জন্ম মৃত্যু

0
3520

বাসার দরজা বন্ধ দেখে ছাদে উঠে আসলাম, আন্দাজ করেছিলাম ছাদেই পাওয়া যাবে শ্বরণী বাবুকে। আন্দাজ সঠিক, দেখি কুচকুচে কালো রঙের  পাঞ্জাবি পড়া শ্বরণী বাবু ছাদে একটা বেতের তৈরী মোড়ার উপর বসে আছেন। শুধু বসে আছেন বললে ভুল হবে, বাম হাতে ধরে থাকা খোলা বইটির উপর মাথাটা নিচু করে মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন আর কিছুক্ষণ পর পর ডান হাতের জ্বলন্ত সিগারেট ঠোঁটে ঠেকিয়ে লম্বা লম্বা টান দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া দিয়ে ফুসফুস ভর্তি করছেন, সেই ধোঁয়া গুলোই কয়েক সেকেণ্ড পর নাক দিয়ে বের করে ফেলছেন। শ্বরণী বাবুর পরণের কুচকুচে কালো রঙের পাঞ্জাবি দেখে প্রথমে মনে হয়েছিল, কোন শিয়া মুসলিম আলী, হাসান এবং হোসেইনের মৃত্যুর মাতম করতে কালো কাপড় জড়িয়ে আছে। আমি শ্বরণী বাবুর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,

– কি বই পড়ছেন? মনোযোগ দেখে মনে হচ্ছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয়ের উপর লেখা বইটা।

বইয়ের পাতা হতে চোখ না সড়িয়েই খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই উত্তর দিলেন

– হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযযালী রহের লেখা মরণের আগে ও পরে।

– মৃত্যুর ভয় ঢুকে গেলো নাকি মনে? আপনি কবে থেকে পরকালের উপরে বিশ্বাস করা করা শুরু করলেন?

এবার শ্বরণী বাবু তার ডান হাতের শেষ হয়ে আসা সিগারেটে উইলিয়াম শেক্সপিয়রের টান দিয়ে, ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে খুবই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে ফিরে তাকালেন| শ্বরণী বাবুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে ভেবেছিলাম বোধহয় বোকার মত প্রশ্ন করায় এবার একটা কঠোর ধমক শুনতে হবে, যদিও আশ্বস্ত হলাম, কারণ তিনি বলে উঠলেন,

– সিগারেট বের কর, একটা সিগারেট খাবো।

পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে দিলাম, শ্বরণী বাবু একটি সিগারেট বের করে ফিল্টারটা দু’পাটি দাতের মাঝে আলতো করে কামড়ে মুখটা আমার দিকে একটু এগিয়ে দিয়ে ইশারা করে বুঝিয়ে দিলেন যে “সিগারেটে আগুন ধরিয়ে দে”। আমি সিগারেটের প্যাকেটের সাথে বিনে পয়সায় পাওয়া ডলফিন ম্যাচের একটি কাঠি বের করে ম্যাচ বক্সের বারুদে ঘষা দিয়ে আগুন ধরিয়ে সিগারেট জালিয়ে দিলাম। শ্বরণী বাবু পরপর কয়েকবার সিগারেটে টান দিলেন ঠিকই কিন্তু ধোঁয়া ছাড়লেন না, প্রায় ২০ সেকেন্ড পর মুখটা গোল করে বুকের ভেতর জমিয়ে রাখা সব ধোঁয়া দিয়ে একটার পর একটা রিং তৈরী করলেন, কম করে হলেও প্রায় আটটা রিং হবে। শ্বরণী বাবুর এই অভ্যাসটা খুব পুরাতন, প্রায়ই এমনটা করে থাকেন। দেখতে ভালই লাগে, মনে হয় মুখের ভেতর হতে একের পর এক ধোঁয়ায় তৈরী রিং জন্ম নিয়ে ধীরে ধীরে নিজেদেরকে বাতাসের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে মৃত্যু বরণ করছে। ধোঁয়া দিয়ে রিং বানানোর প্রতিভা প্রদর্শন পর্ব শেষ হলে শ্বরণী বাবু হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে খুই ঢিলেঢালা কন্ঠে বললেন

– মৃত্যুর ভয় মনে ঢুকলো কিনা এমন ফালতু এবং হাস্যকর প্রশ্ন আমাকে অন্তত করিস না। আমি মৃত্যুকে ভয় পাবো কেন? কারণ যতক্ষণ আমি অস্তিত্বশীল ততক্ষণ মৃত্যু অবর্তমান, আর যখন আমি মৃত আমি অস্তিত্বহীন আর অস্তিত্বহীন অবস্থায় অনুভুতি অবর্তমান। অর্থাৎ যে জিনিষের স্বাদ আমি অনুভব করতে পারছি না তাকে ভয় পাবো কোন যুক্তিতে?

