একটি সমাধি, কাটরা মসজিদ এবং হিন্দু নিধনের স্মৃতি চারণ

0
2967

-চয়ন মুখার্জী

 

ধরুন মাধ্যমিক চলছে। ইতিহাস পরীক্ষা। আপনার হাতে আধ ঘন্টা সময়, একটা বড় প্রশ্ন বাকি।
প্রশ্ন কী?!
– “ভারতের ইতিহাসে ১৮৫৭ সালের গুরুত্ব বিচার করো।”

আপনি একটু চোখ কুঁচকে কান চুলকে লিখে এলেন,
– “কলকাতার অমুক বাবু ওই বছরে তার পোষা বিড়ালের বিয়েতে চৌদ্দ লক্ষ টাকা খরচ করেছিলেন। সেরকম ধুমধাম বাঙ্গালার, ইয়ে ভারতের ইতিহাসে বিরল।”

কী ভাবছেন? লোকটার মাথাটা খারাপ হয়ে গেলো নাকি। আহা, ধৈর্য ধরুন না! আরেকটা প্রশ্ন।

পলাশীর যুদ্ধের গুরুত্ব কী?

আপনি লিখলেন,
– “পলাশীর আমবাগানে কয়েক বছর ধরে আমের ফলন ভালো হচ্ছিল না। অবশেষে সিরাজের আহ্বানে ক্লাইভের নেতৃত্বে একদল ব্রিটিশ আমবাগানে চাষ শুরু করে। পরের বছর থেকে এত আম ফলতে থাকে যে নবাব খুশি হয়ে তাদের আদ্দেক, ইয়ে সমস্ত রাজত্ব দান করে ফকির হয়ে হজ করতে চলে যান।”

জানি, এবার আপনি রেগে যাচ্ছেন। হাত নিশপিশ করছে, কাছে পীঠে যা আছে আমার মাথায় কত জোরে কোন এঙ্গেলে প্রজেক্টাইল মেপে ছুঁড়লে মোক্ষম আঘাত হবে, হিসাব কষছেন।

এবার আসল কথায় আসুন।

রাগছেন কেন? এরকমই কিছু ইতিহাস আপনি কি পড়েননি?

আপনি কি হাবিব সাহেবের সৌজন্যে স্কুল লেভেল টেক্সটবুকে পড়েননি যে, আরবরা ভারত আক্রমণ করায় ভারত-আরব সাংস্কৃতিক যোগাযোগ দৃঢ় হয়েছিল? যদিও সেই যোগাযোগে ভারত কী পেয়েছিল জানা নেই, এটুকু জানা আছে ভারতের গণিত, জ্যোতিষবিদ্যা কপি করে আরবরা ইউরোপে নিজেদের নামে চালিয়েছিল। তবু আমরা ধরে নিতেই পারি, আরবরা আসতেই ভারতীয়রা নাচতে নাচতে তাদের বরণ করেছিল, কোনো প্রতিরোধ করেনি, সিন্ধের রাজা দাহির মারা যাননি, তার বিধবা রাণী জওহরব্রত পালন করেননি।

এভাবেই আরো অনেক কিছু ধরে নিতে পারি। ৭১২ খ্রিস্টাব্দের আগে ভারতে ছিল অন্ধকারময় যুগ, তারপরেই যত আলো এসেছে। মুসলিম শাসকরা বিশেষ করে ফিরোজ তুঘলক, সিকন্দর শাহ, সিকন্দর বুৎশিকান, আওরঙ্গজেব প্রমুখ শাসকগণ ছিলেন পরধর্মসহিষ্ণুতার জনক। কোনো মন্দির ভাঙা হয়নি, কোনো হিন্দু মহিলা ধর্ষিতা হননি, দেবালয়কে বাঁচাতে প্রাণ দেননি কোনো ধর্মপ্রাণ হিন্দু..ইত্যাদি ইত্যাদি!

আহা আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম!!

এরকমই তো পড়ে এসেছেন মশাই, আপনি, আপনারা। তাহলে শুরুতে ওই সামান্য কয়েকটা লাইন দেখে চটে যাচ্ছিলেন কেন?!

