মহারাজা কেদার রায় : এক সংগ্রামী চেতনার স্ফুলিঙ্গ

Maharaja Kedar Roy

ষোড়শ শতকের সূচনায় যখন সমগ্র ভারতবর্ষব্যাপী বিস্তার হইতে থাকে অত্যাচারী মুঘল সাম্রাজ্যের ছায়াময় অন্ধকার, সেই অমানিশার ক্রান্তিলগ্নে পূর্ব্ব ভারতে স্বতন্ত্র সনাতনী শাসনের আলোকবর্ত্তিকা প্রজ্জ্বলিত রেখেছিল বাঙ্গালার ৮ টি স্বাধীন হিন্দুরাজ্য । এই রাজ্যসমূহের মধ্যে বিক্রমপুর রাজ্যের চন্দ্রকুলগৌরব শ্রীপুরেশ্বর মহারাজ কেদারনাথ দেবরায়’র নেতৃত্বে হিন্দু জাতির ক্ষমতা ক্রমশ রূপ নেয় স্পর্ধার, মুঘল সাম্রাজ্যের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়ে বাঙ্গালায় শাসন বিস্তার করে তিনি নির্মাণ করেন অখণ্ড সনাতনী বিক্রমপুর সাম্রাজ্য ।

ষোড়শ শতকের অন্তিম লগ্নে মহারাজা কেদার রায় আরাকান অঞ্চলের মগ ও খাঁড়ি অঞ্চলের পর্ত্তুগীজদের দমন করে বিক্রমপুর রাজ্যের সীমানা শ্রীহট্ট থেকে ত্রিপুরা ও সন্দ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত করেন । বাঙ্গালা থেকে অনধিকারী মুঘলদের উৎখাত করে এবং সদর্পে বাঙ্গালার স্বাধীনতা ঘোষণাপূর্ব্বক তিনি মোগলদের মোট ৪ টি যুদ্ধে পরাস্ত করেন ও বাঙ্গালী জাতির শৌর্যের অতীত গরিমাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন ।

১৫৬১ খ্রিস্টাব্দে (বঙ্গাব্দ ৯৬৮) ঘৃতকৌশিক গোত্রীয় চন্দ্রকুলদীপকঃ ক্ষত্রিয় বঙ্গজ কায়স্থ দেবরায় রাজবংশে বিক্রমপুররাজ রাজা যাদবনাথ দেবরায়ের প্রাসাদে কুলমাতা শিলাদেবীর বরপুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেন যুবরাজ কেদারনাথ । কালীগঙ্গা নদীর তীরবর্ত্তী শ্রীপুর নগরে রাজধানী স্থাপন করিয়া মহারাজ কেদার রায় বিক্রমপুর রাজ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শিলামাতা মন্দির সংস্কার তথা পুনর্নির্মাণ করেন । তিনি ছিলেন মা ছিন্নমস্তার একনিষ্ঠ পরমভক্ত ।

● বিক্রমপুর রাজ্যের সৈন্যবাহিনী সংষ্কার :

মহারাজ কেদারনাথ রায় যখন বিক্রমপুর রাজ্যের রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠান করেন তখন বাঙ্গালার চতুর্দ্দিকে শত্রু আক্রমনের উপযোগ, এসময় পশ্চিম থেকে যখন দুর্দ্দম মোগলসৈন্য এসে এদেশের স্বাধীনতা হরণে উদ্যত তখন পূর্ব্ব হইতে দস্যু মগগণের অত্যাচারে জনজীবন ব্যতিব্যস্ত । প্রজাপালক নৃপতি কেদারনাথ এহেন উভয়প্রকার শত্রু সংযোগ দমনার্থে উদ্যোগী হন, যাহার ফলে মগ ও মোগল উভয় পক্ষের সহিত তাঁর সংঘাত অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায় । ভবিষ্যৎ যুদ্ধসমূহের পরিকল্পনা করে তিনি শৃঙ্খলাপরায়ণ প্রশিক্ষণ ও উন্নত প্রযুক্তির অস্ত্রশস্ত্র বিনিয়োগসহ বিক্রমপুর সৈন্যবাহিনীতে প্রভূত সংষ্কার করেন। ইউরোপীয় প্রযুক্তির সহায়তায় বিক্রমপুরে একাধিক উন্নতমানের অচল ও সচল কামান তথা আগ্নেয়াস্ত্র নির্মাণ শুরু হয় যা দিল্লিতে নির্ম্মিত মোগল কামানগুলির তুলনায় অধিক ঘাতক ও তুলনায় হালকা ছিল । বিক্রমপুর রাজ্যের প্রধান সেনাপতি ছিলেন রঘুনন্দন দাস ঢালী । কোষাবাহিনীর প্রধান ছিলেন রামরাজা সর্দ্দার । রাজা কেদার রায়ের নৌবাহিনী তথা গোলন্দাজ বাহিনীর অধ্যক্ষরূপে পর্ত্তুগীজ ডোমিঙ্গো কার্ভালহো কে নিযুক্ত করেন । জালিয়া নৌবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন ফ্রান্সিস সলভেরিনো।

