বেদান্তদর্শনে জনগণের আগ্রহের পুনর্জাগরণে রাজা রামমোহন রায়ের অগ্রণী ভূমিকা

0
1812

বর্তমান বছর রাজা রামমোহন রায়ের (১৭৭২ – ১৮৩৩) জন্মের সার্ধদ্বিশতবার্ষিকী৷ অর্থাৎ তাঁর জন্মের পর আড়াইশো বছর সমাপ্ত হল৷ অষ্টাদশ শতকের গাঙ্গেয় দক্ষিণবঙ্গের এই উল্লেখযোগ্য ব্রাহ্মণ ব্যক্তিত্বের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে ইতিমধ্যেই অনেক কিছু উল্লেখ করা হয়েছে৷ তবুও হয়তো তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকার পুনর্বিবেচনা করা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকাকেকে যথাযথভাবে বিচার করার জন্য তৎকালীন এবং বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটের বিশ্লেষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আংশিকভাবে, এই পুনর্বিবেচনাটি ব্যক্তিগত পর্যায়েও তাৎপর্য বহন করে, কারণ আমি রাজা রামমোহন রায়ের রচনা (বিশেষ করে তাঁর বাংলা লেখা) থেকে প্রাথমিক উপাদান সংগ্রহ করেছি। আমি সাম্প্রতিককালে সে বিষয়ে বিশদভাবে জানার সুযোগ পেয়েছি, এবং এই পর্যবেক্ষণের ফলস্বরূপ, আধুনিক ভারত তৈরির ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা সম্বন্ধে আমার পূর্বেকার সীমাবদ্ধ উপলব্ধি সমৃদ্ধ হয়েছে এবং নতুন মাত্রাও পেয়েছে।

রাজা রামমোহন রায়ের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে জনমত প্রবাহ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, যখন কেউ বর্তমান সময়ের মূলধারার মিডিয়া, সেইসাথে তথাকথিত আরও গণতান্ত্রিক সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি পর্যবেক্ষণ করে, এই কথাটি যে তাঁর সম্পর্কে অনেক কিছু উল্লেখ করা হয়েছে ঠিক আক্ষরিকভাবে নেওয়া কঠিন। কথাটি যদিও মিথ্যা নয়, তবে এটাও ঠিক কেতাবী জগতের সংকীর্ণ সীমার বাইরে, আমাদের দেশ এবং ধর্মের প্রতি রাজা রামমোহন রায়ের অবদান সম্পর্কে যথেষ্ট জনসচেতনতার অভাব আছে। মতাদর্শিক-রাজনৈতিক বর্ণালীর উভয় প্রান্তে নিযুক্ত পক্ষপাতমূলক অবস্থানের জন্য রাজা রামমোহন রায় এবং আধুনিক ভারত তথা আধুনিক হিন্দু সমাজ গঠনে তাঁর অবদান বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গির প্রভূত প্রভেদ আছে। “ভারতে উদার সংস্কারবাদের অগ্রদূত’ হিসেবে আখ্যায়িত হওয়া থেকে শুরু করে ‘ভারতের দেশীয় সংস্কৃত শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসকারী ব্রিটিশের দালাল”’ হওয়ার অভিযোগ পর্যন্ত, রাজা রামমোহন রায়ের অনুগামী ও কট্টর বিরোধী উভয়েরই অভাব নেই। এই আড়াইশো বছরে, তিনি যতটা বিদ্বেষ অর্জন করেছেন, ততটাই প্রশংসাও অর্জন করেছেন। বেশ কয়েকটি অর্ধসত্য গল্প, তাঁর জীবনের বিবৃতি ও ঘটনাগুলিকে প্রকৃত প্রেক্ষাপট ছাড়াই গ্রহণ, কিছু সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসূত মত, এই সমস্তই উভয় শিবিরেই অকাট্য ও বস্তুনিষ্ঠ বলে দাবি করা হয়। এতে রামমোহন রায়কে মূল্যায়ন করার জটিলতাটুকু বৃদ্ধিই পায়। উভযেই তাঁকে এক ছকে বেঁধে দিতে চায় বলে তাঁর এক মজাদার চিত্রই ফুটে ওঠে। এসবের শিকার হয় নৈর্ব্যক্তিক সত্যই।

