বামপন্থী প্রোপাগাণ্ডার জাল ছিন্ন করে বীর সাভারকর আজ‌ও স্বমহিমায় মহিমান্বিত

0
3969

ইতিহাসের পাতায় যতজন ব্যক্তিত্ব বিতর্কিত আখ্যা পেয়েছেন তার মধ্যে সাভারকর অন্যতম‌। বিনায়ক দামোদর সাভারকরকে ইতিহাস একইসঙ্গে বীর এবং বিপজ্জনক সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করেছেন। সাভারকর তৎকালীন সময়ে জাতীয়তাবাদী মানসিকতার বহু নেতাকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম কমিউনিস্টদের আদিপুরুষ এম এন রায়, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, এস এ ডাঙ্গে প্রমুখও ছিলেন। যদিও স্বাধীনতার পর নব্য কমিউনিস্টরা পূর্বসূরিদের দৃষ্টিভঙ্গি বাতিল করে সাভারকরের ভাবমূর্তি ধ্বংসের জন্য মুখিয়ে থাকে। এর পাশাপাশি সাভারকরকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী বিশ্বাসঘাতক এবং ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে প্রমাণ করতেই ব্যস্ত।

 সাভারকরের বিরুদ্ধে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ, তিনি আন্দামানের সেলুলার জেলে থাকার সময় ব্রিটিশ সরকারের নিকট মুচলেকা দিয়ে ক্ষমাভিক্ষা চেয়েছিলেন। এ বিষয়  নিয়ে প্রথমে বহু বিতর্ক সৃষ্টি হয়।  এর পিছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল সেই সময় জাতীয়তাবাদী শক্তির উত্থানে প্রমাদ গুনেছিলেন বামপন্থীরা। তারা ক্রমাগত কোণঠাসা হতে থাকে। নিজেদের মান ইজ্জত বাঁচাতে বামপন্থীরা সেই কারণে সাভারকরকে সফট টার্গেট করে এবং তিনিই “হিন্দুত্ব” নামক বিষবৃক্ষের শিকড় ছড়িয়ে দিতে চাইছেন বলে অপপ্রচার শুরু করেন। কুটনৈতিক বামপন্থীরা দুর্বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে  সাভারকরের জীবন সংক্রান্ত প্রকৃত সত্য ও সাভারকর সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধ্যান ধারণা পালটে ফেলার জন্য তৈরি হলো প্রোপাগণ্ডামূলক কৃত্রিম ইতিহাস।

বামপন্থীদের শুনতে অপ্রিয় লাগলেও অকপট সত্যিটা হল, ভারতীয় কমিউনিস্টদের প্রথম যুগের নেতারা এম এন রায়, ই এস এম নাম্বুদ্রিপাদ প্রমুখ যারা সাভারকরের সমসাময়িক ছিলেন সাভারকরকে অসম্ভব শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের কমিউনিস্টরা তাদের রাজনৈতিক মুনাফা লাভের আশায় সাভারকরকে জনমানসে ঘৃণ্য প্রতিপন্ন করার জন্য নানারকম মনগড়া তত্ত্ব সাজিয়ে গুছিয়ে ইতিহাসের মোড়কে তুলে ধরতে শুরু করলেন।

যদিও সাভারকর সম্পর্কিত বাম প্রোপাগাণ্ডা এবং সাভারকরের জীবন ও জীবনকালের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত সত্য ঘটনাবলী নিয়ে বহু গ্রন্থ আজ পাওয়া যায়। এবং এইসব গ্রন্থ মোটেই দুষ্প্রাপ্য নয়। আপনি একজন বামপন্থীকে প্রশ্ন করতেই পারেন, সাভারকর-সম্পর্কিত এই ‘নতুন’ তথ্যাবলীর উৎস কী?  যদি সবটাই সত্যি হয় তবে সাভারকরের সমসময়িক বাম নেতারা কেন সাভারকরের বিরুদ্ধে এই অভিযোগগুলো করেননি? ওদের কাছে কেন সাভারকরের নাম শুনলেই এক অকুতোভয় দেশপ্রেমিক, প্রচণ্ড সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী এবং অসমসাহসী যোদ্ধার চিত্র ফুটে উঠতো?

