স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যে বাঙ্গালী রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব সম্পর্কে ইচ্ছাকৃতভাবে সবচেয়ে বেশী অবমূল্যায়ন করা হয়েছে, তিনি হলেন ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। বামপন্থী মহল থেকে বছরের পর বছর ধরে তাঁকে ব্রিটিশদের দালাল, সাম্প্রদায়িক ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে, তবে তা কতদূর সত্য, সেটা প্রকাশ করার সময় এসে গিয়েছে।
শ্যামাপ্রসাদের জন্ম ৬ই জুলাই, ১৯০১ খ্রীষ্টাব্দ।পিতা বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, মাতা যোগমায়া দেবী। তাঁর শিক্ষারম্ভ ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনে, ১৯১৭ সালে সরকারী বৃত্তিসহ প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এর পরের অধ্যায় হল প্রেসিডেন্সি কলেজ। ১৯২১ সালে এই কলেজ থেকে শ্যামাপ্রসাদ প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে ইংরেজী সাহিত্যে বিএ পাশ করেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর ইংরেজী সাহিত্যেই এম এ করার কথা। কিন্তু স্যার আশুতোষ তার কিছুদিন আগেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যে স্নাতোকোত্তর কোর্সের প্রবর্তন করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যে ছাত্রদের আকৃষ্ট করার জন্য আশুতোষ পুত্রকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম এ পড়তে উৎসাহী করেন। ১৯২৩ সালে শ্যামাপ্রসাদ বাংলায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এর পর বি এল পাশ করে কলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী হওয়ার উদ্যোগ নেন। বলা বাহুল্য এই পরীক্ষাতেও তিনি প্রথম হন।
১৯২৫ সালে স্যার আশুতোষের মৃত্যুর পর শ্যামাপ্রসাদ আইন পাঠের উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ড রওনা দেন। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি লিংকনস ইন থেকে বার- অ্যাট-ল পাশ করেন। তবে শ্যামাপ্রসাদের আইন ব্যবসার থেকেও বেশী আগ্রহী ছিলেন শিক্ষাক্ষেত্রে। ১৯২৪ সালে পিতার মৃত্যুর পর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন ১৯২৬ সালে কমনওয়েলথ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মহাসম্মেলনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন শ্যামাপ্রসাদ এবং সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ।
১৯২৭ সালে শ্যামাপ্রসাদ দেশে ফেরেন। কলকাতা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ডক্টর জোন্স আরকুহার্ট (১৯২৮-৩৯) এবং ডঃ হাসান সুরাবর্দীর (১৯৩০-৩৪) উদ্যোগে শ্যামাপ্রসাদ ১৯৩৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনিষ্ঠতম উপাচার্য নির্বাচিত হন। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী মদনমোহন মালব্যও শ্যামাপ্রসাদকে উপাচার্য পদ দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি রাজি হন নি।