পঞ্চম অধ্যায় – পূর্বপক্ষ

0
855

অনুবাদক: বৈষ্ণবাচারী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

জরাসন্ধের গৃদ্ধকূটে আগমনের ঠিক দশ দিন পর, ঋষি চন্দ্রকৌশিক গিরিব্রজে এলেন কাকভোরে। তিনি গিরিব্রজে তাঁর এক শিষ্যের গৃহে থাকবেন। জরাসন্ধ তাঁর মুখ্য আমাত্য কান্তিবর্ধনকে প্রেরণ করলেন ঋষিকে রাজপরিবারের আতিথ্য গ্রহণের অনুরোধ করে। চন্দ্রকৌশিকের তেমনটা ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু কান্তিবর্ধন তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে তিনি রাজাকে কৃষ্ণ নামক গো-পালকটির উপর পূর্বপক্ষ (শত্রুর দৃষ্টিভঙ্গি) সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করার কথা দিয়েছেন। কান্তিবর্ধন বললেন যে পূর্বপক্ষ সম্পন্ন করতে বহু সময় লাগবে। সেজন্য রাজপরিবারের আতিথ্যগ্রহণই সুবিধাজনক হবে, মুখ্য আমাত্য করজোরে বললেন। পরিশেষে, ঋষি নিমরাজী হয়ে রাজপ্রাসাদে আশ্রয় গ্রহণ করলেন।

সৎসঙ্গ শুরু হবে সন্ধ্যাকালে। ঋষি পূর্বপক্ষকে এক ধার্মিক অনুষ্ঠান হিসাবে মনে করেন। তাই রাজাকে মহারাণীর সঙ্গে আসতে হবে কারণ সনাতন পরম্পরায় যজমান পতি-পত্নী উভয়ের উপস্থিতি বিনা কোন অনুষ্ঠান অসম্ভব। ঋত বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চালিকা শক্তির প্রকাশই হল ধর্ম। ধর্মের প্রকাশ শিব আর শক্তির মাধ্যমে। তাই ঋতের প্রকাশের জন্য অনুষ্ঠানে নর আর নারী উভয়কেই কর্মী হিসাবে ভাগ নিতে হবে।

ঋষি কাষ্ঠনির্মিত অনুচ্চ আসনে মৃগচর্ম বিস্তার করে পদ্মাসনে আসীন হলেন। তাঁর দক্ষিণ হস্ত তাঁর দণ্ডোপরি রক্ষিত। চতুর্থ প্রহরে সন্ধ্যার পর মহারাজ আর মহারাণী এই কক্ষে আনীত হলেন। কক্ষে একটি মাত্র দীপ বিদ্যমান। রাজদম্পতি প্রবেশ করে ঋষিকে প্রণাম করলেন, তারপর ভূমিতে একটি চাটুর উপর বসলেন। রাজদম্পতি ঋষির অনুমতিতে সুখাসনে বসলেন।

“রাজন্, কংসের পত্নীদেরকে ডাকো। এই কথা তাদের শোনা তোমার চেয়েও বেশি প্রয়োজন। গল্প বলতে লাগবে এক পক্ষকাল। তোমাকে সবসময় মনে রাখতে হবে যে আমি কৃষ্ণকে অদ্ভূত প্রতিভাসম্পন্ন এক মানুষ মনে করি যিনি অধর্মকে জগৎ থেকে নির্মূল করতে সক্ষম। তাই তোমার কর্তব্য, এই কথার সময় কোন ক্রোধ প্রদর্শন না করা। আমার শর্ত এই যে যদি তোমার দৃষ্টিতে আমি কখনও ক্রোধের আভাষ পাই, তবে আমি আমার কথা সেই মুহূর্তে বন্ধ করব। তোমার পূর্বপক্ষ অসমাপ্ত থেকে যাবে।”

অস্তি আর প্রাপ্তি এসে চাটুতে বসলেন। ঋষি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা শুরু করলেন,

