লাহোর প্রস্তাব মেনেই তৈরী হয় বাংলাদেশ: বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলাদেশ গঠনের কোন‌ও সম্পর্ক নেই

0
1465

বাংলাদেশ গঠনের পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গে বেশ উচ্ছ্বাস চলেছে। এপার বাংলা ওপার বাংলার আত্মিক যোগাযোগ থেকে বাংলা ভাষার অটুট বন্ধন প্রায় স্বীকৃত উপপাদ্য। বাংলা ভাষা আন্দোলনই নাকি বাংলাদেশ স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি – এও প্রায় সর্বস্বীকৃত। এই অতিকল্পিত ধারণা অসাম্প্রদায়িকতার মহান পাত্রে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের কাছে পরিবেশন করা হয়। যখন পশ্চিমবঙ্গকে পশ্চিম বাংলাদেশ বানানোর কাজ অনেকদূর এগিয়ে গেছে তখন বাংলাদেশ গঠনের পঞ্চাশ বর্ষপূর্তিতে এই মিথ্যার উন্মোচন অত্যন্ত জরুরী।

পাকিস্তান কথাটি উচ্চারিত হলেই আমাদের কাছে একটি কট্টরপন্থী ইসলামী দেশের কথাই মনে হয়। ফলে যখন পূর্ব পাকিস্তান হয়ে যায় বাংলাদেশ, আমাদের মনে হয় তাহলে আমাদের ওপার বাংলা আর পাকিস্তান রইল না। ওপার বাংলা শাপমুক্ত হল ফলে উদ্বাস্তু সমস্যায় জর্জরিত পশ্চিমবঙ্গে উচ্ছ্বাসের যথেষ্ট কারণ আছে বৈকি। আর এই উচ্ছ্বাসের জলতরঙ্গ বাজাতে সেকুলার বাঙ্গালী হিন্দু ঐতিহাসিক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবি, রাজনৈতিক দল মায় কিছু হিন্দুত্ববাদীরাও দারুণ সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু একটু পুরানো পাতা ওল্টালে দেখা যাবে, যে দেশভাগ হয়ে পাকিস্তান হবার পরও ওপার বাংলা ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলা নামেই ছিল, তারপর সে নাম পাল্টে হয় পূর্ব পাকিস্তান। ফলে পাকিস্তান হবার জন্য পাকিস্তান নামের প্রয়োজন নেই। চৌধুরী রহমত আলির সৃষ্টি পাকিস্তান (যার অর্থ পবিত্র ভূমি) শব্দটি তৈরী হয়েছিল পাঞ্জাব, আফগানিস্তান, কাশ্মীর, সিন্ধু ও বালোচিস্তান রাজ্যগুলির নাম থেকে। এতে বাংলার কোন উল্লেখ‌ই ছিল না। পাকিস্তান তৈরীর ভিত্তি ১৯৪০-এর লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তান কথাটার কোন উল্লেখ ছিল না। তাছাড়া লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী ভারতের মুসলিম প্রধান অঞ্চলগুলিতে কয়েকটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। লেখক ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ তাঁর বইতে অত্যন্ত স্পষ্ট করে বলেছেন – “এক পাকিস্তানের জায়গায় দুই পাকিস্তান হইয়াছে। ভারত সরকার লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নে আমাদের সাহায্য করিয়াছেন।…লাহোর প্রস্তাবে ‘পাকিস্তান’ শব্দটার উল্লেখ নাই, শুধু মুসলিম মেজরিটি রাষ্ট্রের উল্লেখ আছে। তার মানে রাষ্ট্রের নাম পরে জনগণের দ্বারাই নির্ধারিত হওয়ার কথা। পশ্চিমা জনগণ তাদের রাষ্ট্র-নাম রাখিয়াছে ‘পাকিস্তান’। আমরা পুরবীরা রাখিয়াছি ‘বাংলাদেশ’। এতে বিভ্রান্তির কোনো কারণ নাই।” পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ গঠিত হল ২০শে জুন ১৯৪৭-এর বঙ্গীয় আইনসভার ভোটাভুটিতে। বঙ্গীয় আইনসভার সব মুসলমান সদস্য বাংলাকে ভাগ না করে অখণ্ড বাংলাকে পাকিস্তানে যুক্ত করার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। এই সদস্যরা কি বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্য অখণ্ড বাংলা দাবী করেছিলেন? অখণ্ড মুসলিম প্রধান বাংলার আরেক দাবীদার ছিলেন কলকাতা গণহত্যার কসাই তৎকালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী শহীদ সুরাহবর্দী আর সুভাষ ভ্রাতা কংগ্রেসি শরৎচন্দ্র বসু।

