ভারতের চীন-নীতি: ‘এক-চীন’ না ‘দুই-চীন’?

0
1072

সুজিৎ রায়

ভারতের পূর্ব লাদাকে গালওয়ান উপত্যকায় রক্তাক্ত সীমান্ত সংঘর্ষের পরেও চীন কিন্তু তার আগের জায়গায় পুরোপুরি ফিরে যায়নি। সীমান্তে এখনো উত্তেজনা আছে। এমনকি প্যাংগং লেকেও প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার সাপেক্ষে চীন পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়নি। শুধু তাই নয়, সীমান্তে সেনা-সমাবেশ চীন বাড়িয়েই চলেছে। এই সবের প্রেক্ষিতেই আমরা ভারতের চীনা নীতি নিয়ে আলোচনা করব।

চীন – মূলভূখণ্ড ও তাইওয়ান দ্বীপখন্ড

অদ্ভুত ভাবে এখানে একটি প্রধান প্রসঙ্গ উঠে আসে। চীন বলতে কি বোঝায় একটি দেশ ও রাষ্ট্র, না দুটি দেশ ও রাষ্ট্র? সংক্ষেপে যদি এই ইতিহাস দেখি, তা এরকম। সান ইয়েৎসানের নেতৃত্বে কুয়োমিংটান (কেএমটি- চাইনিজ ন্যাশনালিস্ট পার্টি) ১৯১২ সালে কিয়াং রাজবংশকে উৎখাত করে প্রতিষ্ঠিত করে রিপাবলিক অব চায়না (আরওসি)। পরে কুয়োমিংটানের নেতৃত্বে আসেন চিয়াং কাইশেক, যিনি চীনরাষ্ট্রকে মোটামুটি ভাবে গণতান্ত্রিক পথে পরিচালনা করার চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু, ইতিমধ্যে চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জাতীয়তাবাদী কুয়োমিংটান পার্টির রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা নিয়ে সংঘাত শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চিয়াং কাইশেকের নেতৃত্বেই চীন জাপানি আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করে। ১৯৪৫ অক্টোবরে জাপান সরকার আত্মসমর্পণ করার পরে তাইওয়ান দ্বীপ, যা আগে ‘ফরমোশা’ নামে পরিচিত ছিল, তা আবার চীনের শাসনাধীনে ফিরে আসে।

কিন্তু, তারপরই আবার শুরু হয় চীনা গৃহযুদ্ধ- চাইনিজ সিভিল ওয়ার এবং মাও জেদং-এর নেতৃত্বে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৪৯ সালের মধ্যেই চীনা মূলভূখণ্ড দখল করতে সমর্থ হয় এবং পিপলস রিপাবলিক অফ চাইনা (পিআরসি) প্রতিষ্ঠা করে। চিয়াং কাইশেকের কুয়োমিংটান সরকার তাইওয়ান দ্বীপে সরে যেতে বাধ্য হয়। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এই তাইওয়ান সরকারই রাষ্ট্রসংঘে সমস্ত চীন দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিল, যা পরে মূলভূখণ্ডের চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সরকারের পক্ষে চলে যায়। ১৯৪৯ সাল থেকেই চীন দেশ ও রাষ্ট্রের প্রকৃত সরকার কোনটি, তা নিয়ে দুই সরকারের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে।

ভারতের প্রতিক্রিয়া

ভারত সরকার ১৯৫০ সালেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির শাসনাধীন পিআরসিকে স্বীকৃতি দেয় এবং ‘এক-চীন’ নীতি মেনে তাইওয়ান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। পরে ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রসংঘে পিআরসির দাবীকে সমর্থন করে। অনেক পরে অবশ্য ১৯৯৫ সালে সরাসরি না হলেও তাইওয়ান সরকারের সঙ্গে ভারত সরকার সম্পর্ক স্থাপন করে এবং দুই দেশেই কূটনৈতিক সম্পর্ক ছাড়াই দূতাবাসের মতো সেন্টার তৈরি হয়।

