মুসলিম সমাজের সমস্যা – অন্তিম পর্ব

0
665

(প্রথম পর্বের পর)

ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে মুসলিম সমাজ

ভারতবর্ষের ইসলামিক যুগের ঘটনাপ্রবাহ দেখলে দেখা যায় এই সময়ে হিন্দু এবং মুসলিম দুই সমাজেরই জীবনধারা একই খাতে বইছে। দুই সমাজই নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যে আবদ্ধ। কিন্তু তফাতটা আসে এরপরে বৃটিশ শাসনকালের শুরুর সময় থেকে। এই সময় মূলত ব্যবসায়িক এবং জীবিকার প্রয়োজনেই হিন্দুরা ইংরাজী শিক্ষার অনুসারী হয়। আর সেই শিক্ষার হাত ধরেই ইসলামিক যুগের অন্ধকার কেটে গিয়ে আবার একঝাঁক আলোর প্রবেশ হয় রামমোহন, দ্বারকানাথের মতো মানুষদের হাত ধরে। এঁরা ইংরাজী ভাষা শিক্ষা করেছিলেন নিজেদের জীবিকার তাগিদে, কিন্তু এর ফলে এদের মনের প্রসারতা ঘটে, ধর্ম বিষয়ক তর্ক করার অভ্যেসটিও গড়ে ওঠে। যার ফলে বিরোধ-বিশ্লেষণ-সংশ্লেষণের প্রক্রিয়াটি শুরু হয়। যার ফলাফল সতীদাহ প্রথার বিলোপ।

অপরদিকে মুসলিম সমাজ কিন্তু নিজেদের গুটিয়েই রাখে। এর পেছনে বৃটিশদের ক্ষমতা হারানোর ক্ষোভ যতটা না ছিল তাঁর থেকেও বেশী ছিল এই বিরোধ-বিশ্লেষণ-সংশ্লেষণের প্রক্রিয়ার প্রতি ভয়। কারণ শিকড়হীন এই সমাজের বেঁচে থাকার একটাই অবলম্বন, তা হোল তাদের ধর্ম এবং ধর্মের প্রতি বিশ্বাস। এই তাদের একমাত্র চালনা শক্তি। কারণ সেই একই, তারা বাকী বৃহত্তর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। তাদের ধর্মের দর্শন এই দেশের দর্শনের সাথে নিজেকে এক করে ফেলতে পারেনি। আর এই একাত্মীকরণের প্রক্রিয়াতে তাদের ধর্মগুরুদের সঙ্গত কারণেই আপত্তি আছে। তারা জানেন এই একাত্মীকরণের ফলে সেই বহুত্ববাদের প্রবেশ ঘটবে, যা তাদের একমাত্র একেশ্বরবাদের ধারণাকে আঘাত করবে এবং একসময় ভেঙে দেবে এবং সেই মুহুর্ত থেকে তারা নিজেদের প্রভাব হারাবেন। এই কাজে তাদের সহায় ধনী উচ্চবিত্ত মুসলিমরা। আর এই উচ্চবিত্ত মুসলিমরা দেখলেন এই ব্যবস্থাতে তারাও লাভবান। ফলে তারাও এতে মদত দিলেন। আখেরে নিচে পরে রইল দরিদ্র মুসলিম শ্রেণী। কাজেই যারা বলেন দেশভাগের জন্য দায়ী হিন্দু জমিদার সম্প্রদায়, তাই “ভূমিসংস্কার” প্রয়োজন ছিল, তারা আসলে এই সত্যিটা এড়িয়ে যেতে চান। কারন এই সত্যি তাদের তত্ত্বের জন্যও স্বস্তিদায়ক নয়। তাদের রুটি রুজি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এই সত্যিকে মেনে নিলে।

 

মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অভাব

খেয়াল করবেন হিন্দু সমাজে যেমন মধ্যবিত্তরা সব থেকে বৃহৎ জনগোষ্ঠী, মুসলিম সমাজে কিন্তু তা নয়। মুসলিম সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ দরিদ্র মানুষ, আর কিছু ধনী। এর মাঝে মধ্যবিত্ত মুসলিমের সংখ্যা খুবই নগণ্য। কিন্তু মজার ব্যাপার হোল যে মুসলিমরা আজ ইসলামিক ধর্মগুরুদের বিরুদ্ধে বলছেন তারা কিন্তু এই মধ্যবিত্ত সমাজেরই প্রতিনিধি। মুসলিম সমাজ তাদের নাস্তিক বলে আলাদা করার চেষ্টা করলেও আদতে এরা নাস্তিক নন। আদতে এরা মধ্যবিত্ত।

