মহারাজা প্রতাপাদিত্যের সেনাপতি শঙ্কর চক্রবর্তীর শুরু করা দুর্গাপূজা আজও চলছে দক্ষিণেশ্বরে

Borobari Dakshineshwar
Borobari Dakshineshwar

যমুনা নদীর ঘাট, শীতের শেষবেলার এক ভোরে ঘাটের উপর দন্ডায়মান এক প্রৌঢ়া রাজরমণী, তাঁকে ঘিরে তাঁর পরিচারিকারা ও কিছু দেহরক্ষী। দিল্লির মসনদে আসীন বাদশাহ তাঁর ই সন্তান, তিনি মরিয়ম উজ জমানি, ইতিহাস তাঁকে চেনে যোধাবাঈ নামে। 

চারপাশে বহু মানুষ কিন্তু যোধার নজর নীচে, ঘাটে দাঁড়িয়ে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করছেন একজন প্রৌঢ় ব্রাহ্মণ। দীর্ঘ বলিষ্ঠদেহী ব্রাহ্মণের সমস্ত শরীরে যুদ্ধের দাগ, যেন এক চলন্ত যুদ্ধক্ষেত্র তিনি, কিন্তু তাঁর হাত শৃঙ্খলাবদ্ধ। 

যোধার কানে আসছে ব্রাহ্মণের গলা, মেঘমন্দ্র স্বরে পরিষ্কার সংস্কৃত উচ্চারণ যেন কানে আঘাত করছে, তাঁর মনে দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে ভগবতীর আরাধনা করার ইচ্ছা, কিন্তু মুসলিম বাদশাহর গৃহে তো তা সম্ভব নয়, যোধার যেন মনে হলো এই ব্রাহ্মণ ই পারেন তাঁর মনের ইচ্ছা পূরণ করতে। যোধা তাঁর প্রধান পরিচারিকা কে জিজ্ঞাসা করলেন, “এই হাতে শেকল বাঁধা ব্রাহ্মণ কে?” , উত্তর এলো, “মলিকা এ আজম, ইনি শঙ্কর চক্রবর্তী, বঙ্গালের রাজা প্রতাপ এর সেনাপতি”। 

মহাসেনাপতি সর্দার শঙ্করনাথ চক্রবর্তী(চট্টোপাধ্যায়), দক্ষিণ রাঢ়ীয় কুলীন কাশ্যপ গোত্রীয় ব্রাহ্মণ সন্তান, মহারাজা প্রতাপাদিত্য এর বাল্যবন্ধু, প্রধান সেনাপতি এবং অন্যতম উপদেষ্টা। শঙ্করের প্রবল বাহুবল ও প্রখর রাজনৈতিক দূরদর্শীতাই প্রতাপাদিত্যকে একের পর এক যুদ্ধে জয়ী করেছে, পশ্চিমে রাজমহল থেকে দক্ষিণে পুরী, সমগ্র বাঙ্গালা বিহার ও উড়িষ্যা একত্রে বৃহৎবঙ্গ জুড়ে রায়শ্রেষ্ঠ প্রতাপাদিত্যের যশোর সাম্রাজ্যের বিস্তার হয় এবং সমগ্র পূর্বভারতে হিন্দু সাম্রাজ্যের গৌরবের মঙ্গলময় শঙ্খধ্বনি বেজে ওঠে। বিহার জয়ের স্মারক হিসেবে সেনাপতি শঙ্কর চক্রবর্ত্তী মিথিলার দ্বারভাঙ্গা প্রদেশের হায়াঘাটে জগজ্জননী ভগবতী মন্দির স্থাপন করেন। মহারাজ প্রতাপাদিত্য পূণ্যক্ষেত্র কাশীধামে নির্মাণ করেন বিখ্যাত চৌষট্টি ঘাট ও চৌষট্টি যোগিনী মন্দির।

কিন্তু প্রদীপের তলাতেই থাকে অন্ধকার, বিশ্বাসঘাতকতা হলো মহারাজা প্রতাপাদিত্যের সাথে। ভবানন্দ, লক্ষ্মীকান্ত আর কচুরায়দের মিলিত বিশ্বাসঘাতকতা কাল হয়ে দাঁড়ালো। খাগরাঘাটের যুদ্ধে প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দিলেন প্রতাপাদিত্যের ছেলে উদয়াদিত্য এবং সেনাপতি তথা বাল্যবন্ধু সূর্যকান্ত গুহরায়। প্রিয় বন্ধুকে হারিয়েও লড়ে যেতে লাগলেন প্রতাপ ও শঙ্কর; কিন্তু শেষরক্ষা হলোনা। দুজনেই ধরা পড়লেন মোগলদের হাতে। বাঙ্গালাকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখা দুই মহাবীরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে লোহার খাঁচায় করে ঢাকা থেকে দিল্লি নিয়ে যাওয়া শুরু হলো। পথ মধ্যে বারাণসীতে প্রাণত্যাগ করলেন মহারাজা প্রতাপাদিত্য(সম্ভবত), দিল্লিতে একা বন্দী হলেন শঙ্কর। 

