সম্রাট ও সন্ন্যাসী

0
812

                                                                                                                                              – শ্রীমতী মায়া বসু

 

                                                                নৃপতি বিবস্বান –

প্রজাবৎসল সংযত চেষ্টা বড়ই ধর্মপ্রাণ।

ঘন অরণ্যে সারাদিন ধরে মৃগয়ায় অবশেষে

শ্রান্ত ক্লান্ত ফিরিতেছিলেন সন্ধ্যায় নিজ দেশে।

মাঝখানে তিনি শিবিকায়, আর সৈন্যেরা দুই দলে

আগে পিছে তাঁর অস্ত্রশস্ত্র শিকার লইয়া চলে।

কিছুদূর এসে পাত্রমিত্র চেয়ে দেখে বিস্ময়ে,

গভীর বনেতে এক সন্ন্যাসী সমাধিমগ্ন হয়ে

মুদিত চক্ষে পথের উপরে একা বসে যোগাসনে,

পরমারাধ্য ইষ্ট মন্ত্র জপ করে এক মনে।

 

ত্যক্ত চিত্তে অমাত্য এক তাঁর কাছে গিয়ে কয়,

“ধ্যান করিবার জায়গাটি বেশ পেয়েছেন মহাশয়।

দেখুন চাহিয়া, পিছনে শিবিকা, নিজে রাজা সমাসীন,

মাঝপথ ছেড়ে সরে গিয়ে তাঁকে যাইবার পথ দিন।”

শুনে সেই কথা, চক্ষু মেলিয়া যোগীবর তাকে কয়,

“তোমার রাজাকে বল, হেথা এক মহারাজা বসে রয়।

সহস্র কোটি জপ শেষ হবে না যতক্ষণ,

এক তিলও আমি নড়িব না জেনো, ছাড়িব না যোগাসন।”

 

শুনে তাপসের হেন্ নির্ভীক কথা,

পাত্রমিত্র, রাজার মনেও জাগিল চঞ্চলতা।

শিবিকা হইতে নামিলেন তিনি, বিচলিত অতিশয়

‘এতো বড় কথা বলে যে সাধক, সে তো সাধারণ নয়!’

প্রণমি তাপসে কহিলেন রাজা, “কে আপনি যোগীবর?”

মুনি বলিলেন, “তব প্রশ্নের পরে দিব উত্তর।

আগে বলো মোরে, তুমি কোন জন, কিবা তব পরিচয়?”

বলিলেন রাজা, “আমি অভাজন সাধারণ নর নয়।

রাজা বলে মোরে জানে এই দেশবাসী!”

শুনিয়া সাধুর অধরে ফুটিল ঈষৎ মধুর হাসি।

“রাজার উপরে মহারাজা আমি, এ কথাও জেনো তুমি,

রাজ্য আমার এ তিন ভুবন, এই অরণ্যভূমি।”

মৃদু হেসে রাজা প্রশ্ন করেন, “মহারাজা যদি হন,

সেনাসামন্ত অস্ত্রশস্ত্র তাহলে, কোথায় কোন?”

বলিলেন যোগী শির করি উন্নত –

“শত্রু থাকিলে সৈন্যে অস্ত্রে তবে প্রয়োজন হত।

এ জগতে মোর কোন শত্রুই নাই,

ও সব ঝামেলা – যন্ত্রণা জ্বালা, কিছুই রাখিনি তাই। “

 

পরাজিত রাজা তবু বলিলেন, “কোথা তব কোষাগার?

কোথায় প্রাসাদ, তোষাখানা আর অর্থের ভান্ডার?

কই রাজবেশ? কোথায় বা প্রজা? কোথায় সিংহাসন?

কমণ্ডলু আর কৌপীনে কেন ধুলি ‘পরে বসে রন?

শিশুর মতো সরল হাস্যে এবার বলেন যোগী,

“আমি সন্ন্যাসী হে মহারাজ, নহি তব সম ভোগী।

খরচ কোথায়? কি করিব টাকা দিয়ে?

কী করিব বলো কোষাগার আর অর্থের বোঝা বয়ে?

প্রজাগণ মোর ছাড়ায়ে রয়েছে সারাটি পৃথিবী ময়,

অরণ্যবাসী হিংস্র জীবেরা আমারে করে না ভয়।”

 

এই চরাচর অধিপতি আমি, এ মাটির সিংহাসন,

এর চেয়ে দামী কোন আসনেই নেই মোর প্রয়োজন।

এ মরদেহের সাজসজ্জার কতটুকু দাম আছে?

পরম রতন চিরসত্য সে লুকানো হৃদয় মাঝে।

তুমি তো জানোনা কত সম্পদে পূর্ণ এ বনতল,

কত স্রোতধারা, বৃক্ষ ও পাখি, কত ফুল কত ফল।

এর চেয়ে দামী আর কিছু আছে নাকি?

এ সাম্রাজ্য কোনও দিন রাজা, আমাকে দিবে না ফাঁকি।

 

আমার রাজ্যে চির প্রশান্তি, স্থায়ী রবে চিরদিন,

শত্রুর হাতে ধ্বংস হবে না, হবে নাকো ধুলি লীন।

তাই বলি শোন, তুমি যদি রাজা, আমি তবে মহারাজ,

বিলাস ব্যাসনে তুমি তো ব্যস্ত, ওতে মোর কোন কাজ?

 

তাই বসে এই ধুলার সিংহাসনে,

সারাদিন ধরে “তাঁকেই” যে আমি ডেকে যাই এক মনে।

সেই ‘একজন’ ছাড়া আমি আর শুনি নাকো কারও  কথা,

অন্য কাহারও আদেশ শুনিলে, পাই মনে বড় ব্যাথা।

 

সাধকের কথা শুনে শ্রদ্ধায় রাজা কর জুড়ি কন;

“অক্ষয় হোক হে প্রভু তোমার ধুলার সিংহাসন।

নড়িতে হবে না সরিতে হবে না, থাকে তুমি অবিচল,

পদব্রজেই আমি চলে যাব, লয়ে মোর দলবল। “

 

(কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৩ সালে দেব সাহিত্য কুটীরের পূজাবার্ষিকী “বিভাবরী” তে।)