ত্রিবেণীতে অমৃতের সন্ধান

tribeni kumbhamela

আমাদের অনেকেরই জন্মেরও আগে কথা সাহিত্যিক সমরেশ বসু ‘কালকূট’ ছদ্মনামে লিখেছিলেন ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’। পুরান- ইতিহাসের স্মৃতি বিজরিত তীর্থে সারা ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষের ভাষা-পোষাক-খাদ্য-আচরণের বিভিন্নতা সত্বেও একটি পুণ্য স্নানের আকর্ষণে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর যুক্ত বেণীর মাঝে অবগাহনে মহামিলনের যে সুর তুলেছিল, লেখক তা মুগ্ধ বিষ্ময়ে লক্ষ্য করেছেন। ভীড়ের চাপে পদপিষ্ট হয়ে যাওয়া মানুষের চিতার আগুন আকাশ স্পর্শ করেছিল, কুরুক্ষেত্রের মহাশ্মশানের চিত্র তাতে ফুটে উঠেছিল। লেখকের হৃদয় মন ব্যথিত করে তুলেছিল।
কুম্ভ স্নানে এসে লেখক বারবার খুঁজতে চেয়েছেন অমৃতের। বাম সংস্কৃতিতে লালিত লেখক উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছেন ধর্মীয় এই রহস্যের। চিতার আগুন, প্রেম, নরনারীর ভালোবাসা, পথের কলহ – এইসব উপাদান সঙ্গে নিয়ে কুম্ভের গূঢ় রহস্যের সমাধান তিনি কতটা পেরেছিলেন তা বাঙ্গালী পাঠক বলবে, কিন্তু বঙ্গদেশের এক লুপ্ত হয়ে যাওয়া কুম্ভ স্নানকে ইতিহাসের খনি থেকে খুঁজে বার করে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগে সামিল হয়ে এক বিরল ও অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম।
ত্রিবেণী কুম্ভের কথা বলছি। আদরনীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে এই উৎসবের কথা তুলে ধরে তিনি এটিকে রাষ্ট্রীয় মান্যতা দিয়েছেন। হয়তো ভারত সরকারের সাংস্কৃতিক পঞ্জিকায় আগামী বছর থেকে ত্রিবেণী কুম্ভের নাম উল্লেখ থাকবে।
তবে, এত সহজ ছিল না বিষয় টি।
কিন্তু, তার আগে কুম্ভ নিয়ে কয়েকজন বন্ধুর প্রতিক্রিয়া জানানো প্রয়োজন।
“ ত্রিবেণীতে আবার কবে থেকে কুম্ভ হয়! হাবিঝাবি কিছু কথা বলে দিলেই হলো? আরে বাবা! দেশের চার কুম্ভের কথা জগতবাসী জানে। এগুলো হল প্রয়াগ, হরিদ্বার, নাসিক আর উজ্জ্বয়নী- ত্রিবেণী কুম্ভের কথা কোথাও লেখা নেই! বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র কেউই তো এই কুম্ভের কথা বলেন নি! বিদ্যাসাগরের বাঙ্গালার ইতিহাসে এর উল্লেখ নেই! আর স্বামীজী যিনি বাঙ্গালীকে জাগাতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, তিনিও এ বিষয়ে কিছুই বলে যান নি!”
কোলকাতায় থাকি। এটাই ছিল মহানগরের শিক্ষিত স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবি বাঙ্গালীর মুখের ভাষা। তবে, গ্রাম গঞ্জের মানুষদের মনোভাব কিন্তু ঠিক এর বিপরীত। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
বরং এ বিষয়ে সেক্যুলার ও বাম বুদ্ধিজীবিদের উদ্বেগ ও কৌতুহল বেশ মজার। কথা প্রসঙ্গে এরা বারবার জানতে চাইছে – “ এটা কি হিন্দুত্বের জাগরণের কোনো কৌশল ?? বি জে পি কে ক্ষমতায় নিয়ে আসার এটা কি একটা কৌশল ?”
