মুসলিম সমাজের সমস্যা – প্রথম পর্ব

0
1162

লি কুয়ান ইউ ও ইসলামীয় সন্ত্রাসবাদ

বিশ্ব রাজনীতিতে আমার খুব পছন্দের একজন হলেন লি কুয়ান ইউ (Lee Kuan Yew)। সিঙ্গাপুরের জন্মদাতা এবং আজকের আধুনিক সিঙ্গাপুরের কারিগর। যারা ট্রাম্প বা মোদীর মধ্যে ফ্যাসিস্ট দেখতে পান, তারা লি কুয়ান ইউকে চেনেননা। ভদ্রলোকের একটাই ধ্যান ও জ্ঞান ছিল, তা হোল সিঙ্গাপুরকে কি করে বিশ্ব দরবারে সবার আগে নিয়ে যাওয়া যায়। কাজটা সহজ ছিলনা, একটা দেশ, কোন ন্যাচারাল রিসোর্স নেই, চাষ আবাদ করার জায়গাও তেমন নেই, তারপরেও আজকে যে দেশটা বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোর মধ্যে একটা, তার মূল কারন লি কুয়ান ইউ এবং তাঁর কার্য পরিচালনার পদ্ধতি।

যেমন উনি যদি মনে করেন কেউ দেশদ্রোহিতা করছে বা কেউ যদি সেরকম একটাও কিছু কোথাও লেখে তাহলে তাঁর সেটাই প্রথম ও শেষ লেখা হবে। আমাদের অরুন্ধতী রায়দের মতো ইনিয়ে বিনিয়ে ক্রমাগত ঘ্যানঘ্যান করার সুযোগ পাবেন না। তা এই ভদ্রলোক ইসলামিক টেররিজম নিয়ে খুব সুন্দর একটা সমাধান দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যদি ইসলামিক টেররিজম শেষ করতে হয় তাহলে কর্মী মৌমাছি নয়, রাণী মৌমাছিকে আগে মারতে হবে। অর্থাৎ তাঁর মতে উগ্রপন্থী নয়, আগে ইসলাম ধর্মের প্রচারকদের শেষ করা দরকার। কারন এরাই এই সন্ত্রাসের মূল মাথা।

যদি হালফিলের ঘটনাবলী দেখেন তাহলেও এটাই দেখতে পাবেন। লাদেন থেকে শুরু করে আমাদের দেশী জাকির নায়েক, প্রত্যেকেই ইসলামিক স্টাডিজে স্কলার এবং এঁরা কেউই কিন্তু নিজেরা সুইসাইড বোম্বার নন, কিন্তু এদের প্ররোচনায় সুইসাইড বোম্বার তৈরি হয়।

আপনি বলবেন এটা সত্যি নয়। সাধারণ মুসলিম সমাজ কেনই বা এই ধর্মগুরুদের কথা শুনবে, তারা কেনই বা এদের কথায় নিজেদের জীবন দেবে। অন্যদেশের কথা আমি অতো বলতে পারবনা, কিন্তু আমাদের দেশের মুসলিম সমাজের দিকে তাকালে খুব সহজেই কথাটা বোঝা যায়। আচ্ছা আমাদের তথাকথিত সেকুলার রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীদের কখনও দেখেছেন কোন গরীব মুসলিম, যে দুবেলা খেটে নিজের পেটের ভাত জোগাড় করে, তাদের কারুর বাড়িতে গিয়ে ইফতার করছেন? আমি নিশ্চিত আপনি দেখেননি। এদের স্থানীয় মুসলিম ধর্মগুরুদের আশেপাশেই দেখা যায়। সে ইমাম বরকতি হোন বা ত্বহা সিদ্দিকী। ঠিক যে কারনে আব্বাস সিদ্দিকীর মতো ধর্মগুরু ভারতবর্ষের পঞ্চাশ কোটি মানুষের মৃত্যু চেয়েও পার পেয়ে যান। কারন এরাই তাদের সমাজকে চালনা করেন বা বলা ভালো মুসলিম সমাজ এদের কথা অনুযায়ীই চলে। তাই আমাদের নেতানেত্রীরাও এদের রসেবশে রাখতে চান।

 

