বিধাতার হাতে লেখা গান – ৪৩

অভীক মুখোপাধ্যায়

(দ্বাচত্বারিংশত্তম পর্বের পর)

পর্ব – ৪৩ 

পঞ্চশীল ভঙ্গ হল।

পঞ্চশীল?

আজ্ঞে হ্যাঁ, পঞ্চশীল।

মনে পড়ছে কিছু?

ছোটবেলায় পড়া সেই বৌদ্ধ সিদ্ধান্তের সারাতিসারঃ

১. প্রাণীহত্যা না – করা।

২. অপরের জিনিস চুরি না – করা।

৩. ব্যাভিচারে লিপ্ত না – হওয়া।

৪. মিথ্যা কথা না – বলা এবং

৫. সুরাপান না – করা।

ভারত বুদ্ধের দেশ। ভারত থেকেই বৌদ্ধ ধর্ম গিয়েছে চিনদেশে। চিনেও তাই বৌদ্ধ সিদ্ধান্ত সাদরে গৃহীত হওয়ার কথা। এসব মাথায় রেখেই বৌদ্ধ সিদ্ধান্ত নির্ভর আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন পণ্ডিত নেহরুজি। বৌদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্চশীলের ওপরে ভিত্তি করে একটি রাজনৈতিক ছবি আঁকলেন চিনের চাউ এন লাই, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ এবং ভারতের জওহরলাল নেহরু। ১৯৫৪ সালে পঞ্চশীল চুক্তিতে সাক্ষর করলেন নেহরুজি। তখনই বললেন, ‘হিন্দি – চিনি ভাই – ভাই’। ২০১৯ সালে যখন জি জিনপিং নরেন্দ্র মোদিজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ভারতে আসেন, তখন তিনিও কিন্তু পঞ্চশীল পালনের কথা বলেন। কী ছিল ভারত – চিনের পঞ্চশীল চুক্তিতে? আসুন, চোখ বোলাই —

(ক) প্রতিটি স্বাধীন দেশের ভৌগোলিক অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাশীল হওয়া,

(খ) দ্বন্দ্ব-সংঘাত পরিত্যাগ বা অনাক্রমণ নীতি গ্রহণ করা,

(গ) অন্য কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকা,

(ঘ) পারস্পরিক সাম্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করা এবং

(ঙ) শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সকল সমস্যার সমাধান করা।

তাহলে পঞ্চশীল ভাঙল কে?

ভারত নাকি চিন?

হিসেবমতো উত্তরটা ভারত-ই হওয়া উচিত। দলাই লামাকে শরণ দিয়ে ভারত পঞ্চশীলের তৃতীয় বিন্দু থেকে সরে এসেছিল।

আর চিন? সে কি ধোয়া তুলসিপাতা?

আজ্ঞে না, সুধী পাঠক। আকসাই চিনের বুকের ওপর দিয়ে সড়কপথ বানিয়ে চিন পঞ্চশীলের প্রথম শর্ত ভঙ্গ করেছিল। ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর তথ্য বলছে পঞ্চশীল চিনই প্রথম ভঙ্গ করে। দলাই লামাকে ভারতে আশ্রয় দেওয়ার কয়েকমাস আগে চিনের পক্ষ থেকেই রাস্তা তৈরি করা হয়েছিল।