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে শচীন্দ্রনাথ সান্যালের নাম‌ না নিলে  অপূর্ণ থেকে যাবে। শচীন্দ্রনাথ সান্যাল ছিলেন  রাসবিহারী বসুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং সহকারী, অনুশীলন সমিতির পটনা শাখার প্রতিষ্ঠাতা, এবং চন্দ্রশেখর আজাদের দীক্ষাগুরু। গদর আন্দোলনের সঙ্গেও শচীন সান্যাল জড়িত ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশ সরকারের কাছে শচীন সান্যাল হয়ে ওঠেন মোস্ট ওয়ান্টেড পার্সন, এবং বিচার নামক প্রহসনের দৌলতে  তাঁর গন্তব্যস্থল হয় আন্দামানের সেলুলার জেল। সেলুলার জেলে তাঁর সঙ্গে বন্দী ছিলেন সাভারকার ভ্রাতৃদ্বয়। নিজের আত্মজীবনী বন্দী জীবন ( যা তৎকালীন বিপ্লবীদের অবশ্যপাঠ্য ছিল) গ্রন্থে লিখেছেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে রিফর্ম অ্যাক্ট লাগু করা হলে তিনি নিজেও সরকারকে সহায়তার আশ্বাস দিয়ে মুক্তির আবেদন করেন। মূলত এটি বন্দীদের একটি আইনি অধিকারের মধ্যে পড়ে। কিন্তু তৎকালীন সরকার শচীন সান্যালকে মুক্তি দেয়, সাভারকরকে নয়। শচীন সান্যাল কারণ হিসাবে বলেছিলেন, বিনায়ক দামোদর সাভারকার, বাবারাও সাভারকর এবং অভিনব ভারত সংগঠনের অন্যান্য বিপ্লবীদের সেলুলার জেলে পাঠানোর ফলে বোম্বে প্রভিন্সে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে যায়।  সরকারের ভয় পেয়েছিল সাভারকরকে মুক্তি দিলে আবার মহারাষ্ট্রে বিপ্লবের তেজের আগুন জ্বলে উঠতে পারে। তাই সাভারকরকে মুক্তি দেওয়া অসম্ভব ছিল।

সাভারকরের সহবন্দীরা,যেমন শচীন্দ্রনাথ সান্যাল, বারীন ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়,ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, কেউ তাঁর সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গ বক্রোক্তি করেননি ,যে কুৎসার ট্র্যাডিশন স্বাধীনতা উত্তর সময়ে বামপন্থীদের মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু  ভারতীয় কমিউনিস্টরা যে রীতিমতো ব্রিটিশদের সাহায্য করেছিল , এবং পি সি যোশী হোম সেক্রেটারি রেজিনাল্ড ম্যাক্সওয়েলের কাছে উপস্থিত হয়ে ব্রিটিশ সরকারকে সম্পূর্ণভাবে সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছিলেন আর ইন্টালিজেন্স ব্যুরোর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছিল, সেটা তারা সযত্নে এড়িয়ে যায়। ত্রৈলোক্য চক্রবর্তী নিজের আত্মজীবনীতে  কমিউনিস্টদের “ব্রিটিশ এজেন্ট” আর “বিশ্বাসঘাতক” বলে উল্লেখ করেছেন। এমনকি ভবিষ্যতে স্ট্যালিন পর্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলেন ভারতের কমিউনিস্টদের ব্রিটিশ

পদলেহনে ।

“When due to misguided political whims and lack of vision, almost all the leaders of Congress party have been decrying all the soldiers in Indian Army as mercenaries, it is heartening to know that Veer Savarkar is fearlessly exhorting the youths of India to enlist in armed forces. These enlisted youths themselves provide us with trained men and soldiers for our Indian National Army.”

