‘এত শত যতন করি’- দিল্লি কি তবে সত্যিই যুদ্ধযাত্রায় চলেছে?

0
519

বঙ্গদেশ ডেস্ক: ওয়ারহেডে শান দিচ্ছে ভারতের মিসাইল-ত্রয়ী— ব্রাহ্মোস, আকাশ আর নির্ভয়। ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্র রণসজ্জার ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর। আক্রমণের ‘এসকেলেশন’ নয় বরং লালফৌজের সম্ভাব্য আগ্রাসন প্রতিহত করতেই তৈরি করা হচ্ছে এই মিসাইল-ত্রিভুজকে, রণনীতির পরিভাষায় যাকে বলা হয় স্ট্যান্ড-অফ ওয়েপন।

সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মে মাস থেকে উত্তেজনার পারদ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে লাদাখ সীমান্তে৷ আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও, মেলেনি মজবুত সমাধান সূত্র৷ এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সম্ভাব্য যে কোনও পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত রয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী৷ প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (এলএসি) বরাবর বিপুল সংখ্যক সেনাও মোতায়েন করে রাখা হয়েছে। এমনকী সীমান্তে প্রস্তুত রয়েছে ৫০০ কিলোমিটার পাল্লার ব্রহ্মোস ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এবং ভূমি থেকে বায়ুতে আঘাত হানতে সক্ষম ৮০০ কিলোমিটার পাল্লার নির্ভয় ক্রুজ মিশাইল৷

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে ফুটে ওঠা বিষয়বস্তু থেকে জানা যায়, চিন-ভারত রণনীতি নিয়ে যাঁরা ওঠা-বসা করেন, তাঁদের দাবি এই মুহূর্তে যুদ্ধের সম্ভাবনা ক্ষীণ। অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল সুব্রত সাহা বলেছেন, “শীত আসছে। তাই লাদাখে চিনের মোকাবিলার জন্য চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত থাকতেই হবে ভারতীয় সেনাকে যাতে করে গালওয়ানের পুনরাবৃত্তি না হয়। সে জন্যই ১৪,৫০০ ফুট উঁচুতে লাল ফৌজের মোকাবিলা করতে কামান বাগিয়ে প্রস্তুত ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া বাহিনী।” স্বরাজ্যম্যাগের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, নয়াদিল্লির কাছে মিলিটারি ইনটেলিজেন্স মারফত খবর আছে, শুধু তো আকসাই চিন নয়, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার ৩,৪৮৮ কিলোমিটার বরাবর কাশগর, হোতান, লাসা আর নিইংচিতে দূরপাল্লার সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল বহু আগে থেকেই তাক করেই রেখেছে বেজিং। তিব্বত আর জিনঝিয়াংয়ের বেশ কিছু অংশেও তারা মজুত করেছে বিপুল পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র। সুতরাং, পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া ভারতের আর উপায় নেই।

এ বিষয়ে মেজর জেনারেল অরবিন্দ কাপুরের বক্তব্য, “ভারতের সাঁজোয়া বাহিনীকেও প্রস্তুত রাখা হয়েছে, যাতে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় কোনও সমস্যা দেখা দিলে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে তারা পৌঁছে যেতে পারে। ২৯-৩০ আগস্ট ভারতীয় সেনা যখন প্যাংগং লেকে ঘাঁটি গড়ে, তখন সক্রিয় হয়ে উঠেছিল চিনা সেনার ট্যাঙ্ক। আর সেই খবর পাওয়া মাত্রই কয়েক মিনিটের মধ্যে এসে পৌঁছেছিল ভারতের সাঁজোয়া বাহিনী। ফলে, সেই মহড়া ইতিমধ্যেই সাড়া ফেলেছে।”

সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, “ভারতীয় বায়ুসেনার কার নিকোবর এয়ার বেসটি SU-30 MKI-এর জন্য সবচেয়ে দুর্দান্ত অবতরণ ক্ষেত্র, যা এয়ার-টু-এয়ার রিফিউলার্স অনায়াসে ব্যবহার করতে পারে। এটি মালাক্কা স্ট্রেট থেকে ইন্দোনেশিয়ার সুন্দা স্ট্রেটে আসা কোনও পিএলএ-র যুদ্ধজাহাজকে বিপদ থেকে সুরক্ষা সরবরাহ করতে পারে।”

