ঋণ পরিশোধ না করায় নিলামে উঠছে দিল্লির ঐতিহ্যবাহী বাংলা মাধ্যম স্কুল

0
558

বঙ্গদেশ ডেস্ক: এতদিন পর্যন্ত বাড়ি, গাড়ি, আসবাবপত্র তো বটেই এমন কি বিখ্যাত ব্যক্তিদের পোশাকও নিলাম হতে শোনা গিয়েছে। কিন্তু, এক আজব কাণ্ডের সাক্ষী দিল্লীবাসী। সেখানে নিলাম হতে চলেছে আস্ত একটি স্কুল। নিলামে ওঠা স্কুলটি দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কে অবস্থিত। আজ শুক্রবার সেখানে নিলাম হবে আস্ত একটি বাংলা মাধ্যমের সেকেন্ডারি স্কুল।

আজ থেকে প্রায় ৩৬ বছর আগে দুই একরের বেশি জমিতে গড়ে উঠেছিল “রাইসিনা বেঙ্গলি স্কুল(সেকেন্ডারি)।” এই স্কুল সমগ্র উত্তর ভারতের অন্যতম একটি বাংলা মাধ্যম স্কুল। ক্লাস ওয়ান থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত এখানে পড়ানো হয়। বর্তমানে সেই স্কুলের ৯০০ ছাত্র-ছাত্রীর ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বর্তমানে বিদ্যালয়ে পড়ুয়ার সংখ্যাটা ১৭০০। স্কুল বিক্রি হওয়ার খবর শুনে চরম দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন পড়ুয়া, অভিভাবক এবং স্কুলের শিক্ষক-অস্থায়ী কর্মীরা। রাইসিনা বেঙ্গলি স্কুলের একজন কর্মী চঞ্চল চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ২০০৫ সালে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে ২ কোটি টাকা ঋণ নেয় স্কুল কর্তৃপক্ষ। সুদে-আসলে যা বর্তমানে ৮ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এই বিপুল অঙ্কের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় ঋণ আদায়কারী ট্রাইবুনাল’ স্কুলসহ স্কুলের সম্পত্তি নিলামে তোলার নির্দেশ দিয়েছেন।

স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এই খবরে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন ওই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী নন্দিতা চক্রবর্তী। সে জানিয়েছে, একদম ছোটোবেলায় ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছি। আচমকা শুনছি স্কুল উঠে যাবে। ভাবতেই অবাক হচ্ছি। কেউ ঋণখেলাপি হলে, তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হোক। কিন্তু স্কুল বন্ধ হবে কেন? এখানে পড়ুয়াদের দোষ কোথায় ?

এই পরিস্থিতিতে, স্কুলটিকে বাঁচাত মরিয়া অভিভাবকরা‌ও। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে চিঠি লিখে এই স্কুলটি বাঁচানোর আর্জি জানিয়েছেন স্কুলের পড়ুয়াদের বাবা-মায়েরা। চিঠিতে লেখা হয়েছে, ঋণ পুনরুদ্ধার ট্রাইব্যুনালের নির্দেশ মোতাবেক আগামী ১৪ জানুয়ারি এই স্কুলটি নিলামে তোলা হবে। বিশ্বে কখনও কোনও স্কুল নিলামে ওঠেনি। দিল্লিতে এই ঘটনা ঘটলে তা দিল্লির জন্য অত্যন্ত লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে বলে চিঠিতে লিখেছেন অভিভাবকরা।

পড়ুয়াদের বাবা-মায়েরা অভিযোগ তুলেছেন, স্কুলের জমি বন্ধক রেখে এই সরকারি ব্যাঙ্ক থেকে দু’কোটি টাকা ঋণ নেয় ৯৫ শতাংশ সরকারি অনুদানে চলা রাইসিনা বাংলা স্কুলের পরিচালন সমিতি। ব্যাঙ্কের সঙ্গে স্কুলের এই চুক্তি নিয়েও কারচুপির অভিযোগ তুলেছেন তারা। চিঠিতে, এই ঋণ খেলাপি মুকুব করে, সম্পূর্ণরূপে দিল্লি সরকারের অধীনে এই স্কুলটিকে নেওয়ার আর্জি জানানো হয়েছে এই স্কুলের যে সকল সম্পত্তি নিলাম করা হবে, তার মধ্যে রয়েছে স্কুলের সিনিয়র সেকশন। এই সিনিয়র সেকশনে এই মুহূর্তে রয়েছে প্রায় ৯০০ ছাত্র।