নেতাজী সাভারকর সম্পর্কে বলেছিলেন যে যখন ভারতের অন্যান্য নেতারা দূরদর্শিতাহীনতার পরিচয় দিয়ে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে মানা করছিলেন, তখন বিচক্ষণ সাভারকর তরুণ প্রজন্মকে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে বলছিলেন। এই দেশভক্ত তরুণরা বৃটিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন বলেই আজ আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন সম্ভবপর হয়েছে।

মরাঠী ভাষায় রচিত “তেজস্বী তারে” গ্রন্থ পড়লে জানতে পারি  ২১শে জুন ১৯৪০ তিনি হিন্দু মহাসভার নেতা সাভারকরের সঙ্গে দেখা করেছিলেন এবং ফরওয়ার্ড ব্লক ও হিন্দু মহাসভার মধ্যে যৌথ কর্মসূচির চিন্তাভাবনা ভাবেন। সাভারকর তখন নেতাজীকে হলওয়েল স্মারক সরানোর মত তুচ্ছ আন্দোলন না করে বড় পরিকল্পনার পরামর্শ দেন এবং দেশের বাইরে যাত্রা করতে বলেন।

একই তথ্য তুলে ধরেন, রাসবিহারী বসুর ভাই বিজনবিহারী বসু। তাঁর মতে, সাভারকরের অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু। সাভারকর ১৯৩৭ সালে মুক্তি পাবার পর, তিনি সাভারকরের সঙ্গে একত্রে কাজ করার কথা লেখেন। সেই মত সাভারকর যখন ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০সাল পর্যন্ত হিন্দু মহাসভার নেতা ছিলেন, রাসবিহারী বসুও জাপানে হিন্দু মহাসভা স্থাপন করে তার সভাপতির পদ অলংকৃত করেছিলেন। ঐতিহাসিক গবেষকরা মনে করছেন,  যে সাভারকর‌ই নেতাজী ও রাসবিহারীর সংযোগমাধ্যম হয়ে ওঠেন। তারপর তো তৈরি হল ইতিহাস। নেতাজী জার্মানী ঘুরে জাপানে পৌঁছে রাসবিহারী বসুর কাছ থেকে আজাদ হিন্দ বাহিনীর রাশ নিয়ে নেন।

উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনীতে বেশি করে দেশহিতৈষী যুবকের সংযুক্তিকরণ। তারা কংগ্রেসের আইনঅমান্য বা ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যুবকদের জীবন নষ্ট করতে চান নি।এই বাহিনীই বাইরে গেলে আজাদ হিন্দ বাহিনীতে পরিণত হবে তার তারা আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিলেন।

রাস্তায় চেচানো বা এলোপাথারী আগুন দেওয়া যুবক নয়। সামরিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত যুবক চাই।

 এটাই ছিল,রাসবিহারী-সাভারকর-সুভাষ অক্ষের গোপন ইচ্ছা। বিশেষত, রাসবিহারী ও সাভারকর জীবনে কোনদিন কংগ্রেসের কোনও আন্দোলন এর সঙ্গে সহমত ছিলেন না। আর কংগ্রেসের আন্দোলন করে সাভারকর জেলে যান নি। জেলে গিয়েছিলেন, সশস্ত্র অভ্যুত্থান এর চেষ্টায় ধরা পড়ে। 

গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে যেকটি বিপ্লবী কার্যকলাপ হয়েছে, তার অনেকগুলির পেছনেই রয়েছে বীর বিনায়ক সাভারকরের সক্রিয় উৎসাহ। বাংলার বিপ্লবীরা যখন বোমা তৈরীর মালমশলা শেখার জন্য একজন প্রতিনিধিকে লন্ডনে পাঠায় — তখন সাভারকার তাকে সাহায্য করেছিলেন। মদনলাল ধিংড়া সাভারকারের হাতে গড়া ছেলে। আবার মহারাষ্ট্রের “অভিনব ভারত” দলের যুবকদের কাছেও তিনি গোপনে পাঠিয়েছিলেন কুড়িটি রিভলবার। এই জ্বলন্ত পুরুষ চেয়েছিলেন তখনকার রুশ বিপ্লবীদের মতন সারা ভারতে গুপ্ত সমিতি স্থাপন করে নিজেদের প্রস্তুত হয়ে নিতে হবে। তারপর এক সময় হবে অভ্যুত্থান। কিন্তু তার আগেই সাভারকার ধরা পড়ে গেলেন।

সাভারকার শুধু অস্ত্র সংগ্রহই করতেন না, রণকৌশলও তিনিই ঠিক করতেন।এ বিষয়ে তাঁর ছিল তীক্ষ্ণবুদ্ধি। এবং এই জন্যই সাভারকারের পক্ষে প্রয়োজন ছিল একটু আড়ালে থাকার। কিন্তু ভারতের কোনো একজন তরুণ বিপ্লবী নিজের ফাঁসির হুকুম শোনার পর একটু ক্ষোভের সঙ্গে বন্ধুদের কাছে বলেছিলেন, সাভারকার আমাদের মরণের দিকে ঠেলে দিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে আড়ালে লুকিয়ে থাকেন !

