এক’। বিবেকানন্দ অবশ্য শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখেছেন তাঁর জীবনের শেষ মাত্র বছর পাঁচেক। ফলে এইসব ধর্মচর্চা তাঁর শোনা কথা যার প্রধান উৎস শ্রীরামকৃষ্ণের ভাগিনেয় হৃদয়রাম মুখোপধ্যায় বা হৃদে। আর এই সব ধর্ম একের কথাটি আরো ছড়িয়েছে কারণ ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’-এ ঠাকুর বলছেন পুকুরের চারটি ঘাটে হিন্দুরা জল খাচ্ছে, মুসলমানরা পানি, ইংরাজরা ওয়াটার আর অন্যরা অ্যাকোয়া। গল্পটি সম্ভবতঃ শ্রীম-র কল্পনা প্রসূত। কারণ শ্রীরামকৃষ্ণ ‘অ্যাকোয়া’ বলবেন এটি একেবারের অবাস্তব। মনে রাখতে হবে ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’ শ্রীম নোট খাতা থেকে পরে বিস্তৃত করে লিখেছেন কুড়ি থেকে ত্রিশ বছর পরে। এই নোট খাতার পৃষ্ঠাগুলির কোন ফটো কপি দেখতে পাওয়া যায় না। যে একটি দুটি পৃষ্ঠা জনসমক্ষে এসেছে তাতে দেখা যায় খুব সামান্য কয়েকটি কথা তাতে লেখা থাকে। তা থেকে পরে এত কথা শ্রীরামকৃষ্ণের মুখে বসান হয়েছে এত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে যে এর সত্যতা প্রশ্ন উদ্রেক করে। শ্রীম রোজ দক্ষিণেশ্বর যেতেন না, পরে হৃদের কাছ থেকে শুনে সেসব কাহিনী নিজের মত লিখতেন। শ্রীরামকৃষ্ণের বিভিন্ন ধর্ম সাধনার বিকট বাড়াবাড়ি তারই ফল মনে হয়। ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’-তেও কয়েকবার যে ঈশ্বর সাধনার বিভিন্ন পথের কথা ঠাকুরের মুখ দিয়ে বলা আছে তা হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন শাখার বিভিন্ন পথের কথাই বলা হয়েছে।
রামকৃষ্ণ কালিমায়ের সাধক হলেও তাঁর সঙ্গে হিন্দু রক্ষণশীল সমাজের তৎকালীন নেতাদের সাক্ষাতের তেমন বিবরণ পাওয়া যায় না। তাঁর বেশি যাতায়াত ছিল ব্রাহ্মদের মধ্যে। ব্রাহ্ম নেতা কেশব সেন প্রায় তাঁর ভক্তের মতনই। এই ব্রাহ্মদের সংস্পর্শে এসে তিনি কিছু খ্রিস্টান ধর্মকথা শোনেন যদিও তাঁর তা তেমন ভাল লাগে নি। কোরান হাদিশের কথা রামকৃষ্ণের মুখে শোনা যায় নি। তবে যীশুখ্রীস্টকে তিনি অবতার বলেছেন কয়েকবার। এটা হিন্দুধর্মের বৈশিষ্ট, যেভাবে ঈশ্বরহীন ধর্মের প্রচারক গৌতম বুদ্ধ হিন্দু অবতার হয়ে গেছেন। যেহেতু ব্রাহ্মরা কেউ কেউ উপনিষদ, বাইবেল কোরান – সব কিছুর ভাল নিয়ে ধর্ম গড়ার কহা বলতেন ফলে পরবর্তীকালে ভক্তরা রামকৃষ্ণকে সব ধর্ম সমন্বয়ের গুরু বানিয়ে দিয়েছেন। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকের থেকেই ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদে হিন্দু মুসলমানকে এক করবার প্রচেষ্টা শুরু হয়ে যায়। ফলে ব্রাহ্মধর্মের ও জাতীয়তাবাদের প্রভাবে বাংলার বুদ্ধিজীবিদের ধর্মগুলিকে এক করে দেখানোর প্রচেষ্টার শুরু হয়। বিবেকানন্দ-র ১৮৯৬-র ভাষণ তারই প্রকাশ। কিন্তু সেই বিবেকানন্দই ১৮৯৮ সালে সখন বেলুড় শ্রীরামকৃষ্ণ মঠের নিয়মাবলী প্রস্তুত করেন তাতে লেখেন – ‘এই হিন্দু জাতি ও ধর্ম্মের রক্ষার জন্যই করুণাবতার শ্রীরামকৃষ্ণদেব অবতীর্ণ হইয়াছেন’। বা মুসলমান ও খ্রীষ্টানদিগকেও হিন্দু ধর্ম্মে আনিবার বিশেষ উদ্যোগ করিতে হইবে। কিন্তু উপনয়নাদি সংস্কার কিছুদিনের মধ্যে হওয়ার আবশ্যক নাই।‘ সুতরাং ‘সব ধর্ম এক’ – এই মিথ্যা বাক্যটির সাধনা আমাদের অনেক ক্ষতি করেছে ও এখনো করে চলেছে। এই ক্ষতিতে রামকৃষ্ণ মিশনের অবদান খুব গুরুত্বপূরণ। রামকৃষ্ণ মিশন তাদের ধনসম্পদ রক্ষা ও বৃদ্ধিতে এতটাই অধঃপতিত যে নিজেদের হিন্দু বলে অস্বীকার করেছে। বাঙালি হিন্দু উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত লক্ষ লক্ষ এখনো রামকৃষ্ণ মিশন দ্বারা প্রতারিত হচ্ছেন। হিন্দুর আশা ধর্মাচরণের মাধ্যমে মৃত্যুর পর স্বর্গলোকে স্থান পাওয়া। কিন্তু রামকৃষ্ণ মিশনের ভক্তরা এখন মৃত্যুর পর স্থান পাচ্ছেন নব আবিষ্কৃত ‘রামকৃষ্ণলোকে’!!