দলাই লামা ভারতেই থাকতে চাইছিলেন। আমেরিকাও তা-ই চাইছিল। তাহলে তিব্বতের সঙ্গে তাঁর ভৌগলিক দূরত্বটাও কম হয়। সি আই এ আরও একটা কাজ করল। গোপনে। চিন – বিরোধী প্রোপাগান্ডা ছড়াতে শুরু করল ভারতে। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে ন্যারেটিভ জন্ম নিল। বলা হল, তারা চিনের কমিউনিস্ট পার্টির সহযোগী দল। অবশ্য বিরাট ভুল বা মিথ্যে কিছু ছিল না। সৈদ্ধান্তিক দিক থেকে ভারতের কমিউনিস্টরা সোভিয়েত এবং চিনের সহযোগীই বটে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে বিপর্যস্ত বিশ্ব যখন চিনের দিকে আঙুল তুলছে, তখন নিজেদের সকল আনুগত্য প্রকাশ করে ভারতীয় কমিউনিস্ট সমাজ সমানে চিনের পাশে থেকে অন্যদের শাসিয়ে গিয়েছে। আমরা আবার ট্র্যাকে ফিরে আসি। এটা এমন এক সময়, যখন সি আই এ এবং কে জি বি উভয় প্রতিস্থানই প্রাণপণে ভারতে অতিসক্রিয় হয়ে ওঠার চেষ্টা চালাচ্ছে। নেহরুজি এর আঁচ সেভাবে না – পেলেও পরে লালবাহাদুর শাস্ত্রীজি এবং সুশ্রী ইন্দিরা গান্ধী তা প্রবলভাবে টের পাবেন। আগামী প্রায় দুদশক ধরে এই দুই প্রতিপক্ষের ঠাণ্ডা লড়াইয়ের ময়দান হয়ে দাঁড়াবে ভারত।

তবে দলাই লামাকে এই যে ভারতে এনে ফেলা হয়েছিল, এটা কিন্তু জাস্ট তুললাম, নিয়ে এলাম আর রেখে দিলাম গোছের কাজ ছিল না। তার আগে উপযুক্ত আবহ সৃষ্টি করা হয়। চক্রব্যূহের মতো। এদেশে এসে পাকাপাকি জাঁকিয়ে বসার তিন বছর আগেও দলাই লামা ভারতে এসেছিলেন, তখন চিনের পঞ্চশীল সিদ্ধান্তে ভর করে করা আপত্তির কারণে তাঁকে ফিরে যেতে হয়েছিল। তিন বছর পরে আবার এলেন। তখন চিন আকসাই চিনের ওপর দিয়ে রাস্তা বানিয়ে ফেলেছে। তাই ভারতের আর কিন্তু কিন্তু করার দরকার পড়েনি। বরং ভারত দলাই লামাকে শরণ দিয়ে কূটনৈতিক ভাবে প্রতিশোধ নিয়েছিল। তাছাড়াও ছিল মানবাধিকারের কথা। ভারত কখনও কোনও শরণার্থীকে ফিরিয়ে দেয়নি। তাই কিছুদিন তাঁকে শরণ দেওয়া যেতেই পারে। তিব্বত স্বাধীন হলেই দলাই লামা ফিরে যাবেন, এভাবেই ধরে নিয়ে এগোলো ভারত। তিব্বত আর স্বাধীন হতে পারেনি। দলাই লামাকেও ভারতে রয়ে যেতে হয়।

আরও একটি কথা ভুললে চলবে না যে, প্রতিপক্ষ যখন কমিউনিস্ট রাষ্ট্র চিন, তখন সোভিয়েতের ওপরে বিশ্বাস করা চলে না। মানে সোভিয়েত আর আমেরিকার মধ্যে তখন আমেরিকাকে বেছে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই আমেরিকার আনা শরণার্থীকে ফিরিয়ে দেওয়া ঠিক কাজ হতো না। তাছাড়াও আমেরিকা সাহায্যই করছিল। অর্থ দিচ্ছিল, যুদ্ধের যাবতীয় প্রয়োজন মেটাবে বলছিল। তবে কেনেডি আবার আয়ুব খানকে কথা দিয়েছিলেন যে, তাঁর পরামর্শ না – নিয়ে ভারতকে যুদ্ধাস্ত্র দেওয়া হবে না। অবশ্য আয়ুব খানকে কথা দেওয়ার কোনও মানেই হয় না। যাকে একটা নৈশভোজে ডেকে নিয়ে কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত বদলে ফেলা যায়, তাঁকে লাঞ্চটাইমে ভালো – ভালো খাইয়ে ভারতকে অস্ত্র দেওয়ার ব্যাপারটাতেও রাজী করে ফেলা কোনও ব্যাপারই নয়।

