মমতা সরকার করোণা ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের একজোট লড়াইয়ের পরিপন্থী

0
489
করোণা ভাইরাসের সমস্যা ভারতবর্ষে যখন থেকে শুরু হয়েছে তখন থেকেই পশ্চিমবঙ্গের সরকার ও কেন্দ্র সরকারের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়েছে। এই বিবাদের মধ্যে অনেকগুলো প্রশ্ন রয়েছে। প্রথম প্রশ্ন এটা কি নীতির জন্য বিবাদ, না সদিচ্ছার অভাবের জন্যে? দ্বিতীয় কথা মহামারী বিষয়ে নাকি পশ্চিমবঙ্গ সরকার সবথেকে বেশি উপেক্ষিত হচ্ছে। এর পিছনে কারণটা কি? মোদী সরকার কি আসলে মমতা সরকারকে সাহায্য করছে না? নাকি মমতা সরকার কেন্দ্র সরকারকে উত্তর দেওয়ার হাত থেকে বাঁচার জন্যে সহযোগিতা করছে না? এই বিষয়গুলো বোঝার প্রয়োজন।

গত ২০শে এপ্রিল কেন্দ্র সরকার নিজের উদ্যোগে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে। লকডাউন, জরুরি পরিষেবা এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়গুলি জানার জন্যে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল পাঠানো হয়েছিল। একটি দল দক্ষিণবঙ্গের কলকাতায় আসতেই, একটা বড় বাদানুবাদ শুরু হলো। মমতা সরকারের মুখ্যসচিব একটা চিঠিতে বলেন,

“এই যে দল বাংলায় পাঠানো হয়েছে, এদেরকে আমাদের রাজ্যে ঘোরার অনুমতি দেওয়া হবে না।”

কিন্তু তারপরে কিছু শর্তে ওই দলকে ঘোরার অনুমতি দেওয়া হলেও বলা হলো রাজ্য সরকারের একজন আধিকারিক ওনাদের সাথে থাকবেন। আর এরকম বোঝানোর চেষ্টা হল যে,এই পর্যবেক্ষক দলটিকে কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এটা সত্যি নয়। এই কেন্দ্র সরকারের টিম মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর,রাজস্থান গেছে। ২৪শে এপ্রিলে গুজরাট, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, তেলেঙ্গানার জন্যেও এই দলটি রওনা দিয়েছিল। কিন্তু মমতা সরকার বলছে যে বিজেপি ফেডারেল কাঠামোকে মানছে না,মোদী সরকার খারাপ মতলবের জন্যে এটা করছে। এবার প্রশ্ন উঠছে যে পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জির সরকার যে বিবাদ সৃষ্টি করলেন তা দেশের অন্য আর কোন রাজ্য সরকার করেনি। তাহলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কি লুকাতে চাইছিল?

দেশে  করোণা ভাইরাস টেস্টিং বাড়ানোর জন্যে প্রথম থেকেই বিবেচনা হচ্ছিলো। ৬ই এপ্রিল অবধি ভারতে প্রতিদিন করোণা ভাইরাস পরীক্ষা হয়েছে দশ হাজার। এটা বাড়ানোর জন্যে কেন্দ্র সরকার অনেক চেষ্টাই চালিয়ে গেছে। আর ১০ই এপ্রিলের মধ্যে সেটাকে দ্বিগুনও করেছে। ৬ই এপ্রিল অবধি মোট পরীক্ষা হয়েছিলো মাত্র ৮০ হাজার।আর ২৫শে এপ্রিলে এই পরীক্ষার সংখ্যা  ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়ে হয়ে গেল ৫লক্ষ ৮০ হাজার।

