গৌড়ের রাজতন্ত্রে প্রভাবশালী আচার্য্যগণ

Pala empire, Gauda

আর্য্যজাতির সাম্রাজ্যবিস্তারের চিরকালীন আদর্শ শাস্ত্রীয় প্রজ্ঞার সহিত অস্ত্রধারী মহাশক্তির সমন্বয়মূলক কর্তৃত্ব স্থাপন । ধর্মস্থাপন, ধর্মবিস্তার অথবা ধর্মরক্ষা প্রতিক্ষেত্রেই ব্রাহ্মণ আচার্যগণের ধর্মীয় বিধানের নির্দেশে ক্ষত্রিয় নৃপতিগণ সৈন্যবলে জাতীয় ভূস্বত্ত্বাধিকার বিজয় ও বিস্তার করেছেন । পঞ্চদশ শতকের ক্রান্তিলগ্নে যখন যাবনিক আক্রমনের দুর্দশায় আর্যাবর্ত্তের ধর্ম্মাদিত্য অস্তমান, তন্মুহুর্ত্তে বৃহত্তর গৌড়ক্ষেত্র হতে উত্থিত উগ্রতেজ চন্দ্রহাস তরবারি, প্রতিষ্পর্ধী রূপে উদীয়মান রক্তবর্ণ আর্য্যপতাকার উত্থান নিশ্চিত করে ।

গৌড় সাম্রাজ্যের বিভিন্ন রাজবংশের শাসনে ক্ষত্রিয় গৌড়েশ্বরগণ নিজস্ব ব্রাহ্মণ কুলগুরু তথা প্রধানমন্ত্রীগণের শাস্ত্রবুদ্ধির উপাসনা করে বৃহত্তর ভারতবর্ষে গৌড় সাম্রাজ্য বিস্তার করেন । এরূপ বিভিন্ন রাজন্যবর্গের সাথে তাদের আচার্যগণের নামোল্লেখ করা হলো –

১) আচার্য্য গর্গ ভট্ট –

গর্গাচার্য গৌড়েশ্বর ধর্ম্মপালের প্রধানামাত্য ছিলেন । এনার স্ত্রী শ্রীমতি ইরাদেবী। ইনিই এই প্রধানামাত্য বংশের প্রতিষ্ঠাতা তথা শ্রেষ্ঠ আচার্য দর্ভপাণির পিতা । পালবংশের আচার্যপদে অধিষ্ঠিত ছিল নক্ষত্রচিন্তক জমদগ্নিকুলোৎপন্ন শাণ্ডিল্য গোত্রীয় গর্গবংশীয় ব্রাহ্মণগণ ।

২) আচার্য্য ভট্ট দর্ভপাণি –

শ্রী দর্ভপাণি ছিলেন গৌড়েশ্বর দেবপালের প্রধানামাত্য । এনার স্ত্রী শ্রীমতি শর্করাদেবী । ইনি ছিলেন পালবংশের শ্রেষ্ঠ আচার্য । আচার্য দর্ভপাণির নীতিকৌশলে সম্রাট দেবপাল হিমালয় হতে বিন্ধ্যপর্বত এবং পূর্ব ও পশ্চিম সমুদ্রের মধ্যবর্তী সমগ্র ভূভাগ পদানত করে করদ রাজ্য পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। দিনাজপুরে ভট্টগুরবমিশ্রের স্তম্ভলিপি হইতে অবগত হওয়া যায়, “সেই দর্ভপাণির নীতিকৌশলে শ্রীদেবপাল নৃপতি মতঙ্গজমদাভিসিক্তশিলাসংহতিপূর্ণ রেবা নদীর জনক হইতে মহেশললাটশোভিত ইন্দুকিরণশ্বেতায়মান গৌরীজনক পর্ব্বত পর্য্যন্ত, সূর্য্যোদয়াস্তকালে অরুণরাগরঞ্জিত জলরাশির আধার পূর্ব্বসমূদ্র এবং পশ্চিমসমুদ্র (মধ্যবর্ত্তী) সমগ্র ভূভাগ করপ্রদ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।”

“আরেবা-জনকান্মতঙ্গজমদন্তিস্যচ্ছিলাভৃৎপতেরাগৌরী পিতুরীশ্বরেন্দুকিরণৈঃ পুষ্যৎসিতিম্নো গিরেঃ । মার্ত্তণ্ডান্তময়োদয়ারুণজলাদাবারিরাশিদ্বয়ান্নীত্যারাজ্যভুবং চকার করদাং শ্রীদেবপালো নৃপঃ ॥”