প্রত্যেকটি শিবিরের মতামতে (প্রবন্ধ বা পুস্তকে) উহ্য বা সন্তর্পণে লুক্কায়িত তথ্যের গুরুত্ব অসীম। প্রথমতঃ, রাজা রামমোহন রায়ই প্রথম ব্যক্তি যিনি কোন আধুনিক ভারতীয় ভাষায় উপনিষদের অনুবাদ করেছিলেন। ১৮১৬ থেকে ১৮১৯ সালের মধ্যে, তিনি পাঁচটি প্রধান উপনিষদের–কেন, ঈশ, কঠ, মাণ্ডুক্য এবং মুণ্ডক–যথাক্রমে অনুবাদ ও ভাষ্যসহ মুদ্রণ করেন। তাঁর ভাষ্যগুলি কেবল শঙ্করাচার্যের অনুসারীই ছিল না, এই অনূদিত গ্রন্থে, রাজা রামমোহন রায় আদি শঙ্করকে ভগবান শঙ্করাচার্য, ভগবান ভাষ্যকার এবং ভগবান পূজ্যপাদ শঙ্করাচার্য হিসাবে উল্লেখ করেছেন। এই পাঁচটি উপনিষদকে বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে প্রথমবারের মতো সহজলভ্য করার পাশাপাশি, তিনি উপনিষদগুলির আদি ইংরেজি অনুবাদকদের একজন ছিলেন। কারণ ১৮১৬ সালে, তিনি প্রথম কেনোপনিষদের ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। এর আগে, ইংরেজি অনূদিত উপনিষদগুলি ছিল, কালানুক্রমিক ক্রমানুসারে, স্যার উইলিয়াম জোন্সের ঈশোপনিষদ (১৭৯৯্), এইচ.টি. কোলব্রুকের ঐতরেয় উপনিষদ (১৮০৫), এবং উইলিয়াম কেরির (১৮০৬) ঈশোপনিষদের আরেকটি অনুবাদ। রাজা রামমোহন রায়ের এই অনুবাদ প্রকাশের ফলস্বরূপ, ভারতীয় পাঠকদের বৃহত্তর অংশের পাশাপাশি বিদেশী পাঠকরাও বৈদান্তিক গ্রন্থের অনেক বৃহত্তর অংশের সাথে পরিচিতি লাভ করে, বিশেষতঃ সংস্কৃত-অজ্ঞ পাঠককুলের কাছে এই অনুবাদের ভাষা ছিল সরল ও বোধগম্য। বিদেশে খুব কম সংখ্যক লোকই তথন সংস্কৃতের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন এবং আরও কম সংখ্যক এতটা সংস্কৃত জানতেন যে তাঁরা উপনিষদ পড়তে পারতেন।

তদুপরি, ১৮১৫ সালে, রাজা রামমোহন রায় বদরায়ণ ব্যাসের ব্রহ্মসূত্রের বাংলায় গদ্য অনুবাদ করেন। ব্রহ্মসূত্র উপনিষদ এবং ভগবদ্-গীতা সহ প্রথাগতভাবে বেদান্ত দর্শনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান প্রস্থান ত্রয়ীর অঙ্গ। বলা হয়, রামমোহনের ব্রহ্মসূত্র অনুবাদটি আধুনিক ভারতীয় ভাষায় অনুবাদের এক অনবদ্য কাজ। এটি কলকাতার ফেরিস অ্যান্ড কোং-এর প্রেস থেকে প্রকাশিত। এই অনুবাদের প্রথম মুদ্রিত সংস্করণে একটি বিস্তৃত শিরোনামের মাধ্যমে পাঠ্যের বিষয়বস্তু এবং উদ্দেশ্যকে সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করা হয়েছিল। শিরোনামটি ছিল, “বেদান্তের বাংলা অনুবাদ। এখনও পর্যন্ত ব্রাহ্ম ধর্মতত্ত্বের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সর্বজনবিদিত কাজ। গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে,পরমাত্মাই একমাত্র উপাস্য এবং তাঁর একত্ব প্রতিষ্ঠাই একমাত্র উদ্দেশ্য।” দীর্ঘ বহু বছর ধরে, অনুবাদটি বাংলা ভাষায় বেদান্ত-গ্রন্থ হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছিল।