এইসব অর্বাচীনের কথার কি উত্তর দেব?
এবারে কুম্ভমেলা নিয়ে বেসরকারি টেলি চ্যানেলগুলির খবর ভালোরকম ছিল। বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে তারা কুম্ভকে দেখার চেষ্টা করেছে। সবই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তা মোটেই নয়। কিন্তু প্রতিযোগিতায় টিঁকে থাকার জন্য কুম্ভের খবর করতে তারা কেউ কার্পণ্য করেনি। কিন্তু, কুম্ভ মেলা চলাকালীন একটি রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যমের মুখ্য প্রশাসক এবং তাদের আজ্ঞাবাহীরা কুম্ভের সংবাদ যাতে কোনোমতেই প্রচারিত না হয়, তার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন। জেলা সংবাদদাতাকে এ নিয়ে নীরব থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যদিও তারা জানতেন কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের আর্থিক সহায়তা এই উদ্যোগে রয়েছে। শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় হয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যখন ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে ত্রিবেণীর পবিত্র ভূমির উল্লেখ করে সাতশো বছর পর অতি প্রাচীন এই ধর্মীয় উতসব কে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য উদ্যোক্তাদের বিশেষ করে মার্কিণ প্রবাসী কাঞ্চন ব্যানার্জীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তখন উপরোধে ঢেঁকি গেলার মতনই তাদের অবস্থা হল!
কুম্ভের প্রস্তুতি নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন হয়েছিল। শ্রী পঞ্চায়েতী অখাড়া মহানির্বাণী মঠের মহামণ্ডেলেশ্বর পরমাত্মানন্দজী মহারাজের সভাপতিত্বে উপস্থিত ছিলেন বাংলার বহু মঠ প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিবৃন্দ। ধর্মীয় নানা পুঁথি ঘেঁটে, মহাভারতের কথা, হিউ এন সাং এর বর্ণনা, মঙ্গল কাব্য, জৈন, শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণবীয় কাব্য ও পদ তুলে তাঁরা ব্যাখা করে নানাভাবে চেষ্টা করেছেন যে প্রায় সাতশো বছর আগে বাঙ্গলায় এমন ধর্মীয় স্নানের রীতি ছিল। ইসলামি আগ্রাসনের কারণেই এমন একটি ঐতিহ্যপুর্ণ সনাতনী ধমীয় রীতি বন্ধ হয়ে যায়।
ইসলাম আবার বড় বালাই!! কিছু ট্যারা এবং ত্যাঁদরা সাংবাদিক রে রে করে এগিয়ে এলেন। তবে, তাদের বাক্যবাণেও সাধুরা অটল ছিলেন। এইসব সাংবাদিকেরা ধর্মীয় স্নানের দিকে বিন্দুমাত্র দৃষ্টি না দিয়ে বিভিন্ন বাম মনোভাবপন্ন লেখকের ভাবনা ব্যক্ত করে শ্রেণী বিন্যাস, জাতপাত, উচ্চ ও নিম্ন বর্ণ মানুষদের আবেগ নিয়ে কিম্ভূত কিমাকার প্রশ্ন শুরু করলেন। তাদের বক্তব্য মোটামুটি এটাই-কুম্ভস্নান আসলে সমাজে উচ্চ বর্ণীয়দের একটি বিলাসিতা! সাধুরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন সন্তোষজনক উত্তর দেওয়ার। তবে, উত্তর গ্রহণ করার আগ্রহ এদের মধ্যে ছিল না।