কিন্তু রামকৃষ্ণের ধর্মের সঙ্গে প্রকৃতি পরিবেশের কি সম্পর্ক? আছে। পৃথিবীর ধর্মগুলি মোটামুটি দুই ধরণের – প্রাকৃতিক ধর্মের ও উদ্ভাসিত ধর্মের। প্রাকৃতিক ধর্মগুলি মানুষের প্রথম ঈশ্বরের সন্ধান। প্রাকৃতিক ধর্মগুলি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকমের। যেমন বিভিন্ন স্থানের আদিবাসীরা বিভিন্ন ধরণের দেবতার বিশ্বাস করেন। এই দেবদেবীরা বিভিন্ন ধরণের প্রাকৃতিক শক্তির যেমন সূর্য, চন্দ্র, জল, সমুদ্র বা বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিনিধি হিসাবে বিরাজ করেন। প্রকৃতি সম্পর্কে মানুষের শুরু থেকেই ভীতি-মিশ্রিত একটি শ্রদ্দার ভাব রয়েছে, প্রকৃতি-উপাসনা প্রাচীন ধর্মেরই অঙ্গ। প্রাচীন সভ্যতার অনেকগুলিই লিখিত বিবরণ না থাকায় সবক্ষেত্রে প্রকৃতি উপাসনার বিশদ আমরা জানতে পারি না। তবে শিলালিপিতে সূর্য চন্দ্র ইত্যাদির উপস্থিতি জানিয়ে দেয় যে প্রকৃতির শক্তিগুলির প্রতি তাদের সম্মান জ্ঞাপনের কথা। যেসব সভ্যতার ভাষা পড়া গেছে সেগুলি জানিয়েছে প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক শক্তির সঙ্গে মানব সভ্যতার আত্মিক যোগের কথা। পাঁচ হাজার বছর আগের মিশরের সভ্যতায় প্রাকৃতিক শক্তি, পশু পাখীরা দেবতার সম্মান পেয়ে এসেছে। মিশরীয় সভ্যতায় অনেক রকমের দেবদেবী শৃগাল থেকে সূর্য – সবারই স্থান ছিল। প্রায় সমপ্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতার প্রধান দেবী ছিলেন পৃথিবী ও দেবতা ছিলেন আকাশ। পৃথিবীর দুটি প্রাচীনতম সভ্যতা এখনো চলমান রয়েছে চীন ও ভারতে। চিনের সভ্যতায় প্রকৃতি ভাবনা এসেছে শক্তির রূপ ধরে। ভগবান দেবদেবী সেখানে প্রধান হয়ে ওঠেনি, ধর্ম সেখানে জীবনযাত্রার দিশা। চিনের দুটি প্রধান মতবাদের গুরু কনফুসিয়াস এবং লাওৎসে। সেখানে প্রকৃতির দুটি শক্তি ইন ও ইয়াং – শুভ ও অশুভ, কখনো তা পুরুষ ও প্রকৃতি এবং পঞ্চবস্তু দিয়ে জীবন ও জগতের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। এই পঞ্চবস্তু হল জল, কাঠ, আগুন, ধাতু ও পৃথিবী বা মাটি।
ভারতীয় সভ্যতার শুরু পাঁচ হাজার বছরের পুরানো সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতায়। এই সভ্যতার লিপি এখনো পড়া যায় নি ফলে অনেক কিছুই অজানা। তবে মহেনজোদারোতে পাওয়া গেছে এক দেবতার ছবি যার মাথায় শিং এবং তিনি পশুপরিবৃত। একেই মনে করা হচ্ছে আদি পশুপতি। এর পর আর্য সভ্যতা। সাড়ে তিন হাজার বছর আগে রচিত ঋগ্বেদ প্রাচীনতম লিখিত সাহিত্য। ঋগ্বেদে আমরা পাই সূর্য চন্দ্র, বৃষ্টির দেবতা বরুণ ও কৃষির দেবতা ক্ষেত্রপতির বর্ণনা ও বন্দনা। ঋগ্বেদে বলা হচ্ছে –
চিত্রং দেবানামুদগাদনীকং চক্ষুমিত্রস্য বরুণসাগ্নেঃ
