যেমন আমরা মনে করি, ‘সুফীবাদ’ তেমন নয় – ১

0
1133

– জাহরা সবরি

আজকের দিনে প্রাসঙ্গিক ইসলামি রাজনীতির বিবিধ ক্ষেত্রে আমরা দেখি, ‘সুফী’ আদর্শের দোহাই দিয়ে গভীরতর, অন্তর্মুখী (এবং অধিক শান্তিপূর্ণ) এক আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার দিকে প্রত্যাবর্তনের ডাক দেওয়া হয় বহির্মুখী, রাজনৈতিক এবং প্রায়শ হিংসাত্মক সাম্প্রদায়িকতাকে বর্জন করে। একশো বছর আগেও পশ্চিমী বা পশ্চিম-ঘেঁষা দেশীয় মহলে ইসলামি অতীন্দ্রিয়বাদ (যাকে আমরা সুফীবাদ নামে চিনি, যদিও এই পরিচয় কিছুটা সমস্যাজনক) কে মুসলিম সমাজের জড়তা ও প্রগতিহীনতার জন্য দায়ী করা হত। তবু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে ৯/১১ র পর, রাজনৈতিক ভাবালুতার বশবর্তী হয়ে এই অতীন্দ্রিয়বাদকেই ‘ইসলামের কোমল মুখ’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ব্রিটিশ লেখক উইলিয়াম ডালরিম্পল এবং আরও কয়েকজন পর্যবেক্ষক তালিবান-জাতীয় বিপজ্জনক শক্তির মুখে ‘সুফী’ নামে অস্পষ্ট ভাবে সংজ্ঞায়িত একদল মানুষের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছেন ‘আমাদের’ পরম মিত্র।

আজকাল সাংবাদিক আলোচনা, এমনকী কূটনৈতিক বিতর্কেও ইসলামি অতীন্দ্রিয়বাদের এক কাল্পনিক আদর্শায়িত রূপের গুণকীর্তন করা হচ্ছে, তুলে ধরা হচ্ছে আনুষঙ্গিক মনোমুগ্ধকর সঙ্গীত, অনুপ্রাণক কাব্য এবং এই মহৎ অতীন্দ্রিয়বাদীদের ‘বার্তা’, যা মানুষের আমূল পরিবর্তন ঘটাতে পারে, বা তাকে মুক্তি দিতে পারে। ইসলামের অপেক্ষাকৃত গোঁড়া, রক্ষণশীল প্রতিনিধি, যথা ধর্মপ্রচারক (মোল্লা), ধর্মতত্ত্ববিদ (ফুকহা) এবং অন্যান্য আলিমদের থেকে এঁদেরকে স্পষ্টতই আলাদা চোখে দেখা হচ্ছে।

অথচ, আমরা যখন এই মহৎ অতীন্দ্রিয়বাদী (আউলিয়া/শেখ) কিংবা আধ্যাত্মিক পথিকৃৎ (পীর) দের বর্তমান প্রাতিষ্ঠানিক উত্তরসূরীদের সন্ধান করি, আমরা দেখি যে তাঁরা প্রচলিত সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। ঔপনিবেশিক আমলে সংসদীয় প্রতিষ্ঠানগুলির প্রবর্তনের পর থেকেই এঁদের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তি ভালো মতো লক্ষ্য করা গেছে নির্বাচনের ময়দানেও। পাকিস্তানে পীরগণ কখনো রাজনৈতিক দলের শক্তিশালী নেতা (পীর পাগারা), কখনো মন্ত্রী (শাহ মাহমুদ কুরেশি), এমনকী প্রধানমন্ত্রী (ইউসুফ রাজা গিলানি) রূপেও উঠে এসেছেন। অপেক্ষাকৃত গতানুগতিক ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, যেমন পীর হামিদুদ্দিন শিয়ালভি (একটি বিশেষ ধর্মীয় বিষয়কে কেন্দ্র করে শাসক দলের প্রতি সমর্থন তুলে নেওয়ার হুমকি দিয়ে কিছুদিন আগেই খবরের শিরোনামে এসেছিলেন, আরও বহু ধর্মীয় নেতা এক্ষেত্রে তাঁর পাশে ছিলেন) নির্বাচনের ওপর পরোক্ষভাবে যথেষ্ট প্রভাব খাটিয়ে থাকেন, এবং বিভিন্ন ব্যবস্থাপক সভার সদস্যপদও গ্রহণ করেছেন অতীতে।