হিন্দু সমাজ ও মুসলমান সমাজের পার্থক্য

এখানেই তফাতটা খেয়াল করবেন। অমিত শাহকে দলিত সমাজকে কাছে টানার জন্য কোন ধর্মগুরুর বাড়ি যাওয়ার দরকার পরেনা, তাঁকে যেতে হয় একজন অতি সাধারণ নিম্নবিত্ত দলিতের বাড়িতে। কিন্তু তথাকথিত সেকুলার নেতাদের যেতে হয় কোন ধর্মগুরু বা ধর্মপ্রচারকের বাড়ি। কারন তারা জানেন যে ঐ ধর্মগুরু অর্থাৎ ইমাম বা মৌলানাই ঐ সমাজকে চালনা করেন। তাই বাকী সমাজ নয়, তাঁকে ঐ ইমাম বা মৌলানার ঘনিষ্ঠ হতে হবে। এবার এখানে অদ্ভূত তফাতটা খেয়াল করুন। আমাদের “বুদ্ধিজীবীদের” মতে দলিত এবং মুসলিম দুই পক্ষই নাকি শোষিত। কিন্তু দলিতদের জীবনযাত্রা কোন ধর্মগুরুর দ্বারা পরিচালিত হয়না। ব্যক্তিগতভাবে আরও পাঁচজন হিন্দুর ন্যায় কোন দলিত কোন ধর্মগুরুর ভক্ত হতে পারেন, কিন্তু তিনি কিন্তু তাঁর জীবন শৈলীর সম্পূর্ন নির্মাণ এই ধর্মগুরুর মতামতের ভিত্তিতে করছেন না। তিনি ততোটাই শুনছেন ঠিক যতোটা তাঁর জন্য লাভজনক হচ্ছে বা যতোটা তার পক্ষে সুবিধাজনক বা সম্ভব। অপরদিকে কিন্তু একজন দরিদ্র মুসলিম অক্ষরে অক্ষরে তাঁর মসজিদের ইমাম যা বলছেন তাই অনুসরণ করে চলেছেন। সে তাঁর যতোই অসুবিধা হোক না কেন। সেই দরিদ্র ব্যক্তিটিও নিয়ম করে জাকাত দিচ্ছেন, নির্দিষ্ট দিনে স্থানীয় মসজিদের ইমামের কাছে খাবার পৌছে দিচ্ছেন।

এই ধর্মগুরুদের প্রভাব কতোটা সাধারণ মুসলিম সমাজের উপরে তাঁর একটি উদাহরণ দিই, তাহলেই বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে। গণিখান চৌধুরীকে আমরা সবাই চিনি। পশ্চিমবাংলার কংগ্রেসের অবিসংবাদী নেতা, কোতোয়ালীর নবাব। তা এই গনিখান চৌধুরীর রাজনৈতিক উত্থানের পেছনে এই ধর্মগুরুদের গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা আছে।

মালদা জেলাতে এখন ওয়াহাবী ধর্মগুরুদের প্রভাব বাড়লেও এককালে এখানে মূলত পীরদেরই প্রতিপত্তি ছিল। প্রতিটি এলাকাতেই এরকম কিছু ছোট বড় পীর থাকতেন। মালদার এমনিই দুই বড় পীর যাদের ভক্ত সংখ্যা সর্বাধিক সেই দুই জনের একজনের সেবাইত ছিলেন গনিখান এবং অন্য পীরের সেবাইত ছিলেন তাঁর ভাইয়ের পরিবার। প্রতি বছর ভোটের আগে এই পীরেরা তাঁর ভক্তদের বলে দিতেন গনিখানের পরিবারকেই ভোট দিতে হবে এবং ভোট সেখানেই পড়ত। রেলমন্ত্রী হিসাবে গনিখান যে কাজ করেছিলেন তাঁর কিছু ভূমিকা অবশ্যই ছিল একটা সময়ে, কিন্তু পীরদের ভূমিকাই মূল। মালদা তো বটেই, মুর্শিদাবাদেও এদের ভক্ত সংখ্যা অনেক। দীর্ঘ সময় পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে কংগ্রেসের গড় মালদা হওয়ার পেছনে মূল কারণ এই পীররা। যে কারনে নানাভাবে মালদা জয়ের চেষ্টা করেও শেষমেশ মমতা ব্যানার্জীকে গনিখানের পরিবারের একজনকেই প্রার্থী করতে হয়, বা কংগ্রেসকেও তার পাল্টায় সেই একই পরিবার থেকেই প্রার্থী বেছে নিতে হয়। তাদের হাতে অন্য কোন উপায় থাকেনা। সমাজের উপর প্রভাব বিস্তার করার ক্ষেত্রে ওয়াহাবী এবং পীররা একই রকম ভাবে সচেষ্ট এবং যতই আমাদের বাম বুদ্ধিজীবীরা নানাভাবে পীরদের নিরীহ, ভালোমানুষ হিসাবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করুন না কেন আমাদের কাছে, অতোটাও ভালো মানুষ, নিরীহ বোধহয় এঁরা নন। ওয়াহাবীদের সাথে এদের তফাতটা ঐ ঊনিশ বিশ।