মধ্যবিত্তের ধর্মের দায়ের থেকেও বড় দায় পেটের দায়। নিজের এবং পরিবারের পেট চালানোই তার কাছে মুখ্য বিষয়। এর ফলে সবসময় তার পক্ষে ধর্মের অনুশাসন কঠোরভাবে মেনে চলা সম্ভব নয়। ঠিক যেমন হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজ। এক্ষেত্রে তফাত হোল বৃটিশ শাসনের সময়কাল থেকে হিন্দু সমাজে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পথচলা শুরু হয়েছে। মুসলিম সমাজে সেটাই এখন হচ্ছে। সেই সময়ে ইয়ং বেঙ্গল সোসাইটি হয়ত নবজাগরণের পথিকৃৎ ছিল, কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণী না থাকলে এবং তাদের জীবন ধারণের সমস্যা এবং সেই সমস্যা থেকে বেরোনোর তাগিদ না থাকলে কখনই এই নবজাগরণের প্রচেষ্টা সার্থক হত না। কারণ সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের অংশীদারিত্ব ব্যতিরেকে কোন প্রচেষ্টাই কখনও সফল হতে পারেনা। আর এই প্রচেষ্টার ফলে কিন্তু সে কখনই তার নিজের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেনি। কারণ সমাজ যে দর্শনের উপরে ভিত্তি করে গঠিত, সেই দর্শন তাকে দিয়েছে বহুত্ববাদের পথে চলার অধিকার। ফলে ধর্মের পরিমার্জন ও পরিবর্তন কখনই সেখানে অন্যায় বলে মনে করা হয়নি। বিরোধ হয়েছে, কিন্তু বিরোধ শেষে বিশ্লেষণ আর সংশ্লেষণও হয়েছে। যে কারণে সতীদাহ রদ হয়েছে, বিধবা বিবাহের প্রচলন হয়েছে এবং ধীরে ধীরে সমাজ মেনে নিয়েছে।

অপরদিকে দেখুন আজকের এই সময়েও তিন তালাক রদ হলে কতো বিরোধ বিক্ষোভের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আর সেই বিরোধ বিক্ষোভের মুখ কারা? মুসলিম ধর্মগুরু এবং উচ্চবিত্ত মুসলিম সম্প্রদায়। সেখানে দরিদ্র বা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভূমিকা কি? তাদের একটাই ভূমিকা। এদের হাতে ব্যবহৃত হওয়া। তার নমুনাস্বরূপ কখনও পাথর ছুঁড়ে গ্রেপ্তার হওয়া আবার কখনও আগুন জ্বালিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া। কারন তাকে বোঝানো হচ্ছে এই পদক্ষেপ তার ধর্মের উপরে আঘাত। আদতে কেন, কি, সেসব কিছুই জানে না সে। এবার বলবেন কেন সে এই আহাম্মকী করছে? আমি এই প্রসঙ্গে আমার এক মুসলিম বন্ধুর বলা একটি লাইন লিখব, তিনি বলেছিলেন,

“আমরা তো সব শুনে মুসলিম, কেউই বুঝে মুসলিম নই”।

অর্থাৎ উপমহাদেশের বেশীর ভাগ মুসলিমেরই ইসলাম সম্বন্ধে সম্যক কোন জ্ঞান নেই। কারন সেই জ্ঞান অর্জন করার মতো পুঁথিগত বিদ্যা তার নেই। সেই জ্ঞান অর্জনের জন্য সে নির্ভরশীল তার ধর্মগুরুর উপরে। এবার এই জ্ঞানটি কিরকম হবে তা নির্ভর করে ধর্মগুরুর ব্যাখ্যার উপরে। দেখুন ঠিক হিন্দু সমাজেরই মতো কিন্ত। আমরাও বেশীরভাগ সংস্কৃত বুঝি না। রামায়ণ বা মহাভারত পড়িনি। আমরাও আমাদের ধর্মগুরুদের এই কারণেই মান্যতা দিই। কিন্তু আমাদের ধর্মগুরুরা আমাদের উন্নতির কথা বলেন। কারন আমাদের হয়ত পুঁথিগত বিদ্যা নেই। কিন্তু আমাদের শিকড় জুড়ে আছে আমাদের ধর্মের দর্শনের সাথে। আমরা এবং আমাদের ধর্ম দুইই এদেশের। ফলে আমি যদি শনিবারে নিরামিষ নাও খাই বা মঙ্গলবারে উপোস না করি সমাজ আমাকে বাঁকা চোখে দেখবে না। কিন্তু ইসলামে তা নয়। কারণ সেই একেশ্বরবাদ আর বহুত্ববাদের তফাত। তাই আমাদের ধর্মগুরুরা জানেন আমাদের ধর্মের নাগপাশে বাধতে গেলে আখেরে তারই ক্ষতি। যে কারণে আর্ট অব লিভিং জীবনশৈলীর কথা বলে, সেই কারণেই তাঁর এতো বাড়বাড়ন্ত, কিন্তু রামসেনা বা কর্ণী সেনা কখনই সমাজে সেই মান্যতা পায় না।

