আপন রক্তে শোধ করিব মাতৃভাষার ঋণ – ২

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

এই প্রসঙ্গে ১৯শে মে, ১৯৬১র শিলচরের বাংলা ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি রোমন্থন করা এক আবশ্যক কর্তব্য রূপেই অনুভূত হচ্ছে। কি হয়েছিল সেইদিন?

বাংলা ভাষা, বাঙ্গালীর অবনমনের বিরুদ্ধে সেইদিন সমগ্র বরাক উপত্যকা, আসাম অঞ্চল গর্জে উঠেছিল প্রতিবাদে – বাংলা ভাষা কে অপমান, তাচ্ছিল্য সহকারে তার ন্যায়পূর্ণ দাবীকে অগ্রাহ্য করায়, শুধুমাত্র অসমীয়া ভাষাকে আসাম রাজ্যের প্রধান ভাষা করার প্রতিবাদে। ১৯৪৭ র দেশভাগ – বিশেষ করে শ্রীহট্টের (বিতর্কিত) গণভোটের রায় পাকিস্তানের পক্ষে যায়, অচিরেই সমগ্র শ্রীহট্ট যোগ দেয় পূর্ব পাকিস্তানে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান হিন্দুদের পক্ষে কোনমতেই সুরক্ষিত না হওয়ায়, সেখাকার হিন্দু বাঙ্গালীরা আশ্রয় নিতে থাকে বরাক উপত্যকায়। ক্রমেই এলাকার জন-বিন্যাস পরিবর্তিত হওয়ায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতির এক অংশ একে এক অশনি সংকেত হিসেবে অভিহিত করেন। অসমীয়া-বাঙালী দ্বন্দ্ব র সূত্রপাত এখানেই যা দ্রুত বৈরিতায় প্রবেশ করে।

১৯৬০ সালে তৎকালীন আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভায় প্রস্তাব উত্থাপিত হয় অহমিয়া বা অসমিয়াকে রাজ্য র প্রধানতম ও একমাত্র ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য। প্রস্তাব র প্ৰয়াস ও লক্ষ্য রাজ্য র হিন্দু বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের কাছে এক অত্যন্ত সঙ্কটজনক পরিস্থিতি হিসেবে প্রতিভাত হয়। প্রস্তাব উত্থাপনের পরেই – এপ্রিল, ১৯৬০ – ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় হিন্দু বাঙ্গালী সম্প্রদায় আক্রান্ত হয় অসমীয়া সম্প্রদায় র একাংশ দ্বারা। তা চরমে ওঠে (একই বছরের) এপ্রিল আর সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে যখন নিরন্তর, নৃশংস আক্রমণ হেতু অন্তত ৫০, ০০০ হিন্দু বাঙ্গালী ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে পালিয়ে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেয়। অন্যদিকে ৯০, ০০০ বাঙ্গালী প্রাণভয়ে বরাক উপত্যকায় আশ্রয় নেয়, যা বাঙালীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। মহামান্য বিচারপতি শ্রী গোপাল মেহরোত্রা র নেতৃত্বে One Man Commission গঠিত হয়। Commission র report অনুযায়ী – ৪, ০১৯ টি ঘর ও ৫৮ টি গৃহ – বাঙ্গালীদের – ধ্বংস করা হয় কামরূপ জেলার অন্তর্গত গোরেশ্বর এলাকার ২৫ টি গ্রামে। ভয়াবহ জাতিদাঙ্গায় ৯ জন বাঙ্গালীর প্রাণ নাশ হয়, শতাধিক মারাত্মকভাবে জখম হন। এই ঘটনাপ্রবাহ বাঙ্গালী মননে এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে।

১০ ই অক্টবর, ১৯৬০, শ্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা, মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী, আসাম বিধানসভায় একটি বিল উত্থাপন করেন অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যের প্রধানতম ও একমাত্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য। যদিচ শ্রী রাজেন্দ্রমোহন দাস, বিধায়ক (করিমগঞ্জ উত্তর বিধানসভা ক্ষেত্র) এবং হিন্দু বাঙ্গালী, প্রতিবাদ করেন যে প্রাদেশিক সরকারের এই প্রচেষ্টা রাজ্য র জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের ভাষা অপর দুই-তৃতীয়াংশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে – যা গণতান্ত্রিক রীতিনীতির পরিপন্থী। অক্টবর ২৪, ১৯৬০ বিলটি পাশ হয় আসাম বিধানসভায় – অসমীয়া ভাষা প্রতিষ্ঠিত হয় অসম রাজ্য র একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে। প্রতিক্রিয়া হেতু বাঙ্গালীদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধে; আসামের বাঙ্গালী সংখ্যাধিক্য এলাকায় প্রতিবাদ ও সত্যাগ্রহ গড়ে ওঠে।