পাকিস্তান সৃষ্টির সময় থেকেই পাকিস্তানে বাংলা ভাষার স্থান নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। কিন্তু তা কি বাংলা ভাষা সংস্কৃতির প্রতি কোন আনুগত্য থেকে? দেশ ভাগ হওয়ার পর পূর্ব বাংলায় যে সব বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হয় ও বাংলা ভাষার পক্ষে বক্তব্য রাখে তাদের নাম পয়গাম, দৈনিক আজাদ, ইত্তেফাক, ইনসান, ইনসাফ। আর সেই সময়েই গঠিত যে সংগঠনটি এই প্রচারে সক্রিয় ছিল তার নাম তমদ্দুন মজলিস। এই হচ্ছে বাংলা ভাষা প্রীতির ইসলামী উদাহরণ। বাংলাভাষী মুসলমান এখনো সন্তানের নাম রাখে আরবীতে। ১৯৪৮-এর ২৩শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী তুলেছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁকে সমর্থন জানিয়েছিলেন তিনজন সদস্য – প্রেমহরি বর্মণ, ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত ও শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তীব্র বিরোধিতা করেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত খান (পূর্ব বাংলা থেকে নির্বাচিত সদস্য), পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নিজামুদ্দিন। পূর্ব বাংলার কোন মুসলমান সদস্য এই দাবীকে সমর্থন করেন নি। তবু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করবার আন্দোলন জোরদার হয়েছিল তার কারণ পুরোটাই অর্থনৈতিক। আবুল মনসুর আহমদের ভাষায় “উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করিলে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ রাতারাতি ‘অশিক্ষিত’ ও সরকারী চাকুরির ‘অযোগ্য’ বনিয়া যাইবেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ফারসীর জায়গায় ইংরাজীকে রাষ্ট্রভাষা করিয়া বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ মুসলিম শিক্ষিত সমাজকে রাতারাতি ‘অশিক্ষিত’ ও সরকারী কাজের অযোগ্য করিয়াছিল।” এই ছিল ভাষা আন্দোলনের মূল কথা। ১৯৪৭-এর ডিসেম্বরে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে প্রখ্যাত ভাষাবিদ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লেখেন, “মাতৃভাষার পরই স্থান ধর্মভাষার। এই জন্য আমি আমার প্রাণের সমস্ত জোর দিয়া বলিব, বাঙলার ন্যায় আমরা আরবী চাই। …. সেদিন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম সার্থক হইবে যে দিন আরবী সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গৃহীত হইবে।….. কিন্তু বর্তমানে আরবী পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৈকল্পিক ভাষা ভিন্ন একমাত্র রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণের যথেষ্ট অন্তরায় আছে।” ফলে বাংলা ভাষার আরবীকরণের যুক্তি ও প্রয়োগ তখন থেকেই চলছে।

১৯৫৬ সালে বাংলা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রূপে স্বীকৃত হয়ে যায়। টাকা, ডাকটিকিট থেকে সব সরকারী বিজ্ঞপ্তিতেই বাংলা স্থান পায়। ভাষা আন্দোলন সমাপ্ত। কিন্তু এই ভাষা নিয়ে হৈচৈর মধ্যে বাংলাভাষী হিন্দুদের উপর গণহত্যা থেকে শুরু করে সবধরণের নির্যাতন পূর্ব বাংলা / পূর্ব পাকিস্তানে নিরন্তর চলেছে। ১৯৫০-এই প্রাণ বাঁচাতে পালিয়েছেন পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক তফসিলী সমাজের নেতা পাকিস্তানের আইন মন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। আরো উল্লেখ্য যে ১৯৬১ সালে ১৯শে মে আসামের শিলচরে বাংলা ভাষার সমর্থনের আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত ১১ জন মৃত্যুঞ্জয়ীর ৯ জনই ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান বাংলাভাষী মুসলমানদের অত্যাচারে চলে আসতে বাধ্য হওয়া বাংলাভাষী হিন্দু উদ্বাস্তু। এই হচ্ছে আমরি বাংলা ভাষার টান!!

এরপর বাংলাদেশ সৃষ্টির কথা। দেশভাগের পর থেকেই পূর্ব বাংলা / পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের তীব্র অভিযোগ প্রায় সব রাজনৈতিক দল বিভিন্ন মাত্রায় করেছে। ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব আসনে বিজয়ী হয়ে পাকিস্তানের সরকার গঠনের দাবীদার হয়। আওয়ামী লীগের এই নির্বাচনী জয়ের ভিত্তি ছিল ৬ দফা দাবী। এই দাবী আওয়ামী লীগ পেশ করেছিল ১৯৬৬ সালেই, ১৯৭০ সালে কোন স্বাধীনতার জন্য নয়। এর প্রথম দফার প্রথম বাক্যই ছিল, “ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করত পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশন রূপে গড়িতে হইবে।” অর্থাৎ পাকিস্তান সৃষ্টির মূল বিষয় থেকে আওয়ামী লীগ কখনই সরে আসেনি। ছয় দফা দাবীগুলি ছিল সবই পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত কেবল শেষ দাবীটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য (ভারতের আক্রমণ থেকে) সশস্ত্র বাহিনী গঠনের দাবী। এতে বাংলা ভাষা সংস্কৃতির কোন কথাই ছিল না। পাকিস্তানের সামরিক সরকার ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি আওয়ামি লীগের এই বিজয় মেনে না নিয়ে সামরিক হস্তক্ষেপ বাংলাদেশকে স্বাধীনতার দিকে ঠেলে দিল। এরকম স্বাধীনতার মুক্তিযুদ্ধ চলে দশকের পর দশক। সেসব কিছুই করতে হল না,  মাত্র নয় মাস পরে ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপে ১৪ দিনে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে গেল।