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে তাঁর প্রধান কীর্তি বাংলা ভাষায় সকল বিভাগের পঠন পাঠনের সূত্রপাত, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবস পালন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রতীক প্রবর্তন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন নিজস্ব পতাকা বা প্রতীক ছিল না। প্রতীক হিসাবে পরিচিত ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের চিহ্ন, রয়াল আর্মস। ১৯২৮ সালে দুর্গাপ্রসাদ নামক জনৈক ছাত্র প্রতীকের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে একটি চিঠি লেখেন এবং কর্তৃপক্ষ শ্রী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একটি প্রতীকের নক্সা তৈরীর দ্বায়িত্ব দেন। কিন্তু অবনীন্দ্রনাথ শারীরিক অসুস্থতা হেতু অসমর্থ হন।
উপাচার্য ডঃ ডব্লিউ এস আকুহার্ট একটি প্রতীকের প্রবর্তন করেন, কিন্তু পরবর্তী উপাচার্য হাসান সুরাবর্দী এই প্রতীক প্রত্যাখান করেন। তবে হাসান সুরাবর্দী এইকারণে একটি কমিটি গঠন করেন, যার সদস্য ছিলেন প্রাচ্যতত্ত্ববিদ ডঃ স্টেলা ক্রামরিশ, ডঃ এ এইচ হার্লে, ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।তাঁদের অনুরোধে শ্রী নন্দলাল বসু, শ্রী রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শ্রী মুকুল দে, শ্রী অর্ধেন্দু গাঙ্গুলী প্রমুখের সহায়তার প্রতীকটি প্রস্তুত করেন শিল্পী শ্রী অর্ধেন্দু বন্দোপাধ্যায়। প্রতীকটি ১৯৩১ সালের ৬ই অগস্ট গৃহীত হয়।
তবে প্রতীকটি ডঃ হাসান সুরাবর্দীর পছন্দ হয়নি। তিনি নতুন প্রতীক প্রবর্তনের চেষ্টায় ছিলেন। কিন্তু প্রতীক নিয়ে এই টালবাহানার মধ্যেই হাসান সুরাবর্দীর কার্যকাল শেষ হয় এবং শ্যামাপ্রসাদ দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
কিন্তু এর পরেই প্রতিবাদ আসে সেনেট সদস্য এবং পরবর্তীতে বাংলার প্রিমিয়ার জনাব হুসেন শহীদ সুরাবর্দীর থেকে। প্রতীকের অনুমোদনে তাঁর আপত্তি ছিল।তাছাড়া প্রতীকে বাংলায় “শ্রী” শব্দ এবং পদ্মফুলের ব্যবহার পৌত্তলিক মনে হয়েছিল।
শ্যামাপ্রসাদ অবশ্য অবিচল ছিলেন।তিনি জনাব হুসেন শহীদ সুরাবর্দীকে তাঁর আত্মীয় হাসান সুরাবর্দীর থেকে প্রতীকের মর্মার্থ জেনে নিতে বলেছিলেন।
১৯৩৫ সালে শ্যামাপ্রসাদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৩৭ সালের প্রতিষ্ঠা দিবস (২৪ জানুয়ারি) এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা সহকারে পালিত হয়। পরদিন আনন্দবাজার লেখে ” সকাল ৭ ঘটিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ বিভিন্ন কলেজ হইতে ছাত্রছাত্রীরা প্রেসিডেন্সি কলেজ ময়দানে সমবেত হয়।তথা হইতে তাহারা মার্চ করিয়া কলেজ স্ট্রীট, ওয়েলিংটন স্ট্রীট, ধর্মতলা স্ট্রীট দিয়া গড়ের মাঠের নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হয়। শোভাযাত্রাটির সম্মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা ছিল। অতঃপর বিভিন্ন কলেজের নিজ নিজ পতাকা ও ফেস্টুন লইয়া ছাত্রছাত্রীবৃন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যান্ড ও কতিপয় কলেজের ব্যান্ডবাদ্যের তালে তালে কুচকাওয়াজ করিয়া অগ্রসর হন। কুচকাওয়াজের সময় কবীন্দ্র রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিশেষভাবে রচিত একখানি গান গাওয়া হয়।ভাইস চ্যান্সেলর শ্রীযুক্ত শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন।….