যখন বিক্রমপুরাধিপতি কেদার রায় এইরূপে সর্ব্বত্র নিজ বাহুবল প্রকাশে কীৰ্ত্তি-সঞ্চয় করছিলেন, সে সময়ে আকব্বরশাহের মৃত্যুর পর তৎপুত্র (১৬০৫ খ্রীঃ অঃ) সেলিম ‘জাহাগীর’ নামধারণ করে দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। জাহাগীর শুরু থেকেই বাঙ্গালায় রাজা কেদার রায়ের পরাক্রমের কাহিনী জ্ঞাত ছিলেন, সিংহাসনারোহণের পর ক্রমশঃই তাহার উদ্ধত ব্যবহারের কথা-শ্রবণে তিনি সেই বিদ্রোহী নৃপতি দমনার্থ অম্বরাধিপতি হিন্দুকুলাঙ্গার রাজপুত মানসিংকে বাঙ্গালার স্বাধীনতা নির্ম্মূলার্থ প্রেরণ করেন ।

উপকূলবর্ত্তী,—বিশেষ নদ-নদী-সঙ্কুল স্থানের অধিপতিগণের নৌ-বলের একান্ত প্রয়োজন – সে নিমিত্তই নৌ-সমর-কুশল পর্তুগীজগণের প্রতি বিক্রমপুরাধিপতি কেদার রায়ের বিশেষ লক্ষ্য ছিল, – মহারাজা কেদার রায় স্বীয় সৈন্যবল বৃদ্ধির নিমিত্ত এবং সৈন্যগণকে পাশ্চাত্য শিক্ষানুযায়ী সুশিক্ষিত করে মোগল সৈন্যগণের গতিরোধ করবার উদ্দেশেই কার্ভালো নামক একজন পর্তুগীজকে স্বীয় নৌসৈন্য বিভাগের সেনাপতির পদে বরণ করেছিলেন । কেদার রায় নিজেও বিশেষরূপেই নৌযুদ্ধে পারদর্শী ছিলেন, কার্ভালোর সহায়তায় স্বীয় নৌ-শক্তি অত্যধিক পরিমাণে বৃদ্ধি করতে সমর্থ হয়েছিলেন। কার্ভালোর প্রকৃত নাম ডোমিঙ্গো কার্ভালো বা কার্ভালিয়ান ।

● সন্দ্বীপের প্রথম যুদ্ধ [বাঙ্গালী-মুঘল সংঘর্ষ] –

বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বিখ্যাত লবন ব্যবসায়কেন্দ্র সন্দ্বীপ রাজা কেদার রায়ের রাজ্যভুক্ত ছিল, মোগলেরা পূর্ব্ববঙ্গ আক্রমনের সময় সনদ্বীপ মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত করে তা সরকার ফতেয়াবাদের অন্তর্ভুক্ত করে ফেলে, মোগলদের এই অধিকার কেদার রায় অগ্রাহ্য করে নিজকে পূর্ব্ববৎ সনদ্বীপের “স্বাধীন নরপতি” বলে ঘোষণা করতে থাকেন তথা সন্দ্বীপ পুনরুদ্ধারের জন্য কৃতসংকল্প হ’ন এবং সেনাপতি রঘুনন্দন ঢালী ও কার্ভালোর সাহায্যে মোগল সৈন্যদিগকে আক্রমণ করেন। ভীষণ যুদ্ধের সূচনা হয়— মোগল সৈন্যাধ্যক্ষ ও সৈনিকগণ সহজে তাদের অধিকৃত ভূমিখণ্ড ছাড়িয়া দিতে স্বীকৃত ছিল না, রাজা কেদার রায়ও দৃঢ়তার সহিত যুদ্ধ করিতে প্রবৃত্ত হলেন এবং অবশেষে মোগলদের সম্পূর্ণরূপে পরাজিত ও বিধ্বস্ত করে সনদ্বীপ তাদের অধীনতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজের অধিকারে আনতে সমর্থ হলেন। এই যুদ্ধে কার্ভালহো অসীম বীরত্ব প্রদর্শন করায় মহারাজ কেদার রায় তাঁকে পুরস্কার স্বরূপ সনদ্বীপের প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পণ করে স্বীয় রাজধানী শ্রীপুরে প্রত্যাবৰ্ত্তন করেন ।