ওঁ পূর্ণমদঃ

ওঁ পূর্ণমিদম্

পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে

পূর্ণস্য পূর্ণমাদায়

পূর্ণমেবা বশিষ্যতে।

এরপর তিনি কৃষ্ণের স্তুতি আরম্ভ করলেন আর রাজা আর রাণীর দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে দেখতে লাগলেন।

বসুদেব সুতং দেবং, কংসশ্চানুর মর্দনম্।

দেবকী পরমানন্দং, কৃষ্ণং বন্দে জগদ্গুরুম্।।

জরাসন্ধ ক্রোধে জর্জরিত। তাঁর জামাতা কংস এবং তাঁর প্রিয় যোদ্ধাদের অন্যতম চানুরের হত্যাকারীকে এই শ্লোকটি মহিমান্বিত করছে। চানুরও তাঁর ছেলের মতই ছিল। আপন পুত্র সহদেবের সঙ্গে তিনি তাকে বড় করেছিলেন যদিও সে ছিল সহদেবের চেয়ে বয়সে অনেক বড়। সে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী মল্লযোদ্ধা ছিল। জরাসন্ধেরও প্রিয় ক্রীড়াই হল মল্লক্রীড়া। পাঁচ হাজার মল্লযোদ্ধাকে ক্রীড়াঙ্গনে অদ্যাবধি তিনি হারিয়েছেন। রাজ্যজয়ের তাঁর এক কৌশলই হচ্ছে মল্লযুদ্ধ। একটিও তীর না চালিয়ে, মল্লযুদ্ধের দ্বারা তিনি একের পর এক রাজ্য জয় করেছেন। একের পর এক রাজ্যজয়ের সঙ্গে সঙ্গে তীব্র হয়েছে তাঁর অভিমান। তিনি শিবতাণ্ডব স্তোত্র উচ্চারণে পারদর্শী। বহু লক্ষবার অনায়াসে উচ্চারণ করতে পারেন এই মন্ত্র। তিনি শ্রেষ্ঠ শিব ভক্ত হিসাবে পরিচিত এই মন্ত্রজপের সূত্রেই।

তাঁর শিবভক্তির লক্ষ্য আপন কামনাপূরণ। আর্যাবর্তের অপ্রতিদ্বন্দ্বী সম্রাট হওয়াই তাঁর কামনা। তাঁর পুরোহিতরা তাঁকে বলেছেন যে এর জন্য প্রয়োজন এক নরমেধ যজ্ঞের যাতে একশত রাজার মস্তক আহুতি হিসাবে দিতে হবে। এর ফলে নিশ্চিত হবে তাঁর অমরত্ব। এই লক্ষ্যই তাঁর মদিরা স্বরূপ। আপন অহংমত্ততা তাঁকে ভুলিয়ে দিয়েছে মানব ধর্মের কথা যা তাঁকে ঋষি চন্দ্রকৌশিক এককালে শিখিয়েছিলেন।

ঋষি মন্ত্রোচ্চারণ প্রায় এক ঘটিকা (২৪ মিনিট) ধরে করলেন। দেখে মনে হবে তিনি সমাধি মগ্ন। কিন্তু তাঁর অন্তরে ধরা পড়ছে শ্রোতৃবৃন্দের অভিব্যক্তি। শ্রোতা উপরে শান্তভাবে বসে থাকলেও তলে তলে ফুটছেন। মন্ত্রোচ্চারণের পর ঋষি আবার রাজাকে আপন বাক্যের দ্বারা উত্তক্ত করলেন।

“জরাসন্ধ, মথুরার সঙ্গে তোমার যুদ্ধের থেকে আমি কোন ভালো কিছু দেখতে পাচ্ছি না। কৃষ্ণকে গুরু হিসাবে পূজা করা উচিত, প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে দেখা উচিত নয়। সব গুরুই তাঁর মত শিষ্যকে খোঁজেন যাতে তাঁরা নিজেদের অধীত বিদ্যা সফলভাবে শেখাতে পারেন এবং তার থেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়মকে বুঝতেও পারেন। যদি তুমি নিজের মত বদলাও, তবে আমাকে জানিও। আমি আঙ্গিরসদের বলতেও পারি যাতে তোমার সুমনোভাব তাকে জানায়।”

