আমরা যেমন মনে করি, ‘সুফীবাদ’ তেমন নয় – ২

0
1473
Shaikh Moeenuddin Chishti Ajmeri

– জাহরা সবরি

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

বিভিন্ন সুফী তরিকার মধ্যে নক্সবন্দীরা একটু অস্বাভাবিক, কারণ তাঁরা ঐতিহাসিকভাবেই রাজনীতিতে জড়াতে বেশ উৎসাহী ছিলেন, এবং নিঃসঙ্গতা (খালওয়াত) এর বদলে সংসর্গ (সুবহাত) পছন্দ করতেন। তবে, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ইতিহাস অন্য তরিকাগুলিরও রয়েছে।

সুরাবর্দী তরিকার শেখ বাহাউদ্দিন জাকারিয়া (? – ১২৬২) মোঙ্গলদের হাতে মুলতানের শান্তিপূর্ণ আত্মসমর্পণের বন্দোবস্ত করেছিলেন। হানাদার বাহিনীর সেনাপতিকে ১০০০০ দিনার প্রদানের মাধ্যমে তিনি নাগরিকদের জীবন ও ধন-সম্পত্তি রক্ষা করেন। সুরাবর্দীরা চিরকাল চেষ্টা করে এসেছেন কীভাবে শাসকদের প্রভাবিত করে ধর্মের চোখে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ানো যায়। বাহাউদ্দিন জাকারিয়া দিল্লির দাস বংশের সুলতান ইলতুৎমিশের খুব কাছের মানুষ ছিলেন, এবং শেখ-উল-ইসলাম উপাধিও লাভ করেছিলেন। মুলতানের শাসক নাসিরুদ্দিন কুবাচা সুলতানকে উৎখাত করতে চাইলে বাহাউদ্দিন সরাসরি সুলতানের পক্ষ গ্রহণ করেন।

মুঘল শাসক জাহাঙ্গিরের নাম রাখা হয়েছিল শেখ সেলিম চিস্তির (? – ১৫৭২) নামে – এই তথ্যটি বহুজনবিদিত। তবে, অনেকেই হয়তো জানেন না যে তাঁর প্রপিতামহ বাবরের ‘জাহিরুদ্দিন মহম্মদ’ নাম রেখেছিলেন নক্সবন্দী শেখ খাজা ওবেইদুল্লা আহরার (? – ১৪৯০)। মধ্য এশিয়ায় এঁর রাজনৈতিক প্রতিপত্তি ছিল মারাত্মক। শেখের পুত্র পরবর্তীকালে বাবরকে উজবেকদের হাত থেকে সমরখন্দ রক্ষা করতে নির্দেশ দেন। বহু বছর পর, বাবর যখন ভারতে অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন খাজা আহরারের থেকে আরোগ্য লাভের আশীর্বাদ পেতে তাঁর একটি লেখাকে পদ্যরূপ দিয়েছিলেন।

মধ্য এশিয়ায় রাজত্ব হারিয়ে ভারতেই সীমাবদ্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও বাবর ও তাঁর বংশধররা মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন নক্সবন্দী ঘরানা, যেমন আহরার, জুইবারী ও দাহবিদীদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন। এই সম্পর্ক যে কেবল আধ্যাত্মিক স্তরেই সীমাবদ্ধ ছিল, তা কিন্তু নয়। নক্সবন্দী শেখদের পরবর্তী বহু প্রজন্ম মুঘল দরবারে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও প্রশাসনিক পদ লাভ করতেন।

এই শেখদের পুত্রগণ অনেক সময় রাজকন্যাদের বিবাহ করে অভিজাতবর্গে প্রবেশ করতেন। বাবরের এক কন্যা এবং হুমায়ুনের এক কন্যার বিয়ের কথা জানা যায় নক্সবন্দী শেখ পরিবারে। আবার, এই দুই বাদশাহ নিজেরাও খোরাসানের জম অঞ্চলের শেখ পরিবারে বিবাহ করেছিলেন। আকবরের মাতা হামিদা বানু (মরিয়ম মকানি) ছিলেন বিখ্যাত শেখ আহমদ-এ-জম (? – ১১৪১) এর বংশজাত।

