কেন বানান নয়, লেখা উচিৎ বাণান

আমি জন্মসূত্রে বাঙালী এবং পড়াশোনাও বাংলা মাধ্যমে। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র না হলেও বাংলা গ্রন্থচর্চা নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর নয়। তবু বাংলা “বাণান” লিখতে আমাকে অনেক বেশি হোঁচট খেতে হয় ইংরেজি লেখা অপেক্ষা। আংশিক কারণ হয়ত এটাই যে বাংলা ভাষার “বাণানের” কোন সমরূপতা নেই। এই বৈশিষ্ট্য সবভাষাতেই অল্পবিস্তর থাকে, কিন্তু বাংলায় তা বেশ প্রবল। মজার কথা এটাই যে এ সমস্যা আজকের নয়। এই সমস্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনিই আবেদন করেছিলেন ১৯৩০ এর দশকে তৎকালীন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের কাছে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ফলশ্রুতিতে এক কমিটিকে দায়িত্ব দেন। পরিশেষে সেই কমিটির সুপারিশে কলিকাতা বিস্ববিদ্যালয়ের বাংলা বাণানের নিয়ম প্রণীত হয়। এই নিয়ম প্রণীত হবার পর বহুদশক কেটে গেছে। যে সমস্যার সমাধান ছিল এই কমিটির সুপারিশের লক্ষ্য, কমিটি প্রণীত নিয়মের প্রণয়নে তা বেড়েছে বই কমে নি। তাই আজ হয়তো সময় এসেছে সেই সমস্যার প্রতি পুনর্দৃষ্টিপাত করার।

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ তাঁদের প্রণীত নিয়মাবলীতে রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের সম্মতি জুটিয়ে ফেলেন। বাংলার সাহিত্যাকাশের দুই দিকপাল, যাঁদের বলা হত বাংলা সাহিত্যাকাশের সূর্য-চন্দ্র, সম্মতি জানানোর ফলে তাঁদের নিয়মাবলীর বিরোধিতা করা সাধারণভাবে কোন ব্যক্তির পক্ষে হয়ে পড়ে অসম্ভব কঠিন। তৎকালীন বাংলার বৌদ্ধিক মণ্ডল ছিল এতটাই সমৃদ্ধ যে সেরকম অসাধারণ মানুষও হতেন দৃষ্টমান। এমনই একজন আচার্য্য দেবপ্রসাদ ঘোষ যিনি কখনও কোন পরীক্ষায় দ্বিতীয় হন নি। বরিশালের ব্রজমোহন স্কুল এবং ব্রজমোহন কলেজ থেকে অবিভক্ত বাংলায় এণ্ট্রান্সে এবং আই. এ. তে প্রথম। তারপর গণিত শাস্ত্রে সিটি কলেজ থেকে বি.এ., এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এ. তে প্রথম। পরে তিনি আইনেও প্রথম হন। তাঁর নখদর্পণে ছিল প্রায় এক ডজন ইউরোপীয় এবং ভারতীয় ভাষা। বিনয়ী এই মানুষটি রবীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠিতে লেখেন, “ইউরোপের ও ভারতবর্ষের কিছু কিছু ভাষা আমিও কথঞ্চিৎ জানি বলিয়া ছিটে-ফোঁটা পাণ্ডিত্যের অভিমান আমার নিজের মধ্যেও বিরাজ করিতেছে কিনা তাই।” এ কথা তাঁকেই সাজে।

সাধারণভাবে বঙ্গসমাজে প্রচলিত মত এই যে বাণান উচ্চারণের অনুগমন করবে। এই মতানুসারে অনেক তদ্ভব এবং দেশী-বিদেশী শব্দের বানান বিংশ শতাব্দীতে পরিবর্তিত হয়েছে এবং এখনও হয়ে চলেছে। এই মতের ভিত্তিতেই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপিত কমিটি মোটামুটি ভাবে বানান পরিমার্জনের প্রস্তাব করেছিলেন। দেবপ্রসাদবাবু ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন মতে বিশ্বাসী। তিনি এই ফনেটিক নির্ভর পদ্ধতিকে সাধুবাদ দেননি। তাঁর বক্তব্য ছিল উচ্চারণ যাই হোক, শব্দের বানান তাঁর ব্যুৎপত্তি অনুসারে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কেন? কারণ বহুবিধ।