ফেব্রুয়ারি ৫, ১৯৬১ – কাছাড় গণ-সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য (বাংলা ভাষার স্বার্থে) বাঙালী অধ্যুষিত বরাক উপত্যকায়। ১৪ এপ্রিল, শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে প্রতিবাদ হিসেবে সংকল্প দিবস পালিত হয়। ২৪শে এপ্রিল, পরিষদ বরাক উপত্যকায় দু-সপ্তাহ ব্যাপী এক বিশাল পদযাত্রার আয়োজন করে – আন্দোলনের জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য। পদযাত্রা ২রা মে শিলচরে সমাপ্ত হয়। হাইলাকান্দি অঞ্চলেও একই ধরণের পদযাত্রা সংগঠিত হয়। শ্রী রথীন্দ্রনাথ সেন, পরিষদের শীর্ষস্থানীয় নেতার বয়ান অনুযায়ী, ১৩ ই এপ্রিল, ১৯৬১র মধ্যে সিদ্ধান্ত রদ না হলে, ১৯ শে মে এক সর্বাত্মক হরতাল পালিত হবে।

আন্দোলন প্রতিহত করার জন্য আসাম সরকার প্রথম থেকেই বলপ্রয়োগ র সিদ্ধান্ত নেয় – ১২ই মে র মধ্যে সমগ্র শিলচর কে নিরাপত্তার কঠিন আস্তরণে ঢেকে ফেলা হয়। Assam Rifles ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর জওয়ানদের – যে কোন পরিস্থিতি র মোকাবিলা করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। পরিষদের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের একাংশের গ্রেপ্তারও কিন্তু আন্দোলনকারীদের দমাতে পারেনি।

শেষ পর্যন্ত ১৯শে মে উপস্থিত হয়। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রভাত থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হরতাল ও প্রতিবাদ কর্মসূচি সংগঠিত হয়। শিলচর, হাইলাকান্দি ও করিমগঞ্জে আন্দোলনকারীরা ভোর থেকেই picketing আরম্ভ করে। প্রতিবাদ র দৃঢ়তা, বাঙালীদের ব্যাপক জনসমর্থন আন্দোলন কে সর্বাত্মক রূপ নিতে সাহায্য করে। বিদ্যালয় থেকে আপিস, সরকারী দপ্তর, রেল স্টেশন স্তব্ধ হয়ে গণ-আন্দোলনের এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে যার তুলনা সাম্প্রতিক কালে খুব একটা দেখা যায়না। সমস্যা শুরু হয় Assam Rifles র শিলচর রেল স্টেশনে আগমনের মধ্য দিয়ে।