ইবিডিপি-র সাধারণ সম্পাদক গৌতম সেন চৌধুরী জানিয়েছেন, স্কুলের কথা মাথায় রেখে দিল্লি সরকারের শিক্ষা দপ্তর, মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বারস্থ হয়েছেন তাঁরা। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, স্কুল নিলাম হলে মূল সমস্যায় পড়বে পড়ুয়াদের মতোই শিক্ষক- অশিক্ষক-কর্মচারীরাও। তাঈ নিলাম বন্ধ রেখে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত স্কুলটিকে বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে রাজধানী দিল্লির একাধিক সংগঠন। তবে এখনও কোনো পক্ষ থেকেই ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। যদিও অনেকের আশা, নিলামের ঠিক আগেই নয়াদিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করবেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। তাতেই থমকে যাবে নিলাম।

স্কুলের এই মামলা গড়িয়েছে হাইকোর্ট অবধি। আইনজীবী তনুদ্ভভ সিংদেব নিউজ এইট্টিন বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “সমগ্র বিষয়টির মধ্যে গভীর ষড়যন্ত্রের ইন্ধন রয়েছে। কারণ সরকারি জমি বন্ধক রেখে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ নিয়েছে স্কুল এবং বেআইনিভাবে এই ঋণ দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক। বর্তমানে দু’কোটি ঋণ সুদে-আসলে বেড়ে হয়েছে ৮ কোটি টাকা। নিলামে জমি-সহ স্কুলটির দাম ধার্য হয়েছে ৮১ কোটি টাকা। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে বিপুল অঙ্কের বাকি টাকা কারা হস্তগত করতে চলেছেন।

রাজধানী দিল্লির প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী স্কুলগুলির মধ্যে অন্যতম রাইসিনা বেঙ্গলি স্কুলের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯২৫ সালে। ব্রিটিশ জমানায় পথ চলা শুরু হয় এই স্কুলের। এই স্কুলের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দিল্লির বাঙালি সমাজের বহু খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বের নাম। প্রবাসী বাঙালিদের উপযুক্ত শিক্ষার জন্য তৈরি এই স্কুলের ট্রাস্টের সদস্য ছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধী, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আব্দুল কালাম, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ও মেঘনাদ সাহার মতো বিশিষ্টজনরা।

রাইসিনা স্কুল নিলামে ওঠার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লির বাঙালি সমাজের একটা বড় অংশ দায়ি করেছেন স্কুলের বর্তমান গভর্নিং কাউন্সিল সদস্যদের৷ তাদের বিরুদ্ধে তোলা হয়েছে দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগ। স্কুলের নিলামি রুখতে একটি চিঠি লেখা হয়েছে দিল্লির উপ মুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিসোদিয়ার কাছে৷ এবিষয়ে রাজধানী দিল্লির বেঙ্গল এসোসিয়েশনের সভাপতি তপন সেনগুপ্ত বলেছেন, আমরা যারা দিল্লির প্রবাসী বাঙালি, তাদের কাছে অত্যন্ত গর্বের প্রতিষ্ঠান রাইসিনা স্কুল। যেভাবেই হোক আগে স্কুলের নিলাম আটকাতেই হবে।

তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এই স্কুলের নিলাম আটকাতে সচেষ্ট বিজেপিও। দিল্লি প্রদেশ বিজেপির নেতা ও মুখপাত্র প্রবীণ শঙ্কর কাপুর দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে চিঠি লিখে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এই স্কুল রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করার আর্জি জানিয়েছেন । এই স্কুল যাতে কোনোরকমভাবে নিলামে না ওঠে তা নিশ্চিত করার জন্য চাঁদা তুলে তহবিল তৈরির চেষ্টা করছে রাইসিনা বেঙ্গলি স্কুল অ্যালুমনাই অ্যাসোসিয়েশন।