প্রথমতঃ এবং প্রধানতঃ, লিপির সৃষ্টিই হয়েছে যাতে আমাদের পূর্বসূরিদের চিন্তাধারা উত্তরসূরিদের কাছে অনায়াসে পৌঁছে যায়। বানানের পরিবর্তনে এই গতি বহুলাংশেই বাধাপ্রাপ্ত হয়। বাংলা ভাষার উদ্ভব মাগধী প্রাকৃত থেকে এবং বাংলার বেশির ভাগ শব্দের বানান তৎসম থেকে আসে। তাতে চিন্তার পরম্পরা বজায় থাকে। উদাহরণস্বরূপ, নেওয়া যাক তদ্ভব “বানান” শব্দটাই। এর ব্যুৎপত্তি সংস্কৃত বর্ণন থেকে এবং আদতে একে লেখা হত বাণান হিসেবে। মূর্ধন্য ণ এর স্থানে দন্ত্য ন এলে বাঙালির কণ্ঠস্বরের সঙ্গে সামান্য সামঞ্জস্য হয় হয়ত, কিন্তু পূর্বসূরিদের চিন্তাস্রোত হতে আমাদের কিয়দংশে হলেও বিচ্ছিন্ন করে দন্ত্য ন এর বাধা। পূর্বসূরিদের চিন্তাস্রোতের সঙ্গে সংযুক্তিকে আমাদের সুপ্রাচীন সভ্যতায় ভীষণ গুরুত্ব দেওয়া হয়।

পাশ্চাত্যের অর্ধপক্ব বা অপক্ব আধুনিকতার তাড়ণায় আমরা পূর্বসূরিদের চিন্তাস্রোতকে উপেক্ষা করছি। কিন্তু পাশ্চাত্যও আজ অনুধাবণ করছে পূর্বসূরিদের ভাবনার গুরুত্বকে। যেমন খবরে প্রকাশ গ্রীসের মানুষ আবার তাঁদের নিজস্ব দেবতাদের উপাসনায় ফিরে আসছেন। খ্রীষ্টীয় মতবাদের চেয়ে নিজস্ব পূর্বসূরিদের চিন্তা তাঁদের বেশি আকর্ষণ করছে। তাঁদের এই প্রয়াস ভীষণ কঠিন কারণ ইউরোপের খ্রীষ্টীয় মতবাদের প্রচারের সময় ধ্বংস করা হয়েছে তাঁদের প্রাচীন পুস্তকাবলী এবং সংস্কৃতির ভাণ্ডারকে বহু শতাব্দী পূর্বেই। তাঁদের আপন সংস্কৃতিকে খুঁজে হবার করা খড়ের গাদায় ছুঁচ বার করার মতই, কিন্তু তাঁরা আপন হৃদয়ের প্রেরণায় সেই কঠিন কাজে ব্রতী। কি অদ্ভূত মানবতাবাদী সংকল্প!

আমাদের কাজ বহুলাংশে কম কঠিন। আমাদের দরকার কেবল আত্মবিশ্বাস আপন সভ্যতার গভীরত্ব সম্বন্ধে। উপরন্তু, উচ্চারণ পদ্ধতি স্থান ও কাল বিশেষে ভালোই বদলে যায়। পুরুলিয়ার কথ্য ভাষা আর চট্টগ্রামের কথ্য ভাষার মধ্যে সমতা অপেক্ষা বৈসাদৃশ্যই অধিক নজর কাড়ে। তাই যদি কথ্য ভাষার ভিত্তিতে লিখিত ভাষাকে গড়া হয়, তবে তা আমাদের চিন্তার ঐক্য বা ভাব বিনিময়ের সংযোগ ঘটাবে না, উপরন্তু বহুলভাবে আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলে আরও বেশি করে আবদ্ধ করবে। আর কেই বা না জানে যে চিন্তার ক্ষুদ্রতা করে মনুষ্যত্বের নাশ।

এইরকম ভাবে আমাদের একদিন ভেঙ্গে দিতে চেয়েছিন ইংরেজ সরকার। সময়টা ছিল ১৯০৪ খ্রীষ্টাব্দ। বঙ্গভঙ্গের ঘোষণার চার মাস পর, সরকার আনলেন এক শিক্ষানীতি তাতে বলা হল যে পাঠ্যপুস্তক এবার থেকে বিভিন্ন উপভাষায় লেখা হবে এবং অবিভক্ত বঙ্গে অন্ততঃ চারটি উপভাষাকে লেখার হরফে আনা হবে। বাংলার বিদ্বৎসমাজ এর প্রতিবাদে এগিয়ে এলেন। রবি ঠাকুর লিখলেন, “জনসাধারণের শিক্ষার উপসর্গ লইয়াই হউক বা য়ে উপলক্ষ্যেই হউক, দেশের উপভাষার অনৈক্যকে প্রণালীবদ্ধ উপায়ে ক্রমশ পাকা করিযা তুলিলে তাহাতে যে দেশের সাধারণ মঙ্গলের মূলে কুঠারাঘাত করা হয়, তাহা নিশ্চয়ই আমাদের পাশ্চাত্য কর্তৃপক্ষেরা, এমন-কি, তাঁহাদের বিশ্বস্ত বাঙালী সদস্য, আমাদের চেয়ে বরঞ্চ ভালোই বোঝেন।” (রবীন্দ্রজীবনী, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ ১৫১) তীব্র প্রতিবাদের মুখে পশ্চাদপসরণ করেছিল সেদিনের ইংরেজ সরকার।