● সন্দ্বীপের দ্বিতীয় যুদ্ধ, ১০ নভেম্বর ১৬০২ খ্রি: [বাঙ্গালী-মগ সঙ্ঘর্ষ]

মহারাজ কেদার রায়ের বীর্যাবত্তার বিশেষ তাঁর ক্ষমতায় সনদ্বীপে বাঙ্গালার হিন্দু শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ায় তদানীন্তন আরাকান রাজ মেংরাজাগি বা সেলিমশাহ (Xilimxa) অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন । আরাকান সুলতান বরাবরই নিজেকে সনদ্বীপের দখলদার মনে করতো, এক্ষণে মহারাজা কেদারনাথ রায়ের অধীনে কার্ভালো ও মাটুসের শাসন ক্ষমতা সনদ্বীপের উপর বিস্তৃতি লাভ করায়, পাছে অদূর ভবিষ্যতে বঙ্গীয় শক্তি বঙ্গোপ-সাগরের কূলে মধ্যাহ্ন রবির দ্বীপ্ত তেজে প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠে সে আশঙ্কায় তিনি কেদার রায় ও বাঙ্গালী-পর্ত্তুগীজ জোটসৈন্যগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সনদ্বীপ অধিকার করবার জন্য কৃতসংকল্প হলেন।

আরাকান সুলতানের এ যুদ্ধ যাত্রার আয়োজন বার্ত্তা কার্ভালো, মাটুস প্রভৃতি পর্তুগীজগণেরও অজ্ঞাত ছিলনা, তারাও আরাকান রাজের সম্মুখীন হওয়ার জন্য যুদ্ধ আয়োজনে প্রবৃত্ত হলেন। রণ-ভেরীর ভৈরবনাদ বঙ্গোপসাগরের কূলে কূলে, বিক্রমপুরের শ্যাম তটভূমে ভীষণরবে প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল। কার্ভালো বিপদ বুঝে রাজা কেদার রায়ের সাহায্য প্রার্থনা করে দূত প্রেরণ করলেন। রাজা কেদার রায় তার প্রার্থনানুযায়ী শ্রীপুর থেকে বাঙ্গালী সৈন্যপূর্ণ একশতখানি বাঙ্গাল-কোষা নৌকা কার্ভালোর সাহায্যের জন্য প্রেরণ করেন। ওদিকে আরাকান রাজও দেড়শত ক্ষুদ্র ও বৃহৎ রণতরী সংগ্রহ করে যুদ্ধার্থে প্রস্তুত হলেন। তার এই দেড়শত রণতরীর মধ্যে কতকগুলি ক্ষুদ্র এবং কতকগুলি বৃহৎ ছিল— যে গুলি বৃহৎ ছিল সে গুলি “কার্ত্তুস” নামে অভিহিত হত, এই কার্ত্তুস গুলিই কামান বন্দুক ইত্যাদি আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা সুসজ্জিত ছিল। পর্তুগীজগণ কেদার রায়ের প্রেরিত একশত রণতরীর সহায়তায় বলীয়ান হয়ে আরাকান রাজের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। ঐ একশত রণতরীতে কামান বন্দুকসহ বিক্রমপুরবাসী বঙ্গবীরগণ কেদার রায়ের আদেশে আরাকান রাজের ধৃষ্টতার সমুচিত প্রতিফল দেওয়ার জন্য বীরদর্পে সেনাপতি কার্ভালোর সহায়তার নিমিত্ত সনদ্বীপে এসে উপস্থিত হয়।