আপ্রা দ্যাবাপৃথিবী অন্তরিক্ষং সূর্য আত্মা জগতস্তসথুষশ্চ।।

পৃথিবী ও প্রকৃতির জন্য মানুষের শ্রদ্ধার কাব্যময় প্রকাশ ঘটেছে অথর্ব বেদের পৃথিবীসূক্ত মন্ত্রগুলিতে। পৃথিবী পূজিত হচ্ছেন তার অকৃপণ শস্য ও জল দানের জন্য তার অপার সৌন্দর্যের জন্য, তার ক্রোড়ে বিভিন্ন ধরণের মানুষ, পশুপাখী সবাইকে আশ্রয় দেবার জন্য। বৌদ্ধ ধর্মে কোন মহান ইশ্বর নেই বা বৈদিক প্রকৃতি বন্দনা নেই কিন্তু আছে সব জীবের প্রতি করূণা ও সহমর্মিতার কথা। সব্বে সুখিতা হোন্তু, সুখী অত্তানং পরিহবন্তু – সবাই সুখী হোক, শত্রুহীন হোক – এই সবাই অর্থ পুরো প্রাণী জগতটাই। বুদ্ধের বিভিন্নবার জন্মের গল্প হল জাতককাহিনী যেখানে তিনি পশুপাখি রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পশুপাখি কেউ মনুষ্যেতর নয়। এছাড়া বিভিন্ন জাতকে রয়েছে বৃক্ষদেবতার কথা। বোধিবৃক্ষ তাই চিরপূজ্য।
উদ্ভাসিত ধর্মের ব্যাপারটা একেবারেই আলাদা। এখানে প্রকৃতির কোন ভূমিকা নেই। এখানে ঈশ্বর কোন এক মানব সন্তানের বা সন্তানদের কাছে উদ্ভাসিত হয়ে বিভিন্ন জ্ঞান দান করছেন। এই ঈশ্বর সর্বশক্তিমান। একক। প্রাকৃতিক ধর্মে অনেক দেবতা, অনেক ঈশ্বর। কিন্তু উদ্ভাসিত ধর্ম খ্রিস্টান বা ইসলামে ঈশ্বরের কথা বলবার জন্য রয়েছেন ঈশ্বরপুত্র বা তাঁর মানব দূতেরা। এই ধর্মগুলিতে রয়েছেন এই সর্বশক্তিমান ঈশ্বর – যিনি প্রাকৃতিক শক্তিগুলিরও সর্বময় কর্তা। উপনিষদের একমোবদ্বিতীয়ম ব্রহ্মর সঙ্গে আল্লা বা গডের কোন মিল নেই। এইসব ধর্মগুলিতে প্রকৃতি ঈশ্বরের দাস। ঈশ্বর বললেন তবেই পৃথিবী আলোকিত হল। প্রকৃতির নিজস্ব ভূমিকা শেষ হলো। বাইবেলে এই ইশ্বর বললেন যে আমাদের চেহারার মতো করে মানুষকে বানাও আর পৃথিবীর যাবৎ প্রাণী উদ্ভিদের মালিক হবে মানুষ। মানুষ প্রকৃতির আত্মিক সংযোগ শেষ হলো।
শ্রীরামকৃষ্ণকে যখনই সর্ব ধর্ম সমন্বয় করে অহিন্দু বানানো হবে তখনই তাঁর প্রকৃতি প্রেমিকের সত্বটি শেষ হয়ে যাবে। আর তাহলে আমাদের চেনা রামকৃষ্ণ থাকবে না।
‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’-র একেবারের শুরুতে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের চারপাশের বর্ণনা রয়েছে। সেখানের বাগানের বিশদে বর্ণনাও রয়েছে। তারপরেই জানানো হচ্ছে – ‘শ্রীরামকৃষ্ণও এককালে পুষ্পচয়ন করিতেন। একদিন পঞ্চবটীর সম্মুখস্থ একটি বিল্ববৃক্ষ হইতে বিল্বপত্র চয়ন করিতেছিলেন। বিল্বপত্র তুলিতে গিয়া গাছের খানিকটা ছাল উঠিয়া গেল। তখন তাঁহার এইরূপ অনুভুতি হইলে যে, যিনি সর্বভুতে আছেন তাঁর না জানি কত কষ্ট হইল। অমনি আর বিল্বপত্র তুলিতে পারিলেন না। আর একদিন পুষ্পচয়ন করিবার জন্য বিচরণ করিতেছিলেন, এমন সময় কে যেন দেখাইয়া দিল যে, কুসুমিত বৃক্ষগুলি যেন এক একটি ফুলের তোড়া, এই বিরাট শিবমূর্তির উপর শোভা পাইতেছে – যেন তাঁহারই অর্হনিশি পূজা হইতেছে। সেই দিন হইতে আর ফুল তোলা হইল না’।