ভারতের মেডিক্যাল কাউন্সিল রিসার্চের (ICMR) তথ্য থেকে আমরা জানতে পারছি, ১৪ই এপ্রিল অবধি COVID-19 পরীক্ষা হয়েছে ২ লক্ষ ৪৪ হাজার। আর তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে পরীক্ষা হয়েছে তিন হাজার একাশিটি মাত্র । ১৪ই এপ্রিলের এই তথ্য অনুযায়ী গোটা দেশে প্রতি দশ লক্ষ মানুষে গড়ে পরীক্ষা হয়েছে ১৯৩ জন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে প্রতি দশ লক্ষে পরীক্ষা হয়েছে মাত্র ৩৪ জনের। এখনও অবধি প্রতি লক্ষ রাজ্যবাসীর মধ্যে পরীক্ষা হয়েছে ৯.২ জনের।যেটা ভারতবর্ষের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২৪শে এপ্রিলের তথ্য অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে টেস্টিংয়ের সংখ্যা ৩,০৮১ থেকে ৮,৯৩৩ পৌঁছে গেছে। যখন পশ্চিমবঙ্গে প্রথম করোণা ভাইরাস পজেটিভ কেস লকডাউনের ৮দিন আগেই চলে এসেছিলো ,তখন কেন সঠিকভাবে পরীক্ষা করা হল না। এর পিছনে কারণটা কি? মমতা সরকারের বক্তব্য কেন্দ্র সরকারের থেকে তাঁরা সাহায্য পাচ্ছেন না। এটা কি নিছকই ওনার একটি বক্তব্য নাকি এর পিছনে কোন সত্যতা আছে? এটা অনুধাবন করা আমাদের জন্য জরুরী।

ভারতের মেডিক্যাল কাউন্সিল রিসার্চের (ICMR) বক্তব্য অনুযায়ী কলকাতার মধ্যে সরকার অনুমতি দিয়েছে ৯টি ল্যাবকে। এছাড়াও কিছু হাসপাতালকেও নিজস্ব ভাবে করোণা ভাইরাস পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু মমতা সরকার নির্দেশ জারি করেছে যে স্বাস্থ্য বিভাগের অনুমতি ছাড়া হাসপাতাল পরীক্ষা করতে পারবে না। এজন্যেই যাঁরা পয়সা দিয়ে টেস্ট করতে পারতেন তাঁরাও অসুবিধায় পড়েছেন। এর ভিতরেই সংবাদমাধ্যমের খবর দেখা যায়, যাদের ব্যাধির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তাঁদের এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে বিভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে।

কম পরীক্ষার যখন প্রশ্ন উঠলো তখন তৃণমূল সরকার দোষারোপ করলো যে কেন্দ্র সরকার এখানে টেস্টিং কিট দিচ্ছেনা। কিন্তু ১১ই এপ্রিল ভারতের মেডিক্যাল কাউন্সিল রিসার্চের (ICMR) কোলকাতার ডিরেক্টর ডঃ শান্তা দত্ত স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে,পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে ২৭,৫০০ টেস্টিং কিট আছে। এবার স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যদি টেস্টিং কিট থাকেই,তাহলে সঠিকভাবে টেস্ট কেন করায়নি পশ্চিমবঙ্গ সরকার। আর এমন খবর এসেছে যে,রাজ্য সরকারের অনেকগুলো হাসপাতালে টেস্টিং কিট ছিলো কিন্তু টেস্ট করানো হচ্ছিল না। এর মাঝেই সংবাদমাধ্যমে খবর এলো অন্য দেশ থেকে যে টেস্টিং কিটগুলো নেওয়া হয়েছিলো,সেটা ভালো রেজাল্ট দিচ্ছে না। এই টেস্টিং কিট অন্যদেশ থেকে আমদানি হয়েছিলো, অনেক রাজ্যেই কিট ভালোভাবে কাজ না করার খবর সামনে আসে। ভারত সরকার সেজন্যে খুব দ্রুত সেই কিট ফেরত পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু মমতা সরকার এই বিষয়টিকে এমনভাবে উপস্থাপন করলো, যেন সব খারাপ কিট শুধু পশ্চিমবঙ্গেই পাঠানো হয়েছে। এইরকম দোষারোপ করে, আসলে মমতা সরকার নিজের রাজ্যে কম টেস্টিং করানোর দোষ থেকে বাঁচতে চাইছে।