নাকি আপনি জানেন, এবেলা চটে গিয়ে লাভ নেই। চটলেই আপনি হয়ে যাবেন ,সাম্প্রদায়িক, গোমূত্রখোর, হোয়াটস্যাপ ইউনিভার্সিটির ছাত্র, ‘চাড্ডি’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

“হীরক রাজার দেশে”- র সেই মন্ত্রীদের মতো আপনাকে ঘাড় নাড়িয়ে মাথা দুলিয়ে বলে যেতেই হবে- “ঠিক ঠিক। ঠিক ঠিক।”

কোনো প্রশ্ন নয়। নো কোয়েশ্চেন।

তবু দিনকাল ভালো নয়, বুঝলেন। আম্বানি আমাদের লুঠ করার আগে আমরা কত সস্তায় নেট পেতাম সবাই জানে। তবু জিও আসার পরে, কিছু বজ্জাত ছেলেমেয়ে হয়েছে যারা সবেতেই প্রশ্ন করে। প্রথাগত ইতিহাসকে তারা প্রশ্ন করে, কেন কীভাবে কী কারণে! রমেশচন্দ্র মজুমদার, যদুনাথ সরকারের বইগুলো তারা হেলাফেলা না করে, পড়ে আর পড়ে আসল ঘটনা।

আর জানতে গেলেই কি হয়? উপাধি জুটে যায়  “হোয়াটস্যাপ ইউনিভার্সিটির ছাত্র”।

আজ না হয় একটি মসজিদের ইতিহাস সম্পর্কে একটু জেনে নিন।

স্থান: মুর্শিদাবাদ জেলা। পশ্চিমবঙ্গ। কাটরা মসজিদ।
সাল: ১১৩৫ হিজরি সন।

মুর্শিদাবাদকে বাঙ্গালার রাজধানী হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন যিনি, সেই মুর্শিদকুলি খাঁ তখন বার্ধক্যের শেষ প্রান্তে।
দিনে দিনে স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে। অতএব ধর্মপ্রাণ নবাবের ফরমান এলো, সমাধি নির্মাণ করতে হবে। সেই সমাধিতে একটি মসজিদ কাটরা বা গঞ্জ স্থাপন করতে হবে।

দায়িত্ব পড়লো “মোরাদ ফরাস” নামের এক বিশ্বস্ত কর্মচারীর ওপর। নবাবের ফরমান বলে কথা, তিনি কাজে লেগে পড়লেন।

মুর্শিদাবাদ নগরের পূর্বদিকে, প্রায় আধ ক্রোশ দূরে জমি নির্ধারণ করা হলো। আর স্থির করা হলো, কাছাকাছি সমস্ত হিন্দু মন্দির ভেঙে তার উপকরণ দিয়েই মসজিদ নির্মাণ শুরু করা হবে।

১১৯২ খ্রিস্টাব্দ থেকেই যা হয়ে এসেছে আর কী! আজকালকার ঐতিহাসিকরা আবার তাকে “হিন্দু মুসলিম শিল্প সমন্বয়ের মহান দৃষ্টান্ত” বলে অভিহিত করে থাকেন।

এরকম মহান দৃষ্টান্ত দিয়েই কাজ শুরু হলো। মুর্শিদাবাদ থেকে তিন চারদিনের পথের মধ্যে একটিমাত্র মন্দিরও রক্ষা পেলো না। জমিদার ও অন্যান্য হিন্দুরা অর্থ প্রদান করে মন্দির বাঁচানোর প্রার্থনা করলেন, কিন্তু পাত্তা দেওয়া হলো না।

দূরবর্তী গ্রামের মন্দির ভাঙারও প্রস্তাব এলো। কিন্তু কাজটা বড্ড শ্রমসাধ্য বলে আবার হুকুম জারি হলো, যে সব হিন্দুরা অর্থপ্রদান করবে এবং মসজিদ নির্মাণের কাজে ভৃত্য সরবরাহ করতে পারবে, একমাত্র তাদেরই মন্দির রক্ষা পাবে। মানলে ভালো, না মানলে ওই যে আবার “হিন্দু মুসলিম শিল্প সমন্বয়ের মহান দৃষ্টান্ত” স্বরূপ আরেকটি মসজিদ মাথা চাড়া দেবে।