দুপুর ২.৩০ মিনিট নাগাদ, একটি বেডফোর্ড ট্রাক, যার মধ্যে কাটিয়াগড় থেকে গ্রেফতার হওয়া ৯ জন সত্যাগ্রহী ছিলেন, তারাপুর রেল স্টেশনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। ট্রাকের মধ্যে ৯ জন সত্যাগ্রহী র উপস্থিতি পরিবেশ কে অগ্নিগর্ভ করে তোলে, পথমধ্যে উপস্তিত সত্যাগ্রহীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। অবস্থা বেগতিক দেখে, নিরাপত্তারক্ষীরা পলায়নে বাধ্য হয়। প্রবল প্রতিবাদ হিসেবে এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দেয়। দ্রুত অগ্নি-নির্বাপক কর্মী ও আধাসামরিক জওয়ানরা ঘটনাস্থলে উপস্তিত হন। হঠাত জওয়ানদের দেখা যায় সম্পূর্ণ নিরস্ত্র সত্যাগ্রহীদের নির্মমতমভাবে আঘাত করতে। তারপরেই ঘটে হত্যাকান্ড। সাত মিনিটের মধ্যে ১৭ রাউন্ড গুলি চালনা হয় – একে একে বহু মানুষ লুটিয়ে পড়েন রাজপথে মারাত্মক আঘাত হেতু। ৯ জন তার মধ্যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন জন্মভূমি ও মাতৃভাষা র প্রতি ঋণ পরিশোধ করে। আরো ৩ জন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি থাকেন। এই অসামান্য আত্মত্যাগ এক তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করে সমগ্র ভারত জুড়ে, বহির্বিশ্বেও। ২০ শে মে, শিলচরবাসী, ৯ মৃত্যুঞ্জয়ীর দেহ নিয়ে, এক বিশাল ব্যথিত, রণক্লান্ত, গর্বোদ্ধত মিছিল বের করে। দু’জন পরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইতিহাস রচিত হল হিন্দু বাঙ্গালীর শোনিতে, আত্মত্যাগে, বাংলা ভাষার মর্যাদা সদা উড্ডীন রাখার অভিপ্রায়ে। প্রখ্যাত, নমস্য বিপ্লবী শ্রী উল্লাসকর দত্ত মহাশয় ৯ টি ফুলের স্তবক পাঠান মৃত্যুঞ্জয়ীদের প্রতি শ্রদ্ধা হিসেবে।

মৃত্যুঞ্জয়ীদের নাম:

শ্রী কানাইলাল নিয়োগী;
শ্রী চন্ডীচরণ সূত্রধর;
শ্রী হীতেশ বিশ্বাস;
শ্রী সত্যেন্দ্র দেব;
শ্রী কুমুদ রঞ্জন দাস;
শ্রী সুনীল সরকার;
শ্রী তরণী দেবনাথ;
শ্রী শচীন্দ্র চন্দ্র পাল;
শ্রী বীরেন্দ্র সূত্রধর;
শ্রী সুকোমল পুরকায়স্থ;
শ্রীমতি কমলা ভট্টাচার্য (১৬ বছরের বালিকা)..

নির্মম হত্যাকান্ড ও গণ-আন্দোলনের ধারাবাহিকতা শেষ পর্যন্ত আসাম সরকারকে বাধ্য করে আইনটি প্রত্যাহার করতে। বাংলা ভাষা, অবশেষে, সরকারি স্বীকৃতি পেল বরাক উপত্যকায়। সংগ্রামের এটি ইতি নয়। পরবর্তী দশক গুলোতেও বাংলা ভাষার জন্য গণ-আন্দোলন ও আত্মত্যাগের অসামান্য উদাহরণ রয়েছে আসাম রাজ্যে। বর্তমানেও সেই একই অস্থিরতা বিদ্যমান সেইখানে।

প্রশ্ন ওঠে – তাহলে উপায় কি? এইভাবেই চলবে বাংলা ভাষা? শুধু মুখ বুজে দেখে যেতে হবে তার ওপর অকথ্য আক্রমণ? প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আচার্য যদুনাথ সরকার ১৯৪৮ সালে, যখন শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে অকথ্য অত্যাচার হেতু পূর্ব পাকিস্তান থেকে হিন্দু সম্প্রদায় পশ্চিমবঙ্গ র দিকে ধাবমান (তখনো বরিশাল গণহত্যা – ১৯৫০ অনুষ্ঠিত হয়নি), লিখেছিলেন, ” পূর্ববঙ্গ হইতেছে এয়াহুদি বিবর্জিত ফিলিস্তিনের তুলনা। আর আমরা পশ্চিমবঙ্গকে এয়াহুদি শাসনাধীন ফিলিস্তিনের মতন করিয়া গড়িয়া তুলিতে বাধ্য—ইহা হইবে তমিস্রার মধ্যে আলোকবর্তিকাস্বরূপ, মধ্যযুগীয় অজ্ঞানভাব আর অচলিত ঈশ্বরে বিশ্বাসীদের অন্ধসংস্কারে ডোবা মরুভূমির মধ্যে একখণ্ড মরুদ্যান বিশেষ।”…….আজ প্রায় ৭৫ বছর পরে বাঙ্গালী হিন্দু তথা তার ভাষার অবস্থা আরো সঙ্গীন। বাংলাদেশে যে বাঙ্গালী হিন্দুর racial extermination বা জাতিগত নির্মূলীকরণের অন্তিম অধ্যায় চলেছে, আসামে তার দ্বিতীয় পর্যায় ও সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে তার প্রথম অধ্যায় ইতিমধ্যেই প্রারম্ভ হয়েছে।

