বাঙ্গালী হিন্দু গণহত্যা স্মরণ দিবস ২৭ মার্চ

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙ্গালী হিন্দুদের ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করে৷ পরিকল্পনা মতো ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী “অপারেশন সার্চলাইট” নাম দিয়ে শুরু করে গণহত্যা। ছাত্র বুদ্ধিজীবীরা তো বটেই সারা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে চলে নির্বিচারে হিন্দু গণহত্যা চলে যার মধ্যে হিন্দু নারীদের ধর্ষণ ছিল সবচেয়ে রোমহর্ষক। পাকিস্তানিদের অপারেশনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল এবং জগন্নাথ হলের হিন্দু ছাত্রদের নির্বিচারে হত্যা৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আশেপাশের বহু সংখ্যক হিন্দু শিক্ষক ও সাধারণ কর্মচারীদেরও হত্যা করা হয়৷ পুরোনো ঢাকার হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকাগুলোতেও চালানো হয় ব্যাপক গণহত্যা৷দেশময় ত্রাস সৃষ্টির লক্ষ্যে নির্বিচারে হত্যা করা হয় বিভিন্ন এলাকায় ঘুমন্ত হিন্দু নর-নারীকে৷ ধারণা করা হয়, সেই কাল রাতে কেবল ঢাকা ও তার আশে পাশের এলাকাতে প্রায় এক লক্ষ নিরীহ হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছিল৷

১৯৭১ সালের ২৬ ও ২৭ মার্চ, এই দু দিন রমনা কালী মন্দিরের পবিত্র ভূমি ঘিরে পাকিস্তানি সেনারা যে বিভীষিকার রাজত্ব তৈরি করেছিল তার‌ হৃদয় বিদারক কাহিনী ইতিহাসের পাতায় চিরদিন লেখা থাকবে। পবিত্র তীর্থভূমি রাতারাতি পরিণত হয়েছিল বধ্যভূমিতে। রমনা কালীমন্দিরের অধ্যক্ষ স্বামী পরমানন্দ গিরি সহ সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিল প্রায় ১০০ জন নারী ও পুরুষ। তাদের নির্মমভাবে নির্বিচারে হত্যা করেছিল পাক সেনারা। এমনকি শিশুরাও রেহাই পায়নি পাক হানাদারদের হাত থেকে।২৭ মার্চ পাকিস্তানী বর্বর সেনাবাহিনীর আক্রমণে মন্দিরে স্থিত শতাধিক হিন্দু সাধু, সন্ন্যাসী ও ভক্তদের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয় রমনা মন্দিরের মাটি। এমনকি ডিনামাইট দিয়ে ২.২২ একরের উপর বিশাল মন্দির কমপ্লেক্সটি গুড়িয়ে দেওয়া হয়। মন্দির প্রাঙ্গণে ঘন্টাব্যাপী নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে শতাধিক মানুষকে হত্যার পাশাপাশি প্রায় ১৫ জন কমবয়সী হিন্দু কিশোরীকে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি যাদের আর কখনোই খোঁজে পাওয়া যায় নি।

২৫ মার্চের কালরাতের পর ২৬ মার্চ সকাল এগারোটার দিকে পাকিস্তানী বাহিনী প্রথমে রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ী আশ্রম অঙ্গনে ঢোকে। তারা মন্দির ও আশ্রমবাসীদের মন্দির থেকে বের না হবার জন্য হুমকি দেয়। তাদের সঙ্গে খাজা খয়ের উদ্দিন‌ও ছিল।২৭ মার্চ গভীর রাতে রমনায় ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাকাণ্ড- প্রধানত তারই উদ্যোগে সংঘটিত হয়েছিল। ওই ব্যক্তিই পাক হানাদার বাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ২৭ মার্চ রাত দুটোর দিকে পাকিস্তানী বাহিনী রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম ঘেরাও করে। সঙ্গে শুরু হয় ভারি গোলাবর্ষণ। সার্চলাইটের তীব্র আলোয় গোটা রমনা এলাকা আলোকিত হয়ে যায়।চটপট মন্দিরে ঢুকে মূর্তির দিকে বিস্ফোরক বস্তু ছুড়ে দেওয়া হয। ফলে মূর্তিসহ মন্দিরের পেছনের অংশ দেয়ালসহ উড়ে যায়। এরপরেই মন্দির ও আশ্রম ধ্বংস করা হয়। ওই সময় মন্দির ও আশ্রমের ঘুমন্ত, জাগ্রত মানুষেরা আতঙ্কিত হয়ে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিতে বাধ্য হয়। মেয়েরা শাখা, সিঁদুর মুছে ফেলে। পাকিস্তানী সেনারা পুরুষ ও মহিলাদের সঙ্গে শিশুদেরও লাইনে দাঁড় করায়। সবার সামনে রমনা কালীমন্দিরের পুরোহিত পরমানন্দ গিরিকে কলেমা পড়তে বাধ্য করে এবং তারপরে তাঁর পেট বেয়নেট দিয়ে ফেড়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।এভাবে অনেককে কলেমা পড়িয়ে হত্যা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী।কুৎসিত আনন্দ উল্লাস- করতে করতে তারা বলতে শুরু করে- ‘নৌকায় ভোট দেবার মজা বোঝ এবার।’ এরপর বাকি পুরুষদের ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়। ভয়ঙ্কর এই দৃশ্য দেখে মহিলারা আর্তচিৎকার আরম্ভ করলে বন্দুক দিয়ে পেটানো হয়। এরপর মৃতদেহগুলো একসাথে পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে মৃতদের সঙ্গে অনেক আহতও পুড়ে মারা যায়। এ সময় পাকসেনারা দু’জন যুবককে ধরে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিতে বাধ্য করে এবং পরে মুখের ভিতর গুলি করে হত্যা করে। এই হত্যাযজ্ঞের সময় রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ী আশ্রম আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছিল। আশ্রম ও মন্দিরের গোয়ালে প্রায় ৫০টির মতো গরু ছিল। অসহায় পশুগুলোকেও পাকসেনারা সেদিন পুড়িয়ে মারে।

মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সংগঠিত হত্যাকাণ্ডের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্যণীয় তা হল বেছে বেছে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে হত্যা করা। ২৫ শে মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য অংশে পরিকল্পনামাফিক এবং ঘোষিত নির্দেশ অনুযায়ী হিন্দু প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হত্যা করা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু শিক্ষকদের যেমন রেহাই দেওয়া হয়নি, তেমনি হিন্দু শরণার্থীরাও রেহাই দেওয়া হয়নি। এই হত্যাকান্ডের মধ্যে দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করা হয়, তারা প্রাণভয়ে বাসস্থান ছেড়ে পালাতে শুরু করেন।

রমনার কালী মন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রমে একাত্তরের হুতাত্মাদের তালিকা প্রসঙ্গে বিপুল রায় বলেছেন, ২৭ মার্চ কালো রাতে পাকা হানাদার বাহিনী এই মন্দিরে প্রবেশ করে শতাধিক লোক হত্যা করে। যাদের অধিকাংশ নাম জানা যায়নি। অন্যতম যারা ছিলেন তাদের মধ্যে ১। শ্রীমৎ স্বামী পরমানন্দ গিরি ২। রঘু লাল দাস ৩। ধীরেণ লাল ঘোষ ৪। শ্রীমতি লক্ষ্মী চৌহান ৫। হীরা লাল পাশী ৬। বাবু লাল ৭। সূর্য ৮। রাম গোপাল ৯। সন্তোষ পাল ১০। সুনীল ঘোষ ১১। মোহন দাস ১২। রাম বিলাস দাস ১৩। জয়ন্ত চক্রবর্তী ১৪। বিরাজ কুমার ১৫। ভোলা পাশী ১৬। বাবু লাল দাস ১৭। গণেশ চন্দ্র দাস ১৮। সরষু দাস ১৯। বসুন্ত মালী ২০। শৈবল্লি ২১। কিশোরী ঠাকুর ২২। বারিক লাল ঘোষ ২৩। বাবুল দাস দ্রুপতি ২৪। বাদল চন্দ্র রায় ২৫। ত্রিদিব কুমার রায় ২৬। রামগতি ২৭। শিব সাধন চক্রবর্তী (সাংবাদিক) ২৮। পুরণ দাস ২৯। মানিক দাস ৩০। বিভূতি চক্রবর্তী ৩১। নান্দু লাল ৩২। সরোজ ৩৩। রাজকুমার ৩৪। গণে মুচি ৩৫। বলিরাম ৩৬। সুরত বল্লি ৩৮। রমেশ ধোপা ৩৯। বাবু নন্দন ৪০। হিরুয়া এছাড়া ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকাটাও বেশ বড়ো।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠী স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের আক্রমণের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল। রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল এমনভাবেই তৈরি করা হয়েছিল যেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রের পথে প্রধান বাধা হচ্ছে এখানকার হিন্দু সম্প্রদায়। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা ছিল অভাবনীয় – তাদের সহায়-সম্পদ লুটে নেওয়া, ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, নারীদের উপর অমানবিক-পাশবিক নির্যাতন করা এবং নির্বিচারে হত্যা করা হয়। এই হত্যা পরিকল্পিতভাবে একজন, দু’জন নয়; বেছে বেছে প্রভাবশালীদের নয়, একসঙ্গে শত শত, হাজারে-হাজারে হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, পাকিস্তানী শাসকেরা হিন্দু জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে চেয়েছিল।