এবার বলুন এই পীরেদের প্রভাব কি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ, নাকি সামাজিক ক্ষেত্রে তাদের মুসলিম সমাজকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা থেকেই এই রাজনৈতিক ক্ষমতা আসছে? এক কথায় উত্তর তাদের সামাজিক প্রভাবই তাদের রাজনৈতিক প্রভাবের মূল। যেমন আর্ট অব লিভিং বা আমাদের অনুকূল ঠাকুর, তেমনই এই পীরেরা। তফাত হোল অনুকূল ঠাকুররা আমাদের সবাইকে চালনা করতে পারেননা, কারন ধর্মের অনুশাসন আমাদের কাছে এক এবং একমাত্র সত্যি নয়। হিন্দু সমাজেও দেখবেন যাদের কাছে ধর্মের অনুশাসন এক এবং একমাত্র সত্য তারাও কিন্তু পিছিয়েই রয়েছেন সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রেও, এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তারা একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ের পরে আর এগোতে পারেননা। কারন সমগ্র হিন্দু সমাজ কখনই তাদের মেনে নেবেনা। যে কারনে রামমন্দির পরবর্তী সময়েও বিজেপির মুখ হন অটল বিহারী বাজপেয়ী, উমা ভারতী নন। ঠিক যে কারনে আজও বিজেপির মুখ নরেন্দ্র মোদী বা অমিত শাহ, সাধ্বী প্রজ্ঞা নন। তাদের প্রভাব একটা নির্দিষ্ট অংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু জাকির নায়েক, ত্বহা সিদ্দিকীদের ক্ষেত্রে ঠিক এর উল্টো। সেখানে একজন ওয়েইসী থাকতে পারেন, কিন্তু মুসলিম সমাজের মুখ একজন মৌলানা সাদই হন। যার কথাতে লোকে নিজের জীবন বিপন্ন করতেও রাজী। কারন তিনি তাদের বুঝিয়েছেন যে এ হোল শহীদ হওয়ার আরেক উপায় এবং যেহেতু এক ধর্মগুরু এই কথা বলেছেন এর বাইরে অন্য কোন সত্যি তাদের কাছে নেই। সে যতই আপনি তাদের বলুন এই মহামারীর প্রকোপে মক্কার মসজিদও বন্ধ হয়ে গেছে, তারপরেও তাঁরা তা মানবেন না। কারণ একথা তাদের ধর্মগুরু বলছেননা।

এবার কথা হোল আমাদের এই উপমহাদেশে কেন মুসলিম সমাজের এই অন্ধ বিশ্বাস তাদের ধর্মগুরুদের প্রতি। এর উত্তর লুকিয়ে আছে উপমহাদেশের মুসলিম সমাজের ইতিহাসে। প্রথমেই একটা কথা খুব খোলাখুলি বলে নেওয়া ভালো, যে ভারতীয় উপমহাদেশে খাঁটি আরবী রক্তের মুসলিম কেউই নেই। প্রত্যেকেই হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়েছেন। যদি কেউ বলেন তিনি মুফতি কিংবা সইদ তাহলে জানবেন এটা স্বআরোপিত। আরবের সাথে কোন রক্তের সম্পর্ক এদের নেই। আর যদি কেউ রক্তের সম্পর্ক আছে বলে দাবী করেন তাহলে তাঁর ঠিকুজী কুষ্ঠী নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার বিশেষ দরকার নেই, কারন তার পরিণতিতে খুবই লজ্জাজনক সত্য সেই ব্যক্তির সম্মুখে এসে দাঁড়াতে পারে। তাই সে নিয়ে বিশেষ ঘাঁটাঘাঁটি না করাই ভালো। এই ধর্মান্তকরণের ইতিহাসের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এই ধর্মগুরুদের ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠার রহস্য।

