নামে কিছু আসে যায়

ইংরেজী কবি ও নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপীয়রের “রোমিও এন্ড জুলিয়েট” নাটকের একটি বিখ্যাত সংলাপ – ‘হোয়াটস ইন আ নেম’ অর্থাৎ নামে কিবা আসে যায়? কিন্তু সত্যিই কি নামে কিছুই এসে যায় না? তাহলে শিশু জন্মের ছ’দিনের মাথায় তিথি নক্ষত্র মিলিয়ে, পূর্বপুরুষ, গৃহদেবতা, বংশগত পরম্পরা ইত্যাদি বিবেচনা করে তার নামকরণ করা হয় কেন? কিছু যায় আসে বলেই না করা হয়! ঢাকা শহরে এক সময় চিত্তরঞ্জন এভিনিউ, সুভাষ বোস এভিনিউ ছিল। চিত্তরঞ্জন এভিনিউয়ের বর্তমান নাম নাজিমুদ্দিন রোড। সুভাষ বোস এভিনিউয়ের বর্তমান নাম খালিদ বিন ওয়ালিদ এভিনিউ। অতএব নাম পরিবর্তন করে কিছু যায় আসে বলেই না বাংলাদেশ সরকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে বাঙ্গালী নামগুলি সযত্নে ছেঁটে ফেলেছে।

নামকরণ নিয়ে এই মাথাব্যথার মূল কারণ হল, কলকাতা শহরে সাম্প্রতিক এক বিতর্ক। কলকাতার  নামের উৎস নিয়ে মাঝে মাঝেই পণ্ডিতজনের তর্ক বিতর্কের মাঝে মহানগরের প্রাণকেন্দ্র এসপ্ল্যানেডের নাম পরিবর্তন করে পূর্বনাম ধর্মতলা ফিরিয়ের আনার এক প্রস্তাব ও প্রয়াস নিয়ে রাজধানী বেশ সরগরম।

সাধারণত কোনো ব্যক্তির বা অঞ্চলের নাম শুনলে সেই ব্যক্তি বা অঞ্চলের সম্পর্কে একটা আভাস পাওয়া যায়। দক্ষিণ ভারতে তো এখনো নামের সঙ্গে সেই ব্যক্তির পিতৃপুরুষ এমন কি গ্রামের নামও জুড়ে থাকে। ব্যক্তির নামের সঙ্গে যেমন বংশ পরিচয় লুকিয়ে থাকে, তেমন কোনো নগরের নামের মধ্য দিয়েও  প্রাচীন পরম্পরা, তার ইতিহাস অনুসন্ধান করা যায়। একটি শহরের বা অঞ্চলের নাম পরিবর্তন করে দিলেই সেই অঞ্চলের ইতিহাস, পরম্পরা সব কিছুই কালের গতিতে মুছে যায়। ইসলামি শাসনকালে এইভাবে দেশের নাম ধাম এমন কি প্রাচীন স্থাপত্য সবকিছুই কৌশল করে মুছে ফেলা হয়েছিল। যেখানে যেখানে ইসলামী আগ্রাসন বেশী হয়েছে, সেখানে সেখানে প্রাচীন স্থাপত্য সবকিছুই দখল হয়ে গেছে, এমন কি প্রাসাদ্গুলোও।

অষ্টাদশ শতকের নবজাগরণের সময়কালে জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্য-সংস্কৃতির নব জোয়ারে ঐপনিবেশিক ভাবনাকে বিসর্জন দিয়ে নতুন ভারত উঠে এসেছিল। রামমোহন রায় থেকে বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ হয়ে শ্যামাপ্রসাদ, এই সুদীর্ঘ যাত্রায় ভারতবাসীকে জাতীয়তার ভাবনায় উদ্দীপিত করতে পেরেছিলেন এঁরা সবাই।