স্বাধীন বাংলাদেশ হল বটে, আপাততঃ ভারতীয় সংবিধানের অনুসারে একটি সংবিধানও চালু হল কিন্তু আসলে বাংলাদেশ পাকিস্তানে রয়েই গেল। পাকিস্তানের ঐতিহ্য অনুসারে গত পঞ্চাশ বছরে অন্ততঃ এক কোটি বাংলাভাষী হিন্দুর বাংলাদেশ থেকে বিতাড়ন হল। স্বাধীনতার কয়েক বছরের মধ্যেই সংবিধান পাল্টে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হল ইসলাম, বাংলাদেশ হল আন্তর্জাতিক ইসলামী দেশগুলির সংগঠনের সদস্য। ফলে কেমন আছেন সেখানে বাঙ্গালী হিন্দুরা? গত অক্টোবরে দুর্গা পূজায় বাংলাদেশ জুড়ে প্রতিমা, মন্দির ভাঙচুর ও হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণের পর বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল (প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের ভাই) ১৯ অক্টোবর, ২০২১ তাঁর এক পোস্টে লিখেছেন, “কয়দিন থেকে আমার নিজেকে অশুচি মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি বুঝি আকণ্ঠ ক্লেদে নিমজ্জিত হয়ে আছি। শুধু আমি নই, এদেশে আমার মতো অসংখ্য মানুষের একই অনুভূতি, মনে হচ্ছে জাতির একটি বড় অংশ বিষণ্ণতায় ডুবে আছে। কারণটি নিশ্চয়ই সবাই বুঝতে পারছে। যে দুর্গাপূজাটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় আনন্দোৎসব হওয়ার কথা, সেই দুর্গাপূজাটি এবারে সবচেয়ে বড় তাণ্ডবের কেন্দ্রস্থল। আমি যে এটিকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে নিজেকে সান্ত্বনা দেব, সেটিও করতে পারছি না। কুমিল্লা থেকে শুরু হয়ে এটি শুধু কুমিল্লাতে থেমে থাকেনি, বলতে গেলে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। যার অর্থ সারাদেশের প্রতিটি আনাচে-কানাচে ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক মানুষ রয়েছে, তারা লুকিয়ে নেই, তারা প্রকাশ্যে আছে, বুক ফুলিয়ে আছে। …যখন পূজার সময় আসে, সারাদেশে প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হয়, তখন থেকে আমি নিজের ভেতর এক ধরনের চাপা অশান্তি অনুভব করি। অবধারিতভাবে খবর পাই দেশের এখানে সেখানে সেই প্রতিমা ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। যখন পূজা শুরু হয়, তখন আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকি…।” বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের কোন তফাৎ খুঁজে পাচ্ছেন?

অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন, “শেখ সাহেবকে আমরা প্রশ্ন করি, ‘বাংলাদেশের আইডিয়াটা আপনার মাথায় কবে এল?’ – ‘শুনবেন?’, তিনি মুচকি হেসে বললেন, ‘সেই ১৯৪৭ সালে। আমি সুহরাবর্দী সাহেবের দলে। তিনি ও শরৎচন্দ্র বসু চান যুক্তবঙ্গ। আমিও চাই সব বাঙালীর এক দেশ।'” পশ্চিমবঙ্গবাসী কি কিছু শুনতে পাচ্ছেন? পশ্চিমবঙ্গকে পশ্চিম বাংলাদেশ বানাতে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি এই বাংলার রাজনৈতিক মঞ্চেও এখন অতি পরিচিত। বাংলাদেশ গঠনের পঞ্চাশ বছরে লাহোর প্রস্তাব মেনে শরৎচন্দ্র বসু ও সুরাবর্দীর উত্তরাধিকারীরা আবার সচেষ্ট যুক্তবঙ্গের গঠনে। হিন্দুত্ববাদীরাও এখন গান্ধীবাদী হয়ে ওঠায় এসব নিয়ে কম মাথা ঘামান। পশ্চিমবঙ্গ পশ্চিম বাংলাদেশ হওয়া এখন বোধহয় সময়ের অপেক্ষা।