টানা এক বছর ধরে সেই কাজ চললো, ১১৩৭ হিজরি সনে মসজিদ নির্মাণ শেষ হলো। কথিত আছে মক্কার সুপ্রসিদ্ধ মসজিদের আদলে এই কাটরা মসজিদ নির্মাণ করা হয়। মসজিদের বুকে মাথা তুলে রইলো মিনার, চৌবাচ্চা ও ইঁদারা ।

১১৩৯ হিজরি সনে মারা গেলেন মুর্শিদকুলি খাঁ। তার আদেশ এবং ইচ্ছানুযায়ী প্রবেশ পথের সিঁড়ির নীচে একটি ছোট প্রকোষ্ঠে তাকে সমাহিত করা হলো।

আমার কথাটি ফুরালো, নটে গাছটি মুড়ালো..

না না দাঁড়ান। এখনো কথা বাকি আছে।

কয়েকদিন আগেই, ফেসবুকে নিউজ ফিডে চোখে পড়লো, এক বেসরকারি রেডিও চ্যানেলের জকি একটি সিরিজ লিখতে শুরু করেছেন, “বাঙ্গালার মসজিদ”!

খুবই ভালো কথা।

তিনি সিরিজ শুরু করেছেন এই কাটরার মসজিদ দিয়ে। আর লেখার শেষে তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন যে মন্দির ভেঙে কাটরা মসজিদ গঠন করার কাহিনী সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানানো।

অথচ এই সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে তিনি কোনো যুক্তিই দেননি। আর্কিমিডিসের মতো ‘ইউরেকা ইউরেকা’ বলতে বলতে সমাধান খুঁজে পেয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, আমাদের কৃতার্থ করেছেন।

আমরা তো আর্কিমিডিস নই, আমরা তথাকথিত হোয়াটস্যাপ ইউনিভার্সিটির ছাত্র।

তবু আমরা পক্ষে বিপক্ষে অবশ্যই কয়েকটি যুক্তি প্রতিযুক্তি নিয়ে আলোচনা করে নেবো।

প্রথম কথাঃ মোরাদ ফরাস অত্যাচারী ছিলেন একথা অস্বীকার করতে গেলেও একটু ঢোঁক গিলতে হবে। কারণ মুর্শিদকুলি খাঁর জামাই তথা পরবর্তী নবাব সুজাউদ্দিন মোরাদ ফরাসকে প্রাণদণ্ড দিয়েছিলেন এবং যে কারণে প্রাণদণ্ড দি য়েছিলেন, তা হলো “অত্যাচার। নিষ্ঠুরতা।”

হেঁ হেঁ।

দ্বিতীয় কথাঃ মোরাদ ফরাসকে মসজিদ নির্মাণের জন্য সময় দেওয়া হয়েছিল এক বছর। মাত্র এক বছর। ভারতের আর কোনো প্রসিদ্ধ শিল্পকীর্তি এক বছরের মধ্যে নির্মিত হয়েছে, এরকম উদাহরণ আছে কি?
মোরাদ তো ম্যাজিক জানতেন না। অতএব এক বছরের মধ্যে নতুন করে পাকা ইঁটনির্মিত মসজিদ নির্মাণ অসাধ্য, একথা তিনি ভালোভাবেই জানতেন। অতএব নিকটবর্তী হিন্দু মন্দিরগুলি ভেঙে মসজিদ গড়ার পরিকল্পনা তার মাথায় প্রথম থেকেই ছিল। নচেৎ এক বছরের মধ্যে মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা তিনি করতেন না।

নবাবকে তিনি কথা দিয়েছিলেন, এক বছরের মধ্যে ঈপ্সিত মসজিদ নির্মাণ করে দেবেন, কিন্তু তার কাজে নবাব যেন কোনো বাধা প্রদান না করেন।