মুঘল বাদশাহ ও রাজপুত্ররা ভারতের অন্যান্য বহু তরিকা, যেমন চিস্তি ও কাদরী মাশেখদের পরিবারেও বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতেন। বিশেষত, পারস্য-জাত শাত্তারী তরিকার বিরাট প্রভাব ছিল কিছু কিছু মুঘল বাদশাহের উপর। মুঘল পরিবারের বেশ কিছু সদস্য তাঁদের স্ব-স্ব আধ্যাত্মিক গুরুদের প্রতি শ্রদ্ধাবাচক জীবনীও রচনা করেন। উদাহরণস্বরূপ, দারা শিকো তাঁর গুরু মিয়া মির (? – ১৬৩৫)ও অন্যান্য কাদরী শেখদের তাজকিরা (জীবনী) লিখেছিলেন। তাঁর ভগিনী জাহানারা দিল্লির চিস্তী শেখদের নিয়ে লেখালেখি করেন।

তসৌফীদের প্রতি রাজপরিবারের শ্রদ্ধা এতটাই গভীর ছিল যে, বহু মুঘল বাদশাহ অন্যান্য বহু বিদেশি শাসকের মতোই বিশিষ্ট শেখদের পাশে সমাধিস্থ হতে চাইতেন। ঔরঙ্গজেবকে কবর দেওয়া হয় চিস্তী শেখ জইনুদ্দিন শিরাজি (? – ১৩৬৯) র পাশে। দিল্লিতে মহম্মদ শাহর কবরটিও রয়েছে আরেক চিস্তী শেখ নিজামুদ্দিন আউলিয়া (? – ১৩২৫) র পাশেই।

অন্যান্য বহু মুঘল তথা ইসলামি শাসকের মতোই ঔরঙ্গজেবও তাঁর জীবনের ভিন্ন ভিন্ন পর্বে বিভিন্ন তসউফী তরিকা, যথা চিস্তী, শাত্তারী ও নক্সবন্দীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। ভ্রাতা দারা শিকোর সঙ্গে উত্তরাধিকারের যুদ্ধে তিনি নক্সবন্দীদের আশীর্বাদ চেয়েছিলেন। নক্সবন্দীরা শুধু তাঁর পাশে থাকার আশ্বাসই দেন নি, তাঁরা বাগদাদের ঘাউস-এ-আজম আবদুল কাদির জিলানি (? – ১১৬৬) র মাজারে ঔরঙ্গজেবের বিজয়ের জন্য প্রার্থনা করার প্রতিশ্রুতিও দেন। পবিত্র মক্কা শহরের উলেমা ও মাশেখদের আশীর্বাদ নেওয়ার প্রতিশ্রুতিও তাঁরা দিয়েছিলেন।

বিভিন্ন ইসলামি সমাজে মাশেখদের আধ্যাত্মিক ও লৌকিক প্রভাবের কারণেই শাসকরা তাঁদের শাসন নিষ্কণ্টক ও দীর্ঘস্থায়ী করতে তাঁদের রাজনৈতিক সমর্থন ও আধ্যাত্মিক আশীর্বাদ চাইতেন। এতে উভয়পক্ষের কিছু লাভ ছিল। মাশেখদের অনুমোদন পেলে শাসকদের রাজনৈতিক অবস্থান দৃঢ় হত, আবার শাসক ও অভিজাতদের অর্থসাহায্যে মাশেখদের সামাজিক ও আর্থিক অবস্থার উন্নতি হত। অনেক মাশেখ হয়ে উঠেছিলেন শক্তিশালী জমিদার। তাঁদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ও বংশ প্রায়ই তাঁদের পৃষ্ঠপোষকদের চেয়েও অধিককাল স্থায়ী হত।

এমন নয় যে সমস্ত বিশিষ্ট মাশেখ শাসকদের সাথে মাখামাখি করতে উদগ্রীব ছিলেন। কিছু মাশেখ (বিশেষ করে চিস্তী তরিকার) শাসকদের সান্নিধ্য প্রত্যাখ্যান করেন, এবং জাগতিক ক্ষমতার প্রলোভনের থেকে মুখ ফিরিয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আলাউদ্দিন খিলজি বারংবার তাঁর সাক্ষাৎ প্রার্থনা করায় শেখ নিজামুদ্দিন আউলিয়া বলেছিলেন, “আমার ঘরের দুটি দরজা। একটি দিয়ে সুলতান যদি প্রবেশ করেন, তবে আমি অন্যটি দিয়ে বেরিয়ে যাব।” তবে এই মাশেখগণ কঠোর নির্লিপ্ততা পালন করলেও রাজপরিবার ও উচ্চপদস্থ আমলাদের অনেকেই ছিলেন তাঁদের শিষ্য, ফলে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা থেকে তাঁরা পুরোপুরি বঞ্চিত হতেন না।