রামমোহন ব্রহ্মসূত্রের পাশাপাশি প্রধান উপনিষদগুলির সংক্ষিপ্ত সংস্করণ আপন মাতৃভাষা বাংলায় প্রকাশ করেছিলেন পরের বছর (১৮১৬)। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজটিকে বেদান্ত-সার বা বেদান্ত দর্শনের সারমর্ম হিসাবে তুলে ধরেন। এতে, তিনি বিভিন্ন উপনিষদ এবং ব্রহ্মসূত্রের প্রচুর উদ্ধৃতি অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন যে হিন্দু ধর্মের সর্বোচ্চ আদর্শ পরম নীতি বা পরম বাস্তবতার উপাসনাকে বলা হয় পরব্রহ্ম। তিনি শীঘ্রই তাঁর ইংরেজি অনুবাদ এই পুস্তকে সংযুক্ত করেন এবং পরবর্তী বছরে (১৮১৭) বাংলা ও ইংরেজি উভয় সংস্করণ সম্বলিত নতুন বর্ধিত সংস্করণ ছাপা হয়। এই নতুন সংস্করণের একটি ইংরেজি শিরোনাম ছিল, যেখানে লেখা ছিল: সনাতন ধর্মীয় মূর্তি পূজার বর্তমান ব্যবস্থার একটি ক্ষমাপ্রার্থনাপত্র: বাংলা ভাষায় লেখ্য এবং ইংরেজি অনুবাদ সহ। হিন্দু ধর্মের অপরিহার্য বা সংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্য হিসাবে পরব্রহ্মের উপাসনাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য রাজা রামমোহন রায়ের প্রচেষ্টা এখানে স্পষ্টতঃই পরিলক্ষ্যণীয়। এই উপাসনার পদ্ধতি এবং হিন্দুধর্মের এই ব্যাখ্যাকে বাংলা এবং ইংরেজি উভয় ভাষায় সহজ সরল বোধগম্য ভাবে তিনি অনুবাদ করেছিলেন। এই বিষয়ে তাঁর শ্রমসাধ্য প্রচেষ্টা ব্যাখ্যাযোগ্য হয়ে ওঠে যখন আমরা লক্ষ্য করি যে তিনি এমন সময়ে কাজ করছিলেন যখন খ্রিস্টান মিশনারিদের নেতৃত্বে হিন্দুধর্মকে ‘মূর্তিপূজারী এবং কুসংস্কারপূর্ণ ধর্মমত’ হিসাবে প্রচারের অপচেষ্টা ছিল তুঙ্গে। এমনকি ব্যাপটিস্ট ধর্মপ্রচারক উইলিয়াম কেরির মতো কিছু খ্রিস্টান পুরুষ, যাদের সাথে রামমোহনের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, তাঁরাও শেষ পর্যন্ত হিন্দু ধর্মের উপর প্রবলভাবে আক্রমণ করেছিলেন। তাঁদের ক্রমাগত অন্যায্য অভিযোগ রামমোহনকে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছিল এবং তিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের ধর্ম ও রীতিনীতির পক্ষে কলম ধরেছিলেন।

বেদান্ত দর্শনের উপর এবং ব্যাপক অর্থে হিন্দুধর্মের উপর এই সমস্ত অনুবাদ এবং মৌলিক রচনাগুলি একাধারে লেখার সাথে সাথেই মুদ্রিত হচ্ছিল, পাশাপাশি বাজারে, গ্রন্থাগারে এবং ব্যক্তিগত সংগ্রহে সহজলভ্যও ছিল। পাঁচটি প্রধান উপনিষদের বাংলা ও ইংরেজি অনুবাদের পাশাপাশি বাংলা ভাষায় ভাষ্য সহ ব্রহ্ম-সূত্রের প্রকাশকে বিশ্বের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে যেগুলি পরবর্তী প্রজন্মের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। প্রথমবারের মতো, উপনিষদগুলি একটি আধুনিক ভারতীয় ভাষায় (বাংলা) মুদ্রিত এবং জনতার কাছে সহজলভ্য হয়েছিল। প্রাচীন বৈদিক ঋষিদের মন্ত্রগুলি, যা এতদিন পর্যন্ত দুর্লভ ছিল এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের আয়ত্তের বাইরে ছিল , অবশেষে সেগুলো সহজলভ্য হয়। আচার্য রামানুজের মতো, রামমোহন রায়ও জনসাধারণকে মোক্ষের আকর্ষণীয় মন্ত্র নির্বিচারে দান করেন। ছাপাখানার জন্যই রাজা রামমোহন রায়ের এসব রচনা সহজলভ্য হয়। বৈদান্তিক ধারণা এবং অনুচ্ছেদগুলি ফলে তাঁর সময়ে এবং পরবর্তী সময়েও সাধারণ পাঠকদের কাছে আরও ব্যাপকভাবে পরিচিত হয়। বেদান্তের সত্য সম্পর্কে জনসচেতনতার পুনরুত্থানের জন্য, ফলস্বরূপ হিন্দু ধর্মের আশু পুনরুত্থানের জন্য, সমাজ প্রস্তুত হয়।