জরাসন্ধ করজোড়ে ঋষিকে বললেন, “গুরুদেব, আমি আপনাকে অনুরোধ করছি যে আপনি কৃপা করে আপনার কথা শোনার সুযোগ আমাদের দিন।”

“ঠিক আছে, জরাসন্ধ,” ঋষি বললেন। “তোমার মনের সমভাবে আমি প্রসন্ন হয়েছি। যে কোন কাজে সম্পূর্ণ স্থিরমতিত্ব এবং সমভাব না থাকলে সুপরিণাম দুষ্কর।”

ঋষি তাঁর পূর্বপক্ষ শুরু করার জন্য মানসিক ভাবে যখন থিতু হয়ে আসছেন, তখন বাইরে প্রচণ্ড বিশৃঙ্খলা শুরু হল। জরাসন্ধ চারিদিক নিরীক্ষণ করে প্রহরীকে ইঙ্গিত দিলেন বাইরে কি হচ্ছে জানাতে। প্রবল বেগে পবন গর্জন শোনা গেল। গিরিব্রজ এক কুজ্ঝটিকার সম্মুখীন। চারিদিক থেকে পাহাড় পরিবেষ্টিত বলে সাধারণতঃ ঝড় গিরিব্রজকে তেমন কাবু করতে অক্ষম। কিন্তু গিরিবেষ্টনীর ফাটল দিয়ে পবনদেবের প্রবেশে তো সমূহ বিপদ। কুজ্ঝ্বটিকা একান্তই বিরল নয় এবং সেক্ষেত্রে পবনদেব ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন চতুর্দিকে প্রভূত পরিমাণে রেখে যান। আজ কি সেই রকমই এক দিন? সেক্ষেত্রে মহারাজকে উদ্ধার কার্যের প্রস্তুতি নিতে হবে। পরবর্তী যুদ্ধের দিকে মনোযোগ দেওয়া হবে অসম্ভব।

কংস তো কেবল জরাসন্ধের জামাতাই নন, উপরন্তু তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধুও। চেদিকে কংসের সঙ্গে বন্ধুত্ববন্ধনে জোড়ার কাজে অগ্রণী ছিলেন তিনিই। ভীষ্মের হাতে পূর্বে তিনি যে অপমানিত হয়েছিলেন, সেই যন্ত্রণা থেকে তিনি হয়েছিলেন হস্তিনাপুরের বৃহত্তম শত্রু। ক্ষত্রিয় মর্যাদা রক্ষায় এই অপমানের প্রতিশোধ নিতে তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর। মথুরা তাঁকে পদসঞ্চালনের সেই ভূমিটুকু দিয়েছিল। হস্তিনাপুরের সঙ্গে ভবিতব্য যুদ্ধে মথুরা হত তাঁর চাবিকাঠি। যাদবদের বিকেন্দ্রীকৃত সামরিক বাহিনী নিয়ে কংস ছিলেন প্রচণ্ড বিরক্ত। কংস ক্ষমতা দখল করার আগে মথুরা ছিল একটি গণরাজ্য। শক্তিশালী রাজা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পরও মথুরার পুরানো সেই সামরিক ব্যবস্থার পরিবর্তন হয় নি। আঠারোটি গোষ্ঠীর দ্বারা প্রতিজ্ঞিত সামরিক বাহিনীই ছিল মথুরার সেনাবাহিনী। সেই সেনাবাহিনীতে কোন কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার উৎস কেউই ছিল না। এর ফলে সামরিক বাহিনীকে কংস নিজের মতাদর্শে দীক্ষিত করতে পারতেন না। জরাসন্ধও নিজের এক অনীকিনী সৈন্য মথুরায় পাঠিয়েছিলেন যাতে কংসকে সুরক্ষার পাশাপাশি তাঁকে সৈন্যবাহিনী গড়ে তুলতে সাহায্য করা যায়। জরাসন্ধের নিজের সৈন্যবাহিনী ছিল এর ঠিক বিপরীত – তাঁর আজ্ঞাবহ এবং আধুনিক। গিরিব্রজ নগরের বাইরে রক্ষিত বাহিনী এক সেনানায়কের অধীনে পরিচালিত হত। সর্বোচ্চ সেনাকর্তা ছিলেন জরাসন্ধ স্বয়ং।