সুলতান ও মাশেখদের সম্পর্ক যে সর্বদাই খুব মসৃণ ছিল, তাও নয়। কখনো কখনো তাঁদের যোগাযোগ সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ত। শেখদের কথাবার্তা বা কাজকর্মে যখন শান্তি-শৃঙ্খলায় ব্যাঘাত ঘটার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, কিংবা শাসক মনে করেছেন যে তাঁরা সিংহাসনে বসতে চাইছেন, তখন তাঁরা নির্বাসিত, কারাবন্দি এমনকী মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতও হয়েছেন। শেখ মহম্মদ সরহিন্দি (? – ১৬২৪) র উদাহরণটি বিখ্যাত। জাহাঙ্গির তাঁকে কিছুকালের জন্য কারাগারে নিক্ষেপ করেছিলেন, কারণ নিজের আধ্যাত্মিক স্তর সম্পর্কে তাঁর বড়ো বড়ো দাবিদাওয়া স্বাভাবিক সামাজিক শান্তি বিঘ্নিত করেছিল। বেশ কয়েক শতক পরে, ক্ষমতা দখলের জন্য চক্রান্ত করার সন্দেহে সিদি মৌলাকে মৃত্যুদণ্ড দেন জালালুদ্দিন খিলজি।

ইসলামি অতীন্দ্রিয়বাদী তরিকাগুলি কেবল শাসক ও কূটনীতিবিদদের উপর প্রভাব বিস্তার করেই ক্ষান্ত হয় নি। কয়েকটি তরিকা সরাসরি সামরিক অভিযান চালিয়েছিল বলেও জানা যায়। ‘সুফী’ মানেই ‘শান্তি’ – এরকম একটা ধারণা আজকাল বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। বাস্তবে কিন্তু কয়েকটি তরিকা বড়োসড়ো সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করার ক্ষমতা রাখত।

অধুনা ইরানি আজারবাইজানের আর্দাবিল অঞ্চলের সাফাভিয়া তরিকার নাম এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। প্রায় দুই শতাব্দী ধরে প্রাথমিকভাবে সুন্নী এই তরিকাটি একটি শক্তিশালী সৈন্যবাহিনীতে পরিণত হয়। শেষে প্রথম সাফাভি শাসক প্রথম শাহ ইসমাইল তাঁর কিজিলবাস শিষ্যদের নিয়ে গঠিত বাহিনীর সহায়তায় ষোড়শ শতকের ইরানে একটি দীর্ঘস্থায়ী শিয়া সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।

ব্রিটিশ আমলে সিন্ধুদেশের পীর পাগারার অনুগত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হুর বাহিনী এমনই আরেকটি উদাহরণ। ইসলামি ইতিহাসে এমন আরও মাশেখদের খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়, যাঁরা সুলতানদের যুদ্ধ করতে উৎসাহ দিয়েছেন, যুদ্ধাভিযানে সঙ্গ দিয়েছেন এবং পছন্দসই শাসকের পক্ষে অনুগামীদের লড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কেউ কেউ নিজেই সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন বলেও মনে করা হয়।

তাই যুদ্ধ বা জিহাদের বিষয়ে উলেমা ও মাশেখদের অবস্থানে বড়ো কোনো তফাৎ আছে মনে করলে বড়ো ভুল হবে। অন্যান্য অনেক বিষয়ের মতোই এই বিষয়েও ‘সুফীবাদ’ আর প্রথাগত ইসলামে তেমন কোনো বিরোধ নেই।

 

আরেকটা বহুল প্রচলিত ভুল ধারণা হল – ‘সুফীবাদ’ দক্ষিণ এশিয়ায় বিকশিত ইসলামের এক স্বতন্ত্র, দেশীয় ধারা, তথা এটি ইসলামের একটি ‘কোমল’ স্থানীয় রূপ, যা পৃথিবীর অন্যত্র প্রচলিত ‘কড়া’ ইসলামের চেয়ে পৃথক

পীরি-মুরিদি (গুরু-শিষ্য) সম্পর্ক এবং দরগা গমনের সঙ্গে সম্পর্কিত আচার-অনুষ্ঠানের উপর স্থানীয় প্রভাব সত্যিই লক্ষ্য করা যায়, এবং তার ফলে উপমহাদেশের তসৌফী আচার অন্যান্য দেশ বা অঞ্চলের তসৌফী আচারের চেয়ে অনেকটাই আলাদা।