রমনা কালী মন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞ ‘গণতদন্ত কমিশন গঠিত হয় ২০০০ সালের ২৭ মার্চ। বর্তমানে মন্দিরের প্রধান ফটক দিঘির উত্তর-পূর্ব পাশে প্রধান ফটকের বাইরে রয়েছে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ নিহত শহিদদের তালিকাসংবলিত একটি স্মৃতিফলক।১৯৭১ সালের গণহত্যায় বাঙ্গালী হিন্দুরাই নির্যাতনের প্রধান ও প্রকৃত শিকার হয়েছিল, যা প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্যারী জে বাস তার বই ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’-এ প্রমাণ করেছেন। অন্যান্য গণহত্যার মতোই ওটাও ছিল একটি গণহত্যা, ‘হিন্দু গণহত্যা’। কাশ্মীরি হিন্দুদের যেমন নিজস্ব গণহত্যা স্মরণ দিবস রয়েছে ১৯ শে জানুয়ারী ঠিক তেমনই বাঙ্গালী হিন্দু জাতির গণহত্যা স্মরণ দিবস হিসেবে ২৭ শে মার্চ সবচেয়ে বেশি গ্রহণীয় কারণ ২৭ শে মার্চ মধ্যরাতে পূর্ববঙ্গে স্বাধীনতার চিহ্ন বহনকারী রমনা কালীমন্দির পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দৌরাত্ম্যে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। যার চূড়া ছিল ১২০ ফুট, যা বহুদূর থেকে দৃশ্যমান ছিল। শুধুমাত্র তাই নয়, ওই একই দিনে সারাদিন ব্যাপী ঢাকা শহরে বহু হিন্দু মন্দির নির্বিচারে ধ্বংস করা হয়েছিল, যেগুলো আর নবনির্মিত হয়নি। চিরকালের মতো কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে গিয়েছে সেসব মন্দির। বলা বাহুল্য, ১৯৭১ সালে ২৭ শে মার্চ পূর্ববঙ্গীয় হিন্দুদের জীবনে যে দুর্ভোগ নেমে এসেছিল সেই ধারাবাহিকতা আজ‌ও প্রবাহমান।

রমনা কালীমন্দির শুধুমাত্র একটি কালীমন্দির ছিল না। এই মন্দিরের ১২০ ফুট উঁচু শিখর ও তার অষ্টকোণবিশিষ্ট অপরূপ স্থাপত্য শৈলী ছিল পূর্ববঙ্গে বাঙ্গালী হিন্দুর ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতীকস্বরূপ। অগ্নিযুগে অনুশীলন সমিতির বিপ্লবদের রমনা কালীমন্দিরে মায়ের সমানে বুক চিরে রক্ত দিয়ে বিপ্লবে দীক্ষা নিতে হত। এর থেকেই প্রতীয়মান হয় বাঙ্গালী হিন্দুর সামাজিক ও জাতীয় জীবনে রমনা কালীমন্দিরের গুরুত্ব কতখানি ছিল। এক কথায় রমনা কালীমন্দিরের ধ্বংস ছিল পূর্ববঙ্গ বাঙ্গালী হিন্দু জাতির ধ্বংসের প্রতীক। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ মাটিতে মিশিয়ে সেখানে ‘কলকাতার কসাই’ আখ্যাত হুসেন সুরাবর্দীর নামে গড়ে তোলা হয় এক উদ্যান। পরবর্তীতে ভারতের সহযোগিতায় রমনার মাঠেরই এক ধারে রমনা কালীমন্দির পুনর্নির্মিত হলেও অতীতের সেই গরিমা আর ফেরেনি। ২৭শে মার্চ শুধু রমনা কালীমন্দিরই নয় সারাদিন ধরে প্রদেশের বহু মন্দির ধ্বংস করা হয়। ঢাকার রমনা এলাকাতেই ধ্বংস হয় রমনা শিবমন্দির। সিলেটে আক্রান্ত হয় নিম্বার্ক আশ্রম। এই কারণেই, বাঙ্গালী হিন্দু গণহত্যার স্মরণ দিবস যদি কোনো বিশেষ দিনকে হতে হয় তাহলে ২৭শে মার্চই সবচেয়ে বেশি গ্রহণীয়। তাই ২৫শে মার্চ নয় ২৭শে মার্চই বাঙ্গালী হিন্দু গণহত্যা স্মরণ দিবস হিসেবে অধিক যুক্তিযুক্ত।