Thursday, May 9, 2024
spot_img
HomeArchivesপ্যাঙ্গন ৎসো সংঘাত : চীনের দাবড়ানি ভারত ভাঙতে চায়

প্যাঙ্গন ৎসো সংঘাত : চীনের দাবড়ানি ভারত ভাঙতে চায়

মিডিয়ার সুবাদে আমরা সবাই জানি যে, লাদাখে চলা ভারত চীন সংঘাত চার সপ্তাহ ধরে চলছে, এবং আশংকা হচ্ছে যে, বিবাদ সহজে থামবে না, উল্টে আরও বেড়ে চলবে। ভারত ও চীনের মধ্যে যে কবার দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হয়েছে, সবই চূড়ান্ত ব্যর্থতার সাথে শেষ হয়েছে। দুই পক্ষই লাদাখের কাছে সেনা মোতায়েন করা শুরু করেছে। যা দেখে বিশ্ব উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। দিল্লি ও ওয়াশিংটন সীমান্তে ঘটে চলা বিবাদ নিয়ে আলোচনা করেছে।

মোদী সরকার খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই নিয়ে মুখ খুলছে না। তাদের এই নীরবতার পাশাপাশি শেষ কুড়ি দিনে দুই রকমের প্রতিবেদন বের হচ্ছে। এক রকম প্রতিবেদন উপগ্রহ চিত্রের ওপর ভিত্তি করে ও অপরটা সূত্রের ভিত্তিতে তৈরি হচ্ছে।

যেহেতু সেখানে কি হয়ে চলছে, তা স্পষ্ট করে জানা যাচ্ছে না, ফলে সহজেই পরস্পরবিরোধী সব খবর বেরুচ্ছে; ফলে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে স্বাভাবিক ভাবেই। তথাকথিত ভারতীয় মিডিয়ার একাংশ যেখানে খবর ছড়াচ্ছে যে, চায়নার সেনাবাহিনী বা পিএলএ ভারতের সীমান্তের মধ্যে বেশ কয়েকবার ঢুকে পড়েছে; সেখানে উপগ্রহ চিত্র থেকে স্পষ্ট হচ্ছে যে, চায়না ভারতের দখলে থাকা কোনও অংশই দখল করে নি বা ঢুকতেও পারেনি।

মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি আরও বেড়েছে রাজনাথ সিংহের জন্য, যিনি বেশ কয়েকবার মিডিয়াকে সাক্ষাৎকার দিলেও; একবারের জন্যও সেখানে সত্যিই কি হয়ে চলেছে — তা খোলসা করেন নি। তবে এটুকু স্পষ্ট হয়েছে যে, ভারত চীনের তরফে এতদিন ধরে যে স্ট্যাটাস কুও বজায় রাখা হয়েছে, তা ভাঙতে চায়। চীন তাদের বহু সৈন্য ঐ অঞ্চলে সমাবিষ্ট করেছে এবং ভারতও পিছিয়ে নেই।

এখন প্রশ্ন হল, চীনের স্ট্যাটাস কুও আসলে ঠিক কি? যেটা নয়াদিল্লী ভাঙতে চাইছে? যেখানে উপগ্রহ চিত্রে দেখা যাচ্ছে চীনের তরফে কোনও অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেনি।

এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে একটা কথা জানিয়ে রাখি — লাদাখ নিয়ে চীন ও ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। চীন কিছু জায়গায় সেনা মোতায়েন করতে চাইছে ম্যাকমোহন লাইন ঠিক রাখার অজুহাতে, যেটা ভারতের না পছন্দ। সীমান্তে মধ্যে একটা ধূসর জায়গা আছে, যা কিনা দুই পক্ষের কাছে শক্তি প্রদর্শনের জায়গা। দুই পক্ষই ঐ ধূসর এলাকায় নিয়মিত সেনা পাঠিয়ে একে অপরকে ‘চমকে দেওয়ার’ চেষ্টা করে। ঠিক এই কারণে দুই পক্ষের মধ্যে মাঝেমধ্যেই মুষ্টিযুদ্ধের কথা মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়।

