‘রাম মানে রোম’: কীভাবে বাংলায় পাঠ্যপুস্তকগুলি ছাত্রছাত্রীদের মগজ ধোলাইয়ের অস্ত্র হয়ে উঠছে

0
5787

২০১১ সালে রাজ্যে মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার অল্পকাল পরেই বাংলায় বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমেরইসলামীকরণশুরু হয়ে গেছিল, কিন্তু সম্প্রতি এটি বিশেষভাবে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে।

 

সংস্কৃতে “রাম” শব্দের অর্থ যে ঘুরে বেড়ায়, এবং এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হল রোমিং (Roaming)। তাই রাম আর রোমিং সমান!

এটি, এবং হিন্দু দেবদেবীদের নিয়ে আরও অনেক অন্যান্য কুৎসিত, হাস্যকর এবং গভীরভাবে মর্যাদাহানিকর উল্লেখ ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ড অফ সেকেন্ডারি এডুকেশন দ্বারা প্রকাশিত পাঠ্যবইতে পড়ানো হচ্ছে।

২০১১ সালে রাজ্যে মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার অল্পকাল পরেই বাংলায় বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের “ইসলামীকরণ” শুরু হয়ে গেছিল, কিন্তু সম্প্রতি এটি বিশেষভাবে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে।

অতীত এবং ঐতিহ্য শিরোনামের ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাস পাঠ্যবইয়ের কিছু অংশ গত দুদিন ধরে সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে যেখানে ভগবান রামের বিষয়ে অত্যন্ত আপত্তিজনক এবং অপমানকর উল্লেখ রয়েছে, যা ক্রোধ আর যাতনা উদ্রেক করছে। বইটির চতুর্থ অধ্যায় হল ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন ইতিহাস ধারা এবং এটি বিশেষভাবে অবমাননাকর।

অধ্যায়টিতে বলা হয়েছে যে সংস্কৃতে *রাম” শব্দের অর্থ যাযাবর, অথবা একজন ব্যক্তি যে ঘুরে বেড়ায়। এবং “রাম” শব্দের সাথে “রোমিং” শব্দের বেশ মিল আছে। সংস্কৃত এবং ইংরেজির এই “মিল” পরে এই অধ্যায়ে ভিত্তি গঠন করেছে  অত্যন্ত অশুভ উদ্দেশ্য নিয়ে বামপন্থী ঐতিহাসিকদের দ্বারা রচিত জঘন্য এবং নিন্দিত “আর্য আক্রমণ তত্ত্বের”।

অধ্যায়ে বলা হচ্ছে যে বহু পূর্বে, একদল যাযাবর মধ্য এশিয়ার তৃণভূমি থেকে খাদ্য আর চারণভূমির খোঁজে উত্তরপশ্চিম দিক থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে। তারপর এই যাযাবরেরা “আদি নিবাসীদের” সাথে মিশে যায় এবং তাদের সাথে যুদ্ধও করেছিল।

মধ্য এশিয়ার এই যাযাবরেরা আদি নিবাসীদের সাথে অধিকাংশ যুদ্ধে জয়লাভ করে এবং উপমহাদেশের উত্তর ভাগে বসবাস শুরু করার পর ভারতীয় উপদ্বীপেও বাস করা আরম্ভ করে। অধ্যায়ে বলা হয়েছে,

“দক্ষিণ ভারতে এই যাযাবরদের বসবাস শুরু করার কাহিনীই হল রামায়ণ।” তাই “রাম” বলতে রামায়ণের একজন যাযাবরকে বোঝায়, পাঠ্যবই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে!