১৯৬১ সালে যখন কেনেডি ভারতে এসেছিলেন, তখন নেহরু তাঁকে নিজের বাংলোতে রেখে আদর – আপ্যায়ণ করেছিলেন। কেনেডির অবশ্য পছন্দ হয়নি। তখন নেহরুর বয়েস বেড়ে গেছে। প্রাণশক্তি কমে আসছিল। কথা কম বলতেন। জ্যাকলিন কেনেডীর সঙ্গে অল্প কিছু কথা বলেছিলেন। কেনেডি পরে নেহরুজির সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘হয়তো আগে বড় নেতা ছিলেন, এখন আর কোনও কাজে লাগবেন না। অনেকদিন ক্ষমতায় থাকলে যা হয়।’ তুলনায় পাকিস্তানের ফৌজি মেজাজের প্রখর বক্তা আয়ুব খানকে বরং কেনেডির বেশ ভালো লেগেছিল। তবে নেহরুজির সম্পর্কে এহেন মনোভাবকে একেবারে ভুল প্রমাণিত করে দেন নেহরুজি নিজেই। কেনেডি ভারত থেকে ফিরে যাওয়ার মাত্র পাঁচ মাস পরেই ভারতীয় সেনাবাহিনী যখন গোয়া থেকে পর্তুগালকে বিতাড়িত করে দিল, তখন কেনেডি অবাক হয়েছিলেন। পর্তুগাল আমেরিকার সহযোগী দেশ ছিল। মার্কিন সেনেটে ভারতের এই পদক্ষেপ নিয়ে বেশ নিন্দা করা হয়েছিল।

কেনেডি তখন বার্তা পাঠালেন, ‘আপনি এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিলেন। আমাকে একটি বার বলার প্রয়োজন অনুভব করলেন না? আমি সামলে নিতাম। এবার ইউনাইটেড নেশনস – এ কী বলবেন?’ কেনেডি একথাও বলেছিলেন যে, এরপর থেকে নেহরুজি শান্তির কথা বলবেন কোন মুখে।

নেহরুজিকে কেনেডি দুর্বল বলেছিলেন। পুরোপুরি ঠিক বলেননি, আবার তাঁর মূল্যায়ন সম্পূর্ণ ভুলও ছিল না। নেহরু সত্যিই তো বৃদ্ধ হয়ে পড়ছিলেন। চিনের বিশ্বাঘাতকতার পরে তাঁর মন ভেঙে যায়। জনতার মনে পাঁচের দশকের নেহরুজির যে ছবি ছিল, ছয়ের দশকে তা ছিল না। তখন রাশ ধরেছেন ভেঙ্গালিল কৃষ্ণ কুরুপ কৃষ্ণ মেনন। তিনি তখন দেশের ডিফেন্স মিনিস্টার। ভদ্রলোক বিদেশিদের কাছে ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন। তাঁকে ‘নেহরুজ ইভিল জিনিয়াস’ বলতে বিলিতি শাসকরা। বলা হয়, ‘he taught the white man his place’। তিনিই তখন সুত টানছিলেন। পর্তুগীজদের খেলাচ্ছিলেন। তাঁর আমেরিকা – বিরোধ সর্বজনবিদিত ছিল। প্রশাশনিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি ইচ্ছেমতো ক্ষমতার ব্যবহার করতেন। তাঁর নিন্দুকেরা বলে, তিনি নাকি ক্ষমতার অপব্যবহার করতেন।

অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক – লেখক নেভিল ম্যাক্সওয়েল লিখছেন, ‘…truth was that it was mistakes by the Indian government, specifically Prime Minister Jawaharlal Nehru, that forced the war on China.’ তাঁর মতে যুদ্ধ চিন নয়, নেহরু শুরু করেছিলেন।