বন্দেমাতরম সঙ্গীত দ্বারা অনুষ্ঠান আরম্ভ এবং সমাপ্ত হয়। …..ইসলামিয়া কলেজের ছাত্রগণ উহাতে অংশগ্রহণ করেন নাই। মুসলমান ছাত্রগণকেও এই উৎসব বয়কট করিতে অনুরোধ করিয়াছিল। অপর বিশেষত্ব এই যে ,এইবার ইউনিয়ন জ্যাক ছিল না, অন্যান্যবার ইউনিয়ন জ্যাক থাকিত।”
১৯৩৭ সালের বার্ষিক সমাবর্তনে শ্যামাপ্রসাদ কবিগুরুকে বাংলা ভাষায় সমাবর্তন ভাষণ দানের আমন্ত্রণ জানান এবং কবিগুরু সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন।শ্যামাপ্রসাদ নিজে ধুতি পাঞ্জাবীর ওপর গাউন চাপিয়ে অনুষ্ঠানে অংশ নেন। মুসলিম ছাত্ররা অনুষ্ঠান বয়কট করে। প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী ফজলুল হক,স্পীকার আজিজুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিন, খাজা হবিবুল্লা, নবাব মোশারফ হোসেন, শহীদ সুরাবর্দী ও সৈয়দ নৌশের আলি অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকেন।
কিন্তু এর জল অনেকদূর গড়ায়। শিক্ষাবিভাগ থেকে এই প্রতীকের ওপর প্রশ্ন তোলা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে বলা হয় পদ্ম ভারতের প্রতীক এবং “শ্রী” সৌন্দর্য এবং উন্নতির প্রতীক। রংপুর টাউন হলে মৌলানা আক্রম খান “শ্রী” পৌত্তলিকতার প্রতীক অভিযোগ করে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন। বিখ্যাত “প্রবাসী” পত্রিকার সম্পাদক শ্রী রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় মনে করিয়ে দেন গৌড়ের সুলতান সিকান্দার শাহ নির্মিত আদিনা মসজিদের বিভিন্ন স্থানে পদ্ম উৎকীর্ণ আছে। এমনকি পঞ্চদশ শতাব্দীর বাঙালি মুসলিমেরা নামের আগে শ্রী ব্যবহার করতেন।
১৯৩৮ সালের মার্চ মাসে বাংলার প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেন, এবং ফজলুল হক, ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, শ্রী শরৎচন্দ্র বসু, স্যার জর্জ ক্যাম্পবেল প্রমুখর উপস্থিতিতে এক সভার “শ্রী” অপসৃত হয় এবং তার জায়গায় পদ্মকোরক স্থাপিত হয়।
রাজনীতির অঙ্গনে
শ্যামাপ্রসাদের রাজনীতিতে প্রবেশ ১৯২৯ সালে , কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরূপে, বঙ্গীয় আইন সভায় । ১৯৩০ সালে লাহোর কংগ্রেসের প্রস্তাব অনুযায়ী শ্যামাপ্রসাদ সহ অন্যান্য সভ্যদের বঙ্গীয় আইনসভা থেকে পদত্যাগ করতে হয়। তবে ঐ শ্যূন্যস্থানে তিনি নির্দল প্রার্থীরূপে পুনর্নির্বাচিত হন। বঙ্গীয় হিন্দু মহাসভা শ্যামাপ্রসাদকে যোগদান করানোর চেষ্টা করেও সফল হয়নি।
ইতিমধ্যে ১৯৩৬ সালে ব্রিটিশরা এক নতুন চাল চালে, কম্যুনাল অ্যাওয়ার্ড । ব্রিটিশ পার্লামেন্টে জয়েন্ট সিলেক্ট কমিটি গঠন করা হয় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে আইনসভায় আইন সংশোধনের প্রস্তাব বিবেচনার জন্য। বাংলার আইনসভায় সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক উপায়ে মুসলমানদের জন্য আসন সংরক্ষণ করা হয়। এবারও শ্যামাপ্রসাদকে হিন্দু মহাসভা তাঁকে এই বিষয়ে প্রতিবাদ করার জন্য ইংল্যান্ডে পাঠানোর চেষ্টা করে। কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ রাজী হন নি । শ্যামাপ্রসাদ নির্দল প্রার্থী রূপে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে আইনসভায় পুনরায় নির্বাচিত হন। তবে আইনসভার ব্রিটিশ সদস্যরা মুসলিম লীগকে সমর্থন করলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলকাতা কর্পোরেশনকে তীব্র সংকটে পড়তে হয়।
