১৯৭১ গণহত্যা: ইউরোপে রপ্তানি হয়েছিল মৃতের হাড়গোড়?

0
289
Bangladesh Hindu genocide

১৯৭২ সালের শুরুর দিকে, নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদদাতা সিডনি শ্যানবার্গ ঢাকা থেকে একটি প্রতিবেদনে বলেন যে শহরের মিরপুর এবং মোহাম্মদপুরের আশেপাশের এলাকাগুলি মানুষের হাড় ও কঙ্কালের স্তূপে পরিপূর্ণ। বিংশ শতকের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যার সাক্ষী সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে এ অত্যন্ত সাধারণ দৃশ্য ছিল। শ্যানবার্গের প্রতিবেদনে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হল মিরপুরের শিয়ালবাড়ির একটি বাড়িতে গুঁড়ো করা হাড়ের একটি বড় স্তূপের আবিষ্কার। শ্যানবার্গ ভেবেছিলেন, মৃতদের শনাক্তকরণ যাতে না করা যায় তার জন্য হাড়গুলি গুঁড়ো করা হয়েছিল।

নিহতদের হাড় গুঁড়ো করা হয়তো সামগ্রিকভাবে হত্যার প্রমাণ লোপাট করতে সাহায্য করেছে, কিন্তু তাতে গণহত্যায় নিহত ব্যক্তিদের শনাক্তকরণ কি আদৌ রোধ করা সম্ভব হয়েছে? গণহত্যায় লক্ষাধিক মানুষ, যাদের বেশিরভাগই হিন্দু, নিহত হয়েছিল, তার মধ্যে খুব কম মৃতদেহই শনাক্ত করা হয়েছিল। নিহতদের মৃতদেহগুলি সাধারণত জলাশয়ে ফেলে দেওয়া হতো বা মাটি চাপা দেওয়া হতো অথবা শেয়াল-কুকুরের খাওয়ার জন্য ফেলে রাখা হতো। গণহত্যায় নিহত দুই বিশিষ্ট ব্যক্তি রণদাপ্রসাদ সাহা এবং ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মৃতদেহ কোনদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি বা শনাক্ত করা যায়নি, কিন্তু সকলেই জানেন কোন পরিস্থিতিতে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং তাদের ভবিতব্য কী ছিল।

সেই বছরই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কোম্পানি বেক্সিমকো প্রতিষ্ঠিত হয়। দুই ভাই এ.এস.এফ রহমান এবং সালমান এফ. রহমান, কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ডসের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলিতে সামুদ্রিক খাবার এবং হাড় গুঁড়ো রপ্তানি করে বেক্সিমকো যাত্রা শুরু হয়। একটি বাংলাদেশী সাময়িক পত্রিকায় ১৯৭২ সালেবেক্সিমকোর একটি বিজ্ঞাপন সম্প্রতি ফেসবুক গ্রুপ ‘বিজ্ঞাপন’-এ একজন ব্যবহারকারী শেয়ার করেন।

১৯৭২ সালে একটি বেক্সিমকো বিজ্ঞাপন, সাধারণ জনগণকে হাড় সংগ্রহ করে অর্থ উপার্জনের একটি স্কিম প্রস্তাব করে।

বিজ্ঞাপনের পাঠ্যটি ‘বাংলাদেশি বাংলা’-য়। সেটি অপরিবর্তিত রেখেই নিম্নে প্রদত্ত হল।


অবাক খবর!
হাড্ডিতেও টাকা

বাড়ির আশে পাশে, পথে ঘাটে, মাঠে ময়দানে অনেক হাড়হাড্ডি ছড়িয়ে আছে। আসলে এগুলো মোটেও ফেলনা নয়, বেশ মূল্যবান। এই সব হাড়হাড্ডি সংগ্রহ করে আপনি যেমন আয় করতে পারেন বেশ কিছু টাকা, দেশও উপার্জ্জন করতে পারে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা।

এখানে সেখানে পরে থাকা গরু, মহিষ, ছাগল অথবা ভেড়ার হাড়হাড্ডি সংগ্রহের একটু চেষ্টা করলেই আপনার সংসারে আসতে পারে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ।

৪/৫ মন হাড়হাড্ডি যোগাড় হলেই আমাদের এজেন্টের সংগে যোগাযোগ করুন অথবা সরাসরি আমাদেরকে পোস্টকার্ড লিখে জানান। আমাদের এজেন্ট আপনার কাছ থেকে হাড্ডিগুলো নগদ টাকায় কিনে আনবে।

বিজ্ঞাপনটিতে পশুর খুলি এবং হাড়ের ছবিও রয়েছে, সম্ভবত গবাদি পশুর। বিজ্ঞাপনে বেক্সিমকোর তৎকালীন চারটি অফিসের ঠিকানাও রয়েছে, একটি ঢাকার ধানমন্ডিতে এবং বাকিগুলো চট্টগ্রাম, খুলনা ও আশুগঞ্জে।

পশুর দেহাবশেষের ব্যবসা অবশ্যই নতুন না। পাকিস্তান অমলেও ইউরোপে হাড় গুঁড়োর রপ্তানি বেশ একটি লাভজনক ব্যবসা ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের কোম্পানীগুলো কসাইখানা থেকে গবাদি পশুর অবশিষ্টাংশ সংগ্রহ করে, সেগুলো গুঁড়ো করে, কম্প্যাক্ট করে বস্তাবন্দী করে রপ্তানি করত। কিন্তু, আর্থিক স্বাচ্ছন্দের স্বপ্ন দেখিয়ে দেশ জুড়ে হাড়গোড় সংগ্রহকে এর আগে কখনোই এমন বিপুল আকারে ক্রাউডসোর্স করা হয়নি। তাও আবার দেশের জন্য ফরেক্স আনার সূক্ষ্ম জাতীয়তাবাদী উস্কানি দিয়ে।