বইতে লেখা আছে,

“আদি নিবাসীদের ওপর বিজয়লাভের কাহিনীগুলি মুখের কথায় ছড়িয়ে পড়া শুরু করল এবং তার থেকে গল্প উদ্ভুত হতে লাগল। সেই গল্পগুলিতে পরাজিতদের কাহিনীর খলনায়ক হিসেবে পেশ করা হতে লাগল এবং রাক্ষস, অসুর, অসভ্য এবং ডাকাত রূপে বর্ণনা করা হতে থাকল। বিজয়ীদের লেখা এরূপই একটি গল্প হল রামায়ণ, এবং তাই রাবণকে শয়তান আর বিপজ্জনক রূপে বর্ণনা করা হয়েছে।”

অধ্যায়ে আরো বলে যাওয়া হয়েছে যে “ইন্দো-ইউরোপীয়ান ভাষাগোষ্ঠীর” অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি এবং ল্যাটিন ইত্যাদি ভাষাগুলিতে বেশ মিল রয়েছে। মধ্য এশিয়ার কৃষিজীবীরা খাদ্যের অভাবের কারণে ইউরোপ, ইরান এবং ভারতের বিভিন্ন অংশে প্রচরণ করা শুরু করেছিল।

অধ্যায়ে এই ভুয়ো দাবী করা হয়েছে যে সংস্কৃতের এবং অন্যান্য যে ভাষাগুলিতে আমরা আজ কথা বলে থাকি সেগুলির জন্ম ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর একটি শাখা ইন্দো-ইরানী ভাষা উপগোষ্ঠী থেকে হয়েছে। অধ্যায়ে ঋকবেদ এবং জেন্দ আবেস্তার (পার্সিদের পবিত্র গ্রন্থ) মধ্যে একটি যোগসূত্র স্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছে।

“এই কারণেই মিল রয়েছে, কিন্তু দুটি গ্রন্থের মধ্যে মিল আছে।”, অধ্যায়ে বলা হয়েছে। এর অভূতপূর্ব উদাহরণ পেশ করা হয়েছে: ঋক বেদে দেব হলেন ঈশ্বর এবং অত্যন্ত সন্মানীয় যেখানে জেন্ড আবেস্তায় দায়েভ বলতে শয়তানদের বোঝায়। জেন্দ আবেস্তায় উচ্চতম দেব হলেন আহুর যেখানে অসুর বলতে তাদের বোঝায় যাদের মধ্যে কিছু ঋণাত্মক গুণাবলী বর্তমান।”

অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, ”

ইন্দো-ইরানী ভাষা উপগোষ্ঠীর অন্তর্গত ভাষাগুলিতে যারা কথা বলত তাদের মধ্যে সম্ভবত কোন বিবাদের কারণে সংঘাত শুরু হয়। সেই সংঘাতের ফলে সেই ভাষা উপগোষ্ঠীর একটি ভাষায় কথা বলা একই দল উত্তর পশ্চিম দিক থেকে ভারতীর উপমহাদেশে প্রবেশ করে। এবং যে ভাষা তাদের সাথে বিবর্তিত হয়ে ওঠে সেটি পরবর্তীতে ইন্দো-আর্য ভাষাগোষ্ঠী নামে পরিচিত। ইন্দো-আর্য ভাষাগোষ্ঠীর প্রাচীনতম লেখ হল ঋক বেদ।”

অধ্যায়ে এই ভুল দাবীও করা হয়েছে যে বৈদিক গ্রন্থগুলিতে “ইন্দো-আর্য”দের প্রচরণ এবং উপমহাদেশে তাদের বসতি স্থাপনের কাহিনী পাওয়া যায়, এবং এই যাযাবরেরা এখানে যে সভ্যতার গোড়াপত্তন করেছিল তা বৈদিক সভ্যতা নামে পরিচিত।

“আর্য আক্রমণ তত্ত্ব” নামক ধারণাটি ভুয়ো এবং এখন তা পুরোপুরি নিন্দিত, ইউরোপীয়দের এবং পরে বামপন্থী ঐতিহাসিকদের দ্বারা এটি একটি হানিকর উদ্দেশ্যে ছড়ানো হয়েছিল। ঐতিহাসিক সমীর দাস বলেছেন, “প্রতারণা, অসততা, এবং ছলনার ভিত্তিতে বানানো এই তত্ত্বের মূল উদ্দেশ্য ছিল বহু শতাব্দী ধরে মুসলিম আক্রমণকারীদের দ্বারা লুটতরাজ, লুণ্ঠন, এবং অকহতব্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের মধ্যে ক্রোধের উদ্রেকের সম্ভাবনাকে প্রতিহত করা।”