 

সনাতনী দর্শনের শিকড় – ভারতীয় অস্তিত্বের ভিত্তি

আমাদের সেকুলার লিবেরালরা যতই অস্বীকার করার চেষ্টা করুন একথা সত্য যে ভারতবর্ষের যে ভিত্তি, আমাদের সমাজের যে শিকড় তার ভিত্তি প্রস্তর হিন্দু দর্শনের মধ্যেই রয়েছে। এই ভিত্তি থেকেই আমাদের জীবন শৈলী তৈরি হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে পাল্টালেও শিকড় থেকে কখনই তা বিচ্ছিন্ন হয়নি। বরং যখনই কেউ তাঁকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করেছে তারা নিজেরাই আমাদের এই বৃহৎ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। আমাদের তথাকথিত “বুদ্ধিজীবীদের” দিকে তাকান খুব ভালো বুঝে যাবেন কথাটা। এমনকি বৌদ্ধ, শিখ, জৈন ইত্যাদি ধর্মগুলিও সেই সনাতন হিন্দু ধর্মের দর্শনকেই অনুসরন করেছে। কিন্তু আমাদের জীবন কখনই সম্পূর্নভাবে ধর্মদ্বারা চালিত হয়নি। রামায়ণ মহাভারতের সময় থেকেই। দেখুন সেখানেও দ্রৌপদী সমাজচ্যূত হন না বা সীতাকে সমাজচ্যূত করার চেষ্টা হলেও সে চেষ্টা সফল হয়না (দয়া করে কোন পণ্ডিত এখানে রামায়ণের প্রক্ষিপ্ত অংশ টেনে আনবেন না, আর যদি আনেনও তাহলেও নিশ্চয় দেখেছেন সেখানে সীতাকে সমাজচ্যূত করা সম্ভব হয়নি। বরং স্বামীর আশ্রয় ছাড়াও যে নারী স্বনির্ভর হয়ে উঠতে পারে তাই দেখানো হয়েছে। সেখানে তিনি রামের কাছে ফিরে যান না, কিন্তু রামকে তাঁর কাছে এসে হাত পাততে হয়)। হিন্দু ধর্ম আসলে আমাদের জীবনে এক দিগন্ত বিস্তৃত সীমারেখার মতো, সেখানে আমরা আমাদের জন্য উপযুক্ত এবং পছন্দসই উপাদান খুঁজে নিতে পারি। ফলে আমাদের জীবন দর্শনেও তার ছাপ পড়ে। যা আমাদের বহুত্ববাদে বিশ্বাসী করে তোলে। চরম নাস্তিককেও চরম আস্তিক সম্মান প্রদর্শন করেন। কারন এখানে মূল চালিকা শক্তি ধর্ম নয়, বরং যে দর্শন থেকে এই ধর্মের উৎপত্তি সেই দর্শনই আমাদের চালিকাশক্তি।

অপরদিকে মুসলিম সমাজ, তারা যখন আজ থেকে হাজার কি পাঁচশো বছর আগে নিজেদের শিকড় ছিঁড়ল, তাঁরা তখন এমন এক ধর্মের শরনাপন্ন হোল যে ধর্মের উৎপত্তি ভারতবর্ষের মাটি থেকে নয়। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন প্রতিটি ধর্মেরই উৎপত্তি কিন্তু এই ভারতের মাটি থেকেই। ফলে এই ধর্মগুলিতে যে কথাগুলি বলা হয়েছে সেসবের মূল কিন্তু একটাই দর্শন। সেই দর্শনের ধারনাটি কিন্তু পুষ্ট হয়েছে আমাদের দেশেরই জল হাওয়ায়, আমাদের জীবনশৈলী থেকেই। একদিকে যেমন দর্শন আমাদের জীবনশৈলী নির্ধারনে ভূমিকা পালন করেছে, তেমনই আমাদের জীবনশৈলীও এই দর্শনের পরিমার্জন ও পরিবর্ধনে ছাপ ফেলেছে। বদ্ধকূপে কখনই তা আটকে যায়নি। কিন্তু ইসলাম ধর্মের উৎপত্তিস্থল ভারতের মাটি থেকে নয়। এমনকি প্রথম যে ধর্মগুরুদের হাত ধরে এই ধর্ম ভারতের মাটিতে প্রবেশ করল তারাও কেউ ভারতীয় নন। ফলে তাদের ভারতের জল হাওয়া, জীবনশৈলী সম্পর্কে কোন ধারনাই ছিলনা। এর ফলে তাঁরা যে দর্শনের কথা প্রচার করল তাঁর সাথে ভারতের মাটির কোন যোগ রইল না। এই যোগাযোগহীনতা ক্রমশ সমগ্র মুসলিম সমাজকেই বৃহৎ ভারতীয় সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিল। আজকে যে মুসলিমদের গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনযাপন তাঁর কারণও কিন্তু এই সমাজ বিচ্ছিন্নতা। ক্রমশঃ তাঁরা যত সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেন তত তাঁরা নিজেদের একটা নির্দিষ্ট গন্ডীর মধ্যে আবদ্ধ করে নিলেন।

