জন্ম নিয়ন্ত্রণ আইন মানেই হিন্দু নিয়ন্ত্রণ আইন

Family Planning, Population control

হিন্দুদের সাথে আইনের সম্পর্ক হল মায়ের সাথে মা-ন্যাওটা বাচ্চাদের মতন। বাচ্চা যেমন মায়ের আঁচল আঁকড়ে ধরে রাখে, হিন্দুরাও তেমন আইনের হাত ধরে পথ চলতে পছন্দ করে। আইন-সংবিধান, এসবের নাম হিন্দুরা প্রায় ইষ্টমন্ত্রের মত জপ করে। আইন যদি পক্ষপাত-দুষ্ট কিংবা অন্যায্যও হয়, তবুও হিন্দুরা তার প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না। হিন্দুদের মধ্যে থেকে যে মানসিক দাসত্ব এখনো ঘোচেনি, তার সব থেকে বড় প্রমাণ হল এই অন্ধ আইন-নির্ভরতা। যখন ট্রাফিক আইনের সংশোধনী আনল কেন্দ্রীয় সরকার, একশ্রেণীর হিন্দুদের সে কি আনন্দ! হেলমেট না পড়ার জরিমানা বেড়ে ৫০০০/- টাকা হয়েছে; অতএব এবার মুসলমানি টুপি পড়ে বাইক চালকরা বুঝবে মজা! হেলমেট নিজের ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য। কোন মানুষ নিজের ব্যক্তিগত সুরক্ষা চায় কি না, বা চাইলে ঠিক কতটা; এটা ঠিক করার মালিক সে নিজে। হেলমেট পরা বা না পরার কারণে যেহেতু অন্যদের নিরাপত্তা ব্যাহত হয় না, তাই হেলমেট না পরার জন্য জরিমানা রাখার আমি কোন অর্থ খুঁজে পাই না। সিটবেল্টের ব্যাপারেও এই একই নীতি পালনীয় হওয়া উচিত। এখন মুসলমানরা যেহেতু স্বাধীনচেতা জাতি, তাই আইন যতই কঠোর হোক না কেন, সেগুলো তাদের ছুঁতেও পারে না। জরিমানা ৫০০০/- ই হোক কি ৫০,০০০/-, ট্রাফিক পুলিশরা সচরাচর ভাইজানদের ধরার আগ্রহ দেখান না। কারণ পুলিশের সাথে বোঝাপড়া করার নানান রাস্তা ওদের জানা আছে।

এ তো গেল হেলমেট-সিটবেল্টের কথা। এরপর হিন্দুদের দাবি হল, মুসলমানরা খুব বেপরোয়া বাইক চালায়। পথে-ঘাটে বাইক নিয়ে বিপজ্জনক সব স্টান্ট করে। অতএব কড়া ট্রাফিক আইন এলে লঙ্ঘনকারীরা সব শায়েস্তা হবে। এখন পুলিশের সাথে মিঞাভাইদের যে বোঝাপড়া গুলো হেলমেটের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; সেই একই জিনিস অন্যান্য যে কোন ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ফলে কড়াস্যঃ কড়া ট্রাফিক আইন কার উপর বল দেখাবে? হিন্দুদের উপর। দুর্বল, মিনমিনে হিন্দু নিত্যনতুন যত বাঁশ খাবে এসব আইনের হাতে; ততই মনে মনে সে আত্মপ্রসাদ লাভ করবে এই ভেবে যে মুসলিমরা নিশ্চয়ই আরো বেশি বেশি করে ধরা পড়ছে। “হিন্দুর নাক কেটে মুসলমানের যাত্রাভঙ্গ” করতে চাওয়াটা যে পণ্ডশ্রম, সেটা বোঝার মত বুদ্ধি হিন্দুদের নেই। অতিরিক্ত আইন-নির্ভরতা যে দুর্বলতার নামান্তর; এই ফাঁকিবাজিটা ওয়েসী ভাইরা ঠিকই ধরেছেন। হায়দ্রাবাদ থেকে দেওয়া কুখ্যাত বক্তৃতায় আকবরউদ্দিন ওয়েসী যে বলেছেন- “১৫ মিনিটের জন্য পুলিশ-প্রশাসন সরিয়ে নাও, ২৫ কোটি মুসলমান ১০০ কোটি হিন্দুকে দেখে নেবে”; সেটা এই কারণেই। হিন্দু সংখ্যাগুরু দেশে দাঁড়িয়ে এই ধরণের হিন্দু-বিদ্বেষী কথা শুনলে, লোকের রাগ হওয়া উচিত। কিন্তু হিন্দুদের হয় আতঙ্ক। কারণ হিন্দুদের মনের সুপ্ত ভয়টাকেই মৌখিক রূপ দিয়ে ফেলেছেন ওয়েসী ভায়েরা।