 

একেশ্বরবাদী ধর্ম বিচ্ছিন্নতার বাহক

এক্ষেত্রে আরও একটি বড় সমস্যা হোল মুসলিম সমাজ একদিকে এদেশে বৃহৎ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। অপরদিকে বাকী মুসলিম দুনিয়াতেও সে কখনও সেই মর্যাদা পায়নি যা একজন সৌদির মুসলিম বা তুর্কীর মুসলিম পান। ফলে তার মধ্যে সেদিক থেকেও এক হীনমন্যতা জন্ম নিয়েছে। সেই হীনমন্যতা কাটাতে সে আরও বেশী করে ধর্মাচারী হয়ে উঠেছে। আরও বেশী করে নিজেকে ধর্মের অনুশাসনে আবদ্ধ করেছে এবং বাকী মুসলিম দুনিয়ার কাছে সম্মান, প্রতিষ্ঠা পেতে চেয়েছে। ফলে একদিকে তারা তবলীগী জামাতের মতো সংগঠনের সমস্ত কাজকর্মকে নিশ্বর্ত সমর্থন দিয়েছে। অপরদিকে নিজের গোষ্ঠীকে প্রধান্য দিতে গিয়ে নিজেকে নিজের দেশ, সমাজ থেকে প্রতিদিন আরও বিচ্ছিন্ন করে চলেছে। এতে হয়ত উচ্চবিত্ত মুসলিম শ্রেণীর লাভ হয়েছে, তারা নিজেদের সমাজে নেতা হতে পেরেছেন। কিন্তু দরিদ্র মুসলিমদের কোন লাভই হয়নি। তাদের ভূমিকা সেই একই থেকে গেছে। পাথর ছোড়া, স্বাস্থ্যকর্মী পেটানো এবং ফলশ্রুতিতে নিজেদের আরও বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। এক্ষেত্রেও দেখবেন যারা তবলীগের কাজকর্মকে ঢাকা দিতে চায়, যারা কুযুক্তি খাড়া করে, যারা একে ধর্মের ব্যাখা দিয়ে মুসলিম সমাজকে ভুল বোঝাতে চায় তারা প্রত্যেকেই কিন্তু উচ্চবিত্ত মুসলিম বা ধর্মগুরু। তারা কিন্তু নিরাপদে, লকডাউন মেনেই রয়েছেন। তারা কেউই কিন্তু লকডাউন অমান্য করে থুতু দিতে বা পাথর ছুঁড়তে রাস্তায় নেমে আসেননি। কিন্তু মূল মাথা তারাই।