নীল জায়গাটি ভারতের আর কমলা জায়গাটি চীনের সর্ববাদীসম্মত। মাঝের ধূসর জায়গায় উভয়ের সেনাই আসা-যাওয়া করে।

 

যদি এক পক্ষ অপর পক্ষকে ঐ ধূসর এলাকায় যেতে বাধা দেয়, তবে সেটা স্বাভাবিক ভাবেই স্ট্যাটাস কুও ভাঙবার শামিল হবে। এইভাবে ধূসর এলাকায় সেনা পাঠিয়ে বিপক্ষকে আটকে দেওয়া রণনীতির অঙ্গ নিঃসন্দেহে, বিশেষ করে যেখানে দুপক্ষের পক্ষে সেনা প্রেরণ করা মোটেই সহজ কাজ নয়।

পূর্ব লাদাখের কাছে গালওয়ান উপত্যকা অঞ্চলে, যেখানে নিয়মিত দুপক্ষের সংঘাতের সংবাদ খবর আসছে, সেটা আসলে লাইন অফ আকচুয়াল কন্ট্রোল বলে গণ্য। অর্থাৎ দুই পক্ষের কাছেই কার্যত সেটাই চূড়ান্ত সীমানা। যদিও ধূসর এলাকা নিয়ে বিবাদ সেই ১৯৬০ দশক থেকেই চলছে এবং তা কোনওদিনই থামবে না বলে মনে হচ্ছে। দুই পক্ষের কাছে ধূসর এলাকা হচ্ছে প্যাঙ্গন ৎসো হ্রদ অঞ্চল। হ্রদের পশ্চিম সীমানাকে ভারত নিয়ন্ত্রিত এলাকা বলে মনে করা হয়। পুরো প্যাঙ্গন ৎসো হ্রদটাই ধূসর অঞ্চল হিসাবে গণ্য।

লম্বায় ১৩৫ কিলোমিটার প্যাঙ্গন ৎসো হ্রদের প্রায় ৫৪ কিলোমিটার ভারতের মধ্যে পড়ে, যার দক্ষিণপূর্বে লেহ শহর অবস্থিত। বাকি অংশ চায়নার তিব্বত অংশে পড়ে। প্যাঙ্গন ৎসো বিশ্বের সর্বোচ্চ লবণ জলের হ্রদ।

প্যাঙ্গন ৎসো হ্রদের উত্তরাংশ রয়েছে চ্যাং চেন্মো শৈলশিরা। প্যাঙ্গন ৎসো হ্রদের উত্তর দিকে রয়েছে অদ্ভুত দর্শন সৈকত, যা ভারতীয় সেনার কাছে ‘আঙ্গুল’ নামে পরিচিত। এরকম আঙ্গুলের সংখ্যা ৮। সবই উত্তরাংশে অবস্থিত।

৪ নং আঙ্গুলে, যা কিনা পশ্চিমে অবস্থিত, তা ফক্সহোল শৈলশিরার কাছে রয়েছে; সেখানে ভারতের শিবির আছে। ভারতের দাবি অনুসারে লাইন অফ আকচুয়াল কন্ট্রোল ৮ নং ‘আঙ্গুল’ পর্যন্ত বিস্তৃত, যেখানে চায়নার দাবি অনুসারে লাইন অফ আকচুয়াল কন্ট্রোল ৪ নং আঙ্গুল থেকে শুরু হয়েছে; যা পূর্বদিকে অবস্থিত। মানচিত্রে দেখুন।

২ ও ৩ নং ‘আঙ্গুল’ এলাকায় ইন্দো-তিব্বত পুলিস শিবির রয়েছে। মানচিত্রে শিবিরটা কমলা রং দিয়ে চিহ্নিত দেখা যাচ্ছে। শিবিরটা ২০১৩-১৪ সালের আশপাশে সময়ে নির্মিত হয়েছিল। এদিকে চায়না আবার ৮ নং ‘আঙ্গুলের’ কাছে শিবির করে বসে আছে। মানচিত্রে লাল রং দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এর ফলাফল হয়েছে এই যে, দুই পক্ষই ৪ থেকে ৮ নং আঙ্গুলের মধ্যে নিয়মিত টহলদারি চালায়, মাঝেমধ্যেই অনুপ্রবেশের ঘটনাও হয় বৈকি।