এর পরিত্রাণ কি? কে দেখাবেন বাঁচার দিশা? আজ তো ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, শ্রী শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো ওজস্বী নেতৃবৃন্দ অন্তর্হিত হয়েছেন।

কথায় বলে, যে জাতি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে অপারগ হয় তার ক্ষেত্রে একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি এক অবশ্যম্ভাবী অধ্যায় হিসাবে উপস্থাপিত হয়। ১৯৪০ সালের Secondary Education Bill অথবা মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রস্তাব যা মেনে নিলে শিক্ষা জগৎটিও কার্যত বাঙ্গালী হিন্দুর হাতছাড়া হতো, তখন থেকেই শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের প্রকৃত প্ৰকাশ দৃষ্টিগোচর হয়। প্রকাশ্যেই শ্যামাপ্রসাদ কার্যত বিদ্রোহ ঘোষণা করে বলেন তিনি এই সাম্প্রদায়িক প্রস্তাবটি আইনে পরিণত করা কোনভাবেই মেনে নেবেন না। তিনি এটিও পরিষ্কার স্বরে বলেন, এই প্রস্তাব জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার অর্থ হল ভয়ঙ্কর হিন্দু বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হবে মুসলিম লীগ সরকারকে।সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, ‘আপোসের কোনো রাস্তা খোলা নেই এবং আমরা এই নতুন বিপদের বিরুদ্ধে লড়তে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। একে স্বীকার করার অর্থ হিন্দুর সর্বনাশ।’ শ্যামাপ্রসাদ দৃপ্ত ভঙ্গিতে ঘোষণা দেন, ‘আমি বলছি যদিও আমরা সংখ্যালঘু তবু আমাদের যথেষ্ট দেশাত্মবোধ, সাহস ও প্রভাব রয়েছে আমাদের ন্যায্য অধিকার সুরক্ষা করার জন্য রুখে দাঁড়াবার। আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার চাইতে মহান আর কোনো কর্তব্য আমাদের নেই। এর জন্য আমরা যে-কোনো বিপদের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত।’

স্মরণ করি সেই একদা বিশ্রুত, বর্তমানে বিস্মৃত শার্দুলসম শ্রী শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কে। কে ইনি? অতি সংক্ষেপে বললে, তিনি অনুশীলন সমিতির এক প্রখ্যাত বিপ্লবী ছিলেন, পরবর্তী জীবনে কংগ্রেসের রাজনৈতিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন কিন্তু মহাত্মা গান্ধী কর্তৃক অনুসৃত অহিংসা তত্বের মার্গের অনুসারী ছিলেন না। ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলা, বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলা ও গৌহাটির গুলিচালনা সংক্রান্ত মোকদ্দমায় বন্দিদের পক্ষে লড়ে তিনি প্রভূত খ্যাতি লাভ করেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ কে আপ্রাণ সাহায্য করেন স্বরাজ্য দলের প্রতিষ্ঠায়। ১৯৪২র ভারত ছাড়ো আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা নেন, ‘৪৭ সালে দেশভাগের তীব্র বিরোধিতা করেন এবং শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানে থেকে যান। ১৯৪৮ সালে তিনি, সক্রিয় কংগ্রেস নেতার ভূমিকায়, পূর্ববঙ্গের আইনসভায় প্রবেশ করেন, হিন্দু স্বার্থ র পক্ষে তিনি জোরালো ভূমিকা রাখেন। পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে তিনি বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। অবশেষে, তিনি ১৯৬২ সালে ভারতে চিরতরে চলে আসেন ও সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন।