শ্রুতি বা পবিত্র বৈদিক গ্রন্থগুলিকে সমসাময়িক কথ্য ভাষায় তুলে ধরার জন্য, রামমোহনের সামাজিক জীবন অমসৃণ এবং অপযশ হয়। কঠোরভাবে সমালোচিত হওয়ার পরেও, রাজা রামমোহন রায় অনুবাদের ক্ষেত্রে তাঁর বিশিষ্ট পূর্বসূরিদের উদাহরণ উদ্ধৃত করে তাঁর দৃঢ় পদক্ষেপকে যথোচিত বলেছিলেন, যেমন কৃত্তিবাস ওঝার বাংলা রামায়ণ (শ্রীরাম পাঁচালী), কাশীরাম দাসের বাংলা মহাভারত (একটি সংক্ষিপ্ত অনুবাদ), এবং ‘হিন্দুস্থানী’-তে তুলসীদাসের রামচরিতমানসের অনুবাদের কথা তিনি বলেন। পাশাপাশি তিনি ব্রিটিশ বিদ্বান ও ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের সংগঠিত প্রচেষ্টায় ইউরোপীয় ভাষায় মনুসংহিতা অনূদিত হওয়ার উদাহরণও তুলে ধরেছিলেন।

গ্রন্থক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের এই উদ্যোগগুলির কারণে, সমসাময়িক চিন্তাবিদদের উপর এবং পরবর্তী দশকগুলিতে তাঁকে অনুসরণকারীদের এই সব অনূদিত গ্রন্থগুলির প্রভাবের ফলে, শুধু বাংলা বা ভারত নয়, সারা বিশ্বেই ঊনবিংশ শতকে বেদান্তের প্রতি আগ্রহ পুনরুজ্জীবিত হয় –এটা দাবী করা একেবারেই অযৌক্তিক হবে না। রামমোহন রায়ের বেদান্তের উপর আরও কাজ আছে, বাদ-বিতণ্ডার অংশরূপে এবং সৃজনশীলতার অভিব্যক্তি হিসাবে, কিন্তু তাঁর সমস্ত লিখিত কাজের বিস্তৃত তালিকা এই সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদনে তুলে ধরা অসম্ভব। তদুপরি, তিনি কীভাবে বেদান্তিক পুনরুজ্জীবনের মহান কীর্তি অর্জন করেছিলেন এবং বিশেষ করে তাঁর নিজের দেশ এবং বৃহত্তর বিশ্বে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব, রাজা রামমোহন রায়ের অনুবাদ এবং ভাষ্যমূলক কাজগুলি নিবিড়ভাবে পাঠ করলে অনুধাবন করা যেতে পারে।