“এই ভুয়ো তথ্য ছড়িয়ে ঐতিহাসিকেরা এটা বোঝাতে চেয়েছিলেন যে উত্তর এবং পূর্বে বসবাসকারী ভারতীয়রা আসলে আক্রমণকারীদের উত্তরসূরী এবং ভারতীয় উপদ্বীপের বর্তমান বসবাসকারীদের পূর্বপুরুষদের তারা দখলচ্যুত করেছিল। এখানে এটাই বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে পরবর্তীতে মুসলিম আক্রমণও একই উদাহরণ অনুসরণ করে এবং তাই রেগে যাওয়ার কিছুই নেই। এই উদ্দেশ্যে মাথায় রেখেই এই গল্প ফাঁদা হয়েছিল।” বসু বলেছেন।  অধিকাংশ জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক এই ব্যাখ্যা সমর্থন করেন।

অনেকে এই কথাও তুলে ধরেছেন যে তৃণমূলের সাথে যুক্ত থাকা পণ্ডিত এবং এই দলের বেশ কিছু নেতার দ্বারা প্রচারিত এই মিথ্যা আখ্যান যে ভগবান রাম মূলত উত্তর ভারতীয়দের আরাধ্য দেবতা এবং বাংলায় তাঁর কোন স্থান নেই, তার সাথে এই অধ্যায়ের পাঠগুলি বেশ খাপ খায়।  গত বছরের লোকসভা ভোটের পর অমর্ত্য সেনও একই সুরে কথা বলেছিলেন, যে ভোটে বাংলায় ভারতীয় জনতা পার্টি অভূতপূর্ব ফলাফল লাভ করে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সমাজবিদ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক মতামত রেখেছেন যে, “উদ্দেশ্য হল বাংলা আর বাঙালিকে একটি পৃথক সত্ত্বা হিসাবে দর্শানো যার কিছুই উত্তর  ভারতীয়দের সাথে মেলে না, যে উত্তর ভারতীয়দের পূর্বপুরুষেরা বহিরাগত আক্রমণকারী। এই ভুয়ো এবং ধূর্ত তত্ত্বের একটি লুক্কায়িত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে: বিজেপিকে বহিরাগতদের পার্টি হিসাবে বর্ণনা করা।”

ইতিহাসের পাঠ্যবইটি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক শিরীন মাসুদ দ্বারা সম্পাদিত, যিনি বইটির “বিজ্ঞানসম্মত অনুমান”ও (পরিকল্পনা) তৈরি করেছেন। কাউন্সিলের যে বিশেষজ্ঞ কমিটি দ্বারা এই বইটি প্রস্তাবিত ও গৃহীত হয় তার সভাপতি হলেন জনৈক অভীক মজুমদার (যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক) এবং কলকাতার ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ রবীন্দ্রনাথ দে এর একজন সদস্য।

২০১১ সালের জুলাইতে ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম, পাঠ্যসূচি এবং পাঠ্যপুস্তক যাচাই করার জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির গঠিত একটি বিশেষজ্ঞ কমিটিতেও মাসুদ, মজুমদার এবং দে ছিলেন। এই বিষয়ে গত বছর গঠিত হওয়া একটি বিশেষজ্ঞ কমিটিতেও তাঁরা আছেন।

বর্তমান রাজ্য সরকারের শাসনকালীন প্রকাশিত হওয়া পাঠ্যবই অতীতেও জনরোষের কারণ হয়েছে যখন রামধনুর মত শব্দ পাল্টে রংধনু করে দেওয়া হয়, যা অনেকের মত মুসলিম তোষণের জন্যই করা।

অভিভাবক এবং কিছু পণ্ডিতদের কাছ থেকে প্রতিবাদ আসা সত্ত্বেও রাজ্য সরকার এই ভুলভাল ইতিহাস সম্বলিত পাঠ্যবইগুলি পড়িয়ে যাচ্ছে, এবং হিন্দুধর্মকে ঠাট্টা করা জারী আছে।

 

বর্ষীয়ান সাংবাদিক জয়দীপ মজুমদারের লেখা মূল লেখাটি স্বরাজ্য পত্রিকায় প্রকাশিত। অনুবাদ করেছেন শুভম ক্ষত্রী।