এতক্ষণ পর্যন্ত যা বলা হল সেটি শ্রীশবাবুর ব্যাক্তিত্বময় জীবনের একটি prelude মাত্র। ওঁর আগ্নেয় চরিত্রের কিয়দংশ পাওয়া যায় শ্রী প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী দ্বারা লিখিত “পাক-ভারতের রূপরেখা” নামক গ্রন্থে। ১৯৫০ র পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রযন্ত্র র সক্রিয় সমর্থনে যখন ভয়ঙ্করতম হিন্দু গণহত্যা সমগ্র পৃথিবীকে স্তম্ভিত করে তখন তিনি ই একমাত্র ব্যক্তি যিনি রুখে দাঁড়ান। প্রভাসবাবু লিখছেন, “পূর্বেই বলেছি, ঢাকার হিন্দু মুসলমানগণ বরাবর সবগুলো সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘর্ষের মধ্য দিয়েই আত্মরক্ষার কৌশল বেশ ভালোভাবেই আয়ত্ত করে নিজেদের রক্ষাই শুধু করেন নি, প্রতিপক্ষকে চরম আঘাত ও হেনেছেন। হিন্দুরাও যে সেদিক দিয়ে মুসলমানের পেছনে ছিলেন, তা’ মোটেই না। তার প্রমাণ আমরা দেখেছি ঢাকার নবাবপুরে রাস্তার পাশে একেবারে জেলা-কোর্টের গায়ে লাগা একটা মসজিদের ভাঙা স্তুপ থেকে। ঢাকার হিন্দুরাও ছিলেন বেপরোয়া, অকুতোভয়। দেশ বিভাগ, তথা পাকিস্তান সৃষ্টির এই আড়াই বছরেরও কিছু কম সময়ের মধ্যেই হিন্দুর সেই সাহস – সেই মনোবল একদম ভেঙে গিয়েছে। আমরা ঢাকায় থেকে ১৯৫০ সালের দাঙ্গায় যা দেখেছি তাকে ‘দাঙ্গা’ বলা ঠিক নয়। সেটি হয়েছিল একতরফা হিন্দু-গৃহ-লুন্ঠন ও হিন্দুর হত্যা। ……….গেন্ডারিয়া অঞ্চলেই তখন ঢাকার প্রখ্যাত নেতা শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহাশয় ছিলেন। তাঁর বাড়িও আক্রান্ত হয়েছিল। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, অন্তত ঐ অঞ্চলে যিনি আক্রমণকারীদের সামনে সিংহ-গর্জনে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বলে শুনেছি। তাঁর প্রতিরোধশক্তি দেখে আক্রমণকারীরা পিছিয়ে যায়।

..এই শ্রীশবাবুর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় পূর্ববঙ্গে “অনুশীলন সমিতি” র স্রষ্টা পুলিনবিহারী দাশ মহাশয়ের সহকর্মী হিসাবে। তিনি ঢাকার উকিল ছিলেন এবং বিপ্লবী কর্মীদের বহু মামলায় তিনি আসামীপক্ষের সমর্থনে বরাবর এগিয়ে গিয়েছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আসামের গৌহাটি শহরে ফেরারি বিপ্লবীদের সাথে পুলিশের যে খণ্ডযুদ্ধ হয় এবং যার ফলে আমরা ৫ (পাঁচ) জন ধৃত হই – আমি পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে পরে কামাখ্যা পাহাড়ের উপরে ধরা পড়ি, এবং সেই ঘটনাকে অবলম্বন করে যখন আমাদের তৎকালীন ভারতরক্ষা আইনে “স্পেশাল ট্রিবিউনালে” বিচার হয়, তখন সেই মামলায় কলকাতা থেকে ব্যারিস্টার শ্রী এস এন হালদার ও ঢাকা থেকে শ্রীশবাবু আমাদের পক্ষ সমর্থন করতে বাংলাদেশ থেকে যান। শ্রীশবাবু বরাবরই ছিলেন অত্যন্ত নির্ভীক। ১৯২১ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ মহাশয়ই তাঁকে গান্ধীজি পরিচালিত কংগ্রেসের নেতৃত্বে নিয়ে আসেন। তিনি গান্ধীজি পরিচালিত কংগ্রেসে আসেন বটে এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত (তিনি কিছুকাল আগে পশ্চিমবাংলায় এসে ৯১ বছর বয়সে পরলোকগমন করেছেন) যদিও কংগ্রেসসেবীই ছিলেন, তবু তিনি কোনও দিনই গান্ধীজীকে ‘মহাত্মা’ বলতেন না। আমার রচিত – “India Partitioned and Minorities in Pakistan” ইংরেজি বইখানির ভূমিকা তিনিই লিখেছিলেন। তাতেই, গান্ধীজীর নামের আগে তিনি ‘মহাত্মা’ কথাটি লেখেন নি – আমি বলা সত্বেও তিনি লিখতে রাজী হন নি। এরকমই একরোখা তিনি বরাবরই ছিলেন।  এইটেই ছিল তাঁর চরিত্রের ও স্বভাবের বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য ছিল বলেই তিনি লিখতে রাজী হন নি। এই বৈশিষ্ট্য ছিল বলেই তিনি সেদিন তাঁর বাড়িতে আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পেরেছিলেন।”