তবে কংগ্রেস এই পরিস্থিতিতে নিষ্ক্রিয় ছিল। শ্যামাপ্রসাদের সামনে একটা রাস্তা খোলা ছিল, একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা। যদিও তার প্রস্তুতি ছিল না।
ইতিমধ্যে বীর সাভারকার ভারতীয় রাজনীতিতে তাঁর দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করেছেন। ১৯৩৯ সালের এপ্রিলে সাভারকার খুলনায় বঙ্গীয় প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভার সম্মেলনে যোগ দিতে আসেন। কলকাতায় থাকাকালীন তিনি বিশিষ্ট আইনজীবি শ্রী নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেন। এবং সেখানেই শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। এর ফলেই ১৯৩৯ র আগস্ট মাসে ডঃ
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় হিন্দু মহাসভায় যোগদান করেন।
১৯৪০ র মার্চ মাসে কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মুসলিম লীগের সংরক্ষিত আসনের বাইরে মুলত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় হিন্দু মহাসভা এবং শ্রী সুভাষচন্দ্র বসুর ফরওয়ার্ড ব্লকের। শ্যামাপ্রসাদ অবশ্য চেয়েছিলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের সঙ্গে একযোগে মুসলিম লীগের বিরোধিতা করা। কিন্তু শ্রী বসু রাজি হননি। এমনকি ফলাফল ঘোষণার পর দেখা গেল ফরওয়ার্ড ব্লক এবং হিন্দু মহাসভা সমান আসন পেয়েছে। শ্যামাপ্রসাদ আবার শ্রী সুভাষচন্দ্র বসুকে দুই দলের আলোচনার মাধ্যমে মেয়র নির্বাচন করার প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু সুভাষচন্দ্র বসু এবং শরৎচন্দ্র বসু আপোষ করলেন মুসলিম লীগের সঙ্গে। মেয়র হলেন লীগের আবদুর রহমান সিদ্দিকী।
১৯৩৭ সালের প্রভিন্সিয়াল ইলেকশনে মুসলিম লীগ বাংলায় ৩৯টি আসন পায়। ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি পায় ৩৬টি। নির্দল মুসলিম প্রার্থী হিসেবে ১০ জন নির্বাচিত হয় , এবং কংগ্রেস পায় ৫৭টি।জিন্না ফজলুল হককে সহ্য করতে পারতেন না। ফজলুল হক চেয়েছিলেন কংগ্রেসের সঙ্গে কোয়ালিশন করতে। কিন্তু হাইকমান্ডের নির্দেশে কংগ্রেস ফজলুল হকের সঙ্গে কোয়ালিশনে রাজী হয় না, অগত্যা ফজলুল হক জোট বাঁধেন লীগের সঙ্গে।
১৯৪১ সালের পয়লা ডিসেম্বর মুসলিম লীগের মন্ত্রীরা একযোগে বাংলা গভর্নরের কাছে ইস্তফা দেন ফজলুল হককে বিপদে ফেলার জন্য। আসল উদ্দেশ্য ছিল দল ভাঙ্গিয়ে নতুন মন্ত্রীসভা গঠন করা।
তবে হক সাহেব এর জন্য তৈরী ছিলেন। এর আগেই ২৭শে নভেম্বর জাতীয় কংগ্রেসের নেতা শ্রী যোগেশ গুপ্তের বাড়িতে একটি লীগ বিরোধী সব দলের নেতাদের একটি গোপন বৈঠক হয়। উপস্থিত ছিলেন শরৎ বসু, শ্যামাপ্রসাদ, খান বাহাদুর হাসেম আলি খান, হেমচন্দ্র নস্কর এবং ফজলুল হক । ঠিক হয় ফজলুল হক ডেমোক্রেটিক কোয়ালিশন মন্ত্রীসভার বক্তৃতা দেবেন। শরৎ বসু হবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং শ্যামাপ্রসাদ অর্থমন্ত্রী।