অর্থাৎ মোদ্দা কথা কি দাঁড়াল। মোদ্দা কথা এই দাঁড়াল যে একদল ধর্মগুরু এমন একটি গোষ্ঠী তৈরি করল যারা বাকী সমাজ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তাদের খাদ্যাভ্যাস, সাংস্কৃতিক অভ্যেস এমনভাবেই পালটে দেওয়া হোল যে তারা কোন দিনই বাকী বৃহত্তর সমাজের সাথে কোন সেতু তৈরিই করতে পারল না। বরং তাদের এই খাদ্যাভ্যাস, আচার বিচার এক সংঘাতের ক্ষেত্র তৈরি করল। বৃহত্তর সমাজ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে তারা এক বদ্ধ কুয়োর ভেতরে আটকে রইল এবং সেখান থেকেও যাতে কোনভাবেই সে বেরোতে না পারে তার জন্য তাকে আগাগোড়া বেঁধে ফেলা হোল ধর্মের অনুশাসনে। আর তার সামনে টোপ হিসাবে রাখা হোল সুবিধাভোগী উচ্চবিত্ত এক শ্রেণীকে। যারা ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মের অনুশাসন না মানলেও তাদের সমাজকে বোঝালেন ধর্মের পথে চলেই তাদের এই উন্নতি। তাই ধর্মই তাদের একমাত্র মুক্তির পথ। কাজেই সবসময় ধর্মকে সমর্থন করতে হবে। ধর্ম মাত্রেই সঠিক। ধর্ম কখনও ভুল হতে পারেনা। আজ থেকে হাজার বছর আগে যা ঠিক ছিল আজও তাই ঠিক। তার কোন পরিবর্তন, পরিমার্জনের প্রয়োজন নেই। এভাবেই যারা দরিদ্র তাদের দারিদ্র্যের মধ্যেই আটকে রাখার ব্যবস্থা করা হোল এবং ধর্মগুরুদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি নিশ্চিত হোল। আর এই দরিদ্ররা সবাই শুনে মুসলিম হয়ে রইল, তাদের বুঝিয়ে মুসলিম করা হল না।

যদিও আমার আলোচনাটি ভারতীয় উপমহাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তাহলেও বাকী বিশ্বের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। পৃথিবীর কোথাওই এঁরা দেশ বা সমাজকে ধর্মের আগে রাখতে পারেননি। এই অনীহা কি শুধুই সংখ্যালঘু হিসাবে বঞ্চনার কারণে নাকি সামাজিক বিচ্ছিন্নতার কারণে? সামাজিক বিচ্ছিন্নতার কারণ কি ধর্মের দর্শন নয়? যে দর্শনের শুধু আধিপত্যবাদ এবং বিস্তারবাদের কথাটিই মূল বলে এই ধর্মগুরুরা প্রচার করে চলেছেন। অপরদিকে একজন হিন্দুকে দেখুন তিনি কিন্তু নিজের ধর্ম এবং সংস্কৃতি বজায় রেখেও যে কোন দেশে, যে কোন সমাজে মিশে যেতে পারছেন। তার মূলে কি এই বহুত্ববাদের দর্শন নেই?

এর বাইরে আরেক শ্রেণী বর্তমানে মুসলিম সমাজে আছে, যাদের ভূমিকা আরও হতাশাজনক। আমার এক বন্ধু কদিন আগে বললেন, “দেখো তোমরা আমাদের তবলীগী জামাতের বিরোধিতা করতে বলছ, কিন্তু আমরা তো কোনদিন এসব বিষয়ে কোন কথাই বলিনি। তাহলে এখন হঠাৎ কি করে বলব”। এখানেই আমার বক্তব্য। এতোদিন আইসিস বা আল কায়দার বিরোধিতা করেননি, এখনও মৌলানা সাদের বিরোধিতা করছেন না। কিন্তু আপনাদের এই দীর্ঘ নীরবতা সম্মতির লক্ষন কিনা তা বৃহত্তর সমাজ কি করে বুঝবে যদি আপনি আপনার বক্তব্য জোর গলায় না বলেন। আপনার নীরবতাকে তো বৃহত্তর সমাজ সেক্ষেত্রে মৌনতা সম্মতির লক্ষণ বলেই ধরে নেবে। কাজেই এ দায় আপনারই, আপনাকেই পরিষ্কার করতে হবে যে আপনি কাকে সমর্থন করেন এবং কাকে করেন না। নাকি এটাই বুঝে নেব আপনিও এই ধর্মগুরুদের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস দেখাতে পারছেন না, কারণ আপনি নিজের গোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয় পাচ্ছেন অর্থাৎ প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিচ্ছেন যে এই ধর্মগুরুরাই আপনাদের শাসক। শাসকের রক্তচক্ষুকে আপনি ভয় পান।

 

সমাধান – মহিলাদের ক্ষমতায়ন

এতো গেল সমস্যার কথা। তাহলে কি এর সমাধান কিছু নেই? আছে, কিন্তু তা সময় সাপেক্ষ। কিন্তু হাজার বছর ধরে যখন একটি গোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে তখন সেই গোষ্ঠীকে আবার বৃহত্তর সমাজের সাথে মেলানোর কাজটি সময় সাপেক্ষ হবে বৈকি। বিশেষত কাজটি যখন সবে শুরু হয়েছে।