স্মরণ করি রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সেই অমর বাণীকে।  তত্ত্ববোধিনীতে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ‘আত্মপরিচয়’ প্রবন্ধে নিজের ধর্ম মত নিয়ে তিনি লিখেছেনঃ

” আমরা যে কী, সে লইয়া আমাদের মনে একটা সন্দেহ জন্মিয়াছে। আমরা বলিতেছি আমরা আর কিছু নই আমরা ব্রাহ্ম। কিন্তু সেটা তো একটা নূতন পরিচয় হইল। সে পরিচয়ের শিকড় তো বেশি দূর যায় না। আমি হয়তো কেবলমাত্র গতকল্য ব্রাহ্মসমাজে দীক্ষা লইয়া প্রবেশ করিয়াছি। ইহার চেয়ে পুরাতন ও পাকা পরিচয়ের ভিত্তি আমার কিছুই নাই? অতীতকাল হইতে প্রবাহিত কোনো একটা নিত্য লক্ষণ কি আমার মধ্যে একেবারেই বর্তায় নাই?

এরূপ কোনো সম্ভবই হইতে পারে না। অতীতকে লোপ করিয়া দিই এমন সাধ্যই আমার নাই; সুতরাং সেই অতীতের পরিচয় আমার ইচ্ছার উপর লেশমাত্র নির্ভর করিতেছে না।

কথা এই, সেই আমার অতীতের পরিচয়ে আমি হয়তো গৌরব বোধ করিতে না পারি। সেটা দুঃখের বিষয়। কিন্তু এইরূপ যে-সকল গৌরব পৈতৃক তাহার ভাগ-বাঁটোয়ারা সম্বন্ধে বিধাতা আমাদের সম্মতি লন না, এই সকল সৃষ্টিকার্যে কোনোরূপ ভোটের প্রথাও নাই। আমরা কেহ বা জর্মনির সম্রাটবংশে জন্মিয়াছি আবার কাহারও বা এমন বংশে জন্ম–ইতিহাসের পাতায় সোনালি অক্ষরে বা কালো অক্ষরে যাহার কোনো উল্লেখমাত্র নাই। ইহাকে জন্মান্তরের কর্মফল বলিয়াও কথঞ্চিৎ সান্ত্বনালাভ করিতে পারি অথবা এ সম্বন্ধে কোনো গভীর তত্ত্বালোচনার চেষ্টা না করিয়া ইহাকে সহজে স্বীকার করিয়া গেলেও বিশেষ কোনো ক্ষতি নাই।

অতএব, আমি হিন্দু এ কথা বলিলে যদি নিতান্তই কোনো লজ্জার কারণ থাকে তবে সে লজ্জা আমাকে নিঃশব্দে হজম করিতেই হইবে। কারণ, বিধাতার বিরুদ্ধে নালিশ করিতে হইলে সেই আপিলআদালতের জজ পাইব কোথায়?

এ সম্বন্ধে ভাবিবার কথা এই যে, হিন্দু বলিলে আমি আমার যে পরিচয় দিই, ব্রাহ্ম বলিলে সম্পূর্ণ তাহার অনুরূপ পরিচয় দেওয়া হয় না, সুতরাং একটি আর একটির স্থান গ্রহণ করিতে পারে না। যদি কাহাকে জিজ্ঞাসা করা যায়, “তুমি কি চৌধুরিবংশীয়”, আর সে, যদি তাহার উত্তর দেয়, “না আমি দপ্তরির কাজ করি,” তবে প্রশ্নোত্তরের সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য হয় না। হইতে পারে চৌধুরিবংশের কেহ আজ পর্যন্ত দপ্তরির কাজ করে নাই, তাই বলিয়া তুমি দপ্তরি হইলেই যে চৌধুরি হইতে পারিবেই না এমন কথা হইতে পারে না।”…….. 