এরই ফলশ্রুতি ‘ফিরে চল মাটির টানে’। ইসলামি ও উপনিবেশিক শাসনের আবর্জনাকে দূরে সরিয়ে ভারতের মানুষ আবার তাঁর পূর্বজদের স্মরণ করতে চায়। ১৯৯৫ সালে মহারাষ্ট্রে শিবসেনা ক্ষমতায় আসার পর ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া বোম্বাই বা বোম্বে শহরের নাম পরিবর্তন করে পূর্বেকার স্থানীয় মুম্বাবতী দেবীর নামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মুম্বাই করার প্রস্তাব দেয়। বড় সহজ ছিল না সেই কাজ! কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে শিবসেনা আঞ্চলিকতা ও জাতিগত প্রেমকে এমন জায়গায় পৌঁছে দিতে পেরেছে যে সাধারণ মানুষের অকুণ্ঠ আশীর্বাদ তাদের সেই কাজ কে সমর্থন জুগিয়েছে।

১৯৯৬ সালে দেশের আরো একটি বড় শহরের নাম থেকেও ব্রিটিশ উপনিবেশকতার চিহ্ন মুছে ফেলা হল। তা হোল মাদ্রাজ। সপ্তদশ শতকে দার্মলা চেন্নাপ্পার কাছ থেকে মাছ ধরার গ্রাম মাদ্রাজপত্তনম ক্রয় করে ব্রিটিশ গ্যারিসন মাদ্রাজ শহর ও বন্দর স্থাপন করেন। এই গ্রামের পাশের গ্রামের নাম ছিল চেন্নাপত্তনম। ব্রিটিশরা পরবর্তীকালে দুটি গ্রামকে একত্রিত করে শহরের নাম দেয় মাদ্রাজ। কিন্তু স্থানীয় মানুষেরা চেন্নাপত্তনামকে ভুলে যায় নি। বরং তারা স্থানীয়ভাবে এলাকাকে চেন্নাপত্তনম নামেই ডাকত। দক্ষিণ ভারতে ক্রমান্বয়ে শাসন করেছে পল্লব, চোল, পাণ্ড্য, বিজয়নগরের পরাক্রমশালী শাসকেরা। তীব্র স্বাজাত্যবোধ সম্পন্ন তামিলরা মনে করেছিলেন যে পর্তুগীজ শব্দ (মাদ্র ডি সইস নামে এক পর্তুগীজ কর্মচারী) থেকেই মাদ্রাজ। অতএব মাদ্রাজকে পরিবর্তন করে শহরের নাম হোক চেন্নাই। চেন্নাই নামের সঙ্গে জুড়ে আছে বিজয়নগরের রাজা চেন্নাপ্পা নায়কুডুর নাম। ষষ্টদশ শতকে নির্মিত মন্দির চেন্নাকেসাভ পেরুমল নামটিও উল্লেখ্য।

ঔপনিবেশিক উচ্চারণ পরিত্যাগ করে ব্যাঙ্গালোর হয়েছে বেঙ্গালুরু। ক্যালকাটা হয়েছে কলকাতা। পুনা হয়েছে পুণে। অতি সম্প্রতি উত্তর ভারতে এলাহাবাদের নাম পরিবর্তন করে গঙ্গা যমুনা সরস্বতীর মিলনকেন্দ্র প্রয়াগের নাম নিয়ে সম্পূর্ণ জেলার নাম হয় প্রয়াগরাজ। পরিবর্তনের এই তালিকায় হয়তো আরো অনেক নাম রয়েছে। নামকরণের সঙ্গে যদি জাতীয় অস্মিতা জড়িয়ে থাকে, তাহলে বহিরাগত মুর্শিদ কুলি খাঁর নামে মুর্শিদাবাদের নাম পরিবর্তন করে বাঙালিয়ানার প্রবর্তক ষষ্ঠ শতকের মহারাজা শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণের নাম রাখা হোক।