নগণ্য জ্ঞানে জ্ঞানী হওয়া করনে শ্বরণী বাবুর উক্তিটির অর্থ আমি বুঝতে পারিনি, তবুও সব বুঝেছি এবং আপনি ঠিকই বলেছেন মার্কা মাথা নাড়ালাম। শ্বরণী আমার দিকে তাকিয়ে বললেন

– জানি, না বুঝেই তুই মাথা ঝাঁকাচ্ছিস! যাই হোক দাড়িয়ে আছিস কেন, ওই চেয়ারটা টেনে বসতে পারছিস না?

সত্যি তো, কিছুটা দূরে একটা কাঠের চেয়ার রাখা, এতক্ষণ চোখে পড়ে নি। চেয়ারটা বোধহয় অনেকদিন ব্যবহার হয়নি, এভাবেই ছাদে অবহেলায় ফেলে রাখা হয়েছিল, কেননা ধুলোবালি, বৃষ্টির পানি এবং সূর্যের তাপে রং চটে যাওয়া চেয়ারের চেহারাটা এমনটাই সাক্ষ্য দিচ্ছিলো। চেয়ারটার উপর জমে থাকা ধুলো খালি হাতে কোন রকম ঝেড়ে নিয়ে, শ্বরণী বাবুর কাছে টেনে এনে সামনা সামনি রাখলাম। চেয়ারে বসতে বসতে একটা প্রাসঙ্গিক একটা প্রশ্ন করে বসলাম

– আচ্ছা শ্বরণী বাবু ধার্মিকেরা বলে পরকালে জীবন অফুরন্ত, পরকালের মানুষেরা অমর। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কি?

“বেঁচে থেকেও যে আমি আজীবন বাঁচতে পারবো না, মরার পর নাকি সেই আমি আজীবন বেঁচে থাকবো?” কথাটা বলেই শ্বরণী বাবু হো হো করে উচ্চঃস্বরে হেসে উঠলো, যেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ কৌতুক তিনি আজ শুনেছেন। হাসিটা পুরোপুরি থামেনি, সেই হাসির রেশে রসালো স্বরে তিনি বলতে লাগলেন

– আসলে বিষয়টা কি জানো লেখক, ধার্মিকদের মধ্যে মরার পর আজীবন বেঁচে থাকার ধারণাটার সুত্রপাত সেই প্রাচীন কালেই। মানুষের অমর হবার আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টির শুরু থেকেই রয়েছে। কিন্তু মানুষের মনের সেই আকাঙ্ক্ষা চরম তীব্র হওয়া সত্ত্বেও বাস্তবতা হল মানুষ মরণশীল। হাজার চেষ্টা করেও মানুষ আজ পর্যন্ত অমরত্ব কেউ লাভ করতে পারেননি। ভবিষ্যতের কথা জানিনা, উন্নত চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৌলতে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে মানুষ অমরত্ব লাভ করতেও পারে।

শ্বরণী বাবু কথা হঠাৎ করে থামিয়ে দিয়ে খুই সুরেলা গলায় গেয়ে উঠলেন “কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা, মনে মনে।” আমি কিছুটা অবাক ভঙ্গিতেই জানতে চাইলাম

– হঠাৎ করে রবি ঠাকুরের গান গাইলেন যে?

– কারণটা একটু পরেই বুঝতে পারবি। যাই হোক যেটা বলছিলাম, বাস্তবে মানুষ অমর হয়ে থাকতে না পারলেও নিজের মনের কল্পনার ঘরে মানুষ অমর হয়ে থাকতে চাইলে কেউ বাধা দেয়না, এই প্রসঙ্গেই গানটা মনে পড়ে গিয়েছিলো। বাস্তবতাকে অস্বীকার করা অসম্ভব! তাই কিছু কিছু মানুষ বাস্তবতার কাছে হার মেনে মাথা নত করে নিজের অতৃপ্ত মনকে সান্ত্বনা দিতে কল্পনা এবং প্রচার করতে শুরু করলো যে “আমি মরে আজীবন বেচে থাকবো”! তারা বাস্তব সত্য জানা সত্ত্বেও মরে যাবার দুঃখ ঘুচাতে এমনটা ভাবতো। এমন ধারণার প্রচলিত গল্পগুলো এক সময় ধর্ম বিশ্বাসে রূপ নিল, অবশ্য এর পেছনে ছিল অনেক বুদ্ধিমানের হস্তক্ষেপ।