৩) সোমেশ্বর ভট্ট সেনাধ্যক্ষ –

আচার্য দর্ভপাণির পুত্র ভট্ট সোমেশ্বর ছিলেন গৌড়েশ্বর দেবপালের সেনাপতি। এনার স্ত্রী শ্রীমতি তরলাদেবী । যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর অতুল বীরত্বের কারনে তাঁকে দিগ্বিজয়ী “ধনঞ্জয়ের” সহিত তুলনা করা হয়েছে।

“ন ভ্রান্তং বিকটং ধনঞ্জয়তুলামারুহ্য বিক্রামতা
বিত্যান্যর্থিষু বর্ষতা স্তুতি-গিরো নোদ্‌গর্ব্বমাকর্ণিতাঃ।
নৈবোক্তা মধুরং বহু-প্রণয়িনঃ সম্বল্গিতাশ্চ শ্রিয়া
যেনৈবং স্বগুণৈর্জ্জগদ্বিসদৃশৈশ্চক্রে সতাং বিস্ময়ঃ॥” ৯
—গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৭৩।

৪) আচার্য্য ভট্ট কেদারমিশ্র –

সেনাপতি সোমেশ্বরের পুত্র কেদারমিশ্র তাঁর পিতামহ দর্ভপাণির পরে গৌড়েশ্বরের প্রধান অমাত্য নিযুক্ত হয়েছিলেন। এনার স্ত্রী শ্রীমতি বধ্বদেবী । গৌড়েশ্বর দেবপালের শাসনের শেষের দিকে ইনি তাঁর প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন । সমগ্র ভারতবর্ষব্যাপী গৌড়ীয় পালসাম্রাজ্য বিস্তারে তাঁর কূটনৈতিক বুদ্ধির ভূমিকা সর্বাধিক । গুরবমিশ্রের দিনাজপুর স্তম্ভলিপি থেকে অবগত হওয়া যায় যে, “সম্রাট দেবপাল তাঁহার মন্ত্রী কেদারমিশ্রের বুদ্ধিবলের উপাসনা করিয়া উৎকলকুল উৎকীলিত করিয়া, হূণগর্ব্ব খর্ব্বীকৃত করিয়া এবং দ্রবিড়েশ্বর ও গুর্জ্জরনাথের দর্প চূর্ণীকৃত করিয়া দীর্ঘকাল পর্য্যন্ত সমুদ্রমেখলাভরণা বসুন্ধরা উপভোগ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।”

গৌড়েশ্বর নারায়ণপালের তাম্রশাসনে উল্লেখ আছে — সেনাপতি জয়পাল জৈষ্ঠের আদেশে উৎকল ও প্রাগজ্যোতিষপুর অধিকার করেন। জয়পাল যুদ্ধ যাত্রা আরম্ভ করলে উৎকল-রাজ ভীত হয়ে নিজ রাজধানী ত্যাগ করিয়া পলায়ন করেন । প্রাগজ্যোতিষের রাজা বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে তাঁর আজ্ঞা মস্তকে ধারণ করতেন । যথা :-

“যস্মিন্ ভ্রাতুনির্দেশাৎ বলবতি পরিতঃ প্রেষিতে জেতুমাশাঃ
সীদন্নায়ৈব দূরান্নিজপুরমজহাদুৎকলানামধীশঃ ।
আসাঞ্চক্রে চিরায় প্রণয়ি-পরিবৃতো বিভ্রদুচ্চেন মূৰ্দ্ধ।
রাজা প্রাগজ্যোতিষাণামুপশমিতসমিৎ শঙ্কয়া যস্য চাজ্ঞাম্ ॥”

৫) আচার্য্য ভট্ট গুরবমিশ্র –

ইনি গৌড়েশ্বর নারায়ণপালের প্রধানমন্ত্রী । ভট্টশিরোমণি কেদারমিশ্র এনার পিতা । দিনাজপুরের মঙ্গলবাড়ী বোদাল নামক স্থান থেকে প্রাপ্ত গরুড়স্তম্ভলিপি ইনিই রচনা করেন, যা থেকে গৌড়েশ্বর দেবপালের যুদ্ধজয় ও সাম্রাজ্যবিস্তার সম্বন্ধে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায় ।

