বাঙ্গালীর উর্বরতা রোগ

জনসংখ্যাই গণতন্ত্রের নিয়ন্ত্রক। এই স্বাভাবিক সত্যি কথাটা বেশিরভাগ বাঙালিকেই মারাত্মক রকম অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। কারণ এটা স্বীকার করলে “এক সন্তান নীতি”-র অসারতা মেনে নিতে হয়। গত কয়েক হাজার বছর ধরে বহু সন্তান পালন যে বাঙালিদের পারিবারিক সংস্কৃতি ছিল, স্রেফ কয়েক দশকের মগজ ধোলাই সেই সংখ্যাটা বাধ্যতামূলক ভাবে একে নামিয়ে এনেছে। বাবা-মাকে দুজন ধরলে, তাদের মাত্র একটি সন্তান হওয়া জাতির জীবনে নিয়ে আসে জনসংকোচন। দুজনের একটি করে বাচ্চা, চীনেরও সরকারি নীতি ছিল। তবে অচিরেই চীন বুঝতে পারে যে এর ফলে একটা সময়ে দেশে যুবক-যুবতীদের থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সংখ্যা বেশি হয়ে যাবে। আর তার ফলে অর্থনীতি থেকে সমাজ, সমস্ত ক্ষেত্রে বিপর্যয় নেমে আসবে। তাই এখন চীন “এক সন্তান নীতি”-কে বাতিল আবর্জনার মত ছুড়ে ফেলে দিয়েছে।

বাঙালি যে এখনো এই আত্ম-বিধ্বংসী অভ্যাস থেকে বের হতে পারেনি, তার অনেক গুলো কারণ আছে। প্রথমতঃ, গত দু-তিন প্রজন্ম ধরে মাত্র একটি করে সন্তান নেবার ফলে, পারিবারিক এবং অর্থনৈতিক অভ্যাসের বিপুল পরিবর্তন ঘটে গেছে। যেটা অত সহজে আবার পাল্টে ফেলা সম্ভব নয়। প্রায় প্রতিটি বাঙালি পরিবারেই এখন স্বামী স্ত্রী দুজনেই রোজগার করেন। এবং একজনের রোজগারে নানা রকম শখ আহ্লাদ সামলে সংসার চালানো সম্ভবপর নয়। যে কোন মা প্রতিটি সন্তান পিছু গড়ে ৩-৫ বছর চাকরি করার অবস্থায় থাকেন না। ফলে সন্তান সংখ্যা যত বেশি হবে, তত বেশি বছর ওই মা-টিকে চাকরি থেকে দূরে থাকতে হবে। কাজেই, পরিবারের সম্পূর্ণ আর্থিক দায়িত্ব বাঙালি বাবারা নিজেদের কাঁধে না নিলে পরিবারে একাধিক সন্তান আসা সম্ভবপর নয়।

দ্বিতীয়তঃ, যখনই সম্পূর্ণ পরিবারের রোজগারের দায়িত্ব একজনের ঘাড়ে এসে পড়ছে, তখন বাকীদেরকেও নিজেদের শখ আহ্লাদ কমাতে হবে।একটি মাত্র সন্তান হলে যেভাবে প্রতি গরমকালে লাদাখ কিংবা মানালি আর শীতের ছুটিতে কন্যাকুমারী বা ভাইজাগ যাওয়া হত; দুটো কি তিনটে সন্তানের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব নয়। একটা সন্তানের ক্ষেত্রে যেভাবে তার প্রত্যেকটা চাহিদা বাবা মায়েরা হাসিমুখে যুগিয়ে যেতেন, সন্তান চাইলেই তাকে আঁকা-গান, দামি জুতো, খেলনা কিংবা সবচে বড় স্কুলটায় ভর্তি করা যেত; একাধিক সন্তানের ক্ষেত্রে সেটা হওয়া মুশকিল। এটা একটা বিরাট বড় সাংস্কৃতিক পরিবর্তন; যেটা চট করে বাঙালিদের পক্ষে হজম করা কষ্টকর।

তৃতীয়তঃ, বাঙালিদের সব কিছুই অবাঙালীদের তুলনায় একটু দেরি করে হয়। যে বয়সে অবাঙালীরা প্রথম প্রেম করা শুরু করে, সেই বয়সে বাঙালি ছেলেমেয়েরা ঘাড় গুঁজে শুধু পড়ে। যে বয়সে অন্যরা চাকরি করা ধরেছে, সেই বয়সে বাঙালিরা সবে চাকরির জন্য পড়ছে। যখন অন্য জাতিরা বিয়ে করে ফেলেছে, বাঙালিরা তখন কোনরকমে একটা চাকরি জুটিয়ে সম্পর্কে যাবার চেষ্টা করছে। অন্য সব জাতির বাচ্চা হয়ে যাবার পর, বাঙালিরা বিয়ের খাতায় নাম লেখায়। মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত-দের ক্ষেত্রে বাঙালি পাত্রের গড় বয়স ৩২-৩৩ এবং পাত্রীদের ক্ষেত্রে প্রায় ৩০। এত দেরিতে বিয়ে করলে একাধিক সন্তান নেবার ক্ষেত্রে অনেক সময়ই শারীরিক জটিলতার সৃষ্টি হয়।