আইন দিয়ে নিজের সব সমস্যার সমাধান যে করতে চায়, জীবনে তারাই সবার থেকে বেশি লাঞ্ছিত হয়। এইভাবেই হিন্দুরা জন্মনিয়ন্ত্রণ আইনের পক্ষে সমর্থন বাড়াচ্ছে। উদ্দেশ্য একটাই, সকলের জন্য দ্বিসন্তান নীতি এনে মুসলমানদের জন্মহার কমিয়ে ফেলা। অথচ আইন দিয়ে কারো জননাঙ্গ কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, এটা আমার সাধারণ বৃদ্ধিতে ঢোকে না। দুয়ের বেশি সন্তান হলে কেন্দ্র সরকার কি করবে? সরকারি চাকরি কেড়ে নেবে? রেশন বন্ধ করে দেবে, অন্যান্য সরকারি সুবিধা কেড়ে নেবে? একইরকম আইন আগে থেকেই আসামে জারি রয়েছে। এমন কি কদিন আগে তৃতীয় সন্তান জন্মের জন্য এক মুসলিম মহিলাকে সরকারি পদ থেকে বরখাস্তও করা হয়। তবে এই ব্যাপারে শেষ কথাটি আসামের প্রভাবশালী নেতা বদরুদ্দীন আজমল আগেই বলে রেখেছেন। তাঁর বক্তব্য হল- “মুসলমান সরকারি চাকরির তোয়াক্কা করে না। তাই মুসলমানরা সন্তান নেওয়া কমাবে না।”

আজমল খুব ভাল করেই জানেন যে গণতান্ত্রিক দেশে বেশি সন্তান নিলে সরকারি সুবিধা বন্ধ করা ছাড়া কেন্দ্র সরকার আর বিশেষ কিছু করতে পারবে না। আর মুসলমানদের যাকাত আছে, গরিব মুসলিমের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ আছে। অতএব মুসলিমের ঘরে অধিক সন্তানদের খাওয়া-পরার সমস্যা অতটাও হবে না সরকারি সুবিধা সত্যিই বন্ধ হয়ে গেলে। ভারতবর্ষ তো চীন নয় যে দ্বিসন্তান নীতি না মানলে কারারুদ্ধ করা বা জরিমানা করার মত কঠোর নীতি নিতে পারবে। সঞ্জয় গান্ধীও বেঁচে নেই যে দুটির বেশি সন্তান নিলেই তাদের ধরে ধরে বাধ্যতামূলক ভাবে জনন-ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হবে। আর তাছাড়া আইন কেন্দ্র সরকার বানালেও তার প্রয়োগ করবে রাজ্য সরকার। নাগরিকত্বের মত বিষয়েই যখন একাধিক রাজ্য নিজের বিধানসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনীর বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাশ করাচ্ছে; তাহলে রেশনের চাল-ডাল এবং অন্যান্য সুবিধে কেন্দ্র সরকার বন্ধ করে দিলে, তার বিরুদ্ধে তো আরও অনেক বেশি রাজ্য প্রস্তাব পাশ করাবে। এবং যে পুলিশ সামান্য ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের জন্য মিঞাভাইদের জরিমানা করতে ভয় পায়; তারা দুয়ের বেশি সন্তান নেবার জন্য মুসলমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, এটা তো হাস্যকর চিন্তাভাবনা।