এক অঙ্গাঙ্গিক প্রশ্ন হল: রাজা রামমোহন রায় বেদান্ত এবং এর পুনরুজ্জীবনের উপর তাঁর রচনাগুলির মাধ্যমে কোন ধরণের পুরুষদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন? তাঁর লেখনী সেই সময় বাঙ্গলা এবং ভারতবর্ষের মাটিতে যে শ্রেষ্ঠ পুরুষদের জন্ম দিয়েছিল তাঁদের মধ্যে সর্বাগ্রে ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শ্রী অরবিন্দ। ভারতের ‘বিপ্লবী সন্ন্যাসী’ বিবেকানন্দ রাজা রামমোহন রায় সম্পর্কে কী ভাবতেন? ১৮৯৫ সালের গ্রীষ্মে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের থাউজেন্ড আইল্যান্ডস পার্কে তাঁর শিষ্যদের সামনে বক্তৃতা পাঠ করার সময়, স্বামী বিবেকানন্দ রাজা রামমোহন রায়কে একজন “মহান হিন্দু সংস্কারক” বলে প্রশংসা করেছিলেন। এখানে স্বামীজি যেমনটি বলেছিলেন, তেমনটি তাঁর শিষ্য মিস সারা এলেন ওয়াল্ডো লিপিবদ্ধ করেন:
“সেই মহান্ হিন্দু সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় এইরূপ নিঃস্বার্থ কর্মের অদ্ভুত দৃষ্টান্ত। তিনি তাঁর সমুদয় জীবনটা ভারতের সাহায্যকল্পে অর্পণ করেছিলেন। তিনিই সতীদাহ-প্রথা বন্ধ করেন। সাধারণতঃ লোকের বিশ্বাস, এই সংস্কার কার্য সম্পূর্ণরূপে ইংরেজদের দ্বারা সাধিত, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়। রাজা রামমোহন রায়ই এই প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন আরম্ভ করেন এবং একে রহিত করবার জন্য গভর্নমেণ্টের সহায়তালাভে কৃতকার্য হন। যতদিন না তিনি আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন, ততদিন ইংরেজরা কিছুই করেনি। তিনি ‘ব্রাহ্মসমাজ’ নামে বিখ্যাত ধর্মসমাজও স্থাপন করেন, আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়-স্থাপনের জন্য তিন লক্ষ টাকা চাঁদা দেন। তিনি তারপর সরে এলেন এবং বললেন, ‘আমাকে ছেড়ে তোমরা নিজেরাই এগিয়ে যাও।’ তিনি নামযশ একদম চাইতেন না, নিজের জন্য কোনরূপ ফলাকাঙ্ক্ষা করতেন না।” (দেববাণী, স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা চতুর্থ খণ্ড)

অন্য একটি অনুষ্ঠানে, স্বামী বিবেকানন্দের সবচেয়ে প্রসিদ্ধা শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতা রাজা রামমোহন রায় সম্পর্কে তাঁর গুরুর পর্যবেক্ষণ লিপিবদ্ধ করেছেন। ১৮৯৮ সালের মে মাসে, বিবেকানন্দ তাঁর ভারতীয় এবং বিদেশী শিষ্যদের সাথে হিমালয় ভ্রমণের সময় নৈনিতালে রাজা রামমোহন রায়ের উপর একটি দীর্ঘ বক্তৃতা পাঠ করেছিলেন। এই আলোচনার কথা স্মরণ করে, নিবেদিতা উল্লেখ করেছিলেন,
“এখানে আমরা রামমোহন রায়ের উপর একটি দীর্ঘ বক্তৃতা শুনেছিলাম, যেখানে তিনি [অর্থাৎ স্বামী বিবেকানন্দ] এই আচার্যের বার্তার উল্লেখযোগ্য তিনটি বিষয় তুলে ধরেছিলেন: তাঁর বেদান্ত দর্শনের সত্যতাকে স্বীকার করা, দেশপ্রেমের প্রচার, এবং হৃদয়বত্তা ও প্রেম যা সকলকে (সকল ধর্মের অনুসারীদেরকে) সমানভাবে আলিঙ্গন করেছিল। এই তিনটি বিষয়েই স্বামীজী নিজেকে রামমোহন রায়ের আরম্ভীকৃত বৃহৎ ও দূরদর্শী কার্যের অনুসারীমাত্র বলেছিলেন।” (Notes of Some Wanderings with the Swami Vivekananda, ১৯১৩)