যেটা বলতে চাইছি তা হোল সামাজিক বৈষম্য বা অর্থকরী কারণ যাইহোক না কেন একজন হিন্দু বা বৌদ্ধ যখন ধর্মান্তরিত হলেন তিনি শুধু যে নিজের পূর্ব ধর্মের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করলেন তাই নয়, তিনি একই সাথে বাকী বৃহৎ সমাজ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। এবার অনেকে বলবেন বাকী বৃহৎ সমাজের কি এক্ষেত্রে কোন ভূমিকা ছিলনা? আমি বলব অবশ্যই ছিল। সামাজিক বৈষম্যের কারণে যারা ধর্মান্তরিত হয়েছেন সেক্ষেত্রে ছিল। কিন্তু খেয়াল করে দেখুন সামাজিক বৈষম্যের কারণেই অনেকে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ হয়েছেন। তাদের ক্ষেত্রে কিন্তু এই সমস্যাটি হয়নি। তাঁর কারণ হোল দুটি ধর্ম একই দর্শনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তাই আচারে বিচারে আলাদা হলেও মূল কথাগুলো কিন্তু একই। কারণ দুটি ধর্মের দর্শনই একই জল হাওয়ায় পুষ্ট। কিন্তু ইসলামের দর্শন এদেশের জলহাওয়ায় পুষ্ট হয়নি। বরং হিন্দু ধর্ম যেখানে বহুত্ববাদের কথা বলছে, উদারতার কথা বলছে, সেখানে ইসলাম একমাত্র একেশ্বরবাদের তত্ত্বকে মান্যতা দিচ্ছে। এই দুইয়ের টানাপোড়েনের ফল হোল মুসলিম সমাজের সমাজ বিচ্ছিন্নতা। কারন তাঁর দর্শন এবং বাকী সমাজের দর্শন এক্ষেত্রে সরাসরি সংঘাত তৈরি করছে। কারন সেই একই, দুই দর্শনের উৎপত্তি সম্পূর্ণ বিপরীত জলহাওয়ায়। একদিকে যখন ভারতের প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য, অপরদিকে আরবের মরুভূমির রুক্ষতা। এই দুইয়ের মধ্যে যে অবশ্যম্ভাবী সঙ্ঘাত, সেই সঙ্ঘাতই এই দুই ধর্মের মধ্যে বারেবারে দেখা যায়।

এক্ষেত্রে অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন, যে কেন মুসলিম সমাজও তো এদেশের জল হাওয়ার রীতি অনুযায়ী নিজেকে পরিবর্তন করেছে। বাউল, ফকির এসবও তো ইসলামেরই অঙ্গ। সেক্ষেত্রে আমি সবিনয়ে প্রশ্ন করব, এই বাউল, ফকিরদের স্থান মুসলিম সমাজের ঠিক কোথায়? কেন বারেবারে বাউল, ফকিরদের উপরে ফতোয়া জারি করা হয়েছে? কেন তাদের উপরে বারেবারে মুসলিম সমাজ থেকেই আঘাত নেমে এসেছে? অপরদিকে কেন এই বাউল, ফকিরদের সাথে ক্রমশ হিন্দু সমাজের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছে। উত্তর একটাই, বাউল, ফকিররা যখনই ইসলামের সাথে ভারতীয় দর্শনের সংশ্লেষ ঘটানোর চেষ্টা করেছে তখনই তা ইসলামের একেশ্বরবাদের ধারণাকে আঘাত করেছে। সেই আঘাতের ফলে ইসলামিক ধর্মগুরুদের প্রভাব ক্ষুণ্ণ হওয়ার উপক্রম হয়েছে তখনই এই ধর্মগুরুরা ফতোয়া জারি করে এই বাউল, ফকিরদের মুসলিম সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছেন।