চতুর্থত:, বাংলাতে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চল ছাড়া প্রাকৃতিক ভাবে সন্তান প্রসব হয় না। অর্থাৎ, বাঙালিদের সন্তান হয় পেট কেটে, সিজার করে। সিজার করে বাচ্চা হলে বড়জোর দুটির বেশি সন্তান নেওয়া অসম্ভব। তাছাড়া, সিজারে ঝুঁকি অনেক বেশি, অপারেশনের পর প্রায় ৬ মাস নানা রকম ভারী কাজ করা যায় না এবং অন্যান্য অনেক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। বাঙালি সমাজে সন্তান সংখ্যা বাড়াতে হলে, অঞ্চল ধরে ধরে নরমাল ডেলিভারি করা ডাক্তার, হাসপাতাল এবং নার্সিং হোমের তালিকা তৈরি করতে হবে। যাতে, যারা একের বেশি সন্তান চান, তাঁরা যেন সুরক্ষিত ভাবে বাঙালি জনসংখ্যা ধরে রাখার সর্বোচ্চ সুযোগ তৈরি করতে পারেন।

পঞ্চমত:, বাংলায় বাচ্চা থেকে বড়, সমস্ত মেয়েদের মধ্যেই বাড়ছে PCOD র সমস্যা। পিসিওডি বা পলি সিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিজ। অতিরিক্ত অস্বাস্থ্যকর খাওয়া দাওয়ার ফলে মেয়েদের ডিম্বাশয়ে তৈরি হয় ছোট বড় অসংখ্য সিস্ট, যেগুলো মাসিকের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করে। ১৭-১৮ বছরের মেয়েদেরও এই রোগটা হচ্ছে এবং হু হু করে বাড়ছে, এটা সমগ্র বাঙালি জাতির জন্যই একটা চিন্তার বিষয়। কারণ, যেসব মেয়েদের এই সমস্যা থাকে, তাঁদের কিন্তু সন্তান হতে অনেক জটিলতা দেখা যায়। মজার ব্যাপার হল, এই রোগ থেকে মুক্তি পাবার উপায় হল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে সন্তান প্রসব করা। যাতে প্রসবের তোড়ে সিস্ট সহ বদ রক্ত বেরিয়ে যায়। কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে যেহেতু বিয়ের বয়স ঊর্ধ্বগামী এবং ৩০-এর উপর বিয়ে করাটা শিক্ষিত আভিজাত্যের প্রতীক; ফলে বাঙালি মেয়েদের পক্ষে নিজেদের সমস্যার প্রাকৃতিক সমাধান করাটাও সম্ভবপর হচ্ছে না।

একটা কথা মাথায় রাখতে হবে। এক সন্তান থেকে বহু সন্তান নেওয়াটা, পারিবারিক সংস্কৃতিতে বিরাট বড় রদ-বদল। বাঙালিকে টিভি, সিনেমা, গল্পে, খবরে কেবল এক সন্তানের সুবিধাটা দেখানো হয়েছে। এক সন্তানের অসুবিধাটা দেখানো হয়নি। বহু সন্তানের সুবিধা তো প্রায় ভুলিয়েই দেওয়া হয়েছে। গণ-মাধ্যম থেকে ভারতের জনপ্রিয় মতবাদ গুলো সবকটাই বহু সন্তানের দায়-দায়িত্ব নেবার বিপক্ষে। জন সঙ্কোচনকে বৈধতা দিতে নানা রকম অদ্ভুত মত গেলানো হচ্ছে। সন্তানের জন্ম দেওয়া মানেই পৃথিবী ধ্বংসে সাহায্য করা থেকে শুরু করে, সন্তান না নিয়ে বাড়িতে কুকুর-বিড়াল পুষলেই যে অনেক বেশি আনন্দে থাকা যায়, এগুলো খুব সুকৌশলে মাথায় পুরে দেওয়া হচ্ছে। বাঙালিরা একাধিক সন্তান নিলে পৃথিবী ধ্বংস হবে কিনা জানা নেই। তবে ৭০% হয়েও যারা অন্যদের কাছে মার খেয়ে ভেউ ভেউ করে কাঁদে; ৩০% হলে যে আর কিছুতেই তারা টিকে থাকবে না, এটা একদম ১০০% নিশ্চিত।