ইংরেজ সরকার যে কাল স্থূলভাবে করতে চেয়েছিল আমাদের অন্তর্দৃষ্টির অভাবে আমরা সেই কাজই ধীরে ধীরে করে চলেছি। কথ্যভাষার আদলে লিখিত ভাষার রূপ দেওয়ার বিধি প্রায় সর্বজনসম্মত হয়ে যাওয়ায় বাংলা ভাষার রূপ ক্রমশঃ বিভিন্ন অঞ্চলে ভেঙ্গে যাচ্ছে। এর সুযোগ নিচ্ছে বিভিন্ন আগ্রাসী শক্তি। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান মুসলমান মৌলবাদ এটাই প্রমাণ করে বাঙালী জাতীয়তাবাদ সেদেশে ক্ষয়িষ্ণু শক্তি। বাংলাদেশে বাংলা ভাষার আরবীকরণ আজ এক বাস্তব। আর এর কারণ, আংশিকভাবে হলেও, আবার সেই কথ্য ভাষার প্রাধান্য। ভাষা, সংস্কৃতি, আর ধর্মমত কোনটাই কোনটার থেকে পৃথক নয়। তাই বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে কথ্যভাষার রূপ পরিবর্তন হয়ে যায়। লিখিত ভাষাকে কথ্য ভাষার দ্বারা পরিচালিত হতে দিলে খুব সহজেই জাতীয় সংস্কৃতি থেকে মানুষ পৃথক হয়ে পড়ে।

প্রয়োজন ফিরে দেখার এবং প্রয়োজনীয় সংশোধনের। বিশিষ্ট সাহিত্যিক কেতকী কুশারী ডাইসন তাই এই বইয়ের তাৎপর্য অনুধাবণ করে এর পুনঃপ্রকাশে অগ্রসর হয়েছেন। বইটির মুখবন্ধ তাঁরই লেখা। দেববাবুর ভাষা অতি সরস, যদিও যুক্তির হানি তাতে হয়নি এতটুকু। একটু তুলে ধরার প্রলোভন সামলানো কঠিন: হ্যাঁ, ‘বৌ’ ‘দৈ’ এই দুটি শব্দের বউ দই রূপও চলতি আছে বটে; কিন্তু আপনারা general agreement করে যে ফতোয়া দিতে যাচ্ছিলেন যে, অসংস্কৃত সব বাংলা শব্দেই ঐ-কার ঔ-কার বর্জ্জন করতে হবে, তার শ্রাদ্ধ কতদূর গড়ায় তা একবার ভেবে দেখেছেন? এই ফতোয়া মানতে গেলে যে, অতঃপর ফুলের উপর শুধু ‘মউমাছিরা’ গুঞ্জন করবে, কুকুরগুলোশুধু ‘ভউ ভউ’ করে ডাকবে, ছেলেরা শুধু ‘দউড়া দউড়ি’ করবে, আর রাস্তায় ‘চউমাথায়’ ‘হই হই রই রই’ শুনে পুলিশ ‘ফউজ’ তাড়া করে আসবে।

আমরা বাঙালীরা রবি ঠাকুরকে দেবতার আসনে বসিয়ে রাখি। দেববাবুর সঙ্গে তাঁর বিতর্কমূলক পত্রালাপে রবি ঠাকুরের মানবসত্তা প্রকট হয়েছে এবং তাতে গ্রন্থের উৎকর্ষ বেড়েছে বই কমেনি। রবি ঠাকুরের মানবসত্তার পরিচায়ক কিছু ভ্রান্তি উন্মোচিত হয়েছে। তাতে রবিবাবুর গৌরবের হয়নি একটুকু খাটো বরং দেববাবুর প্রতিভার দীপ্তি হয়েছে সম্যক্ ভাবেই উন্মোচিত। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণান কমিটিতে ঘণ্টা কয়েক কাটিয়েছিলেন দেববাবু আমন্ত্রণের বশে। সেখানে তাঁর যুক্তিতে ভাষাতত্ত্বে সুনীতি চট্টোপাধ্যায়, সংস্কৃতে ডাঃ শহীদুল্লা এবং ব্যাকরণে চলন্তিকার লেখক রাজশেখর বাবু প্রায়ই পরাস্ত।

বাংলার সাংস্কৃতিক নবজাগরণ ভাষাকে বাদ দিয়ে কখনই নয়। সংস্কৃতির মাধ্যম তো ভাষাই। তাই আজ প্রথম প্রয়োজন বাংলা ভাষার উৎকর্ষীকরণ। সেই লক্ষ্যে এই পুস্তকের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

বাঙ্গালা ভাষা ও বাণান, দেবপ্রসাদ ঘোষ, দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০০৫।