বুদ্ধিমান মানুষ লক্ষ্য করলো যারা আজীবন বেঁচে থাকার কাল্পনিকতাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে, তাদের মনে মৃত্যুর দুঃখ অনেকটা কম। তাই তারা ভাবলো যদি মূর্খ মানুষদের অন্ধ বিশ্বাসের অন্তরালে অমর হবার অবাস্তবতাকে বাস্তব হিসেবে ঢুকিয়ে দেয়া যায়, তবে মরে যাবার দুঃখটা প্রতিটি বিশ্বাসীদের মন থেকে উঠে যাবে। যেহেতু ধর্ম হল অজস্র কাল্পনিক এবং অযৌক্তিক বিশ্বাসের সমন্বয়ে সৃষ্টি, তাই সেই বুদ্ধিমানেরা খুব সহজেই মৃত্যুর পর আজীবন বেঁচে থাকার ধারণাটা জুড়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল, যা এখন পরকাল নামে আমাদের কাছে পরিচিত। আবার কিছু মানুষ যারা কিনা কাল্পনিক স্বর্গ নরক থেকে বাস্তব পৃথিবীকে বেশি ভালবাসে, তাদের কাছে পরকাল অর্থাৎ মরে যাবার পর অমর হবার ধারনাটা পছন্দ হলো না, তাই বুধিমানেরা তাদের জন্য এনে দিলো মৃত্যুর পর আবারও পৃথিবীতে ফিরে আসার কাল্পনিক ধারণা, যা আমরা পুনর্জন্ম নামে জানি।

হঠাৎ কথা থামিয়ে শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটের ফিল্টার ছুড়ে ফেলে দিয়ে শ্বরণী বাবু বললেন,

– জানিস না, গুরুর বয়ান শুনতে হলে গুরু দক্ষিণা দিতে হয়?

আমি হাসি মাখা মুখে আমার মাথাটা একটু নত করে জিজ্ঞাসা করলাম

– কি দক্ষিণায় আপনি তুষ্ট হবেন গুরু?

– গুরু দক্ষিণা আমার মাত্র দুটো, এক সিগারেট আর দ্বিতীয় রতন পন্ডিতের কলিজা মিঠা চা। চা পরে খাওয়ালেও চলবে, আপাতত সিগারেট দে।

আমি আবারও প্যাকেট বের করে দিলাম, তিনি একটা সিগারেট বের করে মুখে রাখতেই আমি ম্যাচের কাঠি দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে দিতে দিতে জানতে চাইলাম,

– গুরু যেহেতু আপনি পরকাল কিংবা পুনর্জন্মে মানেন না, তবে আপনি কি মানেন?

শ্বরণী বাবু আমার ধরিয়ে দেয়া সিগারেটে জোরে একটা টান দিয়ে এক গাল ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন

– ধর্মকে যারা মানে তারা আস্তিক, আর যারা ধর্মকে জানে তারা নাস্তিক। আমি পরকাল কিংবা পুনর্জন্ম মানি না কারণ আমি এগুলো সম্পর্কে ভালো করে গভীর ভাবে জানি| আমি যেটা জানি সেটা হল জন্মের আগে যেমন কারও কোনও কাল থাকে না, মৃত্যুর পরেও তেমনই কোনও কাল নেই। জন্মের আগে যেমন একটা ঘুটঘুটে অবচেতনায় ছিলাম, মৃত্যুর পরেও ঠিক একই অনুভুতি, এককথায় বলতে গেলে “জন্মের আগে আমি মৃতই ছিলাম”। আমার কাছে জীবনটা হল রবি ঠাকুরের সেই গানের মতো “না চাহিলে যারে পাওয়া যায়”, জন্মের আগে সেই ঘুটঘুটে অবচেতনায় থেকে অবশ্যই কারো চাওয়া পওয়ার ক্ষমতা থাকা সম্ভব না, আমারও ছিল না, কারণ আমি কারো থেকে ব্যতিক্রম নই। ঠিক অন্যদের মতই আমিও বাবা-মায়ের যৌনক্রিয়ার ফসল হিসেবে জন্মেছি, তাই অন্য সবার মতই এখন আমারও ইচ্ছা শক্তি আছে, জীবন চাইনি ঠিকই, কিন্তু এখন আমি এই সুন্দর জীবনটাকে হারাতে চাই না, জন্মের আগের অনুভুতিতে আবারও ফিরে যেতে চাইনা। অমর হবার ইচ্ছা আমারও আছে, তাই বলে আমি সকল বাস্তবতা জেনে বুঝে ধার্মিক মূর্খদের মত মিথ্যা সান্ত্বনায় পরিপূর্ণ কল্পনার চাদরে নিজেকে মুড়ে রেখে, মনটাকে অবুঝ বানিয়ে রাখতে আমি রাজি নই।

 

ফীচার: লেখক স্বয়ং