আমার মতে এই সমস্যার সমাধানের মূল অস্ত্র হোল মুসলিম মহিলাদের ক্ষমতায়ন। অবশ্যই এখানে ধনী মুসলিম সম্প্রদায়ের মহিলাদের কথা বলা হচ্ছেনা। মহিলাদের ক্ষমতায়ন বলতে দরিদ্র এবং খুব সামান্য পরিমাণ যে মধ্যবিত্ত সমাজের সৃষ্টি হয়েছে মুসলিম সমাজে তাদের ক্ষমতায়নের কথা বলছি। এই প্রসঙ্গে আরও বিস্তারিত আলোচনা করার আগে কিছু উদাহরণ তুলে ধরব, তাহলে হয়ত আপনাদের কাছে পরিষ্কার হবে কেন আমি মুসলিম মহিলাদের ক্ষমতায়নের কথা বলছি।

বছর তিনেক আগের ঘটনা, আমি আর আমার এক দাদা মালদায় একটি সামাজিক সংগঠনের কাজে গেছি। মালদার কোতয়ালীতে একটি কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। বিষয় গ্রামীণ সমাজে মহিলাদের ক্ষমতায়ন। উপস্থিত ৫০-৬০ জন মহিলা সবাই মুসলিম সমাজের। তা সেখানে দুটি বিষয়ে এনাদের খুব আগ্রহী দেখেছিলাম। এক – স্বনির্ভর হতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, দুই – নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়া। ও হ্যাঁ আরও একটা বিষয়, তখনও তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিয়ে তেমন কোন আলোচনা ছিল না। তাও এই মহিলাদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে ওনারা কি চান? তাৎক্ষণিক তিন তালাক থাকা উচিত নাকি উঠে যাওয়া উচিত? সকলেই সমস্বরে একটাই উত্তর দিয়েছিলেন। সকলেই বলেছিলেন তাৎক্ষণিক তিন তালাক অবিলম্বে উঠে যাওয়া উচিত। বর্তমান সরকার এনাদের এই মনের কথাটিই পড়ে নিতে পেরেছেন।

এই প্রসঙ্গেই আরও একটা মজার কথা বলি, আমার এক দাদা, যার ঐ এলাকায় কংগ্রেসী হিসাবেই পরিচিত ছিলেন, তাঁকে এক আড্ডায় জনা কয়েক ধার্মিক পুরুষ খুবই ক্ষোভের সাথে জানিয়েছিলেন যে মোদীজি তাদের মেয়েদের তাদের হাতের বাইরে বার করে নিতে চাইছেন। নাহ, আমি কোন মন্তব্য করব না কারুর মানসিকতা নিয়ে। আশা করি আপনারাই বুঝে নিতে পারবেন। আরও একটি ঘটনা এই মালদাতেই। সেখানকার একটি ক্লাবে মেয়েরা এথেলেটিক্সের চর্চা করত। স্থানীয় মৌলবীদের সেই ক্লাবটির উপরে যারপরনাই ক্ষোভ ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও মেয়েরা থেমে থাকেনি। ও হ্যাঁ, এই ক্লাবের অধিকাংশ মেয়েই ছিল মুসলিম সমাজের।