গভর্নর স্যার জন হাবার্ট এই প্ল্যান ভেস্তে দেওয়ার জন্য লীগ নেতা খাজা নাজিমুদ্দিনকে ডেকে বলেন ফজলুল হককে মন্ত্রীসভার সদস্য করে “ওয়ার ক্যাবিনেট” গঠন করতে বলেন। ফজলুল হক এই টোপ গেলেন নি। গভর্নর লিনলিথগোর আদেশ সংগ্রহ করে মন্ত্রীসভা তৈরির ঠিক আগের দিন ১১ই ডিসেম্বর ১৯৪১ সালে শ্রী শরৎ বসুকে রাজবন্দী করেন, এবং সুদূর কুর্গের কুন্নুর জেলে পাঠান।
তবে ১২ই ডিসেম্বর মন্ত্রীসভা ঠিকই তৈরী হয়। তবে মুসলিম লীগ এবং ব্রিটিশ সদস্যদের বিরোধিতায় এবং সর্বোপরি গভর্নরের চালে প্রাদেশিক অটোনমি রসিকতায় পরিণত হয়।
শাসনভার মুলত কু্ক্ষিগত ছিল গভর্নরের হাতেই, এবং গভর্নর বিশেষ স্নেহশীল ছিলেন মুসলিম লীগের প্রতি।
ইতিমধ্যে ১৯৪২ র অগস্টে শুরু হয় ভারত ছাড় আন্দোলন। এই আন্দোলন অন্যতম মাত্রা পায় মেদিনীপুর জেলায়। সরকারী নির্যাতনও অন্য মাত্রা লাভ করে, যার মূল হোতা ছিলেন মেদিনীপুরের পাঞ্জাবী মুসলিম জেলাশাসক এন এম খান। শ্যামাপ্রসাদের প্রতিবাদে ব্রিটিশ সরকার কর্ণপাত করেনি। ব্যাপারটা চরমে পৌঁছয় অক্টোবর মাসে, যখন প্রবল ঝড় এবং বন্যায় মেদিনীপুরের অনেক অংশ ধ্বংস হয়ে যায়। ঐতিহাসিক ডঃ তপন রায়চৌধুরী তাঁর “বাঙালনামা” বইতে লিখছেন ” দুর্ভিক্ষের চরম অবস্থায় যখন সর্বগ্রাসী বন্যা হয়, ইংরাজ বড় আমলারা বেশ কিছুদিন হাত গুটিয়ে বসে থাকেন। বন্যার খবরটাও বেশ কিছুদিন চাপা থাকে। লাটসাহেব ঘটনার তিন সপ্তাহ পর উড়োজাহাজ থেকে বন্যাবিধ্বস্ত অঞ্চল পরিদর্শন করে তাঁর কর্তব্য শেষ করেন। মন্ত্রীরা মেদিনীপুর পরিদর্শনে গেলে তাঁদের পদে পদে বাধা দেওয়া হয়।আমলাতন্ত্রের সৎমা সুলভ নীতির পিছনে যে মেদিনীপুরবাসীদের শাস্তি দেওয়ার ইচ্ছে কাজ করছিল,সেই হিসেবে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।”
শ্যামাপ্রসাদ গভর্নর জন হার্বাট এবং লিনলিথগোকে চিঠি লিখে সতর্ক করেন। পরিশেষে ১৯৪২ র ১৬ই নভেম্বর পদত্যাগ করেন। তার আগে গভর্নর জন হাবার্টের কাছে এক লিখিত বিবৃতিতে জানান,”মিঃ ফজলুল হকের নেতৃত্বে বাংলার হিন্দু ও মুসলমানদের মিলন এক শ্রেণীর সরকারী কর্মচারীরা যে সানন্দে গ্রহণ করতে পারেননি, একথা অবিদিত নয়। ….বর্তমান মন্ত্রীসভার প্রতি আপনার নিজের মনোভাব আদৌ সন্তোষজনক নয়। সময় অসময়ে আপনি মুসলিম লীগকে সমর্থন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন। মুসলিম লীগের পক্ষে আপনার এইধরণের ঐকালতির ফলে সময়ে সময়ে আমরা আপনাকে এই প্রদেশের এক নিরপেক্ষ শাসনতান্ত্রিক প্রধান হিসেবে মনে না করে মুসলিম লীগের এক অনুগত এবং বিশিষ্ট সমর্থক বলে মনে করতে বাধ্য হয়েছি”