এঁরাই তো আদর্শ। এঁদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত পথই তো আমাদের অনুসরণ করতে হবে প্রজ্ঞা, আমৃত্যু সংগ্রামী হৃদয়ের সাথে।  বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য যা পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম এক শ্রেষ্ঠ অবদান হিসেবে স্বীকৃত তা কি পথের ধুলাতে হারিয়ে যাবে!  অকস্মাৎ কোন বিজাতীয়, মরু সংস্কৃতি আবির্ভূত হবে আর তার আলোকে, তার অত্যাচারী তরবারির ভয়ে কম্পিত হৃদয়ে মেনে নিতে হবে এক নতুন আঙ্গিকের বাংলা ভাষা যার সঙ্গে আবহমান কাল ধরে চলা সনাতন সংস্কৃতির লেশমাত্রটুকু নেই!

সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রয়োজনে ক্রমাগত ণত্ব বিধান ষত্ব বিধান পরিবর্তনের চেষ্টা, তৎসম শব্দের পরিহার মেনে নেওয়া হবে নতমস্তকে? যুগের পর যুগ ধরে যে সনাতন সংস্কৃতি প্রবাহিত হয়েছে, ধৌত করেছে বঙ্গ সংস্কৃতিকে তার মৃত্যুদণ্ডের পরোয়ানায় সই করতে হবে আমাদের? এই কি আমাদের জীবনের অর্থ?

তাহলে কোথায় গেল সেই তেজস্বীতার অত্যুত্তম প্রতীক – ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের “আনন্দমঠ” এ বর্ণিত –

“শব্দ হইয়া আবার সে অরণ্যানী নিস্তব্ধে ডুবিয়া গেল ; তখন কে বলিবে যে, এ অরণ্যমধ্যে মনুষ্যশব্দ শুনা গিয়াছিল? কিছুকাল পরে আবার শব্দ হইল, আবার সেই নিস্তব্ধ মথিত করিয়া মনুষ্যকণ্ঠ ধ্বনিত হইল, “আমার মনস্কাম কি সিদ্ধ হইবে না?”

এইরূপ তিন বার সেই অন্ধকারসমুদ্র আলোড়িত হইল। তখন উত্তর হইল, “তোমার পণ কি?”

প্রত্যুত্তরে বলিল, “পণ আমার জীবনসর্বস্ব |”

প্রতিশব্দ হইল, “জীবন তুচ্ছ ; সকলেই ত্যাগ করিতে পারে |”

আর কি আছে? আর কি দিব?”

তখন উত্তর হইল, “ভক্তি |”

বাংলা ভাষা অবিনশ্বর।  যুগে যুগে তা প্রসারিত হয়েছে, শক্তিশালী হয়েছে নব ভাবনায়, আত্মত্যাগের স্পৃহা তাকে প্রসারিত করেছে –  এইখানেই একত্রে মিশে যায় ১৯শে মে, ১৯৬১ র শিলচরের ১১ জন মৃত্যুঞ্জয়ীর আর ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ তে দাড়িভিটের রাজেশ আর তাপস – ঘোষিত হয় বাংলা ভাষা আন্দোলনের নব দিবস – ২০শে সেপ্টেম্বর।

“শক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত মোরা

অভয়াচরণে নম্রশির |

ডরি না রক্ত ঝরিতে ঝরাতে

দৃপ্ত আমরা ভক্ত বীর |

আবাহন মার যুদ্ধ কারণে,

তৃপ্তি তপ্ত রক্তক্ষরণে,

পশুবল আর অসুরনিধনে

মায়ের খড়্গ ব্যগ্র ধীর |

মায়ের আরতি অরাতি নাশন,

পদে অঞ্জলি বাঞ্ছাপূরণ

শত্রুরক্তে মায়ের তর্পণ

জবার বদলে ছিন্ন শির ||

 

(রচয়িতা শ্রী পুলিনবিহারী দাশ – প্রখ্যাত বিপ্লবী, ঢাকা অনুশীলন সমিতি)

 

(সমাপ্ত)