গাযওয়া ই হিন্দের দুটি কথা

0
2231

ঋতম দেব সিংহ

অজিতদার বাড়ির দিকে রওনা হলো তপু। দাদার কাছে গেলে অনেক কিছুই জানা যায়। অজিতদা একপ্রকার একটি ছোটখাটো এনসাইক্লোপিডিয়া। রাজনীতি হোক বা ইতিহাস, অথবা বিজ্ঞানের বিদঘুটে সব বিতর্ক, সব কিছুতেই দাদার সাথে খুব জমে ওঠে।

পড়ন্ত দুপুরে হাঁটতে হাঁটতে তপু ভাবছিলো একটি শব্দ নিয়ে। গাযওয়া ই হিন্দ। গতকাল শুনেছিলো জামালের মুখে। হঠাৎ পর্ক আর বিফ নিয়ে সেদিন তর্ক শুরু হয়ে গিয়েছিলো জামালের সাথে। তারপর একথা হতে সেকথা। শেষে হুমকির স্বরেই বললো,

– গাযওয়া ই হিন্দ আসছে, সব হিসেব হবে।
– আরেহ যা যা। কতো কি এলো গেলো। এসেছে পর্ক খেতে বাঁধা দিবে। আরেহ বিফটা একবার ছেড়ে এসে বল না।

হুঁস হুঁস করে চলে গেলো জামাল। কিন্তু ওর চাহনিতে একটি ক্ষুধার্ত হিংসা দেখতে পেয়েছিলো তপু। তাহলে কী এই গাযওয়া ই হিন্দ? যার কথা বলে বলে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলো জামাল ক্ষণে ক্ষণেই।

– এই তপু কোথায় যাস রে?
– অজিতদার বাড়ি গো।

আজ স্বাতীদিকে অন্যরকম লাগছে কেন! শাড়ি পড়েছে তাই?

– এই স্বাতীদি, শুনো না। বলছিলাম, এতো সেজেগুঁজে কোথায় চললে গো?
– কেন সাজতে বুঝি উপলক্ষ্য লাগে?
– না সে নয়। তবে যাচ্ছ কোথায় সেটা বলো।
– না সে বলা যাবে না। তবে একটা কাজ কর। এই টিস্যুবক্সটা তোর অজিতদাকে দিবি। তার নাকি সর্দি হয়েছে।
– সেকি! করোনা না তো আবার!
– আরেহ না না। যা তো। ও এমনিই হয়েছে আরকী।

স্বাতীদি। মিষ্টি একটা মেয়ে। অজিতদাকে পছন্দ করে। যদিও অজিতদা বলেছে সে নাকি চিরকুমার সভার প্রেসিডেন্ট। তাই বিয়েটা তার জন্য মানহানিকর বস্তু।

তপু চললো।
অজিতদা বাড়িতেই ছিলো। তার কোটাঘরেই।

– এ যে শ্রী তপ্তমান মহাশয়! টিস্যুবক্স হাতে এদিকে উদয় হঠাৎ!
– অজিতদা তোমার নাকি সর্দি হয়েছে।
– হ্যাঁ রে। তবে এটা তো বলার মতো কিছু হয় নি। ওই নাক দিয়ে একটু একটু ঝরছে আরকি। কিন্তু তুইই-
– স্বাতীদি এই টিস্যুবক্স দিলো, আর বললো এটার যেন সদ্ব্যবহার হয়।
– আচ্ছা স্বাতীদির পিয়ন। শুধু এই জন্যেই আসা?
– নাহ কিছু জানার ছিলো গো।
– আচ্ছা মুড়ি সহযোগে চলবে?
– সাথে ঘি?
– ঠিক আছে।

অজিতদা মুড়ি মাখাচ্ছে। মুড়ি সহযোগে আড্ডা নাকি হতেই পারে না। আড্ডাতে ওই একটু মুড়ি বা অন্য কিছু জলখাবার হতেই হবে। নাহলে ওটা আড্ডা নাকি রে বাবা!

– আচ্ছা, গাযওয়া ই হিন্দ কী বিষয় গো অজিতদা?

– এই রে। এতো বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে চর্চিত বিষয়। তুই শুনলি কোথায় হঠাৎ?

– জামালের কাছে। একটু তর্ক হয়েছিলো। বলো না, ব্যাপারটা কী?

– শোন, গাজওয়া অর্থ যুদ্ধ বা জিহাদ, হিন্দ অর্থ ভারতবর্ষ। অর্থাৎ ভারতবর্ষে মুসলিমদের সাথে মুশরিকদের নেতৃত্বে কাফির বাহিনীর সাথে যে যুদ্ধ সংগঠিত হবে তাহাই হলো গাযওয়া ই হিন্দ।

– যুদ্ধ সংগঠিত হবে মানে! ভবিতব্য নাকি?

– ব্যাপারটিকে তুই ভবিতব্য না বলে, Aim কে ভবিতব্যে রূপান্তরও ভাবতে পারিস।

– অর্থাৎ?