১৬০২ খ্রীঃ অঃ ১০ই নভেম্বর পর্ত্তুগীজগণ ও রাজা কেদার রায়ের জোটসৈনিক- গণের সহিত মগগণের প্রথম রণক্রীড়া আরম্ভ হয়। সে দিন যুদ্ধে কার্ভালো যে অপূর্ব্ব বীরত্ব প্রকাশ করেছিলেন । ৮ই নভেম্বর তারিখে ইম্যানুয়েল মাটুসের সহিত নদীতীরবর্ত্তী ডায়েঙ্গি বন্দরে মগদের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষ উপস্থিত হয়, সেটাই যুদ্ধের প্রথম সূত্রপাত; এই সংঘর্ষে ইমানুয়েল ডি-মাটুস বহুসংখ্যক মগকে সেই বন্দর থেকে বিতাড়িত করিতে সমর্থ হয়েছিলেন।

প্রকৃত যুদ্ধ ১০ই নভেম্বর সংঘটিত হয়। রাত্রির গভীর স্তরতার মধ্যে সমুদ্রের প্রবল তরঙ্গ গর্জ্জনসহ মগসৈন্যের সাথে বাঙ্গালী সৈন্যদের রণলীলার কামান-ভেরী গর্জে উঠল, উভয় পক্ষে ভীষণ যুদ্ধ শুরু হয়, সনদ্বীপের প্রশাসনকৰ্ত্তা কার্ভালো, মাটুসের সাথে মিলিত হয়ে মাত্র ৫০ খানি জাহাজের দ্বারা আরাকান রাজের দেড়শত রণতরীকে প্রতিহত করেন। ঐ ৫০ খানা জাহাজের মধ্যে ১০ খানা ফাভেজ, ৪ খানা কার্ত্তুস, ৩ খানা বার্কেস ব্যতীত অন্য সবগুলিই জালিয়া ছিল । অত্যন্ত আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে এইরূপ অতি অল্প সংখ্যক রণতরীর সাহায্যেই বঙ্গীয় বীরগণ ও পর্তুগীজ বীরগণ সমুদয় বিপদ অতিক্রম করে ভোরের সূর্য ওঠার আগেই মগদের সমস্ত জাহাজ অধিকার করতে সমর্থ হয়,—ঐ দেড়শত মগ রণতরীর মধ্যে শুধু একখানা বার্কেস পলায়ন করতে সমর্থ হয় ।

বিক্রমপুরের সেনা এই যুদ্ধে বিজয় লাভ করে বহু তীর, বন্দুক, ১২ টা কামান এবং অন্যান্য বহু যুদ্ধোপকরণ প্রাপ্ত হয়েছিল। এই যুদ্ধে আরাকান রাজ সম্পূর্ণরূপে পরাজিত ও বহুল পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্থ হ’ন।

● সন্দ্বীপের তৃতীয় যুদ্ধ [বাঙ্গালী-মগ সঙ্ঘর্ষ] :

সন্দ্বীপের যুদ্ধে পরাজয় বার্ত্তা চট্টগ্রাম পৌঁছলে আরাকান রাজ ১০০০ যুদ্ধজাহাজ সহ সনদ্বীপ অধিকারে কৃত-সংকল্প হন । বিক্রমপুর রাজশক্তি দমনার্থে ইনি নানাপ্রকার উপায়- অবলম্বনে প্রবৃত্ত হন, এবং তৎসঙ্গে বাঙ্গালার অন্যান্য প্রদেশেও দৃষ্টিপাত করতে উদ্যত হন ।

আরাকান রাজ যুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়ার জন্য ১০০০ টি যুদ্ধজাহাজ, ঝাণ্ডার, বৃহৎ কার্ত্তুস ও বহু কোষনৌকা সংগ্রহ করেন। মহারাজা কেদার রায় কৃত পরাজয় অপমান পরিশোধার্থ মগ নৌ-সেনাপতি গণ এই বিপুল-বাহিনী সহ সনদ্বীপ অভিমুখে অগ্রসর হন।

এই আক্রমনের সময়েই পশ্চিম থেকে হঠাৎ মোগল সেনার আক্রমণ হয় বিক্রমপুরের বিরুদ্ধে, যার ফলে মহারাজ কেদার রায় মোগলদের সাথে যুদ্ধে সম্পূর্ন ব্যস্ত । সন্দ্বীপে সেনাপতি কার্ভালো একাকী, কাজেই মহাবীর কার্ভালো প্রকৃত বীরের মতো শুধু মাত্র খানি জেলিয়া, ৪ খানি কার্ত্তুস ও একখানা রণপোত সহ মগ সুলতানের বিপুল বাহিনীর প্রতিরোধে অগ্রসর হন । একা কার্ভালো সামান্য বাঙ্গালী ও পর্তুগীজ সৈনসহ রণে প্রবৃত্ত হলেন।