যেখানে গবাদি পশুর দেহাবশেষ রপ্তানি একটি প্রচলিত ব্যবসা সেখানে কসাইখানা বা কসাইরা পশুর হাড়গোড় রাস্তায় ফেলে দেবে এটা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়। অন্যদিকে, গণহত্যার পরবর্তীতে যেখানে তিরিশ লাখ মানুষ, যাদের অধিকাংশই হিন্দু, নিহত হয়েছিল, সেখানে মানুষের দেহাবশেষের বিক্ষিপ্ত হাড়গোড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকার সম্ভাবনাই বেশী। গণহত্যার সময় নিহতদের পরিবার শেষকৃত্য সম্পাদনের জন্য একদম সময়‌ই পায়নি। শকুন, শেয়াল এবং কুকুররা মৃতদেহের মাংস খুবলে খেয়ে নেওয়ার পর পরেছিল তাদের হাড়গোড়। শ্যানবার্গ তার প্রতিবেদনে এও উল্লেখ করেছিলেন ছোট ছোট বাচ্চারা মানুষের মাথার খুলি এবং হাড় নিয়ে খেলতে দেখেছেন।

বিজ্ঞাপনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে হাড়গোড় সর্বত্র ছড়িয়ে আছে, শুধু কুড়িয়ে নেওয়ার অপেক্ষা মাত্র। ছড়িয়ে থাকা হাড়ের পরিমাণ এতটাই বেশী যে, কেউ সামান্য প্রচেষ্টায় ৪-৫ মণ (১৪৪-১৮০ কিলোগ্রাম) হাড় সংগ্রহ করতে পারে এবং সেই বাবদ সহজেই কিছু নগদ অর্থ উপার্জন করতে পারে। হাড় মানুষের শরীরের ওজনের প্রায় ১৫% অংশ। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির হাড়ের ওজন প্রায় ১০ কিলোগ্রাম। যদি একজন সাধারণ মানুষ তার এলাকা থেকে ১৪৪-১৮০ কেজি হাড় সংগ্রহ করতে পারে, তবে তার অর্থ দাঁড়ায় কেবল তার আশেপাশেই কমপক্ষে ১৪-১৮ জন লোককে হত্যা করা হয়েছে। বিজ্ঞাপনদাতারা নিশ্চিত ছিলেন এমন মানুষ নিশ্চয় আছে যার প্রতিবেশীদের হাড়গোড় বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করতে বিবেকে বাধবে না। তাদের ধারণা যে ভুল ছিল না, পরবর্তীতে বেক্সিমকোর ব্যবসায়িক সাফল্যতেই তা প্রমাণিত হয়।

মানব ইতিহাসে নিহত মানুষের হাড়গোড়ের ব্যবহার বিরল নয়। ওয়াটারলু যুদ্ধের পর মৃত সৈনিকের হাড় ইংল্যান্ডে কৃষি কাজে ব্যবহারের জন্য রপ্তানি করা হয়েছিল। কামাল আতাতুর্কের তুরস্ক প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আর্মানী ও গ্রীক গণহত্যায় মৃতদের হাড়গোড় ফ্রান্সে রপ্তানি করেছিল। নাৎসিরা সার তৈরির জন্য বন্দী শিবিরে মৃতদের হাড় গুঁড়ো করার যন্ত্র ব্যবহার করত বলে জানা যায়। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে, যশোরের হিন্দু অধ্যুষিত চাঁচড়ায় একটি সরকারী সারের গোডাউন থেকে মানুষের হাড়গোড় আবিষ্কৃত হয়। সম্ভবতঃ পশ্চিম পাকিস্তানে তুলো উৎপাদনের জন্য ফসফেট সার তৈরিতে সেগুলো ব্যবহৃত হত। তাই, স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে গণহত্যা নিহত হিন্দুদের হাড় ইউরোপে রপ্তানি করা করা হলে তাতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই।

এই রপ্তানি ব্যবসায় বেক্সিমকোকে রাতারাতি সাফল্য এনে দেয়, যার ফলে সংস্থার বার্ষিক টার্নওভার হয় ৩০ মিলিয়ন ডলারের। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করত করিম ড্রাগস নামে একটি কোম্পানী। করিম ড্রাগসকে অধিগ্রহণ করে পরবর্তীতে ওষুধ প্রস্তুতি শুরু করে বেক্সিমকো। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের নিচে আজও চাপা পড়ে আছে বেক্সিমকোর মানবতাবিরোধী উত্থানের ইতিহাস। ইতিহাসের শিক্ষা আমাদের শিখিয়েছে যে সত্য চিরকাল চাপা থাকে না। জার্মান বীমা কোম্পানী আলিয়ানজ, যা এককালে নাৎসি পার্টির ইহুদিবিদ্বেষী নীতি থেকে বিপুল আর্থিক লাভ করেছিল তাদের কুৎসিত কাজকর্ম‌ও একদিন উন্মোচিত হয়েছিল। আলিয়ানজকে তাদের কুকর্ম স্বীকার করতে হয়েছিল এবং ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল। তাই আশা করা যায়, সেই দিন আর খুব বেশি দূরে নেই যে দিন বেক্সিমকো এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সহযোগিতাকারী অন্যান্য কোম্পানির অন্ধকার ইতিহাস মানব সভ্যতার কাছে পুরোপুরি উন্মোচিত হবে।

মূল প্রবন্ধটি লিখেছেন শ্রী সুমিত রায়, অনুবাদ করেছেন দীপান্বিতা বন্দ্যোপাধ্যায়।