হয়ত আমাদের মনে প্রশ্ন আসবে কেন মুসলিম সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই ধর্মগুরুদের সাথে। কেন তাঁরা তাদের জীবন যাপন এভাবে তাদের ধর্মগুরুদের হাতে সঁপে দিল। এর উত্তর একটাই, কারণ তারা পুরোপুরি সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছে। বাউল, ফকির ধারার উদ্বভব যখন হয়েছে ততদিনে এই বিচ্ছিন্নকরন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়েছে। তারা তখন বৃহত্তর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এক গোষ্ঠী। তাদের নিজেদের জীবিকা, জীবন যাপন সব কিছুর জন্যই তারা সেই গোষ্ঠীর উপরে নির্ভরশীল এবং এই গোষ্ঠীকে চালনা করছে এই ধর্মগুরুরা। এই ধর্মগুরুরা নিজেদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক প্রতিপত্তি ছাড়তে রাজী নন। এই প্রতিপত্তি বজায় রাখতেই মুসলিম সমাজের মধ্যে এক ধনী শ্রেণী তৈরি করলেন। যারা এই ধর্মগুরুদের পৃষ্ঠপোষকতায় সম্পদ আহরণ করলেন এবং বাকী দরিদ্র মুসলিমরা নিজেদের জীবন ও জীবিকার জন্য এদের উপরে নির্ভরশীল হয়ে রইলেন। বর্তমানেও দেখুন তথাকথিত মুসলিম নেতারা কেউই সাধারণ নিম্নবিত্ত পরিবারের নন। প্রত্যেকেই যথেষ্ট ধনী পরিবারের এবং প্রত্যেকেই কোন না কোন ধর্মগুরুর আশীর্বাদ ধন্য। অবশ্য আমাদের বামাতিরা একে “সাম্য” বলে থাকেন।

এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবে তাহলে যে সাধারণ মুসলিমরা জীবিকার জন্য এই ধনী মুসলিম বা মুসলিম ধর্মগুরুদের উপরে নির্ভরশীল নন, তারা কেন এই ধর্মগুরুদের বা তাদের সামাজিক অনুশাসনকে অগ্রাহ্য করতে পারছেন না। এর মূল কারণ মুসলিমদের গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন ধারণ। ফলে অর্থনৈতিক চাপ না থাকলেও সামাজিক চাপকে অগ্রাহ্য করা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছেনা। যে কারনে তারা এই সামাজিক অনুশাসনের মধ্যেই সাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন। বাকী বৃহৎ সমাজের সাথে যোগাযোগের সেতুটি বহুপূর্বেই বিচ্ছিন্ন হয়েছে। সেই কারণেই বর্তমান সময়েও যদি দেখেন তাহলে দেখবেন তসলিমা নাসরিন, তারেক ফতাহরা মুসলিম সমাজের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার পরেই তাদের নিজস্ব যুক্তি তর্কগুলির অবতারণা করতে পেরেছেন এবং যে মুহূর্তে তারা তা করেছেন বাকী মুসলিম সমাজ তাদের ত্যাগ করেছে। কারণ তারা ভয় পেয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে এতোদিন ধরে যে যুক্তিজাল তারা বুনেছেন তা ছিন্ন হয়ে যাবে। ফলে আবার তারা আধারহীন হয়ে পড়বে। উপমহাদেশের ধর্মান্তরিত মুসলিমদের এখন আর কোন শিকড় নেই। তারা এখন এক বদ্ধ আধারে আবদ্ধ জলের ন্যায়। সেই আধারের বাইরে যদি তারা চলকে পরে তাহলে বাষ্প হয়ে উবে যাওয়ার ভয় তাদের সব সময় ঘিরে রয়েছে।

(ক্রমশঃ)