৬) আচার্য্য চন্দ্রশেখর চক্রবর্ত্তী –

পঞ্চদশ শতকে বাঙ্গালায় সামরিক হিন্দুশক্তির উত্থানে দেশজ নৃপতিগণকে উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন বন্দ্যবংশীয় আচার্য্য চন্দ্রশেখর চক্রবর্ত্তী, যিনি ঐতিহাসিকভাবে “চন্দ্রাচার্য্য” নামে খ্যাত। তিনি ছিলেন বাঙ্গালাধীশ্বর মহারাজা শ্রী দনুজমর্দন রামনাথ দেব এর কুলগুরু তথা চন্দ্রদ্বীপ রাজসভার সুপণ্ডিত প্রধান সদস্য। দিল্লি সুলতানী ও জৌনপুর সালতানাতের ক্রমাগত ধর্মবিরোধী অত্যাচারে ভারতবর্ষের সনাতন আর্য্য সংস্কৃতি বিপন্ন হচ্ছিল। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন এই বিধর্মীয় আক্রমন প্রতিরোধ করে একটি স্বতন্ত্র ধর্ম্মরাজ্য হিসেবে সুস্থিত হতে গেলে বঙ্গভূম এবং রাঢ়ভূমের সকল হিন্দু রাজ্যকে সঙ্ঘবদ্ধ করতে হবে। এই সময় তিনি শিখরভূম রাজ্যের আচার্য পদ্মনাভ শাস্ত্রীর সহিত সাক্ষাৎপূর্বক বঙ্গ ও রাঢ় এর সকল নৃপতিদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বার্তা দেন । ইনিই সম্রাট দনুজমর্দনদেব কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত অখণ্ড বাঙ্গালা সাম্রাজ্যের রাজকুলাচার্য্য হিসেবে সম্মানিত ছিলেন।

৭) শ্রী হরিদেব ভট্টাচার্য –

আচার্য্য হরিদেব ভূরিশ্রেষ্ঠরাজ রুদ্রনারায়ণ রায়ের রাজসভার রাজকুলাচার্য্য ছিলেন । ইনি ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের সীমান্ত বিস্তার ও প্রতিবেশী রাজ্যসমূহের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এনার মধ্যস্থতায় বিদেশে আরাকান, মাদুরাই ও সিংহলের সাথে ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের উন্নত বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় তথা সপ্তগ্রাম বন্দরের প্রভূত উন্নতি হয় । এনার পৌরহিত্যে মহারাজ রুদ্রনারায়ণের সাথে রানী ভবশঙ্করীর বিবাহ সম্পন্ন হয় । মহারাজ রুদ্রনারায়ণের অকালমৃত্যুর পর এনার রাজনৈতিক পরামর্শে মহারানী ভবশঙ্করী রাজ্যপরিচালনা করেন ও কূটনৈতিক উপায়ে দুই বার উড়িষ্যা সালতানাত থেকে আগত আফগান আক্রমন প্রতিহত করে রাজ্যরক্ষা করেন।

৮) আচার্য্য শ্রীকৃষ্ণ তর্কপঞ্চানন –

ষোড়শ শতকে যশোহর রাজসভায় নিজ পাণ্ডিত্যগুণে সগৌরবে প্রভাবশালী ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ তর্কপঞ্চানন । যশোররাজ শ্রীহরি বিক্রমাদিত্য তাঁর রাজসভার নয়জন প্রধান পণ্ডিতকে নিয়ে নবরত্ন সভা প্রতিষ্ঠা করেন এবং ডামরেলীর নবরত্নমন্দিরে এই নবরত্ব সভার অধিবেশন অনুষ্ঠিত হত। এই পণ্ডিতরত্নগণের মধ্যে ব্যাসকল্প ছিলেন— আচার্য্য শ্রীকৃষ্ণ কমলনয়ন তর্কপঞ্চানন । ইনি কাশ্যপ গোত্রীয় চট্টোপাধ্যায় বংশীয় কুলীন ব্রাহ্মণ । কনৌজাগত দক্ষের ৮ম পুরুষে, বহুরূপ চট্টোপাধ্যায় গৌড়েশ্বর বল্লাল সেনের সময় নির্দোষ কুলীন হিসেবে গণ্য হন; তার প্রপৌত্র শ্রীকর হুগলীর নিকটবর্ত্তী খন্নিয়ানে বাস করেন । সেই বংশে জন্মগ্রহণ করেন পণ্ডিত কমলনয়ন চট্টোপাধ্যায় যিনি তর্কশাস্ত্রে সুগভীর পাণ্ডিত্যের কারনে শ্রীকৃষ্ণ তর্কপঞ্চানন । এনার মধ্যস্থতায় ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই এপ্রিল (৯৮৯ বঙ্গাব্দের ১১ বৈশাখ) বৈশাখী পূর্ণিমার পুণ্যলগ্নে রায়শ্রেষ্ঠ মহারাজ প্রতাপাদিত্যের রাজ্যাভিষেক সম্পন্ন হয় । যশোর সাম্রাজ্য বিস্তার ও যুদ্ধনীতিতে মহারাজ প্রতাপাদিত্যের অদ্বিতীয় পরামর্শদাতা ছিলেন আচার্য্য শ্রীকৃষ্ণ তর্কপঞ্চানন ।