এখন প্রশ্ন হলো: ভারতের এই ‘এক-চীন’ নীতি অনুসরণ করে চলা কূটনৈতিক তথা কৌশলগতভাবে কতোটা উপযুক্ত, বিশেষ করে চীন যেখানে প্রথম থেকেই ভারতের জমি দখল করার নীতি- ‘সালামি স্লাইসিং পলিসি’ নিয়ে চলেছে? আকসাই চীন থেকে শুরু করে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা- এলএসি জুড়ে চীনের আগ্রাসন তথা গিলগিট-বালটিস্থান ও পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে চীনা-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর- সিপেকের কার্যক্রম সরাসরি ভারতের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করছে। কাশ্মীর সংক্রান্ত সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলের ক্ষেত্রে একবছর আগেও চীন যেমন প্রতিবাদ করেছে, এখনও একবছর পরেও সেই ধারা অব্যাহত রেখেছে। ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো চীনের যেন এক কৌশলগত পলিসি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে ভারতেরও এক-চীন নীতি পর্যালোচনা করার সময় এসেছে।

ভারত ও ‘দুই-চীন’

চীনের ব্যাপারে সেই ১৯৫০ সাল থেকেই ভারত যেন এক দ্বিধাগ্রস্ত মানসিকতা নিয়ে চলছে। নেহরু সরকারের অবিমিশ্রকারী নীতির লিগাসী থেকে বেরিয়ে আসার সময় হয়েছে। পিআরসি চীন যখন তিব্বত দখল করে নিল, ভারত সরকার তখন তা মেনে নিয়েছিল। আবার, আকসাই চীন যখন চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি- পিএলএ দখল করে নিল, তখনও ভারত সরকার তার অধিকার ছেড়ে দিল। একদিকে সয়ে যাওয়ার মানসিকতা ও অন্যদিকে কৌশলী না-হওয়ার পরিণতি হল ১৯৬২ সালে কমিউনিস্ট চীনের হাতে অসহায় আত্মসমর্পণ।

একটা কথা মনে রাখা দরকার, আশির দশক পর্যন্ত অর্থনৈতিক ভাবে ভারত ও চীনের মধ্যে প্রায় কোনোই পার্থক্য ছিল না। আসলে যা পার্থক্য ছিল, তা হলো মানসিকতা ও নেতৃত্বের দূরদর্শিতার অভাব। ‘সফট নেশনের’ তকমা পড়ে যাওয়া ভারতের মেটামরফসিস বা সার্বিক রূপান্তর আজকে এক আবশ্যিকতা। প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে?

ভারত ও বহুমেরু বিশ্ব

১৯৬২ সালে চীনের ভারত আক্রমণের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের পক্ষে পদক্ষেপ নিয়েছিল। আবার, ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পূর্বের সোভিয়েত রাশিয়া ভারতের পক্ষে এসে দাঁড়িয়েছিল। এই সবই ‘ঠান্ডা যুদ্ধের’ কালের সমীকরণ। ন্যাম অর্থাৎ নন-অ্যালায়েন্ড মুভমেন্ট বা ‘জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলন’ সে সময় কোনো কাজে আসেনি। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার পতন ও পরে পূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলির পতনের পর ঠান্ডা যুদ্ধোত্তর কালে একবিংশ শতাব্দীর ভূ-রাজনৈতিক ভরকেন্দ্র এখন এশিয়া। এই শতাব্দীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘একমেরু’ থেকে ‘বহুমেরু’ কেন্দ্রীকতা। চীন এখন আমেরিকার প্রতিস্পর্ধী। আর, চীনের কাছে এশিয়াতে সবথেকে বড় বাধা হচ্ছে ভারত। তাই আজকের বিশ্বে এই বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম এক মেরুকেন্দ্র হয়ে ওঠা ভারতের পক্ষে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব।

চীনের বিস্তারবাদী নীতির সামনে শুধু আসিয়ান দেশগুলিই নয়, মধ্য এশিয়ার দেশগুলিও প্রতিরোধ করতে বাধ্য হচ্ছে। সম্প্রতি চীন তাজিকিস্তানের পামির পার্বত্য অঞ্চলের উপর তার দাবী জানিয়েছে। চীনের লক্ষ্য তাজিকিস্তানের সোনার খনিগুলিকে করায়ত্ত করা। দক্ষিণ-চীন সাগর থেকে শুরু করে ‘ভারত মহাসাগর অঞ্চল’ হয়ে আফ্রিকা হয়ে মধ্য এশিয়াকে নিয়ে ইউরোপ পর্যন্ত এক আধুনিক চৈনিক ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য স্থাপন এই কমিউনিস্ট চীনা পার্টির এজেন্ডা। এই এজেন্ডার বিরুদ্ধে ভারতের রুখে দাঁড়ানো ছাড়া অন্য পথ নেই। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে চার ধরনের অপসন: সহযোগিতা, প্রতিযোগিতা, সংঘাত ও সংঘর্ষ – তার সবগুলিকেই ভারতের রাষ্ট্রনীতির অংশ করতে হবে।