পশ্চিমবঙ্গে চৌত্রিশ বছরের বাম শাসনের কুপ্রভাব এখনো অস্তমিত হয়নি। মহানগরের প্রাণকেন্দ্র ‘এসপ্ল্যানেড’-এর নাম পরিবর্তনে সাধারণ মানুষের আকুণ্ঠ সমর্থন থাকলেও বাম বুদ্ধিজীবিদের পথে নামা সময়ের অপেক্ষা মাত্র। বাম শাসনকালে ধর্মতলা স্ট্রীটের নাম পরিবর্তন করে ‘লেলিন সরণী’ রাখা হয়। ভারতবর্ষের ধর্ম, সংস্কৃতি, কৃষ্টির সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কবিহীন বিদেশী এই মানুষটির নামে মহানগরের প্রাণকেন্দ্রে একটি মর্মর মূর্তিও স্থাপিত হয়। ধর্মহীন বাম বুদ্ধিজীবীরা যে ‘ধর্মতলা’ নামটি পছন্দ করবেন না এতে আর আশ্চর্য কী!

পলাশীর যুদ্ধের পর ব্রিটিশদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের কাজ শুরু হয়। ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় উইলিয়ামের নাম অনুসারে এই দুর্গের এই নামকরণ হয়। ময়দানের উন্মুক্ত অঞ্চলকে বেষ্টন করে জঙ্গলে ঘেরা প্রাচীন এই স্থানকে ব্রিটিশ রাজপুরুষেরা নিজেদের সুবিধেমতো একটি শহরে রূপান্তরিত করে বিভিন্ন সড়ক এবং অঞ্চলের নামের পরিবর্তন ঘটায়। এত কিছুর পরেও কালিক্ষেত্র কলকাতা চতুর্পাশে রয়ে থাকা ধর্মীয় অঞ্চলগুলি নাম পরিবর্তন করে দিলেও লোকমুখ থেকে তা বিরত করা যায়নি। কালিঘাট, ঠনঠনে, ফিরিঙ্গি কালি  তারই এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ।  ‘ধর্মতলা’ও তেমনি  অতীতে লোকায়ত ধর্মঠাকুরের থানের নামের স্বাক্ষর বহন করে চলেছে আজও। সাত’শো দু’বছর পর ত্রিবেণীর কুম্ভমেলাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার গৌরব যদি বাঙ্গালী অর্জন করতে পারে তবে এটিই বা নয় কেন?

যে যুক্তিতে নগরের নাম পরিবর্তন করে চেন্নাই, মুম্বই হয়েছে, সেই একই যুক্তি খাটে ধর্মতলার ক্ষেত্রেও। ব্রিটিশ রাজপুরুষদের প্রমোদ ক্ষেত্র এসপ্ল্যানেডের এখন আর কোনো সারবত্তা নেই। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পর উপনিবেশিক চিন্তাকে বিসর্জন দিয়ে দেশের জাতীয়তাবাদী চিন্তাকে জাগ্রত করতে নাম পরিবর্তন একটি জরুরি প্রয়াস। কিছুদিন আগে শিয়ালদহ স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে শ্যামাপ্রসাদের নামে করার একটি উদ্যোগ চোখে পড়েছিল। শহরের এক শ্রেণীর মানুষ সুভাষচন্দ্র বসুর একশো পঁচিশতম বর্ষে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের নাম পরিবর্তন করে দেশনায়ক সুভাষের করার দাবি করেছিলেন। সেই সময় দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সুভাষচন্দ্র বসুর পঁচাত্তরটি ছবির একটি প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেছিলেন। সেগুলি ভিক্টোরিয়ার প্রদর্শন শালাতেই স্থান পেয়েছে।

এসপ্ল্যানেড থেকে ধর্মতলার সাথে সাথে, ফোর্ট উইলিয়ামের নাম পরিবর্তন করে শ্রী অরবিন্দের নামে করার দাবি ধ্বনিত হোক দেশজুড়ে। বিপ্লবের পীঠস্থান কলকাতার মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য এই উদ্যোগ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এসপ্ল্যানেডের নাম পরিবর্তনের দাবির মত ফোর্ট উইলিয়ামের নাম পরিবর্তনের দাবিও অচিরেই মূলধারার আলোচনায় উঠে আসবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।