তাই বলে দক্ষিণ এশিয়ার ইসলামি অতীন্দ্রিয়বাদের মূল ধারা ও বৈশিষ্ট্যগুলি মধ্য প্রাচ্য ও পূর্ব এশিয়ার তসউফী ধারা ও বৈশিষ্ট্যগুলির থেকে আলাদা নয়। ব্রিটিশ গবেষক নাইল গ্রিন বলছেন,

“দরগা-কেন্দ্রিক ধর্মানুষ্ঠানকে দক্ষিণ এশীয় ইসলামের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রূপে চিহ্নিত করা হলেও, এই প্রতিষ্ঠান এবং আনুষঙ্গিক প্রথা এক বৃহত্তর ইসলামি সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার অংশ, যা বহুকাল পূর্বে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রবেশ করেছে। বৃহত্তর মুসলিম দুনিয়া তথা মূলত আরব, উর্বর চন্দ্রকলা, পারস্য ও মধ্য এশিয়া থেকে দীর্ঘকাল ধরে দক্ষিণ এশিয়ায় যে স্বতন্ত্র অভিবাসনগুলি ঘটেছে, সেগুলি না বুঝলে দক্ষিণ এশিয়ায় সুফীবাদের ইতিহাস বোঝা অসম্ভব।”

দক্ষিণ এশিয়ার মুখ্য তসৌফী তরিকাগুলির সকলেরই জন্ম বহির্দেশে। এমনকী যে চিস্তী তরিকাকে পৃথিবীর অন্যান্য যে কোনো অঞ্চলের চেয়ে দক্ষিণ এশিয়ার বেশি কাছাকাছি বলে মনে করা হয়, তারও উৎপত্তি অধুনা আফগানিস্তানের হেরাটের নিকট চিস্ত নামক স্থানে। বিভিন্ন তরিকার সঙ্গে যুক্ত পীর-মুরিদরা কিন্তু এই আন্তরাঞ্চলিক সম্বন্ধগুলি স্বীকারও করেছেন, এবং উদযাপনও করেছেন। দাতা গঞ্জ বক্স নামে পরিচিত ও সম্মানিত শেখ আলি আল-হুজওয়েরি (? – ~১০৭২-৭৭) আফগানিস্তানের গজনা থেকে লাহোরে এসে বসবাস আরম্ভ করেন। তার মানে এই নয় যে উপমহাদেশ থেকে বহু দূরে বাসরত উচ্চস্থানীয় শেখদের মর্যাদা কিছু কম ছিল। বাগদাদের ঘাউস-এ-আজমের ধর্মাচার দক্ষিণ এশিয়ায় আজও যথেষ্ট জনপ্রিয়।

 

আরেকটা প্রচলিত ধারণা হলমোটের উপর সকল মাশেখই সাধারণভাবেশান্তিপ্রিয়এবং সশস্ত্র জেহাদ বা যুদ্ধবিগ্রহের বিরোধী।

কেউ যদি উপমহাদেশের বাইরের মুসলিম ইতিহাস একটুও পড়ে থাকেন, তাঁর পক্ষে এই ধারণাটি সমর্থন করা কঠিন হবে। অথচ ‘সুফী ইসলাম’ সিন্ধু, পাঞ্জাব তথা বৃহত্তর অর্থে ভারতীয় উপমহাদেশের নিজস্ব, এ কথা দক্ষিণ এশিয়ার সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে পণ্ডিতগণ পর্যন্ত বিশ্বাস করেন। প্রকৃতপক্ষে, বৃহত্তর ইসলামি দুনিয়ার সঙ্গে আমাদের অঞ্চলের ইসলামি অতীন্দ্রিয়বাদের ধারাগুলির আন্তর্সম্পর্ক না জেনে এই বিষয়টিকে বুঝতে যাওয়াই বৃথা।

অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা আসলে কী? প্রখ্যাত ফারসি গবেষক আব্দুলহোসেন জারিনকউব বলছেন, “ঈশ্বরের সঙ্গে সরাসরি ও নিজস্ব বা আত্মিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা” ই হল অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা। সুতরাং, অতীন্দ্রিয়বাদ ততটাই প্রাচীন, যতটা মানবজাতি। একে কোনো জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায়ের নিগড়ে বাঁধা সম্ভব নয়।