উপরের দৃষ্টান্তগুলি থেকে স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান যে শুধুমাত্র রামমোহনের বেদান্ত দর্শনকে গ্রহণ এবং সেই দর্শনের পুনরুজ্জীবনের প্রতি তাঁর অবদান বিবেকানন্দকে অনুপ্রাণিত‌ই করেনি, রামমোহনের দেশপ্রেমের দ্বারাও তিনি সমানভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। রাজা রামমোহন রায়ের দেশপ্রেমিক এবং জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনা এবং তাঁর কর্মের ইতিহাস একটি দীর্ঘ অধ্যায়; এটি ভারতীয় রেনেসাঁর ক্রমশঃ উদ্ভাসনের একটি প্রাথমিক কিন্তু ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কালখণ্ডের অন্তর্গত, এবং সেই কারণে, এটি একটি পৃথক নিবন্ধে আলোচনা যোগ্য। আপাততঃ, আমরা ঊনবিংশ শতকের ভারতে বৈদান্তিক পুনরুজ্জীবনের গল্প এবং আধুনিক ভারতের প্রধান স্থপতিদের দ্বারা এর অভ্যর্থনার বর্ণনায় ফিরে আসি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি ভারতের আদর্শ এবং শাশ্বত বৈশিষ্ট্যগুলিকে ঝরঝরে গদ্যে এবং গভীরভাবে কবিতায় প্রকাশ করেছিলেন, রাজা রামমোহন রায়কে ‘ভারত-পথিক’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন, তাঁর কাছে রামমোহন শাশ্বত ভারতের একজন তীর্থযাত্রী, যিনি কেবল দেশকে ভৌগলিক ভাবেই পরিভ্রমণ করেননি উপরন্তু তিনি দেশের এমন একজন ব্যক্তিত্ব যিনি গভীরভাবে ভারতের বহু উত্থান-পতন, সুখদুঃখ, যশ-অপযশের মধ্যে দিয়ে ঐতিহাসিক এবং আধ্যাত্মিক অগ্রগতির অগণিত পথ অতিক্রম করার পরে একটি চূড়ান্ত গন্তব্যের আভাস পেয়েছেন। রামমোহন রায় স্মরণে একটি মণ্ডলীতে ভাষণ দিতে গিয়ে কবি বলেছিলেন:
“Unless we have a life pulsating through our bodies, we cannot assimilate other life forms into ourselves. Had we lacked life, other animals like plants, animals, birds, insects etc. would have devoured us. In this world, the dead cannot last, it dissolves into the living. Had Rammohun Roy found that we no longer showed a trace of life, he would have thrown us onto the Tower of Silence like the Persians do with their corpses, and he would have let Christianity and other living organisms devour us. But instead of doing that, he started the necessary treatment to resuscitate us.” (“রামমোহন রায়”, ১৮৮৪)

শ্রী অরবিন্দ ছিলেন সম্পর্কে ভারতের রেনেসাঁর একজন মহান রচয়িতা। ঋষি রাজনারায়ণ বসুর এই নাতি ছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের প্রকৃত আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী। শ্রীঅরবিন্দ রাজা রামমোহন রায় এবং ভারতের ইতিহাস এবং তাঁর সমাজ গঠনে তাঁর ভূমিকাকে কোন দৃষ্টিতে দেখেছিলেন? তিনি রাজা রামমোহন রায়কে বর্ণনা করেছিলেন “সেই অনন্য মহাত্মা এবং সুদূরপ্রসারী কর্মী, যিনি বঙ্গমাতাকে নাড়া দিয়ে দীর্ঘ, অলস ঘুম থেকে টেনে তুলেছিলেন…”। অরবিন্দের চোখে, রাজা রামমোহন রায় ছিলেন “অনলস উচ্চ প্রতিভাশালী মহাত্মা”, যিনি “একটি উদ্দীপনার ধারা প্রবাহিত করেন যা আমাদের জাতীয় জীবনকে আমূল বদলে দিয়েছে।” (শ্রী অরবিন্দ: হিজ লাইফ ইউনিক, ১৯৭১) রাজা রামমোহন রায়ের আদর্শ ও কর্মকে পরবর্তীকালে মহান চিন্তাশীল নেতারা কি চক্ষে দেখেছিলেন তা বুঝতে ঋষি অরবিন্দের এই কথাকটিই যথেষ্ট।