– দেখ কোরআন হাদিসে কিছু সূরা আছে। যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে এই গাযওয়া ই হিন্দ এর ব্যাপারে। যেমন ধর, সুনানে আন-নাসায়ী, হাদিস নং ৩১৭৫ হাদিসের মান: সহিহ হাদিস। এটাতে নবীর গোলাম ছাওবান দ্বারা বর্ণিত হয়েছে, “রাসুলুল্লাহ বলেছেন: আমার উম্মতের দুটি দল, আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে জাহান্নাম হতে পরিত্রাণ দান করবেন। একদল যারা হিন্দুস্থানের জিহাদ করবে, আর একদল যারা ঈশা ইবনে মারিয়াম (আঃ)-এর সঙ্গে থাকবে।”

– তারপর?

– তারপর, আবু হুরায়রা তে বর্ণিত আছে, “রাসুল বলেছেন “অবশ্যই একটি দল ভারতবর্ষে মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ করবে, আল্লাহ সেই যোদ্ধাদের সফলতা দান করবেন। তারা সেখানকার শাসকদেরকে শিকল/বেড়ী দিয়ে বেধে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসবে। অতপর আল্লাহ সেই সকল যোদ্ধাদের ক্ষমা করে দিবেন, তারা হবে সুসংবাদ প্রাপ্ত। বিজয়ী এই যোদ্ধারা শাম (সিরিয়া) এ ফিরে এসে ঈশা ইবনে মারিয়াম সাথে সাক্ষাৎ পাবে।” (আল ফিতান, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৪০৯)

আবু হুরায়রা আরও বলে, “আমি যদি গাযওয়া ই হিন্দে অংশ গ্রহণের সুযোগ পায় তবে আমি আমার নতুন পুরাতন সকল সম্পদ বিক্রি করে দিয়ে বিক্রয়লব্ধ অর্থ নিয়ে উক্ত যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করবো। এরপর আল্লাহ আমাদের বিজয় দান করবেন, এবং আমি যখন শামে (সিরিয়ায়) ফিরে যাব তখন আমি হব একজন নিশ্চিত (জাহান্নামের আগুন হতে মুক্ত) স্বাধীন আবু হুরায়রা এবং সেখানে আমরা ঈশা এর সাথে মিলিত হব।” (মুসনাদে ইসহাক, হাদিস নং ৪৭৭)

– এ যে পুরোপুরি প্রোপাগান্ডা টাইপ দেখছি।

– হ্যাঁ। আরও আছে। শোন। রক্ত হিম করে দেওয়া কিছু ব্যাপার। হযরত সাফওয়ান বিন উমরু নামক এক মুফতীর কিছু বক্তব্য রয়েছে।

সে বলেছে, “কিছু সাহাবী তাকে বলেছেনঃ রাসুল বলেছেন, আমার উম্মাতের একদল ইমানদার লোক ভারতবর্ষের সাথে যুদ্ধ করবে, আল্লাহ তাদের সফলতা দান করবেন। এমনকি তারা সেখানকার শাসকদেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় পাবে। আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন। যখন তারা শাম (সিরিয়া) এ ফিরে আসবে, তখন তারা ঈশা ইবনে মারিয়াম এর সাক্ষাৎ লাভ করবে।” (আল ফিতান, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৪১০)

(রাসুল এর বর্ণনা অনুযায়ী ভারতবর্ষ বর্তমান মিয়ানমারের আরাকান, বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত।)

– ওরে বাবা।

– হ্যাঁ। এই যুদ্ধের শহীদদের মর্যাদা সম্পর্কে এক বর্ণনায় বলা হয়েছে “উক্ত যুদ্ধে যে এক-তৃতীয়াংশ লোক শহীদ হবে, তাদের একেক জন শহীদ বদরী দশ জন শহীদের সমান হবে। বদরী শহীদদের একজন ৭০ জনের জন্য সুপারিশ করতে পারবেন, পক্ষান্তরে এই যুদ্ধের একেক জন শহীদ ৭০০ জনের জন্য সুপারিশ করতে পারবে।”

(আল ফিতান, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৪১৯)

– এ যে পুরো Enticed করা হচ্ছে।

– হ্যাঁ। আর এই যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করাকে মুসলিমদের নিকট শানগত মর্যাদা হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। অন্যথায় মোটের উপর বদরী শহীদদের মর্যাদা ইতিহাসের সকল শহীদদের মাঝে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ হিসেবে ধরা হয়।

– আর ঠিক এই জন্যেই সমস্ত মুসলিমরা নবীর নস্টালজিয়া অনুভব করতে করতো, আগামীতে এই যুদ্ধে অংশ নিয়ে তখনকারসময়ের যুদ্ধে অংশ নেওয়ার থেকে বেশি পুণ্য লাভের স্বপ্ন দেখছে।

– একদমই। ইসলামিক স্টাডিজ অনুযায়ী, এই গাযওয়া ই হিন্দ যখন হবে, তখন ইমাম মাহাদী আসবে। যে একজন যুদ্ধবাজ জঙ্গি। কেউ বলেন, জঙ্গি মোহাম্মদের বংশের একজন জঙ্গি নেতা সে। আবার, কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশে ২০০৩ সালে ইমাম মাহাদি জন্ম নিয়েছেন, কেউ বলছেন, ২০১৮, ১৯, ২০, ২১, ২৪ সালে ইমাম মাহাদি আসবে, অথবা, আরো পরে আসবে। অথবা এসে গিয়েছে। তবে ২০২১ সালে আসার সম্ভাবনা প্রবল বলেই অনেকেই মতামত দিয়ে থাকে।

– ইমাম মাহাদী! এটাও কি একটি প্রোপাগান্ডা?