সামনের পথ

ডোকলাম এপিসোড থেকে উরি সার্জিক্যাল স্ট্রাইক হয়ে বালাকোট এয়ার স্ট্রাইক – ভারতের প্রতিরোধমূলক প্রতিক্রিয়া ‘নরম রাষ্ট্রের মেটামরফসিসের’ সূচনা করেছে। রিঅ্যাকটিভ পলিসি ছেড়ে ভারতকে প্রোঅ্যাকটিভ পলিসি নিতে হবে। চীনের ক্ষেত্রে এই প্রোঅ্যাকটিভ পলিসির প্রথম ধাপই হলো ভারতের এক-চীন থেকে দুই-চীন পলিসি গ্রহণ করা। কমিউনিস্ট চীন যেরকম দু’মুখো নীতি- মুখে এক, কাজে আরেক নীতি নিয়ে চলছে; ভারতকেও তেমনি দুই-চীন নীতি নিয়ে চলতে হবে।

তার প্রথম পদক্ষেপই হচ্ছে ধীরে ধীরে তাইওয়ান সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করা। তবে তার শর্ত হবে, এলএসি ও তিব্বতকে তাইওয়ানের মেনে নেওয়া। আবার, ভারতে তিব্বতের যে নির্বাসিত সরকার আছে, তাকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ভারত সরকারকে ভাবতে হবে।

একদিকে ‘কোয়াড’- ভারত, আমেরিকা, জাপান ও অষ্ট্রেলিয়া- এই চতুঃশক্তিকে দক্ষিণ-চীন সাগর থেকে ভারত মহাসাগর অঞ্চল পর্যন্ত মূল নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব নিতে হবে; তেমনি চীনের বিস্তারবাদী আক্রমণের শিকার থেকে বাঁচাতে আসিয়ান রাষ্ট্রগুলির সম্মতি সাপেক্ষে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নিতে তৈরি থাকতে হবে।

মধ্য এশিয়ায় ভারতকে এক প্রভাবশালী রাষ্ট্র হতে হলে একদিকে ইরানের চাবাহার বন্দরকে উপযুক্তভাবে ব্যবহার করতে হবে, অন্যদিকে গিলগিট-বালটিস্থান ও পাক-অধিকৃত কাশ্মীরকে ভারতের অঙ্গীভূত করার ব্যাপারে উপযুক্ত কৌশলের কথা ভাবতে হবে।

এটা এখন জলের মতো পরিস্কার যে, চীন তার বিস্তারবাদী নীতি থেকে সরে আসবে না। তাই ভারতকেও এক-চীন নীতি থেকে সরে আসতে হবেই। তার জন্য একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে ‘অ্যালায়েন্স অফ ডেমোক্রেসিস’ তৈরি করতে হবে; অন্যদিকে রাশিয়াকে নিয়ে মধ্য এশিয়ায় ‘অ্যালায়েন্স অফ পার্টনারস’ তৈরি করতে হবে।

শেষে, প্রোঅ্যাকটিভ নীতি গ্রহণের জন্য যে শক্তপোক্ত ভিত দরকার, তার জন্য ভারতকে একদিকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বৃদ্ধির পথে দ্রুত ফিরতে হবে; আরেক দিকে রিঅ্যাকটিভ নীতির ফাঁস ছাড়িয়ে কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও কৌশলগত প্রোঅ্যাকটিভ নীতি গ্রহণ করতে হবে, যাতে এশিয়াতে ভারতের ঐতিহাসিক ভূমিকার ধারাবাহিকতা বজায় থাকে এবং রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ পাওয়ার মধ্যে দিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে আরো সদর্থক ভূমিকা পালন করা যায়।