এই কথা ঘুরতে ঘুরতে একদিন সাভারকারের কানে গেল। তাঁর মতো তেজী পুরুষের পক্ষে একথা সহ্য করা সম্ভব নয়। হঠকারীর মতন তিনি তখুনি নিজের অজ্ঞাতবাস থেকে চলে এলেন লন্ডনে। আর প্রায় তার সঙ্গে সঙ্গেই ধরা পড়ে গেলেন ভিক্টরিয়া স্টেশনে।

সাভারকারের নাম ভারতে তখন দু’ দুটো কেস ঝুলছে। বিচারের জন্য তাঁকে নিয়ে আসতে হবে ভারতে। কঠোর পাহাড়ায় তাঁকে তোলা হলো মুরিয়া জাহাজে। সাভারকার সাংঘাতিক আসামী — রক্ষীরা এক মুহূর্তের জন্যও তাঁকে চোখের আড়াল করে না। এমনকি তাঁর বাথরুমের দরজার মাঝখানেও কাচ বসানো আছে। তিনি বাথরুমে গেলেও রক্ষীরা সেই কাঁচে চোখ লাগিয়ে নজর রাখে। কিন্তু এতো করেও তাঁকে আটকে রাখা গেল না। সাভারকার বাথরুমের দরজা বন্ধ করেই সেই কাছের ওপর তোয়ালে চাপা দিয়ে দিলেন। তারপর পোর্ট হোলের মধ্য দিয়ে লাফিয়ে পড়লেন সমুদ্রে।

জাহাজ তখন মার্সেই বন্দরের কাছে এসে ভিড়েছে। সাভারকার প্রাণপণে সাঁতরে তীরের দিকে যেতে লাগলেন —- ততক্ষনে রক্ষীরা টের পেয়ে গুলি চালাতে শুরু করেছে। তবু সাভারকার ঠিক পৌঁছে গেলেন।

আগে থেকেই খবর পাঠানো ছিল, সাভারকার এইখানে জাহাজ থেকে পালাবেন। বীরেন চট্টোপাধ্যায় এবং মাদাম কামা আগে থেকেই গাড়ী নিয়ে উপস্থিত থাকবেন সেখানে। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। আসবার পথে গাড়ী খারাপ হয়ে যাওয়ায় বীরেন চট্টোপাধ্যায় আর মাদাম কামা ঠিক সময়ে পৌঁছতে পারেননি। সাভারকার একজন ফরাসী পুলিশকে জড়িয়ে ধরে বললেন , আমায় থানায় নিয়ে চল। ফরাসী দেশের মাটিতে ইংরেজ আমায় গ্রেপ্তার করতে পারে না।

ফরাসী পুলিশ কিছুই বুঝতে পারলো না। সারা গা ভিজে, একজন বিদেশী মানুষ হাত-পা ছুঁড়ে বলছেন কি ? সাভারকার ফরাসী ভাষা ভালো জানতেন না। ততক্ষণে ইংরেজ রক্ষীরা এসে পৌঁছে গেছে। তারা ফরাসী পুলিশকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সাভারকারকে আবার জাহাজে তুললেন। আন্তর্জাতিক কানুন অনুসারে এই কাজটা বে-আইনি। আন্তর্জাতিক আদালতে এই নিয়ে মামলাও উঠেছিল। কিন্তু এশিয়ার কলোনির ব্যাপারে তখন ইংরেজ আর ফরাসী সরকারের খুব ভাব। একজন ভারতীয় বন্দিকে ইংরেজের হাতে তুলে দিতে ফরাসী সরকার আপত্তি করলেন না। সাভারকারকে এনে ভরা হলো ভারতের জেলে। নাসিক ষড়যন্ত্র মামলায় আলাদা ভাবে সাভারকারকে দু’বার যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হলো।

দন্ডাদেশ শুনে সাভারকার কারারক্ষীকে বললেন, আমার জীবন তো একটাই। দুবার যাবজ্জীবন দন্ড ভোগ করবো কি করে ?