১৬শ-১৭শ শতকে শেখ আহমদ সরহিন্দি (মুজাদ্দিদ-এ-আল্ফ-এ-সানি) লিখে গেছেন,

“আমরা… ভারতের মুসলিমরা… তুরান (মারওয়ারা উন-নাহর) এর উলেমা ও সুফী (মাশেখ) দের নিকট এত গভীরভাবে ঋণী, যে তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। মুসলিমদের বিশ্বাস সংশোধন করে নবীর আচার-আচরণ ও তাঁর গোষ্ঠী (আহল-এ-সুন্না ওয়াল-জামা) র সঙ্গে সাযুজ্য বিধান করেছেন এই অঞ্চলের আলিমগণ। তাঁরাই হানাফী আইন মোতাবেক মুসলিমদের ধর্মাচরণ সংস্কার করেছেন। অনবদ্য এই সুফী ধারায় মহান সুফীদের (তাঁদের পবিত্র সমাধি সম্মানিত হোক) যাত্রা ভারতে নিয়ে এসেছে ধন্য এই অঞ্চল।”

অবশ্য এ ধরণের প্রভাব একমুখী ছিলো না। মধ্য এশিয়ার ও আনাতোলিয়া অঞ্চলে মুজাদ্দিদী তরিকা (নক্সবন্দী তরিকা থেকে বিচ্ছিন্ন শেখ আহমদ সরহিন্দি কর্তৃক প্রবর্তিত) র দারুণ প্রভাব ছিল। ঔপনিবেশিকতার আবির্ভাবের পূর্বে জ্ঞান-বুদ্ধির চর্চা ও বাণিজ্যে এই অঞ্চলগুলি কতদূর সংযুক্ত ছিল, এটি তার এক বড়ো প্রমাণ।

এই প্রবন্ধে ইসলামি অতীন্দ্রিয়বাদ নিয়ে চারটি বহুল প্রচলিত বিশ্বাস খণ্ডন করার চেষ্টা করলাম। প্রথম বিশ্বাসটি হল – তসউফী খানকা ও বিদ্যালয় বা মাদ্রাসার কার্যকলাপে বিরাট অন্তর রয়েছে (এবং ‘সুফী’ ইসলাম ও প্রথাগত/মূলধারার সুন্নী ইসলামে অনেক তফাৎ রয়েছে)। দ্বিতীয় বিশ্বাস – মাশেখগণ ‘নিষ্ক্রিয়’, অরাজনৈতিক এবং সমসাময়িক রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন। তৃতীয় বিশ্বাস – মোটের উপর সকল মাশেখ ‘শান্তিপ্রিয়’ এবং সশস্ত্র জেহাদ বা যুদ্ধের বিরুদ্ধে। চতুর্থ বিশ্বাসটি হল – ইসলামি অতীন্দ্রিয়বাদ দক্ষিণ এশিয়ার নিজস্ব, এবং বাকি ইসলামি দুনিয়ার চেয়ে দক্ষিণ এশিয়ার পরিবেশ-প্রকৃতির সঙ্গে অধিক খাপ খায়।

আজকের পাকিস্তানের ন্যায় কোনো মুসলিম সমাজে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের জন্য ইসলামি অতীন্দ্রিয়বাদের সাহায্য নেওয়ার সুবিধা-অসুবিধা কী কী রয়েছে, এই সংক্রান্ত যে কোনো অর্থবহ নীতিবিষয়ক আলোচনায় উপরোক্ত চারটি বিষয় মাথায় রাখা জরুরি। এটা জানা দরকার যে, আমরা যখন এই অঞ্চলে তসউফী ইসলামের প্রসার ঘটানোর কথা বলছি, আমরা কিন্তু আসলে ঐতিহাসিকভাবে প্রামাণ্য সুন্নী (মূলত হানাফী) ইসলামের পক্ষই অবলম্বন করছি।

(সমাপ্ত)

 

ডন পত্রিকায় প্রকাশিত মূল প্রবন্ধ থেকে অনুবাদ করেছেন সূর্যদেব। প্রবন্ধের লেখিকা জাহরা সবরি মুঘল ইতিহাসের উপর কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষিকা। প্রবন্ধ প্রকাশের অনুমতির জন্য তাঁকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।

ফীচার: ডাবলিনের চেষ্টার বিয়াটী লাইব্রেরীর সৌজন্যে