বাকশক্তি হারিয়েও ক্লান্ত হননি কান্তকবি

    Rajanikanta Sen
    Rajanikanta Sen

    ১৯৬৬ সালে তৈরি হয়েছিল ‘সুভাষচন্দ্র’ নামে একটি বাংলা চলচ্চিত্র। পীযূষ বসুর নির্দেশনায় এই ছবিতে রজনীকান্ত সেনের লেখা ও সুরে গান গেয়েছিলেন শিল্পী মান্না দে। গানটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। দেশপ্রেমী সুভাষ আর গাওয়া হচ্ছে দেশপ্রেমিক এক সঙ্গীত সাধকের গান। গানটি শুনলে কোথাও মনে হবে প্রকৃতি প্রেম, দেশপ্রেম এবং ঈশ্বর প্রেমের অনুভূতি বোধহয় এক এবং অভিন্ন –

    “তব চরণ নিম্নে উৎসবময়ী
    শ্যামধরনী সরসা,
    ঊর্ধ্বে চাহো অগণিত মনি
    রজ্ঞিত নভঃ নীলাঞ্চলা,
    সৌম্য মধুর দিব্যাঙ্গনা
    শান্ত-কুশল-দরশা,
    শ্যামধরনী সরসা।।

    দূরে হের চন্দ্রকিরণ
    উদ্ভাসিত গঙ্গা,
    নৃত্য পুলক গীতি মুখর
    কলুষ হরতরঙ্গা,
    ধায় মত্ত হরষে
    সাগর পদ পরশে,
    কূলে কূলে করি পরিবেশন
    মঙ্গলময় বরষা,
    শ্যামধরনী সরসা।।

    ফিরে দিশি দিশি মলয় মন্দ
    কুসুম গন্ধ বহিয়া,
    আর্য গরিমা কীর্তি কাহিনী
    মুগ্ধ জগতে কহিয়া,
    হাসিছে দিগবালিকা
    কন্ঠে বিজয় মালিকা,
    নব জীবন পুষ্পবৃষ্টি
    করিছে পুণ্য হরষা,
    শ্যামধরনী সরসা।

    ওই হের স্নিগ্ধ সবিতা
    উদিছে পূর্ব গগনে,
    কান্তোজ্জ্বল কিরণ বিতরি
    ডাকিছে সুপ্তি মগনে,
    নিদ্রালস নয়নে এখনো
    রবে কি শয়নে?
    জাগাও বিশ্ব পুলক পরশে
    বক্ষে তরুন ভরসা,
    শ্যামধরনী সরসা।।”

    বাংলার নবজাগরণ যখন সংগঠিত হল, তখন যেন চাঁদের হাট। কত যে বাঙালি মনীষা তাতে আলো দিলেন, তাদের সকলের খোঁজ কি আমরা রেখেছি! সে যে চন্দ্রালোকিত রজনী, আকাশে শতচাঁদ আলো হয়ে ফুটেছে, তারই উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব রজনীকান্ত। তিনি কান্তকবি, তিনি সঙ্গীতকবি, গীতিকার, সুরকার, গায়ক রজনীকান্ত সেন। ২৬শে জুলাই তাঁর জন্মদিন, ১৮৬৫ সালে বর্তমান বাংলাদেশের বেলকুচির ভাঙাবাড়ি গ্রামে তাঁর জন্ম। রবীন্দ্রসঙ্গীত, দ্বিজেন্দ্রগীতি, নজরুলগীতি, অতুলপ্রসাদের গানের পাশাপাশি রজনীকান্ত সেনের গানের ঘরানা বাংলার সঙ্গীতপিপাসু মানুষকে আজও জারিত করে রয়েছে।

    যদি জানতে চাই আমার কাছে ‘তিনি’ কী পেলেন! সেই মস্তবড় সত্তা, সেই অমিত-বিরাট, যিনি এই অকৃতী-অধমকে সকল কিছুই দিয়েছেন, অযোগ্য বিবেচনা করে সামান্যতম কিছু কেড়েও নেন নি, তিনি কে! তাঁর আশীর্বাদীফুল মাথায় ঠেকাই নি আমি কোনোদিন; হয়তো আশীষ-কুসুম পায়েই দলে চলে গেছি, ফিরেও তাকাই নি, তবুও তো তার দয়া পেয়েছি অনুক্ষণ, প্রতিদানে তাঁকে কিছুই দিই নি! তিনি আমাকে বাঁধনে এঁটে রাখতে চেয়েছেন, আর এই ‘ক্ষুদ্র আমি’ শতবার সেই বাঁধন কেটে চলে গেছি। অতএব, আমায় ছেড়ে গেছেন বিবেচনা করে, যখন পিছনে তাকালাম, বুঝলাম এক পা-ও তিনি যান নি। আমারই জন্যে রয়েছেন। এই অহেতুকী দয়ার কথা লিখেছেন রজনীকান্ত সেন –