আরও একটি ঘটনার কথা শুনেছিলাম এক জনের কাছে। (কার কাছে এখন ঠিক মনে পরছেনা। নাহলে নাম নিতাম।) মহেশতলার কাছাকাছি কোন একটি জায়গায় সেখান থেকে মুসলিম সমাজের মেয়েরা রোজ সকালে ট্রেন ধরে কোলকাতায় আসেন জীবিকার কারণে। তা সকালে যখন এঁরা ট্রেন ধরতে বেরোতেন সেই পুরো সময়টায় মসজিদের মাইক থেকে এদের উদ্দেশ্য করে ক্রমাগত কটু কথা বলে যাওয়া হতো। এঁরা যে কতো পাপী, এদের নরকেও স্থান হবেনা ইত্যাদি। ক্রমাগত এরকম শুনতে শুনতে একদিন ১১ টি মেয়ে ঠিক করে তাদের বাড়ি থেকে আর তারা মসজিদের ইমামদের কোন খাবার পাঠাবেনা।তাদের রোজগার যখন হারাম, তাহলে সেই রোজগারের টাকায় খাওয়াও হারাম। (প্রতিটি মসজিদে যিনি ইমাম থাকেন, তাঁর ভরণপোষণের ভার সেই স্থানীয় অঞ্চলের মানুষের উপরে। মসজিদের বাক্সে প্রতিদিন নামাজের সময় যে টাকা জমা পরে তার উপরে ইমামের অধিকার, আর প্রতিদিন কোন না কোন বাড়ি থেকে তাঁকে খাবার পাঠানো হয়। বোধহয় করোনা উপেক্ষা করেও কেন মসজিদে যেতেই হবে বলে ধর্মগুরুরা প্রচার করছেন তার উত্তর আপনারাও ঐ “প্রণামীর” বাক্সেই খুঁজে পেলেন।) এই মহিলারা খাবার বন্ধ করে দেওয়ার পরে ইমাম সাহেবের নেতৃত্বে তাদের বাড়িতে হামলা হয়। শেষমেশ এই ১১ জন বাধ্য হন আবার আগের মতো খাবার পৌছে দিতে। হয়ত ঘটনাটি খুবই সামান্য বলে মনে হবে আপনাদের। কিন্তু খুব ছোট্ট কোন স্ফুলিঙ্গ থেকেই কি দাবানলের সৃষ্টি হয়না?

আমার অভিজ্ঞতায় মুসলিম মহিলারা মুসলিম পুরুষদের থেকে বেশী পরিশ্রমী এবং বুদ্ধিমতীও বটে। আর যেহেতু তারা নারী তাই তাদের স্বাভাবিক আকর্ষণ সৃষ্টির প্রতিই, ধ্বংসের দিকে নয়। ফলে তারা যখন তাদের আশপাশের হিন্দু সমাজের মেয়েদের দেখছে স্বনির্ভর হতে, সংসারের চালিকা শক্তি হতে, তখন তারাও এই নাগপাশ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এই কারণেই মাঝে মাঝে এখানে ওখানে দুই একটা স্ফুলিঙ্গ হঠাৎ হঠাৎ করেই জ্বলে উঠছে। এখন এই স্ফুলিঙ্গকে দাবানলে পরিণত করার জন্যই ক্ষমতায়নের প্রয়োজন। সেই কারণেই প্রয়োজন এদের উচ্চশিক্ষায় সহায়তা করা। এদের স্বনির্ভর হতে সহায়তা করা। সম্ভবত এই কারণেই বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার মুসলিম মহিলাদের উচ্চশিক্ষার্থে বেশ কিছু কর্মসূচী নিয়েছেন। আমার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি এর ফল আখেরে সমাজের জন্য ভালোই হবে। এই দরিদ্র শ্রেণীর যতো বেশী সংখ্যককে যত তাড়াতাড়ি মধ্যবিত্ত শ্রেনীতে তুলে আনা যাবে ততই বিশ্লেষণ এবং সংশ্লেষণের কাজটি গতি পাবে। আরও একটি বিষয় যা আমি বিশ্বাস করি তা হোল সন্তান তার জীবনশৈলীর মূল শিক্ষা তার মায়ের থেকেই পায়। কাজেই মা যতখানি এই ধর্মগুরুদের অনুশাসন আলগা করতে পারবেন, তার সন্তানও তত এই অনুশাসন আলগা করতে পারবেন।

মুসলিম ধর্মগুরুরা, ধনীরা এবং আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী লিবেরালরা এতে ভয় পাবেন। কারন তাদের আধিপত্য, জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে তারা নানা ছদ্মবেশ ধারণ করে এর বিরোধিতা করবেন। কিন্তু তাতে দমে না গিয়ে এই কাজটি চালিয়ে যাওয়া দরকার এবং একই সাথে এই পদ্ধতিতে মুসলিম ধর্মগুরু ও ধনী সম্প্রদায়কে বাকী মুসলিম সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করার কাজটিও চালু থাকবে। যা আখেরে এই সমস্যার একটি সমাধানের দিকে আমাদের ভবিষ্যতে পথ দেখাবে। মুসলিম সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংখ্যা বাড়াবে। মনে রাখবেন সমাজকে আলো দেখাতে পারে মধ্যবিত্ত সমাজই। তারাই আনতে পারে পরিবর্তন। সেই কারনেই সমাজে একটি শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রয়োজন। এরা যতো স্বনির্ভর হবে, যতো স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে তত পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়বে।

(সমাপ্ত)