মহারাজা কেদার রায়ের প্রেরিত ১০০০ বাঙ্গালী কৈবর্ত্ত্য নৌ-সৈন্য ও কার্ভালোর সংগৃহীত মুষ্টিমেয় পর্তুগীজ সৈন্য অতুল বীরত্বতেজেরপূর্ণ রণ-নৈপুন্যের সাথে আরাকান সুলতানের সৈন্যগণের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয় । বেলা এগারোটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিশাল সমুদ্র প্রকম্পিত করে যুদ্ধ শুরু হয় । মগসৈন্যদলকে অতর্কিত ভাবে আক্রমণ করে, তাদের যুদ্ধ জাহাজ ছিন্ন ভিন্ন করে অপূর্ব্ব রণ-কৌশলের সাথে কার্ভালো আরাকান রাজকে পরাজিত করে যুদ্ধে বিজয় লাভ করেন।

এই যুদ্ধে প্রায় ২০০০ মগসৈন্য জীবন বিসর্জ্জন করে ও তাহাদের ১৩০ খানা রণপোত ভষ্মীভূত হয়ে যায়। সনদ্বীপের এই যুদ্ধে বিজয় লাভ করায় কার্ভালোর বীরত্ব-খ্যাতি বঙ্গের সর্বত্র ব্যাপ্তি লাভ করে। পরাজিত মগগণ চাটিগা অভিমুখে প্রস্থান করে জীবন রক্ষা করে। আরাকান সুলতান এই পরাজয় ব্যাপারে তাঁর সেনাপতিগণের প্রতি বিশেষরূপে অসন্তুষ্ট হন, কিংবদন্তীতে প্রকাশ যে তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর পরাজিত মগ সেনাপতিদের তাদের কাপুরুষতার জন্য স্ত্রীলোকের বেশ পরিধান করিয়ে অপমানিত করেন ।

● শ্রীপুরের যুদ্ধ [বাঙ্গালী-মুঘল সঙ্ঘর্ষ] :

সনদ্বীপের ভীষণ যুদ্ধ পরিসমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই মোগলের সাথে বাঙ্গালীর রণ-কোলাহল দিগন্ত ব্যাপৃত হয়ে উঠল। মানসিং সেমূহুর্ত্তে মহারাজ প্রতাপাদিত্যের সাথে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকার দরুণ সিপাহী মন্দারাই কে বিক্রমপুরে যুদ্ধে প্রেরণ করেন । মন্দারাই সুবেদারের আদেশ ক্রমে ১০০টি রণতরী ও ৩০,০০০ মোগল সৈন্যসহ শ্রীপুরাভিমুখে অগ্রসর হন । মানসিংহের প্রেরিত এই রণতরী সমূহ কেদার রায়ের গর্ব্ব এবং বিক্রমপুরের স্বাধীনতা হরণ করবার উদ্দেশে অর্ধচন্দ্র শোভিত পতাকা উড়াইয়া “আল্লাহো আকবর” রবে পদ্মার উভয় পাড় প্রতিধ্বনিত করে, বীরদর্পে মেঘনার উপকূলে উপনীত হয়।

মহারাজ কেদার রায় পূর্ব্ব হইতেই গুপ্তচর প্রমুখাৎ সমুদায় সংবাদ অবগত হয়ে যুদ্ধার্থ প্রস্তুত ছিলেন। এক্ষণে মন্দারাইয়ের আগমন বার্ত্তায় তার গতি-রোধার্থে সসৈন্যে সম্মুখ সমরে অগ্রসর হন। সেনাপতি রঘুনন্দন ঢালী এই যুদ্ধে মহারাজ কেদার রায়ের সঙ্গী ছিলেন এবং তার উপরেই নৌ-সৈন্য পরিচালনার ভার অর্পিত ছিল।