ফলত, নীতি নির্ধারকগণ যখন ‘সুফী ইসলাম’ এর ধ্যান-ধারণা ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরার প্রস্তাব রাখছেন, তখন আদতে তাঁরা কী যে বলতে চাইছেন, তা স্পষ্ট নয়। তাঁরা কি সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে বিশেষ একরকম ধর্মীয় আদর্শ প্রচার করতে চাইছেন? নাকি তাঁরা অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত ফকির-দরবেশদের পরিচিতি দিতে চাইছেন, এবং সাজ্জাদা-নিশিন (পীর এবং শেখদের বংশধর, এবং তাঁদের দরগার রক্ষণাবেক্ষক) দের হাত আরও শক্ত করতে চাইছেন, এমনিই যেখানে এঁদের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি যথেষ্টই বেশি? নাকি নীতিকার গণ এমনই এক ইসলামি অতীন্দ্রিয়বাদকে তুলে ধরতে চান, যা কাব্যের পংক্তি আর দার্শনিক আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে, অর্থাৎ এক উচ্চ আদর্শ রূপেই কল্পিত হয়েছে, কিন্তু বহু শতাব্দী প্রাচীন মুসলিম সমাজ জীবন ও ইতিহাসের বাস্তবতায় যা স্থান পায় নি?

কূটনীতি-বৃত্তে আজকাল ইসলামি অতীন্দ্রিয়বাদের এই কল্পিত আদর্শ রূপটি যথেষ্ট প্রাধান্য লাভ করেছে, সুতরাং ঐতিহাসিক ভাবে ইসলামি সমাজের এই অতীন্দ্রিয় গোষ্ঠীগুলি শাসক শ্রেণি এবং ধর্মবিধির অভিভাবকদের সঙ্গে কী ধরণের সম্পর্ক রেখে চলতেন, তা একবার দেখে নিলে মন্দ হয় না। ফারসি সংস্কৃতি ও চিন্তাজগতের প্রভাবাধীন মধ্য এশিয়া, আনাতোলিয়া, পারস্য, মুঘল ভারত প্রভৃতি অঞ্চলে শাসক, উলেমা এবং আউলিয়াদের মধ্যে সাধারণত কেমন সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায় বা গেছে? সমাজে তসৌফ (ইসলামি অতীন্দ্রিয়বাদ) কি ঐতিহাসিক ভাবেই এক নিষ্ক্রিয় তথা অরাজনৈতিক শক্তি রূপে রয়ে গেছে, নাকি বিশিষ্ট আউলিয়ারা মোটামুটিভাবে ইসলামের অন্যান্য প্রতিনিধিদের মতোই সমাজ ও রাজনীতিতে সক্রিয় থেকেছেন?

আশা করা যায়, বিশ্বের সম্ভবত সর্বাধিক সুপ্রসিদ্ধ ও জনপ্রিয় আউলিয়া মৌলানা জালালুদ্দিন রুমি (? – ১২৭৩) র জীবনকাহিনী থেকে এ ব্যাপারে বহু কিছু জানা যাবে। অধুনা তুরস্কের কোনিয়া অঞ্চলে তিনি বসবাস করতেন। তাঁরা তসউফী কবিতাগুলির খ্যাতি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়লেও তিনি যে একই সঙ্গে ফীক (ইসলামি আইন) এও উচ্চশিক্ষিত ছিলেন, তা সুবিদিত নয়।