প্ল্যানেট ল্যাবসের তরফে তোলা সর্বশেষ উচ্চ প্রযুক্তির উপগ্রহ চিত্র থেকে এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, চায়না সেনাবাহিনী ৪ নং ‘আঙ্গুলের’ খুব কাছেই পূর্বদিকে শিবির বসিয়েছে।

এখানে বলে রাখা দরকার ৪ নং আঙ্গুলের পশ্চিমাঞ্চল ভারতের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। উপগ্রহ চিত্র থেকে স্পষ্ট হচ্ছে যে, ২ ও ৩ নং আঙ্গুলের খুব কাছেই ইন্দো-তিব্বত পুলিস নতুন শিবির তৈরি করেছে। ৩০ মে আপলোড হওয়া উপগ্রহ চিত্র থেকে সেটা স্পষ্ট হচ্ছে।

৪ ও ৬ নং আঙ্গুল এলাকা জুড়ে চীন শিবির বসাচ্ছে। তারা মাটি খোঁড়ার যন্ত্রপাতি নিয়ে ৪ নং আঙ্গুলের পূর্বদিকে চলে এসেছে।

তাদের কার্যকলাপ নিম্নলিখিত উপ্রগ্রহ চিত্র থেকে পরিষ্কার হচ্ছে।

নিম্নলিখিত উপগ্রহ চিত্র থেকে এটাও পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, চীনা সেনাবাহিনী অন্তত কয়েক মাস আগে থেকেই ৪ নং থেকে ৮ নং আঙ্গুলে শিবির বানানোর কাজ শুরু করেছে। তারা এই কাজটা গোপন রাখার জন্যই এতদিন ধরে টুইটারে কোনও পোষ্ট করেনি, পাছে তাদের কুকীর্তি ধরা পড়ে যায়।

চীন ভারত নিয়ন্ত্রিত এলাকা দখল করে নি। তার দরকারও নেই। তারা শুধু ভারতকে চাপে রাখতেই ৪ নং আঙ্গুলের কাছে শিবির বানিয়েছে। এবং সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে নিয়মিত সংঘাতের সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে।

শুধু তাই নয়, চীন একই সাথে ৪ থেকে ৬ নং আঙ্গুলের মধ্যে বিশাল পরিমাণ সৈন্য মোতায়েন করে ভারতীয় টহলদার বাহিনীকে চাপে রাখার চেষ্টা করছে। যে কাজটা তারা অনেক আগে থেকে ৮ নং আঙ্গুল থেকে শুরু করেছিল শেষ দশ বছর ধরে। চীন যদি একবার ৪ নং আঙ্গুল দখল করে ফেলে, সেক্ষেত্রে তারা ৪ থেকে ৮ নং আঙ্গুল পর্যন্ত বিপুল ভূখণ্ড দখল করে নিতে সক্ষম হবে। যেটা ভারতের কাছে খুবই সমস্যার কারণ হবে, কেননা রণনীতিগত সমস্যার মুখে পড়বে।

চীন একেই স্ট্যাটাস কুও বলছে, যেটা ভারত মানতে রাজি নয়। ভারত চাইছে ১ থেকে ৮ নং পর্যন্ত আঙ্গুল এলাকা চায়নার দখলমুক্ত হোক।

স্বরাজ্যের সাংবাদিক প্রখর গুপ্তের এই প্রবন্ধটি অনুবাদ করেছেন রিচার্ড জুনিয়াস জয়বর্ধনে।

বঙ্গদেশ বারবার চেষ্টা করছে মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে না আসা খবরগুলো আপনাদের সামনে আনার। আমরা আপনাদের খবর করি, আপনাদের কথা লিখি। আমাদের এই প্রচেষ্টা ভালো লেগে থাকলে ১০ থেকে ১০,০০০ যে কোন মূল্যের ডোনেশন দিয়ে বঙ্গদেশের পাশে দাঁড়াতে পারেন। আমাদের আরও ভালো কাজ করার জন্য উৎসাহ দিতে পারেন। ধন্যবাদ।

Most Popular