সুশিক্ষিত সামরিক বাঙ্গালী ও ফিরিঙ্গী সৈন্যগণের সাথে মন্দারাইয়ের মুঘল সেনার যুদ্ধ আরম্ভ হয় । বাঙ্গালী ও ফিরিঙ্গীর সমবেত শক্তির নিকট মোগল সৈন্যগণ কিছুতেই যুঝিতে পারে নি, কামান- ভেরীর প্রলয় গর্জ্জনে, বঙ্গবীরগণের অলৌকিক বীরত্ব প্রভাবে ও সর্বোপরি কুলমাতা শিলাদেবীর আশীর্ব্বাদে মোগল সেনাপতি মন্দারাই পরাজিত ও নিহত হন, মোগল সৈন্যগণ অধিকাংশই নিহত হয়, অন্য সংখ্যক যারা জীবিত ছিল তারা কোনরূপে পলায়ন করে নিজ প্রাণ রক্ষা করে ।

● কালীগঙ্গার যুদ্ধ [বাঙ্গালী-মুঘল সঙ্ঘর্ষ] :

শ্রীপুরে বঙ্গীয় সেনার হাতে মুঘলদের পরাজয় সংবাদ মানসিংহের শ্রুতিগোচর হলে, তিনি যারপর নাই বিস্মিত ও ক্রুদ্ধ হন, বাঙ্গালী বীরগণ যে সুশিক্ষিত মোগল সৈন্যগণকে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত ও পরাজিত করে সেনাপতিকে নিহত করতে সমর্থ হবে তা তার কল্পনায়ও আসেনি। মন্দারাইয়ের এই পরাজয় ব্যাপারের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মানসিং স্বয়ং বিক্রমপুরাভিমুখে অগ্রসর হলো ।

এবার বহু সৈন্য এবং সুদক্ষ সেনাপতিবৃন্দ তার সহচর হইল। তথাপি উন্নত রণসজ্জা ও প্রস্তুতি সত্ত্বেও মানসিং ব্যর্থ হলেন । ছিন্নমস্তার মন্ত্রবলে বলীয়ান রাজা কেদারের সেনাবাহিনী ‘জয় শিলাদেবী’ রণহুঙ্কারে অম্বরমালা বিদীর্ণ করে তুলল। অপমানিত মানসিং অতঃপর পলায়নে বাধ্য হলেন, জয়পুর বংশাবলীতে উল্লিখিত, “কেদার রাজা নে দবাব দীয়ো জদি রাজা মানসিংঘজী তো জাজি মেঁ বৈঠ ভাজ্যো” ।

এই যুদ্ধের বিবরণ জয়পুর ভাষায় লিখিত ‘বংশাবলী’ নামক হস্ত লিখিত প্রাচীন গ্রন্থ থেকে অবিকল উদ্ধৃত করা হলো। কেদার রায়ের সহিত মানসিংহের যুদ্ধ ঐ গ্রন্থে মানসিংহের পূর্ব্বাঞ্চল–বিজয় বৃত্তান্ত যেরূপ লিপিবন্ধ আছে এস্থানেও তাই অনুসৃত হল। ‘বংশাবলী’ গ্রন্থে এইরূপে লিখিত রয়েছে।—

“পাছে উঠানে কেদার কায়ত কো রাজ ছো। সো রাজা বাজৈ ছো। সো উকৈ সিলামাতা ছী। সো মাতা কা প্রতাপ সে উনে কৈ ভীজীৎ তো নহী। সো মানসিংঘজী পুছী— “ইসো কাইকো বল ছৈ। সো অরজ করী সো সীলামাতা কো বল ছে। জদি আপ মাতা নৈ প্রসন্ন হোবা বাতে হোম ঔগরৈছ করারো জদি মাতা প্রসন্ন হই; অর কেদার রাজা হুঁ মাতাকো যো বচন ছো—সো ভূ রাজী হোয় কহসী সো তুজা—জদি জাস্যু।

এদিকে কেদার নামক এক কায়স্থের রাজ্য ছিল, তিনি রাজা নামে অভিহিত হইতেন। তাহার নিকট শিলামাতা ছিলেন। সেই শিলামাতার প্রভাবে তাঁহাকে (কেদার রায়কে) কেহই জয় করিতে পারিতনা। এজন্য মানসিংহ জিজ্ঞাসা করলেন — “ইহার এত প্রতাপের কারন কি? নিবেদন করা হইল – “ইহার প্রতাপের হেতু শিলামাতা”

● শ্রীনগরের যুদ্ধ/ ১৬০৪ খ্রি : [বাঙ্গালী-মুঘল সঙ্ঘর্ষ] :