ঐতিহাসিক নথি বলছে, আলেপ্পো ও দামাস্কাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাদ্রাসাগুলিতে তিনি কোরাণ ও ফীক অধ্যয়ন করেছিলেন বেশ গভীরভাবে। বস্তুত, এক্ষেত্রে তিনি তাঁর পিতার পদাঙ্কই অনুসরণ করেছিলেন, যিনি আনাতোলিয়ার এক রাজদরবারের ধর্মীয় পণ্ডিত হিসেবে মাদ্রাসা ও খানকার যৌথ গুণাবলী সম্পন্ন এক প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করতেন। ইসলামি সমাজে ইসলামি আইন বিদ্যালয় এবং তসৌফী আশ্রমের মধ্যে কী ধরণের সহজ সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে, তা তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন সেকালেই। এমনকী, গত কয়েক শতাব্দী  ধরেই বিশেষভাবে উলেমাদের প্রশিক্ষণে নিয়োজিত মাদ্রাসর সঙ্গেও খানকার যোগাযোগ লক্ষ্য করা গেছে বারবার।

বিবিধ দ্বন্দ্ব বা বিতর্কে রুমির আইনী পরামর্শ যে প্রায়শই চাওয়া হত – একথা তাঁর জীবনীকাররাই লিখে গেছেন। ধর্ম শিক্ষক ও প্রচারক রূপে তিনি শুক্রবারের জমায়েতে নিয়মিত বক্তৃতা (খুৎবা) করে সুবক্তা রূপে দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সমাজের সমস্ত স্তরের প্রচুর মানুষ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিল। তাঁর অনুগামীদের মধ্যে বণিক, শিল্পীদের মতোই শাসক শ্রেণির সদস্যরাও ছিলেন। কোনিয়ায় তাঁর বক্তৃতায় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বহু মানুষ উপস্থিত হতেন। এরই পাশাপাশি এক লম্বা সময় ধরে তিনি তাঁর বিখ্যাত কবিতাগুলি রচনা করেন। সামা ও নৃত্যের নিজস্ব ঘরানার জন্যও তিনি পরিচিতি লাভ করেছিলেন, যদিও অন্যান্য আলিমগণ এগুলির সমালোচনা করেন। এরপরেও অবশ্য আলিমরা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীলই ছিলেন।

রুমির চিঠিপত্র থেকে পরিষ্কার, যে বহু সেলজুক শাসকের সঙ্গে তাঁর খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। একজনকে তো তিনি ‘পুত্র’ বলেই সম্বোধন করতেন। রাষ্ট্রনীতির বিভিন্ন প্রশ্নে এই শাসকদের তিনি নানা পরামর্শ দিতেন, এবং ধর্মীয় নিয়মকানুন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী নানা বিষয়ে (যেমন বিধর্মী রাজশক্তির সঙ্গে সম্পর্ক) নানা সুপারিশ করতেন। নিজের শিষ্য ও আত্মীয়দের ব্যাপারে উচ্চপদস্থ প্রভাবশালী ব্যক্তিদেরকেও তিনি চিঠি লিখতেন, যাতে তারা জীবিকা বা সমাজে সুবিধা পায়। ধর্মকথা কিংবা ভাব গম্ভীর কাব্যরচনায় রুমি প্রথা ভাঙলেও, অভিজাত ও আমলাদের সঙ্গে তাঁর এই চিঠি চালাচালি ছিল মোটের উপর প্রথাগত বা চিরাচরিত রীতিমাফিক।

সুতরাং মাশেখরা সর্বদা শাসকের সান্নিধ্য এড়িয়ে চলতেন – এই ধারণাটি ধাক্কা খাচ্ছে। আউলিয়া, শেখ, মাশেখরা গভীর আধ্যাত্মিক চিন্তায় এতই বিভোর যে তাঁরা তুচ্ছ রাজনীতি নিয়ে মাথাই ঘামান না – ইসলামি ইতিহাসের পাতায় এই চেনা ছকটি আমরা ভেঙে যেতে দেখি বহুবার। বস্তুত, বহু বিশিষ্ট অতীন্দ্রিয়বাদীই সমাজ ও রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