সূত্রের খবর, লাদাখে ক্রমেই পরিস্থিতি আরও বেশি উত্তেজনাপূর্ণ ও জটিল হচ্ছে। এছাড়া আমেরিকার সঙ্গেও সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছি চিনের। এমত পরিস্থিতিতে ভারত-আমেরিকাকে বার্তা পাঠাতে চিন শক্তিপ্রদর্শনের পথ বেছে নিয়েছে। পিএলএ-র রকেট ফোর্স বাহিনী তিব্বতে বেশ কয়েকবার মিসাইল পরিক্ষণ চালিয়েছে। আর এই পরিস্থিতিতে ভারতও চিনের বিরুদ্ধে তাদের মিসাইল প্রস্তুত করে রেখেছে। চিনা আগ্রাসন প্রতিহত করতে বর্তমানে ভারত তিন ধরনের মিসাইল মজুত রেখেছে। একনজরে দেখে নেওয়া যাক সেই মিসাইল সিস্টেমের বিশদ।

ব্রহ্মোস সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল

ব্রহ্মোস সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল ভারতীয় সেনাবাহিনীর অস্ত্র ভাণ্ডারের অন্যতম প্রধান শক্তি৷ শত্রুদেশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারতের প্রধান হাতিয়ার এই সুপারসনিক মিসাইল৷ ভারত ও রাশিয়া যৌথভাবে তৈরি করেছে ব্রহ্মোস৷ ভূমি, জাহাজ বা যুদ্ধবিমান, তিন জায়গা থেকেই ছোঁড়া সম্ভব এই মিসাইল৷ তাই ভারতীয় সেনাবাহিনীর তিন বিভাগ‌ই এই ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার করতে পারে৷ এর রেঞ্জ ৫০০ কিলোমিটার। যার অর্থ তিব্বত বা হোতানে চিনের ঘাঁটিতে অনায়াসেই আঘাত হানতে পারবে এই মিসাইল।

৩ হাজার ৭০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বেগে ছোটে

২০০৬ সাল থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে রয়েছে ব্রহ্মোস৷ একাধিকবার এই ক্ষেপণাস্ত্রের সফল প্রয়োগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে৷ ৩ হাজার ৭০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বেগে ছুটে যাওয়া ব্রহ্মোস হল বিশ্বের দ্রুততম অ্যান্টি শিপ ক্রুজ মিসাইল৷ শব্দের চেয়েও ৩ গুণ বেগে ছুটে গিয়ে শত্রুর জাহাজে আঘাত হানতে পারে এই মিসাইইল৷

আকাশ

শব্দের চেয়ে আড়াই গুণ বেশি গতিতে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম আকাশ। এই ক্ষেপণাস্ত্রটি ব্যাটল ট্যাঙ্ক বা হুইলড ট্রাকের মতো মোবাইল প্ল্যাটফর্ম থেকে নিক্ষেপ করা যায়৷ আকাশ ক্ষেপণাস্ত্রের নকশা ও ক্ষেপণাস্ত্রটি তৈরি করা হয়েছিল ভারতের ৩০ বছরের পুরানো ইন্টিগ্রেটেড গাইডেড-মিজ়াইল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে৷ এই প্রোগ্রামের অন্তর্ভুক্ত অন্য ক্ষেপণাস্ত্রগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- নাগ, অগ্নি, ত্রিশূল ও পৃথ্বী৷

মাটি থেকে শূন্যে উৎক্ষেপণ করা যায় ক্ষেপণাস্ত্রটি

মাটি থেকে বায়ুতে উৎক্ষেপণ করা যায় এই ক্ষেপণাস্ত্রটি৷ বিভিন্ন দিকে বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুকে আক্রমণ সহজেই আক্রমণ করতে পারে এটি৷ যে কোনও পরিবেশেই ব্যবহার করা যায় আকাশ৷ শব্দের থেকে আড়াই গুণ বেশি বেগে লক্ষ্যবস্তুকে আক্রমণ করার সক্ষমতা রয়েছে এর৷ কম, মাঝারি ও উঁচুতে ওড়ার সময় লক্ষ্যবস্তু নির্বাচন করে ধ্বংস করে দিতে পারে৷ এটির রেঞ্জ ৮০০ কিলোমিটার।