কিছুদিন আগে বাঙ্গালীর জাতিসত্বা নিয়ে একটি আলোচনাসভায় উপস্থিত ছিলাম। বক্তা মানুষের বিশ্বাস নিয়ে আলোচনা করছিলেন। গ্রামীণ মানুষের বিশ্বাস, মূল্যবোধ নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি যা শোনালেন ত্রিবেণীর কুম্ভে গিয়েও আমার একই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হল। আলোচনায় ওই প্রবীণ বক্তার বিষয় ছিল, শহরাঞ্চলের মানুষ যতই শিক্ষার বড়াই করুক, দেশের ঐতিহ্য ও পরম্পরাগত সাংস্কৃতিক প্রবাহ ধরে রাখার বিশ্বাস থাকে গ্রামের মানুষদেরই। গ্রামীণ জাগরণই হল কোনো জাতির সঠিক জাগরণ।
একটু ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাই।
কপিলাবাস্তুর যুবরাজ তথাগত বুদ্ধ প্রবর্তিত ধর্মের প্রভাব ভারতবর্ষে এতই বেশি ছিল যে ভারতবর্ষে সনাতনী আচার অনুষ্ঠান প্রায় সব কিছুই লুপ্ত হতে চলেছিল। বুদ্ধের আবির্ভাব খ্রীষ্ট পূর্ব ৫৬৩ থেকে ৪৩৮ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে। বৌদ্ধ ধর্মের সর্বজনীন প্রভাবে পরবর্তী বহু বছর ভারতবর্ষের বহু স্থানে সনাতনী সংস্কৃতি প্রভাব এবং প্রচার ক্ষীণ হয়ে পড়ে। অষ্টম শতকে আদি শংকরাচার্য্যর আবির্ভাবের সময় নীলাচলে জগন্নাথ দেবের পূজো হতনা। কারণ রত্নপেটিকার সন্ধান না পাওয়া। শংকরাচার্য্য ধ্যানযোগে চিল্কা হ্রদে রত্নপেটিকার সন্ধান দিলে পুণরায় শুরু হয় জগন্নাথধামের পুজো। গয়াধাম উদ্ধারের কাজও তিনিই করেন, ফলে, হিন্দু সমাজ পিতৃ তর্পণ করার পুণ্য অর্জনের সূযোগ পায়। দেশের চারপ্রান্তে মঠ নির্মাণ করে সনাতনী সমাজকে ঐক্যে বাঁধার চেষ্টা করেছেন। এককথায় হিন্দুত্বের কারিগর তাঁকেই বলা যায়। । প্রয়াগ, হরিদ্বার, উজ্জয়নী কুম্ভ স্নানের পরম্পরা প্রাচীন আমল থেকে হয়ে থাকলেও মহারাষ্ট্রের সন্ত তুকারামের উদ্যোগেই শুরু হয় নাসিক কুম্ভের স্নান। যেমন শ্রী চৈতন্যদেব খুঁজে বার করেছিলেন বৃন্দাবন। যমুনার তীরে শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলার অনুপম স্থানগুলি দেখে আমরা ভক্তিতে আপ্লুত হই, শ্রী চৈতন্যদেবের আবির্ভাব না হলে এসব অধরাই থেকে যেত।
খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে প্রায় সমগ্র ভারতের অধিশ্বর ছিলেন সম্রাট আশোক। সেই সময় বঙ্গ দেশও তাঁর অধীনে ছিল। তিনি পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করায় সমগ্র ভারতেই সেই প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপ্তির ফলে সনাতনী সংস্কৃতি অনেক ক্ষীণ হয়ে গেল। অনেক পরে, খৃষ্টীয় ষষ্ট শতকে অর্থাৎ প্রায় দেড় হাজার বছর আগে গুপ্ত বংশের সামন্ত রাজা শশাঙ্ক গৌড় বাংলার শাসক হয়ে বাঙ্গলায় সনাতনী সংস্কৃতিকে পুনুরুদ্ধার করেন। কর্ণসুবর্ণে রাজধানী স্থাপন করে শৈব শাসক শশাঙ্ক সূর্য সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রবর্তন করেন বাঙ্গালীর কাল পঞ্জিকা ‘বঙ্গাব্দ’। হিউ এন সাং এই সময়ে পরিভ্রমণে এসে শশাঙ্কের শাসন ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করেন। বিভিন্ন পুরাণ অনুযায়ী এই সময়ে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর পবিত্র ধারার সঙ্গম ত্রিবেণীর দক্ষিণ প্রান্তে মুক্ত ত্রিবেণীতেও মাঘী সংক্রান্তিতে স্নানের উল্লেখ রয়েছে। এই দক্ষিণ ত্রিবেণীই বাঙ্গলার হুগলীর জেলার ত্রিবেণী। প্রায় সাতশো বছর আগেও সেখানে সনাতনী সমস্ত ধরণের ক্রিয়া-কলাপ চলত সাড়ম্বরে বলেই মনে করা যায়।
ত্রিবেণী সহ সমগ্র দক্ষিণবঙ্গ যে প্রাচীনকাল থেকে অন্যতম সমৃদ্ধ অঞ্চল ও তীর্থক্ষেত্র হিসেবে পরিগণিত সে ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কারও কারও অনুমান প্রাচীন চরিত্রপুর আজকের সপ্তগ্রাম। ওড়িশার রাজা গঙ্গা রাজবংশের চোরগঙ্গদেব পাল বংশের রাজা রামপালের মৃত্যুর পর রাজনৈতিক শৈথিল্যের কারণে বঙ্গদেশ আক্রমণ করেন এবং দণ্ডভূক্তির রাজাকে পরাজিত করে আরাম্যনগর অধিকার করেন। কুমার পালের অমাত্য প্রতিরোধ করলেও সফলকাম হন নি। ফলে, সমগ্র দক্ষিণবঙ্গ সম্ভবতঃ সপ্তগ্রাম, পাণ্ডুয়া, মহানদ সহ অঞ্চল ওড়িষা রাজার অধীনে আসে। এই বঙ্গ বিজয়ে সামন্ত সেন সাহায্য করায় পুরস্কার স্বরূপ সামন্ত সেন সুহ্ম প্রদেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। পরবর্তী কালে সামন্ত সেনের পৌত্র বিজয় সেন চোরগঙ্গদেবের সাহায্যে ও অনুমতিক্রমে রাঢ় অঞ্চলের অধিপতি হয়ে ওঠেন। চোরগঙ্গদেবের ৭০ বছরের রাজত্বকালে ওড়িশা সহ দক্ষিণ পশ্চিম বঙ্গে বিষ্ণু, সূর্য ও শিব মন্দির গড়ে ওঠে। অনুমান করা যেতে পারে এই সময়েই ত্রিবেণীর বিষ্ণু মন্দির, সূর্য মন্দির নির্মিত হয়। লক্ষনসেনের সভাকবি ধৌয়ীর পবনদূতে ত্রিবেণীর উল্লেখ সহ রাজধানী বিজয়পুরের উল্লেখ আছে। বিজয়পুর সপ্তগ্রাম কি না তা জানা যায় নি। তবে, কুন্তি নদীর তীরে নয়াসরাই বিসপাড়া বা বিশপাড়া একটি গ্রাম বর্তমান। এর প্রত্নসমীক্ষা আজো করা হয় নি। অথচ এই অঞ্চলটি সহ নিত্যানন্দপুর পর্যন্ত সপ্তগ্রাম বিস্তৃত ছিল।