রাজা রামমোহন রায়ের ইংরেজি এবং বাংলা অনুবাদের পাশাপাশি বেদান্তের ক্ষেত্রে তাঁর মূল কাজগুলির ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল যে তিনি কখনও ইংরেজী/ইউরোপীয় স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাননি। রামমোহন রায় যে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেছিলেন তার প্রধান তিনটি উৎস : তাঁর নিজ গ্রামের স্থানীয় পাঠশালায় প্রাথমিক পাঠ, পাটনার একটি মাদ্রাসায় আরবী ও ফার্সী ভাষায় পড়াশুনা এবং কাশীতে সংস্কৃত ও হিন্দুশাস্ত্রের প্রশিক্ষণ। তখনকার দিনে, জাতি নির্বিশেষে অল্পবয়সী হিন্দুদের পক্ষে আরবী ও ফার্সী ভাষায় প্রশিক্ষণ নেওয়া খুবই স্বাভাবিক ছিল যদি তাদের আর্থিক সামর্থ্য থাকত (এই ধরনের প্রশিক্ষণ সাধারণত মাদ্রাসায় দেওয়া হত) কারণ দেশের বহুলাংশে সরকারী ভাষা ছিল ফার্সী। তাই ফার্সী জানা চাকরী পাওয়ার পূর্বযোগ্যতা ছিল। তিনি যখন ইংরেজদের সাথে বিভিন্ন ব্যবসায় ও মেলামেশা শুরু করেন, তখনই তিনি ইংরেজি শিখেছিলেন। তখন তাঁর বয়স ২৩ বছর প্রায়। অতএব, রাজা রামমোহন রায়কে কোনোভাবেই ইংরেজী ভাষার, এমনকি ইউরোপীয় শিক্ষাব্যবস্থার ফল হিসাবে বর্ণনা করা যায় না। তিনি অবশ্যই ভারতে এবং বিদেশে ইংরেজদের এবং ইউরোপীয়দের সাথে তাঁর সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের জন্য উপকৃত হয়েছেন এবং এমনকি উইলিয়াম কেরির মতো কিছু লোকের কাছ থেকে শিক্ষামূলক সাহায্যও তিনি চেয়েছিলেন, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, তিনি ইংরেজি ভাষা এবং ইংরেজি গ্রন্থরচনার ক্ষেত্রে স্বশিক্ষিত ছিলেন। সেকারণে তাঁর একটি অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, যেখানে তিনি সংস্কৃত এবং তাঁর সাহিত্যের শাস্ত্রীয় প্রশিক্ষণের গুণে তাঁর দেশের মাটি এবং স্থানীয় কৃষ্টির সাথে দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত থেকেই সমগ্র বিশ্বে সমকালীন ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক মন্থনগুলি পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করতে পারেন। বাঙ্গলায় তিনি এক অনন্য প্রতিভা–তিনি ধ্রুপদী ধারায় বেশ কয়েকটি সুরেলা ভক্তিমূলক গান লিখেছেন যা ব্রহ্ম-সঙ্গীত হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। বহির্বিশ্বের সাথে এই মেলবন্ধন এবং তাঁর নিজের দেশ এবং ঐতিহ্যের প্রতি গভীর সাংস্কৃতিক বন্ধন তাঁকে একজন বাস্তববাদী মানুষ করে তুলেছিল, যিনি ভারতের ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে উপযুক্ত আন্দোলনের গতি বুঝতে পেরেছিলেন এবং সঠিকভাবে আপন ভূমিকা অনুধাবন করেছিলেন। তাই, তিনি নিজেকে ঊনবিংশ শতকের শুরুতেই বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি এবং সামাজিক-রাজনৈতিক মুক্তির দ্বারা অনিবার্য পরিবর্তনগুলির একটি অঙ্গ হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন। তদনুসারে, তিনি নতুন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, এবং ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে হিন্দু – এবং আরও নির্দিষ্টভাবে বৈদান্তিক – বিশ্বদর্শনের প্রশস্ত পরিসরে একীভূত করার একটি উদ্ভাবনী প্রকল্পে নিজেকে নিমজ্জিত করেছিলেন। এই অগ্রগামী প্রকল্পের আলোকে দেখা গেলে, সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারের বিষয়ে রাজা রামমোহন রায়ের কর্মকাণ্ড, সেইসাথে তাঁর সমসাময়িক ও উত্তরসূরিদের অনেকের কাছ থেকে তিনি যে উষ্ণ প্রশংসা পেয়েছিলেন, তা আরও স্পষ্টভাবে বোধগম্য হয়ে ওঠে।