তিন হাজার আকাশ তৈরি হয়েছে

এখনও পর্যন্ত তিন হাজার আকাশ তৈরি হয়েছে৷ ভারতীয় বায়ু সেনার কাছে মজুত রয়েছে আটটি স্কোয়াডরান৷ সাতটি আরও অর্ডার দেওয়া হয়েছে৷ প্রতিটি স্কোয়াডরানে ১২৫টি করে এই ক্ষেপণাস্ত্র থাকবেই থাকবে৷ আকাশে চারটি রাজেন্দ্র ব়্যাডার যুক্ত রয়েছে৷ চারটি লঞ্চার একে অপরের সঙ্গে ক্লোজভাবে সংযুক্ত৷ এগুলিকে গ্রুপ কন্ট্রোল সেন্টার থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। প্রতিটি লঞ্চারে তিনটি ক্ষেপণাস্ত্র ও একটি ব়্যাডার থাকে৷ এটি ১৬টি লক্ষ্যবস্তুকে চিহ্নিত কর দিতে পারে৷ সব মিলিয়ে ব়্যাডারটি ৬৪টি লক্ষ্যবস্তুকে চিহ্নিত করতে পারে এবং একত্রে ১২টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা যায়৷

নির্ভয়

এছাড়া রয়েছে নির্ভয়। জল, স্থল ও আকাশ তিন জায়গা থেকেই উৎক্ষেপণ করা যায় নির্ভয় ক্ষেপণাস্ত্র৷ নির্ভয় ভারতে তৈরি একটি সাবসোনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র৷ এটি এক হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম৷ নকশা এবং ক্ষেপণাস্ত্রটি তৈরি করেছে ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গ্যানাইজেশনের অধীনে থাকা এরোনটিকাল ডেভেলপমেন্ট এস্ট্যাব্লিশমেন্ট৷ ভারতের সামরিক বাহিনীর তিন শাখাই অর্থাৎ ভারতীয় সেনাবাহিনী, ভারতীয় বায়ুসেনা ও ভারতীয় নৌবাহিনী এই ক্ষেপণাস্ত্রটি ব্যবহার করতে পারে৷

সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আন্তর্জাতিক যুদ্ধবিদরা বলেছেন এই পরিস্থিতিকেই বলা হয় ‘ওয়েপন ডেটারেন্স’ সিস্টেম। মানে, প্রতিপক্ষ যেন আক্রমণ করতে সাহস করে না, তার জন্য নিজের শক্তি প্রদর্শন করা। ছোবল না-দিলেও ফোঁস করতে দোষ কোথায়! আবার চিন যদি সত্যিই আচমকা আগ্রাসন দেখায়, তখন সেই ‘ওয়ার্স্ট কেস সিনারিও’-তে কাজে লাগবে এই প্রস্তুতি। ঠিক যেমন ঠান্ডা যুদ্ধের সময় যেমন পূর্ব ইউরোপের সোভ ব্লক বরাবর ট্যাকটিক্যাল নিউক্লিয়ার ওয়েপন সাজিয়ে ক্ষমতা দেখাত মহাশক্তিধর সোভিয়েত ইউনিয়ন। পাল্টা তড়পাতে থাকতো আমেরিকা ও ন্যাটোবাহিনী। গর্জন যতটা, বর্ষণ কিন্তু একেবারেই ততটা হয়না। কারণ দু’পক্ষই জানত, ‘কদম কদম বঢ়ায়ে’ করলেই উল্টোদিক থেকে সাঁ করে ছুটে আসতে পারে পরমাণু বোমা। মার্কিন কোল্ড ওয়ার বিশেষজ্ঞ জন লিউইস গ্যাডিস মন্তব্য করেছিলেন, “দু’পক্ষেরই ধ্বংস হয়ে যাওয়ার এই নিশ্চিত সম্ভাবনাময় পরিস্থিতিই ঠেকিয়ে রেখেছিল আসল লড়াইকে, ঠান্ডা যুদ্ধ তাই গরমাগরম যুদ্ধে পরিণত হতে পারেনি কখনও।” বেশ গালভরা একটা নামও আছে এই তত্ত্বের। মিউচুয়ালি অ্যাসিওরড ডেসট্রাকশন— MAD!

ভারত-চিন দু’পক্ষও বাস্তবে বিলক্ষণ জানে সমগ্র বিষয়টা। তাই চলছে ঠোকাঠুকির খেলা কিন্তু লাল বেজিংকে চোখ রাঙানোর ভাবটা এমন যেন বার্তা যায় দিল্লি চলেছে যুদ্ধে।