– হ্যাঁ। একদমই। কেননা, ২০০/৩০০ বছর নয়, সহস্র বছরের অনেক আগে থেকেই এই ইমাম মাহাদীর অপেক্ষায় মুসলিম বিশ্ব আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম সম্পদশালী লক্ষীর ভান্ডার পবিত্র ভারতবর্ষের প্রতি একের পর এক আঘাত এনেছে। পরিণামে, হাত ছাড়া হয়েছে, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, আর আজকের বাংলাদেশ পবিত্র ভারতমাতার অঙ্গ থেকে। এবং দিন দিন আগ্রাসী মুসলিম তাদের সেই স্বপ্নের গাজওয়া-ই-হিন্দ বাস্তবায়নের জন্য দিন দিন ভারত মাতাকে আক্রমণ করছে, বাংলাদেশ হিন্দু শূন্য করছে, ভারতে মুসলিম জন সংখ্যা বৃদ্ধি করছে।

– এই জন্যেই ভারতকে এতো বহিরাগত মুসলিম আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়েছে বারবার। এবার তাদের লক্ষ্য কি?

– তাদের লক্ষ্য আর কি হবে!কোটি কোটি হিন্দুকে হত্যা করবে, ধ্বংস করবে সকল মন্দির, বিগ্রহ। ধুলায় লুটাবে হিন্দু শির। ধর্ষিতা হবে সকল হিন্দু মা বোন। চারদিকে কেবল পূর্বপুরুষের পবিত্র ভারতভূমির বিধ্বস্তু রূপ। তাদের বক্তব্য, ইমাম মাহাদি আসলো বলে। মুসলিমরা পাড়ায় পাড়ায় , অলিতে গলিতে কেবল একটি ভবিষ্যত নিয়ে ব্যস্ত……… গাযওয়া ই হিন্দ।

– আর এই জন্যেই কখনো বোম্বে ব্লাস্ট কখনো বা উরি হামলা। হয়েই চলেছে বারবার।

– একটাইই লক্ষ্য, দারুল ইসলাম বানাতে হবে ভারতকে। বিনিময়ে নবীর সাথে যুদ্ধ করেও বদরের যুদ্ধের শাহাদাৎবরণকারীদের থেকেও শ্রেষ্ঠ সম্মানের হাতছানির লোভ। তবে দিন দিন তারা সংগঠিত হচ্ছে। চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য। কেননা উলেমায়েগণ প্রচার করতে থাকে সবসময়ই, প্রতিদিন ইমাম মাহদীর কাজকে এক কদম এগিয়ে রাখতে হবে। এটাই প্রকৃত ঈমানদারের লক্ষণ।

– আর ঈমানদাররা লাভ জিহাদ, ল্যান্ড জিহাদ, পপুলেশন জিহাদ ইত্যাদির মাধ্যমে দিন দিন ঈমানী দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।

– হ্যাঁ। আর আমরা মার্ক্স আর লেনিন বুঝে দিনাতিপাত করছি।

– বলছিলাম, ভবিতব্য না বলে, Aim কে ভবিতব্যে রূপান্তরও ভাবতে বলেছিলে কেন?

– সে গল্প অন্য একদিন করবো নাহয়। আজ মুড়িও শেষ, আর সন্ধ্যাও সমাগত। বলছিলাম, সন্ধ্যায় মসজিদ থেকে ঘুরে যাস। কীভাবে নামাজ পড়তে হয়, ওযু করতে হয়, শিখে রাখা ভালো।

– কেন কেন??

– দেখ, আমরা লেনিন বুঝতে ব্যস্ত আছি। কিন্তু কবে যে কাশ্মীরের মতো “রালিভ চালিভ গালিভ” সারা ভারতে শুরু হয়ে যাবে, এর কোনো নামগন্ধই আমরা পাবো না। বেঁচে থাকতে হলে, তখন এটাই কাজে আসবে। বুঝলি রে?

– হুম। কাল আসবো আবার যাইইই।

তপু গম্ভীর হয়ে হাঁটতে লাগলো। পশ্চিমাকাশে সূর্য তখন যেন ভারতীয় হিন্দু শৌর্যের বর্তমানকে জানান দিচ্ছে।

তিষ্ঠ বন্ধু, অন্ধকার সমাগত, খানিক বাদেই দিবসের অবসান। প্রদীপ জ্বালো!

গাযওয়া ই হিন্দ সমাগত!

অজিত_ও_তপু_১