এই লেখাটি পাঠানোর সময় অবধি ভারতবর্ষে আটশোর বেশি মানুষ মারা গেছেন। মহারাষ্ট্র,রাজস্থান,গুজরাট,মধ্যপ্রদেশ ও দিল্লি সব থেকে বেশি প্রভাবিত। কিন্তু মৃত্যুর সঠিক সংখ্যা জানানোতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যে অনীহা, তা আর কোন রাজ্যের সরকারের মধ্যে দেখা যায়নি। ২রা এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছিলো। আর ওই কমিটি করোণা ভাইরাসে সাতজন মানুষ মারা যাওয়ার যে রিপোর্ট বার করেছিলো তার ঠিক একঘন্টা পর রাজ্যসরকারের মুখ্যসচিব প্রেস কন্ফারেন্স করে মৃতের সংখ্যা সাত থেকে কমিয়ে বলেছিলেন তিন। এই ঘটনাই মমতা সরকারের অভিসন্ধি নিয়ে সন্দেহ তৈরী করে।

এরপরে সাতজনের মৃত্যুর কথা যে কমিটি বলেছিল, রাজ্য সরকার তা বদলে পাঁচ সদস্যের কমিটি তৈরী করে। এই কমিটি ৩০টি শর্তের উপরে মৃত্যুর তথ্য ঘোষণার নির্দেশ দিতে বাধ্য হয়েছিল। কোন মৃত্যু করোণা ভাইলাসে আর কোন মৃত্যু তা নয়, তার সিদ্ধান্ত নিতে রাজ্য সরকার একটি দুটি নয়, পুরো তিরিশটা শর্ত কাগজে উল্লেখ করেছিল। এতে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। এই সন্দেহ আরো বেড়ে যায় যখন ১১ই এপ্রিল একটা রিপোর্টে কলকাতা মিউনিসিপ্যালিটি বলেছিলো, দশজন মানুষ মারা গেছে এবং সেইভাবে তাদের শেষকৃত্যের কথা জানানো হয়েছে। ১৩ থেকে ১৫ এপ্রিলের মধ্যে এম. আর. বাঙুর  হাসপাতালে যে রোগীরা ভর্তি ছিলো, স্থানীয় সংবাদমাধ্যম যখন ওদের কাছ থেকে রিপোর্ট করে বলেছিল ১১ জন করোণা ভাইরাস পজেটিভ মানুষ মারা গেছে। কিন্তু ১৫ই এপ্রিল যখন রাজ্য সরকার মৃত্যুর তথ্য দিলেন, তখন বললেন শুধুমাত্র সাতজন মানুষ মারা গেছে।

মৃত্যুর তথ্যের ব্যাপারে এতো মত পার্থক্য কেন? এই প্রশ্নটাই যখন কেন্দ্র সরকারের প্রতিনিধি দল রাজ্য সরকারের আধিকারিকদের জিজ্ঞাসা করল, তখন মমতা  সরকার বললেন যে  বিজেপি ফেডারেল কাঠামোকে মানছে না, আমাদের উপরে আক্রমণ করছে। আমাদের উপরে আক্রমণ করে মিডিয়াকে বিভ্রান্ত করছে। ২৫ শে এপ্রিল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের করোণা ভাইরাস আক্রান্তের উপর দেওয়া তথ্যানুসারে মোট আক্রান্ত ব্যক্তির ১১.০৯ শতাংশ মারা গেছেন, এটা সত্যিই উদ্বেগের। মৃত্যুর এই গড়টা অন্য যেকোন রাজ্যের তুলনায় দ্বিগুনের থেকেও কিন্তু বেশি।

এখন প্রশ্ন উঠছে যখন গোটা দেশ একসাথে এই মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে একজোট হয়েছে এবং নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা করছে, প্রধানমন্ত্রী নিজেই বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সাথে কথা বলছে, তাদের মতামত নিচ্ছে, এরমধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেন এমন অবস্থার সৃষ্টি করছে? কেন সমস্যাটাকে না মিটিয়ে উল্টে দোষারোপ করছে, ফেডারেল কাঠামোয় হামলা বলছে আর কেন্দ্র সরকার আমাদের প্রতারিত করছে, এইসব কথা কেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার বলছে?

লেখক শিবানন্দ দ্বিবেদী ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রিসার্চ ফাউণ্ডেশনের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো এবং অমিত শাহের রাজনৈতিক জীবনীগ্রন্থের লেখক। এই লেখাটি আদতে দৈনিক জাগরণ এবং দ্য প্রিণ্টে বেরিয়েছিল। অনুবাদ করেছেন বিশ্বজিৎ পাল।