পরিশেষে বলা যায়, আসুন আমরা ফিরে দেখি রাজা রামমোহন রায়ের হৃদয়ের অভিলাষ – তাঁর দূরদর্শী কার্যাবলী দেশের মানুষের জীবনকে উপকৃত করবে এই আশাই তিনি পোষণ করেছিলেন। ইতিহাস এবং ধর্মের ভূমিতে তাঁর ধারণার বিকাশ দেখতে তিনি বেশি দিন জীবিত ছিলেন না। তবে তাঁর জন্মভূমি বাংলায় তাঁর মৃত্যুর পরপরই একের পর এক ব্যক্তিত্ব হিন্দু ধর্মের উত্থান করতে সাহায্য করেছিলেন, এটি কোন সমাপতন নিঃসন্দেহে ছিল না। ভস্ম থেকে উত্থিত ফিনিক্সের মতো তাঁরা হিন্দুধর্মকে সম্পূর্ণ ধ্বংসের একেবারে কিনারা থেকে উদ্ধার করেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, এবং স্বামী বিবেকানন্দের মতো আধ্যাত্মিক ব্যক্তিবর্গ হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করতে, গতিশীল করতে এবং তেজস্বী করার এই প্রয়াসে রাজা রামমোহন রায়কে অনুসরণ করেছিলেন। এঁরা শাশ্বত ধর্মের মূল ব্যাখ্যার প্রসারের মাধ্যমে এবং তাঁদের মহান ধর্মের আত্মীকরণের শক্তিকে শক্তিমান ছিলেন। দেশের উপর রাহুস্বরূপ বিদ্যমান সমস্ত শক্তিশালী সম্প্রসারণবাদী দেশকে শোষণকামী ভারতের প্রাচীন বৈদিক চিন্তাধারার বিরোধী বিদেশী শক্তিগুলিকে তাঁদের দেখানো পথেই বঙ্গা তথআ ভারত মোকাবিলা করেছিল। অন্য কথায়, তাঁরা রাজা রামমোহন রায়ের প্রকল্পকে পূর্ণতা দান করে একটি বৃহত্তর মাত্রা দিয়েছেন। ব্রাহ্মণ কে সে বিষয়ে রামমোহন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের মতাবলম্বী ছিলেন। তিনি সারা জীবন রীতিনীতি, খাদ্যাভ্যাস এবং ব্রাহ্মণত্বের বৈশিষ্ট্যগুলি যত্ন সহকারে পালন করেছেন – উপবীত পরতেন, ইংল্যান্ডে ভ্রমণের সময় একজন রাঁধুনী এবং একটি গরুও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন, এবং শেষ নিঃশ্বাসে পরব্রহ্মর নাম উচ্চারণ করেছিলেন। রাজা রামমোহন রায় তাঁর ঘটনাবহুল এবং একইসাথে গভীর আধ্যাত্মিক, মননশীল জীবনের মধ্য দিয়ে দেখিয়েছিলেন ভবিষ্যতে হিন্দুদের উচ্চ স্থান ধরে রাখতে কী কী করণীয়। তিনি মানবতার ভবিষ্যতের প্রতি তাঁর বিশ্বাস এবং সমস্ত হৃদয়ের জ্ঞাতা অন্তর্যামিনীতে তাঁর বিশ্বাস সম্পর্কে নিম্নলিখিত শব্দগুলি লিখেছেন: “সম্ভবতঃ এমন একটি দিন আসবে যখন আমার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাকে ন্যায়ের দৃষ্টিতে দেখা হবে – সম্ভবতঃ কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করা হবে। যাই হোক না কেন, মানুষ যাই বলুক না কেন, আমি এই সান্ত্বনা থেকে বঞ্চিত হতে পারি না: আমার উদ্দেশ্য পরমাত্মা অন্তরাল থেকে প্রত্যক্ষ করছেন এবং এর ফলাফল তিনিই সর্বথা দেবেন।”

অনুবাদটির মূল লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল news18.com ওয়েবসাইটে, লিখেছিলেন শ্রী শ্রীজিৎ দত্ত।