বাঙ্গালা আক্রমণে ক্রমাগত একাধিক যুদ্ধে পরাজয় মোগল সাম্রাজ্যের ভিত্তিপ্রস্তর কম্পিত করে তুলেছিল। বাদশাহ জাহাঙ্গীর এতদসকল পরাজয়ে অতীব ক্রুদ্ধ ও বিচলিত হয়ে ওঠেন, তিনি বিক্রমপুর রাজসভায় দূত প্রেরণপূর্বক মোগল সেনার নৃশংসতা তথা দিল্লির কারাগারে আবদ্ধ বন্দিদের দুর্দ্দশা বর্ণনা করবার বিষয় মনস্থ করলেন ।

বিক্রমপুরে মোগলের দূত এসে ভীতি প্রদর্শন করে চলে গেল, বাদশাহের-ভীষণ ক্রোধের কথা জ্ঞাপন করল, রাজা কেদার রায় তাহাতে ভ্রক্ষেপও করলেন না, কাজেই যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠল । ক্রুদ্ধ বাদশাহ জাহাঙ্গীর এই বাঙ্গালী নৃপতির এতদূর আস্পর্ধা নীরবে সহ্য করলেন না । মানসিংহকে অপদার্থ বিবেচনা করে অতঃপর তিনি সেনাপতি কিলমক খান কে বিপুল মোগল-বাহিনী সহ শ্রীপুরাভিমুখে প্রেরণ করলেন ।

রাজা কেদার রায়ও অপ্রস্তুত ছিলেন না, বাদশাহ যে এ অপমান নীরবে সহ্য করবেন না তা তিনি বিশেষরূপেই জ্ঞাত ছিলেন। সর্বত্র দূত প্রেরিত হল । মহারাজ কেদারনাথ দেবরায় সহ বিক্রমপুরবাসী স্বদেশভক্ত বাঙ্গালী বীরগণ, কার্ভালো ও পর্ত্তুগীজ সৈন্যগণ সহ মোগলের আক্রমণ প্রতিরোধার্থে প্রস্তুত হয়ে রইলেন।

সেনাপতি কিলমক খান সসৈন্যে শ্রীপুরের সন্নিকটে এসে উপস্থিত
হলেন। মহারাজ কেদারনাথের সামরিক শক্তির প্রকোপ সম্বন্ধে কিলমক সম্যক অবগত ছিলেন, তাই সর্বাগ্রে রাজধানী শ্রীপুর আক্রমণ করতে সাহসী না হয়ে প্রথমে রাজা কেদার রায়ের অধিকারভূক্ত বিক্রমপুরস্থ শ্রীনগর নামক সমৃদ্ধশালী বাণিজ্য-নগরীর সন্নিকটে সসৈন্যে উপস্থিত হলেন । ভীষণ যুদ্ধের সূচনা হলো ।

কামানের গর্জনে ও সৈন্যের হুঙ্কারে শ্যাম-সলিলা কালীগঙ্গার বক্ষ প্রতিধ্বনিত করতঃ মহারাজ কেদার রায় অতিশয় বীরত্বের ও সাহসিকতার সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন। দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবনের মায়া সম্পূর্ণরূপে বিসর্জ্জন করে বঙ্গবীরগণ যুদ্ধ করতে লাগলেন, মোগলের কামান-ভেরী, তাদের বৃথা আস্ফালন সমুদয়ই ব্যর্থ হল, পলায়নপর রাজপুত ও মোগল সৈন্যগণকে রাজা কেদার রায়ের বাঙ্গালী সৈন্যগণ চারিদিক দিয়া বেষ্টন করে ফেলল। মোগল সেনাপতি কিলমক খানের গর্ব ব্যর্থ হল, তিনি বন্দী হলেন । মহারাজ কেদার রায়, কিলমক খানকে সসৈন্যে শ্রীনগরে বন্দী করে রাখলেন। তাকে পরবর্ত্তীকালে মানসিং এর সম্মুখে আনীত করা হলেও অতি শীঘ্রই সে ক্ষতজনিত কারনে মৃত্যুমুখে পতিত হয় ।

■ রাজা কেদার রায়- মির্জা মান সিং পত্রযুদ্ধ :

মানসিংহ কিলমকের দুরবস্থার কাহিনী জ্ঞাত হয়ে স্বয়ং বিপুল মোগল-বাহিনী স বিক্রমপুরাভিমুখে অগ্রসর হলেন। বারংবার রাজা কেদার রায়ের নিকট পরাজিত হয়ে তার ক্ষোভ বৃদ্ধি পায়, কাজেই এবার রাজা কেদার রায়ের ধৃষ্টতার সমুচিত ফল দেওয়ার জন্য বিপুল সৈন্য সহ মানসিং বিক্রমপুরের প্রান্ত ভাগে এসে উপনীত হন।