কারারক্ষী বললো, তুমি এমন সাংঘাতিক অপরাধী যে শুধু এ জন্মে নয়, পরের জন্মেও তোমাকে জেলে পুরে রাখা হবে।

সাভারকার হাসতে হাসতে মন্তব্য করলেন, যাক , আমার জন্য তাহলে খ্রীস্টান ইংরেজদেরও পরজন্মে বিশ্বাস করতে হল।

বেঁচে থাকলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদ হয় পঁচিশ বছর। সেই হিসেবে করে সাভারকার পরমুহূর্তেই ব্যঙ্গের সুরে কারারক্ষীকে বললেন, তোমার কি ধারণা, পঞ্চাশ বছর পরেও ইংরেজ এদেশে টিকে থাকবে ? দেখা যাক !

সাভারকার জেলে গিয়েছিলেন ১৯১১ সালে। আমরা জানি, তারপর আর পঞ্চাশ বছর ইংরেজ এদেশে থাকতে পারেনি।

আন্দামান জেলে কি অসহ্য অত্যাচার ও নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে, তার বিবরণ আছে সাভারকারের আত্মজীবনীতে। তাঁর দাদা গণেশও তখন আন্দামানে। ওঁদের আর এক ভাইও কারারুদ্ধ।

আন্দামান জেলে অধিকাংশ ওয়ার্ডার এবং রক্ষীই ছিল উত্তর ভারতের অশিক্ষিত মুসলমান। এদের নৃশংস উৎপীড়নে অনেক রাজনৈতিক বন্দী আত্মহত্যা করেছে। অনেকে পাগল হয়ে গেছে। অনেকটা এদের জন্যই দুঃখের বিষয়, সাভারকারের মতন সংস্কারমুক্ত , তেজস্বী মানুষের মধ্যেও পরবর্তী জীবনে ধর্মীয় গোঁড়ামি এসে গিয়েছিল।

জেলখানায় বসে তিলক, শ্রীঅরবিন্দ, গান্ধীজী, নেহেরু , নেতাজী সুভাষচন্দ্র, সরোজিনী নাইডু প্রমুখ অনেকেই উৎকৃষ্ট সাহিত্য সৃষ্টি করে গেছেন। কিন্তু সাভারকার যদিও কবি ছিলেন, তবু তাঁকে এক টুকরো কাগজও দেওয়া হয়নি। তাতেও নিরস্ত হননি তিনি। তাঁর ছোট্ট কুঠুরির দেওয়ালেই তিনি কাঠকয়লা দিয়ে লিখতে শুরু করলেন একটি গাথা কাব্য। কারারক্ষীরা কিছুদিন অন্তর অন্তর ঘরে ঢুকে দেখতে পেলেই সেই লেখা মুছে দিয়ে যেত। তার আগেই সাভারকার সেই অংশটুকু মুখস্ত করে ফেলতেন। ঘরের দেওয়াল যেন তাঁর কাছে স্লেটের মতন। এইভাবেই তিনি সমাপ্ত করেছিলেন ‘কমলা’ মহাকাব্য — যা মারাঠী ভাষায় একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি।

১৮৫৭ সালে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত প্রয়াসে সিপাহী অভ্যুত্থানের যে সার্থক ইতিহাস সাভারকার লিখেছিলেন, তা বহুদিন ধরে ভারতীয় মুক্তিকামীদের প্রেরণা জুগিয়েছে। গদর পার্টির লালা হরদয়াল, ভগৎ সিং এবং নেতাজী সুভাষ সেই বইয়ের বিভিন্ন সংস্করণ বের করে প্রচারও করেছিলেন। 

ঋণস্বীকার :

১) আমাগো একখ্যান দ্যাশ আসিলো

২) আনন্দবাজার আর্কাইভস

৩) অগ্নিপুত্র — সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

৪) ফেসবুক