    “আমি অকৃতী অধম
    ব’লেও তো কিছু
    কম করে মোরে দাওনি
    যা দিয়েছ তারি
    অযোগ্য ভাবিয়া
    কেড়েও তা কিছু নাওনি।

    তব আশীষ কুসুম ধরি নাই শিরে
    পায়ে দলে গেছি চাহি নাই ফিরে
    তবু দয়া করে কেবলি দিয়েছ
    প্রতিদান কিছু চাওনি।

    আমি ছুটিয়া বেড়াই
    জানিনা কি আশে
    সুধা পান করে মরি গো তিয়াসে
    তবু যাহা চাই সকলি দিয়েছ
    তুমিও তো কিছুই পাওনি।

    আমায় রাখিতে চাহ গো বাঁধনে আঁটিয়া
    শতবার যায় বাঁধন কাটিয়া
    ভাবি ছেড়ে গেছ ফিরে চেয়ে দেখি
    এক পা-ও ছেড়ে যাওনি।”

    ঈশ্বর আরাধনার মধ্যেই তিনি স্বদেশ প্রেমকে যেন গেঁথে দিলেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে কালী সঙ্গীত রচনায় হাত দিয়েছিলেন। আর কখন যেন ব্রহ্মময়ী মা দেশমাতৃকা হয়ে উঠলেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় অনুপম গভীরতায়, অতল আবেগে লিখে ফেললেন দেশপ্রিয় গান, “মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই।” এ এক আত্মনির্ভরতার গান, দেশীয় পণ্যকে গ্রহণ করার দীক্ষা-সঙ্গীত। তাঁর গীতি সংকলনগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘বাণী’ ‘কল্যাণী’, ‘অভয়া’ প্রভৃতি, এগুলি তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছিল (১৯১০ সালের ১৩ ই সেপ্টেম্বরের পূর্বে)।

    “তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে, মলিন মর্ম মুছায়ে;
    তব পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক, মোর মোহ কালিমা ঘুচায়ে৷”

    এই বিখ্যাত গানের মধ্যে তিনি পুরোপুরি আত্মনিবেদনের কথা বলেছেন। ত্রিস্তরীয় গান রচনার মধ্যে দেশাত্মবোধ, ঈশ্বর আরাধনার গান ছাড়াও নীতিবোধ ও হাসির গান রচনাও ছিল।

    “শৈশবে সদুপদেশ যাহার না রোচে,
    জীবনে তাহার কভু মূর্খতা না ঘোচে।
    চৈত্রমাসে চাষ দিয়া না বোনে বৈশাখে,
    কবে সেই হৈমন্তিক ধান্য পেয়ে থাকে?”

    এই গানটির মধ্যে তাঁর কৃষিভাবনার প্রকাশ দেখি, আউশধানের বীজ ফেলার কথা। তারই সঙ্গে জীবনচর্যার প্রয়োজনীয় নির্দেশ মেনে চলার সারকথা। সমকালীন শিক্ষা ব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্যতার কথা খুঁজে পাই তাঁর গানে। জ্ঞান-আহরণ ও গবেষণা মানে যে কেবল ‘ডেটা কালেকশন’ নয়, তা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এই গানে –

    “রাজা অশোকের কটা ছিল হাতি,
    টোডরমল্লের কটা ছিল নাতি,
    কালাপাহাড়ের কটা ছিল ছাতি,
    এসব করিয়া বাহির, বড় বিদ্যে করেছি জাহির।
    আকবর শাহ কাছা দিত কিনা,
    নূরজাহানের কটা ছিল বীণা,
    মন্থরা ছিলেন ক্ষীণা কিম্বা পীনা,
    এসব করিয়া বাহির, বড় বিদ্যে করেছি জাহির।”

    কান্তকবি রজনীকান্ত সেনের কাছ থেকে আমরা শিখেছি সক্ষমতা কাকে বলে। শ্বাসনালীর ক্যান্সার; ফলে তার অবশ্যম্ভাবী অস্ত্রোপচারের ফলে বাকশক্তি হারিয়েও তিনি সৃজনশীল ছিলেন সমান দক্ষতায়। এমনকি হাসপাতালে বসেই লিখেছেন গান ও গদ্য। এমন একজন প্রেরণাদানকারী ব্যক্তিত্ব রজনীকান্ত। আজও তাঁর গানের কথায় ও সুরে আমরা মোহিত হই। ঈশ্বর আরাধনায় জেগে উঠি, স্বদেশপ্রেমে জারিত হই। রজনীগন্ধার সুবাসের মতো আমরা রজনীকান্ত সেনকে মনে রাখবো যদি না রজনীকে নিকষ কালো করে ফেলি।