অতএব ওই দ্বিসন্তান আইন এক এবং একমাত্র প্রয়োগ হবে হিন্দুদের উপর। হিন্দুরাই বেশি করে চাকরির উপর নির্ভরশীল, অতএব চাকরি কেড়ে নেবার ভয় দেখিয়ে বাচ্চা কমানো যাবে শুধু হিন্দুদের। হিন্দুদের মধ্যেই ভ্রাতৃত্ব বোধ কম, যাকাতের মত কোন ব্যবস্থাও নেই; অতএব সরকারি সুবিধা বন্ধ করে দিলেই হিন্দুরা এক্কেবারে কুপোকাত। সারা দেশে হিন্দুদের জন্মহার এমনিতেই দুইয়ের কম, বাঙালিদের সেটা একের সামান্য উপরে। যে গুটিকয় বাঙালি এবং অবাঙালি হিন্দু দুইয়ের বেশি সন্তান নিচ্ছিলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণ আইন এলে এবার সেটাও বন্ধ হবে। জন্মনিয়ন্ত্রণ আইন রূপ নেবে হিন্দু-নিয়ন্ত্রণ আইনের। গোটা ভারতে বিহারী এবং মুসলমানদের অধিক জন্মহারের শাস্তি ভারতের প্রত্যেকটা জাতি পেতে চলেছে। এটাই ধর্মনিরপেক্ষ জন্মনিয়ন্ত্রণ আইনের মহিমা! এক-দুজনের পাপে সকলের সমান শাস্তি।

হিন্দুদের মধ্যেও আইনের শরণ নিতে সবথেকে ভালোবাসে বাঙালিরা, আর এইটাই একদিন আমাদের ধ্বংসের বড় কারণ হবে। আইন মানে ভাষার মারপ্যাঁচ নয়। বাঙালির কাছে আইন একটা সরলীকৃত ধারণা, যেটা চালু করলেই সব সমস্যার ঝটিতি সমাধান হয়ে যাবে। তাই প্রত্যেকটা সমস্যার জন্য একটা করে আইন রয়েছে আমাদের মনে। পাহাড় প্রমাণ জনসংখ্যা আটকাবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইনে। রাস্তায় গাড়ি দুর্ঘটনা কমাবে নতুন মোটর যান নিয়ন্ত্রণ আইন। অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ করবে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বিধি। আমরা চাই আইনের কাছে স্বেচ্ছায় পরাধীন হতে। আমরা চাই আমাদের জীবনের প্রতিটি দিক নিয়ন্ত্রণ করুক কোন না কোন আইন। রাষ্ট্র আমাদেরকে বলে দিক কটা সন্তান হওয়া উচিত, গাড়ি চালানোর সময় কি পরা উচিত, নিজের নিরাপত্তা কিভাবে নিতে হবে। এবং বাঙালিরা নিজে আইন মেনে খুশি নয়। সে চায় অন্য ধর্ম এবং জাতির লোকেরাও এসব আইন অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলুক। বিহারী এবং মুসলমানেরা যখন নিজেদের ব্যক্তি-জীবনে আইনের খবরদারিকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করে; বাঙালি তখন চায় অন্যদের আইন মানা বাধ্যতামূলক করার জন্য আরেকটা আইন বানাতে। যে জাতি মানসিক গঠনেই পরাধীন, তারা যে অন্যের স্বাধীনতা সহ্য করতে পারবে না, এটাই তো স্বাভাবিক।

বাঙালির মত আইনপ্রিয় জাতি বিশ্বে কমই রয়েছে। রাষ্ট্রকে আমরা পিতার জায়গায় বসিয়ে দিয়েছি। আইন হল সেই পিতার শাসন। জেল-জরিমানা হল পিতার দেওয়া শাস্তি। আইনের এমন একটা ধারণায় আমরা বিশ্বাস করি, যার উপর চোখ বন্ধ করে ভরসা করা যায়। মায়ের পেট থেকে বেরোনোর এত বছর পরেও আমরা স্বাবলম্বী হতে পারিনি। আমরা এমন একটা আইন ব্যবস্থা খাড়া করতে চাই, যাতে যে কোন সমস্যায় তার কাছে গিয়ে নালিশ ঠুকলেই হয়। তারপর আমাদের দায়িত্ব শেষ। বিপদে পড়লে রাস্তার এক দিক থেকে হাঁক পাড়লে, আইন আমাদের আঙ্গুল ধরে রাস্তা পার করিয়ে দেবে। বাঙালি চায় আইনের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। সে আইন ভাল না মন্দ, ন্যায্য কি অন্যায্য এসব প্রশ্ন তুলতে আমরা ভুলে গেছি। আমরা জানতেও চাই না আইনগুলোর ছত্রে ছত্রে কি লেখা রয়েছে। নিজেদের ভাগ্যকে নিশ্চিন্তে সপে দিয়েছি পরের লেখা কিছু জটিল লাইনের কাছে। আইনই সেই রাখাল, আমরা যার ভেড়ার পাল।