নীহাররঞ্জন রায়ের মতে সেন রাজত্বের শেষ দিকে দক্ষিণবঙ্গের সামন্ত রাজারা যথেষ্ট স্বাধীন হয় পড়ে। এই সময়ে বাঙ্গলাদেশ তিনটি স্বতন্ত্র অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। উত্তরাংশ লখনৌতি যা মুসলিম অধিকারে ছিল। দক্ষিণ পূর্ব অংশ সেন রাজাদের অধিকারে ছিল। এবং দক্ষিণ পশ্চিম অংশ অর্থাৎ সপ্তগ্রাম, ত্রিবেণী, আরাম্যনগর, দণ্ডভূক্তি অঞ্চল ওড়িষার জাজনগর রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল। এই জাজনগর রাজা সেন রাজাদের তুলনায় শক্তিশালী থাকায় বখতিয়ার সে সময় সপ্তগ্রাম, ত্রিবেণী আক্রমণের সাহস পায় নি। রুকনুদ্দিন কৈকাউসের রাজ্বকালে জাফর খাঁ গাজি এই অঞ্চলের প্রথম মুসলমান বিজেতা। ১২৯৮ সালের এই যুদ্ধে সপ্তগ্রামের রাজা ভূদেব নৃপতির নাম উল্লেখ রয়েছে। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে ওই সময় তৃতীয় অনঙ্গ ভীম দেব ও তাঁর পুত্র নৃসিংহ দেব সমগ্র বঙ্গের শাসক ছিলেন। এই রাজত্বের শাসক ছিলেন বীরজিত মল, তাঁর রাজধানী আশিরগাঁও। এই আশিরগাঁওকেই বহু ঐতিহাসিক সপ্তগ্রাম ত্রিবেণী বলে চিহ্নিত করেছেন। বাঁশবেড়িয়া গ্রন্থে সপ্তগ্রামের রাজা হিসেবে শত্রুজিতের নাম পাওয়া যায়।
শোনা যায় সেনাপতি জাফর খানের নজরে পড়ে ত্রিবেণী। নদী মাতৃক বাঙ্গালা তখন বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ স্থান। সপ্ত দ্বীপ থেকে পসরা নিয়ে দেশ বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। ধনে, মানে, গুণে বাঙ্গলার শ্রেষ্ঠ এলাকায় নিজের রাজধানী স্থাপনে সংকল্প করেছিলেন সেনাপতি জাফর খাঁ গাজি । কথিত স্থানীয় রাজা ভূদেব রায় জাফর খানকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। জাফর খানের চ্ছিন্ন মুণ্ড নাকি পড়েছিল গঙ্গাতীরস্থ বিষ্ণু মন্দিরে। পিতৃ হত্যার প্রতিশোধ স্পৃহায় পরের বছর জাফর খানের ছেলে বিপুল সৈন্য সহযোগে ত্রিবেণী আক্রমণ করে এবং বিষ্ণু মন্দির ধ্বংস করে সেই মন্দির চত্বরে জাফর খানের নামে দরগা তৈরি করে। ১২৯৮ থেকে ১৩১৩ সাল পর্যন্ত সপ্তগ্রাম ত্রিবেণী মুসলিম শাসকদের করতলগত হয়। শুরু হয় মন্দির, স্তুপ, ধ্বংস কার্য এবং ধর্মান্তকরণ। হিন্দু, বৌদ্ধ দেবালয় মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ, মাদ্রাসা, দরগা তৈরির প্রচেষ্টা চলতে থাকে। রাখালদাস বন্দোপাধ্যের রচনা থেকেই জানা যায় গঙ্গা সরস্বতীর সঙ্গমস্থালে একটি পাষাণ নির্মিত দেব মন্দির ছিল। সেই মন্দিরেই জাফর গাজি খাঁ সমাহিত। পরবর্তীকালে এই দরগার খিলানে এখনও “সীতা বিবাহঃ”, “রামেন রাবণ বধঃ”, রাম রাবণয়োঃ যুদ্ধম”, “বস্ত্র হরণঃ”, “অভিষেক” প্রভৃতি লিপি খোদিত।