কথিত আছে যে গর্বিত মানসিংহ শিবির সন্নিবেশিত করে রাজা কেদার রায়ের নিকট একজন দূত প্রেরণ করেন, দূতের সহিত একখানি তরবারি ও শৃঙ্খল প্রদান করে বলে দেওয়া হয় যে যদি কেদার রায় শৃঙ্খল গ্রহণ করে বাদশাহের অধীনতা স্বীকার করেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে আর কোনরূপ যুদ্ধ ঘোষণা হবে না, আর যদি তিনি তরবারি গ্রহণ করেন তাহলে শীঘ্রই মোগল-বাহিনী তাঁর উচ্ছেদ-সাধনে রণক্ষেত্রে অগ্রসর হবে। ঐ দূত সঙ্গে মানসিংহ নিম্নলিখিতরূপ লিপি প্রেরণ করেন,—

‘ত্রিপুর-মঘ-বাঙ্গালী-কাক-কুলী-চাকুলী ।
সকল পুরুষমেতৎ ভাগ যাও পলায়ী ॥ হয়-গজ-নর-নৌকা-কম্পিত বঙ্গভূমিঃ
বিষম সমরসিংহো মানসিংহঃ প্রয়াতি ॥”

অর্থাৎ রাজা কেদার রায় হয় পালিয়ে যান বা মুঘলদের অধীনত্ব স্বীকার করুন নয়ত বিক্রমপুর আক্রমণ করতে সিংহের মত মানসিংহ আসছে |

মহারাজ কেদার রায় মানসিংহ প্রেরিত এই পত্র, তরবারি ও শৃঙ্খল দেখে ক্রোধে প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠেন এবং এর উপযুক্ত প্রত্যুত্তর দেওয়ার জন্য সংষ্কৃতজ্ঞ পত্রনবীশ বৈদ্যবংশীয় বিশ্বনাথ সেন দ্বারা রচনা করান-

‘ভিনত্তি নিত্যং করিরাজ কুম্ভং
বিভর্ত্তিবেগং পবনাতিরেকং।
করোতি বাসং গিরিরাজ শৃঙ্গে
তথাপি সিংহঃ পশুরেব নান্যঃ ॥”

অর্থাত বায়ুর চেয়ে সিংহের বেশি গতি, নিয়ত হস্তীমুন্ড বিদারণ করে,সে পর্বতের চূড়াতে ও অবস্থান করে, তবুও সিংহ একটি পশুই ।

তদুপরি তিনি বাঙ্গালা ভাষায় স্বলিখিত একখানি পত্র প্রেরণ করেন যাতে তিনি মানসিংহকে ‘বাদশাহকা পাদসেবী’ বলে তাচ্ছিল্য করেন এবং জানালেন তিনি স্বয়ং একজন স্বাধীন নৃপতি কিন্তু মানসিং এক যবনের ভৃত্ত্য মাত্র, ভৃত্ত্যের সহিত যুদ্ধ রাজার প্রতি অপমানসূচক, তিনি দিল্লীর বাদশাহকে স্বয়ং বাঙ্গালায় এসে তাঁর সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে আমন্ত্রণ জানালেন । রাজা কেদার রায় তরবারি গ্রহণ করলেন ও দূতকে শৃঙ্খল ফেরত দিয়ে লিখিলেন,

“ভেবে দেখো এ শৃঙ্খল কার পায়ে সাজে, তরবারি লইলাম লাগাইব কাজে ।”

তাঁর চারিত্রিক তেজ ও বীরবিক্রম এরূপ প্রত্যুত্তরের অক্ষরে অক্ষরে প্রকাশ পায় । মহারাজ কেদার রায়ের সমস্ত সামরিক সংগ্রাম এই মৃত্তিকার ধর্ম্মপালক স্বীয় জাতি-রাষ্ট্রের রক্ষার নিমিত্ত উৎসর্গকৃত, বর্ত্তমান স্বজাতীয় গৌরবের এই দুর্দ্দিনে এই প্রণম্য নৃপতি আমাদের সংগ্রামী চেতনার আদর্শ হোক ।

চিত্রাঙ্কন – অর্ঘ্যদীপ সর্দ্দার