এই যে সর্ববস্তুতে এই সর্বপ্রাণের দর্শন – এই দর্শনই একমাত্র প্রকৃতি প্রেমের জন্ম দিতে পারে। ঈশোপনিষদে আছে –
যস্তু সর্বানি ভুতান্যাত্মন্যেবানুপশ্যতি।
সর্বভুতেষু চাত্মানং ততো ন বিজুগুপ্সতে।।

যিনি সমুদয় বস্তুই আত্মাতে এবং সমুদয় বস্তুতেই আত্মাকে দেখেন, তিনি সেই দর্শনের বলেই কাহাকেও ঘৃণা করেন না।
‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’-এ শ্রীরামকৃষ্ণ বিভিন্ন বিষয়ের সরল ব্যাখ্যায় বারংবার ফিরে গেছেন প্রকৃতির বিভিন্ন উদাহরণে। বলছেন – ‘কচ্ছপ জলে চরে বেড়ায় কিন্তু তার মন কোথায় পড়ে আছে জান? – আড়ায় পড়ে আছে। সেখানে তার ডিমগুলি আছে। সংসারের সব কর্ম করবে কিন্তু ঈশ্বরে মন ফেলে রাখবে’।
নরেন্দ্র সম্পর্কে বলছেন – ‘দেখ চাষারা হাটে গরু কিনতে যায়; তারা ভাল গরু, মন্দ গরু বেশ চেনে। ল্যাজের নীচে হাত দিয়ে দেখে। কোনও গরু ল্যাজে হাত দিলে শুয়ে পড়ে, সে গরু কেনে না। যে গরু ল্যাজে হাত দিলে তিড়িং-মিড়িং করে লাফিয়ে উঠে সেই গরুকেই পছন্দ করে। নরেন্দ্র সেই গরুর জাত, ভিতরে খুব তেজ’।
অবশ্য কেউ বলতেই পারেন যে যেহেতু শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথাগত শিক্ষা বেশি ছিল না, মূলতঃ গ্রামীন মানুষ, ফলে তাঁর কথাবার্তায় এই ধরণের সাধারণ জীবন থেকে তুলে নেওয়া উদাহরণ স্বাভাবিক। এধরণে উদাহরণ অন্যান্য দেশজ প্রথাগত শিক্ষিত নয় এমন ধর্মীয় গুরুদের থেকেও পাওয়া যাবে। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক ধর্ম ও উদ্ভাসিত ধর্মের ধর্মগুরুদের মধ্যে তফাৎ করতে হবে। কথামৃতে শ্রীরামকৃষ্ণ বর্ণনা করছেন এক সাধারণ বালকের কথা – ‘সে একলা ফড়িং ধরতে যাচ্ছে। কাছে গাছে পাতা নড়ছিল। তখন পাতাকে বলছে – চুপ, চুপ। আমি ফড়িং ধরবো। বালক সব চৈতন্যময় দেখছে’। এই হচ্ছে রামকৃষ্ণের বিশ্ব তাঁর কাছে বিশ্ব চৈতন্যময়। মানুষ, ফড়িং পাতা সব এক। সেই বিশ্বচৈতন্যে প্লাবিত হতে হবে।
প্রকৃতি পরিবেশের উন্নতিতে আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে যতটা সম্ভব নিকট হতে হবে। নিজের প্রয়োজনে প্রকৃতিকে বসবাসযোগ্য করে তুলে আমরা পরিবেশ গড়ি। এই গড়ে তোলার মধ্যে প্রয়োজন মানবিকতা। মানুষ প্রকৃতিকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করবেই। তবে হতে হবে শ্রীরামকৃষ্ণের সাপের মতন – ফোঁস করবে তবে ছোবল দেবে না।

(বিশেষ ঋণ স্বীকারঃ সত্যের আলোকে যত মত ততো পথ শ্রীরামকৃষ্ণও রামকৃষ্ণ মিশন – রুদ্রপ্রতাপ চট্টোপাধ্যায়, তুহিনা পকাশনী কলকাতা, ২০০৫)