জাফর গাজীর তিবেণী বিজয়ের পর পরবর্তী দু শ বছর বাঙ্গালীর সাহিত্য সংস্কৃতি শিক্ষার জগত এক অন্ধকারময় অধ্যায়। ব্রাহ্মণদের আত্মশ্লাঘা এবং নিম্নবর্ণীয় মানুষদের প্রতি উচ্চবর্ণের ঘৃণা, বঞ্চনা, অবিচার, অত্যাচার ইসলাম ধর্ম প্রচারের পথকে সুগম করে তুলেছিল।
এরফলে বহু অঞ্চলের মতো ত্রিবেণী তাঁর ঐতিহ্য ও পরম্পরা ভুলে গিয়েছিল। ত্রিবেণীর কুম্ভস্নানের পুনরুদ্ধার আসলে কোনো ধর্মীয় রীতির পুনরুদ্ধার ভাবলে বোধহয় ভুল হবে। এটি সামগ্রিক এক জাগরণ- এই দৃষ্টিতে দেখা যেতে পারে।
অতীতের গৌরব ভুলে গেলেও ব্রিটিশ সময়ে এবং স্বাধীনতার পর ডানলপ কারখানা, ত্রিবেণী ট্যিসু র মতোন বাঁশবেড়িয়া অঞ্চলের একাধিক কলকারখানা এই অঞ্চলের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করত। বাম রাজনীতির কু প্রভাবে ধীরে ধীরে তা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং বর্তমানের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে সাধারণ মানুষ মুক্তির কোনো পথ দেখতে পাচ্ছিল না। ত্রিবেণী কুম্ভের মাধ্যমে স্থানীয় সাধারণ মানুষ এর মধ্যেদিয়ে মুক্তির স্বাদ খুঁজে পেয়েছে যেন।
মহা স্নানের আগের রাত থেকে ত্রিবেণী অঞ্চল গ্রাম গঞ্জ থেকে আসা লাখো লাখো মানুষের অধিকারে চলে যায়। এক বিশ্বাসে ভর করে তারা দলে দলে সকাল থেকে গঙ্গার ঘাটগুলিতে ভীড় করেন। তারা বিশ্বাস করে ফেলেছে এই স্নানের ফলে পুণ্য হবে। স্থানীয় হুগলী জেলা ও পার্শ্ববর্তী বর্ধমান জেলার মানুষেরা প্রায়ই ত্রিবেণীতে আসেন গঙ্গা স্নানের জন্য। ইসলাম শাসকেরা অনেক ধ্বংস করলেও ত্রিবেনীর মহিমা কে ম্লান করতে পারেন নি। কিন্তু, এ যে কুম্ভ স্নান। এই মাহেন্দ্রক্ষণের অবগাহনের মহাপুণ্য অর্জনের অধিকার থেকে তারা বিরত থাকতে চায় না। সব কিছু হারিয়ে এই স্নানের আগ্রহেই লক্ষ লক্ষ মানুষের এই জন সমাগম। এই বিশ্বাস, এই ভালোবাসা শহরাঞ্চলের কথিত শিক্ষিত ও মিডিয়া চালিত বুদ্ধিজীবীদের বোধগম্য হবে না।
সমরেশ বসুর মতোই বলতে হয়, আমি কী পেলাম! উষ্ণতা ও ভালোবাসা পেলাম। একটি প্রাচীন ধারা কে পুণরায় প্রবাহিত করার জন্য মানুষের মধ্যে বিশ্বাস কে খুঁজে পেলাম। যা শহরাঞ্চলে খুবই দুর্লভ। কুম্ভের অমৃত ফল লুকিয়ে রয়েছে মানুষের এই বিশ্বাস ও ভালোবাসার মধ্যে। স্থানীয় মানুষেরা আন্তরিকভাবে ত্রিবেণীতে আগত হাজার হাজার ভক্তবৃন্দের জন্য ভান্ডারার আয়োজন করে ফেলল। দূর দূরান্তর থেকে আগত সাধুদের জন্য নিয়ে এল ঝুড়ি ঝুড়ি ফল, মিষ্টি। প্রায় বিনা প্রারিশ্রমিকে দেশ বিখ্যাত শিল্পীদের অপূর্ব পরিবেশনা মুগ্ধ করল লাখো লাখো মানুষদের। এই স্বর্গীয় সুষমা মনপ্রাণ দিয়ে চেটেপুটে পান করলাম, আস্বাদন করলাম অমৃতধারার। এ এক চিদানন্দবিলাস! যে যায় নি, তার পক্ষে অনুভব করা অসম্ভব।