দলাই লামা ভারতে আসার পরেই ভারতীয় সেনাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সীমান্তে যতটা পারবে এগিয়ে যাবে, চিনের সাপ্লাই লাইন কেটে দেবে। এটাকে ফরোয়ার্ড পলিসি বলে। আকসাই চিন বাঁজা ভূমি। অতি বিষম আবহাওয়া। একটা ঘাসও নেই। ভারতীয় সেনা শুরু করল অরুণাচলের দিক থেকে। কিন্তু অনেক সমস্যা ছিল। ভারতীয় সেনার হাতে তখনও সেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার হাতিয়ার। ছোট – ছোট সেনা টুকরি। কীভাবেই বা এগোবে। কতটাই বা এগোবে? আকসাই চিনে যখন ভারতীয় সেনা পৌঁছল, তখন তাদের চক্ষু চড়কগাছ। সামনে পাঁচগুণ বড় বাহিনী। হাতে আধুনিকতম অস্ত্র। চিন ততদিনে সেনা পরিবহনের জন্যে ভালো রাস্তা বানিয়ে ফেলেছে। আর ভারতের সৈন্যরা বেচারা পাহাড় ঠেঙিয়ে উঠছিল। তুলনাই হয় না। সংখ্যার তুলনা হয় না, প্রযুক্তির তুলনা হয় না, রণনীতির তুলনা হয় না।

এরই মধ্যে ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর চীফ ভোলানাথ মালিক একটা গোপন খবর পেলেন — আয়ুব খান কাশ্মীরে আক্রমণের ছক কষছেন। চিন ভারতকে আক্রমণ করা মাত্রই পাক – সেনা অনুপ্রবেশ করবে। এভাবে সাঁড়াশি আক্রমণ হলে ভারত কীভাবে লড়বে?

এই প্রশ্নের একটাই উত্তর ছিল। জন এফ কেনেডি। তিনি অবশ্য তখন নিজেই কিউবার পরমাণু সঙ্কট নিয়ে চিন্তামগ্ন। এমন এক পরিস্থিতির উদ্রেক হয়েছে যে, সোভিয়েতের মিসাইল যে কোনও সময় আমেরিকাকে আঘাত হানতে পারে।

এখন একটা বড় প্রশ্ন হল চিন ভারতকে আক্রমণ করার জন্যে ঠিক ওই সময়টাই কেন বেছে নিয়েছিল? মানে, যখন সোভিয়েত আর আমেরিকা যুযুৎসু হয়ে উঠেছে, ঠিক তখনই কেন? এবং আরও একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় সম্মুখ – সমর থেকে সোভিয়েত পিছু হটতেই চিনও হাত গুটিয়ে নেয়। তবে কি কিউবা, পাকিস্তান, ভারত শীতযুদ্ধের ক্রীড়নক ছিল, আসল দরদাম সোভিয়েত আর আমেরিকার মধ্যে চলছিল?

চিন ইউনাইটেড নেশনস এর সিকিউরিটি কাউন্সিলের হারানো সিটটা পুনরুদ্ধার করতে চাইছিল। এশিয়ার বিভিন্ন বিন্দুতে, যেমন ভারত পাকিস্তান ভিয়েতনাম কোরিয়া, আমেরিকার দাদাগিরি চিনের সহ্য হচ্ছিল না। ১৯৬২ সালের অক্টোবরে আসলে যুদ্ধের নাম করে মহড়া চলছিল। বিশ্বের শক্তিমান দেশগুলি পেশী প্রদর্শন করছিল। একে অন্যকে চমকিয়ে আসলে নিজেদের ওজন অনুসারে নিজেদের মধ্যে একটা সমঝোতা করে নিচ্ছিল। সোভিয়েত আর আমেরিকার ডিলের কথা তো আগেই লিখেছি, এবার আসা যাক চিন আর আমেরিকার ডিলের কথায়। কী ডিল হয়েছিল? কিংবা আদৌ কি কোনও ডিল হয়েছিল? হয়ে থাকলে কি আর এই করোনা কালে ট্রাম্প সাহেব জি জিনপিংকে অমন লাল চোখ দেখাতেন?

(ক্রমশ)