এই প্রসঙ্গে আবার বামপন্থী ঐতিহাসিক ডঃ তপন রায়চৌধুরীকে স্মরণ করা যাক।ডঃ তপন রায়চৌধুরী শ্যামাপ্রসাদের বিদায়ী বক্তৃতার সাক্ষী ছিলেন তপন বাবু।” উনি ফজলুল হক সাহেবের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন যে,তাঁর সঙ্গে কাজ করতে কখনও কোন অসুবিধে হয় নি। কিন্তু আত্মসন্মান বজায় রেখে কারও পক্ষে গুটিকয় সেক্রেটারি আর তাদের স্যাঙাত কিছু বেসরকারি ইংরেজ ফোঁপরদালালের সঙ্গে কাজ করা সম্ভব নয়। উনি নানা তথ্যপ্রমাণ দিয়ে দুর্ভিক্ষের জন্য এইসব লোকগুলির দায়িত্ব প্রমাণ করেন, আর কীভাবে তারা পদে পদে মন্ত্রীদের কাজে বাধা দিয়েছে তাও দেখান। এই বিশ্লেষণ অসহ্য বোধ হওয়ায় সভার এক মনোনীত ইংরেজ সদস্য চেঁচিয়ে ওঠে, “তুমি তোজোর কাছে যাও। সেই তোমার রক্ষাকর্তা। ” শ্যামাপ্রসাদ উত্তর দিলেন, “দুশো বছরের শাসনের পর এই যদি তোমাদের অবদান হয়, তবে তোজো আমাদের রক্ষাকর্তা কি না জানি না, কিন্তু তোমরা যে নও , সে বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই।”
১৯৪৩এ শুরু হয় পঞ্চাশের মন্বন্তর, যা ছিল ব্রিটিশ সরকারের গাফিলতি এবং কিছু লোকের অন্তহীন লোভের ফল।
পূর্ব সীমান্তে যুযুধান সৈন্যদের জন্য ব্রিটিশ সরকার খাদ্যসংগ্রহ করতে থাকে, ফলে খাদ্যশস্যের ভান্ডারে টান পড়ে। যুদ্ধপ্রচেষ্টার অঙ্গ ডিনায়াল পলিসি অনুসারে পূর্ববঙ্গের গ্রামাঞ্চলের থেকে সামান্য ক্ষতিপূরণের বদলে প্রয়োজনীয় যাবতীয় যানবাহন কেড়ে নেওয়া হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায়। দরিদ্র গ্রামবাসীদের কাছে খাদ্য সংগ্রহের কোন উপায় থাকে না। শুরু হয় দুর্ভিক্ষ।
মুসলিম লীগ সরকারের থেকে দুর্ভিক্ষ নিবারণের জন্য কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। লীগের দলীয় তরফ থেকে শুধুমাত্র দুর্ভিক্ষ পীড়িত মুসলমান জনসাধারণের জন্য ত্রাণ দেওয়া হয়। কমিউনিস্ট পার্টি শুধু লীগের সাহায্যপুষ্ট ত্রাণ সমিতির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখে, এবং এই সময় থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির তরফ থেকে শ্যামাপ্রসাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা শুরু হয়।
সরকারী সাহায্যের অপেক্ষায় না থেকে শ্যামাপ্রসাদ বেঙ্গল রিলিফ কমিটি গঠন করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের ত্রাণ। ২৪টি জেলায় ২২৭টি ত্রাণকেন্দ্র গড়ে ওঠে।
১৪ই জুলাই বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় এক বক্তৃতায় তিনি বলেন “বাংলাকে খাদ্যসরবরাহ করা সামরিক ব্যবস্থার মতই গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে মনে করতে হবে। কিন্তু উচ্চতর কর্তৃপক্ষ যদি এতে অসম্মত হন, তবে মন্ত্রীমন্ডলীর দায়িত্ব হবে সমস্ত দায়িত্ব পরিহার করে পদত্যাগ করা।”
১৯৪৩ সালের ২০ এবং ২৪ সেপ্টেম্বর শ্যামাপ্রসাদ কলকাতায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। সরকার শ্যামাপ্রসাদের বক্তৃতা সেন্সর করে।
১৯৪৪ সালে ব্রিটিশ সরকার এক অর্ডিন্যান্স জারি করে দুর্ভিক্ষ কমিশন গঠন করে।১০.০৪.১৯৪৫ এ প্রকাশিত এক রিপোর্টে সরকারের গাফিলতি স্বীকার করে নেওয়া হয়। শ্যামাপ্রসাদ এই রিপোর্টের অসঙ্গতি দেখিয়ে লেখেন, “দুর্ভিক্ষ হওয়ার কোন সংগত কারণ ছিল না। ব্রিটিশ সরকার,ভারত সরকার এবং মুসলিম লীগ সরকার পরস্পরের সহযোগিতা করে এটা ঘটিয়েছে।”
(ক্রমশ)…………………..