কথাটা কেবল বিশিষ্ট মাশেখদের বংশধরদের জন্যই প্রযোজ্য নয়, যাঁরা মিশর ও পাকিস্তানের মতো কতিপয় মুসলিম দেশের সমাজ ও রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেছেন। কথাটা প্রযোজ্য সেই সব মাশেখদের জন্যও, যাঁদের নামে বিভিন্ন তরিকার পত্তন হয়েছিল। এই মাশেখগণ অন্যান্য বহু অভিজাত, শাসক ও উলেমাদের মতোই জাগতিক কার্যকলাপে ভালোরকম জড়িত ছিলেন।

 

এই শেখেদের সন্তানগণ প্রায়শ রাজকন্যাদের বিবাহ করতেন, এবং এভাবেই অভিজাত শ্রেণির সঙ্গে জুড়ে যেতেন।

খানকা ও মাদ্রাসার বৃত্ত দুটিকে সাধারণত পরস্পরের থেকে অনেকটাই পৃথক বলে মনে করা হলেও, আদতে তাদের কাজকর্ম ও ভূমিকায় সমাপতন লক্ষ্য করা যেত মাঝেমধ্যেই – এ কথা রুমির জীবন বৃত্তান্ত থেকেই স্পষ্ট। ফলত, জাহিদ (আক্ষরিক ইসলামি আইন মেনে কৃচ্ছসাধক), ওয়াইজ (ধর্ম প্রচারক) ও শেখ (ধর্মজ্ঞানী বিদ্বান ব্যক্তি) দের প্রতি তসৌফী কাব্যে অপমানজনক ইঙ্গিত করা হলেও, তসৌফী এবং ইসলামের বাকি নেতা ও প্রতিনিধিদের মধ্যে মৌলিক কোনো বিরোধ আছে বলে মনে করার কারণ নেই। বরং, কী অতীতে কী বর্তমানে, উলেমা ও মাশেখগণ যৌথ সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণের জন্য পরস্পরকে সাহায্য করেছেন। ব্রিটিশ ভারতের খিলাফৎ আন্দোলন এই জাতীয় যৌথ উদ্যোগের একটি ভালো উদাহরণ।

বিভিন্ন ইসলামি সমাজের বড়ো বড়ো মাশেখরা রাজনীতিতে কীভাবে অংশ নিতেন, তারই প্রাথমিক ইঙ্গিত পাওয়া গেল রুমির কার্যকলাপে। মধ্য এশিয়ার জনজীবনে ১৫শ শতকের মধ্যেই নক্সবন্দী তরিকা এমন জাঁকিয়ে বসেছিল, যে যেকোনো শাসকের পক্ষে উক্ত তরিকার মাশেখগণ হয়ে উঠেছিলেন অপরিহার্য। নক্সবন্দী তরিকার সঙ্গে তৈমুরি ও মুঘল শাসকদের যোগাযোগ সুবিদিত। উজবেক দেশীয় শেইবানি শাসকরাও এঁদের সাথে গভীর সম্পর্ক রাখতেন, এবং নক্সবন্দী মাশেখরা মুঘল ও উজবেক শাসকদের মধ্যস্থতা করতেন।

(পরের কিস্তিতে সমাপ্য)

ডন পত্রিকায় প্রকাশিত মূল প্রবন্ধ থেকে অনুবাদ করেছেন সূর্যদেব। প্রবন্ধের লেখিকা জাহরা সবরি মুঘল ইতিহাসের উপর কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষিকা। প্রবন্ধ প্রকাশের অনুমতির জন্য তাঁকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।

ফীচার: বৃটিশ মিউজিয়ামের সৌজন্যে