স্বাভাবিকভাবেই নবাব কোনো বাধা দেননি।
হেঁ হেঁ।

তৃতীয় কথাঃ যে মুসলিম ঐতিহাসিকের গ্রন্থে প্রথম এই মন্দির ভাঙার কথা লিখিত হয়, তার নাম “তারিখ – ই – বাঙ্গালা”, তার ইংরেজি অনুবাদ করেন গ্ল্যাডস্টোন। এই বই থেকেই মন্দির ভাঙার বিবরণটি ঐতিহাসিক স্ট্যুয়ার্ট নিজের বইতে উল্লেখ করেন।

একমাত্র যে ঐতিহাসিক এই মন্দির ভাঙার ঘটনার বিপক্ষে লিখেছেন তিনি হলেন বিভারেজ। তাঁর প্রশ্ন, প্রচলিত ইতিহাসে মুর্শিদাবাদ থেকে ৪ ক্রোশ দূরে সমস্ত হিন্দু মন্দির ধূলিসাৎ করে দেওয়ার কথা বলা হলে, মুর্শিদাবাদ থেকে এক ক্রোশ দূরে কিরীটেশ্বরী মন্দির টিঁকে গেলো কীভাবে? “The Tale in its original form, is even more preposterous, for in Gladwin’s translation of the Mahammadan narrative and in Stewart, the prohibitory distances given as gour day’s” ( Calcutta Review, October 1892)

এর উত্তরে একথাই বলা যায় যে, কিরীটেশ্বরী মন্দির ছিল তৎকালীন মুর্শিদাবাদের শ্রেষ্ঠ হিন্দুতীর্থ এবং এর জন্যে বাঙ্গালার রাজস্ব বিভাগের প্রধান কর্মচারী বঙ্গাধিকারী কানুনগোর ছিল বিশেষ সম্পর্ক। তাই মোরাদের মতো এক নিম্নশ্রেণীর কর্মচারী তাঁকে চটিয়ে কিরীটেশ্বরী মন্দির ভাঙার দুঃসাহস দেখাতে পারেনি।

সবশেষে বলি, এই লেখার উদ্দেশ্য কোনো সাম্প্রদায়িক অস্থিরতাকে জাগিয়ে তোলা নয়, বরং রমেশচন্দ্র মজুমদার “বাঙ্গালার ইতিহাস”- এর দ্বিতীয় খণ্ড লিখতে গিয়ে তার ভূমিকায় যা লিখেছিলেন, তার যথাযথ পালন করা। একজন ঐতিহাসিকের দায়িত্ব কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক চাপের কাছে নতিস্বীকার না করে শুধু সত্যকে তুলে ধরা, সে সত্য যতই অপ্রিয় হোক না কেন, প্রচলিত জনপ্রিয় মতবাদের যতই বিপক্ষে যাক না কেন! প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়ে তারপরে ঘটনাকে সেই মতো বিশ্লেষণ করা ঐতিহাসিকের কাজ নয়, বরং ঘটনার যথাযথ বিশ্লেষণ করে সত্যকে উন্মোচন করাই একজন ঐতিহাসিকের দায়িত্ব।

আমি এখনই দাবী করছি না যে, ভারতে যত মন্দির ভাঙা হয়েছে তার আবার পুনর্নির্মাণ করা হোক। কারণ মন্দির ভাঙার ইতিহাস এতটাই দীর্ঘ যে, তা করতে হলে ভারত সরকারের দেউলিয়া হয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।

আমরা শুধু চাই যে প্রকৃত সত্য জানা হোক, জানানো হোক। আমাদের শান্তিপ্রিয় ভ্রাতাগণ তা জেনে ভবিষ্যতে এরকম কাজকর্ম থেকে বিরত থাকুন এবং তোষণের আশা ছেড়ে তার হিন্দু প্রতিবেশীদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে এই দেশ গঠনের কাজে ব্রতী হোন।

তথ্যসূত্রঃ

১. কাটরার মসজিদ – জাহানকোষা তোপ
২. ভারতী ১৩০৩ চৈত্র
৩. তারিখ-ই- বাঙ্গালা
৪. মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, দ্বিতীয় খণ্ড, দেজ পাবলিকেশন – কমল চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত।

মতামত লেখকের, বঙ্গদেশ পত্রিকা এর জন্য দায়ী নয়।