বন্দী অবস্থায় তাঁর পিতার উদ্দেশ্যে তর্পণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন শঙ্কর, শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় যমুনায় তাঁকে তর্পণ করতে দেখেন যোধা। যোধার মনে দীর্ঘ সময় ধরে মা ভগবতীর আরাধনার প্রবল ইচ্ছা ছিল, কিন্তু উপায় ছিলনা। মুসলিম বাদশাহর গৃহে মাতার আগমন অসম্ভব, একথা যোধা জানতেন। শাস্ত্রজ্ঞ শঙ্কর চক্রবর্তী কে দেখে যোধার মনে শ্রদ্ধা জাগে, বুঝতে পারেন মা জগৎজননীর পূজার জন্য ইনিই যোগ্যতম ব্যক্তিত্ব। 

বন্দী শঙ্কর চক্রবর্তীর সাথে দেখা করে তাঁকে মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করেন যোধা, সাথে মা দূর্গার পূজা করার কথাও জানান। মা দুর্গার আরাধনা করার অঙ্গীকার দিয়ে মুক্ত শঙ্কর ফিরে আসেন বাংলায়। খাগরাঘাটের যুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরে নিজ পরিবারকে বারাসাতের এক আত্মীয় গৃহে রেখে এসেছিলেন শঙ্কর, সেখানেই ফিরে গেলেন ছাড়া পেয়ে। বারাসাতে শিবের কোটায় শুরু হলো দুর্গাপূজা, শঙ্কর চক্রবর্তীর হাত ধরে। 

শঙ্কর চক্রবর্তীর উত্তরপুরুষ ছিলেন প্রাণবল্লভ বাচস্পতি মহাশয়। দক্ষিণেশ্বর ঘাটে তিনি ও তাঁর তিন ভাই প্রত্যহ স্নান করতে আসতেন,এঁদের দেখে দক্ষিণেশ্বর এর জমিদার তাঁদের সেখানে বসতি স্থাপন করে থাকার অনুরোধ করেন। কিন্তু প্রাণবল্লভ কোন দান গ্রহণ করলেন না, বরং জমিদারের কাছ থেকে স্বল্পমূল্যে জমি কিনে বসবাস শুরু করলেন। বাচস্পতি ছিলেন শাস্ত্রজ্ঞ মহাপণ্ডিত, তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনিই ছিলেন বড়, সেখান থেকে বড়বাড়ির দুর্গাপূজা নামকরণ। এই বংশের বর্তমান প্রজন্ম আজও প্রায় ৪০০ বছর ধরে মা দুর্গার আরাধনা করছেন। ইতিহাসকে বুকে আগলে রেখে আজও প্রতি শরতে হয় দেবী আরাধনা। আড়ম্বর কোন দিনই ছিল না বরং আন্তরিকতা ছিল। যা আজও রয়ে গেছে। প্রতিবছর নবমীতে দক্ষিণেশ্বর থেকে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব আসতেন এই বাড়ীতে পুজো আরাধনা দেখতে। নবমীতে এইখানেই খেতেন ভোগ প্রসাদ এমনই কাহিনী প্রচলিত রয়েছে এই পরিবারে।

পুজো শুরু হয় মহলায়ার দিন থেকে, তারপর দশমীতে মা দুর্গাকে নৌকা করে গঙ্গার মাঝখানে নিয়ে গিয়ে বিসর্জন দেওয়া হয়, এবং পরের দিন সেই কাঠামো আবার নিয়ে আসা হয়,সেই কাঠামোতে পরের বছর প্রতিমা তৈরি হয়। একই কাঠামোতে দুর্গা প্রতিমা তৈরি হয়ে আসছে বছরের পর বছর ধরে। পুজোর যাবতীয় নিয়ম তুলে রাখা আছে পণ্ডিত রত্ন মেলবলী নামের একটি পুস্তকে। আজও কোনও সমস্যায় সেই বইকেই খুলে দেখে চট্টোপাধ্যায় পরিবার। 

মহাসেনাপতি শঙ্করনাথ চক্রবর্তীর শুরু করা এই দুর্গাপূজা আজও চলছে রমরমিয়ে তাঁর বর্তমান বংশধরদের হাত ধরে।