ইত্যবসরে মগধমাদন কক্ষের ভিতরে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। জরাসন্ধ ঋষি চন্দ্রকৌশিকের মুখের দিকে দৃষ্টি রাখলেন। ঋষির মুখে শোভা পাচ্ছে রহস্যময় মৃদুহাস্য।  ঝঞ্ঝায় প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জরাসন্ধ সংশয়াকীর্ণ হলেন। তাঁর রাজধর্ম বলে তাঁকে জনতার সাহায্যে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় অগ্রসর হতে, উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যের নিরীক্ষণ করতে। অন্যদিকে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে ঋষির মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে। তিনি কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য পাবেন এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যাতে তিনি জয় করতে পারেন তাঁর শত্রুকে যাকে তিনি মন-প্রাণে ঘৃণা করেন। তিনি উৎসুক ভঙ্গিতে ঋষির দিকে তাকালেন, কিন্তু ঋষি শুধুই মৃদু হাসিমুখে বসে থাকলেন, তা হয়ত বা জরাসন্ধকে পরীক্ষা করার জন্যই।

জরাসন্ধ সৌদামিনীর দিকে চাইলেন কোন ইঙ্গিতের জন্য। কিন্তু মগধরাজ্ঞী বোধকরি এ জগতে নেই, ধ্যানমগ্না। রাজপুত্রীরাও হয়ত ঋষির সামনে মোহিত। কেবল রাজাই এই কঠিন সমস্যায় জর্জরিত।

আচার্য চন্দ্রকৌশিক আবার স্মিতহাস্যে বললেন, “জরাসন্ধ, যতদিন কেউ তোমার বাল্যকালের শল্যচিকিৎসা সম্বন্ধে জানতে না পারছে, ততদিন তুমি নিরাপদ থাকবে। তুমিও এ সম্বন্ধে জানো না। আজ আমি এই তিন নারীর সামনে আমি এই কথা প্রকাশ করলাম। এখন থেকে তোমার জীবন নির্ভর করবে সৌদামিনী, অস্তি আর প্রাপ্তির উপর। তুমি মল্লযুদ্ধে অজেয় যদি না কেউ তোমাকে শল্যকৃত শরীরাঙ্গের উপর চাপ দিয়ে মুচড়ে না ফেলে। আমি তোমাকে আজ একথা জানালাম তোমার কোন শত্রু এ সম্বন্ধে জানার আগে। তোমার এই শত্রুটি কিন্তু নারীদের মন মোহনে অসম্ভব পটু। তাই সবসময় দৃষ্টি রেখো যেন এই তিন নারীর কেউই যেন তার মায়ার বশীভূত না হয়।”

জরাসন্ধ ভয় পেলেন। এই কক্ষে আসা অবধি ঋষি তাঁর শত্রুর প্রশংসাই করে যাচ্ছেন।

জরাসন্ধ হাস্যমুখী ঋষির দিকে নিরীক্ষণ করলেন। তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।

“আচার্য, পূর্বপক্ষ শুরু করুন।”

(ক্রমশ)

 

মূল গ্রন্থ: Krishna Gopeshvara (2018)

অঙ্কনশিল্পী: শ্রী জয়জিৎ কর

সৌজন্য: Bloomsbury India